'স্মৃতির শহর' ঢাকা: ছবিতে ও অক্ষরে

ঢাকা সম্মেলনের দিকে যাবার লক্ষ্যে প্রতিপক্ষের দ্বিতীয় উদযাপন পর্ব প্রধানত ফটোগ্রাফি বা স্থিরছবির সাহিত্যচর্চা কেন্দ্র করে। আশা করি সবাই আসবেন আজ, এগারো জানুয়ারি, রোববার, বিকাল সাড়ে চারটায়। স্থান বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্র। বিষয়: ‘স্মৃতির শহর’ ঢাকা: ছবিতে ও অক্ষরে’

যেভাবে আমরা এখন ‘সাহিত্য’ কথাটা আক্ষরিক বুঝি, সেই দিক থেকেও আলোচনা হবে। আলোচনা হবে সিনেমার দিক থেকেও – প্রথম পর্বে ‘পিঁপড়াবিদ্যা ও নতুন সিনেমার সম্ভাবনা’ অনুষ্ঠানটিতে যেমন আমরা করেছি। তবে এবার ক্যামেরা আমাদের বিশেষ আগ্রহের বিষয়। ফটো তোলার মধ্য দিয়ে ‘সাহিত্য’ অর্থাৎ সকলের সঙ্গে সম্পর্ক রচনা ও বিরাজ করবার বাসনা কিভাবে চর্চা করছেন আমাদের ফটোগ্রাফাররা সেই দিকটিতে সবার নজর আকর্ষণ আমাদের ইচ্ছা। বলাবাহুল্য এটা সাহিত্যের একমাত্র বা শেষ সংজ্ঞা নয়। বিশেষ একটি টেকনলজির সঙ্গে সাহিত্য কথাটা ঐতিহাসিক কারনে যুক্ত হয়ে পড়ায় সাহিত্যকে টেকনলজির বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করা জরুরী হয়ে পড়েছে। নইলে মুদ্রণযন্ত্রের আতিশয্য সাহিত্যের বিস্তৃত পরিসরকে সংকীর্ণ করে রাখবে। অন্যদিকে ফটোগ্রাফার, চিত্রশিল্পী, সিনেমা নির্মাতা, নাটক ইতুদি মাধ্যমে যারা কাজ করছেন তাদের ঐক্যের জায়গাগুলো অস্পষ্ট হয়ে পড়বে। কলম ( নাকি কী বোর্ড!), ক্যামেরা, তুলি কিম্বা মঞ্চ যে বিভাজঙ্গুলো করে সেটা সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য বা চরেত্রের জন্য যতোটা তার চেয়ে অনেক বেশী মাধ্যম বা হাতিয়ারের ফারাকের জন্য। এই দিকটা এতোই স্পষ্ট যা আমার দেখেও দেখি না। প্রতিপক্ষ সেই দিকে নুর ফেরাতে চাইছে সবার।

স্মৃতি এক দারুন জিনিস। আলোচনা সুনির্দিষ্ট করতে গিয়ে স্মৃতির কথা এসেছে। ফটোগ্রাফি কিভাবে স্মৃতিচারণ করে? ধরুন ঢাকাকে নিয়ে? আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে পুরান ঢাকাকে নিয়ে? আর যদি এই স্মৃতিচারণের অনুপ্রেরণা আসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আর শহিদুল জহিরের সাহিত্য থেকে? তাহলে সাহিত্য কিভাবে ফটোগ্রাফিকে অনুপ্রাণিত করে সেই দিকটার প্রতিও আমাদের আগ্রহ জাগতে পারে। সিনেমা গল্প বা উপন্যাসকে সিনেমা বানায়, এটা আমরা জানি। ফটোগ্রাফিও সেই কাজ করে বা করতে পারে, খবর হিসাবেও সেটা আমাদের কাছে পৌঁছায় নি। তাই না? সে কারনে প্রতিপক্ষের উৎসাহ।

