ইতিহাস, রাজনীতি ও রাজনৈতিকতা বিষয়ক পাঠচক্রের আলোচনা

‘ইতিহাসের দর্শন’ আলোচনাকালে লক্ষ্য করা গেল ঘুরে ফিরে পরিবর্তনের কারণ, মানুষের সমষ্টিবদ্ধতা, সংগঠিত হওয়া এবং পরিবর্তনের নিয়ামক বা কর্তাসত্তা হয়ে ওঠার বিষয়টি আদতে রাজনৈতিক, রাজনীতিকে অনুসরণ করেই সামনে এগিয়ে যায়। ফলে ইতিহাস ও রাজনীতিকে আলাদা করে পাঠ করার প্রয়োজনীয়তা যেমন আছে, ঠিক তেমনি তাদের সম্পর্কের বিষয়টিও নজরে আনা উচিত। সেই ধারাবাহিকতায় গত ১২ ফেব্রুয়ারি ’১৫ চিন্তা পাঠচক্রে আলোচনার বিষয় ছিল ‘ইতিহাস ও রাজনীতির সম্পর্ক’। আলোচনা করেন মুসতাইন জহির।

মুসতাইন জহির- আমাদের আশে পাশে অনেকের কথা শোনা যায়, আবার অনেকের কথা শোনা যায় না। এই যে শোনা যাওয়া এবং না যাওয়ার সমস্যা, এটা রাজনীতির দিক থেকে অসম্ভব তাৎপর্যপূর্ণ। কথা শোনা যাবে কোথায়? রাজনৈতিক পরিসরে। অর্থাৎ বলা ও অপরকে শোনানোর মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক পরিসর গড়ে ওঠে। অন্যদিকে রাজনীতির পরিসরে যিনি কথা বলতে পারেন না, তিনি তার রাজনৈতিক অস্তিত্ব নিয়েও অবস্থান করতে পারেন না। তিনি রাজনীতিতে অনুপস্থিত হয়ে যান। ফলে তার অস্তিত্বহীনতাই একমাত্র তার স্বর শুনা বা শুনা না যাওয়ার কারণ।

আপনারা জানেন, নিম্নবর্গের ইতিহাস নিয়ে একটা চর্চা কলকাতায় হয়েছে। তারা এটার নাম দিয়েছেন ‘সাবঅলটার্ন’; অর্থাৎ যারা নিজেদের কথা কাউকে শুনাতে পারেন না। তারা কথা বলতে পারেন না, তা না। তারা কথা বলতে পারেন। কিন্তু তারা কথা বলতে পারেন না সেখানে, যেখানে কথা বললে অন্যে শোনে। এটাকে বলে ‘পাবলিক স্পেয়ার’। যখন আপনি আপনার স্বর নিয়ে উপস্থিতি জানান দিতে পারেন না এবং আপনার কথা কেউ শোনে না, আপনি সমাজে উপস্থিত থেকেও অনুপস্থিত আপনি তখন ‘সাবঅলটার্ন’ হয়ে যান। ‘সাবঅলটার্ন’ মানে হল আপনি পলিটিকাল স্ফেয়ারের মধ্যে হাজির নাই, আপনার কন্ঠস্বর ধর্তব্য নয়,  আমল অযোগ্য । গায়ত্রী স্পিভাকের একটা লেখার কথা আপনারা অনেকেই জানেন, ‘ক্যান দ্যা সাবঅলটার্ন স্পিক?’ মানে নিম্নবর্গ কি কথা বলতে পারেন? এখানে ফিজিক্যালি কথা বলতে পারেন কিনা এমন প্রশ্ন না। রাজনৈতিক পরিসরে আপনার কথা আপনি  বলতে ও শোনাতে পারেন কিনা,সেটাই প্রশ্ন।

