ইন্ডিয়া থিকা হুমায়ূন আহমেদ


[হুমায়ূন আহমেদ সম্প্রতি গত হয়েছেন। তার জনপ্রিয়তা অনস্বীকার্য, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর অপরিসীম উৎসাহ এবং একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থকদের পক্ষপাত। অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুর আগে হুমায়ূন শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘দেয়াল’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন। কথাকার হিশাবে হুমায়ূন গণমাধ্যমের যে বিপুল সমর্থন ও প্রচার পেয়েছেন তার কণামাত্রও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কপালে জোটে নি। এই তথ্য তুলনার জন্য নয়, বরং হুমায়ূনের সাহিত্যিক ও নান্দনিক বিচারের চেয়েও একটি জনগোষ্ঠির বিশেষ সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক লক্ষণ বোঝার জন্য এই তুলনা মনে রাখা জরুরী। এর সুবিধা হচ্ছে সাহিত্যিক, নাট্যকার কিম্বা ছবিওয়ালাদের সমাজ ও রাজনীতির আরও বড় পরিসরে বিচার করবার প্রয়োজনীয়তাটা আমরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হব। আর, সেটাই যেন বাংলাদেশে এখন প্রধান হয়ে উঠেছে, কিম্বা উঠতে বাধ্য।

 বলাবাহুল্য, হুমায়ূনকে নিয়ে বাংলাদেশে লেখালিখি হচ্ছে খুব। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশের কাছে হূমায়ূনের যে গুরুত্ব পশ্চিম বাংলার পাঠকদের কাছে তার গুরুত্ব সমান নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অভিযোগ করেছেন কলকাতার পত্রপত্রিকায় হুমায়ুনের মৃত্যু তেমন গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয় নি। অবশ্য বাংলাদেশের কবিতা, সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক, চিত্রকলা ইত্যাদি – অর্থাৎ সামগ্রিক অর্থে বাংলাদেশের সংস্কৃতি কলকাতার ওপর নির্ভরশীল নয় আর। হয়তো বাংলাদেশ একটা স্বাধীন দেশ বলেই নিজের ভঙ্গী নিয়ে নিজেই দ্রুত দাঁড়িয়ে যাচ্ছে – ভাবনায় ও ভাষায়, প্রকাশে ও সংকল্পে। নিজের হাজার সমস্যা ও সংকটের বোঝা কাঁধে চেপে বসে থাকবার পরেও সেটা ঘটছে। এর প্রভাব নিশ্চয়ই পড়বে দুই দেশের বাংলাভাষীদের মধ্যে। তবে সেটা মন্দ নাকি ভাল ফল নিয়ে হাজির হবে সেটা নির্ভর করবে পরস্পরের প্রতি আমাদের আগ্রহের মাত্রা ও পরস্পরকে বুঝবার আন্তরিকতার ওপর।

 এই দিক থেকে হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে কবি সৌম্য দাশগুপ্তের একটি পুরানা লেখা, আমাদের ধারণা, পাঠকের কাজে আসবে। সম্ভবত লেখাটি ২০০৩-৪ সালের দিকে ‘পড়শি’ নামক একটি কাগজে ছাপা হয়েছিল। কবি সৌম্য দাশগুপ্ত ‘অগ্রবীজ’ পত্রিকার সম্পাদক। দুই দেশের বাংলাভাষীদের মধ্যে সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে তিনি দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছেন এবং তাকে যতোটুকু জানি, সেটা কোন রোমাণ্টিক বা অবাস্তব বাঙালিপনার জায়গা থেকে নয়, বরং গোলকায়নের এই কালে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের সাধারণ কোন স্বার্থ আছে কিনা তা চিহ্ণিত করবার তাগিদে দুই দেশের মানুষের ইতিহাস সম্যক পর্যালোচনা ও উপলব্ধির জায়গা থেকে।

এই দিক থেকে লেখাটি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। আবার পড়াবার তাগিদ এই কারনেই। ]

