মার্কসের ইতিহাস চিন্তার উপর পাঠচক্রের আলোচনা-২

গত ১২ ফেব্রুয়ারি চিন্তা পাঠচক্রে কার্ল মার্কসের ইতিহাস চিন্তার উপর আলোচনা হয়। আলোচনা করেন মুসতাইন জহির। মুল আলোচনার পর ফরহাদ মজহার ধর্ম ও দর্শন নিয়ে আলাপ করেন। নিচে তা তুলে দেয়া হল।

রাসেল - তারা জানা বলে আসলে কি বুঝিয়েছে? আমি কাপটা দেখে জানছি এটা কাপ। তারা বলতে চাচ্ছে যে এটা মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব না।

ফরহাদ মজহার - আপনি কাপ শব্দটা পাইলেন কোথায়? এটা যে কাপ আপনি কিভাবে জানলেন?

রাসেল - আমি জন্মের পর থেকে দেখে আসছি, এটাকে সবাই কাপ বলে।

ফরহাদ মজহার- তাহলে আপনি জানেন নাই। সমাজে যা বলছে এটাই বলছেন। তাহলে ‘জানা’ কাকে বলে? জানার প্রক্রিয়াটা কি? আপনি যেটা জানছেন বলে ধরে নিয়েছেন, আর তার ভিত্তিতে বলছেন সেটা জানা নয়, জানার প্রক্রিয়া নয়। জানা বলতে দর্শনে বা জ্ঞানতত্ত্বে যা বোঝানো হয়, এটা তা না, আপনি অন্যদের কাছ থেকে ভাষার ব্যবহার করছেন শুধু।

জানা কি? আপনার সামনে একটা কাপ আছে, আপনি কাপটা জানতে চান। আপনি তো অলরেডি জানেন, আর কি জানবেন? ‘কাপ’ শব্দটা আপনি সমাজের ভাষা থেকে পেয়েছেন। তাদের ভাষা ব্যবহার করছেন, এটা তো জানা হল না।

ফিলসফিতে প্রশ্নটা হল জানা কাকে বলে? বা জানা আদৌ সম্ভব কিনা। ইত্যাদি। যেটাকে জানতে চান, যে বিষয় জানতে চান, তাকে কি জানতে পারবেন? বস্তু বা বিষয় যতটুকু নিজেকে দেখায় ততটুকুই তো জানবেন। আজকে আমি দেখলাম যে এটা কাপ। আরেকজন বলল, কি বলেন এটা কাপ,! এটা সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি থেকে আসা একটা প্রডাক্ট। আরেকজন এসে বলল, না না, এটা কি বলছেন? এটা মূলত চীনা ক্লে ছিল, এর মধ্যে ইলেকট্রন, প্রোটন আরও অনেক বৈজ্ঞানিক কায়কারবার চলছে। সে একটা কেমিক্যাল ব্যাখ্যা দিয়ে দিল। কোনটা সত্য? তারপর অনেকদিন পর দেখলেন কাপ সম্পর্কে আরেকটা নতুন গবেষণা হয়েছে যেটা আপনি জানতেন না। আমরা আগে জানতাম না।

আর কান্ট বললেন, বস্তু বা বিষয়ের ততটুকুই আমরা জানি যতটুকু সে নিজেকে দেখায়। আপনার ইন্দ্রিয়ের সামনে ফেনোমেনা হিসাবে যা এক্সপোস হল ততটুকুই আপনি জানতে পারেন। হেগেল আবার কান্টের মতো জানার তর্কে ঢোকেন নাই। বিষয় আর বিষয়ী – অর্থাৎ জানার বিষয় আর যে যিনি জানছেন উভয়ের দ্বান্দিক সম্পর্ক বিচার তাঁর দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ দিক। যখন যখন আমি আমার বাইরে কোন কিছু জানার চেষ্টা করি বা জানি তখন ‘আমি’ বা আমাকে – অর্থাৎ যে জানছে তাকে ভুলে যাই। অনুমান করি ‘আমি’ বলে একটা ব্যাপার আছে যে জানে। সেই ‘আমি’ বাইরে যখন তাকাচ্ছে তখন দেখছে একটা কাপ আছে। এ পর্যায়ে জানা মানে খালি ইন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতা হিসাবে কি জানলাম কি জানলাম না ইত্যাদি। খালি ইন্দ্রিয়ের ব্যবহারের দ্বারা যেটা আমরা জানি তা অনেক বিচিত্র এবং সমৃদ্ধ।

কিন্তু একটা পর্যায়ে আমরা বুঝি ‘আমি’ নামে যে জানতেছে স্বয়ং তাকে তো আমি জানছি না। কারণ আমি ‘আত্ম-সচেতন’ না। ‘আমি’ কখন আত্মসচেতন হতে শুরু করে? ‘আমি’ সম্পর্কে আমরা সচেতন হই যখন আমার ক্ষুধা লাগে। বাইরের জিনিস আপনি দেখেছেন তখন আপনার ‘আমি’ তো আপনার কাছে নাই। যাকে জানবেন বলে জ্ঞানের বিষয় হিসাবে হাজির রাখছেন সেই বিষয়ের মধ্যে ‘আমি’ লিপ্ত হয়ে যায়। এবসর্ব বা বিলীন হয়ে যায়। এই ‘আমি’ কে কি দেখেছেন আপনি? দেখেন? এই ‘আমি’ তো সর্বদাই প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বাইরে থাকে, ধরা যায় না। গায়েব।

