চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ধিত বেতন-ফি প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন


ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে মামলা হামলা রিমান্ড এখন চবি প্রশাসনের একমাত্র ভাষা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ধিত বেতন-ফি প্রত্যাহারের দাবিতে ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলনে নামে। দোসরা আগস্টের ওই ঘটনায় পুলিশ তাদের ওপর নির্বিচার আক্রমণ করে আন্দোলন থামিয়ে দেয়। এতে কয়েক শ ছাত্র আহত হয়। পরে ছাত্রদের আন্দোলন আগাতে না দিয়ে আগামী ষোল সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।

গত বাইশে মে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে বর্ষাকালীন ছুটিতে। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন-ফি বাড়ানোর বিষয়টা ফিন্যান্স কমিটির ২৯৮ নম্বর সভায় তোলা হয়। ৪৫৯ তম সিন্ডিকেট সভায় তা অনুমোদিত হয়। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষ সম্মান শ্রেণীতে ভর্তির সময় বর্ধিত এই বেতন-ফি দিতে হবে ছাত্র-ছাত্রীদের।

এই বেতন বাড়ানোর বিষয়ে ছাত্রদের আগে থেকে জানানো হয় নাই। কিন্তু হঠাৎ করেই পয়লা জুলাই থেকে এই বেতন-ফি কার্যকর হওয়ার ঘোষণা হয়। এতে অন্যান্য বিভাগের মত ইতিহাস ২য় বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে গিয়ে বেতন ও অন্যান্য ফি বাড়ার বিষয়টা জানতে পারে। তারা সহ অন্যান্য বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা এই বর্ধিত বেতন-ফি দিতে অস্বীকার করে। প্রতিবাদ স্বরূপ তারা ছাব্বিশে জুলাই রোববার মানববন্ধন করে। তবে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কথা বলে মানবন্ধনে বাধা দেন। ছাত্ররা কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে প্রক্টর তাদেরকে শাসায় এবং হুমকি ধামকি দেন। এক পর্যায়ে প্রক্টর সুজন কান্তি দে নামে এক ছাত্রকে থাপ্পড় মারেন। এরপর মানববন্ধনের কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রী বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। বেলা বারোটায় তারা প্রশাসনিক ভবন ঘেরাও করে বর্ধিত বেতন-ফি প্রত্যাহারের দাবি জানায়। পরদিন থেকে লাগাতার শ্রেণী পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচি দিয়ে ওই দিনের মত আন্দোলন শেষ হয়। রাতে কোন রকম কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই প্রশাসন শিক্ষক লাঞ্ছনার অভিযোগে লোক প্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ-সম্পাদক সুজন কান্তি দে-কে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার এবং আরও পাঁচজনের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করে। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা সুজনের বহিষ্কারকে অযৌক্তিক ও অগণতান্ত্রিক দাবি করে এই আদেশ বাতিলের আহবান জানান। উল্লেখ্য, দুই হাজার আটে বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল প্রকার রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এবং এধরনের তৎপরতার দায়ে বহিষ্কার করার বিধানও ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে চবি প্রশাসন কয়েক বছর ধরে বহিষ্কার আদেশকে ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিশাবে ব্যবহার করে আসছে। এমনকি এরজন্য কর্তৃপক্ষ ক্যামেরাম্যান নিয়োগ করেছে। প্রশাসন এই ক্যামেরার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ ব্যবহার করে বহিষ্কার করার হুমকি দিয়ে থাকে।

পরদিন সাতাশে জুলাই সোমবার আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীরা সকাল দশটায় কেন্দ্রীয় ছাত্রছাত্রী সংসদের (চাকসু) সামনে জড়ো হয়। সেখান থেকে ‘বর্ধিত বেতন-ফি বিরোধী সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ’র ব্যানারে তিন-চার হাজার ছাত্রছাত্রীর একটি মিছিল বিভিন্ন অনুষদ ঘুরে প্রশাসনিক ভবন ঘেরাও করে। আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের তিন দফা দাবি ঘোষণা করে। দাবিগুলা হল: ১. সকল বর্ধিত বেতন-ফি প্রত্যাহার করতে হবে। ২. অবিলম্বে সুজনের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করতে হবে। ৩. আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে কোনরকম হয়রানি করা যাবে না।

