পাওয়ার সেল দিয়ে বিশ্বব্যাংক সফল, ব্যর্থ বাংলাদেশ


ভাড়া বিদ্যুতের ব্যবসা চালাতে রাষ্ট্রায়ত্ব খাতের সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে না

জনাব রহমতউল্লাহ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক। পাওয়ার সেল এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে (আরইবি) দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে কাজ করেছেন। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক অবস্থা এবং সংকটের কারণগুলা দেখেছেন খুব কাছে থেকে। চিন্তার সাথে দীর্ঘ এক আলাপচারিতায় বর্তমান বিদ্যুৎ সংকট কখন থেকে শুরু হয়, এর কারণ, বর্তমান সরকারের ভূমিকা এবং সংকট সমাধানের উপায় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রকৌশলী বি. ডি রহমতউল্লাহ’র সাথে চিন্তা’র তরফে আলাপচারিতায় ছিলেন নেছার আমিন।

নেছার আমিন: আপনি দীর্ঘদিন পাওয়ার সেলের দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমান বিদ্যুৎ সংকট তৈরি হওয়ার পেছনে কি ধরনের কারণ রয়েছে বা কারা এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন?

বি. ডি রহমতউল্লাহ: বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতের সংকটের পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে বিশ্বব্যাংক। এ দেশের কোন সরকারেরই বিশ্বব্যাংকের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না এবং নাইও। বিশ্বব্যাংক সমস্ত দাতা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করে। তারা যে পরামর্শ দেয় তা সমস্ত দাতাসংস্থা মানতে বাধ্য থাকে। বিশ্বব্যাংক ১৯৮০ সালের দিকে ঘোষণা দেয় যে, তারা বিদ্যুৎ বিতরণে টাকা দিলেও সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে আর টাকা দেবে না। তবে সে সময় থেকেই তারা বিদ্যুৎ খাতে ঋণ দিয়ে আসছিল। এধরনের ঋণের আকার ছিল খুবই ছোট। এবং এই ঋণের উদ্দেশ্য ছিল, বিদ্যুৎ খাতের সংস্কারের জন্য বিদেশী পরামর্শক (কনসালট্যান্ট) আনা। ওই সময় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা চাহিদার চেয়ে বেশি ছিল।

বিদ্যুতের একটা সাধারণ রীতি আছে, স্থাপিত বিদ্যুৎ ক্ষমতা চাহিদার চেয়ে ন্যূনতম ২০% বেশি থাকতে হয়। বিশ্বব্যাংক ও দাতাসংস্থাগুলো ১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশকে টাকা বন্ধ করে দেয়ায় ১৯৯০ এর দশকে এসে চাহিদা এবং উৎপাদন সমান হয়ে যায়। ১৯৯৪ সালে বিশ্বব্যাংক--পিডিবি, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) চেয়ারম্যান এবং বিদ্যুৎ ও পরিকল্পনা কমিশনের সচিব পদমর্যাদার কয়েকজন কর্মকর্তাকে অভিজ্ঞতা অর্জনের কথা বলে আমেরিকা ভ্রমণ করাতে নিয়ে যায়। সেখান থেকে এসে তারা বলে, বিদ্যুৎ খাত সংস্কার করতে হবে। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারিকরণে পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা বলল, পিডিবিকে ভেঙ্গে এর থেকে উৎপাদন, বিতরণ ও সঞ্চালন আলাদা করে ফেলতে হবে। তখন মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ৩ হাজার মেগাওয়াট। এত ছোট একটা খাতকে তারা বিশ্বব্যাংকের সব অবাস্তব ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী পরামর্শের ভিত্তিতে ভাঙ্গার জন্য খোঁড়া যুক্তি উপস্থাপন করতে লাগল। ইতিমধ্যে ১৯৮০ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৯৯৬ সালে বিদ্যুৎ সংকট মারাত্মক রূপ ধারণ করে। তখনই প্রথমবারের মত আমরা লোডশেডিং দেখলাম। আর প্রথমবারের মত বিশ্বব্যাংকের সব অবাস্তব ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী পরামর্শের বদৌলতে আমরা দেখলাম চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম।

আইপিপির অনুমোদন দেয়া হয় কখন থেকে এবং এর ফলাফল কি দাঁড়ায়?