আমাদের বুঝতে হবে,ইতিহাসের মধ্যে স্বর শোনা যাওয়ার বা নিজের স্বর তৈরি করার একটা প্রশ্ন আছে। ইতিহাসে অন্যকে ভাষা দেওয়া বা ভাষা পাওয়া,না পাওয়ার একটা চর্চা জারি থাকে। আপনারা জানেন,পশ্চিম বাংলায় কয়েকজন মিলে একটা ইতিহাস চর্চা শুরু করেছে। তাদের ইতিহাস চর্চার উদ্দেশ্যই ছিল ইতিহাসের মধ্যে যে বয়ানগুলো আছে অর্থাৎ ইতিহাসের মধ্যে যে স্বরগুলো আছে সেগুলোকে চিহ্নিত করা। প্রচলিত ইতিহাস চর্চার মধ্যে দুইটা স্কুল বা পদ্ধতি রয়েছে। একটা হল জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চা,অন্যটি হল মার্কসীয় চিন্তা। ভারতবর্ষের ইতিহাস আলোচনার ক্ষেত্রে আমরা হয়তো পুরনো বৈদিক সমাজ থেকে শুরু করে পরবর্তীতে আরও অনেক কিছু হয়ে মোঘলদের আগমন এবং তারপরে ব্রিটিশ আগমন,এভাবে বিশ্লেষণ করি। কিন্তু ব্রিটিশ যামানায় একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে,অর্থাৎ এখানে একটা কলোনিয়াল সিস্টেমের পত্তন ঘটেছে। আমরা ততদিনে  পশ্চিমা সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়ে গেছি,ব্যাপারটা শুধু তা না। সংস্কৃতির বিনিময়গুলো কম বেশি আগেও ছিল। আমরা পশ্চিমের একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে এসেছি এবং ঐ রাজনৈতিক ব্যবস্থাটা আমাদের এখানে প্রয়োগ করা হয়েছে। এরকম একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা বলা চলে। আধুনিক রাষ্ট্র ধারনার সাথেই কিন্তু তার অনুষঙ্গ ধারনাটা হল রাজনীতি। এই প্রথম,রাজনীতি ধারনার সাথে আমরা পরিচিত হলাম। ফলে কলোনির অধীনে থেকে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে শাসিত হবার মধ্য দিয়ে আধুনিক রাজনীতির ধারনারও মুখোমুখি হলাম। কিভাবে সে ধারণা আমরা আত্মস্থ ও প্রয়োগ করেছি তার ইতিহাস আলাদা। আধুনিক রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা গড়ে তোলার আগে কিভাবে আমাদের সমাজ চলত, অনেকের পক্ষ হয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ধরণ ও কৌশল কেমন ছিল সে বিষয়ে এখন আমাদের আগ্রহ নাই বললেই চলে। তাকে আধুনিক রাজনীতির ধারণা দিয়ে বোঝা আদৌ সম্ভব কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন।   তদুপরি উপনিবেশোত্তর বর্তমান আধুনিক কালে সেই সকল চিন্তার আদৌ কোন উপযোগিতা আছে কিনা, নাকি তারা বর্তমান রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের বাইরে একান্তই প্রাচিন ইতিহাস ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয় এই প্রশ্নটিও আমরা এখনও তুলতে পারি নি। বলাবাহুল্য আমাদের পাঠচক্রে এইদিকগুলোও সমান আকর্ষণীয় দিক।

আধুনিক রাজনীতির পিছনে যে চিন্তা ও দর্শন তা হচ্ছে, রাজনীতি মাত্রই এমন একটা পরিসর, যেখানে সকলে মিলে জীবনের একটা রাজনৈতিক রূপ কেমন হতে পারে তা নির্ধারণ করা। এখন এই নির্ধারণের ধারনাটাকে যদিও আমরা রাষ্ট্র বলি,এটা কিন্তু রাষ্ট্র থেকে আসেনি। গ্রিসে যে ব্যবস্থাটা ছিল,কম বেশি আমরা এটাকেই এখন গণতন্ত্র বলি। পলিটির ধারনাটা পরবর্তীতে স্টেট আকারে এসেছে। যেমন,আমরা বলি ‘সিটি স্টেট’। যদিও স্টেটের ধারনাটা আসলে রোমান ধারনা,গ্রিক ধারনা নয়। স্টেটের ধারনাটা ‘স্টেসিস’ থেকে এসেছে;যার মানে অনেকে একসাথে কোন কিছু গঠন, নির্মাণ বা স্থাপিত করা। একসাথে অনেকের সাথে যুক্ত হয়ে কিছু করা। এখান থেকে এসেছে ‘কন্সটিটিউট’ করার ধারনা: একতাবদ্ধ হওয়ার মধ্যে দিয়ে তার সামষ্টিক জীবনটা পরিচালিত হবে। এই সামষ্টিক জীবনটা পরিচালিত হওয়ার প্রশ্ন আকারেই আসছে পলিটিক্স বা পলিটির ধারনা। গ্রিসে এটাকে মনে করা হত হাইয়েস্ট ফর্ম অফ লাইফ। পলিটিকাল লাইফ ছিল পলিটির মধ্যে জীবন-যাপন করা।

আবার “সামষ্টিক জীবন” অথবা “মানুষের সমষ্টিবদ্ধতা’, কথাটার সম্পর্কে একটা ফুট নোট দিয়ে রাখি। এখানে  এসব শব্দের ভিতরে মুল কথা ‘সমষ্টি’ কিন্তু এই ‘সমষ্টি’ মানে কি শুধু বৈষয়িক মানুষের বা কেবল মানুষের বৈষয়িক স্বার্থের বিষয়ে সমষ্টি? অর্থাৎ ওখানে যে ‘মানুষ’ শব্দের ব্যবহার এর পিছনের আগাম অনুমান কি মানুষ মানে বৈষয়িক স্বার্থওয়ালা মানুষ? নাকি বৈষয়িকতাসহ সামগ্রিক মানুষ?  স্পিরিচুয়াল দিকসহ সামগ্রিক মানুষ? মানুষ ধারণার যদি “রাজনৈতিক” উপস্থাপন করতে হয় তবে সেটা সামগ্রিক মানুষেরই “রাজনৈতিক” উপস্থাপন হওয়ার কথা, হওয়া উচিত। খন্ডিত করে কেবল বৈষয়িক স্বার্থের মানুষ না। ফলে মানুষ শব্দটা যেখানেই ব্যবহার হোক আমাদের কড়া নজর রাখা খুবই জরুরি যে ওটা যেন কোন সংকীর্ণ ধারণার খাপে আমরা বেঁধে না ফেলি।  এদিকে কড়া নজর  রাখলে আমরা দেখবে গ্রীক-খ্রীষ্টিয় পটভুমিতে পশ্চিমে যে রাজনীতি, রাজনৈতিকতার (পলিটি) ধারণা তৈরি হচ্ছে ওখানে সব জায়গায় রাজনৈতিক মানুষ মানে বৈষয়িক স্বার্থসম্পন্ন মানুষের রাজনৈতিক উপস্থাপন এই দিকটায় নজর দুর্বল থাকলে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সত্তায় মানুষকে পর্যবসিত করবার পরিণতি আমরা  ধরতে পারবো না। মানুষ, মানুষের সামষ্টিক জীবন চর্চা ও নতুন ইতিহাস নির্মানের সম্ভাবনাও আমাদের কাছে পরিচ্ছন্ন হবে না। পাশ্চাত্যের বাইরে এ বিষয়ে যে সকল গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাভাবনা ও ধ্যানধারণা রয়েছে এ কালে তাদের উপযোগিতাও আমরা বুঝবো না।

