কারাগার নিয়ে কিছু কথা

কারাগারের শুরু হিসেবে বিবেচনা করা যায়, যখন রাষ্ট্র 'সামাজিক সংগঠন' এর রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে।লিখিত ভাষার কল্যাণে কিছু 'লিগ্যাল কোডস' সমাজের গাইডলাইন হিসেবে আকার লাভ করে।  সর্বাধিক পরিচিত লিগ্যাল কোড ' The Hammurabi' আইন ভঙ্গের অপরাধে প্রথম শাস্তির ধারনা উপস্থাপন করে।
প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকরা, যেমন প্লেটো, অপরাধীকে 'সংশোধন বা পুনর্বাসন' এর ধারনা দেওয়া শুরু করেন। সেসময়ে যারা জরিমানা দিতে অক্ষম,তাদের কারাগারে রাখা হত।
রোমানরা প্রথম কারাগারকে বন্দি করে রাখার পরিবর্তে শাস্তি প্রদানের রূপ হিসেবে ব্যবহার করে।
মধ্যযুগে শাস্তির বিভিন্ন ধারনা প্রচলিত ছিল,যেমন মৃত্যুদণ্ড,দেহের কোন অঙ্গ কর্তন, চক্ষু লজ্জা দেওয়া ইত্যাদি। যারা বিচারাধীন ছিল অথবা শাস্তিভোগের অপেক্ষামান ছিল, তাদেরকে কারাগারে রাখা রাখা হত।
ভারতীয় উপমহাদেশে রাজা অশোকের সময়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামিকে তিনদিন কুটিতে বেঁধে রাখা হত। এরূপ নিয়ম জমিদারি  ব্যবস্থাপনায় ও ছিল।

 আধুনিক কারাগারের ইতিহাসের দিকে তাকালে ১৫৫২ সালে ইংল্যান্ডের 'St Briget well' কে প্রথম কারাগার হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।  রাষ্ট্রীয়,সামাজিক প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষিতে ১৫৯৭ সালে ব্রিটেন আরো কয়েকটি কারাগার খোলে। .১৬০০ সালে প্রত্যেক কাউন্টিতে কারাগার নির্মাণের নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৮১২ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম 'Milk Bank' জাতীয় কারাগার প্রতিষ্ঠিত হয়।যুক্তরাষ্ট্র ১৭৯০ সালে ফিলাডেলফিয়া অংরাজ্যে 'Wal Nut St. Jail' প্রথম রাষ্ট্রীয় কারাগার নির্মাণ করে।
 
আধুনিক সময়ে কারাগার নিয়ে দুটি থিওরি বিকাশ লাভ করে। একটি Utilitarianism  এবং Rationalism  এর উপর ভিত্তি করে বলে, কারাগারের উদ্দেশ্য হবে ভয় দেখানো এবং শাস্তি প্রদান ;যাতে কেউ কারাগারে যাওয়ার ভয়ে অপরাধ না করে।অন্যটি ধর্মীয় মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে কারাগারকে  'নৈতিক সংস্কার অথবা পুনর্বাসন' হিসেবে উপস্থাপন করে ;যাতে বন্দি মুক্তি লাভ করে সংশোধিত এবং মনুষ্যত্ব নিয়ে সমাজে ফিরে আসতে পারে।
কারাগার ছাড়াও আরো কিছু নাম আছে।গাউল,জেল,দ্য বিগ হাউজ,দ্য স্লামার, দ্য স্ল্যামার এবং দ্য স্টোনি লোনসাম নামেও কারাগার পরিচিত।

বর্তমান সময়ে কারাগারে নির্যাতন চরম আকার ধারন করেছে। মানসিক ও শারীরিক সব ধরনের নির্যাতন চলে কারাগারে।চোখ বন্ধ করে বেধড়ক পিটানো,উলঙ্গ করে গরম পানি ঢালা আবার সাথে সাথে ঠাণ্ডা পানি ঢালা, গোপনাঙ্গে ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া,মাসের পর মাসের পর অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রাখা,নখ উপড়ে ফেলানো,প্রশিক্ষিত কুকুর লেলিয়ে দেওয়া ইত্যাদি নির্যাতন করা হয়।এক্ষেত্রে আমরা কিছু কারাগারের উদাহরন দিয়ে দেখব।