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সংকট কমানোর কথা বলে আইপিপি (ইনডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্লান্ট), বার্জ মাউন্টেড (আনসলিসিটেড, অর্থাৎ দরপত্র ছাড়া) প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। তখন থেকেই বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতির বীজ ঢোকে। একই বছর ‘প্রাইভেট পাওয়ার জেনারেশন পলিসি’ প্রণীত হয়। সাধারণত যেসব দেশে মৌলিক ভৌত প্রকল্প নির্বাচনে সরকারের কোন স্বাধীন ভূমিকা থাকে না সেসব দেশে এ ধরনের নীতি প্রণীত হয়। বর্তমান পিডিবির চেয়ারম্যান আলমগীর কবির প্রাইভেট পাওয়ার জেনারেশন পলিসি প্রণয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আমরা রাষ্ট্রবিরোধী যেসব অনুচ্ছেদগুলার বিরোধিতা করতাম তিনি ওইগুলাতে বিশ্বব্যাংকের সমর্থনে জোর সম্মতি দিতেন। তার ভূমিকায় মনে হত তিনি যেন বিশ্বব্যাংকের স্বার্থ রক্ষা করতেই সরকারি চাকুরিতে নিয়োগ পেয়েছেন।

আইপিপির উদ্যোগটাই ছিল রাষ্ট্রবিরোধী উদ্যোগ। আইপিপি কোম্পানিগুলাকে বিদ্যুতের দাম পরিশোধ করতে হয় ডলারে। আমরা জানি, ডলারের দাম সবসময় ওঠানামা করে। চুক্তিকালীন সময়ে যে ডলারের দাম ৪০ টাকা ছিল আজকে ডলারের দাম ৭০ টাকা হওয়ার ফলে আইপিপি কোম্পানিগুলাকে চুক্তিকালীন সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেশি দাম দিতে হচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশকে অনেক বেশি টাকা পরিশোধ করতে হবে। অথচ পিডিবি গ্রাহকদের কাছ থেকে বিদ্যুতের দাম নেয় টাকায়। তাছাড়া তারা ইচ্ছা করলেই দাম বাড়াতে পারে না। আরেকটি বিষয় হল, আইপিপিগুলা কোনরকম কর দেবে না। পিডিবিকে কর দিতে হবে কিন্তু তাদেরকে কর দিতে হবে না। তারা মেইনটেন্যান্সের ৩০% নিয়ে আসতে পারবে কোনরকম কর ছাড়াই। কোম্পানিগুলা তাদের ১০০% লাভ নিজের দেশে প্রেরণ করতে পারবে। তাহলে দেখা গেল, আমাদের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। আমাদের সম্পদ, গ্যাস ব্যবহার করে তারা লাভবান হচ্ছে। আমরা বিদ্যুৎ কিনি আর না কিনি, প্রতিদিন যে খরচ হচ্ছে তা ফেরত দিতে হবে। এটাই হল আইপিপির স্বরূপ। এটা ঠিক আমাদের দেশে আগত সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ ইস্ট ইনডিয়া কোম্পানির মত। অর্থাৎ তারা যা ইচ্ছে তাই করবে।

আমাদের পরামর্শ ছিল--মোট উৎপাদনের ২০% এর বেশি আইপিপি দেয়া হবে না। কিন্তু সেটা আজকে প্রায় ৫০% হয়ে গেছে। এরফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতটি মুনাফাখোরদের হাতে চলে গেছে; যারা বিদ্যুতের মান, মূল্য এবং জনগণের ভোগান্তি দেখে না। অনেকে বলছেন, আইপিপির মাধ্যমে তো বর্তমানে প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে আমার কথা হল, আমার ঘর ভেঙ্গে দিয়া বলা হচ্ছে, তুমি পুকুরে থাক। কিন্তু সেটা তো ঠিক হবে না। আশুগঞ্জসহ সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি কিলোওয়াট-ঘণ্টা (কযি) বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ মাত্র ১ টাকা ৪০ পয়সা। ফার্নেস তেলে সেটা ৬ টাকা এবং ডিজেলে খরচ হয় ১০-১১ টাকা। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করব কিনা? দেশে সংকট তৈরি করে বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ খাতকে আইপিপি বা বেসরকারি খাতে দিয়ে দেয়া হোক। এটা তো মেনে নেয়া যায় না।

আপনি অনেকবারই বলেছেন যে, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ হিশাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা পিডিবির আছে। যদি তা-ই হবে, তাহলে সরকার এ সুযোগ হাতছাড়া করছে কেন?