ইন্ডিয়া থিকা হুমায়ূন আহমেদ

আমার বাংলাদেশের বন্ধুরা ভারতকে কোনো অজ্ঞাত কারণে ইন্ডিয়া বলেন, কলকাতাকে ‘ক্যালকাটা’।  প্রথম আলাপ হওয়ার পর কথাবার্তা শুনে বলেন, আপনি ইন্ডিয়ান বাংগালি, না? তারপর, ‘কোত্ থিকা? ক্যালকাটার থিকা?’ আমি বলি ভাই, আমি বাঙালি। বাংগালি না। ঙ আর ঙ্গ-র মধ্যে বিরাট প্রভেদ ভাই। শুধু ঙ লাগিয়ে দেখেন, মধুর লাগে। আমরা মধুর মধুর বংশী বাজিয়ে আর শুনেই অভ্যস্ত। মুক্তিযুদ্ধের আগে জানতাম না যে আমাদের একটা সামুরাই সত্ত্বাও আছে। আসলে আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি, তার মানুষকে ভালোবাসি। আমার কোনো ধর্মবিশ্বাস নেই। তবে ভাষাবিশ্বাস আছে। আমাদের ইন্ডিয়ায় নতুন প্রজন্মে বাংলা ভাষার দুঃখিনী অবস্থা। বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধারা বাঁচিয়ে দিয়েছেন ভাষাটাকে। রক্ত দিয়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমি থাকি ক্যালিফোর্নিয়া, জন্ম ভারতে, বাপমা সেযুগের পূব-বাংলা থেকে ৪৭-৪৮ সালে ‘ক্যালকাটায় মুভ’ করেছিলেন। মানে, করানো হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষকে এদিক থেকে ওদিক, ওদিক থেকে এদিক রাজনৈতিক নেতারা ধাক্কা দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। তার জন্য এতকাল পর প্রতিবেশী দেশের মানুষের মধ্যে প্যার মহব্বতের কোনো খামতি থাকার কথা না। কিন্তু রাজনৈতিক এবং কিছুটা ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে খামতি হয়েছে। ইদানীং আবার দেখি জোড় লাগছে। সর্বস্তরে না হলেও, লাগছে। গান, বাজনা, নাটক, লেখালেখি নিয়ে আস্তে আস্তে যোগাযোগ বাড়ছে।

ভণিতা সেরে এবার হুমায়ূন আহমেদের কথায় আসি।

সম্প্রতি ইন্ডিয়ান বাঙালি ঠাসা ই-ক্লাবগুলিতে হুমায়ূন আহমেদ একটা আড্ডার বিষয়। জনাব নাজমূল হুদাসাহেবকে নিয়ে হুমায়ুন আহমেদের একটি মর্মস্পর্শী কলাম প্রথম আলো কাগজে বেরিয়েছে। ছোট্ট কলাম। ভাসিয়ে দেওয়া। সেটা নিয়ে হাউকাউ হয়েছে। একটু হাউকাউ। বেশি না। (দেখলেন, হুমায়ুন আহমেদের স্টাইল মেরে দিলাম!) গত কয়েকবছর ধরে কলকাতা থেকে প্রকাশিত পূজোসংখ্যাগুলিতে তাঁর কয়েকটা উপন্যাস প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। প্রতিভাস প্রকাশনার মালিক বীজেশ সাহা কয়েক বছর ধরে একচেটিয়া হুমায়ুন আহমেদের বই প্রকাশ করে স্বপড়ব দেখেছেন খুব বিধি করবেন। কিন্তু নানা কারণে যেমনটা ভেবেছিলেন, হয়নি। কিছু কিছু ইন্ডিয়ান বাসায় আটের দশকের শেষ দিকে মানুষ অ্যান্টেনায় বুস্টার লাগিয়ে বিটিভি দেখতেন, তাদের কাছে হুমায়ুনের নাম ততটা অপরিচিত নয়। কিন্তু এরপরও অত ব্যাপক জনপ্রিয়তা তৈরি হয়নি তাঁর, যতটা বাংলাদেশে আছে। বাংলাদেশের সবাই তাঁকে চেনে, এখন আর তাঁকে নিয়ে বেশি হাউকাউ হয়না। তবে দেশকালের সীমানা ছাড়াতে সময় লাগে, তাই