তাহলে জ্ঞানতত্ত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: যে ‘আমি’ জানল বলে আমরা উপলব্ধি করি, বা দাবি করি তাকে আবার কি করে জানব? হেগেলের ভাষ্য হচ্ছে আমরা ‘আমি’কে উপলব্ধি করি যখন আমি ক্ষুধার্ত হই। তখন বলি আমার ক্ষুধা – ক্ষুধাটা আমারই লাগে। তখন ক্ষুধার মধ্য দিয়ে ‘আমি’ জানার বিষয় হিসাবে সামনে চলে আসল। কান্টের কাছে জানার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল যে বস্তু বা বিষয় জানতে চাই সে আমার ইন্দ্রিয়ের কাছে কতোটুকু ধরা পড়ল, কতোটুকু পড়ল না এই ভেদজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে আমরা কোন কিছুকে পুরোপুরি কখনই জানতে পারি না।

যদি না জানতে পারি, তাহলে একটা বিরাট সমস্যা তৈরি হয়। লেনিন তার সমাজে যখন বিপ্লব করতে গেলেন তখন তার মনে প্রশ্ন আসল- আপনি যদি পুরো জিনিসটা নাই-ই জানেন, যদি পরিপূর্ণ জ্ঞান কান্টের কথা মতো মানুষের পক্ষে সম্ভব না হয় তাহলে আপনি কিভাবে দাবি করেন আপনি বিপ্লবটা যে জানাজানির ভিত্তিতে করতে চান, সেই জানাটা সঠিক। সঠিক না হলে আপনি বিপ্লবের নামে ভুল কাজ করছেন। যে কোনো বিপ্লবী আন্দোলন সংগ্রামের অনুমানটা হচ্ছে আমি যে কাজটা করতেছি, এটা আমি জেনে শুনে করতেছি। কিন্তু আপনি তো ততটুকুই জানেন যতটুকু জগত আপনাকে দেখতে দিয়েছে, বাকিটা আপনি জানেন না। এটা খুব বড় ধরনের প্রবলেম তৈরি করে, ঠিক না? নিশ্চয়ই করে। জানাজানির প্রক্রিয়া বা জ্ঞানকাণ্ডের কারবার নিয়ে দার্শনিকরা যেসব প্রশ্ন করে, কিভাবে করে তার উদাহরণ দিচ্ছি শুধু। আর দেকার্তের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমি যে জানি এটা আমি নিশ্চিত হব কি করে। এগুলো হল খুচরা দর্শনের আলোচনা। আমি উত্তর দেবার জন্য কথা বলছি না। দর্শন কি ভাবে প্রশ্ন তোলে তার নজির দিচ্ছি মাত্র।

সুলায়মান - তাহলে লেনিন বিপ্লব করল কিভাবে?

ফরহাদ মজহার- তর্কটা হচ্ছে, স্বয়ং চিন্তা যে অনুমানের ভিত্তি করে কাজ করছে সেই অনুমান সম্পর্কে সে সজ্ঞান কিনা এবং বৈল্পবিক কর্মকাণ্ড ও তৎপরতার মধ্য দিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপে তার অনুমানের পর্যালোচনা করতে সক্ষম কিনা। তৎপরতার মধ্য দিয়ে গানের সংকটের মীমাংসা করছে কিভাবে। নিজে নিজে ঠিক আছে কিনা? লেনিন কান্ট ও নব্য-কাণ্টবাদীদের সংশয়বাদের জবাব দিতে পেরেছেন কিনা সেটা আমরা সময় পেলে তাঁর Materialism & Empirico-Criticism পড়ে বোঝার চেষ্টা করব। কিন্তু আমাদের এখনকার আলোচনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই জানাজানি বা জ্ঞানকাণ্ডের কারবারটা বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এটা বুঝে নেওয়া এবং বোঝানো।

কান্ট প্রসূত সংশয়বাদের একটা উত্তর হচ্ছে, আমি এতটুকু যখন বস্তু ও বিষয়ের প্রকাশ থেকে জানছি, তারপরে আমি জানি না বা জানা সম্ভব না, এটা ঠিক না। আজকে জগত সম্পর্কে আমার যে থিওরি আগামি দিনে সে থিওরি বদলাবে। জগত তো ভিন্নভাবে আমাকে দেখা দিতে পারে। আমি যে জানতে পারি জানাটা তো আমার কমপ্লিট হয় নাই। ফলে আমি জানতে পারি না এ তথ্যটা ঠিক না। মূলত লেনিনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, মানুষের পক্ষে কখনই সব কিছু জানা সম্ভব না। লেনিন বলছে, জানা সম্ভব। এটা টাইমের ব্যাপার। এখন জানতে পারছি না, কিন্তু আগামী দিনে জানতে পারব। এটা সন্তোষজনক উত্তর কি? মেটেরিয়ালিজমের ফিলোসফিকাল ফেইলিউর যদি ধরতে না পারেন তাইলে আগামি বিপ্লবের জন্য শিক্ষা নেবেন কি করে? ব্যর্থচিন্তার ধারাগুলোর সঙ্গে আপনি মোকাবিলা করবেন কি করে।

সুলায়মান - ফরহাদ ভাই, এই যে বলা হচ্ছে ততটুকু তার জানা যতটুকু প্রকৃতি তার কাছে ধরা দেয়। তাহলে মানুষ যে বিপ্লবের কাজ করে পরিবর্তনের কাজ করে, তাহলে কি ব্যাপারটা এরকম যে, সে যতটুকু জানে ততটুকু নিয়ে পরিবর্তন করতে চায়।