সক্ষমতা যদি ব্যবস্থাপনার দিক থেকে হয় তাহলে আমি বলব- পিডিবির ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা আছে কিন্তু এই সক্ষমতাকে অচল করে রাখা হয়েছে। এর প্রথম কারণ হল আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ধ্বংসের মূলে আছেন বর্তমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক ই এলাহি চৌধুরী এবং বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবুল কালাম আজাদ। তৌফিক ই এলাহি চৌধুরী একজন অকর্মণ্য এবং বিতর্কিত সাবেক আমলা। তার মত একজন ব্যক্তিকে বানানো হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা। এছাড়া আবুল কালাম আজাদের মত একজন অপেশাদার নন-প্রফেশনাল লোককে বানানো হয়েছে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের মত একটি কারিগরি, জটিল ও স্পর্শকাতর মন্ত্রণালয়ের সচিব। তিনি কিছুদিন আগে একটা সেমিনারে আমার সাথে বলেছেন, ‘বিদ্যুৎ সম্পর্কে আমি শুধু এটাই জানি যে, বিদ্যুতের সুইচটিকে নিচের দিকে দিলে বাতি জ্বলে আর ওপরের দিকে দিলে বাতি নিভে যায়। এছাড়া বিদ্যুৎ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না’। যে লোকের বিদ্যুৎ সম্পর্কে কোন জানাশোনা নাই সেই লোককে বানানো হয়েছে বিদ্যুৎ সচিব। যে দেশে এ ধরনের অদক্ষ লোককে বিদ্যুৎ সচিব বানানো হয় সে দেশের বিদ্যুৎ সংস্থাগুলার সক্ষমতা কোনদিনও বৃদ্ধি পাবে না। সরকার পিডিবি এবং পেট্রোবাংলার সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য যে কাজগুলা করা দরকার তা করছে না। বিদেশী স্বার্থ রক্ষা এবং তাদের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করার জন্যই তারা সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে না।

কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রীয় খাতে যে পরিমাণ উৎপাদন ক্ষমতা সংস্থাপিত আছে, তার চেয়ে অনেক কম উৎপাদন হচ্ছে। বর্তমান সক্ষমতাই যেখানে পিডিবি ব্যবহার করতে ব্যর্থ হচ্ছে সেখানে সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলাটা কেমন?

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলা ক্ষমতার তুলনায় কম উৎপাদনী ক্ষমতায় (ডিরেটেড) চলছে। পৃথিবীর কোন দেশে এভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র চলে না। বর্তমানে বাংলাদেশের স্থাপিত ক্ষমতা আছে ৫,৬৭২ মেগাওয়াট। গড়ে উৎপাদন হয় ৪ হাজার মেগাওয়াট। মাঝেমাঝে ৪২০০-৪৩০০ মেগাওয়াট উৎপাদন হয়। স্থাপিত ক্ষমতা থেকে বাংলাদেশে ৩৩% বিদ্যুৎ কম উৎপাদিত হচ্ছে। এজন্য ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি করা ছাড়া কোন উপায় নাই। আমাদের ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা যদি বাড়ে তাহলে যেটা ১০০ মেগাওয়াটের সেটা ১০০ মেগাওয়াটই উৎপাদন করতে পারবে। এই কাজগুলা করতে দেয়া হচ্ছে না। কারণ ৫,৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যদি উৎপাদন হয়ে যায় তাহলে তো ‘সিন্ডিকেট সদস্যরা’ অবৈধ ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুতের ব্যবসা করতে পারবে না। সুতরাং ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুতের ব্যবসাটা চালানোর জন্য এই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে না।

পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ২০-৪০ বছর পুরনো। তাই স্থাপিত ক্ষমতার সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না....

এক্ষেত্রে আমার কথা হল, পৃথিবীতে বহু বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র আছে ৫০-৬০ বছরের পুরনো। এত দীর্ঘ দিন চালানোর পরেও অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখনও ঠিক আছে। ওগুলো কিভাবে চলছে? বিদ্যুৎ কেন্দ্র যখন দীর্ঘদিন চলে স্বাভাবিক কারণেই তার বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নষ্ট হয় (Natural wear and tear)। নষ্ট হলে এর বিভিন্ন অংশ পুনঃস্থাপন করা হয়। তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জীবন (লাইফটাইম) ২৫-৩০ বছর হলেও বিভিন্ন অংশ পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে এর সক্ষমতা ও যথাযথ মান সবসময় ধরে রাখা যায়। বাংলাদেশে ইচ্ছাকৃতভাবে ‘ডিরেটেড’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশেই একমাত্র ডিরেটেড শব্দটা প্রচলিত।

বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে এছাড়া সরকার আর কি করতে পারত?

এখন আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ঘাটতি ২২০০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি। সরকার এই ২২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য দ্রুত কতগুলো পদক্ষেপ নিতে পারত। সরকার যেগুলাকে ডিরেটেড বলছে সেগুলাকে ৬ মাসের মধ্যে সংস্কার করতে পারলে ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা বৃদ্ধি পেত। কিছুকিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আমি যতদূর জানি ট্রান্সফরমার, রোটার এবং স্টেটার কিংবা স্টেশন ট্রান্সফরমার খারাপ। আমার হিসেবে দেড়শ কোটি টাকা খরচ করলে এই ৮০০ মেগাওয়াট পাওয়া যায়। এই ৮০০ মেগাওয়াটের কথা সরকারের ঘোষিত নির্বাচনী ওয়াদাতেও ছিল। সেই ওয়াদার কথা এখন কোথায় গেল? আজকে ১৮ মাস পেরিয়ে গেছে তবু সরকারের সেইরকম কোন উদ্যোগ নেই। বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে গ্রাহক প্রান্ত পর্যন্ত ক্যাপাসিটর স্থাপন করে আরও ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় সম্ভব। এতে সর্বোচ্চ ১৫০ কোটি টাকা খরচ হত। প্রচলিত মটরের সাথে আই এম সি বসালে এতে ন্যূনতম ৫০০/৬০০ মেগাওয়াট চাহিদা কমে যাবে বা বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে।

