অস্বাভাবিক তাড়াহুড়ায় ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র


জ্বালানি নিরাপত্তা ও শিল্পখাত ঝুঁকিতে পড়বে

বিদ্যুৎ সংকট সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার কথা বলে ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করতে বেসরকারি কোম্পানিগুলার সাথে চুক্তি করছে সরকার; আর এই চুক্তির পুরা প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে--অনেক ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই এবং অস্বাভাবিক তাড়াহুড়া করে। এমন বেসরকারি কেন্দ্র--ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র--চালু হলে সরকার প্রতিযোগিতামূলক দামে ওই বিদ্যুৎ কিনে নেবে। ফলে, প্রচলিত প্রক্রিয়ার বাইরে এমন তড়িঘড়ি উদ্যোগে একদিকে যেমন চলমান সংকট হয়ত কিছুটা উতরানো যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের শিল্প ও গেরস্থালি খাতে বিদ্যমান চরম বিদ্যুৎ সমস্যার কোনো টেকসই ও কার্যকর সমাধান নিশ্চিত করা যাবে না। চড়া দামে বিদ্যুৎ কিনে বিতরণ করতে হলে পরে তাতে করে রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ খাতের নিরাপত্তাও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। চিন্তা প্রতিবেদক

সরকার বলছে, আগামী আট মাসের মধ্যে মোট প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, কাজেই এতদ্রুত উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বেসরকারি উদ্যোগ দরকার ছিল। এই দুই ধরনের উদ্যোগ--রেন্টাল এবং কুইক রেন্টাল অর্থাৎ ভাড়া বিদ্যুৎ এবং তাড়িঘড়ি ভাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলা থেকে এক হাজার দুইশত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে আগামী আট মাসের মধ্যে, অর্থাৎ মোট পরিকল্পনার অর্ধেকেরও বেশি।

নিয়মের বাইরে ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ

ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির জন্য এ পর্যন্ত বিভিন্ন কোম্পানির সাথে চুক্তি করেছে সরকার। ইতোমধ্যে ১১০৭ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। যেসব কোম্পানি ফার্নেস ওয়েল এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে তাদের সাথে সরকার ৫ বছর এবং যেসব কোম্পানি ডিজেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে তাদের সাথে ৩ বছর মেয়াদী চুক্তি করেছে।

ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলার প্রাক্কলিত ব্যয়, সরকারের তরফে আয়, জ্বালানি ও কাঁচামাল, উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ও জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার সময় এসব বিষয়ে সরকারের তরফে বেশি কিছু জানানো হয় নাই। অনুসন্ধানে যা পাওয়া গেছে তা এরকম :

কোম্পানির

নাম

মালিক

/গ্রুপ

পরিমাণ

মেগাওয়াটে

জ্বালানি

উৎপাদনে আসার সর্বোচ্চ সময়

 

 

প্রতি ইউনিটের দাম

এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল লি.

যুক্তরাজ্য ভিত্তিক কোম্পানি

২০০                 

ডিজেল

২৮ জুলাই

১৪.৪০ টাকা

কোয়ান্টাম পাওয়ার লি.

অনিমেষ কুন্ডু (ব্যবস্থাপনা পরিচালক -অটবি)

২০০

 ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল

১২০ দিন

১২.৫২ টাকা           

সামিট পাওয়ার                                   

আজিজ খান (বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানের ভাই)

১০২

ফার্নেস অয়েল

৬-৯ মাস

৭.৬৯ টাকা

খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লি. (কেপিসিএল)

আজিজ খান         

১১৫

ফার্নেস অয়েল           

৬-৯ মাস

৭.২৯ টাকা           

জে ভি কনসোর্টিয়াম অব পিডিভি

 

১০০

ফার্নেস অয়েল

৯ মাস   

৭.৭১ টাকা           

আইএফডিসি-ভলকান এনার্জি

 

৪০

ফার্নেস অয়েল

৬-৯ মাস

৭.৭৭ টাকা

বাংলাট্র্যাক লিমিটেড

 

১০০

ফার্নেস অয়েল

৬-৯ মাস

৭.৭৬ টাকা

সিনহা পাওয়ার কোম্পানি  লি.