অন্যদিকে সিনেমাও বা কিভাবে ঢাকাকে মনে রেখেছে বা মনে রাখবার চেষ্টা করেছে। ধরুন খান জয়নুলের ‘তেরো নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’ ছবিতে। এই যে বিভিন্ন মাধ্যম বা টেকনলজি তাদের নিজ নিজ কৃৎকলা ও আঙ্গিকের জায়গা থেকে ঢাকা শহরকে ভাবছে, মনে রাখার চেষ্টা করছে – সেই দিকে সবাইকে যথাসাধ্য উৎসাহিত করবার এই চেষ্টা । মূল কথা হচ্ছে সাহিত্য কোন বিশেষ টেকনলজি – বিশেষত ছাপাখানার – একচেটিয়া না। প্রতিটি টেকনলজি বা মাধ্যম যা চর্চা করে তা সাহিত্য ছাড়া ভিন্ন কিছু না। যদি ‘সহিত’ থেকে সাহিত্য কথাটার তাৎপর্য আমরা কদর করি, তাহলে এ কথা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা না। তবে কলোনিয়াল অভ্যাসে ইংরেজি ‘লিটারেচার’ শব্দটির অনুবাদ হিসাবে আমরা ‘সাহিত্য’ বুঝি তাহলে আমাদের কথা বুঝতে একটু থমকাতে হবে। ইংরেজ তো গিয়েছে অনেক কাল হোল। এবার নিজেদের মত করে চিন্তা করবার জায়গাগুলো তো পরিচ্ছন্ন করা দরকার। এটাই আমরা বলতে চাইছি।

কিভাবে সাহিত্য চর্চা করছেন আমাদের ফটগ্রাফাররা? এই প্রশ্ন তুলে ছাপলেই সেটা ‘সাহিত্য’ হয় এই ধারণা ভাঙবার পথে আরেক ধাপ এগিয়ে যেতে চাইছে প্রতিপক্ষ। ‘সাহিত্য’ সংক্রান্ত ধারণাকে আরও বৃহৎ কাণ্ড জ্ঞান করে আরও বিস্তৃত পরিসরে ভাববার জন্য এই ভাঙাভাঙির আয়োজন। ‘সাহিত্য’ সম্পর্কে আমাদের চিন্তা বড় দীর্ঘকাল বৃদ্ধ পাথরের মতো স্টোন হয়ে গিয়েছে, একে ভাঙা দরকার।

এই প্রশ্ন তোলার মধ্য দিয়ে সাহিত্যের সঙ্গে টেকনলজির সম্পর্ককেও আমরা বিচারের মুখে সামনে আনতে চাইছি। টেকনলজির প্রবল ও প্রকট প্রতাপের মধ্য দিয়ে কিভাবে আমাদের নানান সম্পর্কের রূপান্তর ঘটছে সেটা খুবই গুরুতর বিষয়। সাহিত্যের দিক থেকে একে বোঝার উপায় কি? মুদ্রনযন্ত্র কি পুরানকে অসম্ভব করে তোলে নি? কিম্বা মুদ্রিত বাক্যের শুরু ও শেষ আছে বলে লিনিয়ার চিন্তা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েচ্ছে কি? এটা স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক? এই পরিপ্রেক্ষিতে ফটোগ্রাফি ও সিনেমা কোথায় কিভাবে আমাদের রূপান্তর ঘটায়, ঘটাচ্ছে বা ঘটাতে সক্ষম সেটা ভাবা দরকার।

