নতুন গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া ছাড়া বাংলাদেশের  বিকল্প নাই


[ এ বছর ২৩-২৪ জুন নিউইয়র্কে এবিসি কনভেনশানে ফরহাদ মজহার যোগ দিয়েছিলেন। উত্তর আমেরিকার সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকা “ঠিকানা’ এই সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা। নিউ ইয়র্ক থাকা কালীন ‘ঠিকানা’ পত্রিকার তরফে জাভেদ খসরু তখন একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। অগাস্টের শেষ সপ্তাহে "শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কেন বলা যাবে না, তিনি কি ফেরেশতা?"  শিরোনামে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে সাক্ষাৎকারটির একটি সংক্ষিপ্ত রূপ দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় (২৬ আগাস্ট ২০১২) ছাপা হয়েছে। তাদের শিরোনামঃ "সংবিধান জনগণের অধীন থাকলে সংসদ, নির্বাহী ও বিচার বুভাগে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বিতর্ক উঠত না"। এখানে পুরা সাক্ষাৎকারটি পেশ করা হোল।]

ঠিকানা : আজকের যে ফরহাদ মজহারকে মানুষ দেখে, সেই ফরহাদ মজহার হয়ে উঠলেন কী করে?

ফরহাদ মজহার : আমাদের প্রত্যেকের জীবনের ভেতর দিয়েইতো আমাদের পুরা সমাজের ইতিহাস প্রকাশ পায়। আমাদের পুরা কমিউনিটির ইতিহাস থাকে। যে সময়কালে বড় হয়েছি, সেই সময়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায়, আর নতুন ঘটনাও ঘটতে থাকে।

সাতচল্লিশে ভারত ভাগ হয়েছে, মুঘল সাম্রাজ্য ব্রিটিশদের হাতে চলে যাবার পর একশ বছর মুসলমানরা ইংরাজি শেখেনি, সেই সম্প্রদায়েই তো আমার জন্ম। পূর্বপ্রজন্মের মানুষজন স্বপ্ন দেখত একদিন তারা আবার তাদের রাজ্য ফিরে পাবে। সে এক ট্রাজেডি, মুসলমানদের দিল্লির মসনদ হারানো নয়, সেই মসনদ যে আর ফিরে পাওয়া অসম্ভব এটা অনুভব করবার জন্য যে পথটা পাড়ি দিতে হয়েছে এখনকার প্রজন্মের পক্ষে সেটা উপলব্ধি করা কঠিন। ট্রাজেডি এখানেই। অন্যদিকে ইংরেজি শিখে এবং ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে যে হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠছিল তাদের তুলনায় মুসলমানরা পিছিয়ে পড়েছিল সব অর্থেই। বাবা দাদাদের বয়েসী যারা তাঁদের মুখে আঠারোশ সাতান্ন সালের সিপাহি বিদ্রোহের ইতিহাস শুনে রোমাঞ্চিত হয়েছি। শুধু ইংরাজের নয়, হিন্দু জমিদার মহাজনদের অত্যাচারের কথা শুনেছি। তারা মনে করতেন ভারত ভাগ করে পাকিস্তান গঠন দরকার ছিল। এমন নয় যে একদিন হঠাৎ কেউ একজন দ্বিজাতিতত্ত্ব আবিষ্কার করলেন আর তৎক্ষণাৎ হিন্দু আর মুসলমান দুই জাতিতে ভাগ হয়ে গেল। তারা দাবি করতেন, জিন্নাহ ভারত ভাগ চান নি, তিনি সংখ্যালঘুর স্বার্থ অখণ্ড ভারতে নিশ্চিত করবার চেষ্টা করেছেন, সংখ্যাগুরুরা সেটা মীমাংসা করতে চায় নি। ইতিহাসের এই সকল গল্প শুনে শুনেই আমি বড় হয়েছি। ফলে ছেলে বেলা থেকেই নিজে কিভাবে বেড়ে উঠেছি এটা বুঝতে গিয়ে বারবার ইতিহাসেই ফিরে গিয়েছি।

কিন্তু যারা পাকিস্তান চেয়েছিলেন তাদেরই আবার দেখলাম বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে। তারা বাংলা ভাষার জন্য মহা দরদি হয়ে গিয়েছিলেন তা নয়। শিক্ষিতের যে বাংলা সেই বাংলা তারা বলতেন না, ফলে সেই ভাষা আর যাই হোক সাহিত্যের ভাষা হলেও যাকে আমরা মাতৃভাষা বলি তা ছিলনা। নোয়াখালি, সিলেট বা চট্টগ্রাম বা আমাদের পুরানা ২১ জেলার ভাষার সঙ্গে কলোনিয়াল শহর কলকাতায় গড়ে ওঠা বাংলাভাষা সমার্থক বলা যাবে না। ঢাকা শহরে ছাত্রদের ওপর গুলি চলেছে, এতে তারা ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত গ্রামের কৃষক যখন তাদের ছেলেমেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছে তখন তাদের গুলি করে মারা হচ্ছে। এটা তারা মেনে নিতে পারেন নি। ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের সঙ্গে কৃষক বা বাংলাদেশের সাধারন মানুষ কেন যোগ দিল সেটা বুঝতে হলে ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস মনে না রাখলে কিছুই বোঝা যাবে না। এই ভাবে আমি যে সম্প্রদায় ও শ্রেণী থেকে এসেছি, সেই সম্প্রদায় ও শ্রেণীর রূপান্তর ঘটেছে। বড় হয়েছি গ্রামে। বাবা ছোট খাটো জমিদার না হলেও জমিওয়ালা মানুষ ছিলেন। চাকুরি করতেন সংসারের খরচ নির্বাহের জন্য কিন্তু আসলে কৃষক। ঐ শ্রেণী থেকে আসা মানুষ আমি।

যে ঘটনাটা আমাকে বদলে দিয়েছে, বিশেষভাবে, সেটা হলো ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধ। আমি ছাত্রাবস্থায় আকৃষ্ট ছিলাম বামপন্থী রাজনীতিতে। অর্থাৎ পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন, যার মধ্য দিয়ে সর্বহারা পার্টি গড়ে ওঠে। সে ধারায় থেকে আমি বড় হয়েছি। তারপরে ৭১-এর যুদ্ধের মধ্যে দিয়েও এক ধরনের পরিবর্তন আসে। জনগণের জন্য সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে আমাদেরকে। এ রকম না যে ভারতে গিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্বারা ট্রেনিং পেয়ে ভারতীয় ক্যাম্পে থেকে বাংলাদেশে ঢুকে আমরা যুদ্ধ করেছি, তারপর ফিরে গিয়েছি ক্যাম্পের নিরাপদ অবস্থানে। বিপ্লবী রাজনীতির যাঁরা অনুসারী ছিলেন তাঁদের সকলের ক্ষেত্রে এই কথা সত্য। তাদের যুদ্ধ করা শিখতে হয়েছে দেশের ভেতরে জনগণের সঙ্গে থেকে, জনগণকে নিয়েই। যুদ্ধ আমা্দের রাজনীতির সম্প্রসারণ ছিল, সামরিকতা ও রাজনীতির মধ্য কোন ভেদ ছিল না। এই গণযুদ্ধ বা জনগণের মধ্যে থেকে জনগণকে নিয়ে লড়াই –সংগ্রাম -- এইটা আমার চিন্তা-চেতনায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটায়। আমার নিজের সম্পর্কে আমি জানি। আগের ধ্যান-ধারণায় অনেক পরিবর্তন ঘটে যায়। কিছুটা সজ্ঞানে, অধিকাংশ সময় নিজেরই অজান্তে। আমার নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইটা আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ’ ধারণ করে আছে।

যুদ্ধের পর পর দেখলাম, আমরা যারা ভিন্ন রাজনীতি থেকে এসেছি, ভিন্ন চিন্তা-ভাবনা থেকে এসেছি, আর ৭১-এ যে-রাজনীতি জয়ী হয়েছে বলে আমরা দেখি- সেই রাজনীতির সঙ্গে একটা দূরত্ব বা বিরোধ রয়েছে। বিরোধ ছিলই, স্বাধীনতার পরে সেটা আরও স্পষ্ট ও প্রকাশ্য হতে শুরু করেছে। এই বিরোধটা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। আমার চিন্তা চেতনা গড়ে উঠার ক্ষেত্রে এটা যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল বলে আমার ধারণা।

৭২-এর পর আমি দেশের বাইরে চলে আসি পড়াশুনার কারণে, এখানে। অর্থাৎ আমেরিকার নিউইয়র্কে। তখন নিকারাগুয়ান বিপ্লব, ইরানিয়ান বিপ্লব চলছিল। সেই ষাট দশক থেকে নিকারাগুয়ার ডিক্টেটর সামোজার অত্যাচার নির্যাতনের কথা শুনছিলাম , আর শুনছিলাম সান্দিনিস্তা ন্যাশনাল লিবারেশান ফ্রন্টের বিপ্লবী রাজনীতির কথা। এখানে থাকতে থাকতেই ১৯৭৯ সালে সান্দিনিস্তার বিজয়ী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একনায়কতান্ত্রিক সরকারকে হঠাবার সাফল্য অনুপ্রাণিত করেছে আমাকে। ইরানের বিপ্লবও ঘটেছে ১৯৭৯ সালে। আমার ল্যাটিনো ও ইরানের বন্ধুদের সঙ্গে অনেক দিন কেটেছে আমার নিউইয়র্কে। কী ঘটছে ল্যাটিন আমারিকায়, কী ঘটছে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে সেইসব ছিল তীব্র আগ্রহের বিষয়। এই ঘটনাগুলোও আমার ওপর ছাপ ফেলে।

ততোদিনে বুঝেছি আমরা বাংলাদেশে কার্ল মার্কসের কথা শেখা বুলির মত বলতাম। মাও বা লেনিনকে বিপ্লবের ফর্মূলা মুখস্থ করবার জন্য পড়েছি। আমেরিকায় এসে নিজের মতো করে একা একা পড়ার সুযোগ পেয়েছি। আসলে আমাদের মার্কসবাদের পঠন-পাঠনটা কেমন ছিল এবং কেমন হওয়া উচিত সেইসব ভাবতে শিখেছি এখানে। তখন বিভিন্ন দেশের বিপ্লবী লোকরা এখানে পালিয়ে আসতেন। তাদের সাথে কথা হতো। আমরা যাকে কেন্দ্র করে ছিলাম- তিনি হলেন একবাল আহমেদ। তাঁর ব্যাপারে আপনাদের জানানো উচিত বাংলাদেশের মানুষকে। কারণ হয়তো কেউ জানেই না তাঁর সম্পর্কে। ৭১-এ পাকিস্তানের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে যেসব পাকিস্তানী বুদ্ধিজীবী শক্তভাবে সমালোচনা করেছিলেন- তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। একবালকে কেন্দ্র করে নিউইয়র্কে তখন একটি প্রগ্রেসিভ গ্রুপ গড়ে উঠেছিল। ওর মধ্যে ছিলেন এজাজ আহমেদ, ফিরোজ আহমেদ এবং আরও অনেকে। এরা সকলেই ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপক্ষে।

সেই সময় নিউস্কুলে অর্থাৎ নিউ স্কুল ফর সোশাল রিসার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কসীয় ইকনমিক্স বা অর্থশাস্ত্র পড়ানো হোত। ই্কনমিক্স আমি এখানেই পড়ি। আগে ফার্মাসিস্ট ছিলাম। আমিই সম্ভবত প্রথম বা দ্বিতীয় লাইসেন্সধারী ফার্মাসিস্ট হয়েছিলাম নিউইয়র্কে। আগে থাকলে কেউ থাকতে পারে আমার জানা নেই।

ঠিকানা : এটা কত সালে?

ফরহাদ মজহার : ৭২-তে পড়াশুনা শুরু করি। শেষ হয় ৭৬ সালে। এরপর নিউইয়র্কে ৮০ সাল অবধি ফার্মাসিস্ট হিসেবে কাজ করি। আশির দিকেই আমি চলে যাই বাংলাদেশে। যদিও এর আগে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও যেতে পারি নাই।

ঠিকানা : কেন?

ফরহাদ মজহার : কারণ, তখন দেশে নকশাল পন্থীদের বিরুদ্ধে জিয়াউর রহমানের বড় ধরনের একটা অপারেশন চলছিল। এর ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছিল জাসদের গণবাহিনীর  বিরুদ্ধে রক্ষিবাহিনীর তৎপরতার মত। আমি নিউইয়র্কে তখন এর বিরুদ্ধে মানবাধিকারের বিষয়টি তুলে ধরে ক্যাম্পেইন করছিলাম। তাহেরকে যখন ফাঁসি দেয়া হয়, তখন এখানে যে মেজর ক্যাম্পেইন হয়- সেটার অগ্রভাগেও ছিলাম আমি। এখানকার স্টেট ডিপার্টমেন্টে, কংগ্রেসম্যান-সিনেটরদের কাছে তুলে ধরতাম দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি।

ঠিকানা : আপনি কী ফাঁসির বিরুদ্ধে ছিলেন?

ফরহাদ মজহার : অবশ্যই, সন্দেহ নেই তাতে। আমি গোপন বিচারের বিরুদ্ধে ছিলাম। ৭৭-এ ফিরে দেশে তাহেরের উপর গানও (এত অন্ধকার.... এত অন্ধকার..) গাই। তার জন্য বাংলাদেশ থেকে আমাকে আবারও তাড়িয়ে দেয়া হয়। ৮০ সালের দিকে আমি ফিরে যাই দেশে। তখন গণস্বাস্থ্যের জাফরুল্লাহ চৌধুরী খুঁজছিলেন একজন টেকনিক্যাল লোক। তিনি একটা ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রী করতে চান। অনেক বেতন দেয়ার ক্ষমতা উনার নেই। অনেকটা ভলান্টিয়ার সার্ভিস দিতে হয় আমাকে। যদিও এরই মধ্যে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম আর আমেরিকায় থাকবো না। এদেশে আমি কখনো থাকতেও চাইনি। প্রথম সুযোগেই ফিরে যাই। শর্ত দেওয়া হয়, দেশে ফিরলে গণস্বাস্থ্যের ক্যম্পাসের গণ্ডির মধ্যেই থাকবো।

ঠিকানা : আপনি ফেরত গেলেন ৮২ তে?

ফরহাদ মজহার : না। জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছেন ৩০ মে ১৯৮১ সালে, আমি তার আগে থেকেই বাংলাদেশে, গণস্বাস্থ্যে কাজ করছি।

ঠিকানা : তখনতো ১৯৮২ সালে জিয়াউর রহমান পৃথিবীতেই নেই?

ফরহাদ মজহার : ফার্মাসিটিক্যাল করা শুরু হয় ৮০ সাল থেকেই। গণস্বাস্থ্যে যোগ দিয়েছি ৮০ সালের শেষার্ধে কিম্বা ৮১ সালে। সঠিক তারিখটা আমার মনে নেই। জিয়াউর রহমান নিহত হবার বছরখানেকের মধ্যে আমি গণস্বাস্থ্য থেকে বের হয়ে আসি। জড়িয়ে পড়ি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে। সেখান থেকেই ছোট ছোট স্টাডি সার্কেল, ট্রেড ইউনিয়ন মুভমেন্টের সাথে যুক্ত হওয়ার মধ্যে দিয়ে আমার আরেকটা জগত তৈরি হয়। আর ওদিকে এসব তৎপরতার সাথে সে সময় থেকেই যে প্রতিষ্ঠান আমি গড়ে তুলি তার নাম ‘উবিনীগ’ (উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা)। প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিল মেইন স্ট্রীমের উন্নয়ন নীতি সংক্রান্ত চিন্তা ভাবনাকে সমালোচনা করা। পালটা গণমুখি নীতির পক্ষে কথা বলা। বাংলাদেশের জন্য একটা ইতিবাচক জায়গা তৈরি করা। উবিনীগ সেখান থেকেই ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা পায়। এরপর বিস্তৃতি ঘটে ।

আপনি প্রথমেই যে প্রশ্নটি করেছিলেন সেখানে ফিরে যাই। এত লম্বা কাহিনী বলার পেছনে কারণটা হোল এই যে অনেকগুলো দাগ আছে চিন্তার, মোড় আছে গুরুত্বপূর্ণ জায়গার। একাত্তর আমাকে নিজের শ্রেণী থেকে নিজের রূপান্তর ঘটাতে সহায়তা করে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সহায়তা করে, তত্ত্বগত বিষয়গুলোও নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে, এই দিকগুলোর ওপর জোর দেওয়ার দরকার।

একাত্তর একই সঙ্গে বিপ্লবী রাজনীতির পরাজয়ও বটে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিজয়। একাত্তরের পর এটা পরিষ্কার হতে শুরু করে যে আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিপ্লবী কোন কর্মকান্ড যদি আমরা চালাতে চাই, তাহলে আমাদেরকে নতুন করে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা করতে হবে, প্রথাগত চিন্তা ভাবনার খোলস ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে হবে, ছকবাঁধা গোলকধাঁধার মধ্যে পথ হাতড়ালে চলবে না। নতুন চিন্তার জগতে প্রবেশ করতে হবে। নিউ ইয়র্কে যখন ছিলাম তখন আমি পাশাপাশি সেই কাজটা করার চেষ্টা করি। দেশে ফিরে চেষ্টা করেছি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছু কাজ করতে। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে রাজনৈতিক দল সংগঠিত করার যে যোগ্যতা থাকা দরকার সেটা বোধহয় আমার নাই। আমি ক্রিয়েটিভ মানুষ, লেখালেখি করি, চিন্তা করতে পছন্দ করি, নতুন চিন্তা দাঁড় করাতে চাই; ফলে আমাকে কাজের জন্য এমন জায়গা বেছে নিতে হয়েছে যা দলীয় ও পুরানা বাঁধাবুলির অধীন নয়, কিন্তু যে শ্রেণির জন্য আমি কাজ করতে চাই সে কাজ যেন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।

দলীয় কায়দায় কাজ করার জন্য আমি উপযুক্ত নই এ ধরনের ফিলিংস এসেছে ৯০ দশকের শুরু কিম্বা মাঝামাঝি সময় থেকে। তখন পুরোদমে হিউম্যান রাইটস বলুন, উন্নয়নের ইস্যুর ক্রিটিক বলুন- এসব কাজগুলো লেখালেখি ও অন্যান্য সামাজিক তৎপরতার মাধ্যমে করবার দিকে মনোযোগটা দেই। এই হলো আমার ‘হয়ে উঠবার’ কিছু দিকের খবর, আমার ডেভলপমেন্টের কম-বেশী জায়গা। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক ও ব্যবস্থা মানবেতিহাসের চরম বা শেষ পরিণতি নয়, এর রূপান্তর ঘটবে, কারন তারপরেও মানুষের ইতিহাস আছে। এই ব্যবস্থার বিলয় বা রূপান্তর ঘটানোর প্রশ্নে নীতিগত কোন পরিবর্তন আমার ঘটে নি। তত্ত্বগত দিক থেকে মার্কস বরাবরই আমার চিন্তার কেন্দ্রে ছিলেন, এখনও আছেন। কোনই পরিবর্তন হয়নি। তবে মার্কস মানুষের চিন্তার বিকাশের শেষ কথা নয়। কিম্বা মার্কসই শুধু মানুষের মুক্তির জন্য ভেবেছেন, এতাও ঠিক নয়। অন্যদিকে মার্কসের নামে, ‘মার্কসবাদ’ নামে ও মার্কসবাদ হয়ে যে ধারার সঙ্গে আমরা বিশেষ ভাবে পরিচিত তার সঙ্গে খোদ মার্কসের চিন্তার ঘোর অসঙ্গতি আছে এটা আমি নিউ ইয়র্কে থাকতেই সরাসরি মার্কস পড়তে গিয়েই টের পাই। আমার কাছে মনে হয়েছে, চিন্তার দিক থেকে আমি এগিয়েছি। আমার মনে হয়েছে ‘মার্কসবাদ’-কে নয়, বরং বাংলাদেশে খোদ কার্ল মার্কসকে পরিচিত করানোর কাজটিই বিশেষ দরকার। বিশেষ করে বদ্ধমূল চিন্তা থেকে মুক্ত হওয়া, চিন্তা করতে শেখা, চিন্তা ও মতের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখা। ...

ঠিকানা : আপনি কোন দলে ছিলেন?

ফরহাদ মজহার : শুরুতে ছিলাম পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের সাথে। যেখান থেকে সর্বহারা পার্টি গড়ে ওঠে। সেই সময়ে আমাদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ থিসিস ছিল। একটা ছিল, দুই অর্থনীতি তত্ত্বের সমালোচনা করা। আমিতো করতামই। আমি এখনো মনে করি, এ সমালোচনা সঠিক ছিল।

ঠিকানা : অর্থনীতির কোনটা মার্কসীয় এবং ক্যাপিটালিজম?

ফরহাদ মজহার : আমি তাহলে তত্ত্বটাই বলি, বুঝতে সুবিধে হবে। তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদী অর্থনীতিবিদ, যেমন রেহমান সোবহান ও অন্যান্যেরা পশ্চিম ও পূর্বপাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিরোধ বা সংঘাতের জায়গাটাকে একটা জাতিগত বা রেসিস্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে ব্যাখ্যা দিতেন। যেমন পাঞ্জাবিরা বাঙালিদের শোষণ করছে। কেন করছে? কারন পাঞ্জাবিরা জাতিগত ভাবেই খারাপ। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্বপাকিস্তানের জনগণের লড়াই ব্যখ্যা করা হোত বাঙালির বিরুদ্ধে পাঞ্জাবিদের লড়াই হিশাবে। এখনও বাংলাদেশের ইতিহাস এইভাবেই লেখালিখি চলছে। এইভাবেই আমরা ইতিহাস পড়ি। বাংলাদেশের সাহিত্যের মধ্যেও এই জাতিবাদী দম্ভের বর্ণবাদ পুরামাত্রায় হাজির আছে। এই জাতিয়তাবাদী বয়ানে একাত্তর হচ্ছে পাঞ্জাবি জাতির বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির লড়াই। পাকিস্তানিদের মধ্যে প্রধান ছিল পাঞ্জাবি। বলা হোত এই জাতিবাদী কারনেই বাংলাদেশে তখন দুই অর্থনীতি বিরাজমান ছিল। কিন্তু আমরা বলতাম একাত্তরের বিরোধ সংঘাতের অর্থনৈতিক মর্ম জাতিগত নয়।

আমাদের বক্তব্য ছিলো ভিন্ন। পাকিস্তান আমলে যে অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য রাষ্ট্রীয় নীতি ও পরিকল্পনার প্রয়োগ চলছিল সেটা ছিল পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতি। সেই সময়ের পাকিস্তান সরকারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা কনসালটেন্টরা উন্নয়ন সংক্রান্ত পরামর্শ দিতেন। সেই পরামর্শ ছিল পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতি বিকাশের পরামর্শ।

মার্কিন সাহায্যে ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্যোগে সামন্ত ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে ওপর থেকে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক গড়ে তুলবার যে-প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়ার কারনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি, সেই দিকে নজর ছিল না কারুরই। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের মূল কারণটা বুঝতে হলে তাহলে সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দ্বারা পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক গড়ে তুলবার প্রক্রিয়াটা বোঝা জরুরী। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের বিরোধ বোঝা ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে জাতিবাদী দুই অর্থনীতির তত্ত্বের বাইরে আমরা ভেবেছি। পুঁজিতান্ত্রিক ডেভলপমেন্টের চরিত্রই হচ্ছে কৃষিকে শোষণ করে শিল্পায়ন ঘটানোর পথ। গ্রাম ধ্বংস করে শহর বানাবার নীতি।আর সেই সময়ে বাংলাদেশ ছিল কৃষিপ্রধান দেশ। শিল্পায়নটা ঘটছিল পশ্চিম পাকিস্তানেই। ফলে এই ধরণের পুঁজিতান্ত্রিক উন্নয়ন নীতি পাকিস্তানের দুই অংশকে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। পশ্চিম পাকিস্তান শোষণ করছে পূর্ব পাকিস্তানকে -- এই ভাবে পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির অসম বিকাশ হাজির হয়। পুঁজিতান্ত্রিক উন্নয়ন নীতির কারণে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সেই সময় অর্থনৈতিক অসাম্য গড়ে ওঠে, রাজনৈতিক স্তরে যা বাঙালি জাতিসত্তা উপলব্ধি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অর্থনৈতিক মর্ম যে মূলত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অধীনে পুঁজিতান্ত্রিক পাকিস্তান গড়ে তোলার বিরোধিতার মধ্যে নিহিত সেই দিকটি আমরা আমাদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম চরিত্রের দিক থেকে একারনে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সেই দিকে নজর ফেরানোর জন্য ‘দুই অর্থনীতির’ তত্ত্ব আমাদের বাতিল করতে হয়েছে। খারিজ করে দিতে হয়েছে। একাত্তরে বাংলাদেশে বিপ্লবী রাজনীতির ধারা পরাজিত হবার কারনে এই গুরুত্বপূর্ণ তর্কগুলো আমাদের ইতিহাসে স্থান পায় নি। সেই সময় এই কাজগুলো স্টেন্সিল করে, লিফলেটে, ছোট ছোট পুস্তিকায় বের করা হোত। সেই সবের হদিস পাওয়া এখন অসম্ভবই বলতে হবে।

দ্বিতীয়ত, মূলত পাকিস্তান ছিল একটা ‘ফিউডাল স্টেট’, সেখানে সামন্ত প্রভূদের দৌরাত্ম ও প্রতিপত্তি এখনও আমরা দেখছি। সাতচল্লিশ সালে পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকরা পাকিস্তান সাপোর্ট করেছিল। কারণ তারা স্থানীয় জমিদার ও মহাজনদের হাত থেকে মুক্তি চেয়েছিল। তারা মনে করেছিল, ভারত থেকে আলাদা হলে তারা মুক্ত হবে। পূর্ব পাকিস্তানে যারা জমিদার-মহাজন ছিল, তাদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু। সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান কৃষকরা মনে করেছে, মুক্ত হলে তারা জমিদার-মহাজনদের হাত থেকে রক্ষা পাবে। একই জিনিষ কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে ঘটে নি। যেহেতু সেখানে ফিউডাল লর্ডরা ছিল মুসলমান, ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে কৃষকরা তাদের সামন্ত প্রভুদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে মনে করবার কোন কারন ঘটে নি। অতএব জনগণের বৃহৎ একটি অংশ কিন্তু পাকিস্তানের পক্ষে ছিল না। আমরা অনেকেই এই ইতিহাস সম্পর্কে জানিনা। সেই সময়ে পাকিস্তানের বিপ্লবী রাজনীতির প্রায় প্রতিটি ধারাই পুরা পাকিস্তানব্যাপী গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলত। এটাই ছিল তাদের স্বপ্ন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি এই ধারা থেকে আলাদা ছিলেন না। তারা মনে করতো পাকিস্তানের সমগ্র অঞ্চলে জমিদার মহাজনদের সমূলে উচ্ছেদ করাই সেই সময়ের প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য। বলা হোত, কৃষিতে সামন্ত সম্পর্ক উৎখাত করে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হবে যাতে উৎপাদন শক্তির দ্রুত বিকাশ ঘটে।

আমাদের আরেকটা বক্তব্য ছিল, যদি আমরা পুরো পাকিস্তান জুড়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লব করতে না পারি, ফিউডালিজমকে ধ্বংস করতে না পারি, পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটাবার রাজনীতি যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে তার প্রভাব হবে সুদূর প্রসারী। আমরা ৬৯-এ বলেছি, বাংলাদেশ যদি পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাহলে বিচ্ছিন্নতার জন্য তাকে ভারতের অধীনস্থ দেশ হবার নিয়তি বরণ করতে হবে। সেটা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক হবে না। এই বিপদ থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা ও দাবিদাওয়াকে উপেক্ষা করাকেও আমরা ভুল মনে করেছি। দূরদৃষ্টিগুলো ভুল ছিলনা, কিন্তু ভারতের অধীনস্থ হয়ে যাবার যুক্তিতে যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সে কারনে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলন বলেছিলেন তাদের সেই অবস্থান সঠিক ছিল না। আমরা তা সমর্থন করি নি। ইসলাম রক্ষার অজুহাতে যারা জনগণের জাতীয়তাবাদী আকাংখাকে উপেক্ষা করতে চেষ্টা করেছিল তারাও ভুল ছিল এবং কার্যত তারা পাকিস্তানের সামন্ত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করবার চেষ্টাই করছিল, ইসলামের নয়। মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়ে যারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং একই সঙ্গে ভারতীয় আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, অবস্থান নিয়েছিলেন তারাই বরং সঠিক ছিলেন।

তবে ভুলের জায়গাটা ছিল এই যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যে শক্তি তার গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে বিপ্লবী রাজনীতি যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় নি। জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান, নাকি শ্রেণি দ্বন্দ্ব -- এই প্রশ্নে অধিকাংশ বিপ্লবী ধারাই শ্রেণি দ্বন্দকেই প্রধান দ্বন্দ্ব বলে গণ্য করেছে এবং জনগণের জাতীয়তাবাদী আকাংখাকে উপেক্ষা করেছে। সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে যে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে তাদের বুঝতে বামপন্থিরা ব্যর্থ হয়েছে। এই শ্রেণির সম্ভাব্য ঐতিহাসিক ভূমিকা তারা আন্দাজ করতে পারে নি। মধ্যবর্তী শ্রেণী, তার যে জাতীয়তাবাদী আকাঙ্খা, তার যে জাতিগত চিন্তা --বাঙালি জাতীয়তাবাদ যাকে আমরা বলি -- এটা যে একটা রাজনৈতিক শক্তি, এই শক্তিকে বিপ্লবী রাজনীতি আন্ডারমাইন করেছে। এই শক্তির সঙ্গে শ্রেণী রাজনীতির সম্পর্ককে সমন্বিত করতে পারে নি। এই ক্ষেত্রে মাওবাদী বলুন বা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর যারা সেইসময় বলছিলেন সেই সোভিয়েটপন্থি কমিউনিস্টদের কথা বলুন উভয় ধারাই ব্যর্থ হয়েছে। যার কারণে শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন তথা রাজনৈতিক আন্দোলনে বাংলাদেশের বামপন্থীদের প্রধান ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও দেখা গেল ৭১-এ তারা ব্যর্থ । শুধু প্রধান ভূমিকা ছিল বললে শেষ হবে না, এই ভূমিকা ছিল অসাধারণ এবং গৌরবজনক।অন্যদিকে ৭০-এ ভাসানীকে তারা নির্বাচনে নেয়নি, নির্বাচন থেকে সরিয়ে নেয়। নিয়ে যাবার কারণে বুর্জোয়া লিগালিটির যে ফ্রেমওয়ার্ক, সেই কাঠামোর মধ্যে নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধি হিশাবে শেখ মুজিবরের আবির্ভাব ঘটা সম্ভব হয়েছে। অথচ শেখ মুজিব সব সময়ই পাকিস্তানি শাসক শ্রেণির লেজুড়বৃত্তি করেছে। শেখ মুজিব সব সময়ই অটুট পাকিস্তান হোক কি হোক স্বাধীন পুর্ব বাংলা -- গণতান্ত্রিক বিপ্লবী রূপান্তরের রাজনীতিকে উপেক্ষা করেছে, খাটো করে দেখেছে এবং সবসময়ই বিরোধিতা করেছে। শুধু বিপ্লবী রাজনীতির ধারা নয়, এটাই তো সোহরওয়ার্দ্দি বা শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভাসানি ন্যাপ বা বামপন্থীদের মৌলিক রাজনৈতিক ফারাক। এই একই কারণে আজও স্বাধীন বাংলাদেশ হবার পরও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বিপ্লবী রূপান্তরটা ঘটেনি, অসমাপ্ত রয়ে গেছে। নানান আবর্জনায় আমরা এখন হিমশিম খাচ্ছি।