ফরহাদ মজহার - কান্টশিয়ান ফিলোসফি যে সংশয়বাদের জন্ম দেয় তার ভিত্তিতে বিপ্লব অসম্ভব। লেনিন এটা বুঝেছিলেন, এখানে বিপ্লবী হিসাবে তাঁর অসামান্য গুণ। আমি যেখানে গিয়ে শেষ করলাম কান্ট নিয়ে, অতি প্রাথিমিক স্তরে। ফলে কান্টের মধ্যে কোন রেভুলেশানারি পলিটিক্স আছে? যদি থিং-ইন-ইটসেলফের নোশনটা থাকে যে জগতের একাংশ আমার অগোচরে থেকে যাবে। তাহলে থেকেই যদি যায় এরকম একটি দর্শন দ্বারা কি বিপ্লব সম্ভব? তাহলে মার্কস যখন আসল, মার্কস কোথা থেকে শুরু করল? মার্কস কি কান্ট থেকে শুরু করল নাকি হেগেল থেকে শুরু করছে। হেগেল থেকে শুরু করছে। কান্টকে যদি পর্যালোচনা হেগেল না করত তাহলে মার্কসও আসত না। এখন মার্কসের প্রকল্পটা গ্লোবালি কলাপ্স করছে। কি জন্য? ইসলামিস্টরা যেটা বলে ঐটা? নাস্তিক বইলা? প্রশ্ন মনে রাখেন শুধু, উত্তর এখন খুঁজবেন না।

প্রশ্ন ও অন্বেষণ দর্শনের প্রাণ, আসল জায়গা। গল্প দিয়ে বলি।

হজরত ঈসার গল্প করছি আপনাদের কাছে? হজরত ঈসার মনে প্রশ্ন আসল যে আনন্দ কি? বড় নবী বলেন জ্ঞানী বলেন তাদের জীবনে সবচেয়ে বড় লক্ষণ কি? প্রথমত ওরা প্রশ্ন ভোলে না। তো হজরত ঈসার মনে প্রশ্ন আসছে যে আনন্দ কি করে পাব। তখন তার বন্ধুরা এসে বলল তুমি আনন্দ পেতে চাও? শোন, তুমি মিশরে যাও ওখানে মরিয়ম নামে একটা মেয়ে আছে ওখানে তুমি আনন্দ পাবে। তরুণ বয়সের ছেলেদের কাছে আনন্দের ধারনা একরকম। কিন্তু ঈসা রুহুল্লা যে আনন্দ খুঁজছেন সেটা তো এটা না। তিনি গেলেন মিশরে মরিয়মের কাছে। সেখানে সব লোকজন লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এত লোকজন যখন এখানে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চয় ঈসা ভাবলেন এখানে আনন্দ পাওয়া যাবে। তিনি বসে আছেন। ছেলেরা যায় তারপর বের হয়। খুব খুশি। ঈসা চিন্তা করলেন আমি তো ঠিক জায়গায় আসছি। এখানে আনন্দ পাওয়া যাবে। তিনি মরয়মের ঘরে ঢুকলেন। যখনই মরিয়মের ঘরে ঢুকলেন মরিয়ম এই তরুণকে দেখে বুঝল যে, এ তো আর দশটা ছেলের মত না; একটা ছেলের দিকে তাকালেই তো বোঝা যায়, সে আর দশটা ছেলের মত না। তুমি এখানে কি জন্য এসেছ? ঈসা বল্লেন আমি আনন্দ খুঁজছি, আমি শান্তি চাই, আমি সত্যের সন্ধানে আছি। মরিয়ম বলল, তুমি যা খোঁজ তা তো এখানে নাই। ঈসা তখন বলল, তুমি মিথ্যা কথা কেনো বলছ? এতগুলো ছেলে আসল আর বের হল, আমি আসছি এখন বল নাই। মরিয়ম তখন তার কাছে ব্যখ্যা করে বলেছে তার কাছে কী আছে। ঈসা বললেন না এটা আমার দরকার নাই। এটা আমি খুঁজছি না। তিনি বেরিয়ে এলেন।

রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন তরুণ ঈসা। একদিন হঠাৎ করে দেখলেন সব ছেলেরা একটা মেয়েকে দড়ি দিয়ে বেঁধে বাজারে নিয়ে আসছে। তিনি বললেন কি হইছে? আরে এ মেয়ে তো গণিকা, এ তো খারাপ মেয়ে। এ তো জেনা করছে। আর আমাদের আইন বলে যে, জেনা করলে মাটিতে গলা পর্যন্ত গেঁড়ে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলতে হবে। মেয়েটা দূর থেকে দেখে চিন্তা করতেছে এ তরুণ তো অন্যদের মত না, এ নিশ্চয় ভিন্ন কথা বলবে। ঈসা বললেন, তোমাদের আইন যেহেতু আছে, তাহলে তো আর কিছু করার নাই। ঠিক আছে কর।

মেয়েটাকে পুঁতে ফেলা হল। সবাই পাথর যোগাড় করছে। মরিয়ম ভাবছে, আমি তো ভাবছিলাম যে পুরুষদের মধ্যে সত্যিকারের কিছু মানুষ আছে। এগুলো তো সবি দেখি অমানুষ। এমনকি ঐ তরুন্টাও।