 

৫০

ফার্নেস অয়েল

৬-৯ মাস

৭.৭৭ টাকা

নর্দান পাওয়ার সল্যুশন লি.

 

৫০

ফার্নেস অয়েল

৯ মাস   

৭.৭৮ টাকা

জয়েন্ট ভেঞ্চার অব বাংলাদেশ ডিজেল প্লান্ট লি. এ্যান্ড প্রাইমোডিয়াল এনার্জি লি.

 

৫০

ডিজেল

১২০ দিন

১৩.৯৬ টাকা           

এপিআর এনার্জি

 

৪০

ডিজেল

৯০ দিন

১৪.৩৮ টাকা

ডাচ বাংলা পাওয়ার লি.

আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (প্রধানমন্ত্রীর সাবেক এপিএস)

১০০

ফার্নেস অয়েল

৯ মাস   

৭.৭৮ টাকা           

দেশ এনার্জি

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আনিসুল হক

১০০

ডিজেল

১২০ দিন

১৩.৩৩ টাকা           

আইইএল কনসোর্টিয়াম 

ওবায়দুল করিম(ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান)

১০০

ফার্নেস অয়েল

৬-৯ মাস

৭.৭৮ টাকা

ইন্টিগ্রেটেড পাওয়ার কোম্পানি            )

সালমান করিম (ওরিয়ন গ্রুপ

১০০

ফার্নেস ওয়েল

৯ মাস   

৭.৭৮ টাকা           

রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লি. ও পিডিবি

আবদুস সবুর (ব্যবস্থাপনা পরিচালক- আরপিসিএল)

২২৫

গ্যাস ও ফার্নেস ওয়েল

১ বছর   

৭.৭৮ টাকা

পাওয়ার প্যাক হোল্ডিংস লি.

রিক হক শিকদার (চেয়াম্যান, পাওয়ার প্যাক হোল্ডিংস লি.)

১০০

ফার্নেস অয়েল

৯ মাসের মধ্যে

৭.৭৮ টাকা

আরজেড পাওয়ার লি.

মুনওয়ার মিসবাহ মুবিন (ব্যবস্থাপনা পরিচালক -রহিমআফরোজ)

৫০

ডিজেল

১২০ দিনের মধ্যে

১৩.৭৪ টাকা

 *(এই প্রকল্পগুলা মূলত সবই ভাড়া বিদ্যুতের, কিন্তু যেগুলা থেকে খুব দ্রুত বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে বলে সরকার আশা করছে সেগুলোকে বলা হচ্ছে দ্রুত ভাড়া বিদ্যুৎ)

দরপত্র ছাড়াই সমঝোতার ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ

ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলার অধিকাংশই দরপত্র ছাড়া কেবল সমঝোতার মাধ্যমে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তবে বিনা দরপত্রে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়টি নিয়ম কানুন মেনেই করা হয়েছে বলে সরকার দাবি করেছে। সরকার বলছে, পিপিআর ২০০৮- এ বলা আছে সরকার রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে বিপর্যয় মোকাবেলায় টেন্ডার ছাড়া সরাসরি বিদ্যুৎ ক্রয় করতে পারবে। তাই দরপত্র ছাড়া বিদ্যুৎ কিনলেও আইনের বিপরীত কিছু হয় নাই। অথচ এ সংক্রান্ত আইন পর্যালোচনা করলে সরকারের বক্তব্যের ভিন্নরূপ দেখা যায়।

১৯৯৬ সালে তৈরি করা ‘বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতি’তে (প্রাইভেট পাওয়ার জেনারেশন পলিসি) দরপত্র ছাড়া আর কোনো বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রস্তাব গ্রহণ করার রীতি বন্ধ করা হয়েছিল। কারণ হল, দরপত্র ছাড়া বিদ্যুৎ প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়। পরে ২০০৩ সালে পিপিআর-২০০৩ (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রেগুলেশন) তৈরি হয় এবং ‘বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতি’ও এর আওতায় আনা হয়। নীতিটিতে দরপত্র আহবান করা, কোম্পানির তালিকা এবং সুনির্র্দিষ্ট প্রস্তাবনার কথা বলা ছিল। এটা অনেক স্বচ্ছ নীতি। এখনও এই নীতিমালা কার্যকর আছে। পিপিআর এর বিধান অনুযায়ী, ‘বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতি’র আওতাভুক্ত বিষয়ে অবশ্যই দরপত্র আহবান করতে হবে। যদিও পিপিআর ২০০৮- এর বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র জরুরি স্বার্থে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত অবশ্য ‘বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতি’র উল্টা হতে পারে না।

কারণ পিপিআরের এখতিয়ারে তা পড়ে না। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কেনার বিষয়টা ‘বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতি’র এখতিয়ারে। কাজেই ভাড়া বিদ্যুতের অথবা দ্রুত ভাড়া বিদ্যুতের বেলায় পিপিআরের দোহাই দেয়া অপ্রাসঙ্গিক। ‘বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতিমালা’ এড়িয়ে সরকার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দরপত্র আহবান না করেই বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে, যে কেন্দ্র থেকে পরে সরকার চড়া দামে বিদ্যুৎ কিনে নেবে।

আর এটা করতে গত আঠারো মাস ধরে সরকার চলমান সংকটকে তীব্র করে তুলেছে অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবে। সমস্যার সমাধানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলার রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত কাজ করা দূরের কথা দীর্ঘমেয়াদে কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগও শুরু করে নি বিদ্যুৎ খাতে। গত অর্থ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর যে পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে, তা এর আগের অর্থ বছরের চেয়েও কম। সব মিলিয়ে এমন অনিয়মতান্ত্রিক ও অস্বচ্ছভাবে বেসরকারি খাতে ভাড়া বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করার জন্য বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই কাজ করে আসছিল। যেটা আদতে সংকট তীব্রতর করার কাজ। শিল্প মালিক ও গৃহস্থের ভোগান্তি যাতে এতো দূর পর্যন্ত যায়, যাতে করে এমন অনিশ্চিত ও লোকসানি প্রকল্পের বিপক্ষেও জনমত তৈরি না হয়।

ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচের পরিমাণ

আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী নতুন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা ভাড়াভিত্তিক কোম্পানিগুলোকে ডিজেলে ১০ টাকা আর ফার্নেস তেলে ৭ টাকা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু সরকার সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী ডিজেল ও ফার্নেস তেলে  নতুন ভাড়াভিত্তিক কোম্পানিগুলো থেকে সরকার প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ কিনবে যথাক্রমে ১৪ ও ৮ টাকায় । নিচে এ সংক্রান্ত একটি চার্ট দেয়া হল

                           ডিজেল

 

ফার্নেস তেল 

  পিডিবি ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত খরচ(প্রতি কিলোওয়াট)        

প্রকৃত মূলধনী ব্যয়- বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন খরচ (৭০%)

প্রকৃত পরিচালন ব্যয়-কর্মচারী বেতন ও জ্বালানি (৩০%)

প্রকৃতভাবে মোট খরচ

সরকার ভাড়াভিত্তিক কোম্পানিগুলোকে পরিশোধ করবে(প্রতি কিলোওয়াট)

পিডিবি ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত খরচ(প্রতি কিলোওয়াট)        

প্রকৃত মূলধনী ব্যয়(৭০%)

প্রকৃত পরিচালন ব্যয়(৩০%)