একদিকে নির্বাচন অন্যদিকে মৌলিক গণতান্ত্রিক রূপান্তরের বিরোধিতা – এই দুটো কারণেই বাঙালিদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিশাবে শেখ মুজিবরের আন্তর্জাতিক গ্রহণ যোগ্যতা স্বভাবতই বেড়ে গিয়েছিলো কয়েকগুণ। গণ অভ্যুত্থান সংঘটিত করা, আয়ুবের ক্ষমতা হস্তান্তরের গোল্টেবিল বৈঠকে আলোচনা বর্জন, শেখ মুজিব কারাগার থেকে মুক্তির আন্দোলন ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে মওলানা ভাসানীর বিশাল অবদান থাকা সত্ত্বেও ৭০’র নির্বাচনে অংশ না নেয়ার কারণে তিনি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতাও হারালেন তিনি। বামপন্থিরা এই সর্বনাশগুলো ঘটিয়েছিল। সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে নতুন গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিশাবে শেখ মুজিব এই পরিস্থিতিতে যে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে তার মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও এখন দেখি বামপন্থিদের এক পক্ষের অস্বস্তি, আবার আরেক পক্ষের নির্বিচার গদ গদ ভাব। মেঘ তো এখনও কাটে নি। এগুলো ঐতিহাসিক ঘটনা।

এজন্য ষাট ও সত্তর দশকে বাংলাদেশের বিপ্লবী রাজনীতি যে ইতিবাচিক ভূমিকা রেখেছে তাকে বাদ দিলে উনসত্তরের গণভ্যুথান এবং পরিণতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই ইতিহাস মুছে ফেলবার একটা চেষ্টা জারি রয়েছে। সেই সময় আওয়ামী লীগের শ্রমিকদের ওপর তেমন কোন প্রভাব ছিল না। বা শ্রমিকদের জন্য রাজনীতি বলতে আমরা যা বুঝি তার কিছুই ছিল না, রাজনৈতিক অনুসারী বাদ দিলে আওয়ামি লীগের প্রভাব প্রধানত ছিল ছাত্রদের মধ্যে; তাও একার না, বামপন্থিদের সাথে মিলে ভাগাভাগির ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এর সাথে শ্রমিক আন্দোলনের যোগাযোগটা ঘটিয়ে দিয়ে ৬৯ এর পুরা আন্দোলনের চরিত্র বদলে দেবার ক্ষেত্রে বামপন্থিরা গুরুতপূর্ণ ও মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। মোহাম্মদ তোয়াহা তার অন্যতম। ভূমিকা রেখেছিল তোয়াহার শ্রমিক ফেডারেশন। ভুলে যাওয়া অন্যায় যে পাকিস্তান আমলে তোয়াহার নেতৃত্বের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের কারণে শ্রমিকের পক্ষে মুখ্য আইন গুলো হয়েছে সেই ষাটের দশকে, যেগুলো এখনও বাংলাদেশে বলবত আছে। যদিও স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার এখন কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

ফলে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের নেতা আওয়ামী লীগ একা তো নয়ই বরং নির্ধারক ছিল ভাসানীর নেতৃত্ত্বে চীনাপন্থি বিপ্লবী বাম ধারা বা বামেরা। তোয়াহার এই ভূমিকাকে যদি তত্ত্বগত ভাবে বিচার করি তাহলে বলা যায় এটা ছিল শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ও নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করবার কর্তব্য পালনের চেষ্টা। শ্রমিক শ্রেণি মধ্যবিত্ত বা পেটি বুর্জোয়া শ্রেণির আন্দোলনে শামিল হবার কারণেই উনসত্তরের সফল অভুত্থান ঘটেছে। যদি বামপন্থিদের নেতৃত্বাধীন শ্রমিক আন্দোলন ষাট দশকে ভূমিকা না রাখত বাংলাদেশে উন্অসত্তরে গণভ্যুত্থানও ঘটত না, বাংলাদেশও স্বাধীন হোত না।

আমি মনে করি, এই যে ৭১-এ কমবেশি বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি প্রগতিশীল ধারা রেসিস্ট বা বর্ণবাদী বাঙালি জাতীয়তাবাদী ব্যাখ্যার বিপরীতে পাকিস্তানের দুই অংশের অর্থনৈতিক বিরোধ সম্পর্কে যে-অবস্থান নিয়েছিল সেই থিসিসটি ছিলো সঠিক। কিন্তু এই দ্বন্দের রাজনৈতিক বহির্প্রকাশকে তারা পাত্তা দেয় নি। বামপন্থীদের প্রধান ভুল ছিলো, তারা জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক প্রশ্নটাকে উপেক্ষা করেছে এবং এটাকে তারা খুব হালকাভাবে নিয়েছিল।

ঠিকানা : আপনারা বার বার জনগণের রাজনীতি করেও জনগণ থেকে কেন বিচ্ছিন্ন?

ফরহাদ মজহার : সেটা অন্য তর্ক। কিন্তু তারই তো উত্তর দিলাম ওপরে। ভাসানি প্রসঙ্গে যেমন। এর তত্ত্বগত ভুল হচ্ছে রাজনীতি ও অর্থনীতির সম্পর্ক বুঝবার সমস্যা। রাজনীতিকে যদি শুধু অর্থনীতি বা অর্থনৈতিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব দিয়ে আপনি বোঝার চেষ্টা করেন, রাজনীতির নিজস্ব বৈশিষ্ট স্বভাব ও ক্ষেত্র উপেক্ষা করে, তাহলে জনগণ অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার জন্য আপনার কাছে ভিড়বে হয়তো, কিন্তু রাজনীতির জন্য বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেই যাবে, বামপন্থিদের মাড়িয়ে। তাইতো ঘটছে।

তবে জনগণ থেকে বিপ্লবী বাম ধারার বিচ্ছিন্নতার অন্য কারনও আছে। শুধুমাত্র তত্ত্বটাই কারণ নয়, কৌশলের পথ নির্ণয় – যেমন, ক্ষমতা হস্তান্তরের আলোচনা বা LFO বর্জন, নির্বাচনকে সর্বক্ষেত্রে অস্বীকার করার পথ -- এরকম অনেকগুলো কারণ আছে। বিপ্লবী রূপান্তরে সামরিকতার একটা ভূমিকা আছে। কিন্তু সেই কৌশলকে ক্ষমতাসীন শ্রেণি অনায়াসেই ‘সন্ত্রাস’ হিশাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। এখনকার বিচ্ছিন্নতার ক্ষেত্রে একাত্তরের পরাজয় যেমন আছে, সেই সঙ্গে রয়েছে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, চিনের পুঁজিবাদী রূপান্তরের পথ পরিগ্রহণ এবং সামগ্রিক ভাবে পৃথিবীব্যাপী বিপ্লবী প্রতিশ্রুতির ক্ষয়। বাংলাদেশের ওপরেও এই সকল ঘটনা প্রকট প্রভাব বিস্তার করেছে। এর জন্য বাংলাদেশের বামপন্থিরা পুরাপুরি দায়ী নয়। তবে বিপ্লবী রাজনীতি পুনর্গঠনের জন্য তত্ত্বচর্চা ও তার সঙ্গে সঙ্গতিপরায়ন যে তৎপরতা দরকার সেখানে মারাত্মক অভাব আছে। আমি মনে করি শ্রেণীর প্রশ্ন এবং জাতি দ্বন্দ্বের প্রশ্নকে নিরসন করতে না পারাটা একাত্তরে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার দায় বাংলাদেশকে এখনও বহন করতে হচ্ছে। এখন শুধু আওয়ীমী লীগকে দোষারোপ করলে হবে না, বিএনপিকে দোষারোপ করলে হবে না, নিজেদের ব্যর্থতা নিজেদেরই চিন্তা ও কাজের মধ্যে আগে অনুসন্ধান করতে হবে। ক্রিটিকালি চিন্তা করবার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যুতে শ্রেণি রাজনীতির জায়গা থেকে সঠিক অবস্থান নেবার শক্তি অর্জন করতে হবে। জাতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবার নীতি ও কৌশলের ক্ষেত্রে বামপন্থিরা এখনও দুর্বল।

ঠিকানা : আপনার চারপাশের সহযোগী সহকর্মী তারা আপনাকে সমাজের প্রচলিত ধারার মানুষের চাইতে আলাদা মনে করে। তাদের এই উপলব্ধিকে আপনি কীভাবে উপভোগ করেন?

ফরহাদ মজহার : বিপ্লবী মানুষকে আলাদা হতেই হবে, এই রকম কোন পূর্বানুমান আমার নাই। আমি যা চিন্তা করি, তা সহজ সরল ভাবে হাজির করি। প্রথাগত চিন্তার সঙ্গে সেটা মেলে না বলে আমাকে হয়তো আলাদা মনে হয়। আর আমিতো ঠিক উপভোগ করি না। বরং আমি মনে করি আমি আমার কাজের মধ্য দিয়ে স্বার্থক কিনা তার পরীক্ষা দেওয়াই আমার কাজ। উপভোগ করা তো সেই পরীক্ষা দেওয়া নয়। আমি চিন্তার মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছি কি না, এই দিকটাও আমাকে যথেষ্ট ভাবায়। স্বভাবতই। আমিতো চিন্তা করার জন্য চিন্তা করি না। চিন্তা করি সমাজকে প্রভাবিত করার জন্য, সমাজকে একটা খাপে বা একটি অভিমুখে নেওয়ার জন্য। এক ধরনের রাজনৈতিক লড়াকু চরিত্র আমার মধ্যে আছে। ফলে আমি উপভোগ বলবো না, তবে আমাকে যদি এই দিক থেকে আলাদা মনে হয় তো সেই দিক থেকে সেটা আমার কাছে খারাপ লাগে না। ভালোই লাগে। তবে কেউ যদি অতি আওয়ামী লীগ বা অতি বিএনপি মনা না হয় আমি সাধারণত দেখি যে তারা আমার চিন্তার কাছাকাছি চলে আসে।

ঠিকানা : মানে তারা আপনাকে বুঝতে পারে?

ফরহাদ মজহার : বুঝতেও পারে এবং আমার পক্ষে একটা নীরব বা সরব সমর্থনও থাকে। আমি অনেকগুলো বড় বড় রাজনৈতিক সঙ্কট পেরিয়ে এসেছি মূলত এদের সমর্থনের কারণেই। নানা সময়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক বিপদ আমার ওপরে এসেছিলো। ’৯৫ সালে বেগম খালেদা জিয়া আমাকে জেলে দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ পারলে যেখানে সেখানে পিটিয়ে মারে। আমিতো এসব মোকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছি। সম্প্রতি হিউম্যান রাইটস বিডিআর-এর বিষয়ে যে রিপোর্ট দিল, সেখানে যেসব মানবাধিকার কর্মী এই সংস্থাটির সঙ্গে সহায়তা করেছে বলে সরকার অভিযোগ তুলছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে এখানে বসে শুনেছি। আমি মানবাধিকার নেটয়ার্ক ‘অ্ধিকার’-এর উপদেষ্টা। সেই ক্ষেত্রে ‘অধিকার’-এর সহযোগিতা থাকায় এখন সরকার মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে বলে এখানে শুনেছি। সে জন্য তারা মেরেই ফেলে না জেলে ঢুকায়, কিছুই বলতে পারবো না। কাজটাতো মানবাধিকার কর্মীদের করতেই হবে, আমরাতো বসে থাকতে পারবো না। মানবাধিকারের বিষয়ে আমাদের কথা বলতেই হবে। কারণ মানবাধিকার আন্দোলন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথে যুক্ত। আমরা অনেক সময় কথায় কথায় বলি, হাসিনা-খালেদার অভিশাপ থেকে মুক্তি চাই। এ কথাতো ব্যক্তি আকারে বললে হবে না। আপনি ইচ্ছে করলে আওয়ামী লীগের নাম মুছতে পারবেন না, বিএনপির নাম ইচ্ছে করলে মুছে ফেলতে পারবেন না। তাহলে কোন নীতির ভিত্তিতে আপনি জনগণকে একত্রিত করবেন? বাংলাদেশের জন্য কী দরকার? এই কথাটা যদি আমরা সামনে না নিয়ে আসতে পারি-তাহলে রূপান্তরটাতো ঘটবে না। এটা ব্যক্তিকে সরানোর প্রশ্ন নয়, এটা সমাজকে , রাজনৈতিক কাঠামোকে বদলানোর প্রশ্ন। এই জায়গাতেই মানবাধিকার একটা গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। মানবাধিকার শিক্ষা একটা ‘টুল’ হতে পারে। আজকে বিচারকের কাছে গেলেই অভিযুক্ত নাগরিককে রিমাণ্ডে নিতে পারে। এটাতো আপনি পারেন না। এটা সম্পূর্ণভাবে মানবতাবিরোধী। টর্চার করে তার কাছ থেকে তথ্য আদায় করে স্বীকারোক্তি নেবেন, এটা মানবাধিকার বিরোধী। কিন্তু বিচার বিভাগ একটি দলের পক্ষে এই অন্যায় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এ সবের বিরুদ্ধে আমরা কাজ করছি। আমরা করছি-একটি নির্দলীয় প্লাটফরম থেকে। না করলে সাধারণ মানুষ সচেতন হবে কীভাবে? আর সচেতন হলে এটাই হবে আমাদের ৫ জনের একত্রিত হওয়ার জায়গা। আমাদের মানবিক অধিকার বা ব্যক্তির যে-অধিকার, যে-অধিকার রাষ্ট্রের নির্বাহী, আইন প্রণয়নী সংস্থা বা বিচার বিভাগ কখনই হরণ করতে পারে না, তার নিশ্চয়তা কিন্তু আমাদের সংবিধানে নেই। অতএব আমাদের একটা ‘সংবিধান’ লাগবে, যে সংবিধানে এই অধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে।

ঠিকানা : সংবিধান না গঠনতন্ত্র?

ফরহাদ মজহার : ঠিক ধরেছেন। আমি সংবিধান ব্যবহার করি না। শব্দটা ‘কলনিয়াল টার্ম’। আপনি যখন শাসক, শাসন করবার জন্য শাসকের একটা দলিল দরকার-তাকে বলে ‘সংবিধান’। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে – বিশেষত যে দেশটি রাজনৈতিক ভাবে নিজেকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ বলে দাবি করে -- সেখানে তো রাষ্ট্র শুধু শাসক আর শাসিতের আইনের ওপর দাঁড়ায় না। দাঁড়ায় জনগণের ইচ্ছা, অভিপ্রায় ও সংকল্পের ওপর। ‘বিধান’ বা শাসিতদের শাসন করবার আইন থেকে ‘সংবিধান’। শাসকের ‘সংবিধান’।

অথচ কনস্টিটিউশনের বাংলা কিন্তু ‘সংবিধান’ নয়। বাংলা হওয়া উচিত ‘গঠনতন্ত্র’ -- রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ‘গঠিত’ হয়। সেই গঠনের দলিল হচ্ছে ‘গঠনতন্ত্র’। রাষ্ট্র গঠনের সময় জনগণের বিভিন্ন অংশ, তাদের বিভিন্ন ইচ্ছা, অভিপ্রায় ও সংকল্পকে একটা সাধারণ বা সার্বজনীন রূপ দেবার প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয়। এটা কোন ব্যক্তি, দল বা মতের চাপিয়ে দেবার ব্যাপার নয়। সে কারণে গঠনতন্ত্রে কী আছে তার চেয়ে কিভাবে সেটা প্রণীত হোল এবং জনগণের বিভিন্ন অংশের অংশগ্রহণ কিভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে সেইসব প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা শাসকের পক্ষে জনগণকে শাসন করবার ‘আইন’ নয়। বলাবাহুল্য যারা গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের বিরোধী তাদের ইচ্ছা, অভিপ্রায় ও সংকল্প গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ণের প্রক্রিয়ার অন্তর্ভূক্ত হওয়ার কথা নয়। অগণতান্ত্রিক শ্রেণি ও শক্তির পরাজয় নিশ্চিত করবার জন্য এই কারণেই বিজয়ী গণঅভ্যুত্থানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। আমরা ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হবার পরেও কোনো সংবিধান পাইনি। আওয়ামী লীগ যখন নির্বাচনে জিতে, তারা তখন একতরফা ঘোষণা করে বলে, পাকিস্তানের পার্লামেন্টে জনগণ যাদের পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য নির্বাচিত করেছে, তারাই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করবে। এটাতো হয় না। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য কখনই একটি গঠনতন্ত্র রচিত হয়নি। এটাই হলো বাংলাদেশের আদিপাপ। আমি মনে করি, বাংলাদেশকে আদিপাপ থেকে মুক্ত হতে হবে।

ঠিকানা : তাহলে ’৭২ সালে কী হয়েছিলো?

ফরহাদ মজহার : ’৭২ সালের কনস্টিটিউশন ছিলো দলীয় ড্রাফট। তারা তাদের দলীয় চিন্তা এবং একজন উকিলের মুসাবিদাকে বাংলাদেশের ‘সংবিধান’ হিশাবে চাপিয়ে দেয়। এটা তো বলাই হয় যে বাংলাদেশের সংবিধান কামাল হোসেন লিখেছেন আর অনুবাদ করেছেন আনিসুজ্জামান। তো একজন ব্যাক্তির রচনা কি করে একটি দেশের রাষ্ট্র গঠনের দলিল হতে পারে? আর এখন দেখুন, পঞ্চদশ সংশোধনীর পর বাংলাদেশের সংবিধান তো আসলে একটি দলেরই দলিল হয়ে গিয়েছে। এটা কোন রাষ্ট্রের দলিল নয়।

ঠিকানা : আপনি কি ঐ জন্যই বলেন এখনো রাষ্ট্র গঠিত হয়নি?

ফরহাদ মজহার : আমি এখনও বলি রাষ্ট্র গঠিত হয়নি। স্বাধীনতার পরে আমরা রাষ্ট্র গঠন করি নাই। আসলে রাষ্ট্র ব্যাপারটি কি এটা আমরা বাঙালিরা বুঝি না, দেশ ও রাষ্ট্রকে সমার্থক ভাবি। কারণ ঐতিহাসিক ভাবে আমাদের --বাঙালি বা বাংলাদেশীদের -- রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাই নেই। আপনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস দেখেন, তাদেরকে গঠনতন্ত্রের জন্য লম্বা লড়াই করতে হয়েছে, তাদের ড্রাফট করতে হয়েছে, ড্রাফট নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হয়েছে, ড্রাফটে সংশোধনী আনা হয়েছে, রেফারেন্ডামে যেতে হয়েছে।

আওয়ামী লীগকে আমরা ভোট দিয়েছিলাম পাকিস্তানের গঠনতন্ত্রের জন্য, বাংলাদেশের জন্য নয়। জাতীয় সরকারের অধীনে এটা করার কথা ছিলো। রাষ্ট্র গঠন সভা বা কনস্টিটিউশন এসেম্বলি ডাকার কথা ছিলো। আপনি সহজেই এক তরফা একটি সংবিধান ঘোষণা দিতে পারেন না। পাকিস্তানের সংবিধান সভার জন্য ’৭০’র নির্বাচনে জয়ী হয়েছি বলেই আমি স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান লিখবো, এটা হতে পারে না। আপনি পাকিস্তানের সংবিধান লিখেন, তার জন্যই তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ভোট দিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান থেকে লড়াই করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের জন্য নয়। এটাই হল বাংলাদেশের প্রধান সংকট, ‘ফান্ডামেন্টাল প্রবলেম’। ’৭২ সালে আমরা হয়তো এটা বুঝিনি, আমরা মনে করেছি একটা সংবিধান দরকার, তাই ৫/১০টি বই টুকলিফাই করে একটা থিসিস আকারে জমা দিলেন ব্যারিস্টার কামাল হোসেন। এমনকি ৭১ সালের ১০ এপ্রিল যখন মুজিব নগরে আওয়ামি লীগের নেতারা নিজেদের কনস্টিটুয়েণ্ট এসেম্বলী বলে ঘোষণা দেন, তারও কোন বৈধতা ছিল না। এই অধিকার আমরা তাদের দেই নি। আবার দেখুন বাহাত্তরের সংবিধানে যে চার নীতির কথা বলা হয়, মুজিব নগরের ঘোষণায় সেই চারনীতিও ছিল না। আ’লীগ যে ৪ নীতির কথা বলে সেইসব ছিল না। সেখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন ৩টি নীতির কথা আছে। সেই নীতিগুলো হচ্ছে, (১) সাম্য, (২) মানবিক মর্যাদা ও (৩) সামাজিক সুবিচার। তারপরও আপনি তর্কের খাতিরে বলতে পারেন এই ঘোষণার নিরিখে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। তা আপনি মেনে নেবের পক্ষে তর্ক করতে পারেন। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের পর হঠাৎ চার নীতি এল কোত্থেকে? যদি তিন নীতির জন্যই মুক্তিযুদ্ধ হয়ে থাকে? সেই সময় যে বক্তব্য ছিল পরবর্তী সংবিধানের সাথেও তার কোন মিল নেই।

এটা বুঝতে হবে বাংলাদেশের শুরুতেই আমরা একটা বিভাজনের রাজনীতি দিয়ে শুরু করেছি। দলীয় কর্মসূচি জনগণের ওপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেছি। রাষ্ট্র গঠনের ঐক্য দিয়ে আমরা শুরু করি নাই। এই দলবাজি ও বিভক্তির ধারা আমাদের ক্রমাগত ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে।

ঠিকানা : বাংলাদেশে ৪০ বছর ধরে এই যে জগাখিচুড়ী মার্কা অবস্থা চলছে, এর থেকে উত্তরণ কীভাবে সম্ভব?

ফরহাদ মজহার : এই যে আমরা ৫ জন এখানে বসে আছি। আমরা যদি ৫ জায়গা থেকেও আসি- আমাদের সবাইকে এখন খোলা মনে রাষ্ট্র গঠনের কথা ভাবতে হবে। বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিশাবে নতুন ভাবে গঠন করতে হবে সেই রাষ্ট্র গঠনের তিনটি ভিত্তি আমরা মেনে নিতে পারি কিনা তার জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। সেটা মোটেও কঠিন কিছু নয়। একাত্তরে একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে আমাদের অভ্যুদয় একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এবং এর মধ্য দিয়ে হাজির হওয়া স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের প্রধান কাজ। আমরা কারও উপনিবেশ হতে চাই না বা কারও করদ রাজ্যে পরিণতি লাভ করাও আমাদের পরিণতি হতে পারে না। এরপর রয়েছে নাগরিক ও মৌলিক মানবিক অধিকারের প্রশ্ন। দেশে দেশে গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই নীতিগুলো এখন প্রতিষ্ঠিত এবং আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত । এই ঐতিহাসিক ও সার্বজনীন স্বীকৃতির আলোকে মানবিক মর্যাদা এবং নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা নতুন গঠনতন্ত্রে নিশ্চিত করতে হবে আমাদের। আমাদের একমত হতে হবে যে একদিকে সমষ্টির নামে ব্যাক্তির বিকাশ রুদ্ধ করা যেমন গণতন্ত্রের পরিপন্থি, তেমনি আবার ব্যক্তির অধিকার রক্ষার নামে ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষা্র নির্বিচার স্বেচ্ছাচারিতাও গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্র ব্যাক্তির অধিকার তখনই স্বীকার করে যখন সমষ্টির প্রতি ব্যাক্তি নিজের দায় মানে। এই মানামানি আবার আইন করে বাধ্য করলে সেটা পুলিশি শাসনে পর্যবসিত হয়ে যেতে পারে। তার জন্য সচেতনতার দরকার, শিক্ষার দরকার এবং সর্বোপরি সাংস্কৃতিক চর্চার দরকার। ব্যক্তি নিয়েই সমষ্টি এবং সমষ্টির মধ্যেই ব্যক্তির স্বার্থ নিহিত এই উপলব্ধি ছাড়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র টেকে না। টিকতে পারে না। সমষ্টির স্বার্থ ক্ষুণ্ণ ও বিপন্ন করে ব্যক্তির টিকে থাকাও অবাস্তব। বাংলাদেশের নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হলে ব্যাক্তি ও সমাজের সম্পর্ক ‘গঠন’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তৃতীয় যে দিকটি বর্তমানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সেটা হচ্ছে পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণের বৈচিত্র নিশ্চিত করবার বিষয়টি। প্রজাতি হিশাবে সকল প্রজাতিই আজ বিপন্ন। পরিবেশ ধ্বংস করে ও অন্য প্রজাতির বিনাশ ঘটিয়ে আমরা নিজেরাই এখন বিপন্ন হয়ে উঠেছি। অতএব নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণের বৈচিত্র রক্ষার নীতিকে রাষ্ট্র গঠনের গোড়ায় স্হাপন করতে হবে।

তাহলে দেখুন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট গঠ্ন করবার লক্ষ্যে এই তিনটি নীতিগত ভিত্তি মেনে নেওয়া আমাদের জন্য কঠিন কিছু নয়। তাহলে এই তিনটি ভিত্তির প্রশ্নে আমরা একত্রিত হতে পারি কিনা আসুন সেই চেষ্টা করি। এই তিনটি নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়ে জনগণের কাছে যাই। তাদেরকে সচেতন করে তুলি। আমরা যদি শুধু নির্বাচনকেই একমাত্র সমাধানের পথ হিসেবে ধরি, তাহলে বারবারই আমরা প্রতারিত হবো। আজকে হাসিনা ক্ষমতায়। তাঁর বি্রুদ্ধে জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। কাল খালেদা আসবেন। জনগণ আবারও তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হবেন। যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনি একটি দলিল এবং দলিলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে না পারবেন -ততদিন এ অবস্থা চলবেই।

আবারও গণতন্ত্রের দিক থেকে রাষ্ট্রের তিনটি গাঠনিক ভিত্তির কথা সংক্ষেপে হাজির করবার চেষ্টা করি। একঃ শক্তিশালী গণপ্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা, দুইঃ মানবিক মর্যাদা ও নাগরিক অধিকার এবং তিনঃ পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণের বৈচিত্র রক্ষা ও বিকাশ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গাঠনিক দাবি হিশাবে আসুন আমরা এই তিনটি দাবির ওপর আন্দোলন গড়ে তুলি।

ঠিকানা : আপনাকে বিভিন্নভাবে বিশেষায়িত করা হয়। যেমন সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে। আপনি নিজেকে কী হিসেবে ভাবেন?

ফরহাদ মজহার : মানুষ হিসেবে আমি অতি নগণ্য। আমি চেষ্টা করি আমার চিন্তাটাকে মানুষের কাছে সহজভাবে তুলে ধরতে। কবিতা লিখি, অনেকে কবি বলে। রাজনৈতিক লেখালেখি করি, অনেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলে। তবে আমি নিজে বাংলাদেশে জন্মেছি, বাংলাভাষায় কথা বলি। এই দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে দেশ সম্পর্কে চিন্তা করি কোন দলীয় পক্ষপাত ছাড়া। বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশের যে অবস্থান সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মানুষের জন্য যেটা মঙ্গল সেটাই সহজভাবে বলার চেষ্টা করি। তবে আমি মানুষ ভজনা করি, কোন দেশ বা জাতির অহমিকা আমি চর্চা করি না।

ঠিকানা : আপনাকে অনেকে বাউলও বলে।

ফরহাদ মজহার : বাউল শব্দটা একটা নিন্দাবাচক শব্দ। যারা বলে কেন তারা বলে তাদেরকে প্রশ্ন করলেই ভাল হোত। যাই হোক, বাংলাদেশে একসময় কিন্তু একটা বিরাট দার্শনিক বিপ্লব ঘটে গেছে। সুলতানী আমলে শ্রী চৈতন্যের সময় থেকে শুরু করে ফকির লালন শাহ পর্যন্ত তার একটা বিকাশ আমরা লক্ষ্য করি ও ধরতে পারি। এটা ছিলো একই সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ভাবগত বিপ্লব। এটা বাউলগিরি করে রাস্তায় রাস্তায় ডুগডুগি বাজানোর বিপ্লব ছিলোনা। নিউ ইয়র্কে আপনি দেখেন হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ বলে মৃদঙ্গ-মন্দিরা বাজিয়ে চৈতন্য প্রেমিকরা সংকীর্তন করছে। এই দৃশ্য দেখে আপনার এখন আর বোঝার উপায় নাই শ্রীচৈতন্য একজন ব্রাহ্মণ হয়েও বর্ণাশ্রম প্রথায় জর্জরিত একটি সমাজে কিভাবে জাত-পাত বিরোধী সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর নিজের বর্ণ ও নিজেরই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। এই সময় তিনি বেঁচে থাকলে হয়ত অকুউপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনে যোগ দিতেন, কিম্বা পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণের বৈচিত্র রক্ষার সংগ্রামে জড়িয়ে পড়তেন। ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধ দেখে প্রতিবাদ করতেন ।

বর্ণাশ্রম প্রথা বা জাতপাতের ভেদ এখনো যায় নি, কিন্তু তার ওপর ইতিহাসের এই পর্যায়ে আমাদের নিজেকে বিকশিত বা নিজের পরমার্থিক তাৎপর্য উপলব্ধির ক্ষেত্রে প্রধান বাধা পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক। চৈতন্য প্রেমের কথা বলেছিলেন, ঠিক, কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রেম রচনার ক্ষেত্রে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কই তো প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চৈতন্য প্রেম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে তার সময়ের প্রধান বাধা বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, তাহলে এই আমলে প্রেম প্রচার ও মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রেমের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হলে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই ছাড়া কোন বিকল্প আছে কি? এটাতো আগে করতে হবে। সেই কর্তব্য পালন না করে কেউ যদি এই কালে হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ বলে শুধু নেচে বেড়ায় তাহলে চৈতন্য, নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতাচার্যের অপমানই বলা যায়। বাউল-বৈষ্ণবদের প্রতি নেতিবাচক হবার কারন এখানে খুঁজে পাবেন। আমাদের জীবনাচার ও ভাবগত অবস্থার সঙ্গে যখন সামাজিক-রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের কোন যোগ থাকে না তখন এই দুর্দশা ঘটে।

অন্যদিকে আবার এই অসুখের উলটা দিকও আছে। আপনি সামাজিক-রাজনৈতিক লড়াই করছেন, কিন্তু নিজের ভাব, ভাবুকতা, ভাবগত অবস্থার কোন পর্যালোচনা করছেন না, নিজে বদলাচ্ছেন না, আপনার নিজের জীবনাচারে কোন পরিবর্তন নাই, ভাবছেন সমাজ ও রাজনীতি বদলালে সব ঠিক হয়ে যাবে, আপনার নিজেকে বদলাবার কোন দরকার নাই -- সেটাও বিপদের। যারা ব্যক্তি মানুষকে বদলাবার কথা বলে তাদের মরমিবাদী, আধ্যাত্মিকতাবাদী ইত্যাদি বলে আপনি দূরে থাকেন। বিরোধিতা করেন। এটাও একটা অসুখ। এই দুই ধরণের অসুখে আমরা এই কালে ভুগছি। এই মুশকিল থেকে নিস্তার পাবার চেষ্টা করি আমি, সেটা অনেকের কাছে ‘বাউল’ হয়ে গিয়েছি মনে হতে পারে। কী করব? কেউ নিজের অসুস্থতাকে স্বাভাবিক মনে করলে স্বাভাবিক মানুষকেও ভিন্ন চোখে দেখে। কি আর করি!! আমাকে অনেক দূর একা একা পথ হাঁটতে হবে।

লালন কখনো বাউল ছিলেন না। একজন দার্শনিক হিসেবে, চিন্তাবিদ হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে বাংলার ভক্তি আন্দোলনের ইতিহাসটা আমাদের জানতে হবে, বুঝতে হবে। ঐ যে চিন্তার বড় ধরনের একটা বিপ্লব ঘটেছে, সেটা শনাক্ত করাটা খুবই জরুরী। কেন? কারণ সুলতানী শাসনামলে জাত-পাত বিরোধী এই রাজনৈতিক আন্দোলন একই সঙ্গে বাংলার ভাব ও ভাষাকেও সমৃদ্ধ করেছিলো। পাশাপাশি বিপুল একটা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল তৈরি করেছিলো। ঐ ধারার সঙ্গে যদি আমরা নাড়ির বাঁধনটা বাঁধতে পারি, তাহলে, আমার দাবি, বাংলাভাষীরা শুধু ভাবগত, জ্ঞানগত, সংস্কৃতিগতভাবে একটি উল্লম্ফনের শর্ত তৈরি করতে পারবে তা নয়, একটা রাজনৈতিক উল্লম্ফনও ঘটবে। ঐ জায়গায় যদি আমরা না দাঁড়াই, তাহলে বিশ্বের যে জ্ঞানের সভা- সেখানে আমরা আমাদের নিজস্ব ভাবুকতা ও রাজনৈতিক তৎপরতার জায়গায় দাঁড়িয়ে অংশ নিতে পারব না। বরঞ্চ পাশ্চাত্য চিন্তার অধীনস্থ একটা ‘কলোনাইজড’ মানসিকতায় বা মনে পর্যবসিত হব।

আপনার ঘরে ফাইফরমাশ খাটতে আসা কোন গ্রামের ছেলে যদি ইংরেজি বলে আপনি তো তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বাহাবা দিয়ে থাকেন। পাশ্চাত্য সভ্যতা আমাদের প্রতি সেই আচরণই করে। আপনি ভাবছেন আপনি আপনার ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। আসলে কি তাই? নাকি আপনার ভাষা ও সংস্কৃতিকে আপনি পাশ্চাত্যের অধীনস্থ করবার কাজ করে যাচ্ছেন। এটা করেন বলে আপনার ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি পাশ্চাত্যের বাহাবাও গ্রামের ছেলের ইংরেজি বলার মতই হবে। এই পুরস্কারকেই তো আমরা মাথায় তুলে রাখি। ভেবে দেখুন, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বাংলা সাহিত্যের জন্য – অর্থাৎ বাংলা ভাষায় তার অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার পান নি। তিনি পেয়েছিলেন তার নিজের কবিতা নিজে ইংরেজিতে অনুবাদ করবার জন্য। তাঁকে যখন ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল তখন যে-কারন দেখানো হয়েছিল সেটা হচ্ছে, "because of his profoundly sensitive, fresh and beautiful verse, by which, with consummate skill, he has made his poetic thought, expressed in his own English words, a part of the literature of the West".

রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়া বাংলাভাষী হিশাবে আমাদের আবেগের, সংবেদনশীলতার, গৌরবের জায়গা। অথচ কী বলে তাকে সেই পুরস্কার দেওয়া হোল যদি খেয়াল রাখেন আমার কথা বুঝতে সুবিধা হবে। ঠাকুর নিজের কবিতা নিজে ইংরাজিতে অনুবাদ করেছেন বলে তার পিঠ চাপড়ে দেওয়া হয়েছিল। আর তিনি যা লিখেছেন তাকে বলা হয়েছে ‘পাশ্চাত্য সাহিত্যের অংশ’। ভাবুন।

আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হতে চাই নি। পাশ্চাত্য মন নিয়ে বাংলা ভাষায় পাশ্চাত্য সাহিত্য চর্চা আমার সাধনার বিষয় নয়। নিজের ভাষা ও ভাবের বৈপ্লবিক মূহুর্তগুলোর ওপর না দাঁড়ালে আমি বুঝব না বাংলা ভাষা ও ভাবুকতার দিক থেকে পাশ্চাত্যের দর্শন বা চিন্তার সাথে কোথায় আমার মিলের জায়গা, কোথায় অমিল। আমি নিজের মূল্য যেমন ধরতে পারব না, তেমনি পাশ্চাত্যের পর্যালোচনা করে তার কি নেব আর কি প্রত্যাখ্যান করব সেই বাছবিচার করতেও সমর্থ হব না। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবার কারনে আমরা যা এখন ধরতে পারি না। নিজেদের আমরা বুঝি কিনা সন্দেহ। যে ভাষায় ও ভাবে আমরা এখন ভাবি ও চলি তার উৎপত্তি তো ঔপনিবেশিক আমল থেকে। রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষায় আমাদের পাশ্চাত্য ভাবের অধীন হবার ক্ষেত্রে বিশাল অবদান রেখেছেন। এর সুফলও আছে, অস্বীকার করব কেন। কিন্তু এটা আমার পথ নয়, এতোটুকুই শুধু বিনয়ের সঙ্গে বলে থাকি আমি। ঔপনিবেশিক আমলে আমাদের ভাষা ও ভাবুকতার ইতিহাসে যে ছেদটা পড়েছে, তাকে চিহ্নিত করা এবং নিজেকে সেই ছিঁড়ে যাওয়া নাড়ির সঙ্গে বাঁধবার চেষ্টাকে আমি সে কারনে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। এই ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ আমার কাজে লাগেন না, যাঁরা লাগেন বা কাজে আসেন তাঁরা রবীন্দ্রনাথ পড়া আধুনিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে ‘বাউল’ নামে পরিচিত। যেমন, ফকির লালন শাহ। তাই হয়তো আমাকে অনেকে ‘বাউল’ বলে ধারণা করে। তবে নদিয়ার ভাব আমার আরাধ্য এব্যপারে কোন সন্দেহ নাই।

তবে আমামকে ‘বাউল’ বলার বড় আরো একটি কারণ রয়েছে। নদিয়ার যে জ্ঞানের ধারার কথা বলি, যাদেরকে আমরা সাধক বলি- তাদের সাথে আমার একটা প্রাণের যোগাযোগ আছে। আমার জীবনাচারে তাদের যে দিকটা আমার ভাল লাগে, সেটা আমার চর্চার মধ্যে আনতে চেষ্টা করি ।

ঠিকানা : তাদের সাথে কী আপনার সরাসরি যোগাযোগ আছে?

ফরহাদ মজহার : অবশ্যই। আমার বিভিন্ন রকমের কাজের মধ্যে সবচেয়ে বড় একটা কাজ হল, নবপ্রাণ আন্দোলন। নবপ্রাণটা হলো বাংলাদেশে ভাবগত সাধকদের চিন্তা এবং তার সম্পর্কে গবেষণা এবং চর্চা করা। আপনি যদি বলেন আমি চিন্তাগতভাবে কোথায় আছি? তাহলে আমি বলবো, ঐ যে জাত-পাত বিরোধী, শ্রেণী বিরোধী , নারী পুরুষভেদ বিরোধী যে-আন্দোলন শুরু হয়েছিল সুলাতানি আমলে, চৈতন্যের নেতৃত্বে, আমাদের বাংলাদেশের জমিনে, সে আন্দোলনকে আমি মূলধারার আন্দোলনে নিয়ে আসার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। ফকির লালন শাহ এই আন্দোলনেরই ফল। নদিয়ার ফকির দরবেশদের জীবনাচার ও তাদের ভাবচর্চার ক্ষেত্রগুলো প্রত্যক্ষ ভাবে না বুঝলে এই আন্দোলনের রাজনৈতিক তাৎপর্য পুরাপুরি বোঝা যায় না। বাইরে থেকে যারা একে দেখেন, তারা এদের স্টেজে ডুগডুগি হাতে নাচাতে পছন্দ করেন, কিন্তু অধিকাংশের কাছেই এদের চিন্তা ও জীবনাচার বাতিল মনে হতে পারে। এদের সম্পর্কে নানান আজগবি কাহিনিও প্রচার করা হয়।

এই দিক থেকে মূলধারায় নিয়ে আসার মানে হছে এই সময় এদের ইতিহাস, চিন্তা ও জীবনাচারের অর্থ আমরা কতোটুকু বুঝতে সক্ষম সেই প্রশ্নটিও তোলা। বর্তমান সময়ে তাদের আদৌ কোন দার্শনিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে কিনা সেটা বিচার করে দেখা। এই কাজ করতে গিয়ে আমরা তো অনিবার্য ভাবেই আগাম কিছু মিথ্যা অনুমান নিয়ে বিচার করতে বসি, সেই অনুমানগুলো হাওয়ায় তৈরি হয়নি। ঔপনিবেশিকতার ঔরসে উৎপন্ন, পাশ্চাত্য ‘আধুনিকতা-কেই আমরা সভ্যতার একমাত্র মানদণ্ড বলে গণ্য করি। অনুমানগুলোর পাটাতন তো এই আধুনিকতাই। এই অবস্থান থেকে নদিয়ার আন্দোলন বা নদিয়ার ভাব পরিমণ্ডল আমরা বুঝতে পারব কিনা অনিবার্য ভাবেই সেই প্রশ্ন সামনে হাজির হয়। অতএব আমার কাজ হচ্ছে সেইসব সূত্র বা চিহ্নের সন্ধান করা যা ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস ও সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার কারনে মুছে যেতে বসেছে, অথচ তীব্র ভাবে টের পাচ্ছি বিশ্বব্যাপী বৈপ্লবিক চিন্তার ক্ষেত্রে নতুন কোন জাগরণ ঘটাতে গেলে সেই চিহ্ন ধরে অগ্রসর হওয়া দরকার। সেই কাজ ‘আধুনিকতা’র পর্যালোচনা ছাড়া অসম্ভব। ভাবুকতা ও রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের দিক থেকে এই কাজ খুবই দরকারি কাজ। এই কাজ করতে হচ্ছে এর রাজনৈতিক দিককে গুরুত্ব দিয়ে।

ঠিকানা : বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং এর ভবিষ্যৎ পরিণতিকে আপনি কীভাবে দেখেছেন?

ফরহাদ মজহার : বাংলাদেশের অবস্থা নিঃসন্দেহে ভাল নেই। নতুন করে বলতে চাই না, কারণ অনেকে হতাশ হয়ে পড়ে। আজকে পদ্মাসেতু নিয়ে যে দুর্নীতির কথা উঠেছে, কনষ্টিটিউশন নিয়ে যে বিতর্কের ব্যাপারটা চলছে, আজকে মানবাধিকার নিয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে- এর কোনটিই আমাদের জন্য ইতিবাচক নয়।

তবে আমাদের জন্য ইতিবাচক খবরও আছে। মানুষ আগের চেয়ে সচেতন হয়েছেন। আমাদের বাধা হচ্ছে দলীয় সংকীর্ণতা। এটা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারছিনা। বাংলাদেশে মূলত যে ব্যবস্থাটা কায়েম রয়েছে, সেটাকে আমি ফ্যাসিবাদী বলি। ফ্যাসিবাদী আচরণ বা ফ্যাসিবাদী সরকার নয়। ফ্যাসিবাদ একটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি। শুধু সরকারের আচরণ আর রাষ্ট্রের ধরণ দিয়ে সেটা পুরাপুরি বোঝা যাবে না। আমরা প্রত্যেকেই ছোট ছোট ফ্যাসিবাদী। আমাদের মধ্যে ফ্যাসিবাদ পুষে রাখি।

ফ্যাসিবাদের সঙ্গে একনায়কতন্ত্রের পার্থক্য হচ্ছে ফ্যাসিবাদের পেছনে জনসমর্থন থাকে। ফ্যাসিবাদি চিন্তা চেতনা জনপ্রিয় হয়ে থাকে। ফ্যাসিবাদী শাসক নির্বাচনে জিতে আসতে পারে। নির্বাচন ফ্যাসিবাদকে বৈধ করতে পারে। মুক্তি যুদ্ধের যে একক ও দলবাজি ব্যাখ্যা বা বয়ান ফ্যাসিবাদিরা হাজির করে আপনি তার বিরুদ্ধে গেলে আপনি জাতীয় শত্রুতে পরিণত হবেন। ফ্যসিবাদ জনপ্রিয় ধারণা ও তা নির্বিচার বিশ্বাস থেকে জন্ম গ্রহণ করে। এটা বিকশিত হয় একটা লোকপ্রিয় ও সংবেদনশীল জায়গা থেকে। যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটা লোকপ্রিয় জায়গা। ফ্যাসিবাদ অন্যের মতের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে ক্ষান্ত থাকে না, তাকে নিশ্চিহ্ন করতে তৎপর হয়ে ওঠে। নিজের ছকবাঁধা ফ্রেমের বাইরে অন্যের মতকে দাবিয়ে রাখা, যা আমাদের সরকার ব্যবস্থার সর্বত্র দেখা যায়। আমরা এরকম ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই যাচ্ছি। এখান থেকে লড়াই করে এগিয়ে যাওয়ার কাজটা খুবই সতর্কতার সাথে আমাদের করে যেতে হবে। এই যে আপনারা আমাকে কথা বলতে দিচ্ছেন, আমি কথা বলছি আপনাদের পত্রিকার মাধ্যমে, এ গুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কথা বলতে দেওয়া এবং তার সঙ্গে যে সমালোচনাগুলি আসে সেটাকে যুক্তি দ্বারা মোকাবেলা করতে শেখাও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। এই লড়াইটা করতে হবে। রিস্ক আছে ঝুঁকি আছে, তবুও এই কথাগুলো আমাকে বলতে হবে।

ঠিকানা : তার মানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক দর্শনগত কোন তফাৎ নেই?

ফরহাদ মজহার : না, আমি এটা বলিনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অসঙ্গতি ও তফাতের অনেকগুলো ধারা বা দিক আছে। আপনি সহজেই চিহ্নিত করতে পারবেন, তেমন সমস্যা নয়। চিহ্নিত করে সেই ধারার পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা আমরা করতে পারি। বেসিক্যালি স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের তফাৎটা হল, স্বৈরতন্ত্রের কোন জন সমর্থন থাকে না, একনায়কতন্ত্রের কোন জন সমর্থন থাকে না। কিন্তু ফ্যাসিবাদের থাকে। স্বৈরতন্ত্রের তুলনায় এর বিরুদ্ধে লড়াই করা কঠিন। এই অবস্থা থেকে উঠে আসতে হলে আরেকটি নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে হবে না। মুল সমস্যাকে চিহ্নিত করতে হবে।

বাংলাদেশের সংবিধানটা সবসময়ই একটা স্বৈরতান্ত্রিক সংবিধান ছিল। যে কারনে এই সংবিধানকে আমি সবসময়ই সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র কায়েমের হাতিয়ার বলে এসেছি। ৭০ অনুচ্ছেদে আছে, আপনি দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না। সে জন্যই যে শাসনটা দাঁড়ায় সেটা হয় শেখ হাসিনার না হয় খালেদা জিয়ার একনায়কতন্ত্র। কারণ সংবিধানটাই এরকমই। কিন্তু এখন পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদকে সাংবিধানিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এই সংশোধনীতে ৭ক, ৭খ অনুচ্ছেদ ঢুকিয়ে কোন আলোচনা সমালোচনাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বানানো হয়েছে, মানবাধিকার বিরোধী অনুচ্ছেদ ঢুকানো হয়েছে। শেখ মুজিবের বক্তৃতা বাংলাদেশের সংবিধানে ঢুকানো হয়েছে। কী জন্য? এটার দরকারটা কী? এটা কি সংবিধান? এটাই হলো একটা বড় সমস্যা।

অন্যদিকে জনপ্রিয়তার শক্তি ব্যবহার করে অন্যের মতামতকে দাবিয়েরাখতে পারে ফ্যাসিবাদ। প্রতিপক্ষকে অত্যাচার নির্যাতন করার পরেও অতি সহজেই ফ্যাসিবাদিরা নিজের পক্ষে সাপোর্টটা পেয়ে যান। কেউ যদি আপনার বিরুদ্ধে সমালোচনা করে, তারা সহজেই তাদের রাজাকার বলতে পা্রে। অন্যদিকে স্বভাবতই আমরা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের মধ্যে ফ্যাসিবাদী চরিত্র বেশী দেখি। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একটা সেনসেটিভ সমর্থন জনগণের মধ্যে রয়েছে। আওয়ামি লীগ এটাকে নিজের সংকীর্ণ স্বার্থে কাজে লাগাতে পারে অনায়াসেই।

ঠিকানা : ফ্যাসিবাদ থেকে কি এটা ধরা যায়, সংবিধানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কথাটি লেখা হলেও রাষ্ট্রীয় কোন কর্মকান্ডের সাথে নাগরিকরা সম্পৃক্ত নয়?

ফরহাদ মজহার : এটাতো গণতান্ত্রিক কোন সংবিধানই নয়, গণ প্রজাতন্ত্র হল কেমনে? গণপ্রজাতন্ত্রী কথাটা সুন্দর। কিন্তু ভেতরে যে সকল অনুচ্ছেদ আপনি ঢুকিয়েছেন, তাতে গণ প্রজাতন্ত্রের কোন চরিত্রই নেই।

ঠিকানা : তাহলে কী একটা রাজা প্রজা সম্পর্কের মত?

ফরহাদ মজহার : কার্যত তাই দাঁড়াচ্ছে। আমরা ভোট দেই কাকে? আমাদের দু’জন রাণী আছেন। একজন না গেলে আরেকজনকে আমরা নিয়ে আসি। আমাদের ব্যবস্থা তো এরকমই। গণতন্ত্র আর নির্বাচন সমার্থক নয়, গণতন্ত্র রাষ্ট্রের একটি ধরণ, একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তো কায়েম করতে হবে আগে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম থাকলেই কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে তার আংশিক চর্চা হতে পারে। অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ ভাবে বিধিবদ্ধ ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সরকার গঠন, ইত্যাদি। যেখানে গণতন্ত্রই নাই, সেখানে কী চর্চা হবে? রাজা প্রজার সম্পর্ক ছাড়া? গণতন্ত্রই নাই তো নির্বাচন করলেই তো সেটা গণতন্ত্রের চর্চা বলা যায় না। একজন একনায়কতান্ত্রিক শাসক নির্বাচন করা হয় মাত্র।

ঠিকানা : আর মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে দেখেন?

ফরহাদ মজহার : রাজনৈতিক গোষ্ঠি হিশাবে আমাদের আবির্ভাব নিশ্চিত করা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধ অত্যন্ত পজিটিভ ঘটনা। দ্বিতীয়ত শুধু নিজেদের নয়, পুরানা ভারতবর্ষ যে একটা বহু জাতির রাষ্ট্র, বহু ভাষার রাষ্ট্র, বহু সংস্কৃতির রাষ্ট্র- আমরা তা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রথমত প্রমাণ করেছি। প্রত্যেকটা ভাষা, প্রত্যেকটা জাতি যদি কোন কারনে মনে করে যে কোন বৃহৎ রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত থেকে তাদের জাতীয় বিকাশ অসম্ভব- তাহলে তারা স্বাধীন হতে পারে। সেটা বাংলাদেশের জন্য যেমন সঠিক, তেমনি আসামের জন্যও সঠিক, বেলুচিস্তানের জন্যও সঠিক, কাশ্মিরের জন্যও সঠিক। সেক্ষেত্রে উপ মহাদেশে ১৯৭১ সাল ছিলো একটা গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। আমাদের আগে থেকেই ভারতের অন্যান্য জনগোষ্ঠিও তাদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে আসছে। একাত্তর তাদের অনুপ্রাণিত করেছে। যাদের সংগ্রাম সুপ্ত ছিল, তারা প্রকাশ্যে নিজেদের আকাঙ্ক্ষার কথা বলতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু দ্বিজাতিতত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণ করে নি, একই সঙ্গে অখণ্ড ভারতের মিথ ও তত্ত্বেরও দাফন করে দিয়েছে। বাংলাদেশ একটু শক্তিশালী রাষ্ট্র হিশাবে দাঁড়ালে এর উত্তাপ সারা ভারতে ছড়াবে। দিল্লি যে কারনে কোন ভাবেই একটি শক্তিশালি বাংলাদেশ গড়ে উঠুক চায় না। গড়ে ওঠাকে নিজের জন্য সমস্যা মনে করে।

তৃতীয় ব্যাপারটা হচ্ছে, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মীয় দিক থেকে মুসলমান। যাদেরকে রক্ত দিয়ে বাঙালি হতে হয়েছে। মুসলমানরাও যে বাঙালি এই স্বীকৃতি নিজের রক্ত দিয়ে আদায় করে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। এর আগে ভারতীয় শাসনে মুসলমানরা সাধারণত ইংরেজি শেখার চেষ্টা করেনি। সেই সময়ে উকিল, মোক্তার, ডাক্তার অর্থাৎ মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানের কোন ভূমিকাই ছিল না। তারা কৃষিকাজ করতো,অথবা সবার কাছে জোলা হিসেবে পরিচিত ছিল। সত্যিকারের বাঙালি বলতে যেটা তৈরি হয়েছিল, সেটা মূলত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ বলুন, বিদ্যাসাগর বলেন, সবাই উচ্চ বর্ণের হিন্দু ছিলেন। বাঙালির ‘বাঙালি’ পরিচয়টা মূলত এদের মাধ্যমেই গড়ে উঠে। কিন্তু তারপরও বাঙালি মুসলমান নিজেদেরকে বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই গণ্য করতেন। কিন্তু তার কোন রাজনৈতিক স্বীকৃতি ছিল না। উলটা পাকিস্তান তার ধর্মকেই তার পরিচয়ের ক্ষেত্রে মুখ্য গণ্য করেছে। এই পরিস্থিতিতে রক্ত দিয়ে নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর নিজের অধিকার কায়েম করবার ঘটনাটি ঘটেছে, নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে নিজের আবির্ভাব ঘটাতে হয়েছে বাংলাদেশকে।

এই ঘটনার সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য রয়েছে। শুধু বাঙালির ইতিহাসের জন্য নয়, মুসলমান বা ইসলামের ইতিহাসের জন্যও। কারন বাংলাদেশের মানুষ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর নিজেদের অধিকার কায়েম করতে গিয়ে ইসলাম ত্যাগ করেন নি, ইসলামের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর তাদের হক তারা ত্যাগ করে নি। অন্যদিকে ভারতীয় উপমহাদেশের জনগোষ্ঠি হবার কারনে এবং বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী হিশাবে ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতিও তার নিজেরই জিনিস বলে বাংলাদেশ গণ্য করে, পূর্বপুরুষের সূত্রে পাওয়া সম্পদ। লোকায়ত সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। তবে এটাও সত্য যে ইসলাম-বিদ্বেষীও আছে বাংলাদেশে প্রবল ভাবে। তার বিপরীতে আছে ইসলাম ধর্মাবলম্বি হওয়া মানে নিজেকে আরব ভাবার মানসিকতা, মধ্য প্রাচ্যের সংস্কৃতিকে নিজের সংস্কৃতি গণ্য করা কিম্বা মধ্যপ্রাচ্যমুখি হয়ে নিজের পরিচয় নির্ণয়ের চেষ্টা। এ কারনে হিন্দু বৌদ্ধ, জৈন বা লোকায়ত সংস্কৃতি বিদ্বেষী মানুষও বাংলাদেশে আছে, অবশ্যই। কিন্তু নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর রক্ত দিয়ে নিজের অধিকার কায়েম করে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণ নতুন ধরণের সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণের সম্ভাবনা তৈরী করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশ, আরব ও পারস্যের অভূতপূর্ব সন্ধিক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াবার সম্ভাবনা তৈরি করেছে বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে এটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম ধর্মের সঙ্গে ভাষা ও সংস্কৃতির কোন বিরোধ নাই, এই সত্যটাই রক্ত দিয়ে, প্রাণ দিয়ে প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশের মানুষ। বাংলাদেশের জনগণের এই কীর্তি ছোটখাট ব্যাপার নয়।

কিন্তু ধর্মের সঙ্গে ভাষা ও সংস্কৃতির সম্পর্ক কিভাবে নির্ধারিত হবে, বাংলাদেশ শেষাবধি কী দাঁড়াবে তার মীমাংসা আমরা করে ফেলেছি এই দাবি করা যাবে না। যে কারনে আমি বারবারই বলি, ইসলাম প্রশ্ন বাংলাদেশীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রশ্ন। এই প্রশ্ন এড়িয়ে যাবার কোন সুযোগ নাই। এর মীমাংসার ওপর আ্মরা ভবিষ্যতে কী হয়ে উঠব বা কী হব তা নির্ভর করছে।

পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের এইভাবে নিজেদের বাঙালি প্রমাণ করতে হয়নি। এই ঐতিহাসিক পরীক্ষাটা দিতে হয় নি -ধর্মের সঙ্গে ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সম্পর্ক নির্ণয় বা বিচারের রক্তাক্ত পরীক্ষা। তারা অখণ্ড ভারতের দায় বহন করে চলেছেন, অথচ আমরা অখণ্ড পাকিস্তানের দায় বহন করতে আর রাজি হই নি। এই দিক থেকেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য অসাধারণ।

আধুনিক বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি মূলত উচ্চ বর্ণের হিন্দুর কীর্তি এই সত্য কথাটা আমরা ভুলে যাই, কিম্বা অযথা গোপন রাখতে ভালবাসি। তবে ঐতিহাসিক দিক থেকে এর অন্যথা হতে পারত কিনা সন্দেহ। অতএব ঐতিহাসিক কারনেই হিন্দু হওয়া আর বাঙালি হওয়া পশ্চিম বাংলার বাঙালির ক্ষেত্রে সমার্থক হয়ে গিয়েছে। এই দিকটা জোর দিচ্ছি কারণ দুই দেশের বাঙালিরা এখনও এর গুরুত্ব বুঝত পারেন কিনা সন্দেহ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে এই দিক থেকে বুঝবার অনেক বাকি আছে আমাদের। এখনও পর্যন্ত পশ্চিম বাংলার বাঙালি নিজের ধর্মের সঙ্গে মোকাবিলার দায় বোধ করেন না। কিন্তু আমাদের নিরন্তর মোকাবেলা করতে হয়, করতে হচ্ছে। পাকিস্তানের মধ্যে থাকার পরও আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে যে, আমরা ধর্ম ও সংস্কৃতির সাথে সমন্বয়টা কীভাবে করবো। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ৭১-এর পরে উপমহাদেশে বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক তাৎপর্যটাকে একটা সংকীর্ণ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বাঙালি পরিচয়ের সঙ্গে ইসলামের একটা কৃত্রিম বিরোধ টিকিয়ে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ বলা হচ্ছে, বাঙালি ধারণার মধ্যে ইসলাম নেই, ইসলাম এক্সক্লুডেড। আমাদের বলা হচ্ছে ইসলাম ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের অংশ নয়, বাঙালি হতে হলে ইসলাম পরিত্যাগ করতে হবে ইত্যাদি-ইত্যাদি। এভাবেই বাংলাদেশের একটা অংশ বার বার এটাকে ভুলভাবে প্রভাবিত করে কৃত্রিম একটা বিভাজন তৈরি করে রেখেছে। এর মীমাংসা আমরা এখনো করতে পারিনি। ৭১-এর পর এই কারণেই আমরা একটা ঐক্যবদ্ধ জায়গায় দাঁড়াতে পারিনি। এখনও পারছি না। অথচ ইসলাম যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন নয় এই সত্য অনুধাবনের ক্ষেত্রে বাংলার ফকির দরবেশ আউল বাউলরা ভুল করেন নি। নদিয়ার ভাব যার প্রমাণ।

ঠিকানা : স্বাধীনতা আন্দোলন হয়ে আসলো একভাবে, নেতৃত্ব দিলেন বঙ্গবন্ধ, আবার মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ- বিষয়গুলোকে আপনি কীভাবে দেখেন?