এখনও ইন্ডিয়ানদের কারো কারো কাছে তিনি খুব ইন্টারেস্টিং টপিক।

আমার পড়ার অভ্যেস বেশ এলোমেলো। দেবেশ রায় বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আমি দারুণ উপভোগ করি, আমাকে প্রাণিত করেন তাঁরা। আমি এমন কথাও অন্যত্র বলেছি যে এই দুই মহাশক্তিশালী গদ্যকার আধুনিক বাংলা সাহিত্যের মাইলফলক। বছর ছয়েক আগে এইসব নিয়ে খানিক আড্ডার পর একদিন দেখি আমার প্রয়াত পিতা প্রেসিডেন্সি কলেজের বিএ টিউিটোরিয়াল ক্লাসে আর যাদবপুরের এমএ ক্লাসে এঁদের দু’জনকে পড়াতে শুরু করে দিয়েছেন।

উল্টোদিকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা হুমায়ূন আহমেদ পড়ামাত্রই যে আমার বিরক্তি উৎপাদন হয় সে কথাও বলবো না। উন্নাসিকজনে  নাক সিঁটকোলে কিছু মনে করবো না। দু’জনের একটা চমৎকার মিল -গদ্যভাষা এতো প্রাঞ্জল আর ঝরঝরে যে ভারি আরাম হয়। আরাম হতে হতে প্রাণ জলও হয়ে যায়, আবার এটাও মনে হতে থাকে যে এইসব বেশিদিন টিকবে না, ঝরঝরে ভাষার মতোই ঝর ঝর করে ঝরেও পড়ে যেতে পারে একদিন। তার মূল কারণটা ভাষা নয় অবশ্য, সেটা বেশির ভাগ লেখাতে বিষয়ের গভীরতার অভাব।


জনশ্রুতি বলে যে, অতি শক্তিশালী নাট্যকার, কবি ও গদ্যকার সৈয়দ শামসুল হক কোনো আড্ডায় একবার বলেছিলেন যে, “হুমায়ূনের লেখা হইতেছে লুঙ্গির মতো; পইরা আরাম, কিন্তু বাসার ভিত্রে থাকা যায়, বাইরে যাওন যায় না।” অংশত হলেও কথাটা মিথ্যে নয়। গড়ে ৪০ মিনিটের বেশি সময় লাগে না তাঁর একেকটা ১০০ টাকা (বাংলাদেশী মুদ্রায়) দামের উপন্যাস পড়তে। কিন্তু তাই বলে এমনটা হয়নি যে তাঁর উপন্যাস পড়তে পড়তে মাঝপথে উৎসাহ হারিয়ে সরিয়ে রেখেছি। টেনে রাখে।


সুনীল তো সুনীল, এপার বাংলার সবাই তাঁর নাড়িনক্ষত্র জানে, মিডিয়াও বহুদূর নিয়ে গেছে তাঁকে, কিন্তু তাঁর যে গুণটা আমার ভালো লাগে সেটা হলো উদারতা, বিশেষ করে অসাম্প্রদায়িকতা। নীললোহিত বা সুনীলের ব্যক্তিগত বক্তব্য অনেক সময় একলা চলো রে-র মুহূর্তগুলিতে বেশ উৎসাহ দিয়েছে আমাকে। একইভাবে হুমায়ুন আহমেদের লেখাতেও আর কিছু থাক না থাক, বিরাট ঔদার্য আছে। তার চরিত্রগুলো আমাদের খুব প্রিয়, তাদের ‘একসেন্ট্রিসিটি’-র জন্য।