আন্দোলনকারীরা ভিসিকে স্মারকলিপি দিতে চাইলে ভিসি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তারা ভিসিকে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে দেখা করার অনুরোধ জানালেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেউই দেখা করে নাই। সাড়ে বারোটার দিকে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রী মিছিল নিয়ে বুদ্ধিজীবী চত্বরে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে তারা প্রশাসনিক ভবনের দিকে ফিরে আসার সময় ভিসির ছাত্রলীগের একটি অংশ মিছিলে হামলা করে। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা রুখে দাঁড়ালে হামলাকারীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এতে এক ছাত্র আহত হয়। আন্দোলনকারীরা আবার প্রশাসনিক ভবনের সামনে জড়ো হয়ে তাদের দাবি দাওয়া জানাতে থাকে। বেলা দুইটার দিকে ওই দিনের কর্মসূচি শেষ হয়।

একদিন বন্ধের পর উনত্রিশ জুলাই বৃহস্পতিবার আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীরা বেলা এগারোটায় চাকসুর সামনে জড়ো হয়। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে শ্রেণী পরীক্ষা বর্জন করার ঘোষণায় বিভিন্ন অনুষদের সামনে অবস্থান নিয়ে তারা তাদের দাবি তুলে ধরে। বিবিএ অনুষদের সামনে শ্রেণী পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি সফল করতে গেলে প্রশাসন আগেই জোরপূর্বক অনুষদটির গেটে তালা লাগিয়ে পরীক্ষা গ্রহণ করে। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অগ্রণী ব্যাংকও অবরোধ করা হয়। দুপুরে আন্দোলনকারীরা চাকসু ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে। ইতিহাস বিভাগের ছাত্র তবারক হোসেন সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। এরপর লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে ওই দিনের কর্মসূিচ শেষ করা হয়। ওই দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহ আলম বাদী হয়ে হাটহাজারী থানায় এগারো জন ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় ভাঙচুর, নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি ও সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে আতঙ্কসৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়।

একত্রিশে জুলাই সকাল দশটায় কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রী চাকসুর সামনে থেকে মিছিল শুরু করে। ছাত্ররা বিভিন্ন অনুষদে তালা লাগিয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে মিছিল নিয়ে অবস্থান করে। এরপর তিন দফা দাবিসহ ছাত্রদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। এসময় উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দিতে চাইলে উপাচার্য আবার তা প্রত্যাখ্যান করেন। একপর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের রক্ত দিয়ে প্রশাসনিক ভবনের দেয়ালে তাদের দাবি লিখে দেয়। এরপরও উপাচার্য অফিস থেকে কোন ধরনের সাড়া পায় নাই ছাত্র-ছাত্রীরা। পরে তারা দেড়টার শহরগামী রেলে গিয়ে নগরীর ষোলশহর এলাকা অবরোধ করে। প্রায় ঘণ্টাখানেক ষোলশহরে অবস্থান করার পর ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল নিয়ে পাশ্ববর্তী ২ নং গেইট মোড় অবরোধ করে। মোড়জুড়ে তারা হাতে হাত দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে অবস্থান নেয়। শান্তিপূর্ণভাবে এই অবরোধ চলে রাত আটটা পর্যন্ত।

পয়লা আগস্ট সকালের প্রথম ট্রেন আসবার আগেই প্রচুর পুলিশ জলকামান সহ নগরীর ষোলশহর রেল স্টেশনে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে সকালে মীর নিক্সন নামক এক ছাত্রকে গ্রেফতার করে। বেলা বাড়ার সাথে ছাত্র-ছাত্রীর ষোলশহর স্টেশনে জমা হয়ে শ্লোগান দিতে থাকে। তবে তারা পূর্ব ঘোষিত অবরোধ কর্মসূচি বাতিল করে মিছিল নিয়ে প্রেস ক্লাবের দিকে রওনা হয়। মিছিলকারীরা নগরীর বিভিন্ন জায়গা ঘুরে প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়ে প্রতীকী অনশন করে। ছাত্র-ছাত্রীরা নিক্সনের নিঃশর্ত মুক্তিসহ আগের দাবিগুলা তুলে ধরে। কয়েক গাড়ি পুলিশ জলকামান নিয়ে এই পুরা সময় মিছিলের আগে পিছে ছিল। বেলা একটার দিকে ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল নিয়ে দুই নং গেইটে এসে আবার অবরোধ দেয়ার ঘোষণা দিলেই জলকামান চালনার প্রস্তুতি শুরু হয়। তখন হঠৎ করে পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। লাঠিচার্জে মারাত্মক আহত কয়েকজন ছাত্রকে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুলিশ সেখান থেকে পঁচিশ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। অবশ্য পরবর্তিতে আদালত সকলের জামিন মঞ্জুর করে। তবে ওইদিনই পাঁচলাইশ মডেল থানার (সি এম পি) এস.আই মো. লোকমান হোসেন বাদী হয়ে একত্রিশ জন ছাত্র-ছাত্রীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।

