ভাষা আন্দোলনের “বাঙাল” বয়ান - নয়া উপনিবেশ বিরোধিতার “পবিত্র দিবস” আর “আধ্যাত্মিক” উৎস সন্ধান

মুখোমুখিঃ আমি বনাম কলম্বাস “আমেরিকা আবিষ্কার করিয়াছেন কে?” “মহামতি কলম্বাস”। এই বয়ান আমাদের কি বলে? স্কুলে ছোটবেলায় শেখা এ বয়ান আমাদের কি বলে? এ বয়ান যখন আমাদের বয়ান হয়, তখন আসলে কি হয়? এ অংশে আমাদের আলোচনা এই কয়টা প্রশ্ন ঘিরেই। এই “বয়ান” থেকে আমরা যা পাই তাকে মোটামুটি এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়- ১। কলম্বাস নামক কোন একজন ব্যক্তি “আমেরিকা” নামক স্থানটি সৃষ্টি করেছেন। অথবা ২। কলম্বাস নামক কোন একজন ব্যক্তি আমেরিকা নামক কোন একটি জায়গা খুঁজে পেয়েছেন, যে জায়গার অস্তিত্ব আগে কেউ যানতোনা, এমনকি ঐ অঞ্চলের অধিবাসীরাও না। এই বয়ান থেকে আমরা কি সত্য কিছু পেলাম? কিছু তথ্য উপাত্ত ইতিহাস ঘাটতে গেলে এ বয়ানের পরিপূর্ণ অসততা আমরা খুঁজে পাবো অবশ্যই। ইউরোপ যে ভূখন্ডের নাম দিয়েছে “আমেরিকা”, ইনকা, এজটেক, মায়ান এহেন আরো শত জাতিগোষ্ঠী যাদের ছিলো এই ভূখন্ডে বসবাস, তারা নিজেদের দেশ, নিজেদের থাকার জায়গাকে নিজেদের ভাষায় দিয়েছিলো টিয়ুটিহুয়াকান, টিটিকাকা এইরকম আরো কত শত নাম। উত্তর আর দক্ষিন আমেরিকার মাটি-নদী-হাওয়া-জঙ্গলের আশ্রয়ে বেঁচে থাকা সহস্র জনগোষ্ঠী তাদের নিজ নিজ বাসভূমের যে নামই দিক, ইউরোপের চোখে এই পুরো ভূখন্ডের একটাই নাম, আর তা হলো “আমেরিকা”। একটা নাম জানা সহজ, আয়ত্ত করা সহজ, এই নামের সাথে জড়িত ভূমি, সেই ভূমির মানুষ, সেই ভূমির সম্পদের সরলিকৃত ধারণা পাওয়া সম্ভব, এ কারণেই হয়তো। লক্ষ/কোটি মানুষের কাছে যেই ভূমির অস্তিত্ব সবসময়ই ছিলো, ১৪৯২ সালে একজন ইতালিয়ানের সেই ভূমি আবিষ্কারের দাবী তাই অসত্য ছাড়া আর কিছু না। তারপরও যদি ইউরোপীয় “জানা পৃথিবী” তত্ত্ব মেনে নেই। যদি মেনে নেই, এশিয়া-ইউরোপ-আফ্রিকা এই তিন ভূখন্ডের পারস্পরিক যোগাযোগ জানা-পড়ায় এই তিন ভূখন্ডই ছিলো তখন পর্যন্ত “জানা পৃথিবী”, আর এই “জানা পৃথিবী”র মানুষ হিসেবে আমেরিকা আবিষ্কারের কৃতিত্ব কলম্বাসের তাহলেও কি এই বয়ান সত্য হয়ে যায়। মোটেও না। আমেরিকার অস্তিত্ব জানতো প্রাচীন মিশরীয়রা, আমেরিকায় “চীন” দেশীয়দের অভিযান ইতিহাস স্বীকৃত এবং প্রত্নতাত্মিক প্রমান সর্বস্ব সত্য। কিছু প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থেও “আমেরিকা” সদৃশ ভূখন্ডের সন্ধান পাওয়া যায়। এমনকি কলম্বাসের ৫০০ বছর আগেই ইউরোপের অধিবাসী নরওয়েজিয়ান ভাইকিংরা আমেরিকায় গেছে, অস্থায়ী কলোনিও গেড়েছে, অবশ্য তৎকালিন ইউরোপীয়রা নরওয়েজিয়ানদের সভ্য ইউরোপীয়ান না বরং জংলি ভাইকিং হিসাবেই গণ্য করতো। “কলম্বাস আমেরিকার আবিষ্কারক” তাই কার চোখে, কার জানা শোনায়? কলম্বাসের জন্ম ১৪৫১ খ্রীষ্টাব্দে, ইতালিতে। আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে উল্টোপথে “ইন্ডিয়া” নামক ঐশ্বর্যময় ভূখন্ডে পাড়ি জমানোর তার পরিকল্পনা পর্তুগাল, জেনোয়া, ভেনিস আর ইংল্যান্ডের রাজ দরবারে উপেক্ষিত হওয়ার পর স্পেনের দরবারে আদৃত হয়, চুক্তি হয়, তিনি পান সাগরের এডমিরাল পদ, পান নতুন আবিষ্কৃত উপনিবেশের গভর্ণরের পদ, ব্যবসা আর লুন্ঠনের লভ্যাংশের ভাগ। নিজের আবিষ্কৃত ভূখন্ডের নাম অবশ্য তিনি “আমেরিকা” দেন নাই। তিনি এই ভূখন্ডকে ভেবেছেন “ইন্ডিয়া”, তার ভাষায় “ইন্ডিজ” আর এই ভূখন্ডের অধিবাসীরা “রেড ইন্ডিয়ান”, লাল রঙের ইন্ডিয়ান। এই ভূখন্ড যে ইন্ডিয়া না বরং অন্য কোন মহাদেশ তা বুঝতে ইউরোপিয়দের সময় বেশি লাগে নাই, বোঝার সাথে সাথে এর নাম পরিবর্তন হয়ে আমেরিকা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এর অধিবাসীরা, তারা নিজেরা নিজেদের যে নামেই ডাকুক, তারা লাল ইন্ডিয়ানই রয়ে গেছে, তাদের এই পরিচয়ের মধ্যে বেধে ফেলে তাদের শোষন করা, ধ্বংস করা ইউরোপীয়দের জন্য হয়েছে অনেক সহজ। এই শোষন, এই লুন্ঠন, এই আগ্রাসনের নাম “উপনিবেশ”। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ভিন্ন দেশ ও জাতির ওপর আগ্রাসন, দখলদারিত্ব, শোষন নতুন কিছুনা, কিন্তু সাম্প্রতিক কালে ইউরোপের কতিপয় দেশের ক্ষমতা বিস্তার, শোষন আর দখলের দৌরাত্মের ইতিহাসময় “উপনিবেশ” বিশ্ব সভ্যতায় অস্বাভাবিক আর নতুন একটা ঘটনা, গতিময় কিন্তু নিষ্ঠুর। জল পথে ইউরোপীয়দের বিশ্ববিজয়ের প্রতিযোগিতার প্রথম দিককার নায়ক ক্রিস্টোফার কলম্বাস, ইউরোপীয় উপনিবেশেরও। আমেরিকার একের পর এক দ্বীপ আবিষ্কার করেছেন তিনি, ইউরোপীয় বয়ানে সৃষ্টি করেছেন, উপনিবেশ স্থাপন করেছেন, শোষন করেছেন। “কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন” এই বয়ান তাই উপনিবেশী ইউরোপীয় বয়ান, এই দৃষ্টিভঙ্গি তাই উপনিবেশী ইউরোপিয় দৃষ্টিভঙ্গি। এই বয়ান, এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি হলো কেমন করে, কবে থেকে? স্কুলে কাঁচা বয়সেই সমাজ বিদ্যার পাঠে এই উপনিবেশী জ্ঞান আমি পেলাম কেমন করে ? দুইশ বছরের উপনিবেশী চাবুকের আঘাতে ক্ষুদ্ধ বাঙালির পাঠ্যক্রমে কলম্বাস কেনো একজন “ভিলেন” না, কেনো একজন “শয়তান” না। উপনিবেশক ইউরোপের এই নায়ক কেমন করে আমাদের নায়ক হয়? এতে লাভ কার, ক্ষতিই বা কার? আমাদের শিক্ষায়, জানা শোনায় এইরকম উপনিবেশি জ্ঞানের প্রভাব কতোটুকু ? উদাহরণ আর প্রভাব খুঁজতে গেলে খুঁজে পাওয়া মোটেও কষ্টসাধ্য হবেনা। “কলম্বাসের আমেরিকা” আবিষ্কারের মতো “মার্কো পোলোর প্রথম চীন ভ্রমন” এমন আরো অনেক সাধারণ উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে উপনিবেশী জ্ঞানের বিস্তার আর গভীরতা বুঝতে গেলে কষ্ট একটু করতেই হবে। উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতেই কষ্টটুকু করতে হবে। উপনিবেশী জ্ঞান ও আমাদের অবস্থান উপনিবেশী জ্ঞানের বিস্তার আর গভীরতা আমরা যতটুকু ভাবছি, তারচেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত, অনেক বেশি গভীরে কার্যকর তার ক্রিয়া তৎপরতা। আমাদের শিক্ষা, নৈতিকতা, সমাজ চিন্তা সবকিছুই উপনিবেশী জ্ঞান শাসিত, এমন কি অনেক ক্ষেত্রে আমাদের বিপ্লব চিন্তাও। বিষয়টা দুই ভাবে বোঝা যায়। প্রথমত নন্দনতত্ত্ব আর নৈতিকতা সম্বন্ধে আমাদের প্রতিদিনকার ধারণাগুলোর উদাহরণ বিশ্লেষণ করে। দ্বিতীয়ত, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আর শিল্প-সাহিত্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে। “উপনিবেশী জ্ঞান” শব্দটাকে এডওয়ার্ড সাইদ বলেছেন “উপনিবেশী ডিসকোর্স”, “জ্ঞান” শব্দটার বদলে ডিসকোর্স শব্দটা ব্যবহার করলে বিষয়টা বুঝতে সুবিধা হয় বেশি। “ডিসকোর্স” শব্দটা সাইদ যে অর্থে ব্যবহার করেছেন সে অর্থে শব্দটাকে প্রথম ব্যবহার করেন প্রখ্যত ফরাসি দার্শনিক “মিশেল ফুকো”। “ডিসকোর্স” শব্দটা দিয়ে বোঝানো হয় বই-পত্র, সভা-সেমিনার, নাটক-সিনেমা এরূপ সংস্কৃতির মাধ্যমগুলোতে কোন একটা বিষয়ে জ্ঞানের প্রবাহকে, যার মাধ্যমে একটা সাধারণ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, “আমেরিকার বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নেয়, তারা সবাই সন্ত্রাসী” এই বয়ান একটা ডিসকোর্স। বহু বই-পুস্তক, সভা-সেমিনার, নাটক-সিনেমার মাধ্যমে, বহু রাজনীতিবিদ আর বুদ্ধিজীবীর অক্লান্ত শ্রমে বিশ্বের একটা বড় অংশের মানুষের চিন্তা জগতে প্রতিষ্ঠিত এ ডিসকোর্স। এইসব ডিসকোর্স আমাদের ভালো/মন্দ আর গ্রহণ/বর্জনের মতো ম্যানিকিয় ধারণাকে নিয়ন্ত্রন করে অনেক ক্ষেত্রেই। এডওয়ার্ড সাইদ তার “অরিয়েন্টালিজম” নামক পুস্তকে পশ্চিমের সাহিত্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন কিভাবে ইউরোপের সাধারণ মানবতাবাদী অথবা প্রগতিবাদী সাহিত্যও “উপনিবেশী ডিসকোর্স” তৈরি করে, আর উপনিবেশ তৈরি করতে, টিকিয়ে রাখতে কিভাবে ব্যবহার করে সেই ডিসকোর্স। উপনিবেশী এই ডিসকোর্সকেই সাইদ বলেছেন অরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যবাদ। প্রাচ্যকে জানার জন্য ইউরোপীয় যে জ্ঞান তা প্রাচ্যকে এমন ভাবে জানতে চায়, যেমন ভাবে জানলে প্রাচ্যকে শোষন করা যায়, দখলে রাখা যায়। আবার প্রাচ্যতত্ত্ব পাঠ করে প্রাচ্যের মানুষ নিজেকে চেনে ইউরোপের চোখে, উপনিবেশী শাসকের চোখে সে দেখে তার সমাজ বাস্তবতা। একটু উদাহরণ সহযোগে আলোচনা করা যাক। আমি কে? এই প্রশ্নটা অধিবিদ্যার বিষয়, কিন্তু এই প্রশ্নটা এইখানে আমি করতে চাই, অধিবিদ্যক প্রশ্ন হিসেবে নয়, সমাজতাত্বিক প্রশ্ন হিসেবে। ব্যক্তি হিসেবে আমার পরিচয় অবশ্যই আমার সমাজ নির্ধারণ করে, প্রথমে আমার নাম দিয়ে আমি একটা পরিচয় পাই। তারপর, আমি একজন