জনশ্রুতি বলে যে, অতি শক্তিশালী নাট্যকার, কবি ও গদ্যকার সৈয়দ শামসুল হক কোনো আড্ডায় একবার বলেছিলেন যে, “হুমায়ূনের লেখা হইতেছে লুঙ্গির মতো; পইরা আরাম, কিন্তু বাসার ভিত্রে থাকা যায়, বাইরে যাওন যায় না।” অংশত হলেও কথাটা মিথ্যে নয়। গড়ে ৪০ মিনিটের বেশি সময় লাগে না তাঁর একেকটা ১০০ টাকা (বাংলাদেশী মুদ্রায়) দামের উপন্যাস পড়তে। কিন্তু তাই বলে এমনটা হয়নি যে তাঁর উপন্যাস পড়তে পড়তে মাঝপথে উৎসাহ হারিয়ে সরিয়ে রেখেছি। টেনে রাখে।

আন্তর্জাতিক সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদের লেখা নিয়ে কতোটা আলোচনা হবে জানি না, কিন্তু হুমায়ূন কী অসাধ্য সাধন করেছেন সেটা ইন্ডিয়ান পাঠকদের একটু বলা দরকার মনে করি। বাংলাদেশের সবাই এসব জানেন। এই লেখা হচ্ছে ইন্ডিয়ান পাঠকের জন্য হুমায়ুন আহমেদ ওয়ান ও ওয়ান (১০১)। ১০১ লেভেলের কোর্স পড়ানোর একটা ঘাপলা আছে। যারা কিছুই জানেনা তারা কিছু কিছু শেখে। কিন্তু যারা একটু একটু জানে তারা বেশি প্রশ্ন করে। শেখার জন্য না। দেখানোর জন্য। আর যারা বিরাট জানে তারা এক ঘর জ্ঞান নিয়ে ১০১ ক্লাসে ঢোকেনা। ভাই আপনারা যারা বিরাট জানেন, এই পর্যন্ত পইরা আমারে একটা খোদা হাফেজ দেন।

হুমায়ূন আহমেদ এবং তাঁর বিখ্যাত ভ্রাতা মুহম্মদ জাফর ইকবাল দু’জনেই অতি বাল্যকালে চোখের সামনে খানসেনাদের গুলিতে তাঁদের পিতাকে নিহত হতে দেখেছিলেন। তাঁদের পিতার চরিত্রটি কেমন ছিলো সেগুলো হুমায়ূনের প্রথম দিককার কয়েকটি গল্প-উপন্যাসে পাওয়া যায়। নির্ভেজাল ভালোমানুষ এবং বেশ খেয়ালী এই মানুষটির চরিত্র চিত্রণ পড়লে তাঁর সম্পর্কে একটা ভালোবাসা জন্মে যায়। কী একটা কারণে একবার বাড়িতে ঘোড়া কিনে নিয়ে এসেছিলেন। জাফর ইকবালের একটা মেঘদ্যুতিসম্পন্ন ছোটো গল্প আছে তাঁর পিতার মৃত্যুমুহূর্ত নিয়ে, নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত দৃষ্টান্ত কাগজে ১৯৯১ সালে বেরিয়েছিলো। সম্পাদক ছিলেন আর একজন ভালো গদ্যকার, মোল্লা বাহাউদ্দিন।

দুই ভাই মন দিয়ে লেখাপড়া শিখে অতি সফল শিক্ষাব্রতী হলেন। জাফর ইকবাল তো রীতিমতো পদার্থবিদ, বেল ল্যাব-এ কাজ করতেন, তাঁর তৈরি করা ম্যাকিনটশ-এর বাংলা ফন্ট সেই ১৯৯০-তে বাফেলোয় থাকাকালীন ব্যবহার করেছি। আর হুমায়ূন আহমেদ যে সাউথ ডাকোটা থেকে রসায়নে পিএইচডি করেছেন, সেসব গল্পও আমরা তাঁর নিজেরই উপন্যাস থেকে জানি। কীভাবে তাঁর স্ত্রী গুলতেকিন বেবিসিটিং করে সময় কাটাতেন, কীভাবে ওই স্বজনবিহীন উপশহরে একটি রেস্টুরেন্টে এক মন ভার করা সন্ধ্যাবেলা ওয়েট্রেসরা একটা ফ্রী ডিশ দিয়ে ওনার মন ভালো করে দিয়েছিলেন, সেসবও জানি।