ওই ঘটনার প্রতিবাদে দোসরা আগস্ট সকাল দশটায় হাজার হাজার সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী মিছিল করে। মিছিলটি কলা অনুষদের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশ বাধা দিয়ে বেপরোয়া লাঠিচার্জ, রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ শুরু করে। এতে ছাত্র-ছাত্রীরা ব্যাপক ক্ষোভে ফেটে পড়ে। মুহূর্তে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ছাত্র-ছাত্রীরা বেশ কয়েকটি বাস, লাইব্রেরির কাচ, প্রশাসনিক ভবনসহ বিভিন্ন অনুষদে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আন্দোলনকারী ছাত্র বলেন, “একজন সাধারণ ছাত্র নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ভাঙচুর তখনই করতে পারে, যখন সে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করে এবং বিশ্ববিদ্যালয় তার কাছে শুধু উচ্চমূল্যের সার্টিফিকেট বিক্রির দোকান হিসেবে হাজির হয়। আর, আমরা এক সপ্তাহ ধরে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করার পরও ভিসি আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ তো করেই নি, উপরন্তু আমাদের ওপর পুলিশ দিয়ে হামলা চালিয়েছে। তাই এই ভাঙচুরের দায় দায়িত্ব ভিসি এবং বিশবিদ্যালয় প্রশাসনের।”

দোসরা আগস্টের দিন সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে অবস্থানকারী পুলিশদের সাথে যুক্ত হয় মোট বারো প্লাটুন পুলিশ, এক প্লাটুন র‌্যাব ও এক ইউনিট ফায়ার সার্ভিস। ছাত্রদের একটি অংশ বিশ্বদ্যালয়ের ছাত্রী হলের দিকে অবস্থান নিয়ে আগাতে চাইলে পুলিশ তাদেরকে বাধা দেয়। এক পর্যায়ে রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করতে থকে। ওই সময় ছাত্রীরাও হলের গেটের বাইরে অবস্থান নেয়। পুলিশ ছাত্রদের ধাওয়া করলে ছাত্রছাত্রীরা হলের দিকে দৌড়াতে থাকে। পুলিশ এই সময় শামসুন্নাহার হলের গেট গিয়ে হলের ভেতরেও টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছোঁড়ে। রাবার বুলেটের আঘাতে অনেক ছাত্রী আহত হয়। হামলায় ছাত্রীরা ক্ষীপ্ত হয়ে মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারের দিকে আসে। এ সময় তারা সাংবাদিকদের কাছে তাদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদ জানান। শহীদ মিনারের পাদদেশে অবস্থান নেয়া মিছিলকারী ছাত্রীদের পুলিশ চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। কোনরকম বাধা বা আপত্তি না জানিয়েই হঠাৎ একপর্যায়ে পুলিশ (পুরুষ-সদস্য) ছাত্রীদের বেপরোয়া লাঠি পেটা শুরু করে। পুলিশের ব্যাপক পিটুনিতে ছাত্রীদের আঠাত্তরজন মারাত্মকভাবে জখম এবং অর্ধশতের বেশি আহত হয়। পুরা ঘটনা চলাকালে পরিচয় দেয়ার পরও পুলিশ কয়েকজন সাংবাদিককেও মারধর করে। কালের কণ্ঠের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি রাজীব নন্দী, যুগান্তরের নিজস্ব প্রতিবেদক কামরুজ্জামান বাবলু, ইত্তেফাকের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি এমদাদুল হক এ সময় আহত হয়।

পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রদের বিকাল ছয়টার মধ্যে এবং ছাত্রীদের পরদিন সকাল দশটার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। ক্যাম্পাসে ছাত্রসংখ্যা কমে এলে হল ত্যাগের সময়সীমা পার হবার অনেক আগেই পুলিশ হলগুলাতে ঢুকে গণগ্রেফতার শুরু করে। গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের হলের মধ্যে রেখেই একদফা পেটানো হয়। প্রায় তিনশ ছাত্রকে হল থেকে গ্রেফতার করে। পরে ৫৩ জনকে রেখে বাকিদেও ছেড়ে দেয়া হয়। ৫৩ জনের মধ্যে বর্তমানে জেলে আছেন ২৩ জন। তাদের মধ্যে ৬ জনকে একদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়।

