0


বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে সবচেয়ে কম আলোচিত দিকটা হলো ইনটেলিজেন্স বা গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ। বলা যায়, বিডিআর ঘটনা ইনটেলিজেন্স বিকল বা পরাজিত হবার একটা আদর্শ ঘটনা। এই ইনটেলিজেন্স বিকল বা পরাজয় আবার ঘটেছিল দুই ক্ষেত্রে। দুই ক্ষেত্রে মানে একটা ঘটনা ঘটার আগের আগাম তথ্যের কথা বলছি। আর একটা ঘটনা ঘটে গড়াতে শুরু হয়ে জানা যাবার পর কমপক্ষে পরবর্তী ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত সময়ের কথা বলছি।

ইনটেলিজেন্স (গোয়েন্দা তথ্য) আর অস্ত্র (বাহিনী) - এরা দুজনে দুজনার। যার হাতে অস্ত্র, বাহিনীতে সংগঠিত অথচ কাজের `ইনটেলিজেন্স নাই অথবা বিকল পরাজিত - এটাকে কেবলমাত্র বাচ্চাদের খেলনা বন্দুক নিয়ে খেলাপাতির খেলার সাথেই বোধহয় তুলনা করা যায়। এই তুলনা আমরা করতেই পারি। কিন্তু সমস্যা হলো, বাহিনী গড়া খেলাপাতি খেলা না। এর উপর আবার বাহিনী গড়ার উদ্দেশ্য বলতে যদি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা অথবা সীমান্ত প্রতিরক্ষা বুঝায় - তাহলে পাঠক বুঝতেই পারছেন কী ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে তার।

বিডিআর ঘটনা নিয়ে বহুদিক থেকে কথাবার্তা চলছে। এখানে আমার কথা কেবল ইনটেলিজেন্স প্রসঙ্গে সীমাবদ্ধ রাখব।

 

বিডিআরে অপারেশন ডাল-ভাত নিয়ে জওয়ান অসন্তোষ আছে এটা প্রায় সবাই জানতেন, স্বীকার করেন। এই জানার মধ্যে মাত্রার ফারাক থাকতে পারে। কিন্তু একে পুঁজি করে ভয়াবহ পরিকল্পনা কোথায় কোন কোঠরে গিয়ে ঠেকেছে তা এককথায় বলা যায়, ইনটেলিজেন্স ইউনিটগুলোর কেউই জানতে পারেন নি। ২৫ তারিখে সকালে ডাকা দরবারে জমায়েত হবার পর সবাই একেবারে বোল্ট ফ্রম দা ব্লু । বিডিআর সেনা অফিসার, সেনাবাহিনী, সামরিক বেসামরিক ইনটেলিজেন্স - সবাই আকাশ থেকে পড়েছেন। সবাই না হলেও অনুমান করি, তখন অন্তত জেনারেলদের টের পাবার কথা - একটা মারাত্মক ইনটেলিজেন্সের ফেইলিওর, পরাজয় বা বিপর্যয় ঘটে গেছে। কেমন, কী ধরণের ইনটেলিজেন্সের ফেইলিওর? না, এটা মুম্বাই ঘটনার মত কোন সন্ত্রাসী হামলায় ইনটেলিজেন্সের পরাজয় নয়। এটা সেনা-অফিসারের নিজের সৈনিক জীবনকে রক্ষার মামলা। নিজের ঘরের, ব্যারাকের মধ্যে নিজেকে রক্ষার মামলা। সেই ইনটেলিজেন্সের পরাজয়। নিজেকে রক্ষা মানে এখানে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তার প্রশ্নও বটে। এই নির্মম পরিকল্পনা বিডিআরের ভিতর থেকেই হোক কি দেশে-বিদেশে যেখান থেকেই হোক - তাতে আমার বক্তব্যের কোন হেরফের নাই। কারণ মূলকথা বা ফ্যাক্টস হলো, ইনটেলিজেন্সের একটা চরম ব্যর্থতা ঘটে গেছে। ঘটনার কোন খবর এমনকি ইঙ্গিতটুকুও কারও কাছে ছিল না। আর্মির অন্তত তিনটা গোয়েন্দা সংস্হা আছে। সিভিল প্রশাসনেরও আছে এরকম, সংখ্যায় বোধ হয় একটা বেশি। এছাড়া আছে র‌্যাব। এগুলো সব কাজির গরু খাতায় থাকার মত থেকে গিয়েছে, কিন্তু কোন কাজে লাগে নাই। কেন কাজে লাগে নাই বললাম এর জন্য পাঠক, কোন রেফারেন্সে যাব না। কারণ আমরা দেখতেই পেয়েছি, এছাড়া, কোন ইনটেলিজেন্স ইউনিট এখনও দাবি করে নাই যে তারা কোন কিছু টের পেয়েছিল।

