দুর্নীতি বিরোধিতার তত্ত্ব পাল্টিয়ে সুশীলদের হাসিনা রক্ষার রাজনীতি


বাংলাদেশের সঙ্গে পদ্মাসেতু প্রকল্প চুক্তি বিশ্বব্যাংক বাতিল করায় বিশ্বব্যাংক নিয়ে তর্ক উঠেছে। বিতর্ক নানান দিক থেকে জমে উঠেছে। অন্যান্য তর্কের তুলনায় 'সুশাসনের' প্রবক্তা 'সুশীল সমাজ' কী অবস্থান নিল তার আলাদা গুরুত্ব আছে। মনে হচ্ছে তারা বড়ই অস্বস্তি আর বিপদে আছে। এই তর্ক তাদের তাদের ইজ্জত ও সম্মান একেবারে ছেড়াব্যাড়া করে ছেড়েছে। অবস্থা হয়েছে দশহাত শাড়ির মত, একদিক ঢাকতে গেলে আরেক দিক উদোম হয়ে পড়ে। এই এক দুর্দশা। শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে গেলে তাদের দুর্নীতিবিরোধী নীতি ও তত্ত্ব যায়, তবু শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে তারা তাদের তত্ত্বই বদলাচ্ছে।

বাংলাদেশে ২০০৪ সাল থেকে এক বগলে দুর্নীতি উৎপাটন আর অপর বগলে তথাকথিত সুশাসনের কথা তুলে সুশীল সমাজ মাঠে নেমে পড়েছিল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এদের 'জিহাদ' মনে রাখবার মত ছিল। দুর্নীতি বিরোধিতার নামে নানান প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে নেমে পড়েছিল তারা। তার মধ্যে দাপুটে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারনাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবির ভূমিকা বিখ্যাত। টিআইবির দুর্নীতির বিরুদ্ধে 'জিহাদ', সিপিডির সৎপ্রার্থী আন্দোলন, বিশ্বব্যাংকের প্রোগ্রাম আর এডিবির ফান্ডে 'দুর্নীতি বিরোধি অভিযান' কর্মসুচী্র সাথে ডেইলি স্টার আর প্রথম আলো গ্রুপের মিডিয়া প্রচারণার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল 'রেজিম চেঞ্জ'। আর, ঘটনা ঘটেছিলও তাই। সেনাবাহিনীকে চাপ দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে বাধ্য করে দুবছরের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংবিধান বহির্ভূতভাবে ক্ষমতা চালানো - কিছুই বাদ রাখেনি এরা। তখন আওয়ামি লীগ ক্ষমতায় ছিল না, ছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট। দুর্নীতি বিরোধী এই জিহাদে দুর্নীতিগ্রস্ত খালেদা জিয়ার সরকারকে নাস্তানাবুদ করতে সক্ষম হয়েছিল তারা। অথচ আজ তারা বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারকে বাঁচাতে গিয়ে খোদ বিশ্বব্যাংককেই দুর্নীতির প্রতিষ্ঠান বলছে। বলতে চাচ্ছেন এমন যেন, বিশ্বব্যাংক নিজে যেহেতু দুর্নীতিগ্রস্ত অতএব শেখ হাসিনার সরকারের দুর্নীতি নিয়ে তাদের সন্দিহান হবার কোন অধিকার সুযোগ নাই।

তবে এখন এদের মজার তামাশাটা হোল দুর্নীতি সম্পর্কে তারা তত্ত্ব পাল্টিয়েছে। নতুন তত্ত্ব হচ্ছে বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে দুর্নীতি থাকবে। এর উচ্ছেদ ঘটানো কঠিন। দুর্নীতি চিন দেশে আছে, ভারতেও আছে। অতএব সুশাসন ও দুর্নীতিবিরোধিতার চেয়েও আমাদের জন্য জরুরী হচ্ছে উন্নয়ন। সুশীল সমাজের তরফে এই তত্ত্বটা মোটামুটি গুছিয়ে পেশ করেছেন অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন। সম্প্রতি (২১ জুলাই ২০১২) বিনায়ক সেনের এক সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে তৈরী করা তাঁর নামে একটি ‘নিবন্ধ’ প্রকাশিত হয়েছে "বণিককবার্তা" নামের একপত্রিকায়।  ( এখানে দেখুন)

এই নিবন্ধে দুর্নীতি ও সুশাসনের বিপরীতে উন্নয়নকে 'ট্রেড অফ' গণ্য করে বিনায়ক বলছেন, "দুর্নীতিকে কিছুটা মেনে নিয়ে (সহনীয় অবস্থায় রেখে) উন্নয়নকে গতিশীল করেই কেবল এই ট্রেড-অফ থেকে বেরিয়ে আসা যায়"। বিনায়ক সেন ব্যক্তিগত ভাবে আমাদের আলোচনার লক্ষ্যবস্তু নন। আমরা নিশ্চিত এই অবস্থান তাঁর একার অবস্থানও নয়। তবে সুশীল সমাজের এখনকার রাজনীতি বুঝতে হলে তার এই নিবন্ধ নিয়ে আলোচনা খুবই সমীচিন। বিশেষত এ কারণে যে আজ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার কারণে শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে রক্ষা করতে সুশীল সমাজকে শেষ পর্যন্ত মাঠে নেমে আসতে হচ্ছে। এরা যে আসলে দলবাজ, বিশেষ দলের দোষ ধরবার ক্ষেত্রে দলকানা, তা ধরা পড়েছে। তাদের দুর্নীতি বিরোধি জিহাদী জোশ হঠাৎ ফানুসের মত ফুস করে ফেটে গিয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের জিহাদ হঠাৎ গায়েব হয়ে গেছে, ফলে ইতোমধ্যেই ওয়াজ বদলে ফেলেছে তারা।


দুর্নীতি সম্পর্কে  সুশীল সমাজ তত্ত্ব পাল্টাচ্ছে। নতুন তত্ত্ব হচ্ছে বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে দুর্নীতি থাকবে। এর উচ্ছেদ ঘটানো কঠিন। দুর্নীতি চিন দেশে আছে, ভারতেও আছে। অতএব সুশাসন ও দুর্নীতিবিরোধিতার চেয়েও আমাদের জন্য জরুরী হচ্ছে উন্নয়ন। শেখ হাসিনাকে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে বাঁচাবার জন্য ভোল বদলে ফেলাটা জরুরী হয়ে পড়েছে।


