রাজনৈতিক গণক্ষমতা অবশ্যম্ভাবী

তারেকুল ইসলাম: বিরোধী জোটের একটানা অবরোধ-আন্দোলন ও গুচ্ছ গুচ্ছ হরতাল এবং সরকারের স্বৈরাচারী আচরণ ও পেশিশক্তির জোরে নৃশংস পন্থায় আন্দোলন দমনের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থায় বাংলাদেশ আজ চরম অগ্নিগর্ভে পতিত। দেশ ও জাতির রাজনৈতিক ভবিষ্যত অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনও স্থবির ও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আন্দোলনরত দেশের প্রধান বিরোধী নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মাসাধিককাল ধরে তাঁর নিজ কার্যালয়ে ন্যক্কারজনকভাবে সরকার অবরুদ্ধ করে রেখেছে। তাঁর সাথে দলীয় নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার আতঙ্কে দেখাও করতে সাহস পাচ্ছেন না। কোনো নেতা দেখা করতে যাওয়া মাত্রই গ্রেপ্তার হচ্ছেন। রাজপথে বিরোধী আন্দোলনকারীদের সরাসরি ফায়ার করে নির্বিচারে হত্যা করার রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রকাশ্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঘরে ঘরে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বিরোধী নেতাকর্মীদের হত্যা করা এবং তাদের স্বজন-পরিজনদের হয়রানি ও হেনস্থা করা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের মচ্ছব চরম সীমা পার করেছে। নাগরিক নিরাপত্তা ও অধিকার বলতে বাংলাদেশে এখন কিছুই নেই। লাগামহীন ও অবাধ রাষ্ট্রক্ষমতার এ এক বিভীষণ অনধিকার চর্চা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এবং এই লাগামহীন রাষ্ট্রক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ ও স্বাভাবিক করার জন্য রাজনৈতিক গণক্ষমতা বা গণশক্তির প্রাবল্য ও প্রভাব সুদৃঢ় করার কোনো বিকল্প নেই।
তবে এ কথা বলতেই হয় যে, খালেদা জিয়া কিন্তু এবারের আন্দোলনে একাই দুঃসাহসিকভাবে লড়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এই লড়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় ফলাফল যা-ই আসুক, শেষপর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতাকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদমুক্ত করার পর রাষ্ট্রের পুনর্গঠন তো অত্যাবশ্যক হয়ে পড়বে। ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিএনপি তখন কি এ ব্যাপারে কোনো আশাব্যঞ্জক উদ্যোগ নেবে? যেখানে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের কব্জায় থেকে এতদিন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠান অকার্যকর ও ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে, সেখানে পরবর্তীতে জনগণের পক্ষে বিএনপি’র ইতিবাচক ভূমিকা রাখা এবং রাষ্ট্রের পুনর্গঠন তথা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণপূর্বক গণতান্ত্রিক চেতনায় প্রতিফলিত গণমুখী ব্যাপক রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেঙে পড়া বিভাগগুলোকে সুসমন্বিতকরণের মাধ্যমে নতুনভাবে সেগুলোর সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের অনিবার্য জাতীয় কর্তব্য সম্পর্কে বিএনপি এখনইবা কতটা ওয়াকিফহাল? ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বিএনপি কি আওয়ামী লীগের ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত নেংটি পরবে নাকি বিদ্যমান রাজনৈতিক বিভেদ-বিভক্তির মেরুকরণ দূর করে জাতীয়ভাবে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে শান্তি ও ঐক্যপ্রয়াসী ভূমিকা পালন করবে? এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে বা কীরূপে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হবে?