আলোচনা যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে আবার ফিরে যাই। আমরা প্রশ্ন করেছি যে, ইতিহাসের আলোচনা করতে গিয়ে কেন আমাদের এই অঞ্চলের ইতিহাস চর্চার একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘরানা এই প্রশ্নটা তুললেন,ইতিহাসে একটা স্বর অনুপস্থিত। ইতিহাস  একটা বিশেষ বয়ান একটা বিশেষ স্বরকেই কেবল প্রতিষ্ঠা করছে, যেখান অন্যের স্বর নাই হয়ে যায়। অন্যের  স্বর এবং অস্তিত্বকে সেখানে বিলীন করে দেয়া হয়। এ স্বরটা  কারো  ব্যক্তি বা মানুষ হিসেবে কথা বলার সক্ষমতার প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হল রাজনৈতিক পরিসর বলতে যেটা বোঝায়,রাজনীতির ধারনার সাথে এর সম্পর্ক সেখানে গরহাজির করে রাখা।

রাজনীতি বলতে গ্রিক জগতে ধারনাটা কি ছিল এবং তার সাথে স্বর কথাটা কেন তৈরি হয়েছে? সমষ্টি তখনই হবে যখন ‘সামষ্টিক পরিসর’ নামক জায়গায় নিজের স্বরটা অন্যের কাছে হাজির করতে পারে; এবং অন্যে সে স্বরটা শুনতে পারে। অন্যের সাথে নিজের কথাটা বলতে পারার মানে হল ‘সমষ্টিক পরিসর’ যেটাকে বলা হয় রাজনৈতিক পরিসর বা পাবলিক স্পেয়ার – সেইখানে হাজির থাকা বা হাজির নিশ্চিত করা। ‘পাবলিক’ ধারনাটা রোমান ধারনায় এসে বিকশিত হয়েছে। যেখানে পাবলিক তৈরি করা হয়। সমষ্টির সাধারণ একটি স্বর একটা পরিসরের মধ্যে তৈরি হয়। এ পরিসরে সামষ্টিক স্বর তৈরি হওয়ার জন্য প্রত্যেকে অংশ নিতে পারে। যে অংশ নিতে পারে না সে আর সমষ্টির অংশ হতে পারে না। এখান থেকে সে বাদ পড়ে যায়। এই যে সামষ্টিকতা এটা কি জন্য?   

পলিটিক্সের এবং পলিটি তৈরির পারপাসটা ছিল মূলত নিজেরাই নিজেদের পরিচালিত হওয়ার পদ্ধতি ঠিক করা। এখান থেকেই পরবর্তীতে সেলফ ডিটারমিনেশনের ধারনাটা এসেছে। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কথাটা আমরা বলি। উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের সময় যেটা প্রধান আন্তর্জাতিক এবং রাজনৈতিক ন্যায্যতা আকারে সামনে আসে। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর এই অধিকার স্বীকার করে নেওয়া উচিত যে,সে ঠিক করবে কি করে সে নিজের জীবন ব্যবস্থা পরিচালনা করবে। এই অর্থেই এটা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। আন্তর্জাতিক আইনেও এটি স্বীকৃত। যেহেতু উপনিবেশ মুক্ত হওয়ার সময়ে আধুনিক রাষ্ট্রের ধারনা প্রধান হয়ে গেছে; ফলে এটা রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্ন হয়ে উঠেছিল। কিন্তু রোমান ধারনার মধ্যে রাষ্ট্র ধারনার অন্য একটা মানে ছিল। এখন রোমান ধারনায় এসে পাবলিক এবং রিপাবলিক দুটো ধারনা এসেছে। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসহ যে কোন আধুনিক রাষ্ট্রই কম-বেশি ‘রিপাবলিক’ শব্দ ব্যবহার করে।

‘রিপাবলিক’ মানে কি? ‘রিপাবলিক’ ধারনা আসলে ‘রেস পাবলিকা’ থেকে এসেছে;যেখানে ‘পাবলিক রেলম’ দ্বারা তা চালিত হবে। রেলম মানে পরিসর, স্ফেয়ার। ‘রিপাবলিক’ ছিল রোমান এম্পায়ারের নিজেদের সিস্টেম অফ গভার্নেন্স। রোমান নাগরিকরা নিজেরা যে পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালিত করত সেটাকেই ‘রিপাবলিক’ বলা হত। সেখানে তারা অংশগ্রহণ  করত। এই অংশগ্রহণের জন্য যে কাঠামোটা তারা তৈরি করছিল সেটাকে বলা হত ‘সিনেট’। 