ফরহাদ মজহার : আমি আপনার সাথে এভাবে যাব না। মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব দিয়েছেন, এটা হলো আমাদের সবার ধারণা। আমি এটা এভাবে মানতে নারাজ। আমার বন্ধু আহমদ ছফা তাই বার বার বলতেন, শেখ মুজিব সময়ের পিতা নন, তিনি সময়ের সন্তান। আমি কথাটা ঘুরিয়ে বলতে চাই। আমার কথা শুনতে হয়তো নতুন লাগবে, তবে আপনারা মিলিয়ে নিতে পারেন কিনা দেখেন? শেখ মুজিবুর রহমানের কয়েকটি অসামান্য গুণের মধ্যে একটা হল, তাঁর নিজের শ্রেণি ও রাজনীতির সীমানা ও সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও উনি দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। রাজনীতির ব্যবহারিক অভিজ্ঞতাও তিনি কাজে লাগাতে পেরেছেন। গণ রাজনীতির মধ্য দিয়ে জনগণের দাবি আদায় করবার যে পদ্ধতিগুলো তিনি মুসলীম লীগ থেকে শিখে এসেছিলেন, তা তিনি সফলভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছেন।

আমার প্রথম থিসিস হল এই, শেখ মুজিব কখনোই পাকিস্তান ভাঙ্গতে চাননি। কিন্তু এটাকে আমি ইতিবাচক হিসেবে মনে করি। বাংলাদেশে যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক তারা বিষয়টি স্বীকার করে না। কথাটা শুধু এই অর্থে নয় যে তিনি শুধু প্রাদেশিক স্বায়ত্ব শাসন চেয়েছিলেন। বরং পাকিস্তান ভেঙ্গেই তাকে ক্ষমতা পেতে হবে এটাও তার রাজনীতি ছিল না। আগরতলা ষড়যন্ত্রের কথা মনে রেখেই আমি কথাটি বলছি। পাকিস্তান ভাঙা তার রাজনীতি ছিল মনে করা ভুল হবে। মুজিবের এই অবস্থান পক্ষান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে বুর্জোয়া নীতি নৈতিকতার সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হয়েছে। এর ফল ইতিবাচক হয়েছে।

অন্যদিকে আবার ইয়াহিয়া উভয় সংকটে পড়েছিলেন - মার্চের আলোচনা ভেঙ্গে দিবার পর বাঙালি সেনা, বিডিআর আর পুলিশের হাতে অস্ত্র রেখে দিয়ে তার পক্ষে পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়া সম্ভব ছিল না; ফলে ইয়াহিয়া ২৫ মার্চের ‘অপারেশন সার্চলাইট” এর নৃশংস নির্বিচার হত্যাকান্ডে যাবার রিস্ক নিতে বাধ্য হয়। এই ঝুঁকি নেওয়াই ইয়াহিয়া খানের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ব্যারাক ছেড়ে বাঙালি সৈনিকরা পালিয়ে যাবার পরে এই সৈনিকরাই জনগণের সাথে মিলে সংগঠিত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য মহা বিপদ হয়ে হাজির হয়। এই বিপদ নিউট্রাল করবার জন্য সৈনি্কেরা ফিরে আসলে সাধারণ ক্ষমা পাবে, কোন শাস্তি দেওয়া হবে না -- এমন ঘোষণা দেওয়াও তখন ছিল রীতিমতো অসম্ভব । কারণ সেক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত বাঙালি সৈন্যদের নিয়ে ইয়াহিয়াকে ঘর করতে হোত, যাদের আর বিশ্বাস করা ছিল কঠিন। ফলে ২৫ মার্চের কালরাত্রি স্বাধীন বাংলাদেশ হবার পক্ষে টার্নিং পয়েন্ট হয়ে যায়। শেখ মুজিবের লিগ্যাল বা আইনি পরিমণ্ডলের আন্দোলন ঘটনার নিজস্ব গতিতে নিজেই বাঁক নিয়ে নেয়, নতুন মাত্রা পেয়ে তা সশস্ত্র মুক্তি যুদ্ধের পথে যাত্রা করে।

মুজিব পাকিস্তান ভাঙ্গতে চান নি বলেই একটা আইনী বা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে তিনি আন্দোলন করেছেন বা করতে বাধ্য ছিলেন। যখন স্বাধীনতার দাবিতে সারা দেশ উত্তাল তখন ২৫ মার্চের রাতে তাঁর ধরা দেওয়ার বিষয়টাকে অনেকেই অন্য দৃষ্টিতে দেখেন। বলে থাকেন, দেশকে পেছনে ফেলে তিনি নিজেকে বাঁচিয়ে নিলেন। সারা দেশের জনগণকে সেনাবাহিনীর হাতে নির্মম হত্যার জন্য বলি দিয়ে তিনি গ্রেফতার হলেন। প্রতিরোধের কোন প্রস্তুতি তিনি নেন নি। জনগণকে সশস্ত্র করেন নি। এগুলো সবই সত্য। কিন্তু তিনি তো মাও , লেনিন বা হোচি মিন নন, তিনি একটি পেটি বুর্জোয়া দলের নেতা - যে দলের আদর্শই ছিল বিপ্লবী রাজনীতির বিরোধিতা করা, পাশ্চাত্য সংসদীয় ব্যবস্থা কায়েম করা। তাই তিনি কোন সশস্ত্র গণ অভ্যুথান বা মুক্তি যুদ্ধ সংগঠিত করবার রাজনীতি করেন নি। ফলে দেশের ভেতরে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করা শেখ মুজিব ও আওয়ামি রাজনীতির পক্ষে ছিল অসম্ভব। তিনি ধরা দিয়েছেন, কিন্তু তার পুরা দলই ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু ২৫ মার্চ তিনি যদি ধরা না দিতেন, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে নিজেকে সঁপে না দিতেন, তাহলে তাকেও ভারতে যেতে হত। আর তাঁর ভারতে যাওয়ার মানেটা হল, পুরো যে প্রচারটা পাকিস্তানিরা করছিল যে তিনি ভারতের এজেন্ট, ভারতের হয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গতে চান -সে প্রচারে হাওয়া দেওয়া, সেই প্রচারের বিশ্বাসযোগ্যতা আরো পোক্ত হত। এই দিকটা মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন। এই বুঝতে পারাকেই আমি তারঁ নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দূরদর্শিতা বলে থাকি। ২৫ মার্চের সেই পরীক্ষাটার মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান প্রমাণ করেছেন যে, পেটি বুর্জোয়া শ্রেণির রাজনীতি তার উপজীব্য হলেও এবং সারাজীবন প্রগতিশীল রাজনীতির বিপরীতে থাকবার পরেও তার দল ও তার নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি তার সমসাময়িক অনেকের চেয়ে বেশি । তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন এটা ৫০-৫০-এর মামলা। অর্থাৎ মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী। এই হিসেবটা করেই তিনি রিস্ক নিয়ে ধরা দিয়েছিলেন। অনেকে ৭ মার্চ নিয়ে অনেক কথা বলেন। ৭ মার্চের বক্তৃতায় মোটেও স্বাধীনতার ঘোষণা তিনি দেননি। এবারের আন্দোলন..স্বাধীনতার সংগ্রাম.. বলা্টা যে স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে যায়, এটা টোটালী ননসেন্স। এটা আওয়ামী লীগ ওয়ালারা বলে। কিন্তু তিনি যদি ৭ মার্চ স্বাধী্নতার ঘোষণা দিতেন, সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের শাসকদের জন্য তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোটা অতি সহজ হোত । ফলে এসব করে, ইতিহাস বিকৃত করে, শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিকেই হেয় করা হচ্ছে।

শুধু তাই নয়, ঐতিহাসিকভাবে তাকে ছোটও করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলনের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলেরই কমবেশি ভূমিকা ছিল, ইসলামপন্থি কয়েকটি দল ছাড়া। জনগণ ছাড়াও সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর সবাই যুদ্ধ করেছেন সরাসরি। ঐতিহাসিকভাবে যার যেটা প্রাপ্য, তাকে সেটা দিতে হবে। তাজউদ্দিন আহমেদ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলেন। তিনি এ যুদ্ধটা পরিচালনার ক্ষেত্রে যতটুকু তার রাজনৈতিক দল বা সেনাবাহিনীর উপর বা মুক্তিযোদ্ধাদের উপর নির্ভর করেছিলেন তার চেয়েও বেশি নির্ভর করেছেন ভারতের ব্যুরোক্রেটদের উপর। তার প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা থাকলেও একটা সমালোচনা আছে এই বিষয়ে। যে কারণে শেখ মুজিবের সাথে তার যে মতবিরোধ সেটা পুরোপুরি মিথ্যা নয়। কারণ রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলকে প্রাধান্য দেওয়ার পরিবর্তে তিনি ব্যুরোক্রেটদের প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তাজউদ্দিন হয়তো মনে করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ সফল করবার জন্য এটাই সর্বোত্তম পন্থা। তবে তিনি ছিলেন সৎ নির্লোভ একজন মানুষ।

ঠিকানা : মন্ত্রী পরিষদ থেকে তাঁর বহিষ্কারাদেশের বিষয়টি কীভাবে দেখেন?

ফরহাদ মজহার : তাকে অবিশ্বাস করে মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে,এটা অন্তত আমার কাছে মনে হয় না। বিশ্বব্যাংক সম্পর্কে তার একটা ভিন্ন অবস্থান ছিল, অন্যান্য কিছু বিষয়েও তাঁর অবস্থান ছিল ভিন্ন। আরেকটা কারণ হতে পারে যে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সশরীরে উপস্থিত না থাকায়, দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে শেখ মুজিবের পরিষ্কার ধারণা ছিল না। এর ফলে শেখ মুজিবের সাথে তাজউদ্দিনের হয়তো একটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিলো, আওয়ামিপন্থিদের অনেকে এই যুক্তি দিয়ে থাকেন। তবে এটা গৌণ দিক। এই যুক্তি পোক্ত মনে হয় না। চিন্তার দূরত্ব তৈরি হলে গুরুত্বপুর্ণ তিনটা মন্ত্রণালয় -অর্থ, পরিকল্পনা আর পাট -- তিনটাই তাকে শেখ মুজিব দিতেন না। বরং এটাই সম্ভবত সঠিক যে অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ার করার কারনে আর দুর্ভিক্ষ ঘটার পরিপ্রেক্ষিতেই দূরত্ব তৈরি হয়।

অন্যদিকে মন্ত্রিসভা থেকে তাকে বহিষ্কারের ঘটনা শেখ মুজিবের তরফ থেকে অন্তত নেতিবাচক বলে আমি মনে করি না। কারণ, ৭৪ এর দুর্ভিক্ষের পর তাজউদ্দিনের হাতে অর্থ, পরিকল্পনা এবং পাট মন্ত্রণালয় রেখে তাঁর উপর আর আস্থা রাখা শেখ মুজিবের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

ঠিকানা : স্বাধীনতার ঘোষণা যদি শেখ মুজিব না দিয়ে থাকেন, তাহলে কীভাবে শুরু হল স্বাধীনতা যুদ্ধ।

ফরহাদ মজহার : এই ক্ষেত্রে মইদুল ইসলামের ‘মুলধারা ৭১’ বইয়ের কথা আপনাদের মনে করিয়ে দেব। মইদুল ছিলেন কার্যত তাজউদ্দিনের পলিটিক্যাল সেক্রেটারি বা উপদেষ্টা। ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টা ডি পি ধর বা পররাষ্ট্র ও ইনটেলিজেন্সের সাথে তাজউদ্দিনের পক্ষ হয়ে সম্পর্ক, অনানুষ্ঠানিক আলাপ তিনিই রক্ষা করতেন। তার বই পড়ে মনে হয় বাংলাদেশ-ভারত- সোভিয়েত এই ষ্ট্রাটেজিক এলায়েন্সের লাইন ধরে স্বাধীন বাংলাদেশকে বাস্তব করে তুলতে ভারতকে সঙ্গে নিয়ে সোভিয়েতকে রাজি করানোর ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিক কাজগুলোর সবই তাজউদ্দিন তাকে দিয়েই করিয়েছেন। কিন্তু যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাজউদ্দিন কোন সরকারি আনুষ্ঠানিক নিয়োগপত্র মাইদুলকে দেননি। সেটা পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা খন্দকার মুস্তাকের হৈচৈ বা আপত্তির ভয়ে হতে পারে।

তো মইদুলের বই শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এই দাবি সাপোর্ট করে না। বরং তাজউদ্দিনের নিজের একক সিদ্ধান্তে কি করে এসব ইঞ্জিয়ারিং করা হয়েছে তার বর্ণনা আছে। কোন খারাপ অর্থে বা ইঙ্গিতে নয়, ঘটনার ধারাবাহিকতা হিসাবে। ৩ এপ্রিল তাজউদ্দিনের প্রথম ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন। সেই দেখা করাকে বিধিবদ্ধ ভাবে হাজির করবার জন্য তিনি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রি হিসাবে পরিচয় দেন। ফলে এখান থেকেই আসলে শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার কেচ্ছার শুরু।

তাজউদ্দিন দাবি করেন যে শেখ মুজিব ধরা পড়ার আগে বাংলাদেশ স্বাধীন বলে ঘোষণা দিয়েছেন, স্বাধীন সরকারের ঘোষণাও দিয়ে গেছেন এবং তিনি সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। তাজউদ্দিন যে এভাবে নিজেকে পরিচয় দিবেন একথা তার (২৭ মার্চ) দেশত্যগের সঙ্গী ব্যারিষ্টার আমিনুল ইসলাম ও মাইদুলের সাথে আলাপ করে গিয়েছিলেন বলে মাইদুল তার বইতে আমাদের জানাচ্ছেন। এরপর ১১ এপ্রিল প্রথম আওয়ামী লীগের যেসব নেতা, এমএনএ ও এমপিদের পাওয়া গিয়েছিল তাদের নিয়ে প্রথম যে সভা হয় সেখানে নানা হট্টগোলের পর তাজউদ্দিনের এই বক্তব্যই পাশ করিয়ে নেয়া হয়। তবে এই মিটিংয়ের আগের রাত্রে ১০ এপ্রিল স্থানীয় আগরতলা রেডিওতে স্বাধীন বাংলাদেশ ও মন্ত্রীসভা্ ঘোষণার খবর প্রচার করা হয়। পরদিনের সভায় এই ঘোষণার আনুষ্ঠানিকভাবে পাশ করে নেয়া হয় এবং ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলায় স্বাধীন সরকারের যাবতীয় ঘোষণা, শপথ, আনুষ্ঠানিকতা পালনের সিদ্ধান্ত হয়।

ব্যাপারটি আসলে তাহলে কী ছিল? তাজউদ্দিনকে ইন্দিরা গান্ধির কাছে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী বলে পরিচয় দেবার দরকারেই সাপোর্টিং ষ্টোরি হিসাবেই শেখ মুজিবের স্বাধিনতা ঘোষণার গল্প তৈরি হয়েছে। বৈদ্যনাথতলার ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটাই সরকারী বা আনুষ্ঠানিক ভাষ্য হয়ে যায়।

আমি মনে করি বাংলাদেশ আজ স্বাধীন এটা আজ দিনের আলোর চেয়েও সত্যি। ফলে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন কিনা সেটা খুবই তুচ্ছ একটি তর্ক। এটা আর কোন বড় ব্যাপার নয়। স্বাধীনতার ঘোষণা আসলে কে দিয়েছিলেন বা সরকার গঠন কে কিভাবে কি করে করল ইত্যাদির সত্যতা প্রমাণ ইতিহাসবিদদের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভাল। অথচ বিচার বিভাগ আইন করে ইতিহাস লিখবার দায়িত্ব নিয়েছে মনে হচ্ছে। এটা বিপজ্জনক। ইতিহাসের দলীয় বয়ানকে আদালতের বিষয় বানিয়ে বিচার বিভাগকে দলীয় রাজনীতির হাতিয়ারে পর্যবসিত করা হয়ছে।

কোন দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ কেউ একজন ঘোষণা দিলেই শুরু হয় না। এর আগেও অনেকে ঘোষণা দিয়েছিলেন, মওলানা ভাসানির কথা ভুলে যাবেন না, অন্যান্য বামপন্থি দল থেকেও যুদ্ধের ঘোষণা হয়েছে। পঁচিশে মার্চের রাত্রি ছিল আইনি পরিমণ্ডলে আওয়ামি লিগের লড়াই করবার করুণ পরিণতি। এরপর তো যুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই আমাদের করার ছিল না। বাংলাদেশে ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যদি আক্রমণ না করতো, তাহলে হয়তো শেখ মুজিবর রহমান ও আওয়ামি লিগকে যুদ্ধ করতে হতো না। তাতে বাংলাদেশ স্বাধীন হত কি করে সে আলাদা তর্ক। তবে লীগের রাজনীতির দিক থেকে তাদের বাধ্য হয়ে যুদ্ধ করতে হয়েছে। পঁচিশে মার্চের পর আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের জন্য যুদ্ধ করা ছাড়া করা আর কী গতি ছিল?

পাকিস্তানের সাথে আমাদের যে বিরোধ, যে বিরোধটা আমাদের জাতীয় চেতনার জন্ম দিয়েছে -সে চেতনার মধ্য দিয়েই আমরা স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে চলে গেছি। যখনই নেতৃত্বের কথাটা আসবে, বিশেষ দলের নেতৃত্বের একক কৃতিত্বের কথাটা আসবে। তখনই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এই দাবি আওয়ামী লীগ করে। এ কৃতিত্বের দাবিদার হিসেবে আমরা বঞ্চিত করি বাংলাদেশের জনগণকে, বঞ্চিত করি মওলানা ভাসানীকে। এগুলো ঠিক নয়। এগুলো করলে আমরা জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে পারবো না। ইতিহাসে শেখ মুজিবের যে অবদান তাকে তা দিতে হবে। মওলানা ভাসানীর যে অবদান তাকে সেটা দিতে হবে। উনসত্তরের পুরো আন্দোলনকেই মবিলাইজ করা, তাকে উচ্চতার শিখরে নিয়ে যাওয়া, এর পক্ষে জনমত সৃষ্টি করার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিলো মওলানা ভাসানীর, ন্যাপের আর তাদের গণসংগঠন বিশেষত ট্রেড ইউনিয়নের। তাঁর একটাই ভুল ছিল। তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের লেজিটিমেট প্রতিনিধি হননি। তিনি নির্বাচনে জিতে আসেন নি, কিম্বা জনগণের কী পরিমান অংশ তার পক্ষে সেটা দেখাবার জন্য নির্বাচনী পরীক্ষা দেন নি, ৭০-এর নির্বাচনে অংশ নেননি -- এগুলো ছিল তাঁর বড় রাজনৈতিক ভুল। যদি কেউ বলে ভাসানী বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান রাখেনি, তাহলে এটা টোটালি ননসেন্স। তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা কল্পনাও করা যায় না। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমিতো এটাকে গ্রহণ করতে পারি না। মওলানা ভাসানীর অবদান অসামান্য। তাছাড়া কৃষক এবং শ্রমিক আন্দোলনে বামপন্থি দলগুলোর অবদান ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ কল্পনাও করা যায় না।

আওয়ামী লীগ সেই সময়ে কী ছিল? একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মফস্বলি দল ছিল। সেই সময় দেখতাম যারা ছাত্র ইউনিয়ন করতেন তারা বলতেন ছাত্রলীগের ছেলেরা শুদ্ধ বাংলা ঠিকমতো বলতে পারে না, তারা মফস্বলি ভাষা বলে। তাদের মধ্যে কোনো শিক্ষিত কালচারই ছিলো না। ’৬৯-এ আসাদ (বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের কর্মি) মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত শেখ মুজিবর রহমান অধিকাংশ শিক্ষিত ও সাংস্কৃতিক লোকজনের কাছে ‘গুণ্ডা’ আকারে পরিচিত ছিলেন। কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা সংস্কৃতি ও সাহিত্য চর্চার বিপরীতে এই মফস্বলীয় গ্রাম্যতাকে আপনি খারাপ বলতে পারবেন না। আমি ব্যাপারটাকে ইতিবাচক হিশাবেই দেখি। এসব নিয়েই তো আমাদের ইতিহাস। ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না।

ঠিকানা : সেটাই যদি হয়, তাহলে কোটি কোটি মানুষ কেন তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিল?

ফরহাদ মজহার : সকলে তার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে, কথাটা ঠিক নয়। তাছাড়া রাজনীতিতে একজন নেতাকে সকলেই মানতে হবে এই দাবিটাও বা আমরা কেন করি? এটা তো অবাস্তব। আমি মানি নি, আমরা মানি নি, এখনও মানি না। তাতে কি শেখ মুজিব ছোট হয়ে গেলেন? অন্যান্য দল ছিল, অন্যান্য নেতারাও ছিলেন। রাজনীতির নিজস্ব গতিপ্রক্রিয়ার ফল তিনি। বামপন্থি আন্দোলনের ব্যার্থতার পরিণতি তিনি। উনসত্তরের সফল গণভ্যুত্থানের পরে বামপন্থীদের হঠাৎ হাত গুটিয়ে নেয়া আর তাঁর নিজ রাজনীতির সাধ্যমত আন্দোলনের হাল ধরে থাকা -- যেমন, ক্ষমতা হস্তান্তরের গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেয়া – রাজনীতির এই সকল ঘটানাবলীর প্রক্রিয়া তাকে নেতৃত্বে নিয়ে আসে। বাংলাদেশের জনগণ তাকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে আনেনি। ৭০’র নির্বাচনে তাকে নেতৃত্বে এনেছে, যদিও সেটা পাকিস্তানের সংবিধান লিখবার জন্য। যুদ্ধ যদি দীর্ঘস্থায়ী হোত, কিম্বা ভারত যদি পাকিস্তান আক্রমন না করতো তাহলে ইতিহাস আজ ভিন্ন হোত। ভিন্ন ভাবে লেখা হোত।

আপনাকে খেয়াল করতে হবে শেখ মুজিবুর রহমান যে দল করেছেন সিয়াটো-সেন্টো চুক্তি করেছে তারাই। শেখ মুজিব তো এই ধরনের সাম্রাজ্যবাদী চুক্তি সমর্থন করেই নেতা হয়েছেন । শেখ মুজিবুর রহমান হোচিমিন ছিলেন না। শেখ মুজিব শুধু তাঁর নিজের গুণেই নেতা হন নি, এর সাথে আন্তর্জাতিক রাজনীতিও জড়িত ছিল। ইতিহাসে অনেক সময় একজন বামন ব্যক্তিকেও অনেক বড় দেখা যায়। নেপোলিয়ান তেমনই একজন বামন ছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিক কারণে অনেক বড় হয়ে গেছেন। ফলে বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ মুজিব একটা জায়গায় চলে এসেছেন নানান রকমের সমীকরণের কারণে। কিন্তু এটা বুঝার পরে তাকে খাটো করারও দরকার নাই, অতি মানব হিসেবে দেখাও ঠিক নয়।

শেখ মুজিব নিজে কখনও স্বাধীনতা চাননি। না চেয়ে দোষ করেননি। তিনি সবসময়ই লিগ্যাল পার্লামেন্টারি পলিটিক্সে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর যে আবির্ভাব, তিনি যে একটা জায়গা দখল করে নিয়েছেন সেটা ঐতিহাসিক, কোন ঐশ্বরিক গুণের কারণে নয়। তার চেয়ে যদি নেতা আকারে বলেন, মওলানা ভাসানী ছিলেন অনেক বড় মাপের। তাঁর অবদান বাংলাদেশের জনগণের জন্য অনেক বিশাল। তার আন্দোলনের কারণেই শেখ মুজিবের মতো নেতার জন্ম হয়েছে। হাওয়া থেকে তো আসেনি। শেরে বাংলা ফজলুল হককে আপনি কীভাবে বাদ দেবেন? বাংলাদেশে এ অঞ্চলের কৃষকদের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস আছে না? সেটাকে আপনি কীভাবে বাদ দেবেন? এগুলো বাদ দিয়ে আমরা শেখ মুজিবের কথা কীভাবে বলি? এগুলো আমাদের রাজনীতির অস্বচ্ছতা। একটি বিশেষ দল বাংলাদেশের ইতিহাসটা কুক্ষিগত করার জন্যই বার বার এগুলো বলে। এগুলো বলে শেখ মুজিবকে কখনও সম্মান দেয়া যায় না। আপনি আইন করেছেন, শেখ মুজিবকে কিছু বলা যাবে না। বলা যাবে না কেন? উনি কি ফেরেশতা? উনি ভুল করেননি? মুজিবের বিরুদ্ধে কিছু বললে, রাষ্ট্রদ্রোহিতা কেন? এখান থেকেই আমরা ফ্যাসিজম তৈরি করি। অতি মানব তৈরি করার রাজনীতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। যত দ্রুত আমরা বের হতে পারবো, তত দ্রুত শেখ মুজিবের সঠিক মূল্যায়নটা করতে পারবো আমরা। আবার শেখ মুজিবকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমাদের জিয়াউর রহমানের অবদানকে অস্বীকার বা খাটো করার কোন প্রয়োজন নাই, সেটা ঠিক হবে না। তিনি বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, তাকে কেন আমরা ঘোষক বলতে পারবো না? আমরা কেন ভাসানী, ওসমানী, মোহাম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দিনের অবদানকে স্বীকার করি না। এই সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বেরিয়ে আসলেই অন্যান্য দল মতের সাথে ডায়ালগের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। যা থেকে আমরা সামনে এগিয়ে যাবার অনেক মশলা পাবো। আমরা যদি শুধু গায়ের জোরেই একটা কিছু প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করি, তাহলে সারাজীবনই ঝগড়া-বিবাদ থাকবে।

আপনি যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদ থেকে ইসলামকে বাদ দিলেন, তখনই ‘মৌলবাদের’ জন্ম হল বাংলাদেশে। কারণ বাংলাদেশের লোক মনে করেছে, আরে! আমাদেরকে তো হিন্দু বানায়ে ফেলতেছে! মৌলবাদীরা প্রচার করলো যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ মানে হিন্দু হয়ে যাওয়া, কপালে টিপ পরা, রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়া, মঙ্গল দ্বীপ জ্বালান। -সবাই মনে করলো ঠিকইতো, ইসলাম কোথায় এখানে? বলা হচ্ছে, এমনই বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শ আমাদের ! কেন? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ছাড়া রাষ্ট্রের বিশেষ কোনো আদর্শের কি প্রয়োজন আছে? গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভিন্ন আদর্শ থাকতে পারে। গণতান্ত্রিক কনষ্টিটিউশন বা গঠনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে যে যার মতো তা পালন করবে। কিন্তু সেটা হয়নি। সে কারণেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের পাল্টা হিসেবে, প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাংলাদেশে ‘মৌলবাদ’ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

ঠিকানা : ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্কটা কী রকম হওয়া উচিত?

ফরহাদ মজহার : স্বাধীনতার আন্দোলনটা যখন শুরু হয়, ছাত্ররা তখন পতাকা উড়ায়। সে পতাকায় বাংলাদেশের একটা মানচিত্র ছিল। আতাউস সামাদের একটি লেখায় পড়েছি এবং অনেকের কাছে শুনেছি, দিল্লির দিক থেকে বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের পতাকায় বাংলাদেশের মানচিত্র থাকা উচিত। তারা এটা নিশ্চিত করার জন্য বলেছিলো যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শুধু পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে, পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ে। পশ্চিম বাংলা নিয়ে নয়। দিল্লি একদিকে চেয়েছে পাকিস্তান ভেঙ্গে পড়ুক আবার , অন্যদিক তারা সবসময়ই আতঙ্কিত ছিল, এই ক্ষেত্রে যেন পশ্চিম বাংলার জনগণের উপর এর প্রভাব না পড়ে। বিশেষত ৬৯ সাল থেকেই সারা পশ্চিমবঙ্গে সে সময় নকশালী আন্দোলন তুঙ্গে ছিল এই প্রেক্ষিত মনে রাখলে এই আতঙ্কের মাত্রা বোঝা যাবে। আতংক এখনো আছে। কারণ উত্তরপূর্ব এবং অন্যান্য যেসব রাজ্য ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের অধীনে থাকতে চায় না, তারা বাংলাদেশকে উদাহরণ আকারে ধরে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হবে, দিল্লি এই ভয় পায়।

আবার আরেকটা দিক আছে , যেটা সাধারণত বা সাদা চোখে আমরা টের পাই না। ভারতের চোখে বাংলাদেশের মানুষ আসলে মুসলমান, এমন মুসলমান যারা ৪৭ সালে ভারত ভেঙ্গে আলাদা হবার সাহস করেছিল। ফলে ৭১ সালে ইন্দিরার একটা ভয় কাজ করেছিল যে মুলত এই মুসলমানেরা আবার স্বাধীন হয়ে গেলে কি না করে, দিল্লীর জন্য না সমস্যা করে। এই ভয় ও আশঙ্কা থেকেই নিশ্চিত হতে সেকুলারিজমের আইডিয়াটার জন্ম। ইন্দিরা -তাজউদ্দিন আলাপে সম্ভাব্য বাংলাদেশকে তিলক লাগাতে হয়, লাগিয়ে ঘোষণা করে বলতে হয় স্বাধীন বাংলাদেশ সেকুলার হবে। খেয়াল করবেন, সেই সময় ভারত নিজেও কিন্তু সেকুলার তিলক লাগানো রাষ্ট্র নয়; ৪৭ এর পরের কনষ্টিটিউশনে ভারত তখন ছিল তাদের ভাষায় সাধারণতন্ত্র মানে গণপ্রজাতন্ত্রী। ধর্ম নিরপেক্ষতা কোন ইস্যু ছিল না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মানেই স্যেকুলার রাষ্ট্র, ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়। কিন্তু দিল্লির কাছে আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হলেই চলছিল না, মাথায় সেকুলারিজমের তিলক দিয়ে ইন্দিরার আস্থা অর্জন করতে হয়ে ছিল আমাদের । আর এই নতুন ভাবনায় ভারত নিজে ১৯৭৪ সালে নিজের কনষ্টিটিউশনে সেকুলারিজমের তিলক লাগিয়ে নেয়। এর মানে ভারত কেমন রাষ্ট্র হবে সে সম্পর্কে ৪৭ সাল থেকেই গণতন্ত্র মানে সাধারণতন্ত্রই ভারতের নেতাদের কাছে যথেষ্ট মনে হয়েছিল। কিন্তু নতুন পড়শি হিসাবে (মুসলমান) বাংলাদেশ হাজির হওয়াতে আমাদের সেকুলার হতে হয়। ভারত তখনও সেকুলার নয় এটা দেখতে খারাপ লাগে বলে নিজেও সেকুলার তিলক লাগিয়ে নেয়।

বাংলাদেশ একটা ছোট দেশ হওয়া সত্ত্বেও দিল্লির আধিপত্য সুলভ মনোভাব আছে যে, আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়েছি। এই দম্ভের পর দাবি হচ্ছে, বাংলাদেশকে দিল্লির কথামতো চলতে হবে। এই মনোভাব দিল্লির এখনও আছে।

ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যেও আমরা এই দম্ভ দেখি। ভারতের জনগণ আমাদের সহায়তা করেছে, এটা তো সত্য। কিন্তু, ৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের আলাদা হয়ে যাওয়ার মধ্যে দিল্লির স্বার্থ ছিল, এটাও সত্য। সেই স্বার্থ বাস্তবায়িত করবার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে ভারত।

অতএব দিল্লির সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক সবসময়ই বাংলাদেশের জনগণের আধিপত্য ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের মাত্রা দিয়েই নির্ধারিত হবে। এর অন্যথা হবেনা।। কিন্তু দিল্লির বিরোধিতা করতে গিয়ে আমরা ভারত বিরোধিতা বা ভারতের জনগণের বিরোধিতা করি, সেটা ঠিক না। ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণ আমাদের মিত্র। এই পার্থক্য সব সময় মনে রাখতে হবে। বিশেষত এই বিরোধিতাকে হিন্দু বিরোধিতায় পর্যবসিত করবার রাজনীতিও বাংলাদেশে আছে। সেই দিক সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশের প্রতি দিল্লির যে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য সুলভ দৃষ্টিভঙ্গি তার বিরুদ্ধে জনগণকে সবসময়ই সচেতন থাকতে হবে। দিল্লি সহজে বাংলাদেশকে তার স্বার্থ রক্ষায় কোনো ইতিবাচক সাড়া দেবে মনে করাটা ঠিক হবে না।

একই সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্যগুলোর সম্পর্ক ও সৌহার্দ বৃদ্ধি করা জরুরী। এখন সক্রিয় উদ্যোগ বাংলাদেশ থেকেই নিতে হবে। বিশেষ করে জনগণের সঙ্গে। ভাষার কারনে বাংলাভাষীদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরীর শর্ত রয়েছে। অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরীর প্রস্তুতি হিশাবে তাদের আরও আন্তরিক ও ঘনিষ্ঠ ভাবে জানা, তাদের শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়া দরকার।

ঠিকানা : তাহলে কি দিল্লির শাসক গোষ্ঠী আন্ত:আঞ্চলিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধক শক্তি?

ফরহাদ মজহার : অবশ্যই, এখনকার দিল্লি তাই। সার্ক তো দিল্লি গড়তেই দিল না। এখনো পর্যন্ত আপনি দুই দেশের বাণিজ্য ঘটতি কমানো দূরের কথা, ঘাটতি বৃদ্ধির গতি কমাতে পারেন নি। দুই দেশের মধ্যে কোন অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনবার ক্ষেত্রে আন্তরিকতা তো দেখি না। কোন বাণিজ্য চুক্তিতে আমাদের পণ্যের পালটা প্রবেশাধিকার দিলেও রাজ্য-শুল্ক এবং অশুল্ক বাধা তৈরি করে চলেছে ভারত। কোন বাস্তবায়ন নাই। কী সম্পর্ক গড়বেন তাদের সাথে? ভারত প্রতিদিন বর্ডারে আমাদের জনগণকে পাখির মতো গুলি করে মারে। ভারতের সব চ্যানেল আমরা দেখি, আমাদের কোনো চ্যানেল তারা দেখায় না। আপনি যে কোন দিকে তাকান না কেন, দেখবেন দিল্লি সবসময়ই বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টায় লিপ্ত । তবুও বলি, ভারতের সাথে সম্পর্ক রচনায় বাংলাদেশের নীতিটা হওয়া উচিত ভারতীয় জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কিন্তু দিল্লির আধিপত্যবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ও আগ্রাসী নীতির বিরোধিতা।

ঠিকানা : তাহলে কী ট্রানজিট প্রশ্নে ভারত শুধু সুবিধা আদায়ই নয়, আমাদের ওপর আধিপত্য বজায় রাখতে চায়?

