ডলার আধিপত্যের দিন শেষ হতে চলেছে। ড. রন পল*

ডলার আধিপত্যের দিন শেষ হতে চলেছে। ড. রন পল* (২০০৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে দেয়া বক্তৃতা) ------------------------------------------- তরমজা: মোহাম্মদ আরজু ------------------------------------------- শত বছর আগে এটাকে ‘’ডলার কূটনীতি’ বলা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের, বিশেষত ১৯৮৯ তে সভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ওই নীতি ‘ডলার আধিপত্য’ হিশাবে নয়া রুপ পেল। কিন্তু বিশাল কামিয়াবির অনেকানেক বছর পার করে এখন আমাদের ডলারের আধিপত্য খতম হতে চলেছে। এককালে যথার্থই বলা হতো-- যার আছে স্বর্ণভান্ড, তার কাছে রাজদন্ড। সাফসাফ ও সৎ বাণিজ্যের বেলায় ‘প্রকৃত মূল্য’ সম্পন্ন বস্তুর বিনিময়ের প্রয়োজনীয়তা সেই আগেকার সময়ে কবুল করে নেয়া হয়েছিল। একদম শুরুতে এটা ছিল স্রেফ দ্রব্যাদির বিনিময়। তারপর আবিস্কৃত হলো যে স্বর্ণের সর্বজনীন আকর্ষণ আছে, এবং ভার-ভারিক্কি দ্রব্য বিনিময় ব্যবস্থার বদলি হিশাবে এটা সুবিধাজনক। দ্রব্য ও সেবার বিনিময়ের সুবিধে করে দিল স্বর্ণ, পাশাপাশি যারা দুর্দিনের জন্য সঞ্চয় করতে চাইতো তাদের জন্য স্বর্ণ মূল্যের মজুদ হয়েও থাকতে পারে। ওদিকে বাজারে স্বাভাবিকভাবেই অর্থ ক্রমান্বয়ে বিকশিত হতে থাকলো। ক্ষমতার ওপর সরকারের দখল বাড়ার সাথে সাথে তারা অথের্র ওপর একক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে বসলো। স্বর্ণের গুণগত মান এবং ভেজালমুক্ততা নিশ্চিতকরণে সরকারগুলো কখনো কখনো সফল হলেও, এটা নিয়ে তারা খুশী ছিল না। একসময় তারা নিজেদের রাজস্ব আয় বাড়ানোর অন্য উপায় শিখে ফেললো। নতুন কর আরোপ কিংবা করের হার বৃদ্ধি সবসময়ই জনগণকে নাখোশ করে-- সুতরাং রাজ-রাজড়ারা শিখলো যে কিভাবে প্রতিটি চাকতির স্বর্ণের পরিমাণ কমিয়ে নিজেদের মুদ্রার পরিমাণ স্ফীত করা যায়। তারা ভাবতো প্রজারা ওই প্রতারণা ধরতে পারবে না-- কিন্তু প্রজারা প্রতিবারই বুঝে ফেলতো এবং অভিযোগ করতো। এমনতরো অবস্থায় দেশগুলোর নেতারা স্বর্ণ তালাশে নেমে পড়লেন। আরো বেশি পরিশ্রম করে আরো বেশি উৎপাদন করার যৌক্তিক বিকল্প হয়ে দাঁড়ালো-- অন্য জাতিগুলো পরাজিত করে স্বর্ণ সংগ্রহ করে বাড়-বাড়ন্ত অর্থের যোগাড় করা। বিজয়ী জাতিগুলো অবশ্য শুধু স্বর্ণই নিয়ে আসতো না, একই সাথে তারা স্বদেশে নিয়ে আসতো দাসদের। তাছাড়া বিজিত অঞ্চলসমূহের জনগণের কাছ থেকে আদায়কৃত কর সাম্রাজ্য নির্মাণের পথে ভালো আর্থিক যোগান দিত। একটা সময়ে এই সরকারপদ্ধতি ভালোই কার্যকর ছিলো, কিন্তু এতে করে লোকেদের নৈতিক অবক্ষয়ের ফলে তারা নিজেদের জন্য নিজেরা উৎপাদন করতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়লো। সম্পদের মালিক হওয়ার অপরাধে (!) শোষণ করা যায় এমন দেশের সংখ্যা ছিল সীমিত, এবং সম্পদশালী দেশের এই সংখ্যাল্পতার কারণে সবসময়ই সাম্রাজ্যসমূহের খেল খতম হয়ে যেতো। যখন আর স্বর্ণ পাওয়া যেত না, তখন সাম্রাজ্যের সমরশক্তি ভেঙ্গে পড়তো। ওইসব দিনে যাদের কাছে জমাকৃত স্বর্ণ ছিলো, সত্যিকার অর্থে তারাই শাসনব্যবস্থার মালিক ছিলো, তারাই আইন কানুন বানাতো, এবং বহাল তবিয়তে থাকতো। যুগের পর যুগ ধরে এই সাধারণ নিয়ম এর উল্টোটা ঘটে নি। যখন স্বর্ণ বিনিময়ের মাধ্যম হিশাবে ব্যবহৃত হতো এবং আইন-কানুন সৎ বাণিজ্যের সুরক্ষা দিতো, তখন উৎপাদনশালী দেশ বিস্তার লাভ করতো। যখনই সম্পদশালী জাতিসমূহ-- যাদের শক্তিশালী সব সেনাদল ও স্বর্ণসম্ভার ছিলো-- যারা শুধু সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে এবং নিজের দেশে কল্যানমূলক খরচ করতে ব্যতিব্যস্ত ছিলো-- তারা জাতি হিশাবে ব্যর্থ হতে লাগলো। নীতিসমূহ আজও আগের মতোই আছে, কিন্তু প্রক্রিয়া একেবারেই বদলে গেছে। স্বর্ণ আর মুদ্রা নয়, মুদ্রা হচ্ছে কাগজ। অন্তত এই সময়ের জন্য সত্য হচ্ছে, ‘যে টাকা ছাপায় সে শাসন করে’। স্বর্ণের ব্যবহার না থাকলেও আর্থিক লাভালাভের প্রশ্ন আগের মতোই আছে; অন্য দেশগুলোকে উৎপাদন করতে এবং তাদের সামরিক শক্তি কমাতে বাধ্য করো এবং নিজেদের মুদ্রাব্যবস্থার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ কমাও। যেহেতু কাগুজে মুদ্রা হলো স্রেফ প্রতারণা, ‘প্রকৃত মূল্যহীন’, সুতরাং যেই দেশ আর্ন্তজাতিক মুদ্রার মালিক হবে সেই দেশের অবশ্যই প্রচুর সামরিকশক্তি থাকতে হবে যাতে করে পুরো ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখা যায়। কার্যত বিশ্ব-মুদ্রা বলতে যা বোঝায়, সেই মুদ্রার মালিক দেশের জন্য এটা একটা চমৎকার প্রকল্প-- চিরস্থায়ী বিত্ত কামাইয়ের জন্য লাগসই পদ্ধতি। তারপরও একটা মুশকিল হচ্ছে, এমনতরো পদ্ধতি ওই জাতির লোকেদের চরিত্র ধ্বংস করে দেয়-- ঠিক সেই সময় যেমনটি হতো যখন মুদ্রা ছিলো স্বর্ণ এবং ওই মুদ্রা অর্জন করতে হতো অন্য জাতিগুলো পরাজিত করে। এই পদ্ধতি একই সাথে সঞ্চয় ও উৎপাদনের তাগিদ নষ্ট করে দেয় এবং ধারদেনা করাকে উৎসাহ যোগায়। কাগুজে টাকা দিয়ে যখন দ্রব্যাদি পাওয়া কষ্টকর হয় অথবা যখন স্বর্ণ ফুরিয়ে আসে তখন সম্পদ ও রাজনীতি দুয়ের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়। তারপর ওই দেশটি নিজস্ব সামর্থ্যরে অতিরিক্ত জীবন যাপন থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। ওই দেশটিতে জীবন যাপন কষ্টকর হয়ে ওঠে। অন্তত যতক্ষণ না অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নতুন নিয়ম কানুুনের সাথে তাল মেলাতে পারে। উল্লেখ্য, যারা তখনো অকার্যকর মুদ্রাব্যবস্থা চালায় তাদের নিয়মে আর দেশ চলে না। ল্যাটিন আমেরিকা ও দূর প্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে উইলিয়াম হাওয়ার্ড ট্যাফট ও তার প্রতিমন্ত্রী ফিল্যান্ডার সি নক্স ‘ডলার কূটনিতি’র নকশা সাজিয়েছিলেন। পরে ম্যাককিনলে ১৮৯৮ সালে স্পেনের বিরুদ্ধে রীতিমত একটা যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিলেন। দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ সুরক্ষিত রাখতে রুজভেল্টের মনরো ডকট্রিনের আগেভাগে ট্যাফ্ট কর্তৃক একই সাথে ডলার ও কূটনীতির আগ্রাসী ব্যবহার ‘ডলার কূটনীতি’ নামে পরিচিত হয়। ট্যাফ্ট এর বাতলানো উপায়ের মধ্যে রুজভেল্ট যে বদল ঘটালেন তার মর্তবা দাঁড়ালো এই যে, স্রেফ ‘উপস্থিতি’র মাধ্যমে তখন বিভিন্ন দেশে আমদের হস্তক্ষেপকে ন্যায্যতা দেয়া গেলো। মানে যেসব দেশে আমাদের স্বার্থ আছে বলে আমরা ধার্য করেছি সেসব দেশ-- ইওরোপীয়ান নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে নিরাপদ নয়-- এটা বলে সেসব দেশে আমরা কেবল অধিকারই দাবি করি নি, বরং আমরা ইওরোপীয়দের হাত থেকে আমাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আনুষ্ঠানিক ‘বাধ্যবাধকতা’ আছে বলে পর্যন্ত দাবি করেছি। এই নয়া নীতি বিগত উনিশ শতাব্দির ‘গানবোট’ কূটনীতির দাঁড়ানোর জায়গা তৈয়ার করে দিলো, যার মানে হচ্ছে বলপ্রয়োগের হুমকির আশ্রয় নেয়ার আগে আমরা অসামরিক প্রভাব খাটাবো। ততদিনে উইলিয়াম হাওয়ার্ড ট্যাফ্ট এর ‘ডলার কূটনীতি’র বীজ অনেক গভীরে পৌঁছেছে, আমেরিকান সাম্রাজ্যের বীজমালা বপন করা হয়ে গেছে। ওইসব বীজ এমন এক দেশের উর্বর