রিপাবলিকের ধারনা বা পাবলিক স্পেসের ধারনা হচ্ছে সবসময় নিজেরা অংশগ্রহণ করার জায়গা তৈরি করা। এটাই হল ফান্ডামেন্টাল নোশন অফ পলিটিক্স। এই অর্থে আমরা বলি ‘রিপাবলিক’ হল এমন একটা সরকার পদ্ধতি, যা আপনি নিজেই নির্ধারণ করতে পারেন। আপনি যখন এর রূপটা একবার ঠিক করেন,তার পরবর্তীতে ‘একটিভলি’ (সক্রিয়) এবং ‘ইফেকটিভলি’ (কার্যকরভাবে) তাতে পার্টিসিপেট করেন। আপনার এক্টিভ এবং ইফেক্টিভনেসের মধ্য দিয়ে পাবলিক স্ফেয়ার কাজ করে বা যে পাবলিক রেলমটা থাকে এটাই সিস্টেম অফ গভার্নেন্স আকারে থাকে। এবং ধরে নেওয়া হয় অন্য কেউ এটা নির্ধারণ করছে না। আপনারা নিজেরাই একত্রিত হয়ে সেটা করছেন। এই যে একত্রিত হওয়ার প্রক্রিয়ার প্রশ্নেই যেটা পলিটিক্স- সেটা হল স্বর। যেখানে আপনার কথা শোনা যাবে, শোনানো যাবে। আপনি এখান থেকে বাদ পড়ে যাবেন না বা আপনাকে এখান থেকে বাদ দেয়া হবে না। আপনি যদি এখান থেকে বাদ পড়েন বা আপনাকে এখান থেকে বাদ দেয়া হয় তাহলে তো আপনি আর পার্টিসিপেট করেন নাই।  অর্থাৎ আপনি এটার অংশ নয়। যখন আপনি এটার অংশ নন আপনি যখন বাদ পড়লেন তখন রাজনীতি থেকে আপনার অস্তিত্ব বাদ পড়ে গেল। অর্থাৎ আপনি থাকলেও আপনার কথা কেউ শোনে না বা আপনি শোনাতে পারেন না। পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপ্লবের পর তারা রিপাবলিকের ধারনাটা আবার সামনে নিয়ে এসেছে। ব্রিটেনের বিরুদ্ধে তারা যখন সংগ্রাম পরিচালনা করল এবং এক পর্যায়ে গিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করল। তারা তখন বলল যে,প্রত্যেক মানুষের প্রাকৃতিক অধিকার আছে,সে কি ধরনের সরকার বেছে নেবে। এটাকে নিশ্চিত করার জন্য পরবর্তীতে তারা ফিরে গেলেন রোমান সিস্টেমে।ফলে যখন অন্যের কাছে নিজের স্বর নিয়ে আপনি উপস্থিত হতে পারেন অর্থাৎ যখন নিজেরা সবাই মিলে একটা স্বর দ্বারা নিজেদের জীবন ব্যবস্থা রূপায়ন করতে পারেন,তখন তার দ্বারাই পরিচালিত হয় রাজনীতি। কিন্তু রাজনীতি তো সবসময় এমন আইডিয়াল অবস্থায় ছিল না। রোমান যামানায়ও ছিল না,গ্রিক যামানায়ও ছিল না। গ্রিক যামানায় আমরা দেখব,দাসরা স্বাধীন ছিল না,একারণে তারা পলিসের অন্তর্ভুক্তও ছিল না। অর্থাৎ ফ্রি যিনি তিনিই ছিলেন সিটিজেন। এবং তারা সবাই মিলে রাজনৈতিক পরিসরের সভ্য ছিল। একই কথা রোমান রিপাবলিকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রিপাবলিক একারণেই কিন্তু নট নেসেসারিলি এ কশ্চেন অফ ডেমোক্রেসি,ইন দ্যা মডার্ন সেন্স। এ কারণে আমরা দেখব যে,আধুনিক রাষ্ট্রগুলো গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকে গড়ে উঠেছে ‘পিপলস রিপাবলিক’ শব্দ যুক্ত করে। যদিও রিপাবলিক ধারনার মধ্যে সেটা আছে। তাদের ইতিহাসের মধ্যে সিটিজেন হওয়ার বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। মানুষ মাত্রই তার সভ্য ছিল না,সভ্য হওয়ার জন্য তার অর্থনৈতিক এবং অপরাপর জিনিসগুলোর সক্ষমতা ছিল ক্রাইটেরিয়া। ফলে আসলে তাদের সবার সেখানে আসার কোন প্রশ্ন ছিল না।