ফরহাদ মজহার : ট্রানিজিট বিষয়ে দিল্লিতে ভারতের সাথে যে ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি হয়েছে. তা মূলত মিলিটারি এগ্রিমেন্ট। এর অর্থ হচ্ছে দিল্লির কাছে এখন প্রধান ইস্যু হচ্ছে চিনকে ঠেকান। তার জন্য নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা। সামরিক ও ভূকৌশলগত প্রস্তুতির ঘাটতি দ্রুত দূর করা। চীনের বিপরীতে দিল্লি নিজের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তৎপর। তা তারা যা চায় করুক। কিন্তু প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়তে গিয়ে দিল্লি বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে চায়, এখানেই বাংলাদেশের জন্য বিপদের জায়গা।

ঠিকানা : শুধু কী চীনের জন্যই নাকি নিজেরও স্বার্থ আছে?

ফরহাদ মজহার : একই বিষয়। চীনা একাডেমিকদের মধ্যে এমন একটা কথা উঠেছে যেন চিন চাইলে ভারতকে শতখণ্ডে ভাঙতে পা্রে। ভারতও নিশ্চয় জানে এটা। কারণ ভারতের স্বাধীনতাকামী রাজ্যগুলোকে চিন সাপোর্ট করলেই এশিয়ার পুরো পরিস্থিতিই পাল্টে যেতে পারে। তবে এখনও চিনের এ রকম কোন নীতি নেই। ভারত চাইছে এমন একটা সামরিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে, যাতে প্রয়োজন হলে সেটা ব্যবহার করতে পারে চিনের বিরুদ্ধে। ট্রানজিট বিষয়ে প্রথম বুঝানো হল লাখ লাখ, পরে কোটি কোটি টাকা আয় হবে। ক’দিন পর দেখা গেল কিছুই নেই। আমার ঘরের ভেতর দিয়ে আপনি মাল নেবেন, কি মাল নেবেন বলবেন না-এটাতো হয় না। আবার ভারতের পূবের সাত রাজ্যে বাংলাদেশের পণ্যের জন্য একটা ছোটখাট বাজার তৈরি হয়েছে, সবচেয়ে বেশি চাহিদা সিমেন্টের। ট্রানজিট পুরাদমে চালু হলে এসব বাজার আমরা হারাতে পারি, এর কি হবে? সব এক তরফা ভারতের স্বার্থে, কোন আলাপ নাই, তাতো হয় না। এতো রীতিমতো অত্যাচার।

ঠিকানা : অত্যাচার মানে?

ফরহাদ মজহার : নিপীড়ন।

ঠিকানা : সেটা নয়। আমাদের রাষ্ট্র যদি স্বাগত জানায়, তাহলে ভারতের দোষ কী?

ফরহাদ মজহার : রাষ্ট্র নয়, স্বাগত জানাচ্ছে মহাজোট সরকার। আর আমাদের রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রেও ঘাটতি আছে। আমি এ জন্যই বলি, আমরা তো এখনো রাষ্ট্রই গঠন করিনি। আমাদের মধ্যে রাষ্ট্রের ভাবনাটাই নেই। আমাদের স্বাধীনতার চেতনা আছে, রাষ্ট্রের চেতনা নেই।

এই সরকারকে দিয়ে আপনি সেনাবহিনী ধ্বংস করেছেন, বিডিআরকে ধ্বংস করেছেন, একতরফাভাবে দিল্লির স্বার্থ রক্ষা করে চুক্তি করেছেন-কিন্তু এই সরকারকেই আবার জনগণ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে। আপনি কী বলবেন?

ঠিকানা : শুধু এই সরকার কেন? যে সরকার ক্ষমতায় আসে দেখা যায় ভারতের প্রতি তাদের আলাদা একটা প্রীতি কাজ করে?

ফরহাদ মজহার : অবশ্যই করে। এরশাদের আমলটাকে আপনি প্রো-ইন্ডিয়ান হিসাবে ধরতে পারেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার আমলে সাইফুর রহমান সাহেবের অর্থনীতিটা কী ভারতের অনুকুলে যায়নি? বিএনপি কী আসলেই ভারতের স্বার্থ রক্ষা করেনি? করেছে, করতেই হবে। এভাবে ক্ষমতায় যেতে হলে, এটা করতেই হবে। দিল্লির বিরুদ্ধে তাদের এখন কী কোন বক্তব্য আছে? তাদের একটাই বক্তব্য আমাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাও- আমরা ক্ষমতায় যাই।

ঠিকানা : আপনি বলতে চাচ্ছেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা যান তারা ভারতের আশীর্বাদ নিয়েই যান?

ফরহাদ মজহার : জনগণ বিভক্ত। ভারত প্রশ্নে যার যার দলের ওকালতি ছাড়া স্বাধীনভাবে আমরা কেউ কিছু বলি না। হাসিনা-খালেদাকে শুধু দোষ দিলেই হবে না। আমরা যেরকম, আমাদের রাণী তো ওরকম হবেই। আকাশ থেকে তো কোন রাণী আসবে না। গুরুত্বপূর্ণ হল, আমাদের সচেতন হওয়া। শেখ হাসিনার আমলে ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইন্টারেস্টিং হল, এখন বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই ভারত বিরোধী। উপমহাদেশের রাজনীতির জন্য এটা শুভ নয়। এর কারন শেখ হাসিনা বাংলাদেশের এবং বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক করতে চান। বাংলাদেশের জনগণ সম্পর্ক চায়, কিন্তু আপনি শুধু একতরফা সব নেবেন, কিন্তু কিছুই দেবেন না, কিছুই দেবার নাম নাই, এটাতো হয় না। এই দিকটায় বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুব্ধ বলেই আমার মনে হয়। ঢাকা-দিল্লির সুসম্পর্ক হোক এটা কে না চায়। কিন্তু দিল্লি সম্পর্ক চায় না, বাংলাদেশকে নিজের অধীনস্থ করতে চায়। বাংলাদেশে এর প্রতিক্রিয়া হবেই।

ঠিকানা : আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে অবস্থান, তাতে বাংলাদেশকেও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে দেখা যায় বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোকে। আমরা কেন এটা ব্যবহার করতে পারছি না?

ফরহাদ মজহার : এই সুযোগটা এখন আপনি নিতে পারেন। আমেরিকা তার দৃষ্টিভঙ্গি এখন বদলাচ্ছে বলেই মনে হয়। আমেরিকা ২০১০ সাল পর্যন্ত মনে করেছিলো ভারতের সাথে তার যে সম্পর্ক, তাতে দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্রক্সিটা ভারত অন্তত দেবে। এজন্য ভারতের সাথে তাদের নিউক্লিয়ার ডিলও ছিল, আবার ভারতের সাথে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ডিলগুলোও ছিল। কিন্তু বর্তমানে মনে হচ্ছে আমেরিকার সে উপলব্ধিতে পরিবর্তন এসেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের সাথে আমেরিকার একটা ফ্রেম ওয়ার্ক চুক্তি হয়েছে। এখন তারা মনে করছে, ছোট ছোট দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বাড়ানো উচিত। সম্পর্কটা তারা সরাসরি করতে চায়, কোন ভায়া বা মিডিয়ার মাধ্যমে নয়। মানসিকতার এই সাম্প্রতিক পরিবর্তন প্রেসিডেন্ট ওবামার সম্প্রতিক অস্ট্রেলিয়ায় দেয়া বক্তৃতায় স্পষ্ট। তাঁর বক্তব্যের থিসিসটা ছিলো যে, আগামী দিনের লড়াইয়ের ক্ষেত্রটা হচ্ছে এশিয়া। এশিয়ায় অর্থনৈতিকভাবে কিংবা যুদ্ধের প্রতিযোগিতায় যারা টিকবে তারাই আগামী দিনে বিশ্বের নেতা হতে যাচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই একটা বড় ধরনের নীতির পরিবর্তন হয়েছে এশিয়া কেন্দ্র করে, দক্ষিণ এশিয়া যার অন্তর্ভূক্ত। আর এ কারণেই বাংলাদেশ ভূ-কৌশলগত ভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দেশে পরিণত হয়েছে।

ঠিকানা : তাহলে কী আমাদের মেধা এবং প্রাজ্ঞতার অভাবে আমরা নিজেদের স্বার্থ আদায় করতে পারছিনা?

ফরহাদ মজহার : আপনারা লিখে রাখতে পারেন, ২০১৪ সালের পর আমেরিকা ম্যাসিভলী বাংলাদেশের অর্থনীতিতে, রাজনীতিতে, বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে ঢুকে পড়বে। শুধু তাই নয় পাশাপাশি উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশী কম্যুনিটিকেও তারা অন্যভাবে গুরুত্ব দেয়া শুরু করবে। আমেরিকা মনে করে, বাংলাদেশ একটা বড় মুসলমান দেশ এবং এ রকম একটা দেশের সাথে তারা যদি সফল সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে তাহলে আফগানিস্তান, ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে- সে ক্ষত তারা হয়ত কাটিয়ে উঠতে পারবে। আমেরিকার এই পরিবর্তনশীল নীতিকে কীভাবে ব্যবহার করবো, তা নির্ভর করবে আমাদের মেধা ও প্রজ্ঞার উপর। আমেরিকা সাম্রাজ্যবাদী দেশ। তারা স্বার্থ ছাড়া কিছু করবে না, এতো সরল ভাবে সাম্রাজ্যবাদ বোঝা যায় না। পুঁজির পুঞ্জিভবন ও স্ফীতির নিজস্ব কিছু নৈর্ব্যক্তিক প্রক্রিয়া আছে। সেখানে নিজের সুবিধা আদায় করে নেবার কোন সুযোগ আছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। কিন্তু তাদের সাথে নিগোসিয়েট করবার ক্ষমতা আমাদের আছে কিনা, সেটাও বিচার করতে হবে। আমি মনে করি, সেই ক্ষমতাটা গড়ে তুলবার জন্যই আমাদের এখন থেকেই তৈরি হতে হবে। এখানকার (আমেরিকার) কমিউনিটিতে যারা আছেন তাদের উদ্দেশ্যে আমার বক্তব্য হল, দলগত বিভাজনটাকে বাদ দিয়ে বৃহত্তর কমিউনিটির জায়গায় দাঁড়িয়ে একজন আমরিকান সিটিজেন হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে প্রভাবিত করবার জন্য সক্রিয় হওয়াটা বেশি জরুরী। এই সুযোগটা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি। সেটা হতে পারে কংগ্রেসম্যানের মাধ্যমে, স্টেট ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে বা ইউএস এইডের পলিসির মাধ্যমে। তাদেরকে মার্কিন নাগরিক হিশাবে আপনাদের বুঝানো উচিত যে, বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন নীতি আমাদের দেশের জন্য ভাল হচ্ছে না। সেটা মার্কিন জনগণের স্বার্থেরও অনুকুল নয়।

নেগোশিয়েট করার কথা বলছি কোন সুবিধাবাদী অবস্থান থেকে নয়। মার্কিন নাগরিক হিশাবে আপনাদের এই সুযোগটা আছে। সেটা ব্যবহার না করবার কোন যুক্তি নাই। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার রাজনীতি শুধু লড়াই আর যুদ্ধে হয়, তাতো নয়। নির্ভর করছে, আপনি কোন অবস্থানে আছেন এবং আপনার প্রধান কর্তব্যটা কী, সেইসব বুঝতে পারা.।।

ঠিকানা : সরকার পদ্মা সেতু ও বিশ্বব্যাংক নিয়ে বাহাস অব্যাহত রেখেছে। যুক্ত হয়েছে বিএনপিরও। আপনার কী অভিমত?

ফরহাদ মজহার : পদ্মা সেতুতে হাসিনা যে দুর্নীতি করেননি, এটা তিনি প্রমাণ করেননি। উনি প্রমাণ না করে নানা রকম টালবাহানা করছেন। বামপন্থী থেকে শুরু করে ডানপন্থী পর্যন্ত সকলে বলছে বিশ্বব্যাংক একটা সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠান, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান। সেটা ঠিক আছে, না হয় মানলাম। কিন্তু তাতে এটাতো জাস্টিফাই করে না যে শেখ হাসিনার সরকার কিম্বা তার পরিবার দুর্নীতি করবে, আর দুর্নীতি করলে আমরা মেনে নেব। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান, ফলে আমিও দুর্নীতি করবো, শেখ হাসিনার সরকারও দুর্নীতি করবে - এটাতো হতে পারেনা। বিএনপি দুর্নীতি করেছে বলে আমাকেও দুর্নীতি করতে হবে এটাও কি কোন যুক্তি হতে পারে? পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে যে অভিযোগ উঠেছে তা তদন্ত না করে নিজের স্বচ্ছতা প্রমাণ করতে পারেননি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যতটুকু আমি বুঝি তাতে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠি এতে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ। ক্ষুব্ধ হলেও এটা মনে করবার কোন কারণ নেই যে তারা শেখ হাসিনার উপর থেকে সমর্থন তুলে ফেলেছে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনার পেছনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় ভূমিকা রয়েছে । সেখানে কোন পরিবর্তন হয়েছে বলে আমার এখনও মনে হয় নি। সেপ্টেম্বর এগারোর ঘটনার পরে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ ঘোষণার যে মার্কিন নীতি, সেই নীতি বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। সে কারণে শেখ হাসিনার উপর থেকে আমেরিকার সমর্থন উঠে গেছে, চিন্তা করাটা ঠিক নয়।

ঠিকানা : এখন সরকার বলছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ দিয়ে পদ্মা সেতু করবে। বিএনপি বলছে, আমরা দুইটা সেতু করবো...

ফরহাদ মজহার : এগুলো হল রাজনৈতিক প্রচারণা এবং রাজনৈতিক চাতুরী। সাধারণ মানুষের টাকা দিয়ে যদি হত, তাহলে বিশ্বব্যাংকের কাছে আগে কেন গিয়েছিলেন? আর যদি করেনও তাহলে মানুষের টাকা নিয়ে যে দুর্নীতি হবে না তার কি কোন গ্যারান্টি আছে? সরকার তো এখনও বিশ্বব্যাংকের তোলা দুর্নীতির অভিযোগের কোন সুরাহাই করেননি। বিএনপির সময়ে বিশ্বব্যাংক টাকা দেবে না, তা কিন্তু বলেনি। তবে বিএনপি যেটা বলছে, সেটা রাজনৈতিক স্টান্টবাজি ছাড়া কিছু নয়।

ঠিকানা : তার মানে কয়েনের এপিঠ-ওপিঠ?

ফরহাদ মজহার : আমাদেরকে এই দু’জায়গা থেকে বের হয়ে স্বাধীন নাগরিকদের জায়গা তৈরি করতে হবে। আমি সুশীল সমাজের কথা বলছি না। অন্য কথা, অন্য রাজনীতির কথা বলছি। আমাদের সুনির্দিষ্টভাবে কিছু দাবি তোলার কথা বলছি। আমি শুরুতেই বলেছিলাম, আমাদের একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা। এর সঙ্গে এই দাবি যুক্ত করতে হবে যে আমাদের একটি ম্যাক্রো ইকোনমি পলিসি লাগবে। যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নীতি অবাধ বাজার ব্যবস্থা প্রবর্তন ও বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রকে বাজারের অধীন করবে না। রাষ্ট্র বাজারের বেগার খাটবে না বরং রাষ্ট্র বাজারের ওপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাগে বাংলাদেশের জন্য এমন একটি শক্তিশালী অবস্থান আদায় করতে সচেষ্ট হবে যাতে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশের অনুকুলে থাকে। বিদেশি বিনিয়োগ মাত্রই ইতিবাচক এই ভূয়া ধারণা ত্যাগ করতে হবে। সর্বোপরী শ্রমিককে মজুরি কম দিয়ে পুঁজির অকাতরে শোষণের নীতি বন্ধ করতে হবে। ইত্যাদি।

ঠিকানা : আগের এবং বর্তমানের যে নেতৃত্ব দেখেছেন তাদের মধ্যে কি এসব ধ্যান ধারণার কোন লক্ষণ আপনি কখনো দেখেছেন?

ফরহাদ মজহার : এসব দাবি আমাদেরকেই তুলতে হবে। এগুলো রাজনৈতিক দল করে দেবে, আমি কখনই মনে করিনা। ধরুন আপনাদের ঠিকানা পত্রিকা। এটাকে কিন্তু পত্রিকা ভাববেন না। এটা একটা ইনস্টিটিউশন। এটা ওপিনিয়ন তৈরি করে? এটা একটা পাওয়ারফুল ইনস্ট্রুমেন্ট। এটা আপনার হাতে আছে। অন্যের হাতে নাই। আপনি ব্যবহার করেন। শেখ হাসিনার উপর নির্ভর করে লাভ নেই। এই ইনস্ট্রুমেন্ট আপনার কাজকে যথেষ্ট এগিয়ে দেবে। বাংলাদেশেও অনেক পত্রিকা আছে। তারা কিন্তু শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার চেয়ে বেশি শক্তিশালী। তারাও কিন্তু প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ঠিকানা তেমনি একটা পত্রিকা, যেটা জনমত তৈরি করতে সক্ষম। যেহেতু আপনারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালি কমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব করেন, সেহেতু আপনারা খুবই শক্তিশালী। অনেক ক্ষেত্রে আপনারা আ’লীগ-বিএনপির চেয়েও শক্তিশালী। যদি বাংলাদেশের কী করা উচিত তার কোন রূপরেখা এখানে আপনাদের লেখালিখি তৎপরতার দ্বারা পত্রিকায় দাঁড় করাতে পারেন, তখন নিজেদের শক্তি আরও টের পাবেন। কখনই বাংলাদেশের একটা কলকাঠিও নড়েনা আন্তর্জাতিক মুরুব্বীদের ইশারা ছাড়া। হয় সেটা নীরব সমর্থনে অথবা তাদের সরাসরি হস্তক্ষেপে। সেই ক্ষেত্রে এখানে বাংলাদেশের পক্ষে যদি আপনি একটা জনমত তৈরি করতে চান, তাহলে এটা শুধু কমিউনিটি পত্রিকায় করলে হবে না। ধীরে ধীরে এই দেশের অন্যান্য প্রভাবশালী নাগরিকদের মধ্যেও প্রচার করত হবে। আপনি কী করতে চান সেটা তাদেরকেও বলুন। তাদেরকে বোঝাতে হবে হবে বাংলাদেশ বলে একটা দেশ আছে। এটার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান আমেরিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটা আপনি করতে পারলে দেখবেন ৬ মাসের মধ্যেই রূপ পাল্টে যাচ্ছে।

আমি মনে করি, বাংলাদেশের গুণগত রূপান্তর সম্ভব এবং খুবই তাড়াতাড়ি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটা সম্ভাবনাময় জায়গায় যাওয়ার লক্ষণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। জাতীয় রাজনীতি এখানে প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে আছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি আপনাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের উপর নির্ভরশীল। বিশ্বব্যাপী যদি কোন র‌্যাডিক্যাল পরিবর্তন হয় তখন ধনী দেশগুলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুখ থুবড়ে পড়লেও, বাংলাদেশে তার প্রভাব তেমন না পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারন যা্রা রেমিটন্স পাঠাচ্ছেন তারা খেটে খাওয়া সাধারণ শ্রমিক। বাংলাদেশের জনগণের লাভ ছাড়া ক্ষতি হবেনা। এখন কাজটা হচ্ছে চাবুক মেরে মেরে ঠিক করা। আর সে ক্ষেত্রে দলের চেয়ে পত্রিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

ঠিকানা : বাংলাদেশকে সব পক্ষই বলে বিপুল সম্ভাবনার দেশ। তবুও দেশের মানুষের দুর্গতি যায় না কেন?

ফরহাদ মজহার : সেটাতো আমাদের নীতির কারণে। শুধু সরকারকে বললে হবেনা। যেমন কৃষির কথা বললে অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষই মনে করে আধুনিক কৃষিই একমাত্র পথ। সার ও বিষ ছাড়া পরিবেশ সম্মত কৃষি যে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করে, প্রাণবৈচিত্র রক্ষা করে, প্রকৃতিকে রক্ষা করে - এটা তারা বিশ্বাসই করেনা। পৃথিবীতে যেসব দেশ প্রাণ বৈচিত্রে সমৃদ্ধ, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম একটা দেশ। এই দেশতো শুধু অর্গানিক ফুড খাইয়ে ধনী হয়ে যেতে পারে। মিষ্টি পানির দেশ বাংলাদেশ। শুধু পানি বিক্রি করেই ইউরোপের মত হয়ে যেতে পারে। আমিতো কোন সমস্যা দেখিনা। আমি মনে করি, এটার জন্য জনপ্রিয় বা লোকপ্রিয় চিন্তা ও দূরদৃষ্টির প্রচার এখন খুবই জরুরী। সেই কাজটা আমরা করি না। কোন কিছুই আকাশ ফুটা করে মাটিতে পড়ব না। এটা আমাদের তর্কাতর্কি লেখালেখি করেই দাঁড় করাতে হবে।

ঠিকানা : বাংলাদেশে ইদানিং তৃতীয় শক্তির কথা শোনা যাচ্ছে। আপনিও কি শুনেছেন?

ফরহাদ মজহার : তৃতীয় শক্তির কথাটা আমরা তখনই বলি, যখন রাজনীতিকে আমরা ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হই। এই ব্যররথতার কারণে একটা ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব হাজির করি। অর্থাৎ বলতে চাই এক এগারোর মত ছদ্মবেশে বা সরাসরি আবার সেনাবাহিনী আসবে কিনা। হ্যাঁ আসতেও পারে। তবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করে যদি অন্য কোন পথের কথা আপনি বলে থাকেন, তাহলে সে রকম কোন সম্ভাবনা এই মুহুর্তে আমি দেখছিনা। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বলতে আমি শুধু নির্বাচন বুঝাচ্ছি না, সেটা জনগণের মধ্য থেকে স্বতস্ফূর্ত আন্দোলন-সংগ্রাম হতে পারে। শ্রমিক বিক্ষোভ বা কৃষক আন্দোলন বা কোন একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে গণবিক্ষোভ হতে পারে। এইসব হচ্ছে তাতো দেখতেই পাচ্ছেন।

বাংলাদেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক ধারার মধ্যে দু ধারারই প্রাধান্য। অন্য যেসব ধারা আছে তাদেরকে আপনি মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করতে পারেন। একটি ধারাকে ‘বাম’ বলতে পারেন, ক্লিশে শোনালেও ‘প্রগতিশীল’ বলতে পারেন, যদিও মার্কস বা লেনিনের চোখে এদের কাজকর্ম অনেক সময় চরম প্রতিক্রিয়াশীলকেও হার মানায়। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এরা চিন্তা, চেতনা ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সাম্রাজ্যবাদের স্থানীয় বরকন্দাজের ভূমিকা পালন করেছে। কখনও জেনে, কখনও না জেনে এরা ইসলামফোবিয়া বা ইসলামী আতংকে ভোগে। অথচ এদেরই কাজ ছিল বাংলাদেশে ইসলাম প্রশ্ন বা ধর্মের প্রশ্নকে দার্শনিক ও রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করা। বোঝা উচিত ছিল বাংলাদেশের জনগণের আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবাদ বিরোধী চেতনার ধারা তাদের নিজেদেরই ব্যর্থতার কারনে তারা ধারণ করতে অক্ষম। এরা জনগণের কাছে গিয়ে জনগণের মন জয় করবার চেষ্টা করে না, বিপ্লবী হওয়ার চেয়েও নিজেদের ইসলাম-বিদ্বেষী ‘নাস্তিক’ প্রমাণ করতে বেশি আগ্রহী। ফলে জনগণ সঙ্গত কারনেই তাদের প্রত্যাখান করে। তাদের ধারণা সকল পুঁজিতন্ত্র বিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই কার্ল মার্কস বা লেনিনের নামেই হতে হবে। কার্ল মার্কস বা লেনিন যখন দুনিয়ায় আসেন নি তখনও তো ইতিহাসে বিপ্লব, বিদ্রোহ বা রূপান্তর ঘটেছে এবং সেই ক্ষেত্রে ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের দেশেও সেটা ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

তবুও বড় দুটি দলের সাথে তারা একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা করে সবসময়ই। কিছু নেতা ও দলের আওয়ামি লীগের নির্লজ্জ লেজুড়বৃত্তি বাদ দিলেও বাংলাদেশে যারা আছে তাদের আপনি উপেক্ষা করতে পারেন না, বাম রাজনৈতিক চিন্তা বা ধারা ক্ষীণ বা ছোট হলেও গৌণ নয়। তাদের প্রভাবশালী বলেই আমি মনে করি। তারা হয়তো এই মুহূর্তে ক্ষমতায় যাবে না, তবে সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও আমাদের চিন্তাচেতনার রূপান্তরে তারা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।

যদি তাদের বাদ দেন তাহলে তৃতীয় শক্তি নামে যাদের ইঙ্গিত দিচ্ছেন তারা হচ্ছে ইসলামপন্থিরা। বাংলাদেশে যাদের শক্তিশালি আবির্ভাব আপনি ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না। বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এদের ওপর ব্যাপক জেলজুলুম অত্যাচার নির্যাতন চলছে। যাদের সন্ত্রাসী রাজনীতির সঙ্গে কোন যোগ নাই অথচ সন্ত্রাসী বলে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, তাদের দল নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। ইসলামি জঙ্গি বলে নিরীহ নাগরিকদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। অথচ এদের মধ্যে বিশাল একটি অংশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষিত, মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে তারা এসেছে। এদের মানুষ হিশাবেও গণ্য করা হয় না অনেক সময়। এদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে সবসময়ই। ইসলামপন্থী দল করা মানে সন্ত্রাসী হওয়া – এর পক্ষেই সমাজে প্রচার বদ্ধমূল— তারপরও এদের বিস্তার ঘটছে। জেল জুলুম নির্যাতনের মুখে এটাই ঘটা স্বাভাবিক। সেটা কওমি মাদ্রাসার কিম্বা অন্যান্য মাদ্রাসার ছেলেমেয়েদের মধ্যে নয়, ঘটছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে। আপনি মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলবেন, আর সেটা ইসলামী হলে মত প্রকাশ করতে দেবেন না, তাতো হয় না। এর ফলে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও বাম দলের ওপর আস্থা চলে যাচ্ছে মানুষের।

যেহেতু বিদ্বেষ ও হিংস্র বিরোধিতা ছাড়া ইসলাম ও ইসলামি রাজনীতি নিয়ে মূলধারার গণমাধ্যম আলাপ আলোচনা করতে অক্ষম ও ব্যর্থ, ফলে ইসলামপন্থিদের ওপর জেল জুলুম নির্যাতন অনেকের চোখে মূলধারার চিন্তা ও রাজনীতির নৈতিক পরাজয়ের চিহ্ন হয়ে উঠেছে। এই ব্যাপারগুলো বাংলাদেশের আগামি দিনের রাজনীতি বোঝার জন্য খুবই গুরুতপূর্ণ।

বাংলাদেশের গুণগত পরিবর্তন যদি সাধন করতে হয় তাহলে প্রধান দুটি ধারার নির্মোহ এবং নির্মম সমালোচনা এবং ইসলাম প্রশ্ন মোকাবিলার মধ্য দিয়েই সেটা সম্ভব হয়ে উঠবে বা তাকে সম্ভব করে তুলতে হবে। আর সেটা করতে হবে মানবেতিহাসে মার্কসের আগে বা পরের সকল বিপ্লবী আন্দোলন সংগ্রাম ও রূপান্তরের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা্র স্থিতি সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী মোহ ভেঙ্গে যাবার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশেও নতুন সম্ভাবনা দ্রুত তৈরি হয়ে চলেছে। আমরা তাকে আরও দ্রুততর করতে পারি কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। সে প্রক্রিয়ায় বিপ্লবী গণতান্ত্রিক ধারা বা সোজা কথায় বাম রাজনীতির ধারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে সেটা পুরানা, প্রাচীন বা বাতিল হয়ে যাওয়া বামগিরি দিয়ে হবে না। সমাজের বিকাশ এবং গণমুখী রাজনীতির শক্তি বৃদ্ধির মাত্রা অনুযায়ী বোঝা যাবে তারা ক্ষমতায় আসবে কি আসবে না।

ঠিকানা : মানুষ বার বার বিশ্বাস করে যাদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এনেছে, তারাই প্রতারণা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়তই?

ফরহাদ মজহার : সমাজের মধ্যেই মুশকিল রয়েছে, পরিবর্তনের চিন্তাটা নেই। কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো যায় না। কাউকে ভোট দিয়ে লাভ কী? যেখানে সমাজেই ক্যাপাসিটিটা নেই, সেখানে হাসিনার কাছ থেকে আমি কী আশা করতে পারি, কী আশা করতে পারি খালেদার কাছ থেকে? সমাজের মধ্যে চিন্তাটা আগে আসতে হবে। সে জন্যই আমরা বার বার বলি যে, সমাজ গঠনের জন্য একটা গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র লাগবেই। নতুন চিন্তা ও বৈপ্লবিক দূরদৃষ্টি দরকার। দরকার আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সকল বিষয়েই নতুন নীতি। কিভাবে করব বা কোন পদ্ধতিতে করব তা নিয়ে নিদেনপক্ষে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা শুরু করতে পারি আমরা। সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ একটা নীতি দানা বাঁধলে গিয়ে শেখ হাসিনা বা খালেদাকে আমরা বলতে পারি -এই নীতিতে দেশ চালান। তারা চালাবেন না জানি, কিন্তু সমাজ ও রাজনীতিকে বদলাবার কোন চিন্তা – যা একই সঙ্গে বাস্তবায়নযোগ্য – সেই রকম কোন চিন্তা সমাজে দানা না বাঁধলে পরিবর্তন আসবে না। আমরা কিন্তু সেই গোড়ার কাজটা করিনা। সেই দিকে আমাদের মনযোগ নাই। আমরা ভোট দিয়ে বসে থাকলাম। বললাম, এটা তোমার দায়িত্ব। হাসিনা নিজের স্বার্থে যা দরকার তাই করছে, খালেদা এলেও তাই করবেন।

এটা শুধু বার বার বিশ্বাস করে ক্ষমতায় আনার ব্যাপার নয়। সংবিধানের এখনকার যে অবস্থা তাতে নির্বাচনে কোন ফায়দা নাই। যারা ক্ষমতার লড়াই করেন তারা জানেন ক্ষমতায় গেলেই বিদ্যমান সংবিধানের কারনে রাষ্ট্র আর সরকার বাংলাদেশে কার্যত সমার্থক হয়ে যায়, রাষ্ট হয়ে যায় রাজনৈতিক দলের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার। এখন চোরের ওপর রাগ করে আমরা তো মাটিতে ভাত খেতে পারি না। রাষ্ট্রকে কিভাবে সরকারের হাত থেকে রক্ষা করা যায়, সেটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে আগে। রাষ্ট্র ও সরকার এক কথা নয়। রাষ্ট্র ‘গঠন’ করা আর সরকার নির্বাচিত করাও ভিন্ন দুটো প্রক্রিয়া। সরকারকে জনগণের অধীন রাখার আইনী নিশ্চয়তা সংবিধান বা গঠনতন্ত্রে না থাকার মানে হচ্ছে জনগণ ও রাষ্ট্র উভয়কেই রাজনৈতিক দলের জিম্মি করে রাখা। যেখানে রাজনৈতিক দল মানে সংঘবদ্ধ মাস্তান বাহিনীর অধিক কিছু নয় সেখানে বিপদটা কল্পনা করুন। জনগণকে অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য নতুন গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এর কোন বিকল্প নাই। সরকারকে গঠনতন্ত্রের অধীনস্থ রাখতে হবে। সংবিধান বা গঠনতন্ত্রের বাইরে বা উর্ধে কেউ নয়। যেমন ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আমরা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্য বা সরকারকে সংবিধান বদলাবার ক্ষমতা দিয়ে রাখি তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইচ্ছা মত তা বদলাবে। শেখ হাসিনা যেমন এখন পঞ্চদশ সংশোধনী দিয়ে সংবিধানেকে দলীয় লিফলেট বানিয়ে ফেলেছেন। বিপজ্জনক পরিস্থিতি।

বাংলাদেশের বাস্তবতা অনুযায়ী রেফারেন্ডাম ছাড়া কিম্বা নতুন কনস্টিটুয়েণ্ট এসেম্বলি ছাড়া গঠনতন্ত্র বদলাবার অধিকার কাউকে দেওয়া যাবে না। সেটা হোক বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ বা জাতীয় সংসদ। জনগণ যে গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করবে রাষ্টের সকল অঙ্গকেই তার অধীন থাকতে হবে, আর একই সঙ্গে সেটা সরকারকে জনগণের ইচ্ছা, অভিপ্রায় ও সংকল্পের অধীন রাখবার কার্যকর উপায়ও হয়ে উঠবে। সরকার সংবিধান বা গঠনতন্ত্রের অধীন হয়ে যেন কাজ করে তার জন্য নিদেনপক্ষে আইনী বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করার এটা একটি পথ। জনগণের প্রণীত গঠনতন্ত্রের অধীন হওয়া মানে জনগণের অধীন থাকাও বটে। বাংলাদেশের জন্য নতুন গঠনতন্ত্র এই জন্যই আবশ্যিক। এই জন্য বারবারই নতুন সংবিধানের কথা বলি আমি।

দেখুন, সবাই বলে কামাল হোসেন বাংলাদেশের সংবিধান লিখেছেন। তিনি ব্যারিষ্টার এবং উকিল মানুষ, ফলে উকিলী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি সংবিধান বুঝতেই পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান কামাল হোসেন লিখলে, সেটাতো আমাদের গঠনতন্ত্র হলো না। সেটা বাংলাদেশের জনগণের নয়। এতটুকু বুঝলেই বুঝবেন গঠনতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের চিন্তাটা অদ্ভূত, বিকৃত। গঠনতন্ত্র প্রণয়ণের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া একই সঙ্গে জনগণকে গঠনতন্ত্র সম্পর্কে শিক্ষিত ও সচেতন করার প্রক্রিয়াও বটে। একজন উকিল মুসাবিদা করলেন আর সেটা আওয়ামি লীগের স্বঘোষিত সংবিধান সভায় পাশ হয়েছে বলেই সেটা জনগণের সংবিধান হয়ে গেল?