বাঙালি, একজন মুসলমান বাঙালি বা হিন্দু বাঙালি ইত্যাদি। এইবার দেখি এই বাঙালি জাতটা সম্বন্ধে ঠিক কি ধরণের ডিসকোর্স এর মুখোমুখি হই আমরা প্রতিদিন। আপামর বাঙালির ক্ষেত্রে “বাঙালি মিশ্র জাতি”, “বাঙালি আলসে জাতি”, “বাঙালি দুর্ণীতিপরায়ন”, “বাঙালি ঘরকুনো, এডভেঞ্চার তার ধাতে নেই”, “মধ্যবিত্ত বাঙালি মানেই ছা পোষা চাকুরিজীবী”, “বাঙালি আরাম প্রিয়, খাদক, পেটুক”, বাঙালি নারীর ক্ষেত্রে “বাঙালি নারী শান্ত শিষ্ট আনত নয়না, পুরুষ সেবিকা”, বাঙালি মুসলমানের ক্ষেত্রে “ইসলাম শান্তির ধর্ম, রিপুর বিরুদ্ধে জেহাদই আসল জেহাদ” এইরকম নানাবিধ ডিসকোর্স সেই ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। উপরের এইসব বয়ানের কোনটাই যৌক্তিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য নয়, এইসব বৈশিষ্ট বাঙালি জেনেটিক ভাবে ধারণ করেনা, বাঙালি র আবহাওয়ার সাথেও এর সম্পর্ক নাই। অসংখ্য বই-পুস্তক, গল্প-কবিতা-প্রবন্ধের বয়ানে, অনেক লেখক-বুদ্ধিজীবীর সচেতন অথবা অচেতন বারংবার প্রয়োগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এইসব ডিসকোর্স, জন্ম দিয়েছে বাঙালি সম্বন্ধে নির্বিষ, হীন হেজিমোনির। এইসব ডিসকোর্স, এইসব হেজিমোনিক ধারণা তৈরির কাজ প্রথম করেছে ব্রিটিশরা, অত্যন্ত সচেতন ভাবে। যে ব্রিটিশরা বাঙলার বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিলো দুইশ বছর, বাঙালির রক্ত নিংড়ানো সম্পদে যারা জন্মদিয়েছে নিজ দেশে শিল্পবিপ্লব, সেই ব্রিটিশ সেই সময়টায় বিশ্বের অন্যতম সভ্য জাতি, সেই সভ্য জাতি যখন আরেক জাতির ওপর আগ্রাসন, শোষন চালায়, বজায় রাখে দখলদারিত্ব তখন তার পক্ষে উচ্চ মূল্যবোধ সম্পন্ন যৌক্তিক কারণ দেখানো দরকার হয়ে পরে। ঠিক যেমন এখন আমেরিকা প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, “ইরাক বা আফগানিস্তানের জনগোষ্ঠী অনগ্রসর, অশিক্ষিত, বর্বর, নিজেদের শাসন করার ক্ষমতা তাদের এখনো হয়নি, হলেই মার্কিন সৈন্য তাদের দেশ ছেড়ে দেবে”, বাঙলা দখল করা এবং করে রাখার এই রকমই কিছু যৌক্তিক ধারণা সেই সময় দরকার হয়ে পরেছিলো ব্রিটিশ উপনিবেশীদের, আর ঐসব যৌক্তিকতাই তখন তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ অরিয়েন্টালিস্টরা। এইসব অরিয়েন্টালিস্টদের গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণ সাহিত্যে বারবার উঠে এসেছে ভারতীয় উপমহাদেশের অনগ্রসর, আলসে, বর্বর, পেটুক সার্বভৌম শাসনের ক্ষমতাহীন মানুষের কথা, যারা জ্ঞান গরীমায় চিন্তা চেতনায় সবদিক থেকেই সাদা ব্রিটিশদের চেয়ে পশ্চাতপদ। এদের কোন স্বাধীন ইতিহাস নেই, নেই কোন সভ্যতা, এদের ইতিহাস মানে স্বৈরশাসকের হাতে শোষিত হওয়ার ইতিহাস। ব্রিটিশরাতো বরং এদের মুক্ত করবে। অরিয়েন্টালিস্টরা শুরুতে এই কাজগুলো করেছেন উপনিবেশী শাসন সুবিধার ব্যাপারে অচেতন থেকেই, অনেক ক্ষেত্রেই অজ্ঞতা আর রোমান্টিকতা থেকে। রবার্ট ওরেম অথবা রিচার্ড জোসেফ সুলিভানের মতো লেখকদের রচনা যুগিয়েছে এই সব উপনিবেশী জ্ঞান, যার সার কথা ব্রিটিশ উত্তম, ইন্ডিয়ান অধম। এসময় যে উপনিবেশী ধারার প্রাচ্য চর্চাই হয়েছে তা না। এর ব্যাতিক্রমও আছে। “জ্ঞান ই ক্ষমতা”। কথাটা অনেকেই জানি আমরা, কিন্তু পুরো অর্থটা ধরতে পারি বা না পারি। পলাশীর প্রান্তরে বাঙালির পরাজয়ই যে ব্রিটিশ শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য পর্যাপ্ত না এটা ব্রিটিশরা বুঝতো ঠিকই। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দ পলাশীর যুদ্ধ, আর ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দেই ব্রিটিশরা প্রতিষ্ঠিত করে “ দি এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল”। বাঙালি আর ভারতীয়দের জানার উদ্দেশ্যে তাদের ভাষা, ইতিহাস, ধর্ম তাবৎ বিষয়ে জানা, অনুসন্ধান করাই ছিলো এই সোসাইটির কাজ। এই সোসাইটিতে কাজ করেছেন উইলিয়াম জোনস, এইচ টি কোলব্রুক, জেমস প্রিনসেপের মতো নিখাদ জ্ঞান পিপাসু প্রাচ্যবীদরা। তবে তাদের এই জ্ঞান পিপাসায় ব্রিটিশ শাসক অর্থ যোগান দিয়েছে যতদিন পর্যন্ত শাসনের জ্ঞান আহরণ সমাপ্ত না হয়। ১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দ থেকেই গবেষণা কাজে অর্থ যোগানের পরিমাণ কমিয়ে দেয় ব্রিটিশ সরকার। তখন থেকে শুরু জেমস মিল আর লর্ড ব্যারিংটন ম্যাকলের পলিসির সময়। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচ্যবাদের দ্বিতীয় ধাপের শুরু এখান থেকেই। আধুনিক গণতন্ত্রের দার্শনিক প্রবক্তাদের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ জেমস মিল ছিলেন একজন উগ্র বর্ণবাদী হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট। ভারত বর্ষের ইতিহাস ঐতিহ্যকে তিনি অভিহিত করেছিলেন “শুণ্য পাতা” বলে। এ শুণ্য পাতা ভরার কাজ করতে হবে সভ্য ঐতিহ্যবান ব্রিটিশকেই। ১৮১৮ সালে প্রকাশিত তার পুস্তক “ দি হিস্ট্রি অফ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া”তেই তিনি প্রকাশ করেন এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি। সেই সময় অত্যন্ত জনপ্রিয় এ পুস্তক পরবর্তি সময়ে বিবেচিত হয়েছে ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম রেফারেন্স পুস্তক হিসেবে, ইউরোপীয় এমনকি অনেক ভারতীয় ইতিহাসবিদের কাছেও। ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষানীতি প্রনয়োনের দায়িত্বে ছিলেন লর্ড ম্যাকলে, যিনি মনে করতেন বাঙালি ইতিহাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি সবকিছুতেই হীন। ভারতের ইতিহাসকে তিনি বলেছেন, ত্রিশফুট উচ্চতার রাজা আর ত্রিশ হাজার বছরব্যাপী শাসনের মতো উদ্ভট ইতিহাস। তিনি মনে করতেন, সারা পৃথিবীর সব সাহিত্য এক করলেও তা ইংরেজি সাহিত্যের সমপরিমাণ হতে পারবেনা। ভারতে শিক্ষানীতি প্রনয়নের সময় যে নীতি তিনি মেনে চলেন, তাকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে- “আমাদের সীমিত ক্ষমতা দিয়ে গোটা জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করা অসম্ভব। আপাতত আমরা দোভাষী-ব্যাখ্যানকারের এমন একটা শ্রেণী তৈরি করব যারা হবে আমাদের এবং আমাদের শাসিত মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের মধ্যকার দোভাষী। রক্তে বর্ণে এরা হবে ভারতীয়, কিন্তু রূচি, মতামত, নৈতিকতা আর বোধ বুদ্ধিতে ইংরেজ। এদের ওপর আমরা ছেড়ে দেব উপ-মাতৃ ভাষাগুলো পরিমার্জনের ভার, পশ্চিমা শ্রেনীকরণবিদ্যা থেকে ধার করা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দিয়ে সেই সব ভাষা সমৃদ্ধ করার দায়িত্ব”। এই পর্যায়ে এইরকমই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে সচেতন ভাবে প্রয়োগ শুরু হয় প্রাচ্যতত্ত্বের, যেইসব ডিসকোর্স তৈরি করে “বাঙালি কে শাসন” করা নিজেদের জন্য ফরজ করেছে ব্রিটিশ উপনিবেশী শাসক, ঠিক সেইসব ডিসকোর্স শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমেই তৈরি করা হয় রক্তে বাঙালি আর রুচি/নৈতিকতায় ইংরেজ একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এই শ্রেণীর একটা ট্রাজেডি আছে। এই শ্রেণীর একটা নাম আছে। এই শ্রেণীর নাম “বাঙালি বাবু”। ব্রিটিশ বোধ বুদ্ধি আর নৈতিকতা গ্রহণ করে কিন্তু সে তার প্রভু ব্রিটিশের সমান মর্যাদা পায় না। কারন সম্পর্কটা এখানে শোষক আর শাষিতের। যে প্রাচ্যতত্ত্ব ব্রিটিশকে প্রভু করে সেই একই প্রাচ্যতত্ত্ব বাঙালিকে করে দাস। এই ট্রাজেডি সেই ব্রিটিশ উপনিবেশীক সময় থেকে এখনো বহন করে চলেছি আমরা। এই বাঙালি বাবু, ব্রিটিশ দাসানুদাসরাই আমাদের শিক্ষা, সাহিত্য, রাজনীতির বৃহৎ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে ব্রিটিশ আমলে, জন্ম দিয়েছে ইউরোপের অনুকরণে বাঙালি রেঁনেসা, জন্ম দিয়েছে এক জাতি তত্ত্ব, দ্বিজাতি তত্ত্বের মতো নয়া উপনিবেশের বন্ধু বৎসল রাজনৈতিক তত্ত্ব। আর তার ফল ভোগ করে চলেছি আমরা আজও। নিহাররঞ্জন রায় শেষ বয়সে বিষয়টা বুঝেছিলেন। দুঃখের সঙ্গে তিনি বলেন, যে- রেনেসাঁস ও জ্যোতির্ময়কাল একান্তভবে ইউরোপের ঘটনা তকে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের বলে ভাবলেন, এবং এভাবে রেনেসাঁসের মীথ তৈরি হলো ভারতবর্ষে। ঔপনিবেশিক ভারতে রেনেসাঁস কেন ঘটতে পারেনা তার কারণ বিশ্লেষন করে গেছেন নিহাররঞ্জন। নয়া উপনিবেশী বাস্তবতা বুঝি বা না বুঝি, মানি বা না মানি, আমাদের, এই বাঙলা অঞ্চলের মানুষের বাস্তবতা এক নির্মম নয়া উপনিবেশী বাস্তবতা। আমাদের আনন্দ, বোধ, নন্দনচিন্তা, নৈতিকতায় গর্বিত স্বাতন্ত্র নেই, নেই এগিয়ে যাবার উপযোগিতা, আছে