0


“কেউ না কেউ প্রত্যাঘাত করে” অথবা সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে পাল্টাধাওয়ার ন্যায়তত্ত্ব

[আমেরিকা মহাদেশ নামে যে বিশাল ভূখন্ডটি আমরা চিনি ওয়ার্ড চার্চিল বা কীটুয়াহ ব্রান্ড চেরোকি(১৯৪৭-) সেই মহাদেশের একজন আদি বা খাস অধিবাসী। যে শ্বেতাঙ্গ ইওরোপীয়রা দেশটি দখল করে নিয়েছে তাদের দখলদারি ভাষায় ওয়ার্ড চার্চিল একজন ‘নেটিভ ইন্ডিয়ান’। তিনি লেখক, অধ্যাপক। সত্য উচ্চারণে নির্ভীক, এবং খোলামেলা। মার্কিনদেশে এরকম বিপ্লবী কণ্ঠস্বর বিরল। চার্চিল পূর্বপুরুষের রক্তের সাথে সাথে বয়ে বেড়ান সাম্রাজ্য পত্তনের সূচনায় আদি-ইন্ডিয়ানদের উপর চালানো বর্বর হত্যাযজ্ঞের নৃশংসতম ইতিহাস। একটি মহাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। এ জন্য কোন ঘটনাকেই নিছকই বিচ্ছিন্ন ব্যাপার আকারে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। পাঠ করেন পূর্বাপর মিলিয়ে, জায়মান প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধের উৎসমুখে দাঁড়িয়ে। ইতিহাসের কথিত-অকথিত, দলিত-মথিত, চেপে যাওয়া চাপা দেওয়া সমস্ত কণ্ঠস্বরকে তিনি জড়ো করেন। সবার, সকলের-- দেশ থেকে মহাদেশ বিস্তৃত নিপীড়িত মানুষের মর্মবেগকে ঐক্যসূত্রে গাঁথেন। এত স্বচ্ছ দৃষ্টি আর অনুভবের গভীর থেকে কথা বলেন যে অনায়াসে হৃদয়ে বিঁধে যায়।

সেরকমই একটা লেখা, “কেউ না কেউ প্রত্যাঘাত করে” বা সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে পাল্টা ধাওয়ার ন্যায়তত্ত্ব (“সাম পিপল পুশ ব্যাক”: অন দ্য জাস্টিস অব রুসটিং চিকেনস)। এটা আসলে টুইন টাওয়ার ঘটনায় তাঁর প্রতিক্রিয়া আকারে দেয়া একটা লেখা(১২ সেপ্টম্বর, ২০০১)। পরে লেখাটা আরো বিশদ করে একটা সম্পূর্ণ বইয়ের আকার দেন। সেইসময় দুনিয়াব্যাপী সরকারি বেসরকারি নিন্দার জোয়ার এবং সাম্রাজ্যের লাগাম ছাড়া আক্রোশের মধ্যেও সাহসের সাথে চার্চিল হাজির হন তাঁর বক্তব্য নিয়ে। যথারীতি শুরু হয়ে যায় আক্রমণ। চারদিক থেকে ভয়াবহ আক্রমণ শানানো হয়। কোমর বেঁধে তাঁকে নাস্তানাবুদ করার সবরকম চেষ্টা করা হয়। যুক্তি এবং তর্কে না পারলেও, সত্যের শক্তিতে তিনি অটল থাকলেও কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধানের পদটা তাকে তখনি হারাতে হয়েছে। পরে সাজানো অভিযোগ এনে চাকরিটাও খেয়ে ফেলা হয়। এ লেখার জন্য প্রায় শ’ খানেক হত্যার হুমকি পেয়েছেন। এর আগে অবশ্য কলম্বাস দিবস পালনের শোভাযাত্রায় বাঁধা দেয়ার জন্য গ্রেফতারও হয়ে ছিলেন।