'গুয়ানতানামো বে কারাগার' আধুনিক সভ্যতার নির্লজ্জ কলংক। এমন কোন টর্চার নেই যা এখানে করা হয়না। মূলত মুসলিম বন্দিদের এখানে রাখা হয়। প্রশিক্ষিত কুকুর দিয়ে কামড়ানো,অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ, মানসিক ও দৈহিক নির্যাতন, ধর্মীয় গ্রন্থ ও প্রার্থনার চরম অবমূল্যায়ন, আট দশজনকে একিসাথে Homo-sex করতে বাধ্য করা ইত্যাদি সব নির্যাতনই চলে এ কারাগারে। 'Road to Guantanamo' মুভিতে এসব চিত্র ফুটে উঠেছে ।
'আবু গারিব কারাগার'। এখানে উলঙ্গ করে অনবরত ঠাণ্ডা পানি ঢালা, ইলেকট্রিক শক দেওয়া,নানা অমানুষিক নির্যাতন করা হয়।  আবু গারিব কারাগার নিয়ে 'Boys Abu Garib' নামে একটা ভাল মুভি আছে। ।
থাইল্যান্ডের 'ব্যাংকক কারাগার' পৃথিবীর অন্যতম নিকৃষ্ট কারাগার  । এখানে বন্দিদেরকে  প্রথম তিন মাস লোহার শিকল পরিয়ে রাখা হয়।
'উত্তর কোরিয়ার ক্যাম্প ২২' ।রাজবন্দিদের রাখা হয়। রাজনৈতিক বিরোধী ও প্রতিবাদী পরিবারের তিন প্রজন্মকে কারাগারে রাখা হয়, যাতে তারা সমূলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।   বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল উইপনস  যেমন অ্যানথ্রাক্স বন্দিদেরকে দিয়ে নিরীক্ষণ করা হয়।
রাশিয়ার হোয়াইট লেকে অবস্থিত 'পেটাক আইল্যান্ড কারাগার'। যেখানে রাজবন্দিদের চরম নিঃসঙ্গ অবস্থায় রাখা হয়। প্রবল ঠাণ্ডা ও তুষারপাত থেকে রক্ষা পেতে কোন ব্যবস্থা রাখা হয়না।

স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর কারাগারগুলো অত্যন্ত ভাল ও সুযোগসুবিধা সম্পন্ন।নরওয়ের 'বাসটা প্রীজন', 'হালডেন প্রীজন', সুইডেনের 'সলেনতুনা প্রীজন'অন্যতম আধুনিক কারাগার।এসব দেশ সত্যিকার অর্থে 'সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার স্টেট'। এখানে বন্দিদের রাখা হয় সংশোধনের জন্য, শাস্তি প্রদানের জন্য নয়।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিকে কারাভোগ করতে হয়েছে।ইমাম আবু হানীফা, আহমদ ইবনে হাম্বল, ইবনে তাইমিয়া,আবুল আলা,সাইয়েদ কুতুব, মারটিন লুথার কিং,নেলসন ম্যান্ডেলা,থমাস মুর, ফিদেল ক্যাস্ট্রো,আনে ফ্রাঙ্ক,জেরি আডামস,এলিজাহ মুহাম্মদ,সাইয়েদ নুরসী।

কারাজীবন যদিও বিষণ্ণতা ও কষ্টে পরিপূর্ণ তথাপি পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত মনীষীগণ এখানে বসে তাদের শ্রেষ্ঠ কর্মগুলো উপহার দিয়েছেন। সাইয়েদ কুতুব কারাগারে থেকে তার বিখ্যাত 'তাফসিরে ফী যিলালিল কুরআন' রচনা করেছেন।অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা তার বিখ্যাত আত্মজীবনী 'Long Walk To Freedom' রোবেন দ্বীপের কারাগারে বসে লিখেছেন। বর্ণবাদ বিরোধী নেতা মারটিন লুথার কিং লিখেছেন,'Letter From Birminghum Jal' ; যা পরবর্তীতে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের পথ সুগম করেছে। অ্যাডলফ হিটলার লিখেছেন 'ম্যাইন ক্যাম্পফ'।ইতালির বিখ্যাত দার্শনিক Boethius 'Consolation Of Philosophy'  কারাগারে থেকে রচনা করেছেন । মারকো পোলো লিখেছেন 'Travels'।

কারাগার নিয়ে কিছু অসাধারন বই আছে। The shawshank Redemption,A Life Inside:A Prisoner's Notebook,Midnight Express, A Prisioner's Diary, Life After Death,.কারাগারে রাতদিন।

কারাগারের একটা বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি ছিল সংশোধনগার হিসেবে। এটা এমন একটা স্থান যেখানে ব্যক্তি কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হবে,সংশোধন হবে, সমাজের জন্য নিজেকে গড়ে তোলার অনুপ্রেরনা
পাবে। সময়ের পরিবর্তনে কারাগার এখন সংশোধনের স্থান না ,শাস্তিভোগের জায়গা।
বন্দিদের সাথে ভাল ব্যবহার করা, নৈতিক প্রশিক্ষণ দেওয়া যাতে তারা সংশোধিত হতে পারে, ভারতের তিহার কেন্দ্রীয় কারাগারের মত করে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাতে তারে মুক্তির পর সমাজের কাজে আসতে পারে,নৈতিক উন্নতি বিবেচনায় কারাদণ্ড লাঘব করা ইত্যাদি সংস্কারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি ।বদর যুদ্ধের বন্দিদের সাথে ব্যবহার এক্ষেত্রে অনুকরণীয় আদর্শ।


নিজের সম্পর্কে লেখক



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।