এতবড় একটা সংবিধান, মাথায় বাড়ি দিলে মাথা ফেটে যাবে। আ্মাদের তো এতবড় সংবিধানের প্রয়োজন নেই। আমরা কী চাই, সংবিধানে সেটা সহজ সরল সূত্র আকারে থাকলেই যথেষ্ট। যেমন ব্যক্তির অধিকার , ব্যক্তির মর্যাদা রক্ষা এইসব। এর আগে তিনটি বিষয়কে দাবি আকারে বলেছি।

সংখ্যাগরিষ্ঠতার নামে রাজনীতিবিদরা জনগণের মানবিক ও নাগরিক অধিকার যেন হরণ করতে না পারে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এখনকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সরকার এসে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্র যেন বদলে দিতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।

আমরা বলি, ৭২’র মহান পবিত্র সংবিধান। সংবিধান ‘পবিত্র’ হওয়ার অর্থ কি? এটা কী কোরআন শরীফ নাকি যে আল্লাহ তরফে এসেছে, তাই বদলানো যাবে না? সারাক্ষণই সবাই এটা বদলাচ্ছে। কেউ বন্দুকের খোঁচায় বদলায়, কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বদলায়। এটা আর মানা যাবে না। নাগরিক হিসেবে আমাদের অধিকার আমরা ক্ষুণ্ণ হতে দেব না, এই রাজনৈতিক দৃঢ়তা ছাড়া আমরা এগিয়ে যেতে পারবো না।

ঠিকানা : এখন আবার নতুন বিপদ। নির্ধারণ করা যাচ্ছে না কে বড়? সংসদ, নাকি বিচারবিভাগ, নাকি সংবিধান, নাকি প্রধানমন্ত্রী?

ফরহাদ মজহার : কেউই নয়, সংবিধান যদি সকলকে জনগণের অধীন রাখত তাহলে এখন যেভাবে তর্কটা উঠছে সেইভাবে উঠতো না। আওয়ামি লিগ আমলে নির্বাহী বিভাগ দলীয় স্বার্থে বিচার বিভাগকে দিয়ে সংবিধান বদলাবার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। সংবিধান বদলানো বিচার বিভাগের কাজ নয়। এর আগে বিচারকরা নিজেদের স্বার্থে সংবিধান বদলিয়েছে, আবার বিচার বিভাগকে ‘স্বাধীন’ করবার জন্য আইন করতে বলেছে। তখন বিচার বিভাগ না হোক কিছু বিচারপতি ভাবতে শুরু করেছেন তারা জাতীয় সংসদের চেয়ে কম কিসে? বিচারকরা নির্বাচিত কেউ নন। তারা সংবিধান ব্যাখ্যা করতে পারেন, কিন্তু সংবিধান বদলাতে পারেন না। যে-সংবিধান রক্ষা করবেন বলে শপথ নিয়ে তিনি বিচারক হয়েছেন, সেই সংবিধানের কোন্‌ অনুচ্ছেদ বাদ যাবে আর কোন অনুচ্ছেদের বদল বা নতুন অন্তর্ভুক্তি তিনি মার্জনা করবেন সেই ক্ষমতা তাকে কে দিল? কিন্তু অসাংবিধানিক কাজ তো বিচারকরা করেছেন। শপথ নেবার সময় তো কেউ বলেন নি যে জিয়াউর রহমান দ্বারা সংশোধিত সংবিধান রক্ষা করার শপথ আমি নেব না।

আমি যে গণতান্ত্রিক কনস্টিটিউশনের কথা বলে আসছি সেখানে জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের একক ও অখণ্ড ক্ষমতা চর্চার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গের ক্ষমতার পরিধি ও সীমা নির্ধারিত রাখার কথাও বলি। আমি ‘স্বাধীন’ বিচার বিভাগ বলে গণতন্ত্রে কোন বিচার বিভাগ আছে বা থাকে বলে মনে করি না। এটা গণতন্ত্র বিরোধী ও গণবিরোধী ধারণা। বিচারবিভাগকে অবশ্যই জনগণের প্রণীত গঠনতন্ত্রের অধীন হতে হবে। বিচারক বলে তো কেউ আর গঠনতন্ত্রের বাইরে বা উর্ধে থাকতে পারেন না। তবে বিচার বিভাগ ‘পৃথক’ তো থাকবে সন্দেহ নাই, সেটা কাজের দিক থেকে নির্বাহি ও আইন প্রণয়নী সংস্থা থেকে পৃথক এই অর্থে ‘স্বাধীন’ হবে যে বিচারবিভাগের কাজে রাষ্ট্রের অন্য কোন অঙ্গ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এই অর্থের বাইরে স্বাধীন বিচার বিভগ একটি ঘোড়ার দিম জাতীয় তত্ত্ব।

ঠিকানা : ওয়ান ইলেভেন ছিল আমাদের জন্য অন্য রকম অভিজ্ঞতা। আপনার জন্য ছিল কেমন?

ফরহাদ মজহার : সে সময় স্থানীয় ইউএনডিপির পক্ষ থেকে ডিস্টোর্ট করে ভুয়া রেফারেন্সে সেনাবাহিনীকে বলা হয়েছিল, যদি কোন ভূমিকা না গ্রহণ কর তাহলে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে তোমরা যেতে পারবে না।

ঠিকানা : এটাতো একটা চিঠি ছিল?

ফরহাদ মজহার : হ্যাঁ, চিঠি ছিল।

ঠিকানা : এটা কী আসলেই সত্যি ছিল?

ফরহাদ মজহার : হ্যাঁ, সত্যি ছিল।

ঠিকানা : কিন্তু পরবর্তীতে বলা হলো, মিথ্যা?

ফরহাদ মজহার : এটাতো ওদের দিক থেকে বলা হয়েছে, কিন্তু চিঠিটাতো ছাপা হয়েছে। পরবর্তীতে সমালোচনার মুখে এটা তারা অস্বীকার করেছে। এবারের হাসিনার সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমন কোন চিঠির আনুষ্ঠানিক প্রাপ্তি অস্বীকার করেছে। তবে এটা নিশ্চিত এক এগারোতে একটা পরিকল্পনা ছিল হাসিনা-খালেদাকে মাইনাসের। ‘মাইনাস’ কথাটা আপনি যেভাবে খুশি বুঝতে পারেন। সব রকম অর্থই এর মধ্যে নিহিত আছে।

অন্যরা উদ্যোগ নিলেও সেনাবাহিনীতে মঈন উদ্দিন সাহেব এর নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি বিএনপির লোক ছিলেন, ফলে বুঝতে হবে এটা বিএনপির আভ্যন্তুরীণ দ্বন্দ্বের ফল। এই ঘটনা ঘটাবার পর মইন উদ্দিন বুঝতে পেরেছিলে তিনি আসলে দেশদ্রোহিতার কাজ করেছেন এবং বিএনপি ক্ষমতায় এলে তার বিচার হবে। বিচারের ভয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত করতে হয়েছে। যদিও আজ হোক বা কাল হোক বিচারের সম্মুখীন তাকে হতেই হবে বলে আমার বিশ্বাস। ফখরউদ্দিন সাহেবকেও।

এক এগারোর পুরো প্রক্রিয়ার পেছনে আন্তর্জাতিক সমর্থনও ছিল। পরদেশি শক্তিমান রাষ্ট্রগুলো ঠিক কি চেয়েছিল বুঝতে হবে আমাদের। তারা পরীক্ষা করতে চেয়েছিল তত্ত্বাবধায়কের মত এরকম একটা সরকার দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের জনগণ কীভাবে নেয়। তারা বাংলাদেশে গণতন্ত্র থাকুক বা না থাকুক তাতে আগ্রহী নয়। তারা চায় ঝামেলামুক্ত শাসনব্যবস্থা যাতে বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগ ও মুনাফা অর্জন মসৃণ হয়। এর নাম তাদের ভাষায় ‘সুশাসন’। একটা পর্যায়ে তাদের মনে হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ বেসামরিক লেবাসে সামরিক শাসন গ্রহণ করবে না। ফলশ্রুতিতে মঈন উদ্দিনরা নিজেদের পিঠ বাঁচাতেই হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে সরে যায়। অন্যদিকে তাদের নিজেদের মধ্যেও মতবিরোধ তৈরি হয়েছিলো এ নিয়ে। যে কারণে তাদের আদি যে পরিকল্পনা সেটা আর সফল হয়নি।

ঠিকানা : এটা তাহলে তাদের ভেতরের দ্বন্দ্বের জন্যই সফল হয়নি?

ফরহাদ মজহার : ঠিক। এ জন্যই এদের অধিকাংশেরই নানান সময়ে চাকরি গিয়েছে অন্যদিকে মাসুদ উদ্দিন এখনো চাকরিতে বহাল তবিয়তে। ইনি রক্ষিবাহিনী থেকে এসেছেন। ফলে বিরোধটা শুধু মত বা স্বার্থের নয়, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে কে কিভাবে এসেছে সে ইতিহাসও নেপথ্যে কাজ করেছে।

ঠিকানা : আপনিতো অধিকারের সাথে আছেন? বিডিআর-এর বিচার কেন বন্ধ করতে চাচ্ছেন আপনারা?

ফরহাদ মজহার : আমরা তো বিচার বন্ধ হোক চাচ্ছি না। যেভাবে বিচার চলছে সেখানে অভিযুক্তের মানবাধিকার রক্ষিত হছে কিনা তার প্রশ্ন উঠেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি মানবাধিকার সংস্থা গণহারে বিচারের পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি তুলেছে। এই ভাবে বিচার করা বন্ধ করবার কথা তারা বলছে।

ঠিকানা : কেন?

ফরহাদ মজহার : প্রায় ৬০০০ অভিযুক্ত বিডিআর সদস্য ছিলেন তাদের গণবিচার হচ্ছে। গণবিচারে তাদের ন্যায়বিচার পাবার অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে হিউমেন রাইটস ওয়াচ বলছে। যে কোন মানবাধিকার কর্মী তাই বলবেন। অভিযুক্তদের ন্যায্য বিচার পাবার অধিকারকে তো অবশ্যই আছে।

হিউমেন রাইটস ওয়াচ এ বিষয়ে একটি বড় প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বিদ্রোহের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে তারা। বিদ্রোহে যুক্ত সন্দেহভাজন অভিযুক্তদের ওপর নির্যাতন নথিভূক্ত করেছে সংগঠনটি, র‍্যাব এই নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত বলে তারা অভিযোগ পেয়েছে। তারা বলছে যে ভয়ঙ্কর হিংসাত্মক ঘটনায় ৭৪ জন সৈনিক ও সেনা অফিসার মারা গিয়েছেন তার জন্য দায়ী ব্যাক্তিদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা উচিত, তবে অত্যাচার ও অন্যায্য বিচারের পথ নিলে চলবে না।

হেফাজতে থাকার সময় ৪৭ জন সন্দেহভাজন ব্যাক্তির মৃত্যু হওয়া, আটক ব্যক্তিদের মারধর করা হত, হাতের ও পায়ের পাতায় মারা হত এবং ইলেক্ট্রিক শক সহ আরও নানান ভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। অনেকের কিডনি বিকল হয়ে রয়েছে এবং অনেকে আংশিক পারালাইসিসে ভুগছেন। অথচ এমন কোন নজির নাই যেখানে সরকার এই ধরণের নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। বরং দায়িত্ব থাকা ব্যাক্তিরা বিবৃতি দিয়েছেন যে মৃত্য ঘটেছে হার্ট এটাকে, কিম্বা অন্য কোন ‘স্বাভাবিক’ কারনে।

বাংলদেশ জাতিসংঘের কনভেনশান এগেইনেস্ট টর্চারের একটি রাষ্ট্রপক্ষ। অতএব এই নির্যাতনের ঘটনা মারাত্মক উদ্বেগ তৈরি করেছে। সে কারনে গণহারে বিচারের এই প্রক্রিয়া বন্ধ করবার দাবি উঠেছে।

এভাবে মেরে ফেলায় সাক্ষী মুছে ফেলা হচ্ছে। বিডিআরের হত্যাকান্ডে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সহযোগিতা আছে বলেও বাংলাদেশে অভিযোগ রয়েছে। । ধরা যাক এই অভিযোগ মিথ্যা। কিন্তু যারা এ ঘটনার সাক্ষী, তাদেরকে মেরে ফেললে বিষয়টিতে কী দাঁড়ায়? আপনি তো বিচার করছেন না, আপনি প্রতিশোধ নিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, আপনি বিচারকে বাধাগ্রস্তও করছেন।

ঠিকানা : আপনার কী ধারণা? এ ঘটনার নেপথ্যে কারা?

ফরহাদ মজহার : সত্যিই এটা দুঃখজনক ঘটনা। ডাল-ভাত কর্মসূচির ব্যাপারে বিডিআর জওয়ান্দের একটা ক্ষোভ ছিল, এটা সত্যি। হত্যার যে প্যাটার্ন দেখেছি, তাতে এ ক্ষোভটাই যে আসল মোটিভ সেটা আমার কাছে মনে হয় না। এ ঘটনা তদন্তের যেসব রিপোর্ট, সেটা প্রকাশ করেনি সরকার। সেটা এখন দেখছি হিউমেন রাইটস ওয়াচের ওয়েবসাইটে। । বাংলাদেশের আগামী দিনের পলিটিক্সে বিডিআরের ঘটনাটা একটা গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হয়ে থাকবে সন্দেহ নাই। কারণ বাংলাদেশের চলমান পলিটিক্সে সেনাবাহিনীর পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভূমিকা সব সময়ই আছে থাকবে। আর আপনি ইচ্ছা করলেই বিডিআরের ঘটনা মানুষের মন থেকে মুছতে পারবেন না।

ঠিকানা : এই ঘটনার রেশ ধরে সেনাবাহিনীতে যে চিরুনী অভিযান চালানো হয়, তাতে অনেক অফিসার চাকরি হারান। এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন আপনি?

ফরহাদ মজহার : মূল সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার একটা চেষ্টা সরকারের বিভিন্ন দিক থেকে রয়েছে। তাছাড়া সেনাবাহিনীতে দলীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা তো আওয়ামি লিগ করবেই।

ঠিকানা : সরকার কেন ধামাচাপা দিতে যাবে?

ফরহাদ মজহার : সরকারের যে দায় রয়েছে, সেখান থেকে এখনও মুক্তি পায়নি সরকার।

ঠিকানা : মুক্ত হয়নি, কিন্তু দায় মুক্তির চেষ্টা কি করেছে?

ফরহাদ মজহার : যদি বিচারটা ঠিকমত করতো, রিপোর্ট যদি ঠিকমত প্রকাশ করতো- তাহলে বলা যেত যে, তারা চেষ্টা করেছে দায় মুক্তির। কিন্তু যে রিপোর্টটা বেরিয়েছে তা তো তাদের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। ফলে রিপোর্টটা অন্ধকারে ফেলে রাখা ছাড়া সরকারের আর কী পথ খোলা ছিল? আ’লীগের বড় বড় কিছু নেতার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এখান থেকে কীভাবে তারা দায়মুক্ত হবে?

ঠিকানা : আপনার কী মনে হয় বিডিআর হত্যাকান্ডের সাথে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদের কোন সম্পর্ক আছে?

ফরহাদ মজহার : আমার তা মনে হয় না। বিডিআরের ঘটনা না ঘটলেও তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হত। এটা শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত প্রতিশোধ ছাড়া কিছু ছিল না। তবে আবার আমি বলবো, খালেদা জিয়া ঐ বাড়িটা ছেড়ে দিলেও পারতেন।

ঠিকানা : কেন ছেড়ে দেবেন? সরকারইতো দিয়েছে?

ফরহাদ মজহার : আমি যদি জনগণের রাজনীতি করতাম, তাহলে রাষ্ট্রের দেয়া কোন সম্পদ আমি গ্রহণ করতাম না।

ঠিকানা : তখনতো বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতি করবেন কীনা, নিজেই জানতেন না।

ফরহাদ মজহার : বাড়ি তাকে দেয়া হয়েছিল। তর্কের খাতিরে ধরা যাক তার তখন কিছু ছিল না। কিন্তু যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন, ছেলেরা যখন ব্যবসা বাণিজ্য করছে তখন ছেড়ে দেয়া উচিত ছিল। এর সঙ্গে তার অনেক স্মৃতি জড়িত আছে বলা হয়। সেই ক্ষেত্রে তিনি ক্ষমতায় থাকতেই একে মুক্তি যুদ্ধে সৈনিকদের স্মৃতি রক্ষার জন্য যাদুঘরে রূপান্তর করতে পারতেন, যেখানে জিয়াউর রহমানের ইতিহাসও রক্ষিত হোত। কিন্তু এখন এসব বলে কোন লাভ নাই। এর বিপরীতে শেখ হাসিনা ও আওয়ামি লিগ ৩২ নম্বারকে কিভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মাথায় রেখে ব্যবহার করছে দেখুন, সামনে রবীন্দ্র সরোবর। আওয়ামি লিগ সামাজিক ও সাংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে, তার রাজনীতির স্থিতি রাখে, বিএনপি বা বিএনপি যারা করে তাদের এইসবের দিকে ভ্রূক্ষেপ নাই। বাড়িতো আরেকটিও দেয়া হয়েছিল। উনি রাজনীতিতে না আসলে এসব নিয়ে কখনই প্রশ্ন উঠতো না।

ঠিকানা : খালেদা জিয়াতো রাজনীতিতে আসার আগেই বাড়িটা পেয়েছিলেন। কিন্তু আরেকজন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আমাদের ঐতিহ্য গণভবন আইন করে নিয়ে গেলেন। বিষয়টিকে কী বলবেন?

ফরহাদ মজহার : সেটা ছিল একটি কুৎসিত ঘটনা। তাকে এই বাড়িটি দেওয়া হয় নি বলে শেখ হাসিনা এই কারনেও হয়তো এখন প্রতিশোধটা নিলেন। এটা হল রাজনৈতিক নীতির ব্যাপার। সরকার নিতেও পারে, দিতেও পারে। কিন্তু আপনি সরকারে থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিকে নিজের ব্যাক্তিগত সম্পত্তি হিশাবে দখল নিয়ে নিচ্ছেন। এর চেয়ে কুৎসিৎ আর কী হতে পারে। এইসব নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। তাই নিজে না নিলে্‌ রাষ্ট্র দিতে চাইলেও নীতিগতভাবে ফিরিয়ে দেয়াই শ্রেয়।

ঠিকানা : দেশে দেখা যায় মুরগী চোর থেকে শুরু করে সবারই বিচার শুরু হয় রিমান্ডের নামে আমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়কের নামে দুটি বছর মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে যারা নিরাপদে চলে গেছে, তাদের বিচারের কোন ব্যবস্থাই চোখে পড়েনি এ পর্যন্ত। কেন?

ফরহাদ মজহার : আমি মনে করি না যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারা বিচার করবে। এর কারন আওয়ামি লীগ বিচার করবেনা এই প্রতিশ্রুতিতেই তো মইন-ফখরুদ্দিনের সরকার আওয়ামি লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, আপনি কি করে আশা করেন আওয়ামি লীগ এদের বিচার করবে? তার মানে, বাংলাদেশে জনগণ বিচার করবো না-তাতো না। তাদেরকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করতেই হবে।

ঠিকানা : আপনি লেখালেখির মাধ্যমেও আপনার আন্দোলনটা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আপনার লেখা বাংলাদেশের বড় কোন পত্রিকায় দেখা যায় না, কেন?

ফরহাদ মজহার : মোটামোটি সব কাগজেই লিখতাম। প্রথম আলোতেও লিখতাম। প্রথম আলোর সাথে আমার প্রথম তফাৎটা শুরু হয়, যখন তারা এক এগারোকে প্রকাশ্যে সমর্থন করা শুরু করলো ও বাংলাদেশকে বিরাজনীতিকরণের দিকে ঠেলে দেবার নীতি গ্রহণ করলো। ‘সুশীল সমাজ’ নামে যে রাজনীতির সূচনা ঘটল বাংলাদেশে সেই ক্ষেত্রে তারা ধাত্রীর ভূমিকা পালন করলেন, বাংলাদেশের সামগ্রিক স্বার্থের সঙ্গে এর বিরোধ এতই স্পষ্টই হয়ে উঠলো যে আমাকে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করতে হোল। তাদের পক্ষেও আমাকে ধারণ করা আর সম্ভব হয়ে উঠছিল না। তাছাড়া তাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে যারা সহনশীল ও সমাজের বিভিন্ন রাজনৈতিক চিন্তাকে একটা উদার বিবেচনা থেকে স্থান দেবার কথা ভাবেন, বা হয়তো এখনও ভাবেন, আমার ধারণা তারা পত্রিকাটির অভ্যন্তরে আওয়ামি পন্থী ও দিল্লির স্বার্থ রক্ষাকারীদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারেন নি। বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে এদেরই শক্তি বাড়লো।

এর আগেও বিরোধ হয়েছিল। বিচারপতি সাহাবুদ্দিনকে সমালোচনা করা আমার লেখা তারা ছাপায় নি, কারন কোন একটি অনুষ্ঠানে তাকে প্রথম আলো প্রধান অতিথি করে এনেছিল। আরেকবার তারা ভারতের নীতির বিরুদ্ধে বিশেষত উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোর বিদ্রোহ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ওপর আরেকটি লেখা ছাপেন নি। সেখানে সীমান্তে ভারতীয় রক্ষী বাহিনীর গুলিতে বাংলাদেশীদের হত্যা করার নিন্দা ছিল। তখন আমাকে বলা হয়েছিল ভারত মিত্রদেশ, এই ধরণের লেখা ছাপা যাবে না। আগে প্রথম আলো সীমান্ত হত্যার খবরও ছাপত না। তবে যখন মানবাধিকার কর্মী হিশাবে আমরা এই নিরন্তর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জনমত তৈরী করতে সক্ষম হয়েছি তখন প্রথম আলো ও অন্যান্য পত্রিকাও খবর ছাপা শুরু করেছে। এটা এখন আর উপেক্ষা করা কঠিন।

দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবং আঞ্চলিক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের ঘনিষ্ট মিত্র প্রথম আলো। সে দিক থেকে ইংরাজি ডেইলি স্টারের পাশাপাশি দিল্লির যেমন তেমনি সাম্রাজ্যবাদের গোয়েন্দা ও সামরিক নীতি বাস্তবায়নের খুবই গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার ও বাহন হয়ে উঠেছে পত্রিকাটি। ডেইলি স্টার ইংরাজি ভাষায় হবার কারনে তার ভূমিকা প্রথম আলোর তুলনায় বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নির্ধারক নয়। ইসলামি জঙ্গি হবার অপরাধে যারা ধরা পড়ে বা অভিযুক্ত হয় বিচার প্রক্রিয়ায় তাদের অভিযোগ প্রমাণিত হবার আগেই প্রথম আলোর সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে তাদেরকে দানবীয় করে পাঠকের সামনে তুলে ধরা মানবাধিকারের দিক থেকেও বিপজ্জনক এবং সুবিচার পাবার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। কিন্তু মানবাধিকার বিরোধী এই অন্যায় কাজ প্রথম আলো নিয়মিতই করে আসছে।

তৃতীয়ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগের প্রভাব ও অন্যান্য কারণে গণমাধ্যমের যে বিবর্তন ঘটেছে তাতে প্রথম আলো বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী যুক্ত হয়ে গিয়েছে। প্রথম আলোর এখন যে রাজনীতি, সেটা বহুজাতিক করপোরেট হাউসের স্বার্থ রক্ষার রাজনীতি -দেশীয় বা বাংলাদেশ্র সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য নয়।

প্রথম আলো সমাজ বদলাবার যে শ্লোগান দেয় তারও বিরোধিতা করা ছাড়া উপায় থাকে না। তারা ‘বদলে’ যাবার যে কথা বলে সেটা হচ্ছে ব্যক্তির আচরণ - আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক নয়, ব্যবস্থা তো নয়ই। এই বদলে যাওয়াটা হচ্ছে তুমুল ভোগের যে উচ্চবিত্ত সমাজ গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে তাদের পিঠ সাময়িক চাপড়ে দেবার জন্য। প্রথম আলো নিজের কর্মকাণ্ড, শ্লোগানের মধ্য দিয়ে এই শ্রেণীর সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তিকেই সংহত করতে চায় সেটা খুবই পরিষ্কার। ফলে তাদের সাথে আমার একটা রাজনৈতিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আমার সঙ্গে নানবিধ পার্থক্য নিয়ে সহাবস্থানের জায়গা সংকুচিত হয়েছে। এখন যারা এই পত্রিকায় লেখালিখি করেন তাদের ও তাদের লেখালিখি দেখলে আমার কথার সারবত্তা বোঝা যাবে।

কিন্তু ওখানে অনেকেই আছেন যারা আমার খুব প্রিয় বন্ধু, যাদের সঙ্গে আমার সামজিক সম্পর্ক কখনই খারাপ হয় নি। হবেও না আশা করি। ভালবাসা ও শ্রদ্ধার সাথেই তাদের আমি গ্রহণ করি সবসময়ই। কিন্তু আমি যেভাবে লেখা লিখতে চাই সেই ক্রিটিক্যাল লেখার স্থান সেখানে শুকিয়ে গিয়েছে।

তবে প্রথম আলোকে একা দোষারোপ করলে ভুল হবে, প্রথম আলোর পর সামনের সারিতে যেসব পত্রিকার নাম আমরা করি তাদের প্রায় প্রত্যেকটিরই একই দশা। তাদের পক্ষে আমাকে ধারণ করা কঠিন। ফলে আমি বাধ্য হয়ে অন্য পত্রিকায় লিখি। যেমন, ‘নয়া দিগন্ত’, ‘আমার দেশ’ ইত্যাদি। ‘নয়া দিগন্ত’ জামাত পন্থিদের পত্রিকা বলে পরিচিত। এখানে লিখি বলে কেউ কেউ আমাকে আপত্তি জানান। তাদের সংবেদনার জায়গাটি আমি বুঝি, সম্মান করি। কিন্তু এক এগারোর পরে একমাত্র এই পত্রিকাটাতেই মইনুদ্দিন ফখরুদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে আমি হাত খুলে লিখতে পেরেছিলাম। তারা আমাকে লিখতে দিয়েছেন এবং আমার চিন্তা ও মতাদর্শের সঙ্গে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমাকে জায়গা দিতে তারা কুণ্ঠাবোধ করেন নি। প্রথম আলো বা অন্যান্য পত্রিকার ক্ষেত্রে আবার তাদের কোন সংবেদনা কাজ করে না। এটা ঠিক না।

আমার নীতি হচ্ছে আমি যেখান থেকেই পাঠকদের কাছে পৌঁছাবার সুযোগ পাব সেই সুযোগ পুরামাত্রায় আমি নেব। প্রথম আলোর ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হবে না। লেখক হিশাবে আমার প্রধান একটি কর্তব্য হছে পাঠকের কাছে পৌঁছানো। ‘ চিন্তা’ নামে অনিয়মত একটি পাক্ষিক বের করার চেষ্টা করি আমরা এখন, ওয়েব সাইটে (www.chintaa.com) একে আরো সবল ভাবে হাজির রাখবার চেষ্টা চালাচ্ছি।

ঠিকানা : এক এগারোর মত অন্য কোন শক্তিকে কী আবারো আমরা ডেকে নিয়ে আসছি?

ফরহাদ মজহার : হতে পারে। আমার কেন জানি মনে হয় এবার সেনাবাহিনীর দিক থেকে কোন ঘটনা নাও ঘটতে পারে। তবে গুজব ও কান কথার ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক আলোচনা না হওয়াই ভাল। এগুলো হল অনুমান। মান্নারা (মাহমুদুর রহমান মান্না) যে দল তৈরি করেছেন সেনাবাহিনীর সাথে শলা-পরামর্শ করে, ষড়যন্ত্র করে ইত্যাদি সম্পর্কে এখানে এসেই আমি জোরে শোরে শুনছি, যদিও আমি জানি না। এগুলো দেশের গোয়েন্দারাই ভালো বলতে পারবেন। রাজনীতিটা আমি রাজনীতির চোখেই দেখতে চাই। তার মানে এর পেছনে যে কোনো ব্যক্তির ভূমিকা নেই, বা কোন কলকাঠি কেউ নাড়ছে না -এগুলো আমি বলতে চাই না। তবে রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র বলে কিছু নাই। প্রকাশ্য দেখিনা বলেই সেটা ষড়যন্ত্র মনে হয়। কিন্তু সমাজের প্রতি্টি শ্রেণী ও শক্তি তাদের নিজ নিজ স্বার্থের জন্য অন্য শ্রেণীর বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লড়াই সংগ্রামে রত। ‘ষড়যন্ত্র’ তারই অংশ, আলাদা কিছু নয়। যে পক্ষের কথাই বলুন রাজনীতিতে ‘ষড়যন্ত্র’ অর্থাৎ নিজ শ্রেণী ও শক্তির মধ্যে শলা পরামর্শ ও সুযোগ বুঝে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার নীতি ছাড়া তা কিভাবে সম্ভব?