দুই ভাই দীর্ঘকাল এদেশে থেকে বাংলাদেশে ফিরে গেলেন। এটা বলে দিতে হবে না যে জন্মভূমি দুই ভাইয়েরই অতি আদরের, বিবেকের কাছেও তাঁরা দেশের ব্যাপারে দায়বদ্ধ। এই দায়বদ্ধতা তাঁদের দু’জনের লেখাতেই হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো মাঝে মাঝে উঠে আসে। জাফর তো সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন হলেন, সেখান থেকে তিনি নিয়মিত অতি চমৎকার সব প্রবন্ধ ও কলাম লেখেন, দেশের শিক্ষা, রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা, মানবাধিকার ইত্যাকার বিষয়ে। এই বৈজ্ঞানিকসাহিত্যকের  কল্পবিজ্ঞান কাহিনী যাঁরা পড়েননি, তাঁরা পড়লে দেখবেন যে ঠিকঠাক পাণ্ডিত্য ও রসবোধের সাহায্যে কল্পবিজ্ঞান কোন পর্যায়ে যেতে পারে। কপোট্রনিক সুখদুঃখ যাঁরা পড়েননি, সংগ্রহ করে যত্ন করে পড়ুন।

হুমায়ূন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের রসায়ন বিভাগে অধ্যাপনায় যোগ দিলেন। বিশেষ লিখতেন না, একটি ছোটো কাগজে একবার একটা গল্প লিখে তিনি প্রয়াত মানবতাত্ত্বিক ও লেখক আহমদ ছফার চোখে পড়ে যান। গল্পে আছে যে হুমায়ূন আহমেদের ওই লেখাটি পড়েই উনি এতো তাড়িত হয়ে পড়েন যে রাস্তায় একদিন নিজের থেকে আলাপ করে বললেন, “তুমি হুমায়ূন? তোমার এই অসামান্য গল্পটির জন্য আমি তোমারে পুরস্কার দিতে চাই। আমার তো কিছু নাই, তোমারে আমি এই নাও এক টাকা দিলাম।” আজও নাকি হুমায়ূন আহমেদ স্বীকার করেন যে ওই এক টাকা তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার। এই একই

গল্প অবশ্য জাফর ইকবাল সম্পর্কেও শুনেছি। আহমেদ ছফাকে আমি ছফামামা বলতাম। ছফামামাকে মুক্তিযোদ্ধাদের মাজারে গোর দিতে দেয়নি। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের বিবেক ছিলেন। তিনি থাকলে জিজ্ঞেস করতাম মামা তোমার টোটাল কত খরচ হয়েছিলো। এক টাকা না দুটাকা।


আমার মনে হয় হুমায়ূন আহমেদ স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের জায়মান আর্থ-সামাজিক মনস্তত্ত্বটিক ঠিকঠাক ধরেছিলেন। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির থেকে তৈরি হওয়া নতুন জাতীয়তাবাদের মূল্যবোধ, মধ্যবিত্তের প্রাদুর্ভাব, শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক সেশনজটের থেকে হতাশা, অর্থনৈতিক বিচিত্রগামিতা ও মার্কিন নির্ভরশীলতা, ফাটকাবাজদের (বাংলাদেশে এদের “টাউট” বলা হয়) প্রাদুর্ভাব, রাজনৈতিক মাৎসান্যায়, এইসবের ভারে পীড়িত মধ্যবিত্ত সমাজ, যা বাংলাদেশে দ্রুত প্রসরণশীল, এদের মানসিক অবস্থাটা হুমায়ূন ধরতে পেরেছিলেন। কারণ তিনি নিজেই ওই সমাজের প্রতিনিধি। এবং লেখার সময় সোজাভাবে লিখেছেন, প্যাঁচ মারেননি।