ডিজি শাকিলের কাছে - জওয়ানদের সাধারণ অসন্তোষের আছে - এর বেশি যে তথ্য ছিল না তা বুঝতে আমাদের কষ্ট হয় না। ঐদিন দরবার ডাকার মধ্যে কোন শঙ্কা বিপদ থাকলে অন্তত নিজে না মরার জন্য হলেও তিনি নিশ্চয় দরবার বাতিল করতেন। পাল্টা কোন ব্যবস্হা নিতেন। অর্থাৎ আমরা দেখছি, কোর পরিকল্পনাকারীর অন্তত ভিতরের যারা ছিল সেই বিডিআর সিপাহিরা সবকিছুই করতে সক্ষম হয়েছে, সংগঠিত নড়াচড়া করতে পেরেছে কোন ধরণের ইনটেলিজেন্স (গোয়েন্দা তথ্য) সৃষ্টি বা উত্তেজনা তৈরি না করেই। আর এটাই সামরিক বেসামরিক সমস্ত ইনটেলিজেন্স ইউনিটের মারাত্মক ব্যর্থতা, বিকলতা, বিপর্যয়।

 

বিডিআর ঘটনাকে নিয়ে যত ধরণের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আছে - এর সবগুলোও একসাথে বা কোন একটা সত্য হলেও কথা একই থাকে - এটা ইনটেলিজেন্স ইউনিটের ব্যর্থতা, বিকলতা। ডিজি শাকিল সহ প্রায় শত খানেক সেনা অফিসার নিজেদের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন ইনটেলিজেন্স ইউনিটের ব্যর্থতা, বিকলতা কী জিনিষ। ইনটেলিজেন্স (গোয়েন্দা তথ্য) কত গুরুত্ত্বপূর্ণ। এটা জীবন মরণের প্রশ্ন। রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তার প্রশ্ন। এখানে কোন ধরণের গাফিলতিকে অস্ত্র সহ্য করে না। রাষ্ট্রকে হুমকির মুখে ফেলে দেবার জন্যও এটাই যথেষ্ট।

 

এই কথাগুলো লিখতে লিখতে একটা কথা মনে পড়ল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো একদিন আগেই ঐ দরবার হলে গিয়েছিলেন। তাহলে তাঁর বেঁচে যাবার কারণ কি এই যে, পরিকল্পনাকারীদের পরিকল্পনায় তিনি টার্গেট ছিলেন না। স্রেফ একারণেই কী তার পরিদর্শনের দিনটা সম্ভবত - ঐদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি নয়? রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমি শিউরে উঠছি।