প্রকৃতভাবে মোট খরচ

সরকার ভাড়াভিত্তিক কোম্পানিগুলোকে পরিশোধ করবে(প্রতি কিলোওয়াট)

১০ টাকা

৩.৫ টাকা

১.৫ টাকা

৫ টাকা

১৪ টাকা(গড়ে)

৭ টাকা

৩ টাকা

১ টাকা

৪ টাকা

৮ টাকা (গড়ে)

কোম্পানিগুলো যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করবে

ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো কি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করবে সে বিষয়ে কোনো সরকারি নির্দেশনা নাই। অন্যান্য দেশের ভাড়া বিদ্যুতের অভিজ্ঞতা বলছে, এসব কেন্দ্রগুলা অধিকাংশ সময়েই ব্যবহার করে পুরনো যন্ত্রপাতি। শিল্পোন্নত দেশগুলাতে বেহাল (আউট অব অর্ডার) বলে ঘোষিত যন্ত্রপাতি নিলামে উঠানো হলে সেগুলো বেসরকারি ভাড়া বিদ্যুৎ কোম্পানীগুলা কিনে নিয়ে আসে। এসব অচল মেশিনগুলোকে কোনোরকম ঠিকঠাক করে এগুলো দিয়ে তারা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। যার ফলে উৎপাদন নিশ্চিত থাকে না, আজ পাঁচ মেগাওয়াট উৎপাদন করলে কাল দুই মেগাওয়াট উৎপাদন করে।

বেসরকারি কোম্পানিগুলার পক্ষে সরকারের তরফ থেকে এ নিশ্চয়তা পাওয়া সম্ভব না যে, কতোদিন ধরে কি পরিমাণ বিদ্যুৎ তারা বিক্রি করতে পারবে। জাতীয় গ্রিডের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা সরকারের হাতে থাকায় সবসময় সরবরাহ নিশ্চিত করা যায় না। দেখা গেছে, বিদ্যুৎ ব্যবসার সাথে আদৌ কোনো সম্পর্ক নাই, এমন অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানও বেশি মুনাফা কামানোর জন্য তড়িঘড়ি কোম্পানি গঠন করে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন পেয়েছেন।

হয় দাম বাড়াতে হবে বহু গুণ, নয় বহু গুণ বেশি ভর্তুকি

ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুতের প্রথম প্রস্তাব দেয়া হয় জোট সরকারের আমলে। তখনকার বিদ্যুৎ সচিব ৪৫ টি ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রস্তাব নিয়ে আসে। এর উদ্দেশ্য ছিল বিএনপির ঘনিষ্ঠদের ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ দেয়া, এজন্য তখন বেশ তোড়জোড়ও হয়। তখনও বলা হয়েছিল, কোনো দরপত্র ছাড়াই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হবে। কিন্তু সরকারের মধ্যেই একটি অংশের বিরোধিতার কারণে তখন ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় নাই। পরবর্তীতে সামরিক বাহিনী সমর্থিত ফখরুদ্দিন সরকারের আমলে দুজন উপদেষ্টা ড. তামিম ও ড. ফজলুল কবির খান এ ধরনের উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা করেন। বর্তমান সরকারও নিজেদের মেয়াদের প্রথম আঠারো মাস বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ না নিয়ে সংকট তৈরি করে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুতের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছে।

দ্রুত ভাড়ার নাম করে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ আট থেকে ষোলো টাকায় কিনে ফি বছর কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে সরকারকে। সরকার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে প্রতি বছর যে অর্থ খরচ করবে তা দিয়ে কমপক্ষে একই ক্ষমতার তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা সম্ভব।