শুধু উপনিবেশিক দাসত্বের মূঢ়তা। “সাদা” এখন আমাদের ভাষায় ‘সুন্দর”এর প্রতিশব্দ, কিভাবে আরো সাদা হতে হবে তার বিজ্ঞাপন দেখে কসমেটিক্সের বাজারে এখন শুধু নারীরাই না, পুরুষও ভীর জমায়, ঘরে-বাইরে-বনে-বাদারে-অফিস-আদালতে সবখানেই আচারে-চলনে-বলনে সাদা প্রভুর মতো হয়ে ওঠার চেষ্টা। এ অনুকরণ যে যত ভালো ভাবে করতে পারে, সেই ক্ষমতা আর সম্ভ্রমের কাতারে ততো ওপরে। গোটা জাতিই এক মনোবৈকল্য, জাতিগত ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স, হীনমন্যতায় আক্রান্ত। বাঙালি হওয়া যেন এক অপরাধ। এমনকি আমাদের মুক্তচিন্তা আর বুদ্ধিবৃত্তির জগৎও এই দাসত্ব মুক্ত না। আমার এই লেখার মান অনেক বাড়ে যখন এখানে পাশ্চাত্যের দার্শনিকদের নাম থাকে, “আধুনিকতা” আর “উত্তর আধুনিকতা” নামক পাশ্চাত্য ধারণার আলোচনা থাকে। “নয়া উপনিবেশী বাস্তবতা” আমাদের একজন বুদ্ধিজীবীকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে সাধারণ জনতার কাতার থেকে। একেবারেই সাধারণ কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। “আমেরিকা খারাপ, আমেরিকার ক্ষমতা খারাপ, আমেরিকা আমাদের জন্য ভালোনা, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আমাদের শত্রু ” এই সব কথা এদেশের একটা সাধারণ খেটে খাওয়া বিদ্যালয়ের বিদ্যাহীন মানুষও বোঝে। তাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, কেন আমেরিকা এইরকম, তার উত্তর হবে “আমেরিকার ক্ষমতা বেশি, আমেরিকা ক্ষমতালিপ্সু, আমেরিকা অন্যদের ওপর প্রভুত্ব করতে চায়, আমেরিকা সারা দুনিয়া শাসন করতে চায়” এইরকম কিছু কথা। তার কথার সীমাবদ্ধতা আছে, অর্থনীতির বিষয়টা নাই, পুঁজিবাদের বিশ্লেষণ নাই, কর্পোরেট বিশ্ববিক্ষার ধারণা হয়তো তার নাই, কিন্তু আমেরিকা সম্বন্ধে তার এই বিশ্লেষন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী অবস্থানের কিছু সত্য কারণও কিন্তু নির্দেশ করে, ক্ষমতাবানের অন্যের ওপর কর্তৃত্ব করার চিরকালীন বোধের কথা সে জানে। অন্যদিকে আমাদের প্রচলিত বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার জগতে সাম্রাজ্যবাদের পুঁজিবাদী উৎস খুঁজতে গিয়ে, সাম্রাজ্যবাদের অপেক্ষাকৃত তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও যে শেষ পর্যন্ত একটা খন্ডিত ধারণায় পরিণত হয়, আমরা অনেকেই তা বুঝিনা। সাম্রাজ্যবাদের শুধু অর্থনৈতিক কারণ খুঁজতে গিয়ে এর মানবিক কারণটাই আমরা খুঁজে পাই না। এতে দুইটা সমস্যা তৈরি হয়। প্রথমত, আমাদের নিজেদের ধারণাটাই হয় খন্ডিত, অসম্পূর্ণ, আবার সাম্রাজ্যবাদ কেনো খারাপ সেটা বোঝাতে গিয়ে যখন আমরা দ্বান্দিক বস্তুবাদী কায়দায় পৃথিবীর ইতিহাস, অর্থনীতি, পুঁজিবাদ এইসব বোঝানো শুরু করি তখন এইসব বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচন সাধারণ মানুষের মাথার উপর দিয়েই চলে যায়। সাম্রাজ্যবাদ যে খারাপ এটা মানুষ জানে, সাম্রাজ্যবাদ কিভাবে কাজ করে তাকে কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে সেটা বোঝানোই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এইকাজে এদেশের প্রগতিশীল বামপন্থীদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে এখন সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীরা। “আমেরিকা ইসলামের শত্রু, সাম্রাজ্যবাদ ইসলামের শত্রু, সাম্রাজ্যবাদ মুসলমানদের দাস বানিয়ে রাখতে চায়, ধ্বংস করতে চায়, আমেরিকার বিরুদ্ধে জিহাদে নামতে হবে” এইসব বক্তব্যের সাথে একজন সাধারণ মানুষ নিজেকে যেভাবে সম্পর্কিত করতে পারে তার সাথে “পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ বিকাশ সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে হলে পুঁজিবাদ বুঝতে হবে, পুঁজিবাদ বুঝতে হলে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বুঝতে হবে” এহেন ইউরোপীয় কায়দার সাম্রাজ্যবাদ বিশ্লেষনের সাথে সেভাবে নিজেকে সম্পর্কিত করতে পারে না। আমাদের প্রধান শত্রু এই সাম্রাজ্যবাদের ব্যাখ্যায়, মোকাবেলায় তাই কার্যকর বয়ান প্রয়োজন, ওহাবী/পাকিস্তানী সাম্প্রদায়িক বয়ান না, ইউরোপিয়/মার্ক্সবাদী বয়ানও না, প্রয়োজন “বাঙাল” বয়ান। বাঙাল বয়ান “বাঙাল” বয়ান কেন? “বাঙাল” শব্দটা কেন? এটা আমার ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার, শব্দটার প্রতি আমার একধরণের স্বপ্নময় আধ্যাত্মিক মমতা আছে। অন্যকেউ চাইলে অন্য শব্দ ব্যবহার করতে পারে। “বাঙাল” শব্দটা এখানে আমি কোন ক্ষুদ্র জাতিগত অের্থ ব্যবহার করছিনা, করছি উপনিবেশী জ্ঞানের দাসত্বের বাইরের একটা মুক্ত লোকায়ত অবস্থান কে। শব্দটার একটা বিপ্লবী আমেজ আছে, ঐতিহাসিক ভাবে। ব্রিটিশদের মনোজগতে উপনিবেশের প্রথম শিকার পশ্চিম বঙ্গের ইউরোপীয় উপনিবেশীক শিক্ষায় শিক্ষিত “বাঙালি বাবু”রা পূর্ব বঙ্গের অইউরোপীয় মন মানষিকতার লোকজনদের “বাঙাল” ডাকতেন, অনেকে এখনও ডাকেন। এই “বাঙাল”ত্ম আমার গর্ব, “বাঙাল”ত্ম আমার মুক্তির পয়গাম। এই “বাঙাল”ত্ম, এই “অইউরোপিয় মূর্খতা”ই একজাতি তত্ত্ব আর দ্বিজাতি তত্বের ভ্রম থেকে আমাদের প্রাথমিক মুক্তি দিয়েছে, বায়ান্ন দিয়েছে, একাত্তর দিয়েছে, ভবিষ্যতে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চুড়ান্ত লড়াইয়ে বিজয় দিবে। বাঙাল বয়ানের আরেকটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এই বয়ান কোন পদ্ধতিগত বিষয় না, বরং দৃষ্টিভঙ্গিগত। প্রভূ আর দাসের মাঝে অবস্থানগত মূল পার্থক্য আসলে অর্থনৈতিক না, বরং দৃষ্টিভঙ্গিগত। একজন দাস আসলে জানেই না, তার প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে, তার কাছে তার দাসত্বই বাস্তবতা, স্বাভাবিক। তার উপর তার প্রভুর শোষনে অনৈতিক কিছু সে কখনো দেখেনা, শোষনকে সে তার ভবিতব্যই মানে। তার নিজের প্রতিযোগিতা, লড়াই, বিজয় এইসবের সীমারেখা সে বজায়ে রাখে অন্যান্য দাসের সাথে। প্রভু তার দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিযোগিতা আর লড়াইয়ের অতীত সত্ত্বা। এইসব সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি টিকে থাকে ভাষা দিয়ে তৈরি করা সবকিছুতে। একটা চিঠী, একটা বিজ্ঞাপন, একটা বই, গান, ধর্ম পুস্তক, আইন শাস্ত্র, সংবিধান ইত্যাদি আদায় করে নেয় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিগত লয়ালিটি। প্রভুর তৈরি আইন যখন দাস পড়ে দাস দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তখন সেই দাসের মুক্তি নাই। প্রকৃতি মানুষকে এমনভাবে বানিয়েছে যেখানে সবাই নেতা না, কেউ কেউ নেতা, বাকিরা অনুসারীরা। এই অনুসারীরা নেতার দৃষ্টিভঙ্গিকেই নিজেদের আইন হিসেবে মাথায় তুলে রাখে, এটা চরম বাস্তবতা, সমাজের সৃষ্টি এভাবেই। কিন্তু আমার নেতা যদি আমার নিজের নেতা না হয়, বরং হয় অন্য কারো দাস, সে যদি আমার স্বার্থ রক্ষা না করে রক্ষা করে অন্যকোন প্রভুর স্বার্থ, আমিও তখন টিকে থাকি অন্য কোন সাম্রাজ্যের দাস হয়ে। এর এই দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্যই দরকার বাঙাল বয়ানের। মানুষের সভ্যতার একটা মোটামুটি ধরণের ইতিহাস আছে, তার জ্ঞানেরও একটা ইতিহাস আছে। এই ইতিহাসে এক জাতি অধ্যয়ন করে আরেক জাতির জ্ঞান, বাড়ায় নিজের জ্ঞান, জন্ম দেয় নিজের জ্ঞান, আবার একসময় সেই জ্ঞানের আলো নিয়ে সামনে আগায় অন্য কোন জাতি। জ্ঞানের এই আদান প্রদানের সময় ঠিক কি কি ধরণের পারস্পারিক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করতে পার তার কোন খন্ডিত আলোচনা এখানে করতে চাইনা। তবে প্রভুত্ব বিস্তারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যে ভিন্ন জাতির জ্ঞান অনুশীলন করা যায় তা আগে আলোচন করেছি। এখন, ইউরোপীয় প্রভুত্বের জ্ঞান যখন বাঙালির জন্য পরিণত হয় দাসত্বের জ্ঞানে, তখন বাঙালি কি করবে? মৌলিক জ্ঞানের আদান প্রদান আর উপনিবেশী জ্ঞানের আগ্রাসনের পার্থক্য সে কিভাবে করবে। একমাত্র উপায় দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন, বাঙাল বয়ানের আবিষ্কার। ইউরোপীয় জ্ঞান অর্জন করতে হবে, দাসত্বের মন মানসিকতা নিয়ে নয়, ইউরোপীয় জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে পরিহাস করে, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, প্রভুসুলভ মন মানসিকতা থেকে। হীনমন্যতার চিকিৎসা উন্নাসিকতা, ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স এর ঔষধ সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স, আগ্রাসনের জবাব দিতে হয় আগ্রাসনে, সন্ত্রাসের জবাব