যখনই একজন পাথর তুলল মারতে, তখন ঈসা বলল যে দাঁড়াও দাঁড়াও একটা কথা আছে। তোমাদের আইন ঠিক আছে। কিন্তু পাথর তো মারতে পারবে সে যে কোনদিন কোন পাপ করে নি। সবার হাত থেকে আস্তে আস্তে পাথর পড়ে গেল। কারণ সবাই ছিল পাপী। সেখানে একজনই শুধু ছিলেন যিনি কোন পাপ করেন নি, তিনি হজরত ঈসা (রাঃ) রুহুল্লা। কিন্তু পাথর না ছুঁড়ে তিনি তখনকার বিদ্যমান আইনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়ে গেলেন, তাঁকে কেন্দ্র করে নতুন ধর্ম বা চিন্তার উৎপত্তি ঘটতে পারল। এই ঘটনার জন্য শুধু নয়। আরও বিস্তর গল্প সব নবিরসুলদের জীবনেই আছে। এই গল্পের মধ্য দিয়ে নবিরসুলরদের মনে জাগ্রত প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণের মর্ম আমরা বুঝতে পারি। প্রশ্ন তোলা ও তার উত্তরের জন্য অনুসন্ধান। আনন্দ কি? শান্তি কি? সত্য কি? ইত্যাদি।

তাইলে ফিলসফি আর ধর্মের অনুসন্ধানটা একই রকম। এখান থেকে হেগেল এসে বলতেছে রিলিজিয়ন যে ট্রুথকে সার্চ করে দর্শন এটাই করে। নতুন কিছু করে না। ধর্ম এবং দর্শনের পার্থক্যটা আধুনিক কালে এসে আলাদা হয়ে গেছে। কিন্তু নিজ গুণে ধর্ম যা উপলব্ধি করে জ্ঞাঙ্কাণদের কারবার হিসাবে দর্শন সেটাই প্রদর্শ করে মাত্র।

প্রত্যেকটা সোসাইটি কোন না কোন সত্যের ধারনার উপর ভিত্তি করে তার সমাজকে গড়ে। প্রত্যেকটা ধর্মেরও নিজস্ব একটা ধারা আছে। তার মধ্যে ওভারলেপিং আছে। ইসলামের মধ্যে ওভারলেপিংটা বেশি। কারন ইসলাম অন্য ধর্মকে স্বীকার করে। এই ধর্ম কখনই বলে না যে সত্য একমাত্র মুহাম্মদই পেয়েছেন। আদম থেকে শুরু করে সকলেই আল্লাহর নবী। তার অনুসারীরা এটা ভুলে গেছে বলে এখন তাদের সাথে ঝগড়া। ঈসায়ীদের সাথে ঝগড়াটা এ কারণে নয় যে তারা কেতাবের বই না। তারা লাইন চ্যুত হয়ে গেছে। এইখানে তাদের সঙ্গে তর্কের জায়গা। আপনি যদি ঈসাকে নবী না মানেন আপনি মুসলমান থাকতে পারবেন না।

হযরত বেলাল একমাত্র মানুষ যে লম্বা দেখতে, কালো। রসুলের সামনে দিয়ে হাঁটতে পারতেন। যাতে কোন আঘাত আসলে যেন তার গায়ে আগে এসে । আসে। বেলাল একবার সাংঘাতিক কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। নবীজি বললেন তুমি কান্না করছ কি জন্য। বেলাল বললেন, বলতে পারি যদি আমি যা চাই তা আমার জন্য আপনি করেন। নবীজি বললেন এটা কি করে হয়। আমি জানি না তুমি কি চাইবে আগে থেকে কি করে প্রতিশ্রুতি দেই আমি এটা করব। বেলাল বলে তাহলে আপনি জিজ্ঞেস কইরেন না, আমাকে কাঁদতে দেন। তখন রসুল, যেহেতু মন নরম, বেলালের জন্য অসম্ভব মহব্বত, ঠিক আছে তুমি বল কিন্তু আমাকে মাফ করে দিও যদি আমি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারি। কিন্তু বেলাল বলল, না বলতে হবে যে, আমি যা বলি তাই আমার জন্য আপ্নাকে করতে হবে, আমাকে দিতে হবে। বুকফাটা কান্না দেখে রসুল বলল ঠিক আছে বল। তখন তিনি বললেন আপনি মারা যাওয়ার পর আপনার উম্মত নানা ধারায় বিভক্ত হয়ে যাবে। আমাকে আপনি আজান দিতে বলছেন। আমি যখন আজান দেই উম্মত একত্রিত হয়। আজান যখন আপনার কানে আসে ঐ একটা জায়গায় আপনার সব উম্মত একত্র হবেন। কারন মানুষের সঙ্গে মানুষের সকল বিভেদ ভুলে মানুষকে একই উম্মাহর অন্তর্ভূক্ত করবার জন্য আল্লার তরফে আপনি এসেছেন। কিন্তু আজানের আহ্বান উপেক্ষা করে ও একত্রে জমায়েত না হয়ে আপনার পাশে যখন আরেকজন আজান দেয় তখন তার অর্থ কি। জামাত ভাগ হয়ে যাবে না? তাহলে উম্মতও বিভক্ত হয়ে । এক থাকবে না। আপনি তো সারাজীবন সাধনা করছেন উম্মতকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে। আপনার কাছে আমার নিবেদন আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন আপনার আগে যেন আমি মারা যাই। কারন আপ্নার উম্মতেরা বহু ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে এটা আমার পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব। রসুল বললেন এটা আমি কি করে চাইব। এটা তো অন্যায় কথা। বেলাল বলল না আপনি কথা দিয়েছেন। রসুল পড়ে গেল বিপদে। তারপরে তোমার এই দাবি বাদ দাও বেলাল, তুমি এটা বাদ দাও কি বললে বল তুমি রাজি হবে? বললেন, তাহলে আজানে আমাকে বলতে অনুমতি দিতে হবে যে ‘মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’। তখন আজানে তাকে বলতে অনুমতি দিল যে ‘মুহামদ্দুর রসুলুল্লাহ’।

সুলায়মান-আগে ছিল না?