দুর্নীতির বিরুদ্ধে বয়ান বদলানো প্রথম শুরু করেছিলেন টিআইবির পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির আঙুল উঠতেই প্রথম আলোতে দ্রুত এক সাক্ষাতকার দিয়ে পুরানা ওয়াজ বদলে নতুন ওয়াজ নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন তিনি । বলেছিলেন, "বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব এক নিরপেক্ষ মূল্যায়নে দেখা গেছে, উন্নয়নশীল দেশে যেসব প্রকল্পের সঙ্গে তারা জড়িত, সেখানে দুর্নীতির ঘটনায় বিশ্বব্যাংক নিজেও দায়মুক্ত নয়"। অর্থাৎ বিশ্বব্যাংকই দুর্নীতিবাজ। তো শেখ হাসিনার এমন কি দোষ? এবার একই ভাবে 'বদলে যাওয়া' ওয়াজে মাঠে নেমেছেন ড. বিনায়ক সেন। তাঁর বক্তব্য টিআইবির ইফতেখারুজ্জামানের মত রাখঢাক করে নয় কিম্বা 'বিশ্বব্যাংকও দায়যুক্ত দুর্নীতিবাজ' ধরণের বক্তব্যও তিনি দিচ্ছেন না। তিনি টিআইবির দুর্নীতি বিরোধি অভিযানের তত্ত্বগত ভিত্তিটাকেই প্রশ্ন করে বসেছেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি উচ্ছেদ আদৌ বাংলাদেশের জন্য কাম্য বা সম্ভব কিনা এই গোড়ার প্রশ্ন তিনি তুলেছেন; এ যাবতকাল সুশীল সমাজ যেসকল কথা বলে আসছিল তার খোদ পাটাতনটাই তিনি বদলে দিয়েছেন। তিনি এতই মরিয়া যে এতে সুশীল সমাজের আগের দুর্নীতি বিরোধিতার জেহাদি আওয়াজ ম্লান হয়ে গিয়েছে, খোদ টিআইবি নামের প্রতিষ্ঠান জন্ম নেবার ন্যায্যতাকেই প্রশ্ন করে বসেছেন তিনি।

সাক্ষাতকারভিত্তিক নিবন্ধের শুরুতে বিনায়ক সেনের কিছু পরিচয় দেয়া আছে সেখান থেকে টুকছি, 'বিনায়ক সেন অর্থনীতিবিদ; তিনি বিশ্বব্যাংকে সিনিয়র ইকোনমিস্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত। এ ছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউএনডিপিসহ অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক কমিটির সদস্য (১৯৯৭-২০০১), সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা কমিশনের সদস্য (২০০২-০৩)। বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন'। ডঃ বিনায়কের পরিচয় থেকে ধারণা করা যায় তিনি পশ্চিমের 'উন্নয়ন' আর 'সুশাসন' ধারণার ফেরিওয়ালা। কিন্তু এছাড়া আর এক পরিচয় এখানে বাদ পড়েছে, সে পরিচয় 'বণিকবার্তা' দেয় নি। তাঁকে কেন্দ্র করে দৈনিক প্রথম আলো এক নতুন প্রজেক্ট চালু করেছে, বাইরে যার পরিচয় ‘প্রতিচিন্তা” নামে এক সাময়িকী প্রকাশের মধ্যে। সুশীল সমাজের পক্ষে তত্ত্ব করবার কাগজ এটি। সেই হিশাবে বিনায়ক সেন কী বলছেন তাকে গুরুত্বের সঙ্গেই নিতে পারি আমরা।

লঘু পাপে গুরু দণ্ড

বিনায়কের এই লেখাটির মজার একটি দিক হলো, 'লঘু পাপে গুরু দণ্ড' তত্ত্ব। 'যেভাবে আর্থিক সুশাসন নিশ্চিত করা যেতে পারে' উপ- শিরোনামে বিনায়ক বলছেন, 'আর্থিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা গেলে বিশ্বব্যাংকও বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে পারে। তখন তারা মনে করতে পারে, হয়তো লঘু পাপে গুরু দণ্ড হয়ে গেছে'। কিন্তু এখানে লঘু পাপ আর গুরু দণ্ড বিষয়টা কি? শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ লঘু পাপ, তুলনায় সে অভিযোগ তদন্ত করতে না দেয়ার পরিণতিতে বিশ্বব্যাংকের পদ্মাসেতু প্রজেক্ট বাতিলের সিদ্ধান্ত গুরু দণ্ড। দুর্নীতির অভিযোগ উঠা এবং দুর্নীতির প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরী, কানাডা পুলিশের তথ্য সংগ্রহের একশনে এএনসি-লাভালিনের অফিস রেইড করা, কানাডা আদালতে মামলা - এই অবস্থায় বিশ্বব্যাংকের এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ অংশে ফারদার ডিটেল ইনভেষ্টিগেশনে সহায়তার বদলে বাধাদান ইত্যাদিকে বিনায়ক দেখছেন লঘু পাপ হিশাবে। অর্থাৎ দুর্নীতির মধ্যে এবার তিনি লঘু-গুরু বা ছোট-বড় তর্ক আনছেন। অথচ ২০০৪ সালে থেকে বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ আর সমাধান 'সুশাসন' – এই তত্ত্ব নিয়ে বিনায়কের মত সুশাসনের তত্ত্ববিদেরা যখন মাঠে নেমেছিলেন তথন কিন্তু পাপ অর্থাৎ দুর্নীতি লঘু না গুরু সে তর্কের কোন বালাই ছিল না। দুর্নীতি মাত্রই জিহাদ করতে হবে এই ছিল শ্লোগান; এমনকি কি সেজন্য সেনাবাহিনী ব্যবহার করে 'রেজিম চেঞ্জ' পর্যন্ত করতে হবে, জিহাদি জোশ এতই তীব্র ছিল। এখন বলছেন সম্পুর্ণ উলটা কথা। বলছেন, দুর্নীতি নিয়ে বেশি চাপাচাপি করলে 'উন্নয়ন' ব্যহত হবে। তিনি বলছেন, 'এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে উন্নয়নটা মাথায় রাখব, না সুশাসন— সেটা মূল প্রশ্ন'। এলডিসি, মানে আমাদের মত স্বল্প আয়ের দেশ আর সেখানে সুশাসনের প্রবক্তা তিনি এখনও। তা হওয়া সত্ত্বেও বলতে চাচ্ছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদি সুশাসনের শ্লোগান রয়ে সয়ে দিতে হবে, জায়গা মত ওয়াজ করতে হবে; নইলে এতে উন্নয়ন ব্যহত হবে। এতে বিশ্বব্যাংকের অবকাঠামো ফান্ড আমাদের মত কম আয়ের গরীব দেশের (কন্সেশনাল সুদের আইডিএ ফান্ড ) বদলে মধ্যম আয়ের দেশে, (আইবিআরডি ফান্ডের চার পার্সেন্ট সুদের ঋণ হয়ে ) মেক্সিকো বা ভারতে চলে যাবে। তিনি মহা এক ব্লেন্ডিং তত্ত্ব দিয়ে বলছেন, আমাদের মত দেশে দুর্নীতি-সুশাসন নিয়ে টিআইবি ধরণের প্রতিষ্ঠান দিয়ে ধুন্ধুমার কান্ড করলে, হৈচৈ ফেলে দিলে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে এলডিসি কন্সেশনাল ফান্ড (সুদবিহীন কেবল সার্ভিস চার্জের ঋণ) এখানে ব্যবহার করা যাবে না। তখন তা মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ব্যবহারের জন্য চলে যাবে। তাই তাঁর বোধোদয় ফান্ড ব্যবহার বিতরণে কম আয় আর মধ্যম আয়ের দেশের মধ্যে একটা 'ব্লেন্ডিং' মানে একটা ভাল ভাগাভাগির মিশ্রণ করে দেয়া দরকার। এই বিবেচনায় তিনি এখন দুর্নীতির পক্ষে সরব আওয়াজ নিচু স্বরে করবার পরামর্শ দিচ্ছেন। দুর্নীতি তো থাকবেই, এখ্ন আমাদের কাজ হচ্ছে উন্নয়ন করা। এই যুক্তিতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগকে লঘু পাপ বলছেন।