সন্ত্রাসে। এর মাঝখানে কিছু নাই। সমানে সমানে লড়াই হলেই ক্ষতি এড়ানোর প্রয়োজনে মধ্যপন্থার আগমন হয়, তার আগে না। ফ্রাঞ্জ ফেনো তার “হোয়াইট স্কিন ব্লাক মাস্ক” আর “রেচেড অব দা আর্থ” পুস্তকে দেখিয়েছেন কিভাবে উপনিবেশী আগ্রাসন কিভাবে মনোবৈকল্য তৈরি করে। ফরাসি উপনিবেশের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ার মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে লড়েছেন ফ্রাঞ্জ ফেনো, নয়া উপনিবেশের চেহারা প্রথম যে কয়জন মানুষ চিনেছেন, ফেনো তাদের অন্যতম। ফেনো ডাক্তার ছিলেন, মনোবিজ্ঞান ছিল তার গবেষণার যায়গা। উপনিবেশী শোষন সন্ত্রাসে যে মনোবৈকল্য তৈরি হয় প্রতিরোধ, সংগ্রামই হয় তার চিকিৎসা, দেখিয়েছেন ফ্রাঞ্জ ফেনো। অহিংসা মুক্তি দেয় না। উপনিবেশের পর আমাদের নয়া উপনিবেশের দাস করে এই অহিংসা। লড়াই তাই হতে হবে হিংসাত্মক। সেই হিংসা, সেই বিদ্বেষ থাকতে হবে কবিতা থেকে রাজপথে। বুদ্ধিজীবীর কলম, চিত্রশিল্পীর তুলি, সঙ্গিতজ্ঞের বাদ্যযন্ত্র, রাজপথে সংগ্রামীর প্ল্যাকার্ড, হাতের লাঠি, ছুড়ে দেয়া ইট, প্রয়োজনে গেরিলা যোদ্ধার অস্ত্রের বুলেট এই প্রতিহিংসা কায়েম করবে। প্রভু-দাস সম্পর্কের যে ক্ষমতা কাঠামো আর সেই ক্ষমতা কাঠামোকে টিকিয়ে রাখে যেইসব হেজিমনিক ধারণা, আর সেইসব হেজিমনিক ধারণাকে টিকিয়ে রাখে যেইসব ডিসকোর্স, সেইসব প্রত্যেকটা ডিসকোর্সকে চিহ্নিত করতে হবে, আগ্রাসী হেজিমনিকে নিশ্চিহ্ন করে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে সংগ্রামী হেজিমনি। বাঙাল বয়ানে সাম্রাজ্যবাদ আমি সাম্রাজ্যবাদ বুঝতে চাই। আমার জীবনে, আমার বাস্তবতায়, আমার শিক্ষা ব্যবস্থায়, আমার নৈতিক ধারণায়, আমার অর্থনীতিতে সাম্রাজ্যবাদ জগদ্দল পাথরের মতো কিভাবে চেপে বসে আছে আমি বুঝতে চাই। এর শুরু কোথায়? এর আগে “আধুনিক” আর “উত্তর আধুনিক” শব্দ দুটো নিয়া একটু কথা না বললে হয় না। প্রথম যখন আমি আবিষ্কার করলাম “আধুনিক” বলতে একটা সুনির্দিষ্ট সময়, একটা কালখন্ড বোঝানো হয়, তখন আমার “বাঙাল” মাথায় ব্যাপারটা ঢোকে নাই। যা কিছু অধুনা তাই আধুনিক এমনই জানতাম এক কালে, সেই হিসেবে ১৪০০ বছর আগে হজরত মোহাম্মদের সময়ের লোকজন তাদের সময়কে আধুনিক কাল ভাবতো, আমার দাদা ভাবতো তার সময়কে, আর আমি ভাবি আমার সময়কে, আমার নাতি ভাববে তার সময়কে আধুনিক আর আমার সময়কে সেকেলে। অথচ ইউরোপীয় বয়ানে modern একটা সময়, মানুষের চুড়ান্ত বিকাষের মুহুর্ত। অথচ যা কিনা আসলে শুধুমাত্র ইউরোপের বিকাশের একটা মুহুর্ত, তাও আবার চুড়ান্ত কিছু না। নিজেদের সময়কে মানবেতিহাস আর মানুষের বিকাশের চুরান্ত সময় ভাবার একটা রোগ অবশ্য ইউরোপের অনেক আগে থেকেই আছে। এরা প্রতি শতাব্দিতেই ভাবে শেষ কাল আর বেশি দূরে নাই, প্রতি সহস্রাব্দে দাজ্জালের আগমন আর দুনিয়া ধ্বংসের জন্য পুরোপুরি তৈরি হয়, আর এদের মহামনীষীরা সবসময়ই নিজেদের সময়কে ভাবে মানুষের বিকাশের চুড়ান্ত সময়। রেঁনেসা আর উপনিবেশী লুন্ঠনের জোরে ইউরোপে যে জ্যোতির্ময়কালের আবির্ভাব তা মোটেই সারা বিশ্বের জন্য কোন জ্যোতির্ময়কাল না, বরং অনেকের জন্যই অন্ধকারকাল। ইউরোপে আধুনিক কাল, গণতন্ত্র আর শিল্প বিপ্লবের সাথে উপনিবেশের একটা যোগসূত্র আছে। যে সাম্রাজ্যবাদের কথা আজ আমরা বলি সেই সাম্রাজ্যবাদ আর নয়া উপনিবেশ একই জিনিস। আর এর জন্ম ইউরোপে গণতন্ত্রের আবির্ভাব আর শিল্পবিপ্লবের সাথে সম্পর্কিত। উপনিবেশী ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার রক্ষার স্বার্থেই আধুনিক কালের প্রথম গণতান্ত্রিক সংসদ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আবির্ভাব। যে শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে ইউরোপ আমেরিকার এতো প্রভাব প্রতিপত্তি, সেই শিল্প বিপ্লব চুড়ান্তভাবে নির্ভর করতো উপনিবেশের উপর। শিল্প বিপ্লবের জন্য উপনিবেশের প্রয়োজনীয়তা স্বিকার করতে কার্পণ্য করেনা পশ্চিমা ঐতিহাসিকরাও। তিন দিক দিয়ে শিল্প বিপ্লবে ভূমিকা রেখেছে উপনিবেশ। ১। উপনিবেশ থেকে উপনিবেশক পেয়েছে কাঁচামাল (Raw Materials)। ২। উপনিবেশ থেকে উপনিবেশক পেয়েছে সস্তা শ্রম। ৩। উপনিবেশে উপনিবেশক পেয়েছে নিজেদের প্রক্রিয়াজাত পণ্যের (Finished Goods) বাজার। আর তরতরিয়ে গড়ে উঠেছে শিল্প