ওয়ার্ড চার্চিল মূলত আমেরিকার ইতিহাস, আইনকানুন, সাহিত্য ও সিনেমা কিভাবে দখলদারি এবং উপনিবেশায়নের বয়ান তৈরি করে তা নিয়ে কাজ করেন। তিনি এথনিক স্টাডিজ-এর অধ্যাপক এবং আমেরিকান ইন্ডিয়ান স্টাডিজ এর সমন্বয়ক। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে কয়েকটা হল: ‘ফ্যান্টাসিস অব মাস্টার রেস’, ‘সিন্স প্রিডেটর কেইম’, ‘ফ্রম এ নেটিভ সান’ এবং ‘এ লিটল ম্যাটার অব জেনোসাইড: হলোকস্ট এন্ড ডিনায়াল ইন দ্য আমেরিকাস’।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যাঁরা আদি অধিবাসী তাঁরা কিভাবে তাঁদের দেশ ইওরোপীয়দের দখলে চলে যেতে দেখেছেন সেই রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার কথা খুব কমই শুনেছেন; উপনিবেশায়ন ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে  তাঁদের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণ খুব কমই অবহিত। ওয়ার্ড চার্চিলের এই লেখাটির মধ্য দিয়ে তাঁরা বর্তমান বিশ্বরাজনৈতিক বাস্তবতার পর্যালোচনা পাঠ করবেন এমন এক মানুষের নজর দিয়ে যিনি দখলদারির দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমানকে বিচার করছেন, যার নজির পাওয়া দুঃসাধ্য।এখানে সংক্ষেপে মূল লেখাটির একটা  তরজমা পেশ করা হল। তরজমা করেছেন মুসতাইন জহির ]

৯-১১’র পুণ্যাত্মারা

আততায়ীর হাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি খুন হওয়ায় সাংবাদিকরা ম্যালকম এক্স’র প্রতিক্রিয়া জানতে চান। তো সমবেত সাংবাদিকদের নিরাশ না করে, ১৯৬৩ সনের নভেম্বর মাসে, তিনি সরস একটা উত্তর দেন। তাঁর সেই বিখ্যাত উত্তর ছিল: এটা আহামরি কিছু না, কেবল “পাল্টা ধাওয়ার শুরু”--অন্যের উপর খাটানো জিনিস নিজের ঘাড়ে ফিরত আসার একটা নমুনা মাত্র।

সেপ্টেম্বর ১১, ২০০১ সকালে নিউ ইয়র্কে হুলুস্থুল বাধানো টুইন টাওয়ার ঘটনায় পাঁচ লক্ষ মৃত ইরাকি শিশুর পাশে, পাল্টা ধাওয়া খেয়ে সবেমাত্র কিছু মুরগি খোঁয়াড়ে ফেরত এসেছে। তো, এর মধ্যে আবার কয়েকটা মুরগির আদত নিবাস ছিল পেন্টাগন।

খুব ভালোকরে জেনেশুনে ১২ বছরের নীচে যাদের বয়স, সেইসব তরতাজা ইরাকি কিশোরদের মারা হয়। একদম সহজ হিশাবের মধ্যেই ছিল যে, তারা ১৯৯১ সনে মার্কিন “সার্জিক্যাল” বোমা বর্ষণে ছিন্নভিন্ন হবে। পানি শোধনাগার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা সহ অন্যান্য অবকাঠামোগত স্থাপনাকে সামরিক লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছিল। যার উপর নির্ভর করে [শহুরে]বেসামরিক লোকজনের খোদ জীবনযাপন, বেঁচে থাকা।

এই ধরনের বোমা হামলা ইতোমধ্যে বীভৎসতার চরম নজির ছাড়িয়ে গেছে। এও মনে রাখতে হবে “আসমানী যুদ্ধে”-র যে রেওয়াজ তারা চালু করেছে তা যেকোনো বিচারে ‘মানবতার’ বিরুদ্ধে জঘন্যতম অপরাধ, সমস্ত রকমের আন্তর্জাতিক বিধিবিধানকে বুড়া আঙ্গুল দেখানো। এই অভিনব কায়দা ও “সভ্য ব্যবহার” দীর্ঘ এক দশকের মার্কিন আবরোধে মৃত্যুর সারিকে যারপরনাই অবিরাম বাড়িয়ে তুলেছে । ব্যাপক সামরিক উপস্থিতি আর সময়ান্তরে বোমা হামলার মুখে রাখার পাশাপাশি নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা জীবন রক্ষার ন্যূনতম উপকরণ, ঔষধপত্র সংগ্রহের রাস্তা পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়। নিঃসন্দেহে এই চাপিয়ে দেওয়া দুর্ভোগ তাদের শারীরিকভাবে পঙ্গু ও মানসিক যন্ত্রণায় এতটাই বিপর্যস্ত করেছে যে পুরাপুরি সেরে উঠা রীতিমত অসম্ভব। বস্তুত একটা পুরা প্রজন্মকে এভাবে ধূলিসাৎ করে ফেলা হয়েছে।