রাজনৈতিক জমিনে জন্মানোর নসিব পেয়েছে, যে দেশটি সংবিধান প্রণেতাগণ কর্তৃক আমাদের জন্য রচিত প্রজাতন্ত্রের প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা হারিয়েছে। সত্যি সত্যিই বীজগুলো জন্মালো, বেড়ে উঠলো। ডলার ‘কূটনীতি’ যখন ডলার ‘আধিপত্য’ হয়ে উঠলো এটা তো খুব আগের কথা নয়, বিংশ শতাব্দির দ্বিতীয় ভাগের কথা। মুদ্রা নীতির নাটকীয় পরিবর্তনের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া ডলারের নিজস্ব আচরনের ধরণও এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে। কংগ্রেস ১৯১৩ সালে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম চালু করে। এরপর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত নিরাপদ মুদ্রা’র নীতি পদ্ধতিগতভাবেই অবহেলা করা হয়েছে। এই পুরোটা সময়জুড়ে যুদ্ধে অর্থের যোগান দেয়া ও অর্থনীতিকে নিজেদের ইচ্ছেমতো চালানোর জন্য খুব সহজ একটি কাজ করেছে ফেডারেল রিজার্ভ-- তারা যখন ইচ্ছে তখনই বাজারে মুদ্রা সরবরাহের পরিমাণ বাড়িয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর্ন্তজাতিক মুদ্রাবাজারে ডলারের মুরব্বিয়ানা একলাফে বহুগুণ বেড়ে যায়। আমরা দুনিয়ার অনেক দেশে বিধ্বংসী হামলা চালাই, ওই দেশগুলো দুর্ভোগের শিকার হয়, কিন্তু তাদের স্বর্ণে আমাদের সিন্দুকগুলো ভরপুর হযে ওঠে। কিন্তু কোনো দেশ স্বর্ণমান ভিত্তিক পদ্ধতিতে ফিরতে আগ্রহী হয় নি, আমাদের রাজনিতীকরা তাদের এই অবস্থানের প্রশংসা করেছিলেন। দেনা পরিশোধের লক্ষ্যে কর আদায় করা কিংবা অপ্রয়োজনীয় খরচ নিয়ন্ত্রণের চেয়ে কাগুঁজে মুদ্রা ছাপানোর সিদ্ধান্ত তখন অনেক জনপ্রিয় হয়েছিল। তাতে করে অল্প মেয়াদে উপকার পাওয়া গিয়েছিল সত্য কিন্তু দশকের পর দশক ধরে এই ভারসাম্যহীনতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল। ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস চুক্তিতে ব্রিটিশ পাউন্ডের বদলে দুনিয়ার প্রধানতম রিজার্ভ মুদ্রা হিশাবে ডলারকে ধার্য করা হয। মূলত আমাদের রাজনৈতিক - সামরিক শক্তি ও আমাদের হাতে থাকা প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণের প্রতি খেয়াল রেখেই দেশগুলো ডলারের পক্ষ নেয়। প্রতি ৩৫ ডলার হচ্ছে ১ আউন্স স্বর্ণের সমমূল্য- এই হারে। ডলারকে বলা হলো ‘স্বর্ণের মতো সুবর্ণ’ এবং ১/৩৫ হারে দুনিয়ার যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলার বিনিময়ের সুযোগ হলো। স্বর্ণ বিনিময়ের এই ১/৩৫ হার থেকেই পতনের যাত্রা শুরু হলো। সবাই যা আন্দাজ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ঠিক তা-ই করলো। বিপরীতে কোনো স্বর্ণ গচ্ছিত না রেখেই সে ডলার ছাপাতে থাকলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৯৬০ সালে নতুন প্রশ্ন না ওঠানো পর্যন্ত দুনিয়া ওই ডলারের ওপর রাজি-খুশি ছিল। ১৯৬০ সালে ফ্রান্স এবং আরো কয়েকটি দেশ দাবি করলো; আমাদের ট্রেজারিতে তাদের জমা দেয়া প্রতি ৩৫ ডলারের বদলে ১ আউন্স করে স্বর্ণ দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি আমরা দিয়েছিলাম তা যেন আমরা পূরণ করি। ওই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে গিয়ে প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণ বাইরে চলে গেল এবং এর ফলে খুব দুর্বলভাবে সাজানো ‘কাল্পনিক স্বর্ণমান’ ব্যবস্থা শেষ হতে চললো। ১৯৭১ এর ১৫ আগস্ট ওই ব্যবস্থার সমাপ্তি ঘটলো। নিক্সন সেদিন স্বর্ণ বিনিময় বন্ধ করে দিলেন এবং খাজাঞ্চিতে অবশিষ্ট ২৮০ মিলিয়ন আউন্স স্বর্ণ হতে আর কোনো পাওনা পরিশোধ করতে