আই এম সি (ইন্টিলিজেন্ট মোটর কন্ট্রোলার ইলেকট্রনিক ব্যালাস্ট- ওগঈ) এর মত একটা যন্ত্র। পত্রিকায় দেখলাম নাটোরের শিমু নামের একটা ছেলে সম্প্রতি এটা উদ্ভাবন করেছে। মোটর লোডের বিপরীতে যদি আই এম সি বসিয়ে দেয়া যায় তাহলে চাহিদার ৫০% লোড কম লাগে। ৫ ঘোড়ার বিপরীতে বসালে এটা ১০ ঘোড়ার কাজ করে। এর মাধ্যমে অর্ধেক লোড বেঁচে যায়। সিস্টেম লস কমানো গেলে আরও ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চয় হবে। এটা বন্ধ করতে একটি শক্তিশালী জনপ্রিয় সরকারের মাত্র একদিন লাগে। সিএফএল কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে ৫০০ মেগাওয়াট সাশ্রয় সম্ভব। এটা সরকারই সম্প্রতি বলেছে। অবশ্য বিশ্বব্যাংক বলার পরে। কিন্তু আমরা যখন বলেছি তখন সরকার আমাদের পাগল বলে ঠাওরেছে! এ হল আমাদের দেশের সরকারদের চরিত্র! বিশ্বব্যাংক কোন কিছু বললে এটা শিরোধার্য হয়ে যায়! যাই হোক এ পদক্ষেপগুলো নিলে কোথাও সাশ্রয় কোথাও উৎপাদন বৃদ্ধি করে সিস্টেমে নিদেনপক্ষে ২,৩৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এছাড়া বায়ুশক্তি, সূর্যতাপ, বায়োমাস (সবধরনের বর্জ্য) সহ অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার করলে খুব অল্প সময়ে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যায়। যেমন ঢাকা সিটি করপোরেশনের হিশাব অনুযায়ী দৈনিক মোট ৫,০০০ টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়, যা থেকে সৃষ্ট বায়োগ্যাস থেকে প্রায় ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।

আমরা জানি, বর্তমান বিদ্যুৎ সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ হল গ্যাস সংকট। গ্যাস সংকট সমাধানে সরকার কি পদক্ষেপ নিতে পারে?

দেশে যে গ্যাস সংকট আছে তা কৃত্রিম সংকট। বাপেক্সের শক্তিশালী ভূমিকা না থাকায় প্রত্যাশা মত গ্যাসও পাওয়া যাচ্ছে না। এরফলে গ্যাসের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে মোট গ্যাসকূপের সংখ্যা ৭৯টি। ৫১টি পেট্রোবাংলার আর বাকি ২৮টি বিদেশী কোম্পানির। আমাদের কূপগুলো থেকে ৩-৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস ওঠানো যায়। কূপ যখন খনন করে তখন কয়েকটা করা হয়। কারণ শুধু একটা দিয়ে গ্যাস ওঠানো হলে দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে ওখানে পানি জমে সেটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তখন গ্যাস ওঠানোর পরিমাণ কমে যায়। আমাদের কূপগুলাতে প্রত্যেকটার বয়স ২০-২৫ বছর হয়ে গেছে। দেশীয় কোম্পানির পরিচালনায় গড়ে প্রতিদিন ১ কোটি ঘনফুট গ্যাস যদি দৈনিক ৫১ টা কূপ থেকে ওঠানো হয় তবে তাতে ৫১ কোটি ঘনফুট গ্যাস হয়। বিদেশী কোম্পানিগুলার কাছে থাকা ২৮ টি কূপের প্রতিটি থেকে দৈনিক ৫ কোটি ঘনফুট করে ওঠালে ১৪০ কোটি ঘনফুটের মত গ্যাস ওঠানো সম্ভব। অর্থাৎ সবমিলিয়ে ১৯০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে আমাদের বর্তমান সক্ষমতা। তবে বর্তমান চাহিদা হচ্ছে প্রায় ২২৫ কোটি ঘনফুটের মত। সুতরাং আমাদের বর্তমান ঘাটতি ৩৫ কোটি ঘনফুট। সরকার চাইলে যেসব কূপগুলাতে ৩ কোটি ঘনফুটের নিচে গ্যাস ওঠে সেগুলো থেকে ৪-৫ কোটি ঘনফুট ওঠাতে পারে। ৪-৫ কোটি ঘনফুট তুলতে হলে মেইনটেন্যান্স অব ওয়েল বা কূপক্ষেত্রকে সরিয়ে দিতে হবে। এটাকে বলে কূপ উন্নয়ন। পুরনো গ্যাসক্ষেত্রগুলার ভেতরে নতুন কূপ খনন করা। এটা করার জন্য প্রতিটা কূপে ১-২ কোটি, কোনটাতে ১০ কোটি টাকাও লাগতে পারে। সরকার ৫০০ কোটি টাকা খরচ করলেই ১ মাসের মধ্যে গ্যাস সংকটের সমাধান সম্ভব।