ইনটেলিজেন্সের পরাজয়ের সাথে, ডিজি শাকিলের ও তাঁর নিকট সহ কমান্ডদের বিষয়ে একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সাধারণ জওয়ানদের মধ্যে একটা অসন্তোষ আছে এতো তাঁরা জানতেন (যার উপর দাড়িয়ে, একে কাজে লাগিয়ে পরিকল্পনাকারীরা সেনাবাহিনী বনাম বিডিআর জওয়ান বলে বিবাদ খাড়া করতে পেরেছিল) - এই ক্ষোভকে (তা যতই ছোট বা মতান্তরে বড় হোক না কেন) প্রশমিত করার জন্য সরকারের প্রধানকে এত কাছে পেয়েও তাঁকে ইতিবাচক অর্থেই ব্যবহারের কথা তাঁরা চিন্তা করেন নাই কেন? এটাই সেই প্রশ্ন। এই অসন্তোষ তাদের সীমিত তথ্য বিচারে যতই কম জানা থাক, আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাঁরা একে পুষে রাখার পথ বেছে নিয়েছিলেন। এটা যে যেকোন দিকে মহীরুহ হয়ে উঠার পথে পটেনশিয়াল - এই পটেনশিয়াল করে রাখার জন্য কী তাঁরা দায়ী নন? এই ঝুঁকি তাঁরা কেন নিতে গেলেন? ঝুঁকি নেয়া কেন সঠিক বলে মনে হলো? আমি যদি ধরে নেই ডাল-ভাত কর্মসূচিতে কোন দূর্নীতি গাফিলতি নাই; ধরা যাক, সমস্যা হলো ভুল বুঝা, বিডিআর কমান্ডকে জওয়ানরা ভুল বুঝেছেন, বা সরকারী আমলাতান্ত্রিক কোন জট যার কারণে যার জন্য জওয়ানদের উপযুক্ত বা অনুপযুক্ত আকাঙ্খা ক্ষোভে পরিণত হতে পেরেছে -সেটা যাইই হোক - প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য নিয়ে এটা সবচেয়ে সহজে মোকাবিলার, অসন্তোষ তা যতই ছোট বা বড় হোক তাকে খামোশ করে ফেলার এই সুযোগ কেন ডিজি শাকিলের ও তাঁর সহ কমান্ডরা উপেক্ষা করলেন, হেলায় সুযোগ নষ্ট করলেন? সমস্যা যাই থাক প্রধানমন্ত্রীর একটা আশ্বাসই কী এখানে যথেষ্ট ছিল না? অন্তত এতে ২৫ ফেব্রুয়ারীর পরিকল্পনার ভিতর বা বাইরের যারাই করুক তাদের মুখ থেকে ভাতের থালা কেড়ে নেবার মত একটা কাজ হতে উঠতে পারত না সেটা? এই বিশাল প্রশ্ন আমার পিছু ছাড়ছে না। তবে কী আসলে ডাল-ভাত কর্মসূচিতে কোন দূর্নীতি বা বড় কোন ঘাপলা ছিল যার জন্য সরকারী প্রশাসন বা প্রধানমন্ত্রীকে জানালে নিজেরা বিপদে বা ঝামেলা-জটিলতায় পড়ার সম্ভবনা ছিল - ব্যাপারটা কি এরকম? যার জন্য মনে করা হয়েছিল এটা নিজেরাই সামাল দিতে পারতে হবে? এটা যদি সত্যি হয় তাহলে বলব - এত সর্টকাট ও একচোখা - কেবল নিজেদের বাঁচানোর চিন্তা কেন তাঁরা চিন্তা করবেন? আর আসলেই কী তাঁরা শেষ পর্যন্ত নিজেদের বাঁচাতে পারলেন? নিজেকে বাঁচানোর সঠিক পথও তাঁরা বেছে নিতে পারেন নাই, দেখাই যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর পরিদর্শনের একদিন পর জওয়ানরা অসন্তোষ প্রকাশ করবে অথবা এই অসন্তোষকে কেউ ব্যবহার করবে, কেয়ামত লাগিয়ে দিবে - এটাকে বিডিআর ডিজি শাকিল ও তাঁর সহযোগী নেতৃত্ত্ব চেয়ে চেয়ে দেখবেন? সমর সংশ্লিষ্টদের সিদ্ধান্ত নেবার এধরণ অগ্রহণযোগ্য, আত্মঘাতি - এটা আর আমার বলার অপে


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।