সেদিনই বিশ্ববিদ্যালয় উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (রেজিস্ট্রার অফিস) চৌধুরী আমির মোহাম্মদ মুছা বাদী হয়ে ধারা ১৪৭/১৪৮/১৪৯/৪৪৮/৪৩৬/৪৩৫/৪২৭ দণ্ডবিধি অনুযায়ী সত্তরজন ছাত্রের বিরুদ্ধে নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরো প্রায় পাঁচশজন আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। মামলায় অভিযোগ ছিল: তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদ ভবন ও দপ্তরের দরজা, জানালা, কম্পিউটার, ফটোকপি মেশিনসহ বিভিন্ন অফিস যন্ত্রপাতি, পরিবহন দপ্তরের বাসসহ ছোট বড় সতেরটি গাড়ি ভাঙচুর এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের দরজা জানালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে পরীক্ষার টেবুলেশান শীটে অগ্নিসংযোগসহ শিক্ষকদের নাজেহাল ও আহত করে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।

পরদিন তেসরা আগস্ট হাটহাজারী থানায় এস. আই. আবুল কাশেম বাদী হয়ে চুয়াত্তরজন ছাত্র-ছাত্রীর নাম উল্লেখ করে এবং আরো নয়শজন অজ্ঞাতনামা ছাত্রের বিরুদ্ধে পুলিশের সরকারী কাজে বাঁধা দান, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও মারপিট করে উনিশজন পুলিশ সদস্যকে গুরুতর জখম এবং ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি আইনের ১৪৭/১৪৮/১৪৯/৩৩২/৩৫৩ দণ্ডবিধি তৎসহ বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের ৩/৪ ধারায় নিয়মিত মামলা রুজু করে।

এরপর পাঁচ আগস্ট বিকালে নগরের শহীদ মিনার চত্বরে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষক, অভিভাবক ও বুদ্ধিজীবী সংহতি সমাবেশের আয়োজন করে। এতে তারা বর্ধিত বেতন-ফি প্রত্যাহার, সুজনের বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার, ভিসির পদত্যাগ এবং সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও আটককৃত ছাত্র-ছাত্রীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

চবি প্রশাসনের স্বৈরাচারী আচরণ ছাত্রছাত্রীদের ক্ষোভের অন্যতম কারণ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের স্বৈরাচারী আচরণই দোসরা আগস্ট ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষোভ ও ভাঙচুরের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ২০০৯ সালের মার্চ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল ধরনের সভা, সমাবেশ, মিছিল, র‌্যালি, মানববন্ধনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। বিগত ষোল মাসে চবিতে তিন জন ছাত্র খুন হলেও ছাত্র-ছাত্রীরা এর কোন বিচার পায় নাই। অধিকার থাকা সত্ত্বেও নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদও জানাতে পারে নাই। এছাড়া ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে ভর্তিচ্ছু ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে কোন রসিদ ছাড়াই ৯০ লক্ষ টাকা আদায় করা হয় (কালের কণ্ঠ, ১১ জানুয়ারি ২০১০)। এর বিরুদ্ধেও ছাত্র-ছাত্রীরা ন্যূনতম প্রতিবাদ জানাতে পারে নাই। এ সময় কোন রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার বা নতুন কোন সাংস্কৃতিক সংগঠনের নিবন্ধনের অনুমতিও ছাত্রদেও দেয় নাই প্রশাসন। নিষেধাজ্ঞার নামে ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করলেও বর্ধিত বেতন-ফি বিরোধী আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিও করে নাই। অথচ প্রশাসনের দায়ের করা প্রতিটা মামলায় ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দুইহাজার নয় সালের অক্টোবরে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ছাত্রী হলগুলাতে সূর্যাস্ত আইন জারি করে। এর বিরুদ্ধে ছাত্রীরা আন্দোলন করলে তাদের বহিষ্কার করার হুমকি দেওয়া হয়। এমনকি অভিভাবকদের ফোন করে “আপনার মেয়ে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে হলে ফিরতে চায় না” ধরনের কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত পর্যন্ত করা হয় বলে ছাত্রীরা অভিযোগ করেন। এছাড়াও চবিতে রয়েছে অগণতান্ত্রিক আচরণবিধি।

একটা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের সাথে মামলা হামলা আর রিমান্ড নিয়ে দাবিদাওয়া বন্ধ করতে উদ্যত। সমাজ ও রাষ্ট্রের অপরাপর ক্ষেত্রের মত নিপীড়ন ও নির্যাতনে তারাও পিষ্ট হচ্ছে, বাদ যাচ্ছেনা। ছাত্রছাত্রীদের উপর রাষ্ট্র ও প্রসাশনের বলপ্রয়োগের এই নতুন যোগসাজশ আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়কে আর মুক্ত জ্ঞানচর্চা ও গণতান্ত্রিক সংবেদনশীলতায় অগ্রগামী নেতৃত্বের জায়গায় থাকতে দিবে না। এই ভয় সকলের।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।