সরেজমিন সিরাজগঞ্জ


গবাদিপশু সমৃদ্ধ সিরাজগঞ্জ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে অ্যানথ্রাক্স

অ্যানথ্রাক্স জীবাণুর প্রথম আক্রমণের ঘটনা ঘটে উত্তরাঞ্চলীয় জেলা সিরাজগঞ্জে। পশুসম্পদে সমৃদ্ধ এই পুরা অঞ্চল; বিশেষ করে সিরাজগঞ্জ হচ্ছে গবাদি পশুপালনের জন্য সমৃদ্ধ এলাকা, জেলার শাহজাদপুর উপজেলাকে বাংলাদেশের দুধের ভাণ্ডার বলা যায়। এখানে কৃষকরা চারটা পাঁচটা থেকে শুরু করে প্রতিজন দশ এগারটা পর্যন্ত গরু পালন করেন। শাহজাদপুর ঘুরে এসে জানাচ্ছেন রেজাউল হক

সাতাশে আগস্ট চিথুলিয়া গ্রামে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার কায়েমপুর ইউনিয়নের গ্রাম এই চিথুলিয়া। ওই গ্রামের কৃষক আবদুস ছালামের গরু আক্রান্ত হয়েছিল অ্যানথ্রাক্সে, সেই গরু জবাই করে খেয়ে কয়েকজন অসুস্থ হয়েছেন। এ খবর ছিল আমার কাছে। কিন্তু খবরের পেছনে ছুটে--ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রকৃত ঘটনা ও পুরা পরিস্থিতি তুলে আনা সহজ কাজ ছিল না। বিশেষত, পথ যখন অনেক দীর্ঘ এবং যাত্রা অনেক কষ্টকর।

বানতিয়ার গ্রামে নেমে প্রথমে নৌকা, তারপর ভ্যান, তারপর রিক্সায় করে পৌঁছলাম শাহজাদপুর বিসিক বাসস্ট্যান্ড। বাসস্ট্যান্ড থেকে সিএনজি নিয়ে সরিষাকোল, সরিষাকোল থেকে ভ্যানে চেপে জগন্নাথপুর বাজার, জগন্নাথপুর বাজার থেকে নৌকায় ভেসে বনগ্রাম, সেখান থেকে আবার নৌকার যাত্রী হয়ে তবে চিথুলিয়া পৌঁছাই।

এটা তড়কা রোগ না

চিথুলিয়া পৌঁছানোর আগে বনগ্রাম গিয়ে প্রথমে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মোঃ আক্তার হোসেনের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তিনি গরুর মালিকের কথা জানালেন। আক্তার হোসেনের কাছেই জানলাম যে, গরুটি স্থানীয় জাতের গরু ছিল না, ওটা ছিল তথাকথিত ‘অস্ট্রেলীয় উন্নত জাত’র গরু। অমন গরুকে শুকনা খড়, গমের ছাল, খেশারীর ভূষি, সরিষার খৈল, তিলের খৈল, নালীগুড়, লবণ, এ্যাংকার ভূষি, ধানের কুড়া ইত্যাদি খাওয়ানো হত। হোসেন বলেন, এই অ্যানথ্রাক্সকে বলা হচ্ছে তড়কা রোগ। কিন্তু এটা সাধারণ ‘তড়কা’ হতে পারে না। তড়কা এমন মহামারী আকারে ছড়ায় না। দেশী মানে স্থানীয় জাতের গরুতে তো ফি বছরই তড়কা রোগ হয়, কিছু গরু মারাও পড়ে। কিন্তু গরুর তড়কা কখনও মানুষে ছড়ায় না। বনগ্রামসহ আশপাশের এলাকায় এখন অ্যানথ্রাক্স রোগ প্রতিরোধের জন্য গরুকে ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে। শাহজাদপুর উপজেলার রতন কান্দি গ্রামের বাসিন্দা জনাব দুলাল চন্দ্র পেশায় পশু চিকিৎসক চন্দ্র জানান, গরুর ভ্যাকসিনের বোতলে লেখা আছে--‘গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, মহাখালী, অ্যানথ্রাক্স রোগের প্রতিরোধক ভ্যাকসিন।’ জনাব চন্দ্র জানান, আক্রান্ত গরুর মাংস কাটাকাটি করার ফলে যারা আক্রান্ত হন তাদের চিকিৎসায় সিপ্রোফ্লক্সাসিন (ciprofloxacin 500mg)। শিশুর জন্য দেওয়া হচ্ছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির তরল সিপ্রোসিন (ciprocin)

