প্রপার্টি বা সম্পত্তি বিষয়ক পাঠচক্রের আলোচনা

“প্রপার্টি বা সম্পত্তি” বিষয়ক আলোচনা মাঝে মাঝে ফাঁক দিয়ে অনিয়মিতভাবে চলে আসছিলো। গত বৃহস্পতিবারের পাঠচক্রে আগের পাঠ পর্যালোচনার খোঁজ খবর নিয়ে ফরহাদ মজহার প্রপার্টি বিষয়ে আলোচনার প্রসংগ তোলেন। জর্মান ইডিওলোজির সম্পত্তি বিষয়ক মার্কসের বয়ানের বরাত দিয়ে ফরহাদ মজহার সম্পত্তির গুরুত্ব পেশ করেন। তিনি বলেন: সম্পত্তি বিষয়টি তিনটি কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সম্পত্তি ব্যাপারটা আসলে কী? সম্পত্তি মানে এখানে ব্যাক্তিগত সম্পত্তির বিষয়। এটি বুঝতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যেকোনো লড়াই-দ্বন্দ্ব সম্পত্তি, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে ঘটে। ফলে আজকে কমিউনিজম, উম্মাহ, জিহাদ, ভক্তি- এই কথাগুলোর মানে বুঝা যাবে না সম্পত্তি বুঝা না গেলে। এর জন্য প্রথমত শনাক্ত করতে হবে যে কোনো বিশেষ ঐতিহাসিক কালপর্বে সম্পত্তির রূপ কী? ধরণ কী? কারণ সম্পত্তির কোনো সাধারণ রূপ নেই। সম্পত্তির কোনো সার্বজনীন বা স্থির ধারণা নেই। আমাদের দেশের কমিউনিস্টরা এবং তাদের অনুসারীরা এই ধারণাগত জায়গাটায় অস্পষ্ট। তারা এটা ধরতে পারে নাই। তারা হেঁটেছেন এর উল্টো পথে। এরপর, প্রসংগ ধরে তিনি লেনিনের রচনাবলী থেকে পাঠ করে শোনান- পার্টিগুলো যখন জমি সংক্রান্ত দাবি তোলে- দাবির ধরন দেখলে বুঝবো তারা কোন শ্রেণীর- একটি ধারা দাবি করেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষা করতে হবে। আসলে জমিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তি তারা যদি ধরে রাখতে চায়- তবে কী বলে রাখতে চায়, দাবিটা কী তাদের? সেদিক থেকে এই দেশে বামপন্থীরা কি তাদের দাবিটা তুলে ধরতে পেরেছে? মূলত তাদের দাবীটা কী? মওলানা ভাসানীর দাবীটা ছিলো। দাবী মূলত দুটি। এক- জমিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ধরে রাখবার দাবী। কৃষকের দিক থেকে এটি জরুরী। যেকারণে লেনিন তাদের ‘লাঙ্গল যার-জমি তার’ শ্লোগানকে কৌশলগত কারণে সমর্থন করেছেন। তবে অবশ্যই লেনিন এই দাবীকে নীতিগতভাবে সমর্থন করেন নাই। দুই. জাতীয়করণ। সে সময় প্রশ্নটা ছিলো, জমি থেকে মালিকানা তুলে দিলে কৃষকের কী উপকার হয় তাতে? লেনিনের কাছাকাছি একদল মনে করলেন- আমরা জমি কিনে নেবো। লেনিন তাতে বিরোধীতা করলেন। প্রসংগ টেনে লেনিন সমাজতন্ত্রের ধরন নিয়ে কথা ওঠালেন, সমাজতন্ত্র নানান রকমের। পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্র ও প্রোলেতারিয়েতের সমজাতন্ত্র। যেখানে প্রশ্ন থাকে ধনি আর গরিবের প্রভেদ কিভাবে দূর করা যায়, পেটি বুর্জোয়ারা মনে করেন, ধনী আর গরিব সকলের পক্ষেই সমান হওয়া সম্ভব। (আমাদের এখানে ৯০% পেটি বুর্জোয়া তাই মনে করেন। কিন্তু লেনিন বলেন অন্য কথা। লেনিন এটাকে সাপোর্ট করেননি। লেনিন প্রশ্নটাকে গোড়া থেকে নাড়া দিয়েছেন। লেনিন বলেন, যতোদিন পুঁজির শাসন, অর্থের শাসন উঠে যাবে না ততোদিনে শুধু জমির মালিকানা তুলে নিলেই এর সমাধান হবে না। ফলে এভাবে আমরা সকলকে সমান করার দাবি সমর্থন করি না। একইসাথে লেনিন কৃষকরা যে জমি চায় তারও বিরোধীতা করেন না। এটার দরকার আছে। লেনিন বলেন, কিন্তু তাতে মুক্তি আসবে না। কারণ মালিকানা বিলুপ্ত করলে আমলাদের কর্তৃত্ব তো আর বিলুপ্ত হচ্ছেনা। তাহলে জাতীয়করণের মধ্যে দুটি বিষয়। মালিকানা এবং দখল। ফলে কৃষকের দিক থেকে দখল মানে- মালিকানা লুপ্ত হলে কৃষক তার ততোটুকু অংশই পাবে যতোটুকু সে তার উৎপাদনের মধ্যে অবদান রাখে। সেকারণে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে কৃষকরা যে দাবিটা তোলে সেটা হলো, বিপ্লবীরা জমি জাতীয়করণের মাধ্যমে জমিকে কৃষকের কাছে হস্তান্তর করবে। লেনিন বলেন কৃষকের কাছে এই হস্তান্তর মালিকানা আকারে নয়। উৎপাদন আকারে। উৎপাদনে