অস্বীকার করলেন। যে অস্বীকৃতির সার কথা হলো; আমরা আমাদের অস্বচ্ছলতা ঘোষণা করলাম এবং সব দেশই উপলদ্ধি করলো যে মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে অন্য কোনো মুদ্রব্যাবস্থা সাজাতে হবে। বিস্ময়করভাবে এমন এক নতুন ব্যবস্থা সাজানো হলো; যে ব্যবস্থায় কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই দুনিয়ার প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা হিশাবে কাগুঁজে ডলার ছাপানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র অনুমতি পেয়ে গেল-- কাল্পনিক স্বর্ণমানে ডলার রূপান্তরযোগ্য হবে কিংবা এ ধরনের কোনো শর্ত ছাড়াই! এই নতুন ব্যবস্থা যদিও আগেকারটির চেয়ে আরো বেশি দুর্বল ছিল কিন্তু তা সত্ত্বেও এর ফলেও ডলার-আধিপত্য বিস্তারের দরজা খুলে দিল। কিন্তু নতুন ব্যবস্থার প্রতি দেশগুলোর দোনোমোনো ভাব রয়েছে এবং সবাই নতুন কিছু একটা চাইছে এটা বুজতে পরে শীর্ষ মুদ্রা ব্যবস্থাপকরা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের জোর সমর্থন পেয়ে একটা আচানক কাজ করে বসলো। তারা ওপেক-এর সাথে চুক্তি করলো যে, দুনিয়াজুড়ে তেল বেচা-কেনার ক্ষেত্রে শুধু মাত্র ডলারকেই বিনিময় মুদ্রা হিশাবে গ্রহণ করা হবে। দুনিয়ার মুদ্রাগুলোর মধ্যে ডলারকে একটা বিশেষ জায়গা করে দিল এই চুক্তি। ডলার তেলের ওপর উঠে দাঁড়াল। চুক্তিতে এই সুবিধার বদলে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দিল যে, তারা পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের এই দেশগুলোকে অন্য রাষ্ট্রের আগ্রাসন ও আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ থেকে সুরক্ষা দেবে। এ চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে আর্থিকভাবে প্রচুর লাভবান করার মাধ্যমে ডলারকে কৃত্রিম শক্তি যোগাল। যার ফলে বিশ্ববাজারে ডলারের প্রভাব বাড়লো এবং আমরা বিশাল ছাড়কৃত মূল্যে তেল ও অন্যান্য দ্রব্যাদি আমদানি করে নিজেদের মুদ্রাস্ফীতি রপ্তানি করার সুযোগ পেলাম। ১৯৪৫ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত যে মুদ্রা-ব্যবস্থা চালু ছিল তার তুলনায় ব্রেটন উডস পরবর্তী এই ব্যবস্থা আরো অনেকানেক নাজুক ছিল। তেল-ডলারের চুক্তি বেশ খানিকটা উপকারে আসলেও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা ব্রেটন উডস চুক্তির ‘স্বর্ণের কল্পমান’ ব্যবস্থার কাছেও যেতে পারে নি। এবং নিশ্চিতভবেই এ ব্যবস্থা বিগত ১৯শতকের স্বর্ণমান ব্যবস্থার চেয়ে অনেক কম স্থিতিশীল ছিলো। ঢেউয়ের গতিতে তেল ও স্বর্ণের মূল্য বৃদ্ধির পরিণতিতে ১৯৭০-এর দিকে ডলারে পতন প্রায় ঘনিয়ে আসছিল। ৭০’এ প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ছিল ৮০০ ডলার। এ থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে ব্যাংক সুদের হার নির্ধারন করা হয় ২১%। নতুন পদ্ধতিতে ডলার আমাদের যেসব বাড়তি লাভের যোগান দিচ্ছিল সেই তুলনায় সত্তরের দশকে ডলারের ওপর এমনতরো চাপ সৃষ্টি হলো কেন। কারণ, ষাটের দশকে লাগামহীন বাজেট ঘাটতি ও মুদ্রাস্ফীতি’র ‘মাখন আর মারণাস্ত্র’ দুটোই আমাদের সাধ্যের মধ্যে-- এলবিজে’র এমন আশ্বাসে মুদ্রাবাজারকে আর বোকা বানানো গেল না। কিন্তু আরো একবারের মতো ডলারকে পতনদশা থেকে বাঁচানো গেল; ১৯৮০ তে ডলার এমন বাঁচাই বাঁচলো যে সত্যিকারের ‘ডলার আধিপত্যের’ জমানা শুরু হলো। যে জমানা এখনো শেষ হয় নি। ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান অ্যালান গ্রিনস্প্যানের দৃষ্টিভঙ্গী এর আগে স্বর্ণমানের পক্ষে ছিল। এ বিষয়ে কংগ্রেসের ব্যাংকিং কমিটিতে তিনি নানা উপলক্ষে আমার প্রশ্নের জবাবে বলেছেন যে-- তিনি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তার সহকর্মীরা কাগুঁজে মুদ্রা মানে ডলার পদ্ধতি খুঁজে পেয়েছেন, তার জবাব দেয়ার ধরনে মনে হয় তিনি ডলারকেই স্বর্ণ মনে করছেন। প্রতিবারই আমি দৃঢ়ভাবে আমার নারাজির কথা জানিয়েছি; তারা যদি এমন একটা উপায় খুঁজে পেয়ে থাকেন তবে তো-- ‘অর্থ’ হবে এমন কিছু একটা যার প্রকৃত মূল্য আছে-- শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা অর্থনৈতিক ইতিহাসের এই সিদ্ধান্তকে তাঁরা অগ্রাহ্য করলেন। আত্মতৃপ্তি ও আত্মবিশ্বাসের সাথে তিনি এই ‘খুঁজে পাওয়া’র সাথে একমত হয়েছিলেন বারবার। কাজ চালানো যায় এমন মানে ডিক্রিজারি-মুদ্রা (ফিয়াট) ডলারকে ধরে রাখার কায়েমি স্বার্থ যারা দেখভাল করে-- সেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আরো বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজারে বিশাল পরিমাণে স্বর্ণ বিক্রি করেছে। স্বর্ণের মূল্য কমতে থাকায় এমনতরো নীতির বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলো তখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ ওই প্রতিষ্ঠানগুলো স্বর্ণ বিক্রিতে কোনো লুকোছাপা করেও নি। তারা কখনোই স্বর্ণের মূল্য বেঁধে দিতে রাজি হয় নি। কিন্তু পর্যাপ্ত যথেষ্ট প্রমাণ আছে যে তাদের বিশ্বাস ছিল; স্বর্ণের মূল্য পড়ে গেলে তা বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনবে-- কাগজকে স্বর্ণে পরিণত করতে তারা যে আসলেই বিস্ময়কর কামিয়াবি হাছিল করেছে-- সেই আস্থা। ঐতিহাসিকভাবে, স্বর্ণের ক্রমবর্ধমান মূল্যকে কাগুঁজে মুদ্রার প্রতি অবিশ্বাসের সূচক হিশাবে দেখা হয়। ডলার নিরাপদ ও স্বর্ণের মতো সুবর্ণ-- এ বিষয়ে দুনিয়াকে আশস্ত করতে ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের খাজাঞ্চিখানা প্রতি আউন্স স্বর্ণ ৩৫ ডলারে বিক্রি করেছিল; তা থেকে এই সাম্প্রতিক উদ্যোগ পুরোপুরি ভিন্ন নয়। এমনকি আর্থিক মন্দার সময় রুজভেল্ট প্রথম যে কাজটি করলেন তা হলো দুর্বল মুদ্রা ব্যবস্থার আলামত হিশাবে সাব্যস্ত-- স্বর্ণের মুক্ত বাজার কায়দায় স্বর্ণের মূল্য নির্ধারনের সুযোগ, সেটি বন্ধ করে দিলেন। তিনি আমেরিকান নাগরিকদের জন্য স্বর্ণের মালিক হওয়া আইনত অবৈধ করে দিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে আর্থিক আইনের অধীনে রুজভেল্টের এমন উদ্যোগের ব্যাপ্তি সীমিত হয়ে পড়ে, যেমন ১৯৭০ এর দিকে আইএমএফ ও আমাদের খাজাঞ্চিখানা মিলে স্বর্ণের দাম স্থির করার জন্য রুজভেল্টের চেয়ে একদম উল্টো রাস্তা ধরলো। বাজারে টনকে টন স্বর্ণ ঠেলে দেওয়া হলো-- স্বর্ণের মালিকানা ফের আইনত বৈধ হওয়ার পর যারা পতনশীল ডলারের বদলে নিরাপদ কিছু একটা খুঁজছিল তাদের অতি উৎসাহকে ঠেলে নিচে নামিয়ে দেয়ার জন্য। ডলারের প্রকৃত মূল্য আছে বলে মুদ্রাবাজারকে বোকা বানানোর আরো একটি প্রচেষ্টা চালানো হয় ১৯৮০ থেকে ২০০০ সালের মাঝখানে। সেই প্রচেষ্টাও অসফল প্রমাণিত হলো। গত পাঁচ বছরে স্বর্ণের বিপরীতে ডলারকে শতকরা ৫০ ভাগ অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আপনি সবাইকে সব সময় বোকা বানাতে পারবেন না, আপনার ফেডারেল রিজার্ভের কাগুঁজে মুদ্রা বানানোর ও ছাপানোর জন্য অনেক শক্তিশালী ছাপাখানা থাকলেও না। কিন্তু ফিয়াট মুদ্রাব্যবস্থার সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ডলারের প্রভাব বিস্তৃত হলো। যে প্রভাবের ফলাফল লাভজনক বলে মনে হলেও পুরো পদ্ধতির মধ্যে গড়ে ওঠা সামষ্টিক অস্বাভাবিকতা রয়ে