এছাড়া পুরনো গ্যাস ক্ষেত্রগুলা যেমন বাঙ্গুরা, সাঙ্গু এগুলা অচল হয়ে আছে। অথচ এগুলা থেকে আরও ২০-৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস ওঠানো সম্ভব। এই উদ্যোগগুলা নিলে সংকট ছাড়াই আমাদের তিন চার বছর চলে যেত। এরমধ্যে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান অব্যাহত রাখতে হবে। আরেকটা বিষয় হল, গ্যাস ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়া। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলা মেইনটেন্যান্স করে এটা করা সম্ভব। আজকে ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাস লাগছে ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলা যদি মেইনটেন্যান্স করা যায় তাহলে এই ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দিয়েই নিদেনপক্ষে ৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। অর্থাৎ অনেক কম গ্যাস ব্যবহার করে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বিপুল পরিমাণে গ্যাস সাশ্রয় সম্ভব। সুতরাং সরকার যে গ্যাস সংকটের কথা বলছে তা ঠিক নয়। কারিগরি কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে সরকার যেন ইচ্ছা করেই এই সংকট বজায় রেখেছে।

চলমান বিদ্যুৎ সংকটকে সহনীয় পর্যায়ে আনার কথা বলে সরকার বেশি দামের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুতের জন্য বিভিন্ন কোম্পানিকে অনুমোদন দিচ্ছে। তো রাষ্ট্রীয় খাতে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নয়ন চালু রাখলে এ সংকট কি স্বাভাবিক ছিল? আপনি এই ভাড়াবিদ্যুতকে কিভাবে দেখছেন?

জনগণকে ইচ্ছা করে সংকটে ফেলে সরকার ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সামনে নিয়ে এসেছে। আজকে আমাদেরকে সাগরে ফেলে দিয়ে বলা হচ্ছে ‘এই দড়ি দিয়ে তুমি ওপরে ওঠ’। আমার কথা হচ্ছে সাগরে কেন ফেলে দেবে। ১৮ মাস আগে এই উদ্যোগ নিলে তো এ সংকট থাকে না। আমাদের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুতের কোন দরকার নেই। এর ইতিহাস বলছে, এগুলো আজ ৫ মেগাওয়াট উৎপাদন করলে কাল ২ মেগাওয়াট উৎপাদন করে। কারণ সব পুরনো, বাতিল যন্ত্রপাতি এনে জনগণকে ধোঁকা দেয়া হয়। কম্বাইন্ড সাইকেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়ে ১ টাকা ৩০ পয়সা, ওপেন সাইকেলে ১ টাকা ৪০ পয়সা এবং কাপ্তাই জল বিদ্যুতে পড়ে মাত্র ২৫ পয়সা। সরকার কোন যুক্তিতে ১৬ টাকায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা অপব্যয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে আমি তা ভেবে পাই না।

তাছাড়া এই ফার্নেস তেল ও ডিজেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে যে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে তার জন্য কে দায়ী হবে? সরকার যদি বিদ্যুৎ খাতের উন্নতির জন্য কিছু করতেই চাইত, তাহলে এই ভাড়াভিত্তিক প্রকল্পে যেত না। অনেকে বলছে, ৯ টাকা হলেও সরকার বিদ্যুৎ তো দেবে। প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মুসার মত একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি একদিন টক শোতে খুশি মনে বলেছেন, ‘দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুতের উদ্যোগ নিয়ে সরকার একটা ভাল কাজ করেছে। সরকার একটা কাজের কাজ করছে’। সরকারও এই জিনিসটাই চাচ্ছে! লোকজন যেন কৃত্রিম সংকটকে বুঝতে না পারে, এভাবে এসব ক্ষতিকর উদ্যোগের প্রশংসা করে। এজন্যই সরকার বিদ্যুৎ সংকটকে ইচ্ছে করে জিইয়ে রেখে জনগণকে যন্ত্রণার শেষ সীমানায় নিয়ে গিয়ে এখন তড়িঘড়ি করে মানুষের সমর্থন আদায় করার কৌশল করে এ অবৈধ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার পদক্ষেপ নিচ্ছে।