অংশগ্রহণের ভিত্তিতে। কিন্তু মার্কসের চিন্তার আলোকে মূলত কমিউনিস্টদের কাছে প্রশ্নটি ছিলো সাধারণভাবে নয়, ঐতিহাসিকভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিশেষ রূপকে উৎখাত করা। যদিও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে ব্যক্তিগত মালিকানা জমি থেকে উঠে গেলেও শিল্প-কারখানার ক্ষেত্রে থেকে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে একাত্তরে ঘটেছে এর উল্টোটা। ফলে আজকের দিনে সম্পত্তির বিশেষ রূপটি কী? এটা বুঝতে পারাটা অসম্ভব কাজের বিষয়। তার রূপ কী? এবং কিভাবে তা হাজির আছে এটা বুঝতে হবে প্রথমে। জর্মান ইডিওলোজি থেকে পাঠ করে শোনান কামাল। এরপর ফরহাদ মজহার ‘ক্যাপিটাল’ রচনার আগে মার্কসের লেখা খসড়া নোট নামে পরিচিত ‘গ্র“নডিস’ থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ পাঠ করে সম্পত্তির সাথে ব্যক্তির সম্পর্কের প্রসংগ তুলে বলেন- ব্যক্তি আগে হাজির হয়ে গেছে এমন অনুমান মার্কস করেন না। তাঁর অনুমান আগে কম্যুনিটি। সম্পত্তি মূলত উৎপাদনের যে কণ্ডিশানগুলো হাজির তার সাথে মানুষের বা শ্রেণীর সর্ম্পকের দিক থেকে বিচার্য। মানুষ (কম্যুনিটি) যেমন আছে তেমনি সম্পত্তিও একইভাবে একটা গীভেন বা প্রদেয় ব্যাপার। জন্ম হবার সাথে সাথে সে সম্পত্তির মধ্যে ঢুকে যায়। অর্থাৎ মানুষ এবং সম্পত্তি সমবয়সী। একই সময়ে হাজির। এটা প্রাকৃতিকভাবে হাজির। সে এই সম্পর্কগুলো তার সামনে হাজির আকারে পায়। কিন্তু আসলে প্রাকৃতিক নয়। কণ্ডিশান মানে উৎপাদনের পরিস্থিতি। এটা খুবই গভীর একটা বিষয়। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এটা যেমন না বোঝার কারণে কমিউনিস্টরা ব্যর্থ হয়। ফলে এটা বুঝতে হলে বুঝতে হবে- উৎপাদনের শর্ত, উপায় এবং সম্পর্ক। মূলত মানুষ এই সম্পর্কগুলো পায় পূর্বানুমানগতভাবে। এই সম্পত্তি আসলে নিজেরই স¤প্রসারণ। ফলে আদিতে সে একদিকে সাবজেক্ট। অন্যদিকে নন অরগানিক সত্ত্বা। জমির সাথে তার সম্পর্ক হয় একটা মধ্যস্থতায়। সেটা তার কম্যুনিটি ও মাটির সাথে তার সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ঘটে। তাহলে কম্যুনিটির মধ্যে প্রপার্টি অন্তর্ভুক্ত থাকে। তাই যদি প্রপার্টিকে একটি সচেতন ক্রিয়া আকারে বিচার করি এবং সম্পত্তিকে আইনের দ্বারা নির্ণয় করি তবে মালিক যখন উৎপাদন করে তখন এই উৎপাদনের বিষয়টি তার সামনে হাজির হয়। আসলে ভোগ, উৎপাদন এইগুলো আইনের ব্যাপার নয়। এর সাথে আমাদের যে সক্রিয় সম্পর্ক- সেটাই বিষয়। এখানে এই উৎপাদন সম্পর্ক পরিবর্তনশীল। এই সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সে যে নিজেকে পুনরুৎপাদন করে এটাও সম্পত্তির সাথে সম্পর্কিত। ‘সম্পত্তির আদি উৎস ঘটে বলপ্রয়োগের ভিত্তিতে’। এরকম একটা সাধারণ আলোচনা জারি আছে। যেমন মানুষ আগে পশু ধরতো। এরপর তারা মানুষ ধরা শুরু করলো। অর্থাৎ মানুষ মানুষকে ধরে দাস বানাতো। মানুষের উপর মালিকানা, প্রভুত্ব কায়েম করতো মানুষ। এভাবে সম্পত্তি ও মালিকানার চল শুরু হয়। মার্কস এই রকম শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সম্পত্তির উৎপত্তির ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে নাকচ করে দেন। মার্কস বলেন। এরকম বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সম্পত্তির ধারণা এটা আসলে একটা স্টুপিডিটি। উল্লেখ্য, এই আলোচনায় আরো অনেকে ফরহাদ মজহারের সাথে অংশ নেন। সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার বাদ মাগরিব পাক্ষিক চিন্তার নিয়মিত পাঠচক্র এইভাবে আরো গম্ভির, তাৎপর্যময় আরো বিতর্কে মুখর হয়ে ওঠে। দর্শন, রাজনীতি, ধর্ম, চিন্তা-তৎপরতা ও সমসাময়িকতার নানান প্রসংগে এই পাঠচক্র আগ্রহী সবার জন্য উন্মুক্ত।


নিজের সম্পর্কে লেখক

student



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।