গেল। স্বল্পমেয়াদে ফিয়াট রিজার্ভ মুদ্রা ইস্যুকারি দেশ নিজের ঘরে বিশাল অর্থনৈতিক সুফল তুলতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটা ইস্যুকারি দেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়; যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এটাই ঘটেছে। যতদিন দেশগুলো সত্যিকারের দ্রব্যাদির বিনিময়ে আমাদের ডলার নিয়েছে ততদিন আমরা সামনে এগিয়েছি। কিন্তু এতে করে বৈদেশিক বাজারের জন্য আমাদের উৎপাদনকারি খাতে কর্মী ছাটাই বেড়েছে, আমরা অন্যদের ওপর আরো নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি ও আমাদের স্বনির্ভরতা আরো কমেছে। বাইরের দেশগুলো তাদের সঞ্চয়ের উচ্চ হারের কারণে আমাদের ডলার পুঞ্জিভূত করতে পেরেছে। খুবই বদান্যতার সাথে খুব নীচু সুদের হারে সেই ডলার আবার আমাদেরই ধার দিয়েছে আমাদের মাত্রাতিরিক্ত ভোগের অর্থায়ন করার জন্য। আমাদের প্রত্যেকের জন্য এটা খুব খোশ খবর হতে পারে। কিন্তু ওইসব দেশে মন্দার কারণে যখন আমাদের ডলার গ্রহণ করতে তারা অনেক কম উৎসাহ দেখাবে অথবা একদমই প্রত্যাখান করবে; সেটা নিশ্চয়ই আমাদের বদ নসীবের কারণ হবে। সামর্থ্যরে ও উৎপাদনের অতিরিক্ত জীবন যাপনের মূল্য দিতে হবে আমাদের। ডলার প্রসঙ্গে বাইরের দেশগুলোর মানসিকতায় ইতোমধ্যেই বদল আসতে শুরু করেছে, কিন্তু আরো খারাপ সময় আসতে এখনো বাকি আছে। আমাদের ডলারের জন্য কৃত্রিম চাহিদা ও আমাদের সামরিকশক্তি দুনিয়াকে শাসন করার জন্য আমাদেরকে এক অতুলনীয় জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে। এ জায়গায় আমরা পৌঁছেছি সঞ্চয়ের স্বভাব ও উৎপাদনমূলক কাজ ছাড়াই, এবং ভোক্তাদের খরচ ও বাজেট ঘাটতির ওপর কোনো সীমা না টেনেই। মুশকিল হলো-- এ ব্যবস্থা টিকতে পারবে না। আরো দরকারি কথা হলো-- ডলারকে দুনিয়ার প্রধান মুদ্রা হিশাবে ধরে রাখার জন্য তেল-ডলারের খায়খাতির বজায় রাখতে হবে। এই খাতিরের ওপর যে কোনো আক্রমণকে বলপ্রয়োগ করে রুখে দিতে হবে-- যেভাবে ইতোমধ্যেই কয়েকবার রুখে দেয়া হয়েছে। ২০০০ সালের নভেম্বরে সাদ্দাম হোসেন তার দেশের তেল বিক্রি করে ইওরো দাবি করলেন। সাদ্দামের এই ঔদ্ধত্যই ডলারের প্রতি হুমকি ছিল, তার কোনো প্রকার সামরিকশক্তির অভাব থাকা ডলারের জন্য হুমকি ছিল না। তৎকালিন অর্থমন্ত্রী পল ও’নেইল এর ভাষ্য অনুযায়ী; ২০০১ এ নতুন প্রশাসনের মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল-- আমরা কিভাবে সাদ্দামের হুমকি থেকে রেহাই পেতে পারি। সাদ্দাম যে আমাদের জন্য বিপদজনক এ বিষয়ে আর কোনো প্রমাণ ছিল না। ও’নেইল আমাদের জানিয়েছেন, সাদ্দাম হুসেইন কে নিয়ে এমন গভীর উদ্বেগ দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। আর এটা এখন জানা কথা যে, সাদ্দাম সরকারকে উৎখাতে ইরাকে আগ্রাসন চালানোকে কিভাবে ন্যায্যতা দেয়া যায়-- সেই সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে নাইন ইলেভেন। ওই হামলার পরপরই প্রশাসনের প্রতিক্রিয়ার মূল লক্ষ্য ছিলো কিভাবে এর সাথে সাদ্দামকে যুক্ত করা যায়। নাইন ইলেভেনের সাথে সাদ্দামের কোনো যোগসূত্র অথবা ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের কোনো প্রমাণ না থাকলেও নানা তথ্যকে ভুলভাবে উপস্থাপিত করে, তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়ে জনগণের ও কংগ্রেসের সমর্থন আদায় করা হয়। ইওরো তে তেল বিক্রি করতে চেয়ে বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা হিশাবে ডলারের সমন্বিত শক্তির ওপর আক্রমণের কারণেই যে সাদ্দামের ওপর হামলা করা হলো-- এ বিষয়ে