উৎসাহ ও স্বীকৃতি পেয়ে লেখা শুরু হলো। হুমায়ূন কখনোই বিরাট সময় বিরাট মহাকাল বিরাট পৃথিবী বিরাট ও ক্ষুদ্র মানুষ এইসব পরিসর নিয়ে গুছিয়ে লিখতে বসেননি। সুতরাং তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নন, জগদীশ গুপ্ত হতে পারেননি, ইলিয়াস সাহেবের যুগান্তকারী গদ্যকৃতি ও মহৎ সাহিত্য তিনি লিখতে চেষ্টাও করেননি। কিন্তু তিনি উল্টোদিকে হ্যাডলি চেজ বা নিমাই ভট্টাচার্যও নন। বেশিরভাগ গল্পই বাংলাদেশের নানা শ্রেণীর মানুষকে নিয়ে লেখা, প্রায় লঘু ভাষায়, অনেকক্ষণ ধরে হাসান, হাসাতে হাসাতে গল্পের শেষে ক্যাঁক করে পাঠকের পেটে একটা লাথি কষান। তখন আবার দু'চোখের অশ্র“ সামলানো মুশকিল হয়ে যায়। এইসবই হলো যাত্রা থিয়োরি, যাত্রা ছাড়া বাঙালির পেট আজও ভরে না।

সুতরাং ওই “লুঙ্গি-আরাম”-এর মন্তব্যটা সত্য ছাড়া মিথ্যে নয়। তবু তো আরাম কিন্তু গত তিরিশ বছর ধরে এই “প্রলিফিক” লেখকের এই ধরনের লেখাগুলি একটা কাণ্ড করে বসে।

সাহিত্যের বই পড়ার একটা অনুপস্থিত অভ্যাসকে রাতারাতি দাঁড় করিয়ে দিলেন হুমায়ূন, বাংলাদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা পয়সা দিয়ে তাঁর বই কিনে পড়তে শুরু করলেন। চটুল বই কি আগে লেখা হতো না? মাসুদ রানা-র বইগুলিও তো ছিলো। কিন্তু তা নয়, হুমায়ূন নিচের তলার লোকজন থেকে শুরু করে ভদ্রলোকদের ঘরেও পৌঁছে গেলেন। কিংবা উল্টোদিকে বলা যেতে পারে ওপর থেকে নিচ সব জায়গাতেই একটা পাঠাভ্যাস শুরু হয়ে গেলো। এটা যে কতো বড়ো একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন, যাঁরা বাংলাদেশে বইয়ের ব্যবসা করেন তাঁরা জানেন।

আমার মনে হয় হুমায়ূন আহমেদ স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের জায়মান আর্থ-সামাজিক মনস্তত্ত্বটিক ঠিকঠাক ধরেছিলেন। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির থেকে তৈরি হওয়া নতুন জাতীয়তাবাদের মূল্যবোধ, মধ্যবিত্তের প্রাদুর্ভাব, শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক সেশনজটের থেকে হতাশা, অর্থনৈতিক বিচিত্রগামিতা ও মার্কিন নির্ভরশীলতা, ফাটকাবাজদের (বাংলাদেশে এদের “টাউট” বলা হয়) প্রাদুর্ভাব, রাজনৈতিক মাৎসান্যায়, এইসবের ভারে পীড়িত মধ্যবিত্ত সমাজ, যা বাংলাদেশে দ্রুত প্রসরণশীল, এদের মানসিক অবস্থাটা হুমায়ূন ধরতে পেরেছিলেন। কারণ তিনি নিজেই ওই সমাজের প্রতিনিধি। এবং লেখার সময় সোজাভাবে লিখেছেন, প্যাঁচ মারেননি।


