রাশিয়া-জর্জিয়া যুদ্ধের এক বছর: ঘটে যাওয়া পরিবর্তন

২০০৮ সালের রাশিয়া-জর্জিয়া যুদ্ধ বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কমিশনের (ইইউসি) দীর্ঘ প্রতিক্ষিত রিপোর্ট কোন রকম বাড়তি হইচৈই তৈরী করেনি। ইউরোপীয় রাজনীতির আদলে পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে কোন রকম কড়া সমাপ্তির দিকে না গিয়ে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা হয় রিপোর্টে। তবে দেখা যাক কেমন হতে পারে প্রকাশিত রিপোর্টের সমাপ্তি? প্রথমত, আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওসেটিয়ার স্বাধীনতার মস্কো ঘোষণার ভবিষ্যৎ বিবেচনায় কোন পরিবর্তনের সুযোগ নেই। কারণ এ অবস্থান থেকে ইউ-টার্ন রাশিয়ার জন্য সম্মানহানিকর। তাই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক লাভালাভের বিষয়ে চাপ থাকলে দু’টি অঞ্চলকে সমর্থন দিয়ে যাওয়া ছাড়া আপাতত কোন বিকল্প নেই মস্কোর সামনে। যদিও সময় বিবেচনায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক লাভালাভের হিসেবটি একটু চড়া, তবে আপাতঃ স্বস্তি এই- বর্তমান বিশ্ব মোড়লদের এমন অবস্থান নেই যা রাশিয়ার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করতে পারে। আর এই বিষয়ট তখনই পরিস্কার হয়ে যায়, যখন ইউরোপের পার্লামেন্টারি এসেম্বলীর কাউন্সিল রাশিয়ান প্রতিনিধির ভোটাধিকার বাতিলের উদ্যোগ নাকচ করে দেয়। জর্জিয়া যদিও জাতিসংঘ, অর্গানাইজেশন অব সিকিউরিটি এন্ড কো-অপারেশন ইন ইউরোপ (ওএসসিই), ইউরোপীয় কাউন্সিল এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে এই ঘটনার বিষয়ে প্রভাবিত করার মাধ্যমে তার সব প্রচেষ্টা কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু এসবের মাধ্যমে তিবিলিশি কতটুকু রাশিয়ার রাজনৈতিক ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম হবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। তবে আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওসেটিয়ার কিছু বিষয় রাশিয়া জন্য মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষ করে, দু’টি অঞ্চল মস্কো থেকে অতিমাত্রায় নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করতে পারে। এছাড়া এ দু’টি অঞ্চলে দুর্নীতি এবং ব্যর্থ নেতৃত্ব জনগণের মধ্যে ব্যাপকহারে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে। এক্ষেত্রে হয়তো মস্কোকে পদক্ষেপ নিতে হতে পারে এবং সরকার দু’টির প্রতি জনগণের আস্থা যাতে হ্রাস না পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, এটা অনেকটাই বাস্তব যে, জর্জিয়ার প্রেসিডেন্ট মিখাইল সাকাশভিলি যেকোন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সম্ভবনা খুইয়েছেন। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হবার পর তাকে বৈধতা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকাতে দক্ষিণ ওসেটিয়ায় সামরিক অভিযান চালানোর কোন বিকল্প ছিলনা। কিন্তু, রাশিয়ার পদক্ষেপের দীর্ঘ সমালোচনা করলেও ইইউ কমিশনের রিপোর্টে ওই ঘটনাকে সমর্থন দেয়া হয়নি। যতদূর বলা যায়, সাকাশভিলি যতদিন ক্ষমতায় আছেন ততদিন পশ্চিম থেকে তিনি কেবলমাত্র প্রতীকি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থনই আশা করতে পারেন। তৃতীয়ত, সংঘাত বন্ধে ওই সময়ে আন্তর্জাতিক আহ্বান ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। মধ্যস্ততাকারী হিসেবে ওএসসিই যে তার খ্যাতি ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কারণ সংগঠনটি ২০০৮ সালের আগস্টের ওই আলোচিত যুদ্ধকে প্রতিরোধ করতে পারেনি এবং বন্ধও করতে পারেনি। তবে এক্ষেত্রে ইউরোপে নতুন নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলার রাশিয়ার প্রস্তাব সম্পর্কিত আলোচনা তথাকথিত ‘কর্ফ্যু প্রসেস’-এ ওএসসিই নতুন করে কিছু ভূমিকা রাখতে পারে। যদিও এই কাঠামোর কোন সুস্পষ্ট ধারণা এখনও তৈরী হয়নি। যদিও এক্ষেত্রে জাতিসংঘকে আন্তর্জাতিক নেতৃত্বদানকারী শক্তি হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু এর সব সিদ্ধান্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মতির ওপর নির্ভরশীল বলে এর কার্যক্রম অনেকাংশেই বাধাগ্রস্ত হয় যা অনেকাংশেই বাস্তবতা বিরোধী। আর মস্কো এবং তিবলিশি কোন বিষয়ে এক অপরের সাথে কথা বলতেও অসমর্থ। এ অঞ্চলের নতুন মোড়ল ইইউ অবশেষে দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলের সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব নেয়। আর এর মাধ্যমে ইইউ এক ধরনের আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মর্যাদা লাভ করেছে যে সুযোগ সে হারাতে চায়নি। তবে জর্জিয়া ও তার প্রতিবেশীদের মধ্যে শান্তি স্থাপনের উদ্যোগের জন্য ইইউ ধন্যবাদের দাবিদার সে বিষয়ে বির্তকের অবকাশ নেই। মজার বিষয় সাবেক সোভিয়েত রিপাবলিকগুলোর ব্যাপারে ওবামা প্রশাসন অনেকাংশেই কম গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে তার মানে এই নয় যে, দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চল যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ মেয়াদী গুরুত্বের বাইরে থাকবে। এবিষয়ে জোর ধারণা আছে যে, ওয়াশিংটন তার ইরান কৌশল এখনও চুড়ান্ত করেনি। কারণ ইরান এ অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারক শক্তি। এক্ষেত্রে দেশটির যে কোন ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন কাস্পিয়ান সাগর, দক্ষিণ ককেশাস ও মধ্য এশিয়ায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়া রাশিয়া-জর্জিয়া যুদ্ধের মাধ্যমে এই অঞ্চলে নতুন করে প্রভাব বিস্তারে তুরস্কের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। এমনকি সব পক্ষই চায় আঙ্কারা ককেশাস অঞ্চলে নতুন করে ভূমিকা রাখুক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ’র সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে তুরস্কের। এক্ষেত্রে রাশিয়া চায় বাইরের কোন শক্তির প্রভাব খাটানোর চেয়ে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আঙ্কারা এই অঞ্চলের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখুক। আর তার প্রমাণ বহন করে সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-তুরস্কের সম্পর্কের উন্নতি। তবে দেখার বিষয়ে তুরস্কের আকাঙ্খা কতটুকু বিস্তৃতি লাভ করে। এক্ষেত্রে আঙ্কারা-ইয়েরভানের সম্পর্কের উন্নতি এবং আঙ্কারার আবখাজিয়া দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ। এই বছর আগস্টে রাশিয়া-জর্জিয়া যুদ্ধের এক বছর পূর্তিতে অব্যাহত তথ্যযুদ্ধ সত্ত্বেও সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল অনেকটাই স্থিতিশীল ছিল। যদিও আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওসেটিয়ার স্বাধীনতাকে এককভাবে স্বীকৃতি দেয়ার কারণে মস্কোকে সৃষ্ট রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে কয়েক বছর ধরে কাজ করতে হবে, তথাপি নিকট ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে নতুন করে যে কোন সংঘাতের সম্ভাবনা নেই তাও অনেকটাই নিশ্চিত।


নিজের সম্পর্কে লেখক



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।