ভব নদী

'মাঝি, আর কতো দূর?' এই নিয়ে কমপক্ষে সাতবার এই প্রশ্নটা করলাম। মাঝি ফিরেও তাকালো না। আপন মনে আপন কাজে ব্যস্ত। এমন নদী আর দেখি নাই। কূল কিনারার কোন নির্দেশ নাই। চলছি তো চলছি। এ যেন অকূল দরিয়া। মাথার উপর দ্বি প্রহরের সূয্য। কোন তেজ টের পাওয়া যায় না। নদীর জল ঠিকরে আলো পড়ে চোখে। চোখ ধাঁধিয়ে আসে। ছৈয়ের ভেতর শুয়ে শুয়ে চোখ ধাঁধানো জলের নকশা দেখতে দেখতে.. চমৎকার একখানা বাগান। নন্দন কানন। বসন্তী বাতাসে ফুলের সুবাস। কিছু মানুষের জটলা দেখা যাচ্ছে। শুনতে পেলাম কে যেন বলছে 'সে এসে গেছে'। কে? একজন চমৎকার যুবাপুরুষকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। স্মিত হাসি মাখা কোমল কান্তি মুখ। কেউ কিছু বলছে না। মনে হয় নিরবতায় এইখানকার ধর্ম। আমি বললাম ' আপনি কে?' কে যেন বলে উঠল, 'চুপ চুপ।' সে হাসি মুখে তাকিয়ে রইল, নিরত্তর। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, 'কে আপনি?' আবারও। তিনি বললেন, 'আমি কেউ না।' চারপাশ থেকে অদৃশ্য কেউ একটানা ফিসফিস করে বলছে, 'আমি কেউ না, আমি কেউ না, ..।' আমি ভয় পেয়ে বললাম, 'মাফ করুন, আমি বুঝি নাই।' তিনি বললেন, 'তুমি কে?' কে যেন আমার ভেতর থেকে বলল, 'বল, আমিই তুমি।' দেখলাম, উপস্থিত সবার চেহারা আমার মতো হয়ে গেছে। আমি ভয় পেয়ে পালাতে গিয়ে দেখি, মাটি থেকে পা সরছে না। অদৃশ্য কিছুতে আটকে গেছে। আমি সর্বশক্তিতে পা তোলার চেষ্টা করলাম। আবার প্রশ্ন করল, 'তুমি কে?' আমি বললাম, 'আমিই তুমি।' সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসল। আমি একা। সেই বাসন্তী সুবাস। কোন ফিসফিসানী নাই। সামনে জলে টলমল সরোবর। হাত মুখ ধুয়ে নিই। সরোবরে ঠান্ডা জলে হাত দিতে ভয় পেয়ে গেলাম। একি জলে কোন প্রতিবিম্ব নাই.. 'মাঝি, আর কতো দূর?' মাঝির মুখে যেন অস্পষ্ট হাসি খেলে গেল। আমি ঠিক দেখেছি তো! এই যাত্রায় এই প্রথম তার মুখে কোন ভাব দেখা গেল। আমি বললাম, 'তুমি কে?' মাঝি চুপ করে রইল। আমি ভয়ে ভয়ে জলের কাছাকাছি মুখ নামিয়ে আনলাম। না ঠিক আছে। এই তো জলের স্রোতে আমারি প্রতিবিম্ব। আমি আবার মাঝির দিকে তাকালাম। আবার সেই হাসি। মাঝি বলল, 'আপনার রব কে?' আমি বললাম, 'আল্লাহ!!' 'আল্লার নাম নেন, দরিয়ায় তুফান আইবো।' কি অদ্ভুত কথা। কোথাও মেঘের চিন্হ নাই। রোদে ঝলমল চারদিক। মাঝির দিকে তাকালাম। সে ভাবলেশহীন মুখে তার কাজ করে যাচ্ছে। পাল গুটিয়ে নিলো। আস্তে আস্তে রোদ উধাও হয়ে তার জায়গা ঠাই নিলো কালো মেঘ। চারদিকে বেজায় অন্ধকার। তুমুল বাতাস। নদীর শান্ত পানি সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বিশালকার ধারন করেছে। প্রচন্ড তর্জন গর্জন। ঢেউয়ের আঘাতে নৌকাটা ভীষণভাবে এইদিক ওদিক করছে। শক্ত করে নৌকার কিনারা ধরে আছি। সে ভীষণ ঝড়ের কোন বর্ণনা নাই। শুধু আল্লাহকে ডাকছি... চমৎকার একখানা বাগান। নন্দন কানন। বসন্তী বাতাসে ফুলের সুবাস। কিছু মানুষের জটলা দেখা যাচ্ছে। শুনতে পেলাম কে যেন বলছে 'সে এসে গেছে'। একজন চমৎকার যুবাপুরুষকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। স্মিত হাসি মাখা কোমল কান্তি মুখ। কেউ কিছু বলছে না। নিরবতায় এইখানকার ধর্ম। আমি তার হাত ধরলাম। না আমি কারো হাত ধরিনি। একা একা সে শীতল বাগানে ঘুরলাম। জন-মানব এ স্থান আমার ভালো লাগে না.. 'মাঝি, এটা কি নদী?' আমি লোকটির দিকে তাকালাম। বললাম, 'ভব নদী।' 'আমারে পাড় করতে কতো নিবা?' 'আপনার কাছে দেবার মতো কিছু থাকলে দেবেন, নয়তো বিনা পয়সায় পাড় করাইয়া দেবো।' তার চেহারায় লোভের ভাব দেখা গেলো। ভাবছে বিনা ভাড়ায় পার হওয়ার সুযোগ পাওয়া গেলো। আমি নৌকা ছাড়লাম। 'মাঝি, আর কতো দূর?' শুনতে পেলাম লোকটা কিছু বলল.. লেখাটি somewhere in blog - এ পূর্বপ্রকাশিত।


নিজের সম্পর্কে লেখক

ইচ্ছেশূন্যতার কোন অর্থ হয় না। মানুষ নিজেই ইচ্ছের রূপান্তর। তার বাসনাগুলো নানারূপে অধরাকে ধরে, অনুধাবন করে। একই সাথে সে নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। এই চাওয়া-না চাওয়ার কি ঘটে সেটা কথা নয়। কথা হলো, তাকে চাইতে হয় আবার চাওয়াটাকে অস্বীকার করতে হয়। এই স্বীকার-অস্বীকারের দ্বন্ধে যেটুকু আশা বেঁচে থাকে তাকে বলি, এই তো আছি। এই বেঁচে থাকাটাই আনন্দের।

ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।