পরবর্তীতে পাবলিক রেলম-এর মধ্যে সকলকে অংশগ্রহণ করার প্রয়োজন এবং রাজনৈতিক দাবি উত্থাপিত হল। ফরাসী বিপ্লবের পর থেকে ‘জনগণ’ ধারনা এসেছে। প্রথম রাজনীতিতে এই বিপুল গন-মানুষের উত্থান ঘটেছে। গণ-মানুষ রাজনীতির পরিসরের মধ্যে এসে পড়েছে এবং তার অংশ হয়ে উঠার চেষ্টা করছে। এটা ফরাসী বিপ্লবের আগে আমরা দেখি না। এর আগে আমরা দেখব বিদোহ, বিক্ষোভ ইত্যাদি। বিদ্রোহ ও বিক্ষোভগুলো মোটা দাগে পরিচালিত হত একটা ইনসাফের দাবি নিয়ে। অন্যায়ের প্রতিকার,অন্যায়ের অবসান এবং ইনসাফ ফিরিয়ে আনার জন্য। একজন অপশাসককে ন্যায় এবং ইনসাফের পক্ষে স্থিত থাকার জন্য দাবি জানানো হত। অথবা তাকে পরিবর্তন করে অন্য আরেকজনকে বসানো হত। এই ধারনা থেকে প্রথম বের হয়ে আসে,যখন রাজনীতিতে ‘মাস্’ শব্দটি যুক্ত হয়। রাজনীতির পরিসরের মধ্যে এটা এখন আগের অর্থে ‘পলিটি’ বা ‘পিপল’ না। ‘মাস্’ অর্থাৎ ‘জনগণ’ নিজেরাই এখন এর অংশ হবে এবং এরা সবাই মিলে ঠিক করবে মাসের ফর্ম অফ পলিটি-টা কি হবে। জনগণ নিজেরাই এখন নিজের কর্তা হয়ে উঠল। এটা মৌলিকভাবে রাজনীতির ধারণা ও রাজনীতির চর্চায় রাজনীতিতে আরেকটা রূপান্তর ঘটিয়েছে। অর্থাৎ আগের সরকার ব্যবস্থায় মাস্ বা পিপল অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এখন আমরা দ্বিতীয় ধাপে এসে যেটা দেখতে পাচ্ছি,জনগণের অংশগ্রহণ। জন পরিসর অর্থেই পাবলিক স্ফেয়ার অর্থটার বিস্তৃতি ঘটল। সকলেই যেহেতু এখন নাগরিক তাহলে সকলেই রাষ্ট্রের অংশ। আগে তো নাগরিক ছিল সীমিত। ফলে নাগরিকতার পরিসর এখন বিস্তৃত হয়ে সকলের মধ্যে প্রসারিত হল ।

আগে অধিকারের ধারনাটা ছিল সোশ্যাল। অধিকার গুলোকে দেখা হত ট্র্যাডিশনাল বা হিস্টরিকাল হিসাবে। এছাড়া ন্যাচারাল রাইটের ধারনা ছিল। কিছু কিছু অধিকার প্রাকৃতিক ভাবে স্বীকৃত ছিল। কিন্তু এর মধ্যে আরেকটা ধারনা আসছে তা হল ‘ইনএলিয়েনিভল’ রাইটস। অনস্বীকার্য এমন কিছু অধিকার আছে তা যখন হরণ করা হয় বা নিয়ে নেয়া হয় তখন আর রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে কেউ  অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে পারে না। এমন অধিকারের ধারনার আগমন ঘটে এই সময়কালে।

যা বলছিলাম,দাস ব্যবস্থার মধ্যে পাবলিক স্ফেয়ারে সবার অন্তর্ভুক্তি ছিল না। আধুনিক অর্থে গণতন্ত্রের মানে হল জনগণ নিজেরা সিদ্ধান্ত নিবে এবং জনগণ নিজেরাই তাদের সরকার পদ্ধতি ঠিক করবে। ইন প্র্যাকটিস আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠার পরেও আমরা দেখলাম আগে যেরকম দাস এবং স্বাধীন মানুষের  বিভাজন ছিল এখন যেন সেটাই কে সম্পত্তির মালিক কে নয় এই বিভাজনে  রূপান্তরিত ওল।  বিভাজনটা আরও বেশি তাৎপর্যময় হয়ে উঠল। আপনি নাগরিক হিসেবে এটার অন্তর্ভুক্ত কিন্তু আপনি আসলে কার্যকর ভাবে আরেকজনের মত,আরেকটা শ্রেণির মত রাজনৈতিক পরিসরে নিজের স্বর এবং নিজের উপস্থিতি নিয়ে হাজির হতে পারছেন না। ফলে সেখানে স্বর অনুচ্চ হয়ে যাচ্ছে অথবা গরহাজির হয়ে যাচ্ছে। একেই  ইটালিয়ান একজন রাজনীতিক প্রথম একটা ধারনার মধ্যে নিয়ে আসলেন যাকে বলা হয় সাবঅলটার্ন। 