রাষ্ট্রীয় খাতে বর্তমানে কম্বাইন্ড সাইকেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়ে ১ টাকা ৩০ পয়সা, ওপেন সাইকেলে ১ টাকা ৪০ পয়সা এবং কাপ্তাই জল বিদ্যুতে পড়ে মাত্র ২৫ পয়সা। পিডিবির গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ পড়ে সর্বোচ্চ ২ টাকা। এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় হচ্ছে ২ দশমিক ৭০ টাকা। ভাড়ার বিদ্যুতের কারণে এ উৎপাদন ব্যয় এক লাফে সাড়ে ৪ টাকায় গিয়ে ঠেকবে। তখন হয় এমন দামে গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে হবে, নয় এ পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হবে। দাম বাড়ানো বা ভর্তুকি-এ দুইয়ের যেটাই করা হোক শেষ পর্যন্ত তা গ্রাহকদের কাঁধেই চাপবে। এই কেন্দ্রগুলা জ্বালানি হিশাবে ফার্নেস তেল ও ডিজেল ব্যবহার করবে জ্বালানি হিশাবে এ দুটো তুলনামূলক বেশি পরিবেশ দূষণ করে এবং বেশি ব্যয় সাপেক্ষও বটে। তাছাড়া জীবাশ্ম জ্বালানির মজুদ দীর্ঘস্থায়ী করতে বর্তমান দুনিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি হিশাবে এ দুইয়ের ব্যবহার নাই বললেই চলে।

ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র : অন্য দেশের নজির


জরুরি বিদ্যুৎ চাহিদার কথা মাথায় রেখে সাধারণত পাঁচ সাত বছর মেয়াদে ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার নজির অন্যান্য দেশে আছে। এরকম কেন্দ্র আছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তান, ইনডিয়া, শ্রীলঙ্কা, সৌদি আরব, তুরস্ক, আরব আমিরাতসহ বেশ কয়েকটি দেশে।

ফিলিপাইন :

উন্নয়নশীল দেশে বিদ্যুৎখাতের মতো রাষ্ট্রীয় সেবাখাত বেসরকারি করে দিলে তা জ্বালানি নিরাপত্তা ও শিল্পখাতের বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন নজির দক্ষিণ এশিয়াতেই আছে। বিদ্যুৎখাত বেসরকারি করে দিয়ে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ফিলিপাইন। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে ফিলিপাইন সরকার বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে খাতটিকে বেসরকারি করে দেয়। দেশটির সরকার বিভিন্ন কোম্পানির সাথে ৪৮টি চুক্তি করেছিল। সরকার সবগুলো কোম্পানির বিল পরিশোধ করলেও যথাসময়ে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রও উৎপাদনে যেতে পারে নাই। যার ফলে দেশটির লোকসান দাঁড়িয়েছিল ১৪০০ কোটি ডলার।   

পাকিস্তান:

বাংলাদেশের বর্তমান বিদ্যুৎ পরিস্থিতির সাথে সবচেয়ে বেশি মিল রয়েছে পাকিস্তানের। ওই দেশটিতে ২০ হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ ৪ হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি। তারপরও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির বিষয়ে দেশটিতে বেশ বিতর্ক চলছে। ইতোমধ্যে পাকিস্তান সরকার ১৪ টি প্রকল্পের মাধ্যমে ২২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অনুমোদন দিয়েছে। দেশটির অর্থমন্ত্রী শওকত তারিন মন্ত্রীপরিষদের সভায় এর জোর বিরোধিতা করেন। তিনি সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র বেশ ব্যয়বহুল এবং তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য সমাধান না। পাকিস্তান শেষপর্যন্ত বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কাছে পরামর্শ চেয়েছে। এডিবি ১৪ টির স্থলে ৮ টি ভাড়ার কেন্দ্র স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছে এবং বিদ্যুতের দাম বাড়াতে বলেছে দেশটিকে।