হুমায়ূন কখনোই বিরাট সময় বিরাট মহাকাল বিরাট পৃথিবী বিরাট ও ক্ষুদ্র মানুষ এইসব পরিসর নিয়ে গুছিয়ে লিখতে বসেননি। সুতরাং তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নন, জগদীশ গুপ্ত হতে পারেননি, ইলিয়াস সাহেবের যুগান্তকারী গদ্যকৃতি ও মহৎ সাহিত্য তিনি লিখতে চেষ্টাও করেননি। কিন্তু তিনি উল্টোদিকে হ্যাডলি চেজ বা নিমাই ভট্টাচার্যও নন। বেশিরভাগ গল্পই বাংলাদেশের নানা শ্রেণীর মানুষকে নিয়ে লেখা, প্রায় লঘু ভাষায়, অনেকক্ষণ ধরে হাসান, হাসাতে হাসাতে গল্পের শেষে ক্যাঁক করে পাঠকের পেটে একটা লাথি কষান। তখন আবার দু'চোখের অশ্র“ সামলানো মুশকিল হয়ে যায়। এইসবই হলো যাত্রা থিয়োরি, যাত্রা ছাড়া বাঙালির পেট আজও ভরে না।


এরপর আটের দশকের প্রথমদিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাটকের জগতে হুমায়ূন আহমেদ ব্যাপক বিপ্লব ঘটিয়ে দিলেন। এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, নক্ষত্রের রাত, আজ রবিবার ইত্যাদি টেলি-সিরিয়ালের

গল্পকার, স্ক্রিপ্ট-লেখক, কখনো নির্দেশকও তিনি। এগুলি ব্যাপকহারে মিডিয়া ধরে জনপ্রিয়তা পায় একটি সিরিয়ালে বাকের বলে একটি অতি বিবেকবান সমাজবিরোধীর ফাঁসির ঘোষণা হওয়ার এপিসোডের পরে ঢাকা শহরে একটি মহামিছিল বেরিয়েছিলো ফাঁসি রদ করার জন্য। হুমায়ূন অবশ্য ফাঁসি রদ করেননি। ফাঁসি দিয়েছিলেন পরের এপিসোডেই। বলেছিলেন, আসলে এইরকমই হয়ে থাকে। সেই বাকের রোলটা করে তো আসাদুজ্জামান নূর বাঙালির ঘরের লোক হয়ে গেলেন।

হুমায়ূন এখন এলি তেলি লেখেন, ফাজলামো ধরনের লেখা, অতি বাজে কয়েকটা ছবি করেছেন, বেশিরভাগ নতুন লেখা স্রেফ পয়সা বানানোর জন্য লেখেন সেটা বেশ বোঝা যায়। পয়সা করে করে চট্টগ্রামের কাছে সেন্ট মার্টিন-এ একটা দ্বীপও কিনে ফেলেছেন, সেখানে বাংলাদেশের ও পশ্চিমবঙ্গের গ্লামারওয়ালা লেখক-টেখকদের, অভিনেতাদের সম্মান করে নিয়ে যাওয়া হয় ফূর্তি করতে। এতো পয়সা যে সমরেশ মজুমদার তো ডালাসে আমাদের সাহিত্য সম্মেলনে ১৯৯৯ সালে আমার এক বন্ধুকে বলেই ফেললেন, “আচ্ছা, আমি কি খারাপ লিখি? তাহলে হুমায়ূনের এতো পয়সা হয় কী করে বলতে পারো?”

কীভাবে হয় সেটার কারণ তো বললাম। ১০০ টাকার একটা বই ১ লক্ষ কপি বিক্রি হয়। একটা টেলি-সিরিয়াল থেকে কোটি কোটি টাকা আসে। উনি অসৎ পথে বানিয়েছেন বলে মনে হয় না। ফুরফুরে লেখা, ফুরফুরে ছবি, ফুরফুরে টাকা।

কিন্তু মাঝে মাঝে আমি হুমায়ূন আহমেদের পুরনো লেখাগুলি নিয়ে বসি। নাড়াচাড়া করি। করতে করতে আমার কান্না পেয়ে যায়।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।