বিপ্লব। বাঙলার রক্ত চুষে গড়ে উঠেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। মজার ব্যাপার হচ্ছে ব্রিটিশরা এ দেশ থেকে সৈন্য সামন্ত আর লর্ড ভাইসরয়দের সরিয়েছে সে আজ পঞ্চাশ বছরের অধিক। অথচ উপরের যে তিনটা কারনে ইউরোপীয় শিল্প বিপ্লব গড়ে উঠেছে তরতর করে, সেই তিনটা ঘটনা এখনো ঘটে চলেছে খুব সহজ স্বাভাবিক ভাবে। আমরা এখনো পশ্চিমে কাঁচামাল আর সস্তা শ্রম বিক্রি করি আর পশ্চিমের সাদা চামরার প্রভুর মতো হতে খরিদ করি পশ্চিমের ফিনিশড পণ্য। উপনিবেশ তাই এখনো বিদ্যমান, নয়া উপনিবেশের চেহারায়। পশ্চিমের প্রভুত্ব টিকিয়ে রাখতেই পশ্চিম কখনো এই উপনিবেশের মৃত্যু চাইবেনা। আমরা চাইবো, আমাদের মুক্তির জন্য। অথচ, যেই “আধুনিক” শব্দটার পশ্চিমা ব্যাখ্যা শুনে প্রথমে মেনে নিতে চাই নি, সেই আধুনিক কাল বুঝতে গিয়ে আমরা যখন পাঠ করি আধুনিক কবিতা, আধুনিক দর্শন, আধুনিক সমাজ বিদ্যা আর মেনে নেই “আধুনিক” নামক সময়কে একটা কালখন্ড বলে, পশ্চিমের জ্ঞানে জ্ঞানী বলে নিজে নিজে গর্বিত বোধ করি, অন্যকে শিখাই আধুনিকতা কি, তখন আমি হই পশ্চিমা দাস। অথচ গত চার-পাঁচশ বছরের পশ্চিমা জ্ঞানকে যদি দাস মনমানসিকতা থেকে পাঠ না করি, জানার কাজটাও হয় আবার আধুনিক যুগ নামক কোন চুড়ান্ত যুগের বিভ্রান্তিতেও পড়তে হয় না। শুরু করেছিলাম, আধুনিক নামক শব্দের বিভ্রান্তি নিয়ে। অনেকে হাসতে পারেন, কিন্তু প্রথম যখন উত্তর আধুনিক শব্দটা শুনি, আমার “বাঙাল মাথা” এর অর্থ পুরোপুরি ভুল বুঝেছে। আমি ভেবেছিলাম উত্তর আধুনিক বলতে বুঝি অতি আধুনিক বোঝায়। “উত্তর আধুনিক প্রজন্ম ও আমাদের ভাবনা” নামের একটা পাঠচক্রে যাওয়ার সময় আমি ভেবেছিলাম ইদানীংকার আলট্রা মডার্ণ পোলাপান ঐ পাঠচক্রের বিষয়বস্তু, কিন্তু বিষয়টা যে আলট্রা মডার্ণ না বরং পোস্ট মডার্ণ তা বোঝার পর আকাশ থেকে পড়ার যোগাড়। আমার এক বন্ধুর অভিজ্ঞতা তো আরো মজার, “উত্তর আধুনিক মতবাদ” বলতে সে বুঝেছিলো পৃথিবীর উত্তরাঞ্চলে বিকোশিত কোন আধুনিক মতবাদ। অথচ নিজেদেরকে ইউরোপীয় জ্ঞান গরিমায় গর্বিত করতে আমি এবং আমার বন্ধু উভয়েই উত্তর আধুনিকতা পাঠ করে আধুনিকতায় পরে থাকা বাঙালিদের চেয়ে নিজেদের এগিয়ে থাকা নিয়ে গর্ব করেছি, অন্তত অল্প কিছুদিনের জন্য হলেও। আর একারণেই দরকার বাঙাল বয়ান। বাঙাল বয়ানে আমার কাছে আধুনিক কাল খন্ড বলে কিছু নাই। আধুনিক ধ্যান ধারণার বিরোধিতা করার জন্য তাই উত্তর আধুনিক বলেও আমার কাছে কিছু নাই। শিল্প বিপ্লব-পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের ধারাবাহিকতা এইসব কিছুও আমার কাছে নাই। আমার কাছে আছে শুধু জাজ্বল্যমান উপনিবেশ, মাথা হেঁট করা দাসত্বের লজ্জা। আমার সামনে শত্রু আছে উপনিবেশ, দুইশ বছর আগেও ছিলো, এখনো আছে। এই উপনিবেশ পশ্চিমের উপনিবেশ, পশ্চিমকে আমি তাই সন্দেহ করি। এই সন্দেহ আমাকে বাঁচাবে। আমি পশ্চিমের অর্জিত মৌলিক জ্ঞান আর উপনিবেশী জ্ঞানের পার্থক্য করতে পারবো। দাস মন মানসিকতা না থাকলে পশ্চিমের কোন তত্ত্ব বা ধারণা আমি অন্ধের মতো মেনে নেবোনা। আমার দেশে জন্ম নেয়া জ্ঞান ভান্ডারই হোক, আর হোক আরব থেকে আসা জীবন বিধান, অথবা ইউরোপীয় সাম্প্রতিক সমাজতত্ত্ব, এই সবের কোন কিছুই আমি সন্দেহ ছাড়া, বিচার বিশ্লেষণ ছাড়া, নিজের স্বার্থের সাথে উপযোগিতা ছাড়া গ্রহণ করবোনা। এভাবেই আমি সামনে এগোতে চাই। ইউরোপে শিল্পবিপ্লব হইছে তাতে আমার কি? আমার তো হয় নাই। আবার আমার দেশে যে ইউরোপের মতোই শিল্পবিপ্লব হইতে হবে সেই বাদ্ধবাধকতাই বা কে দিলো। ইন্ডিয়াঃ এক উপনিবেশী বয়ান কলম্বাস একজন মাত্র ব্যক্তি। আমেরিকার আদিবাসীরা সংখ্যায় লক্ষ কোটি, অথচ সেই কলম্বাসই এই লক্ষ কোটি মানুষের নাম পরিচয় বদলে দিয়ে তাদের বানালেন ইন্ডিয়ান, রেড ইন্ডিয়ান। আমেরিকার অধিবাসীরা যদি ইন্ডিয়ান না হয় তাহলে ইন্ডিয়ান কারা? ইন্ডিয়ান এই ভারতীয় উপমহাদেশ নামক ভূখন্ডের মানুষের পরিচয়। কিভাবে? এই ইন্ডিয়া আর ইন্ডিয়ান শব্দের উৎপত্তি কিভাবে। এই অঞ্চলের মানুষ কবে থেকে নিজেদের এই নামে ডাকা শুরু করলো? এই অঞ্চলের কোন মানুষের মুখে বা লেখা বইয়ের পাতায় না বরং শব


নিজের সম্পর্কে লেখক

General Secretary Aroj Ali Matubbar Pathagar



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।