সরকার কোনরকম দরপত্র ছাড়াই কেবল সমঝোতা করে বিভিন্ন কোম্পানিকে এ পর্যন্ত ১১৪৭ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে। সরকার বলছে দরপত্রের মাধ্যমে অনুমোদন দিতে গেলে দীর্ঘ সময় লেগে যায়, এজন্যই দরপত্র ছাড়াই অনুমোদন দেয়া হয়েছে . . .

আমরা বলেছি সরকার দরপত্রের এই দীর্ঘসূিত্রতা বাদ দিয়ে দিক। রাষ্ট্রীয় জরুরি বিবেচনায় মালয়েশিয়ার মত একই ধরনের উদ্যোগ আমরাও নিতে পারতাম। মাহাথির মোহাম্মদ সব সাংবাদিক, ঠিকাদার, বিতরণকারী ও মন্ত্রীসভা ডেকে প্রকাশ্যে দরপত্র আহবান করত। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দামের প্রস্তাব করা হত। যারা সবচেয়ে কম দামে রাজি হত তাদেরকে কাজ দেয়া হত। তখন সবার সামনে লিখা হত অমুক এই কাজটা এত দামে করবে। এই কোম্পানির এই এই সক্ষমতা আছে। এভাবে করলে দরপত্রের দীর্ঘসূত্রিতা বা দুর্নীতির কোন সুযোগ থাকে না। আমাদের এখানে এরকম পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ভূমিকা পালন করতে পারতেন। কাজেই ইচ্ছা করলেই সরকার দরপত্রের এই প্রক্রিয়াকে সহজ করতে পারে।

সব সরকারের আমলেই প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কি বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন না?

স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এই খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়ার জন্য। যদি তাই হয় তাহলে প্রয়োজন ছিল প্রতি মাসে দু তিনবার সভা আহবান করে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে আমরা অধিকাংশ সময়ই জরুরিভাবে সভা বা আলোচনা করতে দেখি নি। তার অতি ব্যস্ততা হয়ত এর কারণ হতে পারে। এ সমস্যাসংকুল ও স্পর্শকাতর খাতের সংকট এড়ানোর জন্য তাদের থেকে বিদ্যুৎ খাত নিয়মিত পরামর্শ পাচ্ছে না। তাহলে কি এটাই প্রমাণিত হয় না যে, বিদ্যুৎ খাতে তাদেরকে ব্যবহার করে সুযোগ সন্ধানীরা দুর্নীতির আশ্রয় ও সুযোগ নিচ্ছে। যেহেতু স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন, সুযোগ সন্ধানীর দুর্নীতিবাজদের মওকা মারার এটাই বড় সুযোগ।

এছাড়া অধিকাংশ প্রকল্পে দেখা গেছে ৫-৬ বার পর্যন্ত দরপত্র আহবান করা হত। আমরা প্রকল্পের যাবতীয় বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন ঠিকঠাক করে মন্ত্রীপরিষদে বা একনেকে পাঠাতাম। কিন্তু সেখানে অনেক প্রকল্প বাতিল করে দেয়া হত অথবা পুনর্মূল্যায়নের জন্য ফেরত পাঠানো হত। পুনরায় ঠিকঠাক করে পাঠালে আবার পুনর্মূল্যায়নের জন্য ফেরত পাঠানো হত। এভাবে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হত। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ মন্ত্রী হিসেবে এগিয়ে এসে বলতে পারতেন আসলে সমস্যা কোথায়? কিন্তু এরকম কোন উদ্যোগই প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কখনও নেয়া হয় নি। অন্য কেউ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে থাকলে নিশ্চয়ই তিনি এগিয়ে আসতেন।

বর্তমান সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ২০১১ সালে পিডিবিকে ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনতে হবে বেসরকারি খাত থেকে। এরফলে রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পিডিবি পরিণত হবে বিদ্যুৎ কেনাবেচার প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু এর বিপরীতে রাষ্ট্রীয় শক্তিশালী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিডিবিকে দাঁড় করানোর আর কোন সম্ভাবনা নাই?