সুশীল সমাজের নতুন বয়ান হচ্ছে, আমাদের মত দেশে দুর্নীতি-সুশাসন নিয়ে টিআইবি ধরণের প্রতিষ্ঠান দিয়ে ধুন্ধুমার কান্ড করলে, হৈচৈ ফেলে দিলে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে এলডিসি কন্সেশনাল ফান্ড (সুদবিহীন কেবল সার্ভিস চার্জের ঋণ) এখানে ব্যবহার করা যাবে না। তখন তা মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ব্যবহারের জন্য চলে যাবে।  অতএব পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির আওয়াজ কম তোলা হোক। কুশাসন ও দুর্নীতির সঙ্গে উন্নয়ন ব্লেন্ড করেই আমাদের চলতে হবে। এই কথা অবশ্য তারা ২০০৪ থেকে ২০০৮ কালপর্বে কখনও বলেন নি।


এটা স্বভাবতই সুশীল সমাজের পুরানা অবস্থান থেকে পিছিয়ে আসা। 'বদলে যাওয়া আওয়াজে' ব্যাক-ফোর্থ মানে সামনে পিছনে দুদিকে দুই গিয়ারেই যাওয়া যায়। যেতেই পারেন তিনি। কিন্তু কেন যাচ্ছেন? এই যে লঘু-গুরু পাপ তত্ত্ব বা ব্লেন্ডিং তত্ত্ব তিনি এখন আনছেন এটা কি তাঁর বা ইফতেখারুজ্জামানের নতুন বোধোদয়? কারও নতুন বোধোদয় আটকে রাখা যায় না, 'বদলে যাও, বদলে দাও আওয়াজে' নতুন বোধোদয় হতেই পারে, সেটা সমস্যা না। কিন্তু তওবা পড়া বলে একটা কথা আছে। তওবা মানে আগের ভুল স্বীকার করা; পুনর্মূল্যায়ন । এই অংশটা আমরা তাঁর লেখা পড়ে নিশ্চিত হতে পারছি না। দুর্নীতি-সুশাসনের বিরুদ্ধে জিহাদ ছোটখাট কাণ্ড ছিল না; ছিল একেবারে লোকলস্কর, প্রতিষ্ঠান এবং আক্ষরিক অর্থেই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে। দুই হাজার চার সালের এডিবির দুর্নীতি-সুশাসনের জিহাদ প্রজেক্টে তা ঢাক-ঢোল পিটিয়েই করার বাধ্যবাধকতাও ছিল। ঢাক-ঢোল পিটানো, ব্যন্ডগায়ক দল নিয়ে মিডিয়ায় প্রচারণা খরচের জন্য আলাদা ফান্ড বরাদ্দ ছিল; তা করা হয়েছে কি না নিশ্চিত করে বাৎসরিক রিপোর্টে তা উল্লেখ করলে ও তা পরীক্ষা নিরীক্ষার পরই প্রজেক্টের পরের কিস্তির টাকা ছাড় করার শর্ত ছিল । এভাবে চার বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল রেজিম চেঞ্জ বাস্তবায়ন। নেপথ্যে রেজিম চেঞ্জ ধরণের করণীয় কাজ মনে রেখে বিশ্বব্যাংক সহ দাতাদের যেসব প্রজেক্ট রয়েছে, জানা মতে এই ভাবে সরকার বদলের চেষ্টার এটা দ্বিতীয় ঘটনা। এর আগে ১৯৮২ সালে এরশাদের নেতৃত্বে রেজিম চেঞ্জের মাধ্যমে সংস্কার কর্মসুচী বাস্তবায়ন ঘটতে দেখা গেছিল। ফলে ডঃ বিনায়কের লঘু-গুরু পাপ তত্ত্ব বা ব্লেন্ডিং তত্ত্ব কি নতুন তত্ত্ব? এই বোধোদয় কি সম্প্রতি কালের না ২০০৪ সালের আগেই ছিল বা তিনি জানতেন? আমরা কোথায় দেখিনি ডঃ বিনায়ককে উন্নয়নের যুক্তি তুলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংক বা অন্য কোন বহুপাক্ষিক দাতা অবস্থানের সমালোচনা করেছেন। এটা কি তার নতুন বোধোদয়? আমরা বরং লক্ষ্য করি যদি বোধোদয়ই হয় তাহলে বোধোদয় সত্ত্বেও এই লেখাতেও তিনি সুশাসনের বক্তব্য ত্যাগ করেননি। অর্থাৎ সুশাসন এখনও বগলে রাখলেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদি জোশটা খালি লঘু করতে চাইছেন।

মানুষের নতুন উপলব্ধির কারণে চিন্তা বদলাতে পারে। ভুল চিন্তা ত্যাগ করার মধ্যে দোষের কিছু নাই। তাহলে সুশীল সমাজের ২০০৪-৮ সালের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদি দায় কে নেবে? আর সে চিন্তা কর্ম ভুল ছিল। এই ভুল প্রকাশ্যে স্বীকার করা উচিৎ। পাবলিকলি ঘোষণা দিয়ে তা বলা উচিত। তা তিনি কোথাও করেছেন বলে আমরা দেখিনি। এমনকি দেখছি এই লেখায় তাঁর লঘু-গুরু পাপ তত্ত্ব বা ব্লেন্ডিং তত্ত্ব পুরানা জের বহন করছে, পুরাপুরি ছাড়তে চাইছে না। তিনি প্রকারন্তরেই রেখে দিয়েছেন। স্পষ্ট করে বলার সাহস দেখাননি। স্পষ্ট করে না বলা পর্যন্ত এই প্রশ্ন থেকে যাবে যে তাঁর এই লঘু-গুরু পাপ তত্ত্ব বা ব্লেন্ডিং তত্ত্ব তিনি আমদানী করছেন ব্যক্তি শেখ হাসিনার পক্ষে দাড়াবার জন্য, হাসিনাকে কুশন দেবার জন্য। ব্যক্তিকে রক্ষার জন্য তিনি চুপেচাপে নিজের তত্ত্ব বদলাচ্ছেন, শঠতাপুর্ণ নতুন অবস্থান নিচ্ছেন। নিজের পেশাগত বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন যদি স্বচ্ছ রাখতে চান তবে তাকে পরিস্কার করে বলতেই হবে যে ২০০৪-৮ সুশীল সমাজের দুর্নীতি-সুশাসনের জিহাদ প্রজেক্ট ভুল ছিল।

তবু এতটুকুতেই শেষ হবে না। উন্নয়নের স্বার্থে দুর্নীতির ব্যাপারে ট্রেড-অফ বা মুখ বুজে থাকার তত্ত্ব আগের প্রায় সব ধারণা, কাজ –নতুন ভাবে সব কিছু মুল্যায়নের তাগিদ তৈরি করবে; যেমন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) সম্পর্কে। প্রশ্নটা উঠবে বাংলাদেশে টিআইবির শাখা মানে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এর বাংলাদেশ শাখা খোলার উদ্যোগ ভুল ছিল। এটা কান টানলে মাথা আসার মত। দুর্নীতির ব্যাপারে ট্রেড-অফ বা মুখ বুজে থাকার তত্ত্ব যদি এখন সঠিক বলে মনে করা হয় তাহলে ২০০৪ সালে বাংলাদেশে একটা ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল খোলার উদ্যোগ নেয়াটা ভুল ও শঠতা ছিল। দরকার ছিল বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ভাবে এগিয়ে যাচ্ছ কিনা সেটা দেখা।