আমি মনে করি বাংলাদেশের এখন যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতে আগামীতে নির্বাচন হবে না, এটা চিন্তা করা আমার জন্য কঠিন। আন্তর্জাতিক শক্তিকে আমি যতটুকু চিনি, তারা যেভাবেই হোক একটা নির্বাচন চায় বাংলাদেশে। তাদের ধারণা, নির্বাচন না হলে বাংলাদেশে যে অস্থিতিশীলতা বাড়বে তাতে তাদের স্বার্থ নিশ্চিত রাখা কঠিন হবে। তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে সবকিছু চলে যাক,এমন কিছু ঘটুক যা তাদের পরিকল্পনার বাইরে এটা তারা চায় না। আর এ জন্যই তারা নির্বাচন চাচ্ছে। চাইতে বাধ্য। হাসিনা সরকারের ওপর তারা ক্ষুব্ধ, কারন তারা আশা করেছিল হাসিনা ‘সুশাসন’ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। কিন্তু বর্তমান সরকারের ওপর সমর্থন তারা এখনও প্রত্যাহার করেনি। তারা চায় নির্বাচনের মাধ্যমে একটা ব্যালেন্সড পার্লামেন্ট আসুক। তবে এমনও আবার হতে পারে বিএনপিও ক্ষমতায় আসতে পারে।

ঠিকানা : কোন যুক্তিতে মনে হচ্ছে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে?

ফরহাদ মজহার : আমি বাংলাদেশের মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে ধারণা করছি, কিন্তু নাও আসতে পারে। কিন্তু আমি মানুষের যে মানসিকতা দেখছি সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। মানুষ ভেবেছিল চার দলীয় জোটকে ক্ষমতা থেকে সরালে তারা দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ পাবে। এখন তারা দেখছে শেখ হাসিনা এই ক্ষেত্রে বরং অধিক প্রতিভাবান। মানুষ বিএনপির দুর্নীতি থেকে মুক্তি পেতে হাসিনাকে ভোট দিয়েছিলো। কিন্তু হাসিনা আরো কয়েকগুণ বেশি দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে হাজির হলেন মানুষের সামনে। দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুঃশাসন এবং দিল্লির অধীনস্থতা। বাংলাদেশের অরক্ষিত সীমান্ত ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। শেখ হাসিনার হাত থেকে মুক্তি পেতে তাদের মধ্যে যে বিপুল আকুতি ও উদ্দীপনা দেখছি -এতে মনে হয় পালা বদল আসন্ন।

ঠিকানা : শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?

ফরহাদ মজহার : এ জন্য এই সরকারই পুরোপুরি দায়ী। মানুষের সঞ্চয়কে বিনিয়োগে খাটাবার নাম করে শেয়ার বাজারে আপনি আইন বানিয়ে ও নিয়মনীতি করে তাদের বাজারে আনলেন, কিন্তু রীতিমত ডাকাতি করবার জন্য। যারা এই লুটতরাজ করেছে তারা অপরিচিত নয়। তারা তো রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত।

ঠিকানা : দায়ী করেই কী কাজ শেষ?

ফরহাদ মজহার : তাদেরকে দায়ী করে যে আপনি জবাবদিহিতার মধ্যে আনবেন, সে ব্যবস্থাটা কোথায়? ঘুরে ফিরে আমরা কিন্তু একই জায়গায় আসছি। গঠনতন্ত্র। এটা ঠিক না করলে, আপনি কাউকেই বিচারের আওতায় আনতে পারবেন না। আপনি ক্ষমতায় থাকলে বা ক্ষমতার সঙ্গে থাকলে তো আপনি আইনের উর্ধে না। কিন্তু আপনি যে রাষ্ট্র বানিয়েছেন সেখানে রাজনীতিবিদরা তো ক্ষমতার উর্ধে। আপনি লক্ষ্য করেন এদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপনি কিছু করতে চাইলে আপনাকে সংবিধান স্থগিত রেখে এক এগারোর মত সরকার বসাতে হয়। রাষ্ট্রের স্বাভাবিক বিধান বা আইনে একাজ সম্ভব না। তাহলে কখন করবেন! রাষ্ট্রকে আগে গড়তে হবে। নইলে কার কাছে জবাবদিহি বা বিচার চাইবেন। শেখ হাসিনা কাছে?

ঠিকানা : কিন্তু গঠনতন্ত্রের কথা বললেই তো মামলা-হামলা-গুমের ভয়?

ফরহাদ মজহার : বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন গঠনতন্ত্রের কথা বললে কেন মামলা হবে? আমি এটার সাথে একমত নই। আমি নাগরিক। আমার অধিকার সম্পর্কে আমি বলতে পারবো না কেন? আমরা কি চাই তা বলার অধিকার হরণ করবার বিরুদ্ধে তখন আমাকে লড়তে হবে। শর্টকাটে তো কিছুই হবে না; দুর্দশা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া ছাড়া।

ভয় পেলে তো কিছু করা যাবে না। চিন্তা করা তো আর বন্ধ করে দেওয়া যায় না।

ঠিকানা : সমাজ পরিবর্তনে আপনার যে চিন্তা, তার চূড়ান্ত রূপ কীভাবে দেখবো আমরা?

ফরহাদ মজহার : সমাজে একটি চিন্তা যখন দানাবাঁধে,তখন চিন্তার পক্ষে একটা রাজনৈতিক শক্তিও দানা বাধে। চিন্তাটা আগে আসে, রাজনীতিটা পরে আসে। চিন্তাটা যখন দানা বাঁধে তখন তার পক্ষে জনগণের মধ্যে আগ্রহ তৈরী, জনসমর্থন বাড়ে। সমাজে সংবেদনশীল বুদ্ধিজীবী শ্রেণী যারা আছেন, তারা তাদের চিন্তার জায়গাটা যত পরিচ্ছিন্ন ভাবে হাজির করতে পারেন তার একটা প্রভাব পড়ে সমাজে। রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের ওপরও, কারন কেউই সমাজের বাইরে নয়। এখান থেকেই পরিবর্তনের আকাংখাটা আসবে।

এরপর আসে সংগঠনের প্রশ্ন। । আমি কোন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নই। কিন্তু যুক্ত হতেও পারি কিম্বা নতুন গড়ে তুলতেও পারি। কিন্তু আমি মনে করি আমি যেভাবে চিন্তা করি তার জন্য সেই সময় এখনও আসে নি। আমি মনে করি আমার চিন্তাকে ছড়িয়ে দিতে হলে চিন্তা তৈরির কাজ শেষ করা দরকার। সামাজিক আন্দোলনে আমাকে বরং এখন অনেক বেশি সময় দিতে হবে। আমি দেবার চেষ্টাও করি।

চিন্তার বাস্তবায়ন সহিংস পদ্ধতিতে না অহিংস পদ্ধতিতে, না নির্বাচনের মাধ্যমে আসবে, তা আমরা চিন্তার প্রচারের মধ্য দিয়ে বুঝবো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পদ্ধতি সহিংস হতেও পারে, হয়তো প্রতিপক্ষ শ্রেণী, শক্তি বা সরকার আক্রমণ করতেও পারে। কিন্তু সহিংসতাই আপনার চিন্তা বাস্তবায়নের একমাত্র পথ এই চিন্তা আমি ভুল বলে মনে করি। বরং আলাপ আলোচনা ও অহিংসার সকল ক্ষেত্রগুলোর পূর্ণ ব্যবহার করা প্রথম ও প্রধান কাজ। এর মধ্যে দিয়েই আপনি শক্তিশালী হয়ে উঠবেন। নতুন মেরুকরণ ঘটবে। জনগণ আপনার পক্ষে দাঁড়াবে। আমি অহিংসার চর্চা করি, কিন্তু ‘অহিংসবাদী’ নই। এর কারন হচ্ছে ইতিহাসে নিপীড়িত ও নির্যাতীত মানুষ নানান কারণে শোষকের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ভাবে লড়ে। কখনও ন্যায় সঙ্গত কারণে বা কখনও ঘটনার অনিবার্যতায় অস্ত্র ধরতে বাধ্য হয়। তার এই প্রতিরোধকে আমি মানি। যদিও অহিংসাবাদের দিক থেকে এটা নীতিবিরুদ্ধ হয়। অহিংসবাদ শ্রমিক, কৃষক নিপীড়িতের সংগ্রামকে ‘অপরাধ’ বা নীতিগর্হিত বলার সুযোগ তৈরি করে, তাই অহিংসবাদের সঙ্গে আমি সায় দিতে পারি না।

ঠিকানা : আজকের বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষ এবং আধুনিক সভ্যতার কারণে কি আমরা শান্তির দিকে যাচ্ছি, নাকি তৃতীয় কোন বিশ্ব যুদ্ধের দিকে যাচ্ছি?

ফরহাদ মজহার : তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধতো চলছেই। আফগানিস্তানের যুদ্ধকে কী বলবেন? ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধ হলেই কি বিশ্বযুদ্ধ হয়? কেবল ইউরোপই কি ‘বিশ্ব’? আজকের ইরাক আফগানিস্তানের যুদ্ধই হলো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে আনফরচুনেটলি মুসলমানরা টার্গেট। যেহেতু আল্লাহর কাছে চুক্তি করে কেউ মুসলমান হয়ে আসেনি, মুসলমান হয়ে জন্ম নিয়েছে, এর পরেও এই যুদ্ধে তারাই টার্গেট, কারণ ইউরোপ-আমেরিকার চোখে এরা সন্ত্রাসী। এই দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে বর্ণবাদ, ক্রুসেডের ইতিহাসের কারণে এবং সাধারন ভাবে ইসলাম সম্পর্কে পাশ্চাত্যে ভীতি ও আতংক কাজ করে। আমরা যদি ‘গুড’ মুসলিম হই, নামাজ কালাম ঠিক মতো পড়ি, মার্কিনীদের বিরুদ্ধে কিছু যদি না বলি-তাহলে তারা খুব খুশী। কিন্তু এদের অন্যায় অবিচারের কথা বললে,আপনি হয়ে যাবেন আল-কায়দার সদস্য, সন্ত্রাসী।

‘আধুনিক’ সভ্যতার কথা যখন বলেন তখন মনে রাখতে ঔপনিবেশিক নিপীড়নের ইতিহাস ধরেই আধুনিকতার আবির্ভাব বা জন্ম । সেটা তো শান্তির ইতিহাস নয়। ‘বৈজ্ঞানিক” উৎকর্ষ যদি বলেন তাকে যুদ্ধাস্ত্র, মারণাস্ত্র ও হত্যার সাজ সরঞ্জাম থেকে আলাদা করবেন কিভাবে?

ঠিকানা : ৯/১১’র পর আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস নির্মূলের নামে বিভিন্ন মুসলিম দেশে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, আপনি কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন এ ঘটনাগুলোকে?

ফরহাদ মজহার : এক দিক থেকে তেলের অর্থনীতি ও রাজনীতির বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই সেটা বুঝতে হবে। জ্বালানির ওপর দখল কায়েম রাখা পাশ্চাত্যের দরকার। শুধু পরদেশ লুন্ঠন ও তেল কোম্পানির মুনাফা নিশ্চিত করবার প্রয়োজন ছাড়াও আরও কারন আছে। কাঠামোগত ভাবে পাশ্চাত্য সভ্যতা মুলত জীবাশ্মভিত্তিক সভ্যতা। অতএব জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে এই ‘সভ্যতা’র পক্ষে টিকে থাকা মুশকিল। মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বজায় রাখার সাথে এই সন্ত্রাস নির্মূলের রাজনীতিও জড়িত। সৌভাগ্য হোক বা দুর্ভাগ্য হোক, তেল মুসলিম দেশগুলোতেই বেশি পাওয়া যাচ্ছে। তার ওপর দখলদারি কায়েম করতে যুদ্ধ দরকার, জ্বালানি বা তেল যেখানে সেখানেই তারা যুদ্ধ করছে।

কিন্তু সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধকে মতাদর্শিক দিক থেকেও বোঝার দরকার আছে। সোভিয়েতের ভাঙন এবং চীনের পুঁজিতান্ত্রিক পথ অনুসরনের ফলে মতাদর্শ হিশাবে সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের দুর্বল হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ ও পাশ্চাত্য সভ্যতার আধিপত্যের বিরুদ্ধে ইসলাম একটি আদর্শিক জায়গা করে নিতে পারছে। এই ক্ষেত্রে মোটা দাগে দুটো ধারা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা। এক: এই যুদ্ধকে ইহুদি-নাসারার বিরুদ্ধে মুসলমানদের যুদ্ধ হিসাবে হাজির করবার সাম্প্রদায়িক ও বিপজ্জনক ধারা এবং দুই: পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটাবার ক্ষেত্রে ইসলামের বৈপ্লবিক ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ এবং ইসলামের দার্শনিক বিচারের মধ্য দিয়ে তার সাবর্জনীন আবেদনকে চিহ্নিত ও বিকশিত করবার ধারা। কোন ধারা শেষ তক শক্তিশালী হবে তা বলবার সময় এখনও আসে নি। তবে এটাও সত্য আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস নির্মূলের নামে যে যুদ্ধ চলছে সেটা পড়ন্ত শক্তির শেষ হুঙ্কার।

ঠিকানা : এখন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া যে যা কিছু বলুক বা করুক না কেন সবকিছুকে গালি দিয়ে বলা হয়, এটা করা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করার জন্য। কিন্তু বিচারের নামে যা হচ্ছে সেটাকে আপনি দেখছেন কীভাবে?

ফরহাদ মজহার : এই বলাটা ক্ষমতাসীনদের নৈতিক ও রাজনৈতিক পরাজয়ের লক্ষণ, সেভাবেই দেখা উচিত। তাদের দুর্নীতি ও দুঃশাসনে বাংলাদেশে যে উৎকট পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে তার পক্ষে কোন কৈফিয়তি আর খাটছে না। দ্বিতীয়ত তারা মনে করছে যুদ্ধাপরাধ আমাদের এমন এক সংবেদনশীল জায়গা যাকে যখন তখন ব্যবহার করা যায়, আর সবকিছুতেই একাত্তরের পরাজিত শক্তির চক্রান্ত আবিষ্কার করে নিজের অপরাধ ঢাকা সম্ভব।

বলাবাহু্ল্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের এই গভীর ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছি আমরা। শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধী বলুন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী বলুন বাংলাদেশের স্বাধীনতার যারা বিরোধী শক্তি ছিল তাদের বিচার শেষ না করে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। যারা সেই সময় তার শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে ঊঠেছিল তাদের মোকাবিলা করার দিকেই শেখ মুজিবকে তখন অজর দিতে হয়েছে। হতে পারে যুদ্ধ বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন ও তাকে সচল করার দিকে মনোযোগ দেবার তাগিদ থেকেও তিনি রাজনৈতিক শত্রুর সংখ্যা কমাতে চেয়েছিলেন। ৭৩ সালের তেল অবরোধের আরব নীতির কারণে গ্লোবাল অর্থনীতির সঙ্কটের মধ্যে আমরা তখন নবীন রাষ্ট্র। তাই এখান থেকে বেরোবার উপায় ছিল মধ্যপ্রাচ্য দেশগুলোর সহায়তা ও অর্থ ধার পাওয়া। কিন্তু এক্ষেত্রে বাধা ছিল, আমরা ওআইসির সদস্য ছিলাম না। এই সূত্রে ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দেবার ত্রিদেশীয় চুক্তির বিনিময়ে পাকিস্তানের সম্মতিতে ওআইসির সদস্যপদ হাসিল করার প্রয়োজনীয়তাকেও অস্বীকার করা কঠিন। ইত্যাদি সবকিছুই শেখ মুজিবকে করতে হয়েছিল ওআইসির বিপ্লবী ও প্রভাবশালী সদস্য আলজিরীয় নেতা হুয়ারে বুমেদিনের মধ্যস্থতায়। এই সকল কারণে যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি শেখ মুজিবের কাছে গৌণ হয়ে পড়ে।

আবার অন্য দিকে সেসময়ের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে সাধারণভাবে বাংলাদেশের বামধারার সব রাজনৈতিক দলই অন্তর্ভূক্ত ছিল, কিন্তু বিশেষ ভাবে ছিল জাসদ, সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি, ইত্যাদি। জামায়াতে ইসলামি তখন স্পষ্ট ভাবেই বলেছিল তাদের শত্রু কমিউনিস্টরা।ফলে শেখ মুজিবর রহমানের আওয়ামি লিগের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামির অলিখিত রাজনৈতিক আঁতাত গড়ে উঠবার আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক শর্তও বর্তমান ছিল। ফলে যে কাজ স্বাধীনতার পরপরই হয়ে যাবার কথা ছিল তা আর করা হয় নি। এই ক্ষতস্থান সযত্নে লালন করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধ বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিচার করে যদি ক্ষমা করে দেওয়া হোত তাহলেও এই ক্ষত শুকাবার সুবিধা পেত। কিন্তু তাকে দিনের পর দিন খুঁচিয়ে আরও বড় করা হয়েছে। আবার মনে রাখতে হবে রক্ষী বাহিনী দিয়ে যেসকল রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যা ও নির্যাতন করা হয়েছে তারা কেউ যুদ্ধাপরাধী ছিল না, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ছিল না। তাদের সংখ্যা কমপক্ষে তিরিশ কি চল্লিশ হাজার, শুধু জাসদপন্থিরাই তো দাবি করেন তাদের বিপুল সংখ্যক কর্মীকে রক্ষী বাহিনী হত্যা করেছে। অন্যদের কথা নাই বা বললাম। জামায়াতে ইসলামি তখন স্পষ্ট ভাবেই বলেছিল তাদের শত্রু আওয়ামি লিগ নয়, কমিউনিস্ট বা সাধারন ভাবে বামপন্থি রাজনীতি। স্নায়ুযুদ্ধের রাজনীতির ধারক হিশাবে জামায়াতে ইসলামি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিই বাস্তবায়ন করে এসেছে।

কিন্তু এই ক্ষতের তো নিরাময় দরকার, যুদ্ধাপরাধের বিচার তো হতেই হবে। কিন্তু সেটা বিচার হতে হবে, প্রতিশোধ হলে তো হবে না। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এখন বিচার হচ্ছে না কিম্বা বিচার কোন আন্তর্জাতিক আদালতেও নয়, হচ্ছে দেশীয় আইনে দেশীয় আদালতে। আবার সেটা যুদ্ধাপরাধের জন্যও নয়, বরং বলা হচ্ছে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য। কারণ পাকিস্তানীদের বিচারের আওতায় আনার সুযোগ আর নাই। নতুন আদালত গঠন করা হয়েছে। তার নাম ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল’ ; আন্তর্জাতিক আদালত না হলেও দাবি করা হচ্ছে অপরাধের চরিত্র ‘আন্তর্জাতিক’ বলেই এই নামকরন । যুদ্ধে বিজয়ী পক্ষ বিচার করছে পরাজিতদের, তৃতীয় কোন পক্ষ বিচার করছে না। বলা হচ্ছে ‘পরাজিত শক্তি’ বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু এই পরাজিত শক্তি অপরাধের মূল হোতা নয়। যেসকল পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ উঠেছিল তাদের বিচার হচ্ছে না, বিচার হচ্ছে কেবল তাদের সহকারীদের। ফলে এমন বিচার সম্পর্কে তর্ক গোড়াতেই উঠেছে।

আপনি যদি কাউকে ঝুলাতে চান, আপনি ঝুলিয়ে দেন। কিন্তু বিচার করতে চাইলে আপনাকে সঠিকভাবেই তো বিচার করতে হবে; বিচারের প্রক্রিয়া মানতে হবে। বার বার দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিকভাবে বলা হচ্ছে, এই বিচার আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন হচ্ছে না। কিন্তু আপনি শুনছেন না। জামায়াতে ইসলামি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ট মিত্র, তারপরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই বিচা্রের বিরোধিতা করছে না, বরং সমর্থন করছে। খেয়ে না খেয়ে একে ‘আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন’ করবার জন্য চাপ দিচ্ছে। এর কারন বিচার আইসিসি বা ইন্টারনেশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে না করে দেশীয় কোর্টে করেও যুদ্ধাপরাধ বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার করা সম্ভব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেটা প্রমাণ করে দেখাতে চায়। দেশীয় আইনের অধীনে দেশীয় আদালতে করার পরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই বিচারকে আন্তর্জাতিক বিচারের চরিত্র দিতে চায়। লোহাকে সোনা প্রমাণ করবার দরকার আছে তাদের। একে ‘আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন’ করবার জন্য তাই অস্থির হয়ে গিয়েছে তারা। আওয়ামি লিগ চাইছে ক্ষমতায় থাকতে থাকতে যেন তেন একটা বিচার করে রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করা। তবে মনে হচ্ছে, এটা এখন গলার কাঁটা হয়ে উঠবে তাদের।

আইসিসি হচ্ছে একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালত। দুই হাজার দুই সালে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ইত্যাদির বিচারের জন্য রোম স্টাটিউটের অধীনে গঠিত হয়েছে। যেসব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই ধরনের অপরাধের অভিযোগ আছে তার মধ্যে, বলাবাহুল্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষ স্থানে। তাই আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় উঠবার ভয়ে রোম স্টেচিউটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাক্ষর করেও তাকে রেটিফাই করবে না। ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর ২০০৯ সালের শেষের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি পরিবর্তনের আভাস হিসাবে স্টিফেন র‍্যাপের নিয়োগ দেখছি আমরা। অন্যান্য যেসব দেশের বিরুদ্ধে এই ধরণের অভিযোগ তোলা যায় তারাও স্বাক্ষর করে নি। যেমন ভারত। কাশ্মির ও উত্তর পূর্ব ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে ভারত, মানবাধিকার কর্মীদের এই অভিযোগ আছে। তেমনি স্বাক্ষর করেনি চিন। বাংলাদেশের এই বিচার আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।

আবার অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধ বা একাত্তরে মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ হয়েছে তার বিচার যদি আপনি করতে চান তাহলে তো শুধু যুদ্ধের পরাজিত পক্ষের বিচার করলে তাকে সুবিচার বলা যাবে না। সম্প্রতি করুন সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ মারা গিয়েছিলেন। সেই সময় ‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে ব্যতিক্রম ও বিতর্ক’ নামে তার একটি লেখা ইত্তেফাকে পুনমূদ্রিত হয়। তারেক বলছে, প্রতিরোধের সাথে অনেক সময় প্রতিহিংসা জড়িয়ে যায়, প্রতিপক্ষ যদি পঁচানব্বই ভাগ যুদ্ধ অপরাধ করে থাকে ‘আমরা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে পাঁচ ভাগ যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করে থাকতেই পারি, এটিকে অস্বীকার করা ইতিহাসের অপলাপ। স্বাধীনতার চল্লিশ বছরে পৌঁছে আমাদের এই সত্যকে স্বীকার করার সৎ সাহস থাকা উচিত্’। তারেকের এই কথার মধ্য দিয়ে বুঝতে হবে আমাদের সমাজে এই চিন্তা হাজির আছে। -- নিজেদের আত্মসমালোচনার ইতিবাচক চিন্তা রয়েছে। যারা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন বা রাখবেন তারা আত্মসমালোচনার ওপর দাঁড়িয়েই একাত্তরের ক্ষত দ্রুত নিরাময়ের কথা বলবেন, এটাই স্বাভাবিক।

সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দলিলপত্র সংগ্রহ করেছেন এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ডক্টর এম এ হাসানও যে-পক্ষেরই অপরাধ হোক বিচার না করার অভিশাপ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করেছেন। এই সময়ের হত্যা, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অপরাধ সম্পর্কে কথা তুলেছেন। ‘আমাদের সময়’ পত্রিকায় তার লেখা যে কোন মানবাধিকার কর্মীরই চোখে পড়া স্বাভাবিক। তিনি ঠিকই দাবি করেছেন যে আইনের দৃষ্টিতে এবং মানবতার দৃষ্টিতে কোনও বিচারবহির্ভূত হত্যাই বৈধ নয়।

ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত সেনাবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ডক্টর হাসান সম্পৃক্ত থাকার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের অপরাধগুলো দেখার সুযোগ হয়েছিল তার । তিনি ময়মনসিংহ, নরসিংদী, ভৈরব এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হত্যা, লুণ্ঠন এবং নির্যাতন কিভাবে হয়েছে দেখেছেন । স্বাধীনতার পরও ষোড়শ ডিভিশনসহ মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার এবং তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক লুণ্ঠন এবং হত্যাযজ্ঞ তিনি দেখেছেন। যুদ্ধের শুরুতে ভৈরবে যেমন নিরীহ নারী নির্যাতনের কথা বলেছেন তিনি তেমনি যুদ্ধের ময়দানে পূর্ব পাকিস্তানের একাউন্টস জেনারেল মিস সেলিনার ভগ্নিকে ধর্ষিতা হতে তিনি দেখেছেন। তার অভিযোগ, এই সবের কোনও বিচার হয়নি। তিনি, শহীদ লে. সেলিম ও তখনকার ক্যাপ্টেন মতিন এ বিষয় প্রতিবাদ করেছিলেন, কোন প্রতিকার পাননি।

বলাবাহুল্য, তিনি খুবই গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন। যেসব অপরাধের কথা তিনি ওপরে বলেছেন তার প্রতিবাদ করে তিনি প্রতিকার তো পান নি এমনকি উল্টো স্বাধীনতার পরপরই নিজেদের লোকরাই তার ভাইকে মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন মিরপুরে হত্যা করেছে -- তার লেখায় সেই মারাত্মক অভিযোগও তুলেছেন। মনে রাখতে হবে এটা তিনি করছেন ২০১২ সালে । রাষ্ট্র তার খোঁজ নেয়নি এবং কোনও প্রতিকারের ব্যবস্থা করেনি। কয়েক টুকরো অজানা হাড় তার পারিবারের কাছে গছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর প্রতিবাদ করায় তার ও তার ভাইয়ের খেতাব শুধু কেড়ে নেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের এই দিকগুলোকে চাপা দিয়ে রেখে একাত্তরের ক্ষত নিরাময় অসম্ভব বলেই আমি মনে করি।

এসব নানান দিক বিবেচনা করে আমি ব্যক্তিগতভাবে নেলসন ম্যান্ডেলা ও ডেসমন্ড টুটুর সত্য উদ্ঘাটন ও ক্ষত নিরাময়ের জন্য ‘ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশান কমিশন’ প্রক্রিয়ার কথা বিবেচনার পক্ষপাতি।

ঠিকানা : সেটা কী রকম?

ফরহাদ মজহার : এই প্রক্রিয়া এক ধরণের আদালত কিন্তু ইনসাফ বা ন্যায় বিচা্র এই ক্ষেত্রে কোন বিধিবদ্ধ আইনী প্রক্রিয়ার ফল নয়। এই প্রক্রিয়া বুঝতে হলে ‘বিচার’ নয়, বুঝতে হবে অপরাধের যারা ভূক্তভোগী তাদের কাছে এটা ইনসাফ বা ন্যায়বিচার বলে প্রতিষ্ঠিত মনে হয়েছে কিনা, তারা এই প্রক্রিয়ায় সন্তুষ্ট কিনা সেটাই এই বিচারের প্রধান মানদণ্ড। যারা ভিক্টিম নয়, তারা যেন ভিক্টিমদের দেখিয়ে দেখিয়ে কোন রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করতে না পারে তার জন্যই এই ব্যবস্থা। তাই এই বিচারের ফল নির্ণয় করা হয় রায় দিয়ে নয়, বা অভিযুক্তের অপরাধ প্রমাণ করে শাস্তি প্রদান নয় বরং কিভাবে ইনসাফ কায়েম বা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায় সেই দিকেই এই প্রক্রিয়ার মনোযোগ নিবিষ্ট থাকে।এখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার, বিচারের রাজনীতিকরণ বা দলবাজির সুযোগ কম।

বিমূর্ত আইনী নীতি ও প্রক্রিয়ার প্রয়োজন মেটানোর চেয়ে এই প্রক্রিয়া জোর দেয় অন্যত্র। যার বিরুদ্ধে এবং যে-জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে অপরাধ সংগঠিত হয়েছিল তারা বরং এই ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারছে কিনা তার ওপর নজর নিবদ্ধ রাখা হয়। একই সঙ্গে যে অপরাধ করেছে তার স্বীকারোক্তি ও উপলব্ধির মধ্য দিয়ে সমাজকেও পেছনের তিক্ত ইতিহাসের ভার কমিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে এই প্রক্রিয়া সাহায্য করে। এই প্রক্রিয়ার প্রধান চালিকা শক্তি উকিল ব্যারিস্টার, বিচারক বা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার যারা দাবি করছেন তারা নন, বরং যার বিরুদ্ধে বা যাদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংগঠিত হয়েছে তারাই সরাসরি এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত থাকেন । অন্যদিকে, যে ব্যাক্তি বা গোষ্ঠি অপরাধ করেছে তারা যেন তার দায় স্বীকার করে তার জন্য পরিবেশ তৈরি করা এই প্রক্রিয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। সত্য উদ্ঘাটন এখানে গুরুত্বপূর্ণ, যা আইনী পদ্ধতিতে সাক্ষী প্রমাণ দলিল্- দস্তাবেজ সওয়াল জবাব দিয়ে বের করা কঠিন।

এই অপরাধের যারা ভূক্তভোগী - ব্যাক্তি হোক কি সমাজ হোক, তাদের কাছে অপরাধীর ক্ষমা চাওয়া এবং কী করে এই অপরাধের দায় থেকে অপরাধী মুক্ত হতে পারে তা প্রার্থনা করা এই প্রক্রিয়ার আরেকটি অসাধারণ দিক। অপরাধ তো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, বরং ব্যক্তি ও সমাজের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছে।

যুদ্ধাপরাধ বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের শাস্তি হওয়া উচিত। এটা ইনসাফের দায় ও তাগিদ বটে, কিন্তু তার প্রক্রিয়া ভুল হলে ক্ষত নিরাময় হবে বলে আমি মনে করি না। সমাজে যে ক্ষত গলে পঁচে ইতোমধ্যে বিষাক্ত পূঁজ হয়ে উঠেছে তার নিরাময়ের কাজ সহজ নয়। আমরা যদি যুদ্ধাপরাধীদের সত্যিকারের বিচার না করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেই, তাহলে এই ক্ষত আরও বাড়বে। এতে নতুন যে ক্ষত সৃষ্টি হবে সেটা সমাজে থেকে যাবে। আর এই ক্ষতটার জন্য আবারও দেখবেন একে লালন করবার লোকের অভাব হবে না। ক্ষতটাকে আস্তে আস্তে কচলিয়ে কচলিয়ে আরও বড় করে তোলা হবে।

এই সকল বিষয়ে একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মত নির্ণয়ের জন্য আমাদের কিন্তু নিগোসিয়েশন আলাপ-আলোচনার কোন জায়গা নেই। কী করে সমাধান করবেন? গৃহযুদ্ধ লেগে যেতে পারে। সমাধান করতে হবে সমাজকে আরও বিভক্ত করে দিয়ে নয়, নীতিগত অবস্থানে দৃঢ় থেকে আলোচনার দ্বারা। আর আলোচনা সফল না হলে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ ঠেকানো যাবে না। পৃথিবীতে কিন্তু বহুজাতি ধ্বংস হয়ে গেছে এভাবেই। ’৭১ সালে আপনি যা অর্জন করেছেন, সেটা যদি ধরে রাখতে না পারেন, একাত্তরের ক্ষত জীবিত রেখে আমাদের রাজনৈতিক বিভাজন যদি আমরা অতিক্রম করতে না পারি দেখা যাবে বাংলাদেশ দু’টুকরো হয়ে গেছে। অসম্ভব কিছু নয়। এক খন্ডের নাম হয়েছে ইসলামী রিপাবলিক অব বাংলাদেশ, আরেক খণ্ডের নাম হয়ে যেতে পারে সেক্যুলার বাংলাদেশ! হতেও ত পারে।

আর একটা কথা। নীতিগত কারণে নয় বরং যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে বারবার যে যুক্তি শুনেছিলাম সেটা হোল ‘পরাজিত শক্তি’ বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, শক্তিশালী হয়েছে। তাদের যে কোন মূল্যে ‘নির্মূল’ করা দরকার। এখানে অভিযোগটা হলো যে এরা আবার রাজনৈতিকভাবে মাথাচাড়া বা শক্তিশালী হয়েছে তাই তাদের বিচার করতে হবে। ঘাতক দালালদের ‘নির্মূল’ করাই যদি আমাদের উদ্দেশ্য হয় তাহলে এটা তো স্রেফ প্রতিহিংসা। নির্মূলের মনোভাব নিয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে যেনতেন ভাবে ফাসিতে লটকিয়ে ক্ষত নিরাময়ে কখনই আমরা সফল হতে পারব না। সেটা রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ্র ক্ষতির কারণ হয়ে উঠবে। এই ক্ষেত্রে বিচক্ষণতা এবং দূরদৃষ্টি দরকার। রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী কাউকে পরাজিত করা যায় একমাত্র পালটা শক্তিশালী রাজনীতি দিয়ে – প্রতিহিংসা দিয়ে নয়।

ঠিকানা : আপনার সাথে এতক্ষণ কথা বলে মনে হচ্ছে আপনার চিন্তা-ভাবনাটা জুড়ে শুধুই মাটি এবং মানুষ। মানুষকে ভালোবাসা অন্তত আমার কাছে মনে হয়, পথিবীর কঠিনতম কাজ। এই ব্রতটা পালন আপনি অব্যাহত রেখেছেন কীসের প্রভাবে, কার প্রভাবে?