দেশে দুই প্রধান রাজনৈতিক শিবিরের মধ্যকার দলবাজি ও উগ্র জাতীয়তাবাদী বিভক্তিকরণ-প্রণালি আমাদের জাতীয় জীবনের অগ্রসরমানতার সবচে বড় বাধা। রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তির শিকার স্বয়ং জনগণ। এই বিভক্তির ভয়ানক প্রভাবে আমাদের জাতীয় একতা ও সংহতির চেতনা আজ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান ধসে পড়েছে। জনসমাজগত ও আইনশৃঙ্খলাজনিত স্থিতিশীলতা এলোমেলো হয়ে গেছে। তবে এটা সত্য যে, বড় দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে যদি সহনশীলতা, সমঝোতা ও আপসমূলক সহাবস্থান থাকত তাহলে জনগণের মাথাব্যথার আর কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না কেন? তার কারণ দুইটা: প্রথমত, আমাদের গণমুখী ও নাগরিক মূল্যবোধসম্পন্ন একটা সংবিধান নেই; তবে যেটা আছে সেটা যদি এমন হতো তাহলে সেটার এতটা পৌনঃপুনিক ব্যবচ্ছেদ ঘটত না-অর্থাৎ শাসকচক্র বারবার নিজস্ব স্বার্থে ইচ্ছামতো সেটার পরিবর্তন সাধন করার সুযোগ পেত না। বিশেষত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বর্তমান সংবিধানকে ফ্যাসিবাদের নির্যাসে সিক্ত এক বীভৎস গণবিরোধী একনায়ক চরিত্র দেয়া হয়েছে, যার ফলে মৌলিক নাগরিক-মানবিক অধিকার সম্পর্কিত প্রশ্নগুলো এখানে বরাবরই উহ্য বা উপেক্ষিত হয়েছে। যেখানে সংবিধানের এহেন দুরবস্থা, সেখানে রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী শাসকবর্গের কর্মকান্ড থেকে আর কীইবা আশা করা যায়। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বেআইনি ক্ষমতাচর্চার নজির ও বাস্তবতা তো আমাদের সামনেই উপস্থিত। আমাদের বিরোধী ও ক্ষমতাসীন উভয় দলের রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় কর্মযজ্ঞ আদৌ সাংবিধানিক অধিকার লালন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সংরক্ষণে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সক্ষম হয়ে ওঠেনি।
দ্বিতীয়ত, প্রচলিত রাষ্ট্রক্ষমতা চর্চার বিপরীতে রাজনৈতিক গণক্ষমতার প্রাবল্য অনুপস্থিত। রাজনৈতিক গণক্ষমতার সঙ্কোচন বা অনুপস্থিতির কারণে শাসকচক্রের রাজনৈতিক লড়াই স্বাভাবিকভাবেই হয়ে পড়েছে ক্ষমতাকেন্দ্রিক এবং অবশ্যই জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী। রাষ্ট্রক্ষমতা স্বাভাবিক ও নিয়মতান্ত্রিক থাকে রাজনৈতিক গণক্ষমতার চাপে ও প্রভাবে। কিন্তু যেখানে রাজনৈতিক গণক্ষমতাই দুর্বল ও অসহায়, সেখানে রাষ্ট্রক্ষমতার চর্চাকারী শাসকচক্রের রাজনৈতিক দুরাচার ও দুর্বৃত্তায়ন রুখবে কে? রাষ্ট্রক্ষমতা আর রাজনৈতিক গণক্ষমতা এক জিনিস না। দুটোর মধ্যে পরিপূরক অবস্থান বা সমন্বয় না থাকলে জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গন বিপন্ন হতে বাধ্য। কেননা যদি রাষ্ট্রক্ষমতাকে একেবারে লাগামহীন করে দেওয়া হয়, তাহলে ক্ষমতাসীনরা এর অপব্যবহার করতে কুণ্ঠাবোধ করবেনা। সাধারণত গণক্ষমতা তৈরি হয় সমাজের বিশালসংখ্যক জনগণের একাট্টা সংগঠিত হওয়ার মধ্য দিয়েইÑ অর্থাৎ এই সংগঠিত ব্যাপক রাজনীতি সচেতন গণমানুষ, তৃণমূল রাজনীতির কর্মী বা সমর্থকদের সম্মিলিত ঐক্যবদ্ধ একক রাজনৈতিক জনসমাজ গড়ে ওঠার মাধ্যমে সৃষ্ট রাজনৈতিক গণক্ষমতার পক্ষেই সম্ভব রাষ্ট্রক্ষমতাকে জনগণের অভিমুখে ও নিয়ন্ত্রণে দন্ডায়মান রাখা। রাজনৈতিক গণক্ষমতার অভাব ও অনুপস্থিতির বাস্তবতায় রাষ্ট্রক্ষমতার একক