ফরহাদ মজহার- না। ঈসাও তো রসুলুল্লাহ। মুসাও তো রসুলুল্লাহ। সেই ধারাবাহিকতায় নবিজিও যে রুসুলুল্লাহ সেটা দাবি করতে হয়েছে বটে, কিন্তু আজানের সময় শুধু তাঁকেই রসুলুল্লাহ বলার মানে এই নয় যে অন্যেরা আল্লার রসুল ছিলেন না। আপনি আলাদা করে মুহাম্মদকে রসুল কেন বলছেন? মুহাম্মদের শিক্ষা এটা ছিল না কখনো। আপনি তো মুহাম্মাদান না। খ্রিস্টানরা খ্রিস্টিয়ান, ইহুদীরা ইহুদী, কিন্তু আপনার ধর্ম তো ইসলাম। যে ধর্ম হজরত আদম থেকে শুরু করে হজরত ইব্রাহিম, মুসা সকল নবিরসুলদেরই ধর্ম ছিল। এমনি কোরানে যাদের উল্লেখ করা হয়েছে তার বাইরের প্রতিটি জাতির জন্য পথ প্রদর্শকও তো ছিল। ঈসাও আপনার রাসুল্লাহ, মুসাও আপনার রাসুল্লাহ, দাউদ আপনার রাসুল্লাহ। আপনি আলাদা করে মুহাম্মদের কথা বলছেন কেন? এ প্রশ্নটা করার জন্য হিস্টরিকাল ঘটনাগুলো কি করে ঘটছে?

ইসলামের মধ্যে মুসলিম উম্মাহ কথাটা অনেক পরে এসেছে। উম্মাহ তো একটাই। সারা দুনিয়ার মানবজাতিকে একত্রিত করার জন্য আখেরি নবিকে পাঠানো হয়েছে। আরো কথা আছে। তাঁকে রহমতুল্লিল আলামিন বলি আমরা। সারা দুনিয়ার পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ যা কিছু আছে সবার জন্য রহমত আকারে এসেছেন নবি। প্রত্যেকটা ধর্মের চিন্তা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যসূচক কিছু দিক আছে। ইসলামকে সেই দিক থেকে ভাবতে শিখতে হবে। প্রতিটি ধর্মই তাদের নিজ নিজ চিন্তা পদ্ধতির মধ্যে দার্শনিক চিন্তার দৃষ্টিভঙ্গির বীজ ধরে রাখে। নবী সারা দুনিয়ার জন্য রহমত আকারে এসেছেন। এখন শুধু ভাবুন, মুসলমান যখন মোনাজাত করে নাজাত বা মুক্তি খালি মুসলমানদের চাই কেন? এই অধঃপতনটা কি করে ঘটল?

আমি কিন্তু কোথা থেকে শুরু করছি মনে আছে? ট্রুথের সার্চ সাংঘাতিক ইম্পর্টেন্ট। সত্যের অন্বেষণ থেকে আপনি যখন থেকে আপনি যখন সরে যাইতেছেন আপনি আর ধর্মে নাই। দর্শনে জানাজানির চর্চা বা জ্ঞানতত্ত্ব সত্যের জন্যই। ধর্ম সেটা জ্ঞানতাত্ত্বিক কায়দায় অগ্রসর হয় এতা ভাববার কোন কারন নাই, কারণ জ্ঞানকাণ্ডই সত্য অন্বেষন ও নির্ণয়ের একমাত্র উপায় না, এ কথা বলার জন্য এতগুলো গল্প বললাম।

যেমন আল্লাহ আছেন। আল্লাহ আছে এটা তো নতুন কিছু না। তাইলে মূর্তি ভাঙতে হইল কি জন্য? তাহলে ‘আছে’ কথাটা আল্লাহ সম্পর্কে যখন লেখা হয় তখন কথাটা মেটাফরিকালি ব্যবহার করি আমরা। কথা শুনলে মনে হয় যেন উনার হাত আছে, রূপ আছে। এটা হচ্ছে মেটাফরিকাল কথা। কিন্তু আছে কথাটাতো এমন নয় যে যেমন আমার সামনে এই গ্লাসটা আছে, তিনি এরকমি আছেন? ধর্মতত্ত্ব গল্পে মেটাফোরে কথা বলার সুবিধার জন্য আছে কথাটাকে নানান ভাবে ব্যবহার করতেই পারে। বলতে আল্লা আসমানে আছেন। কিন্তু দর্শন প্রশ্ন তুলবে আসলে ‘আছে’ কথাটার অর্থ কি? কে কিভাবে আছে কথাতা ব্যবহার করছে দর্শন তা বোঝার জন্য প্রাণান্ত হবে। এই দর্শনে ঢুকে গেলেন। দর্শনের প্রশ্ন, ইসলামে ‘আল্লাহ আছে’ কথাটা কোন অর্থে ব্যবহার করে।