ইতিহাস চর্চা কথাটার মানে কি? আমরা যখন পিছনের সময়,ঘটনা নিয়ে আলোচনা করি তখন আমরা আসলে একটা বিশেষ ধরনের স্বর জন পরিসরের মধ্যে উচ্চকিত করি। তার দ্বারাই নির্ধারণ করি কি ধরনের রাজনীতি,রাষ্ট্র,সরকার,জীবন ব্যবস্থা আমাদের থাকা দরকার। তার মধ্যে বিপুল একটা অংশের স্বর যদি না থাকে সেই স্বর উপস্থাপনের প্রয়োজন হতে পারে। এই প্রয়োজনের চেষ্টা বা দাবিটা হল সাবল্টার্নের নিয়ে  ইতিহাস চর্চার একটা মুখ্য উদ্দেশ্য। পরবর্তীতে খুব ইম্পরট্যান্ট একটা প্রশ্ন গায়ত্রী করলেন যে,আসলে কি এটা রিপ্রেজেনটেটিভ কাজ, অন্যকেও প্রতিনিধিত্ব করা? আপনি আরেকজনের হয়ে কথা বললে সেটা তো তার কথা হয় না। কিংবা কথা বললেই তো সেটা কথা হয়ে যায় না,সেটা অপরকে শুনতে হয়। স্পিকিং ইজ নট টকিং। এটা হল কথোপকথন,যখন অন্যে আপনাকে শোনে এবং রিকগনাইজ করে। যে কথা বলতে পারে এবং যার কথা অন্যে শোনে তার মানে সে অলরেডি পাবলিক স্পেয়ারে ইনক্লুডেড। তাহলে তো সে আর সাবঅলটার্ন হতে পারে না। যখন আপনি কথা বলতে পারেন তার মানে আপনার সত্তা অলরেডি হাজির এবং অপরের কাছে সেটা স্বীকৃত। যদি তাই হয় তাহলে তো আপনি আর সাবঅলটার্ন না। ক্যান দ্যা সাবঅলটার্ন স্পিক এর  মধ্যে ফিলসফিকাল  প্রশ্নটা ছিল এই। এবং এটা কি আরেকজন করতে পারবে কিনা আপনার হয়ে। ইতিহাসে আপনি তার স্বর লিখলেই তা দিয়ে তার রাজনৈতিক সত্তার উপস্থিতি নির্ধারিত হয়ে যাবে না। যদিও ডেফিনেটলি তার পক্ষে একটা মতাদর্শিক রাজনৈতিক লড়াই তৈরি হওয়ার একটা বাস্তব পরিস্থিতি ও শর্ত নির্মাণ করতে পারেন।

আমরা তাহলে আবার ফিরে যাই,রাজনীতি বলতে গ্রিক যামানায় যেটা ছিল একটা ভার্সুয়াস পাবলিক লাইফ। কিভাবে সবচেয়ে ভাল উন্নত জীবন আপনি যাপন করতে পারেন। এটাই রাজনৈতিক পরিসরের মধ্যে একে অপরের সাথে বসবাস করার লক্ষ্য। এই লক্ষ্য পরবর্তীতে ইতিহাস চিন্তার অন্য পরিবর্তনগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। গ্রিক চিন্তায় রাজনীতি এবং ইতিহাসের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক ছিল না। মানুষ মরণশীল,এই মরণশীলতাকে সে অতিক্রম করে যেতে পারে যদি সে একটা কিছুর দ্বারা নিজের অমরত্বকে নিশ্চিত করতে পারে। সেটা কিভাবে হতে পারে? মানুষ তার কীর্তি-কর্মকাণ্ডের দ্বারা অপরের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে। সে যে বিশেষ কাজগুলো করবে সেই কাজগুলোর মধ্য দিয়ে সে স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে। এমন কাজই  আসলে পলিটিকাল এক্ট। এই পলিটিকাল এক্টকেই তখন মনে করা হত যে হিস্টরিকাল এক্ট। এটাই ইতিহাস। প্রকৃতির বাইরে মানুষ নিজে যা কিছু করে,প্রকৃতির মধ্যে সে চিরদিনের জন্য যে স্বাক্ষরটা  রেখে যায় তাই তৈরি করে ইতিহাস। ইতিহাসের কোন ‘অনিবার্যতা’  ইতিহাসের কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন তখন মানুষের কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল না।

মানুষ প্রাকৃতিক জগতের মত তার ইতিহাসকে স্থায়ী করতে চায়। এ কারণে সে তাই করতে চায়,যা তাকে স্থায়ী করে তুলবে। ফলে তার কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিকতা স্থান পেতে থাকে। যা আস্তে আস্তে ইতিহাস হয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। গ্রিক চিন্তার মধ্যে মানুষ তার কর্মকাণ্ডের মধ্যে যা কিছু করে তাকে ধরে রাখার,তাকে স্মরণ করার যে চর্চা ছিল এটাই  হিস্ট্রি, ইতিহাস ধারণার সারকথা।

পরবর্তীতে প্রকৃতিকে এই যে দেখা প্রকৃতির উপস্থিতির কারণ অনুসন্ধানের মধ্যে দিয়ে চিন্তা বা দর্শনে উপস্থিতি বা সত্তার ধারনাটা কম বেশি সচল ছিল। তাহলে কোন সত্তাকে বুঝতে হলে সে যে আছে এটা বুঝা দরকার। সেটা কিভাবে বুঝব। কেন সে উপস্থিত থাকে। কি তার বিশেষত্ব। এবং কি কারণে সে অন্যের থেকে আলাদা। এটার একটা লম্বা দার্শনিক তর্ক আছে আজকে সে দিকে না যাই।