রাষ্ট্রীয় তহবিলের অপচয় ও জ্বালানি খাতের নিরাপত্তা

চিন্তা’র সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছেন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতুল্লাহ; তিনি বলেন, ‘গ্রাহকদের স্বার্থে ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ আসে নি। কিছু উচ্চাভিলাষী ব্যবসায়ীদের স্বার্থে এসেছে।’ এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপে জনাব রহমাতুল্লাহ জানান, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ হয় সাধারণত যুদ্ধাবস্থায়, যেখানে সরকার এবং আইন শৃঙ্খলা নাই। আমেরিকা প্রথম এই ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ আবিষ্কার করে। ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান ও ইরাকের যুদ্ধে আমেরিকান বেসরকারি কিছু কোম্পানি জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। এরকম পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় বলে উৎপাদন খরচের সাথে ঝুঁকি যোগ করে, এবং বাজার মূল্যের চেয়ে সাত আট গুণ দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করে ।

বর্তমানে পিডিবি গড়ে প্রায় ছয় হাজার মেগাওয়াটের চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে মাত্র চার হাজার মেগাওয়াট। এতে করে পিডিবির বার্ষিক ঘাটতির পরিমাণ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। অথচ ‘কুইক সল্যুশনের’ নামে ‘কুইক রেন্টালের’ মাধ্যমে মাত্র ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য সরকারকে ‘কুইক ভর্তুকি’ দিতে হবে প্রায়  পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি!

নতুন অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা টাকার অংকে ছয় হাজার ১১৫ কোটি টাকা। কিন্তু এই বিশাল পরিমাণ টাকা পিডিবির আওতাধীন নতুন কোনো বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির জন্য বরাদ্ধ দেয়া হয় নাই। এ টাকার বিশাল অংশই খরচ হবে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভর্তুকি মেটানোর জন্য। 

‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির’ সদস্য সচিব ড. আনু মুহাম্মদ-এর পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ‘ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পেতে এক থেকে দেড় বছর লেগে যাবে।’ চিন্তা’র সাথে আলাপে তিনি বলেন, ‘গ্যাস সরবরাহ যদি বাড়াতে পারে তাহলে এর চেয়ে কম সময়ে অর্থাৎ দুই তিন মাসের মধ্যে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। বিদ্যুৎ যেহেতু একটি স্পর্শকাতর বিষয় তাই একে এভাবে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া উচিত না। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো’।

পরিকল্পনাহীনতার সংকটকে বিদ্যুৎ সংকট বলে চালাচ্ছে সরকার

জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়া রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তাই অনিশ্চিত। ফলে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং যথাযথ উদ্যোগ প্রয়োজন রাষ্ট্রের তরফ থেকে। যাতে করে এই খাতে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্ষম করে গড়ে তোলা যায়, জাতীয় সক্ষমতা তৈরি করা যায়। কিন্তু বর্তমান সরকার নিজস্ব উদ্যোগে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ না নিয়ে প্রধানত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। সরকার এখানেই থেমে যাবে না। পরবর্তী ৯ মাসের ভেতর ভাড়াভিত্তিক আরো ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য চুক্তি করবে। এসবই করা হচ্ছে গ্রাহকদের ‘বিদুৎ সংকটের’ শিকারে পরিণত করে।

অথচ সংকট পুরাটাই ব্যবস্থাপনার। সরকারের নিজস্ব প্রশাসনের এবং বিদ্যুৎ খাতের অব্যবস্থাপনার ফলেই মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলা রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও তদারকিতে চরম অব্যবস্থাপনার ফলে কেন্দ্রগুলা উৎপাদন সক্ষমতা হারাচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের প্রশাসনের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগছে। এই অদক্ষতা আর অব্যবস্থাপনার দোহাই দিয়ে এখন ঝুঁকিপূর্ণ ও লোকসানি ভাড়া বিদ্যুতের দিকে দেশকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার।

এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল লি.

যুক্তরাজ্য ভিত্তিক কোম্পানি

২০০                 

ডিজেল

ঘোড়াশাল ও খুলনা

২৮ জুলাই

১৪.৪০ টাকা

২০ মে


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।