জনপরিসরে কোনো বিতর্ক হয় নি। অনেকেই বিশ্বাস করেন, ইরাক প্রসঙ্গে আমাদের বুঁদ হয়ে থাকার আসল কারণ এটা। আমি মনে করি, একমাত্র কারণ না হলেও এটাই প্রধান প্রণোদনা যুগিয়েছে। ইরাকে সামরিক বিজয়ের খুব অল্প সময় পরেই ইরাকের সব তেল ডলারের বিনিময়ে বিক্রি হয়ে গেল। ইওরো বাদ দিয়ে। ২০০১ সালে রাশিয়ায় নিযুক্ত ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্রদূত বলেন যে তারা ডলারের বদলে ইওরোতে তেল বিক্রির চিন্তা করছেন। এর এক বছরের মধ্যে শ্যাভেজের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা হয়। সপ্রমাণ অভিযোগ আছে, এর পেছনে সিআইএর সহযোগিতা ছিল। ইওরোকে ডলারের জায়গায় ওঠানোর এইসব প্রচেষ্টা ভালোভাবেই শক্তিপ্রয়োগ করে ঠেকানো হলো। ইওরোর বিপরীতে ডলারের পতন ঠেকানো গেল। ডলারের মুরব্বিয়ানা বজায় রাখতে এইসব উদ্যোগের তাৎপর্য আছে। এখন পেট্রোডলার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নয়া উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শয়তানের অক্ষশক্তির এক সদস্য ইরান এ বছরের মার্চে তেল-প্রতিরোধ শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে। একবার ভাবুন! এই প্রতিরোধ কি হতে পারে? নিশ্চিতভাবেই তেল ইওরোতে বিক্রি হবে, ডলারে নয়। বছরের পর বছর ধরে আমাদের নীতিসমূহ অপ্রয়োজনীয়ভাবে এবং পদ্ধতিগতভাবে কিভাবে ইরানিদের আমাদের শুত্রুতে পরিণত করেছে-- সেটা অধিকাংশ আমেরিকান এখন ভুলে গেছেন। বিষয়টি ঠিক এরকমও নয় যে এসব যুদ্ধে যাওয়ার পেছনে কারণ হিশাবে শুধু ডলারের আধিপত্য-ই কাজ করেছে। ডলারের গুরুত্ব নিসন্দেহে স্পষ্ট। কিন্তু তাতে করে মধ্যপ্রাচ্যকে নিজেদের মতো করে সাজাতে নয়া-গোড়া নীতিনির্ধারকদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার প্রভাব আড়াল হয়ে যায় না। একইভাবে যুদ্ধে যাবার ক্ষেত্রে ইজরাইল ও ক্রিশ্চিয়ান ইহুদীবাদীদের প্রভাবও কাজ করেছে। এবং সব ক্ষেত্রেই দশকের পর দশক ধরে ‘আমাদের’ তেল সরবরাহ নিশ্চিত রাখার বিষয়টি মধ্যপ্রচ্য নীতিতে প্রভাব রেখেছে। সত্য কথা হচ্ছে; মান্ধাতার আমলের উপায়ে এইসব আগ্রাসনমূলক হস্তক্ষেপের বিল মেটানো সম্ভব নয়। আমেরিকানদের দিয়ে আরো বেশি কর আদায়, আরো বেশি সঞ্চয় এবং আরো উৎপাদন সম্ভব নয়। উপসাগরীয় যুদ্ধের মতো এখন আর মিত্রদেশগুলোর কাছ থেকে অর্থ পাওয়া সম্ভব না। এখন আমাদের যুদ্ধের বিপুল খরচ যোগাতে সারা দুনিয়ার রিজার্ভ মুদ্রা হিশাবে ডলারকেই দরকার-- ডলার আধিপত্য দরকার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডলার আধিপত্যে সত্যিকারের শিকার দেশগুলো সচেতন নয় যে তারা কিভাবে আমাদের পাওনা পরিশোধ করছে। হাওয়া থেকে পাওয়া টাকা বানানোর লাইসেন্স থাকার ফলে দেশগুলো এখন মূল্যস্ফীতির মধ্য দিয়ে আমাদের বিল পরিশোধ করে। বর্তমানের আমেরিকার নাগরিকরা এবং চীন, জাপানসহ অন্যান্য দেশের নাগরিকরা যে প্রায়ই মূল্যস্ফীতিতে ভোগে তার মানে হচ্ছে-- আমাদের সামরিক অভিযানের খরচ তাদের ট্যাক্স থেকে মেটানো হয়। এ অবস্থা চলতে পারে ততদিন, যতদিন না এই প্রতারণা আবিস্কৃত হয়, যতদিন বিদেশী উৎপাদকরা তাদের পণ্যের বিনিময়ে আমাদের ডলার না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মুদ্রাব্যবস্থার এই প্রতারণার ফলে দেশে দেশে যে সাধারণ মানুষরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছে , তাদের সামনে যাতে এটা প্রকাশ না হয়ে পড়ে সে লক্ষ্যে সম্ভব সবকিছুই করা হয়েছে। যে কারণে আমরা অবিশ্বাস্য রকম সুবিধার মধ্যে আছি; আমরা মূল্যবান দ্রব্য আমদানি করি ও এর বদলে আমাদের ক্রমশ অবচয়ের শিকার ডলার রপ্তানি করি। নিজেদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্যই রপ্তানিকারক দেশগুলো আমাদের কাছে বিক্রি করার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের ওপর নিজেদের এরকম নির্ভরতার কারণেই ওই দেশগুলো ডলারের প্রতারণা চালু রাখার কাজে আমাদের মিত্র হয়েছে, তারা বাজারে অংশ নিচ্ছে বলেই ডলারের মূল্য কৃত্রিমভাবে বাড়ছে। এ ব্যবস্থায় যদি দীর্ঘ মেয়াদে কাজ চালানো যেত তবে আমেরিকানদের আর কখনো কাজ করতে হতো না। রোমানরা যেমনটি করেছিল আমরাও তেমনি রোজগারের চিন্তা না করে আহার আর বিহারে মেতে থাকতে পারতাম। কিন্তু একসময় তাদের স্বর্ণ ফুরিয়ে গেল এবং বিজিত জাতিগুলোর ওপর লুটপাট চালানোর সামর্থ্য আর তাদের রইলো না, স্বাভাবিকভাবেই রোমের সাম্রাজ্য শেষ হয়ে গেলো। আমরা কিন্তু সেইসব পুরনো দিনের মতো বিভিন্ন দেশের জাতীয় সম্পদের ওপর সরাসরি মালিকানা দাবি করি না-- আমরা শুধু এই জবরদস্তি খাটাই যে আমরা যা চাই তা-ই কিনবো এবং কাগুঁজে টাকায় পাওনা পরিশোধ করবো। যে দেশই আমাদের এই কর্তৃত্বের মোকাবিলা করতে চায় তাদের খবর আছে। ইরাকের মতো করে এখন আবার ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রপাগান্ডা শুরু করেছে আমাদের কংগ্রেস। ইরাকের বেলায় যেমনসব অসত্য কারণ দেখানো হয়েছিল এখনো তাই দেখানো হচ্ছে। সত্যিই আমাদের পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বর্তমান মুদ্রা ব্যবস্থার ওপর ভর করে চলছে; যার মানে হলো ডলারের এই পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়া চালু রাখতেই হবে। যে প্রক্রিয়া চালু আছে বলেই আমরা আমাদের উপকারি বন্ধুদের কাছ থেকে কম সুদে ধার নিয়ে চলছি, যারা কঠোর পরিশ্রম করে এবং তাদের প্রস্তুতকৃত দ্রব্যের বিনিময়ে আমাদের কাগুঁজে ডলার নেয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে; ডলারের শ্রেষ্টত্ব নির্ভর করে শক্তিশালী সামরিকবাহিনীর ওপর আর শক্তিশালী সামরিকবাহিনী নির্ভর করে ডলারের ওপর। ইতিহাস বলছে-- সাধারণ আমেরিকান ও আমেরিকার রাজনৈতিক নেতারা সবসময়ই আগ বাড়িয়ে যুদ্ধ করার পক্ষের অতি স্বদেশি প্রপাগান্ডা দ্বারা প্ররোচিত হয়। এবং যখন প্রচুর মানুষ জীবন হারায় ও ডলারের মূল্য পড়তে শুরু করে কেবল তখনই জনগণ অবিবেচক যুদ্ধংদেহিতার বিষয়ে আপত্তি জানায়। আজব ব্যাপার! ইরাকে ব্যার্থ হওয়ার কাহিনী এখন অধিকাংশ আমেরিকানের কাছে স্পষ্ট, কিন্তু এখনো তারা এবং কংগ্রেস উভয়েই ইরানের সাথে অপ্রয়োজনীয় ও বিপজ্জনক সংর্ঘষে যাওয়ার উদ্যোগকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার জরুরি আহ্বান এবং শক্তিপ্রয়োগ করার হুমকি ঠিক এই সময়েই দেয়া হচ্ছে যখন দেশটি ডলারের বদলে ইওরোতে তেল বিক্রি করতে যাচ্ছে। অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম হলো; সুষ্ঠু বিনিময়ের মাধ্যম হিশাবে প্রকৃত মূল্য সম্পন্ন মুদ্রা চাহিদা বাদ দেয়া অসম্ভব। ৩৫ বছর ধরে দুনিয়াজুড়ে ফিয়াট মুদ্রার পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালানোর জের হিশাবে এমন এক দিন আসছে যেদিন বিনিময় হিশাবে প্রকৃত মূল্যসম্পন্ন মুদ্রা চাইবে বাদবাকী দুনিয়া। সেদিন কবে আসবে সেটা আমরা তখনই বুঝতে পারবো যখন তেল উৎপাদক দেশগুলো ডলার অথবা ইওরোর বদলে স্বর্ণ কিংবা স্বর্ণের মূল্যমান সম্পন্ন কিছু দাবি করবে। শুভস্য শীঘ্রম। *ড. রন পল: টেক্সাস থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান


নিজের সম্পর্কে লেখক

সাংবাদিক



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।