বিনায়ক এখানেই থেমে থাকেন নি, তিনি একদিকে দাবি করছেন বিশ্বব্যাংক দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠান আবার বলছেন খোদ বিশ্বব্যাংকের মত প্রতিষ্ঠানটাই নাকি নবাগত, প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিজে এখনও স্থির হয়ে বসতে পারে নাই ইত্যাদি। ফলে এখানেও একটা ট্রেড-অফ বা মুখ বুজে থাকার যুক্তি দিচ্ছেন। টিআইবির দোহাই দিয়ে লিখছেন, “মূলত এ কারণেই বোধ হয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) থেকে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাংক এ ক্ষেত্রে নবাগত এবং ট্রানজিশনের মধ্যে আছে’।

বিনায়কের ট্রেড-অফ তত্ত্বের এটা সবচেয়ে তরল আর ভয়ঙ্কর দিক। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠান; শেখ হাসিনা সহ অনেক বিপ্লবীই একথা বলেছেন। বিশ্বব্যাংক নিজেই যদি নবাগত এবং ট্রানজিশনের মধ্যে থাকা প্রতিষ্ঠান হয় তাহলে সেই বিশ্বব্যাংকের প্রণীত কর্মসুচী, যাতে ফান্ড দিয়েছে এডিবি -- তাদের ২০০৪-৮ সাল চলা বাংলাদেশে 'দুর্নীতি বিরোধী অভিযান' চালানোকে এখন কিভাবে ব্যাখা করা হবে? বিশেষত যেখানে সেনাবাহিনী দিয়ে রেজিম চেঞ্জের মত ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ জড়িয়ে আছে এই প্রশ্ন এড়িয়ে এখন ট্রেড-ফের যুক্তি তুলে বা 'বিশ্বব্যাংক এ ক্ষেত্রে নবাগত এবং ট্রানজিশনের মধ্যে আছে' বলে পালিয়ে যাবার সুযোগ নাই।

প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিশ্বব্যাঙ্কের জন্ম ১৯৪৪ সাল। এর বয়স এখন ৬৮ বছর। এছাড়া ১৯৪৪ সালে বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের নতুন তিন গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান হলো - জাতিসংঘ, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক। নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেশ প্রতি এক ভোট - এমন গণতন্ত্র মেনেও এই প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড়িয়ে নাই। এমন চিন্তা বা চেষ্টাও তখন করা হয়নি। সামরিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক ক্ষমতা সামর্থ আর ষ্ট্রাটেজিক স্বার্থ এই বিচারে সেই সময়ের গ্লোবাল প্লেয়ার যারা ছিল তাদের কাউকে বাইরে না রেখে এক জায়গায় এনে এই প্রতিষ্ঠানগুলো খাড়া করা হয়েছিল। এতে আশা করা হয়েছিল দুনিয়া থেকে যুদ্ধ উঠে যাবে না, গায়েব হয়ে যাবে না তবে যুদ্ধ এড়ানো, যথাসম্ভব দেরি করিয়ে দেয়া, স্বার্থবিরোধে বিবদমান রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের সঙ্গে কথা বলা, স্বার্থ বিরোধ মীমাংসার জন্য সবার গৃহীত নীতিগত দিক বা কনভেনশন তৈরি করার কাজের তাগিদ থেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্ম । অন্যদিকে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য লেনদেনের আইন, পুঁজির চলাচলের নিয়ম কানুন এবং সর্বোপরি একটা গ্লোবাল মুদ্রা মেনে নিয়ে তা চালু করা ও সবার রাষ্ট্রীয় মুদ্রার মান সেই গ্লোবাল মুদ্রার তুলনায় কি হবে এসবের একটা ব্যবস্থা বা সিষ্টেম দাড় করানো – এভাবে দুনিয়াটাকে ঐ প্রতিষ্ঠান তিনটার মাধ্যমে নতুন আকার দেয়া - এই ছিল প্রতিষ্ঠান তিনটা গড়ে তোলার পিছনের চিন্তা। আমরা পছন্দ করি আর নাই করি ভাবভালবাসা বা নিদেনপক্ষে কোন কিসিমের গণতন্ত্রও না, বরং ক্ষমতাধর দেশের অনুকুলে কান্নি মেরেই প্রতিষ্ঠানগুলো খাড়া করানো হয়েছিল এবং সেই থেকে এভাবেই এগুলো কাজ করেছে। 


প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিশ্বব্যাঙ্কের জন্ম ১৯৪৪ সালে। এর বয়স এখন ৬৮ বছর।  এছাড়া ১৯৪৪ সালে বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের নতুন তিন গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান হলো - জাতিসংঘ, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক। নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সদস্য দেশ প্রতি এক ভোট - এমন গণতন্ত্র মেনে এই প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড়িয়ে নাই। এমন চিন্তা বা চেষ্টাও করা হয়নি সেসময়। সামরিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক ক্ষমতা সামর্থ আর ষ্ট্রাটেজিক স্বার্থ এই বিচারে সেই সময়ের গ্লোবাল প্লেয়ার যারা ছিল তাদের কাউকে বাইরে না রেখে এক জায়গায় এনে এই প্রতিষ্ঠানগুলো খাড়া করা হয়েছিল।


আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক ফাইনান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান। ফলে কার কেমন মালিকানা শেয়ারের পরিমাণ কেমন অথবা কার অর্থনীতির সাইজ কত বড় তা থেকে সুবিধা আদায় করে নেওয়া এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের  ও পরিচালনার ভিত্তি। কোন ব্যাংক বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে যেমন গণতন্ত্র আবদার করে চাইবার মতো কিছু নাই, এই সব প্রতিষ্ঠান মালিকানার সুবাদে ধনি দেশগুলোর স্বার্থ না দেখে গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করবে এটা আশা করা হাস্যকর। তবু ব্যাংক বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সমাজে থাকলে সাধারণ মানুষের এক ধরণের কাজেও লাগে -এগুলো তেমনই। অবস্থা বিশেষে গরিব, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাজে লেগেছে বলে অনেকে তাই দাবি করেন। প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাই আপন ভাবার কিছু নাই, আবার রাগ করে এতে অংশ নিব না বলারও কোন মানে নাই।

