লোকাচার ও সম্পর্কের গল্প

ওকুরিবিটো’ জাপানী শব্দ। ইংরেজী থেকে বাংলা অর্থ দাড়ায়, যে মৃত ব্যক্তির আত্নাকে স্বর্গ যাত্রায় পাঠায়। ‘ওকুরিবিটো’ মুভিটি ইংরেজী টাইটেল ‘ডিপারচারস’। ‘ডিপারচারস’ মুভিটি ডিয়াগো কোবেইসী নামক এক তরুণ সেলোবাদককে কেন্দ্র করে। সে টোকিওতে একটা অকোস্ট্যায় সেলো বাজাত। হঠাৎ করে চাকুরীচ্যুত হলে স্ত্রী মিকাকে সাথে নিয়ে নিজ শহরে ফিরে আসে। ট্রাভেল এজেন্সীর কাজের বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করলে জানতে পারে বিজ্ঞাপনটি ভুলভাবে ছাপানো হয়ে ছিলো। এটা আসলে মৃতদেহ সাজিয়ে দেখার প্রতিষ্টান। ডিয়াগো অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাজটিতে যোগদান করে। প্রথমে পর্যায়ে এই কাজটিকে বৈরী মনে করলেও- কিন্তু ভালো বেতন সুবিধা এবং অন্য কোনো কাজ না পাওয়ায় সে এই কাজটি বেছে নেয়। পরবর্তীতে সে এটাকে অন্যভাবে মূল্যায়ন করে। তার বস একজন অনুভূতিপ্রবণ কোমল হৃদয়ের মানুষ। যখন তার পরিচিতজনদের কেউ কেউ তার পেশার বিষয়টি জেনে যায়- সে নানাভাবে অপদস্থ হয়। তার স্ত্রীর মধ্যেও একই ধরনের ট্যাবু কাজ করে। ফলত সেও ডিয়াগোকে ছেড়ে চলে যায়। ডিয়াগো তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। সেই ভয়ংকর নিসঙ্গ সময়ে ডিয়াগো এই কাজের ভেতর কিছু একটা খুঁজে পায়। কয়েক সপ্তাহ পর মিকা ফিরে আসে। মিকা জানায় সে গর্ভবতী। সে সময় একটা ফোন আসে, ডিয়াগোর এক পারিবারিক বন্ধু মারা গেছেন। তার শেষকৃত্যের কাজ করতে হয় ডিয়াগোকে। তখন মিকা তার সাথে যায় এবং সে তার ভুল বুঝতে পারে। এরপর ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে। ডিয়াগোর ভেতরকার যে বিষøতা সবসময় মূর্ত তার পশ্চাতে কাজ করে পিতার কাহিনী। ডিয়াগোর মনে পিতার দুটো স্মৃতি। সে তার বাবার সামনে বসে সেলো বাজাচ্ছে এবং পিতার সাথে পাথরের চিঠি বিনিময় করছে। এই পাথর চিঠি প্রাচীন জাপানের লোকাচার। যেখানে একে অপরের প্রতি মনের ভাব জানাতে পরস্পরকে পছন্দসই পাথর উপহার দেয়। ডিয়াগোর স্মৃতিতে তার বাবার ছবি অস্পষ্ট। ডিয়াগোর বাবা ছয় বছর বয়সে অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে তাদের ছেড়ে চলে যায়। ডিয়াগো বাবাকে একই সাথে ভালোবাসে আবার ঘৃণা করে। মুভি শেষে দেখা যায়, ডিয়াগোর বাবা মারা গেছে এমন খবর আসে। ডিয়াগো তার লাশ গ্রহণ করতে যেতে অস্বৃকীতি জানায়। মিকা তাকে সেখানে যেতে বাধ্য করে। একপর্যায়ে, ডিয়াগো যখন বাবার মৃতদেহ সাজাতে থাকে, দেখে বাবার হাতে সেই ছোট্টবেলায় ডিয়াগোর দেয়া পাথর চিঠি। ডিয়াগো সেই পাথর চিঠি তার অনাগত সন্তানকে দেয়। ‘ডিপারচারস’ সম্পর্কে এককথায় বলা যায়, একগেয়েমীহীন অসাধারণ মুভি। জাপানী জীবনে যে হাল হকিকত, তাতে মনে হয় পুঁজিবাদের উৎকর্ষিত যান্ত্রিক জীবনে সে সীমাবদ্ধ। সেই জানা হাল হকিকতের বাইরে জাপানী জীবনের গভীরতায় ডুব দেবার