আছে কথাটার মধ্যে টাইমস্পেইস বা দেসকালের ধারণা নিহিত রয়েছে। যেমন এটা ‘আছে’। এই টেবিলে এটা আছে এবং বিশেষ সময়ে জিনিসটা আছে। আছে কথাটাই কোন কিছুর ওপর খাটাতে গেলে সময় লাগে, একটা জায়গা লাগে।বিশেষ সময় এবং একটা বিশেষ জায়গা একটা বিশেষ স্থানে যদি কোন সত্তা থাকে তাইলে তার সম্পর্কে ‘আছে’ কথাটা খাটে। আল্লাহ সম্পর্কে কি ‘আছে’ কথাটা দেশকালের অধীন বস্তুর মতো খাটে? আল্লাহ কি সময়ের অধীন? আল্লাহ কি দেশের অধীন না বাইরে? তাইলে আল্লাহ সম্পর্কে আছে কথাটা খাটে না।

না খাটলেও যদি আছে বলি অসুবিধাটা কোথায়? খ্রিস্টানরা আছে বলে। ইহুদীরা আছে বলে। কোরান আসার পরে এই আছে কথাটার দেশকাল অধীনস্থ ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেল কি জন্য। আছে কথাটা কেন আল্লাহ সম্পর্কে বলাটা ঠিক না। ইসলামে কি এমন গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে যাতে এটা বলাটা ঠিক না? যেটা খুব বৈশিষ্ট্যসুচক? যেটা খ্রিস্টানিটি থেকে আলাদা করা যায়? জুদাইজম থেকে আলাদা করা যায়? আধুনিক বিজ্ঞান থেকে আলাদা করা যায়?

প্রথম কথা হল অন্য কোন ধর্মে এই কনসেপ্ট নাই। ইসলাম প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয় এই ধারণা। এটাকে বলে শিরক। শিরক মানে কি? অংশীদার করা, তুলনা করা, শরিক করা। আপনি ‘আছে’ কথাটা বলে শিরক করলেন। আল্লা বস্তু নয়, কিন্তু বস্তুর সঙ্গে তাকে শরিক করে ‘আছে’ কথাটা ব্যবশার করলেন। তার সম্পর্কে ‘আছে’ কথাটা খাটে না। তিনি তো বস্তু না।

সে কারনে ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নোশন হল শিরক। ইসলামে নাস্তিকতা সমস্যা না। সমস্যা হল শিরক। এখন ফিলসফিতে ঢুকেন। কেন শিরক করতে পারবেন না? পারবেন না কারণ আপনি যাকে নিয়ে কথা বলছেন ‘আল্লাহ’ নামকরণ দিয়ে তিনিএমন এক বিষয় বা সত্তা যিনি বস্তুগত কিম্বা দেশকালাধীন কোন কিছুর সঙ্গে তুলনীয় নন। দেশকালাধীন বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে যে গুণাবলী সে গুণাবলী তার উপরে খাটবে না। তাইলে যার সম্পর্কে বস্তু জগতের ‘আছে’ কথাটা খাটে না তার সম্পর্কে ‘নাই’ কথাটাও খাটে না? আল্লাহ নাই বললেও একই রকম শিরক হয় সমানই তো প্রায়।

অতএব নাস্তিক ‘নাই’ বলে যাকে নাই করে দেয়, তিনি ইসলামের আল্লাহ না, বস্তুজ্ঞানে নাস্তিকের মাথায় থাকা কোন ভাবমূর্তি মাত্র। বস্তুওরই প্রতিকল্প। বাস্তবের প্রতিমাকে নাই বলা আর ভাবের মূর্তিকে নাই বললে ইসলামের কিছুই আসে যায় না।

মুসার গল্প বলি একটা। গল্প শুনলে খুব তাড়াতাড়ি দর্শন বুঝবেন। গল্পটা হল- মুসা একদিন যাচ্ছেন বাজার দিয়ে। তিনি দেখেন যে, একটা কামার কাজ করে, হাপর চলছে আর বলতেছে যে, ‘আল্লাহ গো তোমারে যদি আমি পাইতাম, দুধ খাওয়াইতাম বাচ্চার মতো কোলে লইয়া। আর সারাদিন কত ভাবে যে আদর করতাম কোলে লইয়া। আল্লাহ গো তোমারে যদি পাইতাম পায়ে লাল মোজা পরাইয়া দিতাম, খুব সুন্দর একটা বিছানা বানাই দিতাম তোমার জন্য। গান গাইয়া গাইয়া তোমারে ঘুম পাড়াইতাম। তোমারে যদি পাইতাম কত যে মিষ্টি খাওয়াইতাম।’ এই বকর বকর করতেছে। মুসা বলে দেখছ ব্যাটা হারামজাদা। কাছে গিয়ে বললেন, এই তুমি এটা কি বল, এটা তুমি কাকে বল। সে বলল, কেন? আল্লাহকে বলি।

মুসা কলিমুল্লাহ খেপে গেলেন। কি মনে করছ তুমি? আল্লাহ কি এরকম? তুমি দুধ খাওয়াইবা কোলে নিবা? লোকটি দেখতেছে ইনি আল্লাহর নবী। এরপর বলল আমার ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দিন। আমি তো জানি না। আমি তো মনে করছি এটা খুব ভাল। তখন মুসা মনে মনে ভাবল তিনি বিরাট এক নবীর কাজ করে ফেলেছেন।

এরপর মুসা হাঁটছে। কতক্ষণ পর একটা গায়েবী আওয়াজ আসল- হে মুসা।মুসা প্রথমে আমলে নিলেন না। কয়েকব্র ডাকার পর যখন গম্ভীর আওয়াজ হোল মুসা দাঁড়াও। মুসা দাঁড়ালেন। গায়েবি আওয়াজ বলল, মুসা তুমি ঐ লোকটাকে এটা বলতে গেলে কি জন্য? তোমাকে আমি অধার্মিককে ধর্মের পথে আনার জন্য পাঠিয়েছি। যে ধর্ম করে তার জন্য তো পাঠাই নাই। মুসা বলে- ঐ লোকটা আল্লাকে দুধ খাওয়াবে, পায়ে লাল মোজা পরাবে, দোলনায় দোলাবে । আমি অন্যায় কি করলাম?