আমি মনে করি আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল পিডিবিকে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। আর সেটা এখনও সম্ভব। কিন্তু পিডিবিকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে দাঁড় করানোর সরকারের কোন দৃষ্টিভঙ্গি নেই। সরকার পিডিবির জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে পারছে না, কিন্তু ৩০০ কোটি টাকা লোন নিয়ে বিদেশী কোম্পানির জন্য বরাদ্দ দিচ্ছে। সেই লোনের ভার পড়ছে জনগণের ওপর। এটা বিশ্বব্যাংকেরও নীতির অংশ যে, পিডিবির জন্য টাকা বরাদ্দ দেয়া যাবে না। বাপেক্স ও পেট্রোবাংলার ক্ষেত্রেও একই নীতি অবলস্বন করা হচ্ছে। পিডিবি দক্ষ প্রকৌশলীদের একটা সংস্থা। বিভিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলা মেইনটেন্যান্স করতে বিদেশী প্রকৌশলীরা যেখানে ব্যর্থ হয়েছে সেখানে পিডিবির প্রকৌশলীরা সফল হয়েছে। আমরা যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র মেরামত করেছি বিদেশী প্রকৌশলীরা বলেছে ওসব লাইন চালানো যাবে না। পিডিবির অনেক বেশি সক্ষমতা আছে। প্রশ্ন হচ্ছে কোন ধরনের সরকারের অধীনে পিডিবির মত সংস্থাগুলো চলছে? যদি আজকে দেশপ্রেমিক সরকার আসে তাহলে দেখা যাবে দু বছরের মধ্যে পিডিবি একটি সফল সংস্থায় পরিণত হবে।

পাওয়ার সেল কি উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল? লক্ষ্য অর্জনে এটি কতটুকু সফল আপনার বিবেচনায়?

পাওয়ার সেল গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে বিশ্বব্যাংক। পাওয়ার সেল তৈরির ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক আমাদেরকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, আমাদেরকে সামনে ঠেলে দিয়ে পর্দার অন্তরালে থেকে কলকাঠি নেড়েছিল। পরবর্তীতে আমরা বুঝতে পেরেছি, এর উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যুৎ খাতকে ভেঙ্গে একে বেসরকারিকরণের পথ প্রশস্ত করা। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৯৯৬ সালে পাওয়ার সেল গঠন করা হয়। আমি ১৯৯৬ ইংরেজি সালে প্রথমে এতে একজন পরিচালক হিসেবে যোগদান করি। এ খাত উন্নয়নের অনেক আশা নিয়ে যোগদান করি। বিশ্বব্যাংক এটি গঠনের মাধ্যমে পিডিবি এবং ডেসার মত বড় সংস্থাগুলো ভেঙ্গে এদের ক্ষমতা একদম কমিয়ে দেয়। সুতরাং এদিক থেকে বিশ্বব্যাংক সফল হয়েছে। অন্যদিকে সরকার হয়ত ভেবেছিল পাওয়ার সেল গঠিত হলে বিদ্যুৎ খাতের সংস্কার হবে, সিস্টেম লস কমে যাবে এবং সবখানে স্বচ্ছতা আনা যাবে। কিন্তু এই উদ্দেশ্যও সফল হয় নাই।

এখন পাওয়ার সেলের কি অবস্থা?

এখন পাওয়ার সেলের খুবই খারাপ অবস্থা। বিদ্যুৎ খাত তো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে তাই পাওয়ার সেলের আর কোন কাজ নেই। আগে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালকের কমান্ডিং ক্ষমতা ছিল। আমি যখন মহাপরিচালক ছিলাম তখন উপলব্ধি করতাম, বিদ্যুৎ খাতের স্টিয়ারিং হুইলে বসে কাজের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করতে পারছি। যদিও বিশ্বব্যাংক ও ঔপনিবেশিক আমলের ধাঁচে গড়া আমলাতন্ত্র, যা আজও বাংলাদেশকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, তা কখনও বাস্তবায়ন করতে দেয় নি। আর এখন পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক হল পিডিবির চেয়ারম্যানের একজন সদস্য, তার অধীনস্ত একজন কর্মকর্তা।

সিস্টেম লসের কারণে প্রতিদিন প্রায় ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লোকসান হচ্ছে। এই লোকসান কমানো যায় কিভাবে?

প্রথমে সিস্টেম লস কিভাবে হয় তা বুঝা দরকার। প্রথমত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের লস হল গড়ে ১.৫%। ট্রান্সমিশন লাইনে লস হয় গড়পড়তা ২%। ট্রান্সমিশন পর্যন্ত এই ৩.৫% লস কিন্তু হবেই। এটা চুরি নয়। গ্রিড সাবস্টেশন থেকে আবার ৩৩,০০০ ভোল্টেজ এর মাধ্যমে আরইবিসহ সব বিতরণ কোম্পানিকে দেয়া হয়। এখানে লস হয় আরও ২%। তারপর সরাসরি গ্রাহককে দেয়ার আগে যে তার দিয়ে দেয়া হয় সেখানে আবার ৬% লস হয়। এই ১১.৫% থেকে ১২% হল আমাদের প্রকৃত কারিগরি লোকসান।