মানুষ যেভাবে ইন্দ্রিয় দিয়ে জগতকে বুঝতে চেষ্টা করে তার মাঝে একটি মৌলিক গলদ দেখা দেয়।  রেঁনেসাকালীন সময়ে যখন টেলিস্কোপ আবিষ্কার হল,সৌরকেন্দ্রিক পৃথিবীর ঘূর্ণন আবিষ্কার হল, তখন প্রশ্ন আসল যে আমাদের বাইরের জগতটা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সঠিকভাবে বা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারছি না। মহাজাগতিক যে অস্তিত্ব এটা তো ইন্দ্রিয়ে ধরা দেয় না। এখান থেকেই দেকার্তীয়ান ফিলসফির  স্কেপটিসিজমের ধারনাটা আসছে যে,ইন্দ্রিয় বৃত্তির মধ্য দিয়ে জগতকে বা  ন্যাচারকে বোঝার যে চেষ্টা এটা আসলে কাজ করবে না। ইভেন যুক্তির মধ্য দিয়ে জগতকে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। না ইন্দ্রিয় না আপনার র‍্যাশনাল  ফ্যাকাল্টি-- আপনি আসলে কখনই জগতকে বুঝতে পারবেন না। জগত কখনোই আপনার কাছে জগতের সত্য নিয়ে ধরা দিবে না। এখান থেকে পরবর্তীতে কান্ট এই চ্যালেঞ্জটা মোকাবিলা করতে গিয়ে দুইটা ভাগ করেছেন নুমেনা এবং ফেনমেনা। কতদূর জানতে পারব আর কতদূর পারব না।

তখন থেকে ইতিহাস ধারনার নতুন অর্থ তৈরি হয়। তা হল ন্যাচার বোঝা যাবে না কিন্তু মানুষ নিজে যা করে সেটা জানতে পারে। তখন ইন্টারেস্টিং একটা তর্ক আসল যে এতদিন যাবত ধরে নেওয়া হয়েছিল যে সৃষ্টি প্রক্রিয়া- এটার মধ্যে ধর্ম বিশ্বাস এবং অপরাপর অনেক জিনিস আছে,যদিও গ্রিক জগতের মধ্যে সৃষ্টি তত্ত্ব বলে কোন কিছু ছিল না। আমরা বলি যে ঈশ্বর এ জগত সৃষ্টি করেছেন। তিনি কিভাবে সৃষ্টি করেছেন আমরা কি সেটা জানি? জানি না। তখন একটা শিফট ঘটেছে কোন কিছু জানতে হলে জানতে হবে কি প্রক্রিয়ায় সেটা হয়। এখন ঈশ্বর কি প্রক্রিয়ায় জগত সৃষ্টি করেছেন এটা না জেনেও আমরা অনুমান করে নিয়েছি জগতকে জানা সম্ভব উইদাউট নোয়িং দ্যা প্রসেস অফ দ্যা ক্রিয়েশন; সৃষ্টির প্রক্রিয়া না জানলেও আপনি সৃষ্ট জিনিস সম্পর্কে জানতে পারবেন। তারপর বলছে যে এটা সম্ভব না,আপনি কোন জিনিসের সৃষ্ট হওয়ার প্রক্রিয়া যদি না জানেন তাহলে তো জানবেন না সেটা আসলে কি। এই দুটো জিনিসই আপনি পাবেন হিউম্যান ওয়ার্ল্ড যেটা হিস্ট্রির মধ্যে আছে। যেটা মানুষ নিজে সৃষ্টি করে ফলে সে জানে সৃষ্টির প্রক্রিয়াটা কি। এই প্রক্রিয়া ধারনাটা আসছে আসলে নেচারের মধ্যে থেকে; সেটা হল নেচারকে একটা প্রসেস আকারে দেখা। এটা প্রতিনিয়ত একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পুনরাবৃত্ত হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া না জানলে জানা সম্ভব না। মানুষ একমাত্র বুঝতে পারে সে যা করে। এরপর থেকে হিস্ট্রি বলতে পুরো জিনিসটা ঘুরে গিয়ে আসল মানুষের কৃতকর্মকান্ড যে প্রক্রিয়ার মধ্যে ঘটে সে প্রক্রিয়াটাকে প্রকৃতির মত প্রক্রিয়া আকারে বোঝা, এটা হল হিস্ট্রি বোঝা।

ইতিহাসের আরেকটা ধারনা আছে,মুক্তির ধারনা যেটাকে বলা হয়। জুদাইজমের মধ্যে ধারনাটা প্রথম আসে। একটা দাসত্বের মধ্যে তারা যেহেতু লম্বা সময় ছিল ফলে তারা সবসময় প্রত্যাশা করত যে একজন আসবেন যিনি মাসাইয়া। যিনি এসে তাদেরকে মুক্ত করবেন। তাদের কাছে কনসেপ্ট অফ টাইমের ভিন্ন একটা ধারনা ছিল। তারা প্রহর গুনতেন একটা অনাগত সময়ের। এটা ভবিষ্যৎকাল না, অনাগত যে সময় আসে নি,যা আসবে। এ অনাগত সময়ের অপেক্ষার একটা যে ধারনা ছিল এ ধারনাটার সাথে মুক্তির একটা ধারনা আছে। এ মুক্ত হওয়ার মধ্যে দিয়ে তার দাসত্বের পরিসমপ্তি ঘটবে। এটা খ্রিস্টীয় চিন্তার মধ্যে এসে আরেকটা নতুন মোড় নেয়। এই ধর্ম চিন্তার মধ্যে সৃষ্টি আছে ফলে এর একটা উদ্দেশ্য আছে। ঈশ্বর একটা উদ্দেশ্য নিয়ে জগত সৃষ্টি করেছেন এবং এই উদ্দেশ্য পূর্ণতা লাভ করবে। তখন আবার এই জগতের বিলয় ঘটবে। যেখানে আমরা জানি আখেরাতের ধারনা আছে,জাজমেন্টের ধারনা আছে। এটাকে বলা হয় ‘সটোরিওলজিকাল’। এই জগত সৃষ্টি এবং পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর মানুষের মুক্তির একটা উদ্দেশ্য নিহিত রেখেছেন। তা এই যে এর মধ্যে দিয়ে যে নিহিতার্থটাকে পূর্ণতা দেয়ার জন্য ঈসা মাসীহ এসেছেন। ফলে জগতের এই যে সূচনা এবং পরিসমাপ্ত হওয়ার মধ্যে দিয়ে মানুষের মুক্ত হওয়া। এটা খ্রিস্টানিটি আর জুদাইজমের মধ্যে ছিল, কিন্তু খুব ইন্টারেস্টংলি দেখেন সৃষ্টির ভাবনাটা ইসলামের মধ্যে থাকলেও ইসলামে কিন্তু এরকম কোন মানব মুক্তির ধারনা আছে আমার জানা নাই।

ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করেছেন এবং জগত পরিচালনার একটা উদ্দেশ্য আছে। এটার মধ্যে অর্ডার প্রতিষ্ঠা করেন এবং জেসাসের মাধ্যমে তিনি মিনিস্ট্রিয়াল রূপটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই যে ডিভাইন যে গভর্নেন্সটা এটার যে মিনিস্ট্রিয়াল রোলটা সেটা হল জেসাসের। যেখান থেকে চার্চের ধারনাটা পরে বিকশিত হয়েছে। যেখান থেকে এ কারণে পাবলিক অফিস,এই যে সার্ভিস। মিনিস্টাররা কি করে- দে গিভ সার্ভিস। কাকে সার্ভ করে এবং চার্চের সম্পর্কটা কি? কেন চার্চের সাথে যুক্ত থাকতে হয়। এ নোশনগুলো আস্তে আস্তে বিকশিত হয়েছে আধুনিক ধারনার মধ্যে।

ইতিহাসের ধারনার মধ্যে যদি আমরা ফেরত যাই তাহলে দেখব,আধুনিক যামানায় যখন মানুষ নিজেই তার নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা,নিজে যা সৃষ্টি করে এবং সৃষ্টি করার মধ্যে দিয়ে নিজেকে জানতে হয়। এর আগে মানুষের কর্মকাণ্ডের মধ্যে কোন অনিবার্য যোগসূত্র চিন্তা করা হত না। বলা হত মানুষের কর্মকাণ্ড হল এমন যে,আপনি ন্যাচারাল কোন প্রসেসকে প্রেডিক্ট করতে পারেন,কারণ এটা রিপিট করে কিন্তু হিউম্যান এক্ট আনপ্রেডিকটেবল। এটা পরে কি ফল দেবে আমরা বলতে পারি না। পলিটিকাল এফেয়ার্স বা হিউম্যান এফেয়ার্সের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যটা ছিল। কিন্তু প্রক্রিয়া আকারে যখন এটাকে বোঝা হল মানুষের কোন কর্মকাণ্ডকে তখন আর আলাদা করে দেখা হল না। হিস্ট্রিকে দেখা হচ্ছে এটা একটা ক্রমাগত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে যে প্রক্রিয়ায় একটা অনিবার্য ধরণের যোগসূত্র আছে। একটা আগের ঘটনা পরের ঘটনার জন্য নির্ধারক কারণ হিসেবে উপস্থিত হচ্ছে। কারণের ধারনাটা এখানে এসে যুক্ত হয়েছে। প্রকৃতির মধ্যে কজালিটি আছে যেটাকে আমরা বলি ন্যাচারাল ল,হিস্ট্রি যদি একটা প্রসেস হয় তাইলে হিস্ট্রির একটা ল থাকবে সে ল হল কজালিটি। কজালিটি হল একশন ইজ ডিটারমাইন বাই দ্যা প্রিভিয়াস একশনস। ফলে ইতিহাস বোঝা মানে মানুষের কোন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক্ট আকারে না,ইভেন্ট না বরং এটা একটা প্রক্রিয়া আকারে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মানুষ নিজে যা করে সেটা হল ইতিহাস নির্ধারিত একটা রোল প্লে করা – এমন ধারণা।

ইতিহাসের এই বোঝাপড়াটা রাজনীতির ক্ষেত্রে যে ধারনাটা নিয়ে আসে তা হল মানুষের ঐতিহাসিক কর্তব্য নির্ধারিত হয় এই প্রক্রিয়ার অধীনস্থ হয়ে। ফলে মানুষ রাজনৈতিক হবে কি হবে না,তা নাকি আসলে ‘হিস্টরিকালি ডিটারমাইন্ড’। এইখানে এসে আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে মার্কসবাদী  চিন্তার যোগসূত্রটা কোথায়। এর সুবিধা এবং সীমাবদ্ধতার জায়গাটা কোথায়। পরে আমাদেকে এইদিকে ফিরে আসতে হবে। আজকে আপাতত এটুকুই।         


নিজের সম্পর্কে লেখক



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।