বনগ্রাম থেকে চিথুলিয়া পৌঁছেই যাই আবদুস ছালামের বাড়িতে, ছালাম বলেন, ‘গরুটা মোটা করার জন্য যোগাল দিচ্ছিলাম, এঁড়ে গরু ছিল ওটা। জ্বর হল এরপর। মিল্ক ভিটার পশু ডাক্তার মোঃ বাবুলকে জানানো হয়, কিন্তু তিনি আসেন নাই। জ্বরের জন্য গরুটার গায়ের পশম দুই দিন ধরে খাড়া হয়েছিল। শবেবরাতের দিন বেলা ৩টার দিকে গরুটাকে পাইরাভেট (piravat) টেবলেট ২টা এক সাথে খাওয়াই। খাওয়ানোর সাথে সাথে পুরা শরীর ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। তারপর দাড়াক মাইরা শুইয়া পড়ে। তারপর সন্ধ্যা পর্যন্ত গরুটার মাথায় পানি দেই। জ্বর ছিল একশ ষাট ডিগ্রি। গরুটা তখন থেকে এদিক সেদিক মাথা ঠুকতে থাকে। গ্রামের এক ডাক্তার পরামর্শ দেন, গরুটা জবাই করে কম দামে গ্রামে বিক্রি করে দিলে কিছু টাকা আসবে। তার কথা মত গরুটা জবাই করা হয়। ৩ মণ ২০ কেজি মাংস ১৪০.০০ (একশত চল্লিশ) টাকা দরে বিক্রি করা হয়। গোশত বানানোর সময় হাড় কাটতে যেয়ে হাড়ের টুকরা যার যেখানে লেগেছে সেখানে ফোসকা পড়ে ঠোসা পড়ে যায়। ঠোসা গলে ঘা হয়। ছালামের ডান হাতের এক আঙুলে, ছালামের ছোট ছেলের পায়ে তখনও ঘায়ের চিহ্ন দেখতে পেলাম। চিকিৎসা হিশাবে তাদের বয়সভেদে সিপ্রোফ্লক্সাসিন ৫০০ মিলিগ্রাম বা তরল সিপ্রোসিন খাওয়ানো হচ্ছে।

এলাকার কৃষকরা জানান, এই রোগের লক্ষণ হল গরু প্রথমে ২/৩ ঘণ্টা দম ধরে থাকে, তারপর শুয়ে পড়ে; ২/৩ বার হামবা হামবা করে ডাক দেয়, মুখে ও মলদ্বার দিয়ে রক্ত বের হয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যায়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু অর্ধশত বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, অ্যানথ্রাক্স একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। ব্যাসিলাস এনথ্রাসিস (Bacillus anthracis) নামের ব্যাকটেরিয়া এ রোগের জন্য দায়ী। এ রোগের বীজগুটি (স্পোর) মানুষ ও গবাদিপশুতে ছড়িয়ে পড়ে। এ বীজগুটি (স্পোর) ব্যাসিলাস এনথ্রাসিস রোগের জীবাণুর শক্ত আবরণ তৈরি করে। এ ব্যাকটেরিয়া অধিক সময় ধরে বেঁচে থাকে। ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে মারা যায় না।

সবগুলোই কথিত ‘উন্নত’ জাতের গরু

আবদুস ছালামের গরু আক্রান্ত হওয়ার ঘটনার কয়েক দিন পর একই গ্রামের মোঃ সাহেব আলীর ১টা গরু মারা যায়। জনাব আলী জানান, মারা যাওয়া গরুটা মাটিতে পুতে ফেলা হয়। তারপর ঢাকা থেকে লোকজন এসে পুতে রাখা গরু আবার তোলে। শুনেছি তারা ঢাকার কলেরা গবেষণাগার থেকে এসেছেন। পরীক্ষা করতে তারা গরুটার চামড়া, রক্ত, মাংস হাড়সহ কিছু নমুনা নিয়ে যান। আলী যাকে কলেরা গবেষণাগার বলছেন, পাঠকের সুবিধার জন্য জানাই, সেটা হচ্ছে ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত আইসিডিডিআর-বি। সিরাজগঞ্জজুড়ে সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, পুরা জেলায় ১ লাখ গরুকে অ্যানথ্রাক্সের ভ্যাকসিন দেয়া হবে। চিথুলিয়া গ্রামেরই ইব্রাহিম মোল্লার ছেলে শাহ আলীর একটা গরুও মারা গেছে। গরুটা অসুস্থ হওয়ার পরও জবাই করা হয়, মাংস হয় ৪ মণ ২০ কেজি। মাংস গ্রামে বিক্রি করা হয়। খেয়াল করার বিষয় হচ্ছে, জেলার শাহজাদপুর উপজেলার কায়েমপুর ইউনিয়নের যে গরুগুলা অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়েছে তার সবগুলোই তথাকথিত ‘উন্নত’ জাতের গরু। এখন পর্যন্ত ওখানে কোন দেশী জাতের গরুতে অ্যানথ্রাক্স আক্রমণ হয় নাই। দেশী জাতের গরুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। এদিকে সরকার সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মীদের জন্য রেড অ্যালার্ট জারি করলেও তা কোনও কাজে আসবে না। কারণ, ইউনিয়ন পর্যায়ে দরকারি সংখ্যক টিকাদান কর্মী নাই এবং ভ্যাকসিনের সরবরাহও অপর্যাপ্ত।

১ নম্বর ছবির কাহীনি: অ্যানথ্রাক্স মূলত তিন ধরনের। রেসপিরেটরি (শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত) অ্যানথ্রাক্স, গ্যাস্ট্রেইনটেস্টিনাল (পরিপাকজনিত) অ্যানথ্রাক্স এবং কিউটেনিয়াস অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা। রেসপিরেটরি অ্যানথ্রাক্স-ই জীবাণু অস্ত্রের আকারে ছড়ানো হয়। রেসপিরেটরি অ্যানথ্রাক্সে প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে সবচেয়ে বেশি। অবশ্য আমাদের দেশের অ্যানথ্রাক্স কোন ধরনের তা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয় নাই।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।