এই নিধনযজ্ঞের(হলোকস্ট) কারণ খুব সাধারণ। মার্কিন মুল্লুকের ৪১তম “স্বাধীনতা-প্রেমী” রাজা বাবা বুশের সোজাসাপ্টা ঘোষণা: “বিশ্ববাসীকে অবশ্যই বুঝতে হবে, ‘আমরা যা বলি, তাই হবে’। আর ওভাল অফিসের ৪৩তম সম্রাট, স্বাধীনতার কারবারী পুত্রের গলায় তারই প্রতিধ্বনি শুনে উল্লসিত হাত তালিতে মাতোয়ারা ছিল সর্বত্র স্বাধীনতা-প্রেমী আমেরিকানরা। এটুকু শুধু স্মরণ করলেই চলবে, দিবারাত্রি অনর্গল টিভি চ্যানেলগুলাতে ইরাক যুদ্ধের মুহুর্মুহু বোমা বর্ষণের ভিডিও প্রদর্শনের মাত্রাটা। আন্দাজ পাওয়া যাবে কত বেশি তারা জানতো!

যদি কেউ এসবের মানে খুঁজতে চান, তাহলে যুতসই হবে ঔসব টিভি রিপোর্টের বন্যায় আমেরিকানদের পুলক আর উৎসাহের আতিশয্যের সাথে [দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন] জর্মান ভদ্রলোকদের তুলনা টানলে। [প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়] মৃত্যুর মহাসড়কে একহপ্তায় জেট বিমান থেকে নির্বিচার গুলি চালিয়ে একলাখ ‘আচকান পরা’, ‘উটের জকি’ কিম্বা ‘মাঠের কালা আদমিদের’ বালিতে লুটিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা ছিল নাৎসিদের রাশিয়া অভিযানের প্রথম মাসের কর্মকান্ডের মত।  নির্বিচার কচুকাটা হত্যা-লীলায় সেসময় ভালো-জর্মানরা আমোদিত অভিনন্দন জানিয়েছিল। বস্তুত ১৯৪৩ সনে স্টালিনগ্রাদে পরাজিত হওয়ার আগ পর্যন্ত “নির্দোষ বেসামরিক’’ জার্মানদের মধ্যে হিটলারের প্রতি সমর্থনের আহামরি কোন খামতি ধরে নাই। [ঠিক যেমন ইরাক ও আফগানিস্তানে বিপর্যয়ের আগে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে বুশেরও কোনই অসুবিধা হয় নাই।]

এখানে ইতিহাসের অন্দরে মনোনিবেশ করলে গুরুত্বপূর্ণ মরতবা হাসেল হবে। সম্মিলিত অপরাধের মর্ম বোঝা যাবে। পূতপবিত্র এই আমেরিকানদের নেতৃত্বেই সম্মিলিত অপরাধের দায়ে দায়ী করা হয় সামগ্রিকভাবে জর্মান জনগণকে। এবং এটা কিন্তু তাদের কারো ব্যক্তিগত কৃতকর্মের জন্য নয় বরং তারা যার এখতিয়ার দিয়েছে--আরো যথাযথ করে বললে, তাদের নেতা ও সৈন্যবাহিনীকে জনগণের তরফে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং প্রয়োগের যে ক্ষমতা তারা [রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সাংবিধানিক ও রাজনৈতিকভাবে] হস্তান্তর করেছিল সে জন্য।

