ইসলাম, সঙ্গীত ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: ৭

জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ শওকত আলী চৌধুরী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার বয়াতি শরিয়ত সরকারকে জামিন দেন নি। গত ৯ জানুয়ারি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মির্জাপুর থানায় শরিয়ত বয়াতির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন একই উপজেলার আগধল্যা দারুসসুন্নাহ ফোরকানিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা মো. ফরিদুল ইসলাম। ইতোমধ্যে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে বেশ কয়েকটি আলোচনা দেখেছি, যেখানে দাবি করা হয়েছে ফরিদুল ইসলাম ব্যক্তিগত রেষারেষি বা হিংসা চরিতার্থ করবার জন্য এই মামলা করেছেন। কিন্তু এই মামলা ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক ও দ্বন্দ্ব যেমন স্পষ্ট করছে, তেমনি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির অবস্থানও স্পষ্ট করে তুলছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট আইন বটে, কিন্তু শুধু এর দ্বারা এই আইনের তাৎপর্য আমরা বুঝব না। এই আইনের একটি প্রধান উদ্দেশ্য ধর্মীয় অনুভূতি রক্ষার নামে ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা ও আইনের পক্ষে বাংলাদেশের আলেম ওলেমা ও ধর্মবাদীদের সমর্থন আদায় করা। আমরা এখন দেখছি ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা ধর্ম আশ্রয় করে দীর্ঘস্থায়ীত্ব পেতে চায়। তাই ধর্ম রক্ষার নামে, কিম্বা ধর্মীয় অনুভূতি রক্ষার নামে ফ্যাসিস্ট আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ফ্যাসিস্ট আইনকে ধর্মের নামে ন্যায্য প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা ইসলাম বিদ্বেষী সেকুলার বা ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতি আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে, যার প্রধান প্রকাশ ঘটেছিল শাহবাগের আন্দোলনে। এর আদর্শিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক-নিরাপত্তামূল আচ্ছাদন ছিল 'ওয়ার অন টেরর' এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এখন আমরা আরেক পর্বে প্রবেশ করছি। নতুন পর্বটি প্রমাণ করতে চায় ফ্যাসিস্ট আইন দিয়ে ধর্ম রক্ষা করা যায়।

আলেম-ওলেমাদের পক্ষ থেকে শরিয়ত সরকারের নিন্দা, সমালোচনা কিম্বা বাউলদের প্রত্যাখান স্বাভাবিক, মোটেও কোন সমস্যা নয়। সামাজিক-সাংস্কৃতিক তর্ক-বিতর্ক সবসময়ই ইতিবাচক। কিন্তু এই আইন সেই তর্কবিতর্কের কন্ঠরোধ করতে চায়। তর্কবিতর্কে আমাদের চিন্তা প্রখর হয়, বিষয়ের মর্মে প্রবেশ করাও সহজ যায়। কি ধরণের ভাষা ও প্রকাশভঙ্গী নৈতিক কারনে পরিহার করা দরকার, এবং আলেম-ওলেমাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার কেন ক্ষতিকর --এইসব আদব-লেহাজের দিকও আমরা তাড়াতাড়ি জনগণকে শেখাতে পারি। সেটা অবশ্যই আইনের বাইরে সামাজিক নীতি ও আদপ হিশাবে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া।

লক্ষ্য করবার বিষয় যে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীরা শরিয়ত সরকারের পক্ষ নিয়েছে তাদের ইসলাম বিদ্বেষী চিন্তা ও রাজনীতির কারনে। তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে নয়, সামনে নিয়ে আসছে 'মৌলবাদ'। এরা ইসলামের বিরুদ্ধে বাউলদের ব্যবহার করতেই অধিক আগ্রহী। বাউলদের বড় অংশ আওয়ামী লীগের সমর্থক। তাদের অনেকেই জেনে বা না জেনে 'ওয়ার অন টেরর' এবং বাংলাদেশের ফ্যসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে এতোদিন ভূমিকা রেখেছে। শান্তির পক্ষে লড়াই এক কথা আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা নির্ধারিত 'সন্ত্রাস' সংক্রান্ত বয়ান মেনে ইসলামি মৌলবাদ বা ইসলামি সন্ত্রাসের সৈনিক হওয়া ভিন্ন জিনিস। শরিয়ত সরকারের নিগ্রহ থেকে তারা কিছু শিখলেন কিনা আমরা আগামিতে হয়তো বুঝব। সংসদে শেখ হাসিনার বক্তব্য থেকে আশা করি এখন তারা বুঝবেন বাংলার ভাবের ধারাকে দলীয়করণ করবার বিপদ কতো ভয়ংকর হতে পারে।

আমরা আশা করব আলেম-ওলেমারা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার হাতিয়ার হবেন না। ইসলামে গান হারাম কিনা সেটা ইসলামের আভ্যন্তরীণ তর্কের বিষয়। ভাষা, প্রকাশ ভঙ্গী কিম্বা গিবত-নিন্দাও সামাজিক নীতি, কিম্বা আদপের বিষয়। বড় জোর ধর্মীয় বিধানের আলোকে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু কোন অবস্থাতেই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার আইনের বিষয় হতে পারে না। কোরানে গান হারাম -- এমন কোন আয়াত আছে কি নাই সেটা গুরুত্বপূর্ণ তর্ক। সুরা লোকমানের প্রচলিত ব্যাখ্যা কিম্বা হাদিসের বয়ানকে বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হবে। এক শ্রেণীর আলেম-ওলেমা গান হারাম ফতোয়া দিলেই সেটা আমাদের মেনে নিতে হবে এমন কোন কথা নাই।

তাই আমাদের জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান আলেম ও ওলেমাদের বুঝতে হবে তথাকথিত 'তাগুতি' আইন দিয়ে রসুল প্রেমিক ও ইসলামের আধ্যাত্মিক বা দার্শনিক মর্মের প্রচারকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ও শাস্তি দেওয়া তাঁদের পথ হতে পারে না, তেমনি দয়া, ক্ষমা ও সহনশীলতার অভাব ইসলাম রক্ষা করবে না, ধ্বংস করা ছাড়া।

শরিয়ত সরকারের নজির বাংলাদেশের জনগণকে ধর্মের প্রশ্নে বিভক্ত করবে। তাই যারা ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন তাদের ভূমিকা নেতিবাচক। ফ্যাসিস্ট আইনের ফাঁদে বাংলাদেশে্র আলেম-ওলেমাদের বড় একটি অংশ ইতোমধ্যেই পা দিয়ে দিয়েছেন। এর ফল আগামিতে তাদেরকেও ভোগ করতে হবে। কারণ তাঁদের ওয়াজও 'ধর্মীয় অনুভূতি'কে আহত করে। আধুনিক রাষ্ট্রের আইন কোরান-সুন্নাহ ভিত্তিক আইন নয়, আলেম-ওলেমাদের ভাষায় সেটা 'তাগুতি' আইন। কিন্তু তাগুতি আইন দিয়েই তারা বয়াতিদের শাস্তি দিতে নেমেছেন।

আধুনিক ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র সম্পর্কে ধর্মবাদীদের চরম অজ্ঞতাই প্রকাশিত হোল। যেটা দাঁড়াল সেটা হচ্ছে আলেম ওলেমাদের একাংশ নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে নেমে পড়ছেন। তারা দারুন নজির সৃষ্টি করলেন!

 


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।