আমার নেতৃত্বে বর্তমান পিডিবির চেয়ারম্যানসহ আমরা একটা টিম কেনিয়া ও নেপাল গিয়েছিলাম এ বিষয়টির তুলনা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। আমরা সেখানে ৯-১০% এর বেশি সিস্টেম লস দেখি নি। এছাড়া আমরা বাংলাদেশের ২২ টি জায়গায় অনুসন্ধান চালিয়ে কোথাও ৮-৯% এর বেশি সিস্টেম লস হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পাই নি। টেকনিক্যাল লস হয় সর্বাধিক ১০-১২% অথচ আজকে বাংলাদেশে সিস্টেম লস হচ্ছে ২২%। তাহলে ১০% চুরি হচ্ছে। এই চুরি কে করছে বিভিন্ন সংস্থায় নিয়োজিত মিটার রিডার প্রকৌশলী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এভাবে প্রায় ৪০০ মেগাওয়াট সিস্টেম লস হচ্ছে। বিদ্যুৎ সংস্থাগুলায় ১০০ টাকার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ২৪২ টাকায় কেনার মাধ্যমে আরেক ধরনের সিস্টেম লস হয়। এটা হল মহাচুরি। এটার কমিশন নিয়ে সবাই ব্যস্ত থাকে। আমার অনেক আগের একটা হিসেবে দেখিয়েছি, সিস্টেম লসের কারণে বছরে দেশের ক্ষতি হচ্ছে ৮০০ কোটি টাকা। বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থায় এক ইউনিট বিদ্যুৎ ঘাটতি হলে যে পরিমাণ উৎপাদন হ্রাস পায় তার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ৩২ টাকা। ২০০৬ সালের এক হিসেবে দেখা গেছে, ৫শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি হলে সে কারণে প্রতিবছর উৎপাদন কমে ৮ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। এভাবে গত ৫ বছরে কমপক্ষে ১ লক্ষ হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে।

ইনডিয়া থেকে বিদ্যুৎ আমদানির সরকারি পরিকল্পনাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

সরকারের এই পরিকল্পনা ইনডিয়ার কাছে একটা নতজানু এবং আর্থিক ঔপনিবেশিকতার চূড়ান্ত নিদর্শন। তাছাড়া ইনডিয়া বাংলাদেশকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিতে যাবে কেন তা আমার বুঝে আসছে না। ইনডিয়ার নিজেরই রয়েছে বিদ্যুৎ সংকট। তার চাহিদা হল ১ লক্ষ ৯০ হাজার মেগাওয়াট এবং উৎপাদন হচ্ছে ১ লক্ষ ৪০ হাজার মেগাওয়াট। সুতরাং বিদ্যুৎ ঘাটতি হল ৫০ হাজার মেগাওয়াট। আগামী দু এক বছরের মধ্যে ইনডিয়ার বিদ্যুৎ চাহিদা দাঁড়াবে ২ লক্ষ ৫০ হাজার মেগাওয়াট।

৫০০ মেগাওয়াটের জন্য ট্রান্সমিশন লাইন বানাতে বাংলাদেশের খরচ হত ৩০০ কোটি টাকা। কিন্তু ইনডিয়ার হিসেব অনুযায়ী খরচ হবে ১,১০০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে অবকাঠামো তৈরি বাবদ ইনডিয়া বাংলাদেশের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৮০০ কোটি বেশি আদায় করে নিয়ে যাবে। যদিও ইনডিয়া এই ট্রান্সমিশন লাইন নির্মাণের জন্য ঋণ দেবে কিন্তু বাংলাদেশকে উচ্চহারে তার সুদ পরিশোধ করতে হবে। এর মাধ্যমে ইনডিয়ার একটা ব্যাংকের ব্যবসা হচ্ছে। এই লাইন বানানোর জন্য ইনডিয়া থেকেই মালামাল আনতে হবে। সুতরাং এখানেও আরেকটা ব্যবসা হবে ইনডিয়ার। এই ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য যে ১,১০০ কোটি টাকা খরচ হবে তা দিয়ে বাংলাদেশ নিজেই ৫০০ মেগাওয়াটের একটা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে পারত। আর বিদ্যুৎ আমদানির জন্য খসড়া চুক্তিতে যেসব শর্তের কথা শুনলাম তাতে ইনডিয়ার স্বার্থই বেশি সংরক্ষিত থাকবে। বিল নির্ধারণ ও বকেয়া পড়লে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা ইত্যাদি ক্ষমতা ইনডিয়ান বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রক সংস্থার হাতে দেওয়ার প্রস্তাব রাখায় বাংলাদেশ অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়তে পারে।

আমাদের সাথে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।

আপনাদেরও ধন্যবাদ।

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।