কিন্তু ৬৮ বছরের এই সিষ্টেমটা নিজগুণে বা দোষে ভেঙ্গে পড়ার সময় হয়ে গেছে, এর আলামত এখন চারিদিকে ফুটে উঠছে; বিশেষত ২০০৭-৮ সালের বিশ্বমন্দার পর থেকে। যে গ্লোবাল ক্ষমতা ভারসাম্যের ওপর ভিত্তি করে এই ব্যবস্থাটা এতদিন দাঁড়িয়ে ছিল সেই খোদ গ্লোবাল ক্ষমতার ভারসাম্যই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। সামরিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক ক্ষমতা সামর্থ আর ষ্ট্রাটেজিক স্বার্থগুলো ভেঙ্গে পড়েছে, আর নতুন করে তা আবার সাজিয়ে তুলবার তাগিদ প্রতিদিন হাজির হচ্ছে। এটা শুধু একাডেমিক কথাবার্তা নয়, এই আলামতগুলোকে গুরুতর বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বব্যাংক নিজেই নিজেকে সংস্কার করে নতুন পরিস্থিতির জন্য উপযোগী করার চেষ্টা শুরু করেছে ২০০৯ সাল থেকে। বলা বাহুল্য ভেঙ্গে পড়ার আলামত বলছে এটা যথেষ্ট নয়; নতুন ধরণের কোন আলাদা বিশ্বব্যাংক গড়ে উঠবার আলামতই দিনকে দিন স্পষ্ট হচ্ছে। মনে রাখতে হবে বর্তমান গ্লোবাল অর্ডারটা একটা প্রত্যক্ষ যুদ্ধের ফলাফলের পর ও তারই ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল। আগামি গ্লোবাল অর্ডার কি হবে কেমন হবে, তা কি আপোষ আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে প্রতিস্থাপিত হতে পারবে নাকি আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের ফলাফলে দাঁড়াবে তা নিয়ে এখনই বলবার মত সময় হয়নি। কিন্তু এখনকার জন্য এটা স্পষ্ট যে বিশ্বব্যাংক নিজেই দাঁড়ানো গ্লোবাল সিষ্টেমের আয়ুর শেষ প্রান্তে। এই ৬৮ বছরের আয়ুর শেষ কালে “বিশ্বব্যাংক এ ক্ষেত্রে নবাগত এবং ট্রানজিশনের মধ্যে আছে’ একথা বলবার কী মানে হয়? এখনও বিশ্বব্যাংক ‘নবাগত’ অথবা এখনও সে একটা জন্মের পরের অন্তর্বর্তিকালীন সময়ের অস্থিরতায় আছে, থিতু হয় নাই – একথাগুলো খুবই হাস্যকর শোনায়।

বিনায়ক যদি তার ট্রেড-অফ মানে ‘দুর্নীতিকে কিছুটা মেনে নিয়ে (সহনীয় অবস্থায় রেখে) উন্নয়নকে গতিশীল’ করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে চান সেক্ষেত্রে ‘বিশ্বব্যাংক এ ক্ষেত্রে নবাগত এবং ট্রানজিশনের মধ্যে আছে’ এই যুক্তি তোলা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু তাহলে বিনায়ক এই অপ্রয়োজনীয় ও অচল যুক্তি আনলেন কেন? বিনায়কের লেখা পড়ে ধারণা করার কারণ আছে বিশ্বব্যাংককে বুঝা, অন্যকে বুঝানো ও ব্যাখ্যা করা তাঁর যতটা লক্ষ্য তার চেয়ে বেশিই জরুরি হাসিনার বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ থেকে হাসিনাকে বাঁচানো, তার ইমেজ তৈরি করা, বিশ্বব্যাংকের বিপরীতে অবস্থান নেবার জন্য শেখ হাসিনার জন্য একটা কুশন তৈরি করে দেয়া।

বিনায়ক প্রায়ই ‘সহনীয়’ বলে একটা শব্দ ব্যবহার করেছেন, দুর্নীতি সহনীয় করে দেখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। তাঁর ‘সহনীয়’ কথাটাকে বুঝবার জন্য তার লেখা থেকে ‘সুশাসন ও প্রবৃদ্ধির ট্রেড-অফ’ উপশিরোনামে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতকে উদাহরণ হিসাবে নিয়ে কিছু কথা বলেছেন - সেখানে যাব। তিনি লিখছেন, “১৫ বছর ধরে এ খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে গিয়ে ডেসা, ডেসকো প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা নব্বইয়ের দশক থেকে এ পর্যায়ে এসেছি। ১৫ বছর এ খাতে বিদেশী সাহায্য দাতারা পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না করায় যেটা হয়েছে— এ সময়ে যে পরিমাণ প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা ছিল, বিদ্যুত্স্বল্পতার কারণে সেটা হয়নি। যেহেতু বিদ্যুৎ বাড়েনি, সেহেতু তার চটজলদি সমাধানের জন্য রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পদ্ধতিতে যেতে হয়েছে, যার সামষ্টিক অর্থনৈতিক মাশুল একটি পৃথক আলোচনার বিষয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগে একটু নমনীয়তা দেখানো হলে আমরা ভালো একটা জায়গায় থাকতে পারতাম আজ। তখন আমাদের গ্যাসও ছিল, বিদ্যুৎ তৈরির বিভিন্ন উপাদানও ছিল। যেটা গত পাঁচ বছরে হচ্ছে, সেটা ১৫ বছর ধরে হতো। সহনীয়ভাবে ও গ্রহণযোগ্যভাবে হতো; অর্থনীতিবিদদের মধ্যে সবসময় তর্ক ছিল— সুশাসন না প্রবৃদ্ধি আগে”।

পনের বছর বিদ্যুৎ খাতে বিদেশী সাহায্য দাতারা পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না করা আজকের বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের মুল সংকট, কথাটা একশ ভাগ সত্য। কিন্তু এই সত্যতা সত্ত্বেও পালটা প্রশ্ন করা যায়।  বিদ্যুৎ সংকটের কারণে তো এতে আমাদের অর্থনীতির পারফরমেন্স খারাপ হবে, খারাপ হলে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের দিক থেকে সেটা খুশির খবর নয়। কারণ বিদ্যুৎ সংকটের কারনে জন্য বাংলাদেশে বিদেশী পুজি যেটুকু আসতে পারেনি, ব্যবসা করতে পারেনি, গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের জন্য সেটা ক্ষতি। বাংলাদেশে যেন বিদেশী পুজি ব্যবসা করতে পারে তার জন্য অবকাঠামোগত ভাবে বাংলাদেশকে প্রস্তুত করা জন্মের সময়ে বিশ্বব্যাংকে দেয়া মুল ঘোষিত দায়িত্ব। তাহলে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের দিক থেকে দেখলে বিশ্বব্যাংক কেন সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলো? এটাকে বিশ্বব্যাংক কিভাবে দেখে?