তখন গায়েবি আওয়াজ বলল- ও লোকের জীবনে আমি ছাড়া কিচ্ছু নেই। তার আগাগোড়া খালি আমি। প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমার জিকির ছাড়া তার জীবনে কিচ্ছুই নাই। তুমি তাকে ঐটা বলছ কি জন্য? তখন মুসা ভয় পেয়ে গেল। মুসা ভয়ে দৌড়ে লোকটির কাছে ফিরে গেল। মুসা দৌড়িয়ে আসছে, কিন্তু লোক্টি আর নাই। কঠায়? দেখে ঐ লোকটা মরুভূমির মধ্য দিয়ে হাঁটছে, চলে যাচ্ছে দূরে। মুসা গিয়ে আরে দাঁড়াও দাঁড়াও আমি খুব অন্যায় ক্রেছি। তুমি যা খুশি কর, দুধ খাওয়াও কি ঘুম পাড়া্‌ কর। আমি কিছুই বলবো না। তুমি মাফ করে দাও আমাকে। মহা অপরাধ হয়ে গেছে আমার। মুসা করজোড়ে মাটিতে বসে পড়ল।

লোকটি সভয়ে পিছিয়ে এসে বল্ল, একি করছ মুসা? তুমি আল্লার রসুল। তুমি তো ভুল করতে পারো না। তুমি তো ঠিকই বলেছ মুসা। আসলে তো আল্লাহকে কেন দুধ খাওয়াব। এটা কি হইল নাকিচ? কিভাবে মোজা প্রাব? বিছানায় শোয়াব? এটা তো হয় না। তুমি ঠিক করছ। আল্লাহ তোমাকে এ কথা বলার জন্যই তো পাঠাইছে। তুমি যাও আল্লাহ তোমাকে যে কাজ করতে পাঠাইছে সে কাজ করতে যাও, আমাকে আমার কাজ করতে দাও।

মুসা বলল।কিন্তু তুমি কোথায় যাইতেছ মরুভূমির মধ্যে। সে বলল, আমি যার জন্য সারা জীবন অপেক্ষা করেছি, তা তো পেয়ে গেছি। আমি তার কাছেই যাইতেছি।

তাইলে সাধারণ মানুষ বুদ্ধি দিয়ে আল্লাহকে বিচার করে না। আল্লাহ জ্ঞানতত্ত্ব কিম্বা দর্শনেরও বিষয় না। তার প্রেমে আল্লার আশেকান সারাক্ষণই মশগুল। তার কাজের মধ্যে সে সবসময় আছে, নানান ফর্মে নানান রূপে সে নিজেকে ধরা দেয়। দেখেন, দুটো কনসেপ্ট অফ আল্লাহ ইজ ডিফারেন্ট। প্রথমটায় আমরা জ্ঞান-তাত্ত্বিক আল্লাহর কথা আলোচনা করছিলাম, যে আল্লাহ কোন টাইম এবং স্পেসের অধীন না। এ ছাড়াও ইন্দ্রিয়োপলব্ধির জায়গা থেকেও তাঁর আলোচনা হতে পারে যেমন আল্লার হাত আছে, পা আছে, তিনি আসমানে আরশে থাকেন ইত্যাদি। এটা আকার নিরাকারের তর্ক না। আমর কে কিভাবে ‘আল্লাহ’ নামক বিহয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা কিম্বা ভালবাসার সম্পর্কে যুক্ত তার মামলা। সেই সম্পর্ক আমাদের ইহলৌকিক কর্মাকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে, অর্থ দেয়, আমাদের মানসিক শান্তি কিম্বা অশান্তির কারন হয়। একালের দর্শন বস্তু বা বিষয়ের সঙ্গে কিভাএ সম্পর্কিত থাকি এবং তার ভিত্তিতে সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও রাষ্ট্র গড়ে ওঠে সে ব্যাপারে তুমুল উৎসাহী। আস্তিকতা/নাস্তিকতার তর্ক খুবই পুরানা ও পশ্চাৎপদ তর্ক। চিন্তাশীলদের কাছে এইসব এখন অনেক পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন।