এই নীতি যদি তখন খাটে তাহলে এখনও তা সমানভাবে খাটানো যায়। যেরকম নির্দোষ ভাল জর্মানদের বেলায় প্রয়োগ হয়েছিল, ঠিক সেরকম ভালো আমেরিকানদের বেলায়ও তা সমানভাবে প্রযোজ্য। মূল্যবোধের সামাজিক অবক্ষয়ের জন্য গোটা জর্মান জাতিকে চরম-মূল্য দিতে হয়েছিল, তাদের দায় শোধ করানো হয়েছিল। [এর অন্যতম দার্শনিক বয়ান যাঁর হাতে তৈরি হয়েছিল তিনি কার্ল জেসপার। আগ্রহীরা তাঁর ‘দ্য কোশ্চেন অব জর্মান গিল্ট’(১৯৪৭), বইটা পড়তে পারেন]। উপসাগরীয় যুদ্ধ ও তৎপরবর্তী নিষেধাজ্ঞা আর অবরোধের ধারাবাহিকতা ক্লিন্টন প্রশাসনের পর বড় বুশের নেতৃত্বে মার্কিন সামরিক-অর্থনৈতিক আধিপত্যের “নতুন বিশ্বব্যবস্থা” প্রতিষ্ঠার উদ্দাম মত্ততায় পৌঁছায়। দুনিয়া দখলের চূড়ান্ত রফা করার ঘোষণায় তাদের ধনুর্ভঙ্গপণ মধ্যপ্রাচ্যে আকসার প্রয়োগ হয়। কি রকম বর্বরতার ভিতর দিয়ে ইরাকের শিশুসহ প্রতিটি মানুষকে যেতে হয়েছে তার একটা নমুনা স্মরণ রাখা যেতে পারে। খোদ মানবিক সাহায্য বিতরণ কাজ সমন্বয়ে নিয়োজিত ছিল এমন দুজন জাতিসংঘ কর্মকর্তাকে মার্কিনীদের চাপানো নীতির বিরোধিতা করে অবশেষে পদত্যাগ করতে হয়েছিল।

এর একজন জাতিসংঘের সাবেক সহকারি মহাসচিব ডেনিস হাল্লাডে বারবার বলেছিলেন, যা ঘটছিল তা একটা “পদ্ধতিগত পরিকল্পনা... ইচ্ছাকৃত গণহত্যা”। এই বিবৃতি নিউ ইর্য়কসহ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় ১৯৯৮ সনের শরতের সময় ছাপা হয়। ফলে কিছুতেই বলা যাবে না যে মার্কিন জনগণ এটা “জানতো না”; বরং কিছুদিন পরে ব্যাপক দর্শকপ্রিয় একটা টিভি অনুষ্ঠানে (মিট দ্য প্রেস) সাংবাদিকরা তৎকালিন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডেলিন অলব্রাইটকে জিজ্ঞাসা করলে স্বীকার তো করা হয়ই, উত্তরে হিমশীতল গলায় সরাসরি বলে: যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য অর্জনের জন্য “এই খরচা বেশি কিছু না”।

হানাদার জনগণের রাজনীতি

সর্বোপরি মার্কিন জনতা এসমস্ত নৃশংসতাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। আর হাই তুলতে তুলতে টিভিপর্দায় লক্ষ লক্ষ ইরাকির মৃত্যু ও দুর্ভোগের মত অপ্রাসঙ্গিক বিষয় বাদ দিয়ে তাদের অবসর কাটিয়েছে ‘জেরেমি’ কিংবা ‘এলিংটন’র সাপ্তাহিক সসার গেম শো দেখে।

সত্যিকার অর্থেই স্বীকার করতে হবে ধুলায় মিশিয়ে দেয়া ইরাকি শিশুদের প্রতি যা করা হয়েছে/হচ্ছে তার বিরুদ্ধে অতিশয় ক্ষদ্রাতিক্ষুদ্র নগণ্য একটা অংশমাত্র ‘প্রতিবাদ’ জানিয়েছিল। একইসাথে অবশ্য এটাও মানতে হবে প্রতিবাদে অংশ গ্রহণকারীরা নিছক স্বাক্ষর দেওয়া আর মৃতের স্মরণে মোমবাতি জ্বালানোতেই সীমাবদ্ধ ছিল। মার্কিন সাম্রাজ্যের এই নির্মূল অভিযানের বিরুদ্ধে রাস্তায় প্লাকার্ড নাড়ানো ‘বিরোধিতা’ সর্বস্বতার অধিক এককদমও আগ বাড়ানোর কারও কোন আগ্রহ ছিলনা। তারা ওইসব সুশীলপনা প্রদর্শন করে “নীতিবোধের সাক্ষী” বনেছে যখন কিনা বিশাল অঞ%


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।