ভালো সুযোগ। বোধ পূর্ব ধারণায় কিছু ভুল ছিলো। এই মুভিটি প্রায় নাটকীয়তা বিহীন সাধারণভাবে একটা গল্প বলেছে- যার উপরিকাঠামো এই সময়ে অথচ যার শিকড় রয়েছে জাপানী ঐতিহ্যিক জীবনবোধ ও লোকাচারে। ডিপারচারস’ সম্পর্কে বলতে গেলে, যে বিষয়টি সব চে’ সামনে আসে তাহলো, মৃতদেহের সৎকার প্রণালী। হিন্দু ও বৌদ্ধ মতে, আত্না বারবার ফিরে আসে। মৃতদেহ পড়ে থাকে জীর্ণ বস্ত্রের মতো। এই অপ্রয়োজনীয় অংশটি অপর জম্মে কোনো কাজে আসে না। তাই তারা মৃতদেহকে পুড়িয়ে ফেলে। পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে নিশ্চয় এই বিষয়টি নানাভাবে উদ্যাপন করা হয়। কিন্তু জাপানী ধারণার পিছনে কি দর্শন কাজ করে তা বলা কঠিন হলেও, তা কিন্তু এই জাগতিক জীবন ও তার সৌন্দর্য সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ অনুভূতি দান করে। জন্ম এবং পুর্নজন্মের যে ধারণা তার ভেতর যে যোগসুত্র তা অন্যকিছুর সাথে সাথে নন্দনের ভেতর দিয়েও গোচরীভূত হয়। অর্থ্যাৎ এই জীবন সম্পর্কে আলাদা মূলায়ন হাজির করে। এই কাজটি ডিয়াগো পেশা হিসেবে বেছে নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডিয়াগোর অনুভূতির রূপান্তর ঘটে। সে হয়ে উঠে অনন্তযাত্রা পথে শেষ নন্দন কারিগর। সে হয়ে উঠে জন্ম এবং পুর্নজন্মের দ্বাররক। সে ইহলোক আর পরলোকের মাঝামাঝি বাস করে। ডিয়াগোর বস যখন বলে তাদের কাছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলমান খৃস্টান কেউ তাজ্য নয়, এতে মানুষ সম্পর্কে একটা মিশ্র ধারণা তৈরি হয়। ডিয়াগো মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে জীবনকে অনুধাবন করে। যা মহৎ কোনো সংগীতের মতো। সে যখন সেলো বাজায়, তাতে অপার্থিব সুর বেজে উঠে, সেখানে ভ্রম হয়- এই সংগীত কোথাকার? জীবন এবং মৃত্যুকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দেয়। দুনিয়াবী এই কাল আধুনিক, উত্তরাধুনিক নানা নামে চিহ্নিত হয়েছে। আমরা প্রায়শ বলি, যুগের পরিবর্তন এসেছে মন মানসিকতা বদলাও। এই কালের মূলমন্ত্র মানবিকতা/উদারতা। আসলে কতটা? যখন ডিয়াগো’র পরিচিত’রা জেনে যায় সে কি কাজ করে, তখন সবাই বলে এই কাজটি ছেড়ে দিতে। ডিয়াগো অপারগতা জানালে তারা তাকে এড়িয়ে চলে। পরিচালক খুব দভাবে মানুষের ভেতর সংস্কার, ভীতিকে তুলে ধরেছেন। অথচ, এই আচারটি জাপানী সংস্কৃতির অংশ। হায়, মানুষের ভেতর কেমন দ্বৈততা। মুভিটিতে চমৎকার কিছু মিথিক্যাল ট্রিটমেন্ট আছে। যেমন- মিকা রান্না করার জন্য একটা অক্টোপাশ কিনে । বাসায় এসে দেখে অক্টোপাশটি জীবিত। তখন অক্টোপাশটিকে নদীতে ছেড়ে দেয়। আবার এক দৃশ্যে দেখা যায় মাছেরা স্রোতের প্রতিকূলতায় নিজের জম্মস্থানে ফিরে যাচ্ছে। যেন ফিরে ফিরে আসাই আমাদের নিয়তি। অথবা ডিয়াগো আর তার বাবার সেই পাথর চিঠির কেচ্ছা। এটা সময়সুত্রের অভিন্ন যোগাযোগকে নির্দেশ করে। অতীত বর্তমান ভবিষ্যত কি একই