ঢাকার স্মৃতি নিয়ে ভাবতে গিয়ে কবিতার কথা মনে পড়ল। শামসুর রাহমান। ‘স্মৃতির শহর’। শহরের কাব্যানুবাদ কিম্বা শহর কবিতায় স্মৃতি, উপমা, উৎপ্রেক্ষা কিম্বা আঙ্গিকে কিভাবে হাজির থাকে কাব্যবিচারের দিক থেকে সেটা খুবই আকর্ষণীয় বিষয় হতে পারে। বলা বাহুল্য এটা শুধু প্রতীকে উৎপ্রেক্ষায়, আঙ্গিকে বা গঠনে শহরের উপস্থিতি বিচার না, কিম্বা শহরের স্মৃতিও শুধু নয় -- তবে এইসবও নিশ্চয়ই। শামসুর রাহমানের কবিতায় শহর কিভাবে এসেছে সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে কিভাবে এসেছে সেটা বুঝবার আগেই তিনি ‘নাগরিক কবি’ খেতাব পেয়েছিলেন। যদিও নাগরিকতা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ধারণা, সেটা বাংলাদেশের শহুরে সাহিত্যে আদৌ আছে কিনা সেটা গুরুতর তর্কের বিষয়। কিন্তু পুরানো ঢাকা তার উপস্থিতি ও চলমান রূপান্তরসহ সাহিত্যে নানা ভাবে এসেছে। চেনা ছবিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত, মাহুতটুলির অলিতে গলিতে বেড়ে ওঠা শামসুর রাহমানের কবিতা কিভাবে স্মৃতি ও রূপান্তর ধরে রেখেছে, কিম্বা আদৌ রেখেছে কিনা তা নিয়ে আমরা ভাবতে পারি।

শহর যখন সরাসরি তাঁর কবিতার বিষয় তখন তাকে এভাবে পড়ি:

এ শহর ট্যুরিস্টের কাছে পাতে শীর্ণ হাত যখন তখন
এ শহর তালিমারা জামা পরে নগ্ন হাটে, খোঁড়ায় ভীষণ।
এ শহর রেস খেলে, তাড়ি গেলে হাঁড়ি হাঁড়ি, ছায়ার গহ্বরে
পা মেরে রগড় করে আত্মার উকুন বাছে, ঝাড়ে ছারপোকা।
কখনো-বা গাঁট কাটে, পুলিশ দেখলে
মারে কাট। টক টকে চাঁদের মতোন চোখে তাকায় চৌদিকে,

এ শহর বেজায় প্রলাপ বকে, আওড়ায় শ্লোক।
গলা ছেড়ে গান গায়, ক্ষিপ্র কারখানায়
ঝরায় মাথার ঘাম পায়ে।
ভাবে দোলনার কথা কখনো-সখনো
দ্যাখে সরু বারান্দায় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির রূপ।

... ...

এ শহর ক্ষুধাকেই নিঃসঙ্গ বাস্তব জেনে ধূলায় গড়ায়;
এ শহর পল্টনের মাঠে ছোটে, পোস্টারের উল্কি-ছাওয়া মনে
এল গ্রেকো ছবি হয়ে ছোঁইয় যেন উদার নীলিমা,
এ শহর প্রত্যহ লড়াই লরে বহুরূপী নেকড়ের সাথে।

( এ শহর, ‘নিজ বাসভূমে’। শামসুর রাহমান)

তবে ‘প্রতিপক্ষ’ যখন এই অনুষ্ঠানটির বিষয় হিসাবে যুগপৎ স্মৃতি ও শহর নিয়ে ভাবছিলো তখন স্বাভাবিক ভাবেই ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমিকে যে গল্প শামসুর রাহমান শোনাতে চেয়েছিলেন সেই শহরের গল্প মনে পড়ল। ব্যঙ্গমা আর ব্যঙ্গমি আর পুরানা রাজরাজড়ার কাহিনী শুনতে চায় না। তো শামসুর রাহমান গাছতলা থেকে প্রশ্ন করলেন, ‘ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি, আমার গল্প শুনবে তোমরা?

ব্যঙ্গমা প্রশ্ন করছে: ‘কী তোমার পরিচয়?’

‘ছড়া কাটি কবিতা বানাই’ হেসে হেসে বললেন কবি

‘সেই শহরের গল্প শোনাতে পারবে তুমি?’