তাহলে মুল কথা দাড়াচ্ছে এই যে বিশ্বব্যাংকের স্বার্থ অর্থাৎ বিদেশি বিনিয়োগ ও উৎপাদকের স্বার্থের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক কোন ছাড় দিতে পারে না; এটা বিশ্বব্যংকের ‘সহনীয়ভাবে’ সহনশীল বা গরম হবার ব্যাপার নয়। এটাই বিশ্বব্যাংকের নীতি ও স্বার্থ। এটা বিশ্বব্যাংকের পাবলিকলি ব্যাখ্যা করে বলার মত কথাও নয়। এটা বাংলাদেশের সাথে গ্লোবাল বিনিয়োগ পুঁজির স্বার্থের লড়াই – বিশ্বব্যাংক যেটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লড়ে আদায় করে দিচ্ছে।


বিশ্বব্যাংকের স্বার্থের দিক থেকে দেখলে বাংলাদেশকে তার এ অবস্থায় না ফেলে উপায় ছিল না। যে কোন অর্থনৈতিক তৎপরতাকে সরকারী মালিকানা নাকি বেসরকারি মালিকানা সেটা বিশ্বব্যাংকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সরকারী মালিকানা (মানে আমাদের চটজলদি ভাষায় ‘সমাজতন্ত্র’) বিশ্বব্যাংক পছন্দ করে না। কিন্তু ফ্যাক্টস হলো, ১৯৭৬-৯০ সময়কালে আমাদের বিদ্যুৎ খাত ১০০ ভাগই সরকারি মালিকানা ছিল তা সত্ত্বেও, মুলত ঘোড়াশাল ভিত্তিক গ্যাস টারবাইন প্লান্টে বিনিয়োগ সে বারবার দিয়ে গেছে। আর ১৯৯০ সালের পর থেকে আর দিবে না সেকথাও জানিয়ে গেছে। সরকারী মালিকানা বিশ্বব্যাংক পছন্দ করে না, বিনিয়োগ দিতে চায় না একথা সত্য কিন্তু সেটা এজন্য না যে এতে বাংলাদেশে 'সমাজতন্ত্র' হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের যুক্তি হচ্ছে, এতে রাষ্ট্র চালানোর অপারেটিং কষ্ট বা দায় বেড়ে যাবে; উৎপাদনে জড়িয়ে থাকা সরকারী প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতার দায়ে যে খরচ বৃদ্ধি হয় সেটা রাষ্ট্রের কাঁধে আসে; সরকারের আয়-ব্যয় বাজেটে চাপ পড়ে, এর সব দায় ব্যবসাবাণিজ্য বিনিয়োগের উপর পড়ে। বিনিয়োগ অপারেশনের উপরও পড়ে। তাই বিশ্বব্যাংক সরকারকে কোন প্রডাকশনের কায়কারবারে দেখতে চায় না। তবে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত না পারতে বাংলাদেশ সরকারকে টাকা দিয়েছে। কারণ বিদ্যুৎ একটা বড় বিনিয়োগের কারবার যা স্থানীয় কোন ব্যবসায়ীর পক্ষে এ কারবার বিনিয়োগে এগিয়ে আসা, সামাল দিয়ে চালানো সম্ভব নয়। কোন বিদেশি বিনিয়োগের স্রেফ লোকাল এজেন্ট, কেবল সরকারের সাথে লাইনঘাট করে অনুমতি পাইবে দিবে, যারা প্রজেক্ট সামলানোর ন্যূনতম ম্যানেজমেন্ট জ্ঞান রাখে বাংলাদেশ একাজ করার মত অবস্থাতেও ছিল না। ফলে এই অবস্থাটা তৈরির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া বিশ্বব্যাংকের উপায় ছিল না। তাই বিশ্বব্যাংকের মুল লক্ষ্য ও কাজ হলো, বিদেশি বিনিয়োগ ও বিদেশি প্লান্ট চালানো বা কারখানা উৎপাদনকারীর এদেশে আসার জন্য সহায়ক অবস্থা তৈরি করা। বাংলাদেশকে এজায়গায় নিয়ে আসতে গত ২০ বছর বিদ্যুৎ খাতে কোন বিনিয়োগ অর্থাৎ সুদবিহীন কন্সেশনাল লোন দেয় নাই। এটাকেই প্রকারান্তরে বলে বাংলাদেশকে বিদেশি পুজি বাজার থেকে বিনিয়োগ নিতে বাধ্য করা। তবে এই বিশ বছর বিশ্বব্যাংক একেবারে হাত গুটিয়ে রাখেনি, টেকনিক্যাল সহযোগিতা দিয়েছে। যেমন প্লান্ট পরিকল্পনা, টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরি, বিড শেষ করে কাজ দেয়া, কাজ বুঝে নিতে সহায়তা ইত্যাদিতে সরকারের ক্যাপাসিটি বিল্ডিং। মাস দুয়েক আগে ৪৫০ মেগাওয়াটের এক বিদেশী বিনিয়োগের প্রজেক্টে হঠাৎ ৩০ ভাগের মত বিনিয়োগ দিতে রাজি হয়েছে এবং বিশ্বব্যাংক সেটা দিয়েছে। তাহলে এতদিন চাপের মধ্যে ফেলে রেখে বিশ্বব্যাংক নিজে কী অর্জন করতে চেয়েছে? চেয়েছে যেমন ডেসা ডেসকো ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান বিতরণ সার্ভিস দিয়ে বিল তুলে আনতে পারে কিনা, সিষ্টেম লসের নামে চুরি কমাতে পারে কি না, ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষ করে তোলা। আর ওদিকে আমাদের নিজেদের গ্যাস আছে বলে তুলনামুলকভাবে আমাদের গ্যাসভিত্তিক উৎপাদন খরচ এত চুরি অদক্ষতার পরেও কম। সম্ভবত বিদেশি বিনিয়োগ ও উৎপাদকের জন্য এটা আকর্ষণীয় নয়। এসব অবস্থা থেকে কতটা উত্তরণ ঘটলো তার ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা পেতেই বিশ্বব্যাংকের এই স্বল্প বিনিয়োগ।

আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি এটা বিশ্বব্যাংকের বিদ্যুতখাতের বিনিয়োগে ফিরে আসা নয়। ধরে নেয়া যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য কমপক্ষে ৮% সুদ চার্জ করবে গ্লোবাল পুজি বাজার। এই বাজারে আর যাই হোক পুঁজি ব্যবসায়ীদের সুদব্যবসা বঞ্চিত করে তাদের প্রতিযোগী হওয়া বিশ্বব্যাংকের (বিনা সুদে সার্ভিস চার্জে ঋণ দেয়া) লক্ষ্য নয়; বরং সে বাজারে বাংলাদেশ ক্রমেই এক লোভনীয় খাতক করে হাজির করাই তার কাজ। ইতিমধ্যে শেখ হাসিনার রেন্টাল বিদ্যুতের চুরি লুটপাটের খেসারতে দেশি ব্যবসায়ী-গ্রাহকের অবস্থা এমন যে সে এখন তিনটাকার জায়গায় ১৬ টাকা ইউনিটে বিদ্যুৎ কিনেও ব্যবসায় টিকে থাকতে রাজি। ফলে বিদেশি বেসরকারী বিদ্যুৎ উৎপাদকের কাছ থেকে পিডিবি বিদ্যুৎ কেনার রেটও সহজেই বাড়বে ও ইতোমধ্যেই বেড়েছে। এখন পিডিবির রেন্টাল বিদ্যুতের কেনার রেটে (আট টাকা) যদি বিদেশি গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদক পিডিবির কাছে বিক্রি করতে পারে তবে বিদ্যুতখাতে বিদেশি ব্যবসা বিনিয়োগ সহায়ক হবে। এই অবস্থাটা দেখার জন্যই বিশ্বব্যাংক এতদিন বিদ্যুতখাত থেকে নিজেকে প্রত্যাহার নীতি চালিয়ে গেছে। অথচ বিনায়ক এই বিষয়টাকে দেখছেন বিশ্বব্যাংকের ভুমিকা যদি বিদ্যুতখাতে সহনীয়ভাবে ও গ্রহণযোগ্যভাবে হতো তাহলে সুশাসন না হলেও প্রবৃদ্ধি হত।

কিন্তু প্রথম ফ্যাক্টস হলো, বিদ্যুৎ খাত থেকে বিশ্বব্যাংক নিজেকে প্রত্যাহার করে নেবার নীতি চালিয়ে গেছে এই খাতের দুর্নীতির কারণে নয়। এমন কোন অভিযোগ এখানে নাই। বিশ্বব্যাংক ভাল করেই জানে পিডিবির দুর্নীতির পরেও ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের ইউনিট তিন টাকাই ছিল ও আছে। এককথায় বললে বিশ্বব্যাংক কেন বিনিয়োগ দিবে না এর কোন ব্যাখ্যা সে কোথাও দিয়েছে বলে আমাদের জানা নাই। কারণ এটা তার আসল স্বার্থের কথা যা পাবলিকলি বলা যায় না।

তাহলে মুল কথা দাড়াচ্ছে এই যে বিশ্বব্যাংকের স্বার্থ অর্থাৎ বিদেশি বিনিয়োগ ও উৎপাদকের স্বার্থের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক কোন ছাড় দিতে পারে না; এটা বিশ্বব্যাংকের ‘সহনীয়ভাবে’ - কোন সহনশীল বা গরম হবার ব্যাপার নয়। এটাই বিশ্বব্যাংকের নীতি ও স্বার্থ। এটা বিশ্বব্যাংকের পাবলিকলি ব্যাখ্যা করে বলার মত কথাও নয়। এটা বাংলাদেশের সাথে গ্লোবাল বিনিয়োগ পুঁজির, ওয়াল ষ্ট্রীটের স্বার্থের লড়াই – বিশ্বব্যাংক যেটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লড়ে আদায় করে দিচ্ছে। এটাই তার কাজ। সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বিশ্বব্যাংকের দিক থেকে এটা কোন ধরণের দুর্নীতির মামলাও না। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতিবাজ বা দুর্নীতি করাই তার নীতি – এটা মোটেও তা নয়। ফলে বিশ্বব্যাংকের পরিচালনায় দুর্নীতির প্রতি সহনশীল হওয়ার আবেদন নিবেদনের বিষয়ই নয় এটা। এখানে বিদ্যুৎ খাতে না সরকার দুর্নীতি করেছে, না বিশ্বব্যাংকের কোন অভিযোগ আছে , ফলে ‘সুশাসনের’ অশ্বডিম্বের কোন দেখা নাই এখানে। কারণ গত বিশ বছরে এখানে বিশ্বব্যাংকের কোন বিনিয়োগই নাই। ফলে বিনায়কের পরামর্শ বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির প্রতি সহনীয় নমনীয় হওয়ার দিক থেকে এটা একেবারেই বেজায়গা উদাহরণ। এজন্য বলা যায় বিশ্বব্যাংকের ভুমিকা নিজে বুঝা ও আমাদের বুঝানোর জন্য বিনায়ক একেবারেই সিরিয়াস না। তিনি প্রতিষ্ঠানটির চরিত্র না বুঝেই আবদার করে বলছেন, ‘বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগে একটু নমনীয়তা দেখানো হলে আমরা ভালো একটা জায়গায় থাকতে পারতাম আজ। তখন আমাদের গ্যাসও ছিল, বিদ্যুৎ তৈরির বিভিন্ন উপাদানও ছিল। যেটা গত পাঁচ বছরে হচ্ছে, সেটা ১৫ বছর ধরে হতো’। অথচ এটা তো দুর্নীতির কোন অভিযোগের মামলা না। এটা বাংলাদেশের সাথে বিদেশী স্বার্থের রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রশ্ন। বাংলাদেশ একমাত্র যা রাজনৈতিক ভাবেই জিতে নিজের পক্ষে ফয়সালা আনতে পারে। আর কোনভাবে এখান থেকে আমাদের মুক্তির উপায় নাই।

বিনায়ক বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির উদাহরণ দিতে গিয়ে বলছেন, 'ইন্ডিয়ায় পরিচালিত পাঁচটি স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পের মধ্যে চারটা সে সময় বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। বড় ধরনের দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায় এ ক্ষেত্রে'। ভাল কথা আমরা বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি এবার দেখতে পাব আশা করি। তিনি বলছেন 'এইচআইভি রোগের ভুল টেস্টিং কিট প্রদান' করা হয়েছিল। কিন্তু এটার সাথে বিশ্বব্যাঙ্কের দুর্নীতিবাজ হবার সম্পর্ক কী? এটা কি এমন যে বিশ্বব্যাংক নিজে প্রজেক্টের টাকায় কেনাকাটাটা নিজে করেছে? নিজে কোন ভুয়া কোম্পানীর কাছ থেকে কিনে তা সরবরাহ করে টাকা মেরে দিয়েছে কি? বিশ্বব্যাংক কোন বিশেষ কোম্পানীর কাছ থেকে কিনতে বাধ্য করেছে? এই ঘটনায় বিশ্বব্যাংক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লাভবান হয়েছে কি? তাহলে একে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি বলে বিনায়ক কেন দাবী করছেন? বিশ্বব্যাঙ্কের অর্থায়নের প্রজেক্টে ইন্ডিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেনাকাটায় একটা গাফিলতি করেছে বা মন্ত্রণালয়ের কেউ ঘুষ নিয়েছে? এর সাথে খোদ বিশ্বব্যাংক দুর্নীতিবাজ বা দুর্নীতি করেছে এই বলে প্রচারের কোন সুযোগ কোথায়?