সময় সুতোয় বাধা নয়? এটা প্রশ্ন আকারে যেমনি বলা যায়, আবার নিজস্ব পর্যবেণের ভেতর জীবন নানা প্রতীকি আকারে ধরা দেয়। ডিপারচারস সম্পর্কের গল্প। মানুষের সাথে মানুষের, জীবের সাথে বস্তু সম্পর্ক। সম্পর্কই সত্য ঘটনা। সম্পর্কের টানপোড়নে নানা সত্য উম্মোচিত হয়। যেমন ডিয়াগো তার বাবার প্রতি প্রচন্ড মমত্ব অনুভব করে অথচ সে তাকে ঘৃণা করে। যদি এটাকে জীবনের টুকরো একটা ঘটনা বলি, কিন্তু তার তাৎপর্য জীবনের ভেতরকার মাজেজা। হয়তো জীবনের সৌন্দর্য। এই মুভির কাহিনী কি? এক মৃতদেহ সজ্জাকারী ব্যক্তির জীবন যে কিনা আবার সেলো বাদনে দ। এখানে জীবনের অন্তিমমুহূর্ত বারংবার চোখের সামনে ভেসে উঠে। যা প্রায়শ জীবনহীনকে অর্থময় করে বলে মনে হয়। না, এই মুভিটি দেখে জীবন অর্থহীন মনে হয় নি। এই প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি, একই পৃথিবীর মানুষ হিসেবে আমাদের সবার একাত্ন হবার বিন্দু কোনটি? আমাদের মতো জনবহুল দেশে যারা বসবাস করে, বিশেষ ঢাকা শহরে- তাদের কাছে ডিয়াগোর নিস্তরঙ্গ শহরটি ভূতুড়ে মনে হয়। এই মুভির কাহিনীতে সিনেম্যাটিক কোনো বাক নেই। এখানে জাপানী জীবন যাপনের কিছু সাধারণ উপাদান টের পাওয়া যায়। যেগুলো একই সাথে লোকাচার এবং সম্পর্ককে বৈশিষ্ট্যসূচকভাবে দেখিয়ে দেয়। সবশেষে বলা যায়, আমাদের চিন্তাকে যদি জাপানী চিন্তার সমান্তরালে না রাখা যায় তবে আপাত সহজ সাবটাইটেলের মুভিটির ভেতরে ঢুকা অনেকাংশে অসম্ভব। বোধ করি ‘ওকুরিবিটো’ শব্দটির ইংরেজী তা পাশ্চাত্য ধারণাকেই ব্যক্ত করে। তাই এর গুঢ় অর্থ খোঁজা কঠিন চেষ্টার বিষয়। এই মুভির কলাকুশলীদের নিয়ে তেমন কিছু বলার নাই। সবার অভিনয় বিশ্বাসযোগ্য। পুরো মুভি জুড়ে ছিলো ডিয়াগো। এমন কোনো দৃশ্য পাওয়া যাবে না যেখানে ডিয়াগোর উপস্থিতি নাই। তিনি এমনভাবে অভিনয় করেছেন, তার আচ পাওয়া যায় মনে। ডিয়াগো চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাশাহিরো মোটোকি, এর জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। ছবিটি ২০০৮ সালে মন্ট্রিল ওয়ার্ল্ড ফিল্ম ফ্যাস্টিভেলে সর্বোচ্চ পুরস্কার আর ২০০৯ সালের অস্কারে সেরা বিদেশী ভাষা ক্যাটেগরীতে পুরস্কার জিতে নিয়েছে। মিউজিক স্কোর অসাধারণ। মিউজিক করেছেন জো হিসাইশী। বলা যায়, ডিয়াগোর পরে যার উপস্থিতি শক্তিশালী - তাহলো মিউজিক।


নিজের সম্পর্কে লেখক

ইচ্ছেশূন্যতার কোন অর্থ হয় না। মানুষ নিজেই ইচ্ছের রূপান্তর। তার বাসনাগুলো নানারূপে অধরাকে ধরে, অনুধাবন করে। একই সাথে সে নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। এই চাওয়া-না চাওয়ার কি ঘটে সেটা কথা নয়। কথা হলো, তাকে চাইতে হয় আবার চাওয়াটাকে অস্বীকার করতে হয়। এই স্বীকার-অস্বীকারের দ্বন্ধে যেটুকু আশা বেঁচে থাকে তাকে বলি, এই তো আছি। এই বেঁচে থাকাটাই আনন্দের।

ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।