‘চেষ্টা করে দেখতে পারি’।

‘তোমার গল্প শুনতে রাজি আছি আমরা’।

‘তবে বলি, শোনো,...।।

শামসুর রাহমান তাঁর অভিজ্ঞতার ঢাকার গল্প বলছেন:

“আরমানিটোলার মাঠ পেরিয়ে বাবুবাজারের পুল পেরিয়ে ইসলামপুরের রকমারি দোকান ঘেঁষে কখনো পাটূয়াটলীর পথ মাড়িয়ে, কখনো বা শাখারি বাজারের ভেতর দিয়ে পোগোজ ইশকুলে আসা-যাওয়া করতাম রোজ। শাঁখারী বাজারে ঢুকলেই একটা গন্ধ এসে জড়িয়ে ধরত আমাকে। শাঁখের গুঁড়োর । দেখতাম, শাঁখের ওপর করাত চালাচ্ছে দুবেলা। সমস্ত গলিটা রূপকথার ভ্রমর হয়ে উঠত করাতের গুঞ্জনে। দিনের পর দিন ওই সরু গলির ভেতর তৈরি হতো শাঁখের রকমারি সুন্দর সুন্দর সব জিনিস। ভাবতাম, ছোট একটি গলিতে এত লোক থাকে কী করে? এত সুন্দর কাজই বা শেখাল কে ওদের? সরু নরুনের মতো যন্তর দিয়ে শাঁখের গায়ে নকশা ফুটিয়ে তোলা তো মজাত খেলা। বছরের পর বছর ধরে এই ভারি মজার খেলাটা খেলে আসছে শাঁখারিরা। আজ যে শাঁখারি শাঁখের কারুকাজময় চুড়ি বানাচ্ছে, সে ওর বাবার কাছে শিখেছিল এই বিদ্যে। তার বাবা আবার শিখেছিল ওর বাবাব কাছে। এমনি ধারা হাতে হাতে চলে এসেছে এই চমৎকার শাঁখের কাজ। আজ ঢাকা শহরের অনেক কিছু বদলে গেছে, কিন্তু শাঁখারিবাজার সেই আগে যেমন ছিল, এখনো রয়ে গেছে ঠিক তেমনই। সেই সারি সারি পুরোনো বাড়ি, ছোট ছোট নিচু নিচু ঘর। সেই অন্ধকার। সেই শাঁখ, সেই করাত। সেই শাঁখের গুঁড়ো, সেই গন্ধ”।

(‘স্মৃতির শহর’, শামসুর রাহমান)

তাই কি? না, পুরানা ঢাকা আগে যেমন ছিল এখন কি তেমন রয়েছে। সব কিছু বদলাচ্ছে দ্রুত। ক্রমশ অপসৃয়মান শামসুইর রাহমানের পুরান ঢাকা কি এখনও বর্তমান? সেই এই শহর এখন স্মৃতি।

স্মৃতি কিভাবে ধরে রাখা হবে, সেটা শুধু ইতিহাসের বিষয় নয়, সাহিত্যেরও বিষয়। ওর মধ্য দিয়ে যা নাই তা আমাদের মধ্যে হাজির হয় আবার, আর ওর মধ্য দিয়ে যিনি এই উপস্থিতির চর্চা করেন তিনিও। তিনি কখনও কবি, কখনও গল্পকার বা ঔপন্যাসিক; কখনও ফটোগ্রাফার, কখনও সিনেমা নির্মাতা, কখনও চিত্রশিল্পী বা ছবি আঁকিয়ে। বিভিন্ন টেকনলজি বা মাধ্যমের সাহিত্যচর্চা আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়।

শহর নিয়ে। আমাদের নিজেদের নিয়েও।

১১ জানুয়ারি ২০১৫। রবিবার। ২৮ পৌষ ১৪২১। শ্যামলী।

 

 

 


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।