কান্টের দিক থেকে তাকালে দেখবেন যে দেশকালের অতীত বিষয় খুব ইন্টারেস্টিংলি ব্যাখ্যা করা হয়েছে যাতে জ্ঞানতাত্ত্বিক জায়গা থেকেই দাবি করা যায় আল্লা কোন জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারনা না। একে নিয়ে বস্ত্যজ্ঞানে আছে/নাই তর্ক চলে না। সেটা ইসলামের দিক থেকে শেরেকি। শেরেকি দর্শনের দিক থেকে দিক থেকে সম্পূর্ণ নতুন ধরণের ধারণা। গ্রিকো-খ্রিস্টিয় চিন্তার মধ্যে থেকে তাকে উপলব্ধি, বোঝা বা ধরা যাবে না। তত্ত্ব দ্বারা সবসময় আল্লাহকে বুঝা যায় না। সেকেন্ড কনসেপ্ট মুসার যে গল্প বললাম সেখানে আল্লাহ এট দ্যা সেইম টাইম আমার সাথে একটা পার্সোনাল সম্পর্কের ব্যাপারও। আমি বিপদে পড়লে আল্লাহ আল্লাহ বললে বা আল্লাহ জিকির করলে ভাল লাগে। বিপদে পড়লে তাকে ডাকলে যে উদ্ধার পাবেন এমন কোন কথা নাই। কিন্তু এটা করলে আপনি কনফিডেন্স পান এবং এটা আপনার নৈতিক জগতকে গাইড করে। নৈতিক একটা শক্তি আকারে আপনি চর্চা করেন। দুটো কিন্তু সম্পূর্ণ দুই রকম। এক জায়গায় জ্ঞান-তাত্ত্বিকভাবে তার বিচারের প্রশ্ন আরেক জায়গায় ব্যাক্তিগত সম্পর্ক – বিশেষত প্রেম বা আশেকির জায়গা থেকে সম্পর্ক এবং সম্পর্কজাত নীতি নৈতিকতার প্রশ্ন।

তাইলে, প্রশ্ন করতে পারি। ইসলামে আল্লাহ কি জ্ঞানতাত্ত্বিক? উত্তর হল না। আল্লাহ কি এরকম ব্যক্তিগত ধারনা? আনসার ইজ নো। তাহলে ইসলামে কি ধারনা আল্লার? যখন ইসলাম বলতেছে ঈসাও তোমার নবী, মুসাও তোমার নবী। ইসলাম তাহলে এই ধারার মধ্যে গড়ে ওঠা আল্লার ধারণা অস্বীকার করে এমন নাও হতে পারে, যতক্ষণ কেউ শেরেকি না করে। নাস্তিক হলে কোন অসুবিধা নাই। যদি খ্রিস্টানরা বলে আল্লাহ এরকম পার্সোনাল। ইসলাম এটাতেও আপত্তি করে না। ইসলাম বলে হ্যাঁ হতে পারে। কিন্তু মুহাম্মদের উম্মত যারা তাদের জন্য এটা বাধ্যতামূলক না। তাদের বিভ্রান্ত হলে চলে না। কারন আল্লার ধারণা একই সঙ্গে আকিদার সঙ্গে সম্পর্কিত।

আরেকটা উদাহরণ দেই। আল্লাহকে প্রভু বা লর্ড বলা হয়। লর্ড শব্দটা কোথা থেকে এসেছে, কারা বেশি বলে লর্ড। খ্রিস্টানরা আল্লাহকে প্রভু বলে। আল্লাহকে প্রভু বলা কি ভুল ? ভুল না। কিন্তু মুহাম্মদের উম্মত যারা ওদের কিভাবে আল্লাহকে ডাকতে বলা হয়েছে? প্রভু বা লর্ড বলে কি? না। রাহমানির রাহিম ডাকতে বলছে। দয়ার দয়া। তাহলে আল্লাহ লর্ড বা প্রভু সেই ধারণা অস্বীকার না করেও ইসলামের আকিদার দিক থেকে আল্লার ফান্ডামেন্টাল নোশন বা ধারনা হচ্ছে-দয়া। দয়ার দয়া। দয়াল। কি বললে আমি বুঝব যে সত্যিই আপনি ইসলামের ধারায় আখেরি নবির উম্মত হয়ে আছেন? সেটা আকিদার দিক থেকে বুঝব। আল্লার সঙ্গে আপনার সম্পর্কের ধরণ – দয়ার দয়া – দয়ালের সঙ্গে সম্পর্ক চর্চার মধ্য দিয়েই বুঝব আপনি আখেরি নবির মর্ম বুঝেছেন।

তাহলে ইসলাম জ্ঞানতাত্ত্বিক ধর্ম হল না। ইসলাম আল্লার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক চর্চার ধারনাও হল না। কিন্তু ইসলাম আরেকটা কথা গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে দাবি করে, ইসলাম বলে, আল্লাহ নিরাকার। এটা সত্য না মিথ্যা? আল্লাহ সাকার হইতে পারে না? উত্তর হচ্ছে হতে পারে। আল্লাহ তো সর্বশক্তিমান তার ইচ্ছা হলে তিনি নিরাকার কিম্বা সাকার যা খুশি হৈতে পারেন। এজন্য আল্লাহ নিরাকার কি সাকার এটা ইসলামের মধ্যে বিতর্কের বিষয় না। এটা কোন ইস্যু না। ইসলাম জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাবে আল্লাহর প্রশ্নকে উপস্থাপন করে না। ইসলাম বলে নিরাকারই মানুষের উপাস্য। এটা আদেশমুলক। এটা জ্ঞানমুলক বাক্য না। আকিদার দিক থেকে উপস্থাপন। নিরাকারের উপাসনাটাই মানুষের জন্য উচিত কর্তব্য।

কেন নিরাকার উপাসনা করতে হবে? সাকার করলে অসুবিধা কি? এটা প্রশ্ন আকারে থাকল আপনাদের জন্য। চিন্তা করতে থাকেন।

 

 


নিজের সম্পর্কে লেখক



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।