দুদকঃ পদ্মাসেতু ঋণচুক্তি বাতিলের বিশ্বব্যাঙ্কের যুক্তি

পদ্মাসেতু ঋণচুক্তি বাতিলের বিশ্বব্যাঙ্কের দিক থেকে যুক্তি কি? প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে এটা সে কারণ নয়। প্রকল্পে দুর্নীতির যে প্রাথমিক প্রমাণ সে পেয়েছে তা নিয়ে বিস্তারে তদন্ত করবার কাজে বাংলাদেশ সহায়তা করে নাই; পরিস্থিতি একটা ষ্টেলমেট অবস্থায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে । বিনায়ক নিশ্চয় এটা মানবেন তাহলে ভারতের স্বাস্থ্য প্রকল্পের যে উদাহরণ তিনি টানছেন তা কি একই ধরণের? ভারতের সাথে এই প্রজেক্টেও কি তাই হয়েছিল? ভারত তদন্ত করতে দেয় নাই? তাই কি? বিনায়ক সেকথা পরিস্কার করে আমাদের জানান নি। আমাদের আনিসুল হক, যিনি আইনত দুদুকের আইনজীবি মাত্র, দুদুকের কোন কর্মচারি বা সরকারের কোন কর্মচারি কেউ নয়। প্রথম আলো লিখছে সাংবাদিক সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা আনিসুল হক দাবি করেছেন, ‘পদ্মা সেতু অর্থায়ন বাতিলের সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত করতেই বোধ হয় বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা দুই দিনের সফর পরিকল্পনা করেছিল।’ এই ষ্টেটমেন্ট কি তিনি দিতে পারেন? ঐ একই সাংবাদিক সম্মেলনে দুদুক চেয়ারম্যান উল্টা কথায় বলছেন, 'বাংলাদেশ পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য ঋণ পেল কী পেল না তা নিয়ে দুদকের কোনো মাথাব্যথা নেই’। অর্থাৎ এটা দুদুকের দেখার বিষয় নয়। তাহলে আনিসুল হক কেন দুদুকের এখতিয়ারের বাইরে এবং সরকারের কেউ না হওয়া সত্ত্বেও এই পলিটিক্যাল ষ্টেটমেন্ট করলেন? বিশ্বব্যাংকের দিক থেকে তদন্তের পুরা বিষয়টা দেখভাল করছে তাদের ইন্টিগ্রিটি বিভাগ। ইন্টিগ্রিটি বিভাগ কান্ট্রি অফিসকে তো নয়ই এমনকি ব্যাংক প্রেসিডেন্টকেও জবাবদিহি করেন না। এই বিভাগ রিপোর্টিং, তথ্য শেয়ার কোনটাই নির্বাহিদের কাউকে করতে বাধ্য নয়, কারণ সে পরিচালিত হয় বোর্ডের অধীনে। এই নিয়মটা ইচ্ছা করেই করা হয়েছে যাতে নির্বাহী অরগানোগ্রামের কেউ ঘটনায় যদি সংশ্লিষ্ট থাকে, খোদ কান্ট্রি ডিরেক্টরই হয়ত জড়িত থাকতে পারেন, তখন তারা যেন তদন্ত প্রভাবিত করতে না পারে। তাই দুদুকের তদন্ত রিপোর্ট ইন্টিগ্রিটি বিভাগের প্রতিনিধির কাছে জমা দিতে বলেছেন। অথচ আনিসুল হক এ বিষয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে বলছেন, “কিন্তু তারা বলল, না, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে কিছু জানাতে হবে না। সেটার জন্য বেতনভুক্ত কর্মচারী [ইন্টিগ্রিটি বিভাগ] বিশ্বব্যাংকের থাকবে তাদের জানাতে। আমরা বলেছিলাম ব্যাংককে জানাব। ব্যাংক তাদের প্যানেলকে জানাক। সেটাই হচ্ছে আইনসম্মত, বিধিসম্মত। তখন তারা বললেন যে না আমাদের জানাতে হবে না”।

অর্থাৎ এখানে তিনি গো ধরে গিট্টু দিলেন, তিনি ইন্ট্রিগ্রিটিকে নয় ব্যাংককেই জানাবেন, মানে কান্ট্রি ডিরেক্টর গোল্ডষ্টেইনকেই জানাবেন । তার জানা উচিৎ ছিল এবং জানা আছে  কেন ইন্টিগ্রিটি বিভাগ নিজের কাছে ছাড়া কান্ট্রি অফিসের কাউকে দুদুকের রিপোর্ট দিতে বলতে পারবেন না। অথচ তিনি এই পয়েন্টেই গো ধরে গিড়া দিলেন। জানালেন ‘সেটাই হচ্ছে আইনসম্মত, বিধিসম্মত’। ফলে দুদুকের সাথে ইন্ট্রিগ্রিটি বিভাগের আলোচনা ভেঙ্গে গেল।

আবার হাসিনার দিক থেকে তিনি এই তদন্ত চলতে দিতে রাজি হলেন না। সংসদ, মাঠের বক্তৃতায় শেখ হাসিনা গরম করে বলতে থাকলেন বিশ্বব্যাংকই দুর্নীতিবাজ। দেশপ্রেমের নহর বইয়ে দিলেন। যদিও চাদা তুলতে গিয়ে ৯০০ টাকার জন্য এক কর্মী খুনাখুনিতে মারা গেলেন। এভাবে  পাবলিক মাইন্ড পরিস্থিতি নিজের পক্ষে নিয়ে এরপর আবার বিশ্বব্যাঙ্কের চার শর্তে রাজি বলে জানালেন এবং দুদুক তা এনডোর্স করলো। তাহলে কেন আনিসুল হক এই নাটক করলেন?

প্রথম আলো ঐ সাংবাদিক সম্মেলনের রিপোর্ট করতে গিয়ে লিখছে, 'গতকাল দুদকের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহার নোট বইয়ে 'পারসেন্টেজ টু বি অ্যালোটেড টু স্পেসিফাইড পারসনস ইন কানেকশন উইথ দি অ্যাওয়ার্ড অব দি সিএসসি কনট্রাক্ট' এবং কিছু নাম সাংকেতিকভাবে লেখা ছিল। তার আলোকে বিশ্বব্যাংক একটি সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করে। এ তালিকাসহ কিছু তথ্য বিশ্বব্যাংক অর্থমন্ত্রীর হাতে এবং কমিশনের কাছে পৌঁছে দেয়'। তা সত্ত্বেও হাসিনা লন্ডনে বিবিসিকে বলছেন,'পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ দিতে পারেনি বিশ্বব্যাংক'। তাহলে হাসিনা কি চাইছেন? বিশ্বব্যাংক হাতেনাতে প্রমাণ দিক? নাকি যতটুকু তারা জেনেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে আরও তদন্ত করে অভিযোগটা একটা ফয়সালায় আসাই তাদের উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ সরকারের সাথে একসাথে তদন্ত করতে চাইবে ঘটনার একটা সত্যতায় দুপক্ষ মিলে পৌছাবে এটাই তো সবচেয়ে স্বাভাবিক, নয় কি? এর সাথে বিশ্বব্যাংকের অনমনীয়তা অথবা নমনীয়তার সম্পর্ক কী? উন্নয়ন আগে না দুর্নীতি ধরা আগে একথা তোলার মানে কি? প্রধানমন্ত্রী হিসাবে হাসিনার এই মনোভাবকে বিশ্বব্যাংকের দিক থেকে তদন্ত করতে কাজে অসহযোগিতা বলাটাই কি স্বাভাবিক না? বিনায়ক ভারতের যে উদাহরণ টেনেছেন তা কি এরকম - তদন্ত করতে কাজে অসহযোগিতা? তাহলে কিসের ভিত্তিতে বিনায়ক এই উদাহরণ টানছেন?

বিনায়ক এই পুরা কথোপকথনে অযথা লঘু-গুরু পাপ, দুর্নীতি ধরা আগে না উন্নয়ন আগে – এসব বিতর্ক তুলেছেন। টিআইবির মত করে বিশ্বব্যাংক নিজেই দুর্নীতিবাজ ধরণের প্রশ্ন তুলেছেন। তবে তাঁর বাড়তি সংযোজন হলো, বিশ্বব্যাংককে নমনীয় হতে বলা। এভাবে হাসিনার ইমেজ সংকট কাটিয়ে একটা কুশনের ব্যবস্থা করে দেয়া – এটাই তার লেখার কারণ বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। একাজে তিনি এতই মরিয়া যে এতে তার পেশাগত পরিচয়ে দাগ লেগে যাচ্ছে, সেদিকেও তার ভ্রুক্ষেপ নাই। এটা দুর্ভাগ্যের ঠিক, কিন্তু এর মধ্য দিয়ে সুশীল সমাজের রাজনীতি এবং তাদের দলবাজ অবস্থান সম্পর্কে আমরা ভাল একটা ধারণা করতে পারছি। এটাই লাভের।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।