ব্যক্তিকেন্দ্রিকরণের ফলস্বরূপ দীর্ঘকাল ধরে তথাকথিত নির্বাচনমুখী গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নামে বাংলাদেশে অন্যায্যভাবে ক্ষমতাসীনদের গদি আঁকড়ে থাকার প্রবণতা ও স্বভাব গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান আপাতত শুধু নির্বাচন ও সংলাপের ওপর নির্ভর করে পড়ে আছে। বাহ্যিকভাবে সঙ্কট মূলত নির্বাচন নিয়ে, কিন্তু সঙ্কটের গোড়ায় তো আমাদের নজর নেই। নির্বাচনই শেষ কথা নয়, যদিও নির্বাচন প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের মৌলিক শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম। গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার নিমিত্তে নির্বাচনকেন্দ্রিক আলোচনা ও উদ্বেগের পাশাপাশি নাগরিকতা, মানবাধিকার, সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি হালের বিপন্ন এই বিষয়গুলো সম্পর্কেও সম্যক আলোচনা ও চিন্তা অপরিহার্য।
বুঝলাম একটি স্বচ্ছ ও সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সঙ্কট নিরসন এবং একইসাথে ক্ষমতার পালাবদল ঘটবে, এক্ষেত্রে সাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতিও নাহয় স্বাভাবিক হবে; কিন্তু ক্ষমতায় গেলে বিএনপি বর্তমান ক্ষমতাসীনদের নিন্দনীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে-তার কোনো নিশ্চয়তা কি আছে? মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ হওয়ার মতো সমাধান অবশ্যই ক্ষণস্থায়ী হতে বাধ্য। তাহলে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও ঘুরে ফিরে আমাদেরকে পুনরায় নির্বাচনকে ঘিরে একই রাজনৈতিক অচলাবস্থার সম্মুখীন হতে হবে। সুতরাং মাত্র একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মূল ইস্যু হলেও এই সুযোগে আমাদেরকে আরো গভীর মৌলিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। রাষ্ট্রক্ষমতা চর্চাকারী রাজনৈতিক মোর্চাগুলোকে এখন এমন একটা সংবিধান প্রণয়নের দিকে নজর দিতে হবে, যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের জনগণকে জাতীয় সংহতি ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে সুসংগঠিত করে তাদের ভেতর বিক্ষিপ্তভাবে নিহিত গণক্ষমতার জাগরণ ঘটিয়ে এই রাষ্ট্রের পুনর্গঠনপূর্বক তার প্রকৃত গণতান্ত্রিক পাটাতন নির্মাণ করতে হবে। সংবিধান রাষ্ট্রক্ষমতার দন্ড ও নিয়ামক। একটি দেশের সংবিধান যত উদার ও গণমুখী হবে, ততই সেদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা, রাজনৈতিকতা ও গণক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্যমূলক মেলবন্ধন তৈরি হবে। সমাজের সর্বস্তরের গোষ্ঠী ও শ্রেণির আশা-আকাঙ্ক্ষার ধারক গণমুখী একটি সংবিধান গড়ে তোলার জন্য সবার প্রচেষ্টা চালানো উচিত, শ্রদ্ধেয় বড়ভাই ফরহাদ মজহার যেটা সবসময় বলে থাকেন। আর রাষ্ট্রক্ষমতার বিপরীতে রাজনৈতিক গণশক্তি ও গণক্ষমতার প্রাবল্য নিশ্চিত করা, যাতে করে রাষ্ট্রক্ষমতা চর্চাকারী রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের প্রতি অভিমুখী করে রাখা সম্ভব হয়। রাজনৈতিক গণক্ষমতার বৈপ্লবিক জাগরণ সব বিভেদ-বিভক্তি দূর করে জনগণকে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করার পথ সুগম করবে বলে আমি মনে করি।


নিজের সম্পর্কে লেখক



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।