ফরহাদ মজহার : এর মধ্যে মহৎ কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমার এমন কিছু কাজ করতে হবে যেটা আমাকে ভেতর থেকে সায় দেয়, যেটা করে আমি আনন্দ পাবো, তৃপ্তি পাবো। আমেরিকাতে ক্যারিয়ারের দিক থেকে বলুন যে কোন দিক থেকে বলুন-আমি খুবই ভালো করেছিলাম । অর্থাৎ পেশাগত ভাবে ফার্মাসিস্ট হওয়া, ভাল চাকুরি পাওয়া, অর্থনীতি পড়ার সুযোগ পাওয়া। কোন অসুবিধা ছিলোনা। সেখান থেকে আমি বাংলাদেশে গেছি। আমার মনে হয়েছে,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থেকে আমি বাংলাদেশের জন্য কী অবদান রাখতে পারবো? আমি বাংলাদেশে গিয়ে ক্ষুদ্রভাবে যতটুকু পারি অবদান রাখার চেষ্টা করেছি। ভালো না মন্দ করেছি, মানুষ সেটা বিচার করবে।

মানুষকে ভালবাসার ব্যাপারটাকে ব্যক্তির বিশেষ গুণ আকারে না ভেবে আমাদের জোর অন্যত্র দেওয়া উচিৎ। মানুষ মাত্রই সামাজিক জীব এবং সামাজিকতার মধ্যেই সে নিজের মানে খুঁজে পায়, সমাজের মধ্যেই মানুষ নিজের স্ফূর্তি বা নিজের প্রকাশ দেখে আনন্দ বোধ করে। মানুষকে ভালবাসার অর্থ তাহলে এই সামাজিকতাকে শনাক্ত করতে শেখা এবং পুঁজিতান্ত্রিক ব্যাবস্থা যেভাবে এই সম্পর্ককে টাকার সম্পর্কে বিকৃত করে তোলে, বাজারের সম্পর্কে পর্যবসিত করে এবং মানুষকে ব্যক্ততান্ত্রিক করে তোলে তাকে আমা্দের যার যার জীবনে ও জীবনাচারে প্রতিরোধ করা । এই প্রতিরোধ ছাড়া ভালবাসার কোন অর্থ নাই। এর মধ্য দিয়েই অপরের প্রতি ভালবাসা আমরা উপলব্ধি করি। সেভাবেই মানুষের প্রতি ভালবাসাকে দেখা দরকার। তখন ভালাবাসার রাজনীতিকে আমরা আরও ভাল ভাবে বুঝব।

এই অর্থে নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশিদের মধ্যে মানুষকে ভালবাসার লোকের অভাব আছে বলে আমি মনে করি না। সেই ভালবাসা শুধু বাংলাদেশিদের বাসতে হবে, এটাও আমি মনে করি না। এখানে থেকেও মানুষের জন্য কাজ করা যায় এবং আমা্র অনেক বন্ধু আছেন, তাঁরা অসাধারণ কাজ করছেন এই দেশেই। ফলে আমি বাংলাদেশে ফিরে গিয়েছি বলে বিশাল কিছু করে ফেলেছি তা ঠিক নয়। তাছাড়া বাংলাদেশের মানুষ বা শুধু যার যার নিজের দেশের মানুষকে অন্য দেশের মানুষের চেয়ে বেশি ভালবাসতে হবে কেন? এই দেশেও তো মানুষ থাকে। মানুষ আছে। আপনারা এই দেশে শত প্রতিকুলতার মধ্যেও একটা পত্রিকা বের করছেন। একটা নিরপেক্ষ জায়গায় দাঁড়িয়ে সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করছেন, তার মুল্যও কম নয়। মানুষের প্রতি ভালবাসা এই ক্ষেত্রে কাজ করছে না সেটা কিভাবে বলবেন?

ঠিকানা : কবিতায় কীভাবে এলেন?

ফরহাদ মজহার : ছেলেবেলা থেকেই কবিতা লিখি। কবিতা আমার রক্তের মধ্যেই আছে। ছোটবেলা থেকেই কবিতা, গান, নাটকে আমি উৎসাহিত ছিলাম। আমার কবিতা লেখা, রাজনীতি করা, চিন্তা ও দর্শন- কিম্বা কৃষি কাজ করা বা তাঁত আর তাঁতীদের নিয়ে কাজ --একটি থেকে আরেকটি আলাদা কিছু না।

ঠিকানা : কবিতায় কী পান আর কবিতায় কী দেন?

ফরহাদ মজহার : কবিতা বিভিন্ন সময়ে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। বিভিন্ন সময়ে কবিতা বিভিন্ন ভাবে বিচিত্র সব কায়দায় আনন্দ দেয়। আমাদের আচ্ছন্ন করে। তবে আমি এগুলোকে কবিতার গৌণ দিক বলি। প্রশ্ন হচ্ছে কবিতার বিশেষ কাজটি কি? কি কাজ যেটা শুধু কবিতা করতে পারে অথচ অন্য শিল্পকলার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়? কবিতা যে কাজটা করে সেটা হল, কবিতার ভাষার মধ্য দিয়ে নিজেকে হাজির করে, কিন্তু ভাষাকে অতিক্রম করে যায়। নানান দিক থেকে এই অতিক্রম করে যাওয়াকে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি। যেমন, নতুন ভাষা নির্মাণের মাধ্যমে মানুষকে নতুনভাবে চিন্তা করার শর্তটা তৈরি করে দেয় কবিতা; একটা বন্ধ দরজা খুলে দেবার মতো। ভাষার আগে বা ভাষার মধ্যস্থতা ছাড়া জগতের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ -- জগত নিয়ে ভাবাভাবি সম্ভব কিনা সেই তর্কে না গিয়েও বলা যায় দৈনন্দিন ভাষায় আমরা যখন অভ্যস্ত হয়ে পড়ি তখন জগতকে উপলব্ধির ক্ষেত্রেও একটা অভ্যাস গড়ে ওঠে। জগত বুঝি আমাদের কোন এক সময় ধরা দিয়েছিল, এখন আবার লুকিয়ে রয়েছে। সেই গোপন যায়গাগুলোকে হঠাৎ উদ্ভাষিত করে কবিতা।

কবিতা ভাষা দিয়ে লেখা হয়, ফলে কবিতায় প্রতীক, উপমা অন্যান্য শারীরীক শৈলী যেমন থাকে, তেমনি অর্থও। কবিতা অনেক সময় বিষয়কে বিমূর্ত করে রাখা প্রয়োজন বোধ করতে পারে, কিম্বা কবিকেও কবিতায় গরহাজির রাখতে পারে কবিতা। কিন্তু আঙ্গিকই কবিতার প্রধান আরাধ্য, কিম্বা কবিতা এমন ভাবে লিখতে হবে যেন তা অর্থহীন হয়ে যায় – এই ধরণের একদেশদর্শী চিন্তা ও চর্চাকে আমি কবিতার জন্য ক্ষতিকর মনে করি। মনে রাখা দরকার ভাষা কবিতার উপায় মাত্র নয় যে, ভাষার বাইরে কবিতা নামক কিছু থাকে -- ভাষায় তা আমরা পেশ করি মাত্র। ভাষার বাইরে কবিতা নামক কিছু নাই। এই অর্থে ভাষা মাত্রই কাব্য, কথাটা মিথ্যা নয়। কিন্তু প্রথাগত চিন্তা ও ভাষার অভ্যাসকে কবিতা নড়বড়ে করে দেয়, এ কারনে কবিতাকে আমি দর্শনের সহোদর বলে মনে করি, কিম্বা দর্শনের আগের মুহূর্ত। কবিতায় যে অধরা আগে ধরা পড়ে তাকেই গদ্যে ক্রমশ স্পষ্ট করে তোলে দর্শন। কিম্বা কবিতার ব্যর্থ যুগে দর্শন বা ভাবুকতাকে কবিতার ভূমিকা পালন করতে হয়। অন্যদিকে দর্শন যখন নিজের কর্তব্য ভুলে যায় -- নিজেকে বিজ্ঞান বা রাজনীতির অধীনস্থ করে -- তখন কবিতাকে দর্শনের ভুমিকা পালন করতে হয়।

আমি কবিতাকে দর্শনের সহোদর গণ্য করেই কবিতা লিখি, বাংলা ভাষায় কবিতা ও ভাবুকতার বর্তমান যে অবস্থা সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই অবস্থানই এখন সঠিক বলে মনে করি। এই ভাবুকতাকেই কবিতায় দিতে চাই। অন্য কাব্যাদর্শন থাকতেই পারে। অন্যদের কবিতাগুলোও ভাল হতে পারে। আমি নিজেও রাজনৈতিক কবিতা লিখেছি, সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা থেকে কবিতা লিখেছি। কবি আকারে আমার একটা সামাজিক দায় আছে। সে দায় আমি যখন অনুভব করেছি, তখনই দায় মিটিয়ে কবিতা লিখেছি। যারা সেই দায় অস্বীকার করে তাদের আমি অসামাজিক, পশ্চাতপদ ও ব্যাক্তিতান্ত্রিক গণ্য করি। দেখা যায় রাজনীতির ক্ষেত্রে এই ধরণের কবিরা সাধারণত প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করে। কবিতার কোন চিরায়ত বা শ্বাশ্বত রূপ নাই, তবে ভাষার মধ্যে তৈরী হয়েও ভাষাকে অতিক্রম করে যাবার সাধনা থাকে কবিতার –এই টানাপড়েন থেকে কবিতার মুক্তি সম্ভব নয় বলেই আমার মনে হয়।

ঠিকানা : ‘এবাদতনামায়’ আপনি কিসের এবাদত করেছেন?

ফরহাদ মজহার : ‘এবাদতনামা’টা ছিল কবিতা নিয়ে পরীক্ষা। ইসলাম সম্পর্কে প্রথাগত যে ব্যাখ্যা -- যাকে আমরা ধর্মতত্ত্ব বা থিওলজি বলি -- তার সঙ্গে ঝগড়া না করে কবিতার জন্য একটা দার্শনিক জায়গা আদায় করে নিতে পারি কিনা তার পরীক্ষা ছিল ‘এবাদতনামা’। এটা কতটুকু সম্ভব? সেটা করতে গিয়ে বাংলার সাধকদের ভাবুকতা কতোটা আত্মস্থ করা যায় তার চেষ্টাও ছিল আমার। ‘এবাদতনামা’ আসলে দর্শন নিয়ে এবং বাংলার ইতিহাস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। বাংলার ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে যেসকল দার্শনিক বা ভাবগতভাবে ঘটনাগুলো ঘটেছে তাকেও চিহ্নিত করতে চেয়েছে ‘এবাদতনামা’। দেখা যাবে রামকৃষ্ণ নিয়ে কবিতা আছে ‘এবাদত নামায়’, গৌরাঙ্গের ওপর কবিতা আছে। এগুলো বাংলা সংস্কৃতির অংশ। এটা একটা নতুন ধরনের পরীক্ষা। সে পরীক্ষায় আমার মনে হয় কবিতার যারা সমঝদার তাদের ইস্কুলে আমি পাশ করেছি। অন্তত ফেল করি নি।

দাবি করে বলি নি, কিন্তু অনুমান আছে ‘এবাদতনামা’য় যে, ইসলাম বাংলার সংস্কৃতির অংশ। ঠিক যেমন জৈন, বৌদ্ধ হিন্দু এবং আধুনিকতার সুবাদে খ্রিষ্ট ধর্মের ইতিহাস কিম্বা অন্যান্য গৌণ জিনিষ অথবা লোকায়ত ধর্ম নিয়েই – সবকিছু নিয়েই -- আমাদের ইতিহাস। ইসলাম উপমহাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। থিওলজিকাল ইসলামের সাথে আমাদের নানা বিরোধ থাকে, সেটা যে কোন ধর্মতত্ত্বের সঙ্গেই হতে পারে – হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম বা খ্রিস্টিয় – কিন্তু, ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে তর্কটা অন্যত্র। আমি আল্লার সঙ্গে চুক্তি করে মুসলমান ঘরে জন্ম গ্রহণ করি নি। কিন্তু তাই বলে ইসলামের বিরুদ্ধে খেয়ে না খেয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রগতিশীল প্রমাণ করবার চেষ্টা আমার কাছে হীনমন্যতা মনে হয়। আমি যেমন ইসলামের সুবাদে আরব বা পারস্য সংস্কৃতির ওপর আমার হক ছাড়তে রাজি না, ঠিক তেমনি সিন্ধু নদের এপারের অধিবাসী হবার কারনে এবং বাংলাভাষী হবার সুবাদে রামায়ন-মহাভারতের ওপর অধিকারও ছাড়ব কেন? সবই আমার সংস্কৃতির অংশ। আমি কোনটাই ছাড়তে রাজি নই। আধুনিকতার সুবাদে পাশ্চাত্যের সঙ্গেও যোগ আছে আমার। বাংলাদেশ এক দারুন সন্ধিস্থান। ‘এবাদতনামায়’ আমি দেখতে চেয়েছি বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান, ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির ধারাকে বাংলা কবিতায় ধরা যায় কিনা আদৌ। ধরার পদ্ধতিটা কী হতে পারে? এসবেরই একটা চেষ্টা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ‘এবাদতনামা’।

ঠিকানা : আপনার ‘এবাদতনামা’ যার মধ্যে তসবীহ, জায়নামাজ আছে, সেটার দাম নিউইয়র্কে সর্বনিম্ন ৪০ ডলার। অনেক দাম? অনেকে কিনতে গিয়ে কেনে না?

ফরহাদ মজহার : এটাতো আমি জানি না। সত্যিই অনেক দাম। এটা পাবলিশার বলতে পারবেন। বাংলাদেশে মাত্র ৮০০ টাকা। তসবিহ আছে ঠিক, কিন্তু দেখবেন এমন ভাবে আছে যাতে নিরানব্বই দানা গোনা যায়, অন্যভাবে একশ আটটি দানাও গুনতে পারেন। ঠিক। জায়নামাজ আছে। কিন্তু তাকে চাইলে উত্তরীয় হিশাবেও ব্যবহার করতে পারেন।

ঠিকানা : আপনার লুঙ্গী দর্শনের রহস্য কী?

ফরহাদ মজহার : এ ব্যাপারে আমার আলাদা কোন দর্শন নেই। আমি শুধু পরি। আমি তাঁতের কাপড় পড়ি সবসময়। যে কাপড়টা আমি তৈরি করি, সেই কাপড়ই আমি পরি। আপনি চাইলে এই পোশাককে আপনার মত করে অর্থ করতে পারেন। যেমন, নিজের চিন্তা ও ভাবুকতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ জীবনযাপন, পোশাক আশাক ইত্যাদি।

ঠিকানা : উবিনীগ কি এনজিও?

ফরহাদ মজহার : না। এটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান। আমরা সরকারকে ট্যাক্স দেই। আমরা উন্নয়ন নিয়ে কাজ করি। এটা এক ধরনের পরামর্শ দাতা প্রতিষ্ঠান। আপনি যে কোন ইস্যুতে আমাদের মতামত চান, আমরা দেব। বিনিময়ে একটা কনসাল্টিং ফি আমরা নেব।

ঠিকানা : নিউইয়র্কে এসেছিলেন এবিসি কনভেনশনের অতিথি হয়ে। কেমন লাগলো কনভেনশন? এই অভিজ্ঞতা থেকে কনভেনশনকে আরো উন্নত করার কি কোনো ভাবনা বা পরামর্শ আপনার রয়েছে?

ফরহাদ মজহার : প্রথমত আমি বলবো যে, আপনারা যখন আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তখন আমি বিস্মিত হয়েছি। এখানে ফোবানা হয় শুনেছি অনেক আগে থেকে, কিন্তু আমি এই প্রক্রিয়ার সাথে কখনই যুক্ত ছিলাম না। আমি খুব ফ্রাঙ্কলি বলি, আমি দ্বিধায় ছিলাম দুটো কারণে। প্রথমত আমার মনে হচ্ছিল, আমি হয়তো ভিসা পাবো না। দ্বিতীয়ত আমি খুব ক্রিটিক্যাল কথাবার্তা বলি, মধুর কথা তো বলি না-সে অর্থে জনপ্রিয়ও নই। কে শুনবে আমার কথা। যাই হোক সানন্দেই গ্রহণ করি আমন্ত্রণ। আমি মনে করি এবিসি কনভেনশনের মতো একটা ইভেন্ট আয়োজন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই যে আমি আপনাদের সাথে পরিচিত হলাম, জানলাম, আরো অনেকের সাথেও কথা হল-এগুলো থেকে আমি যথেষ্ট উপকৃত হয়েছি। নতুন নতুন লোকের সাথে এই আলাপ পরিচয় এবিসি কনভেনশনের মাধ্যমেই হলো। তার মানে কনভেনশনের একটা অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা আছে এখানে। আমার পরামর্শ হবে, আগামীতে যখন করবেন চেষ্টা করবেন আরো গুছিয়ে করার। গুরুত্ব দিতে হবে সেমিনারের ওপরে। এখন যেটা হচ্ছে, তা হলো সেমিনার এবং অনুষ্ঠান জড়াজড়ি হয়ে যাচ্ছে। যারা আসলে সেমিনারের জন্য আসে নাই, গান শুনতে বসেছেন-তারা একদিকে যেমন সেমিনারকে উপদ্রব মনে করেছে, আবার তেমনি সেমিনারের জন্য যারা এসেছেন তারা উপদ্রব মনে করেছেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে। আমি মনে করি, এ ধরণের অনুষ্ঠানে এখানকার মেইনস্ট্রিমের লোকজনদের আরো বেশি যুক্ত করানো উচিত। লন্ডনের মেয়রকে আপনার এনেছেন খুব ভালো হয়েছে। আমার কথা হলো, এ ধরনের কনভেনশন অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হলে এখান থেকে প্রচুর ফল আপনারা বের করতে পারবেন। একটা জিনিস আমার কাছে ভালো লেগেছে যে, আপনারা চেষ্টা করেছেন নির্দলীয় একটা জায়গা থেকে কনভেনশনটা করার।

ঠিকানা : আপনি একাধারে কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক। অনেকদিন থেকেই এসব চর্চার মধ্যেই আছেন। আমাদের দেশে যে কয়েকটি পুরস্কার রয়েছে যেমন-একুশে পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কার, জাতীয় পুরস্কার, বাংলা একাডেমী পুরস্কার- এগুলোর কোন একটি কি আপনার কপালে জুটেছে?

ফরহাদ মজহার : আমি একজন নগন্য মানুষ। এগুলো আমাকে কেন দেবে? আমি আমার কাজ চর্চা অব্যাহত রেখেছি। পুরস্কারের কথা চিন্তা করে কোনো কিছু করি না আমি। যারা পুরস্কার দেন, তাদের কাছে হয়তো আমি যোগ্য নই।

ঠিকানা : বর্তমান সরকারের সাথে ড. ইউনূসের স্নায়ুযুদ্ধ সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?

ফরহাদ মজহার : এটা সম্পূর্ন শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা থেকে এসেছে বলে মনে হয়েছে। রাজনৈতিক কারনে ইউনুসের বিরোধিতা করার যুক্তি থাকলেও তাকে নিন্দা করবার ভাষা, তাকে সরাবার প্রক্রিয়া সমস্ত কিছু মিলে এই ধারণাই হাসিনা দিয়েছেন যে তিনি ব্যক্তি ইউনুসের বিরোধী। গ্রামীন ব্যাংক সংসদে পাশ করা আইনে প্রতিষ্ঠিত – সেই দিক থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে সরকারের কতোটুকু বিনিয়োগ আছে কি নাই সেই তর্ক অপ্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্র যে প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়েছে ডক্টর ইউনুস সেই প্রতিষ্ঠানের – অর্থাৎ কার্যত রাষ্ট্রের কর্মচারী। কিন্তু শেখ হাসিনার প্রতিহিংসা বাসনার কারনে এই গুরুত্বপূর্ণ তর্কে আমরা প্রবেশ করতে পারি নি। একই ভাবে ক্ষুদ্র ঋণ যে দারিদ্র মোচন করে না, বরং বাড়ায় সেই তর্কও সুষ্ঠ ভাবে করা গেল না। গ্রামীণ ব্যাংক নামের প্রতিষ্ঠান -- যার বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সাংগঠনিক ভুমিকা রয়েছে। ওদিকেও হাসিনার চোখ পড়তে পারে বলে অনেকে ইঙ্গিত দিচ্ছেন; আমি জানি না সেটা কি। তবে ড. ইউনূস যথার্থই বলেছেন, সরকার এখন যে অবস্থান নিয়েছে তাতে প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক দুর্বল হবে।

অবশ্য আমি নিজে মাইক্রোক্রেডিটের পক্ষের লোক না। এর বিরোধী। কিন্তু ইউনুস অসৎ, দুর্নীতিপরায়ন ইত্যাদি অভিযোগ সঠিক বলে মনে করি না। ইউনুস যা ভেবেছেন যা করতে চেয়েছেন সারা জীবন্ তাই করেছেন। তার চিন্তা, তত্ত্ব, রাজনীতি ইত্যাদির আমি ঘোর বিরোধী। কেন বিরোধী তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করা আমি জরুরী মনে করি। স্বল্প পরিসরে এখানে তা হাজির করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাকে ব্যাক্তিগত ভাবে হেয় করা, তাকে সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট বলে গালি দিয়ে সস্তা রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা আদায় আমি সমর্থন করি না। তাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিলে সাম্রাজ্যবাদ বাংলাদেশ থেকে পাততাড়ি গুটাবে না।

ঠিকানা : বিজনেস মানেই হলো প্রফিট। আর প্রফিট মানে হলো শ্রমিক শোষণ। শ্রমিক শোষণ করে প্রফিট করে গালভরে বলছেন, সোস্যাল বিজনেস। গালভরা এই নামটা দেয়ার মানেটা কী দাঁড়ালো?

ফরহাদ মজহার : বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থরক্ষা করতে হলে নানান ধরনের কথা বলতে হয়। স্যোসাল বিজনেস মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির পারপাসই সার্ভ করছে। এগুলো তো খুবই দৃশ্যমান। বহুজাতিক কোম্পানি তো ননপ্রফিট অর্গানাইজেশন নয়। এই সমালোচনাগুলো বিচ্ছিন্ন ভাবে করলে চলবে না। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন এবং তার এক পর্যায়ে গত শতকের আশির দশকের পর থেকে লগ্নি পুঁজির যে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতি ও বিচলনের ধরন তার সঙ্গে গরিবদের টাকা ভাড়া দিয়ে সুদে আসলে উসুল করার পুঁজিতান্ত্রিক তাগিদকে বুঝতে হবে। যেখানে রাষ্ট্রগুলো টাকা ধার দিয়ে টাকা ফেরত দিতে পারছে না, সেখানে গরিব উচ্চ সুদে টাকা নিয়ে সুদে আসলে ফেরত দিচ্ছে। পুঁজিতান্ত্রিক দুনিয়ার জন্য এ এক অভাবনীয় আবিষ্কার। ডক্টর ইউনুস নোবেল পুরস্কার পাবার বহু আগে আমি তাই বলেছিলাম তাকে অবশ্যই এই কারনে নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে তার অবদান অস্বীকার করার কী দরকার। তবে পুঁজিবাদী বিশ্ব এখন যে সংকটে পড়েছে তা থেকে উদ্ধার পাওয়া খুবই কঠিন। ফলে ডক্টর ইউনুসের গ্রহণযোগ্যতাও বিশ্বব্যাপী পড়তির দিকে। বাড়বার কোন সম্ভাবনা আমি দেখি না। তিনি ব্যবস্থার দরকারে ওপরে উঠে গিয়েছেন, ব্যবস্থার গতিকে আবার নীচে পড়বেন। এটাই তো আমি দেখছি।

ঠিকানা : বাংলাদেশে বিডিআরের ড্রেস ও নাম পরিবর্তন হয়েছে। অনেকে বলে থাকেন অনুকরণ করা হয়েছে ভারতীয় আর্মির। আপনার কী অভিমত?

ফরহাদ মজহার : আমি মনে করি সমালোচনাটা সঠিক। আমি এই পরিবর্তনের পক্ষে নই। আগে বিডিআর কথাটার মধ্যে যে গাম্ভীর্য ছিল, বর্ডার গার্ড নাম দিয়ে জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যাপারটিকে হাল্কা করা হয়েছে মনে হয়েছে। আমার ধারণা এ পদক্ষেপের কারণে বিডিআরকে এক ধরনের দারওয়ানগিরিতে পরিণত করা হয়েছে। বাংলাদেশকে দিল্লির প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থার অধীন করার প্রক্রিয়ার বাইরের দিক হিশাবেই এই বদলগুলো ঘটেছে।

ঠিকানা : যখন কোনো একটি সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন দেশটাকে নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করে শাসন চালাতে থাকে। অন্য মতের কেউ কোথাও আর স্থান পান না। চাকুরি, রাজনীতি, ব্যবসায়-সর্বত্র শুধু ক্ষমতাসীনরাই। এটা নিয়ে কী কেউ কথা বলছে?

ফরহাদ মজহার : নিশ্চয়ই বলছে। ঘুরে-ফিরে কিন্তু আমরা একই জায়গায় চলে যাচ্ছি। আমরা যতক্ষণ না গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করতে পারছি এবং সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবার জন্য দরকারী প্রতিষ্ঠান বানাতে না পারছি -ততক্ষণ এগুলো চলবেই। সরকার এবং রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য এখনো পরিষ্কার নয় আমাদের কাছে। হাসিনার বিরোধিতাকে বলা হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতা। কিন্তু হাসিনা কে? মানুষ ভোট দিয়েছে, তাই তিনি ক্ষমতায়। সেই জনগণের কাছে তাকে তো জবাবদিহি করতেই হবে। তাহলে নাগরিকদের সমালোচনা তাকে সহ্য করতেই হবে।

ঠিকানা : আমেরিকায় পড়াশোনা করেছেন? এখানেই গড়ে উঠতে পারতো আপনার নিরাপদ ভবিষ্যত। কিন্তু না থেকে চলে গেলেন দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য। উল্টো দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে কিছু প্রভাবশালী দলীয় লোক জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে এসব দেশে। কী বলবেন আপনি?

ফরহাদ মজহার : সবই জানি। বাংলাদেশ বড় দেশ নয়। এই শ্রেণীও বিশাল নয়। এ সুযোগ আমরাই করে দিচ্ছি। সামগ্রিকভাবে আমরা যদি চেতনাটা তৈরি করতে না পারি, সচেতন না করতে পারি-আমরা কিন্তু এগুতে পারবো না।

ঠিকানা : আপনি আমেরিকা থেকে যখন একবারে চলে যান, মনে পড়ে কী সেই দিন? মনে পড়ে সেই মুহূর্ত আপনার মাথায় তখন কী কাজ করছিল?

ফরহাদ মজহার : স্বাধীনতার পর এ দেশে আসলাম। পড়শোনা করলাম। যখনই সুযোগ পেয়েছি দেশের জন্য কিছু করার, তখনই আমি ঝাঁপিয়ে পড়েছি। সিদ্ধান্ত নেবার মানসিক শক্তি আমার মধ্যে ছিল বলে, আমি সেই সময়ের যুবক ফরহাদ মজহারকে নিয়ে গর্ব করি, বলতে পারেন। সেদিন সন্ধ্যায় নিউইয়র্কে একটি ফার্মেসিতে কাজ করছিলাম। মাথার মধ্যে নানা প্রশ্নের মধ্যে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, আরে! আমি এখানে কী করছি? এটা তো আমার জায়গা নয়। গায়ে থেকে এপ্রন খুললাম। সহকর্মী ভাবলেন, চা খেতে যাচ্ছি। কিন্তু এপ্রন খুলছি দেখে বলল, তুমি এপ্রন কেন খুলছো? আমি বললাম, আমি কুইট করছি। মানে? বললাম, আই এম কুইটিং দ্য জব, এই চাকুরি ছেড়ে দিলাম। আমি এদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে। পেছনে আর ফিরে তাকাইনি । শুধু তাই নয়, আবার যাতে আমেরিকায় আসতে ইচ্ছে না করে সেজন্য পরবর্তীতে ফিরে আসার কাগজপত্রও ছিঁড়ে ফেলি। গ্রিন কার্ড ফেরত দেই।

ঠিকানা : আপনি কী খেলাধুলা পছন্দ করেন?

ফরহাদ মজহার : হ্যাঁ করি। ফুটবল খেলতাম ছোটবেলায়।

ঠিকানা : আর খাবার?

ফরহাদ মজহার : নিরামিষ।

ঠিকানা : রং?

ফরহাদ মজহার : সাদা

ঠিকানা : মানুষের সাহচার্য কীভাবে উপভোগ করেন?

ফরহাদ মজহার : মানুষ আমার খুবই পছন্দ। এমনকি যারা আমার নিন্দা করেন, তাদেরকেও। আমার কাজই হলো মানুষকে নিয়ে। আমার একটা বদনাম আছে, আমি কোনো দেশে গেলে ঘুরতে পছন্দ করি না, গল্প-গুজবে মেতে থাকি। মানুষের সাথে কথা বলার চেয়ে বড় কোনো আনন্দতো হতে পারে না ।

ঠিকানা : আপনার কিছু কী বলার আছে, যা আমাদের আলোচনায় আসেনি?

ফরহাদ মজহার : আমার একটা মিনতি আছে। আপনারা অত্যন্ত অসাধারণ কিছু কাজ করেছেন। আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখছি যে, উত্তর আমেরিকা জুড়ে যেসব প্রবাসী আছেন তারা অসাধারণ কিছু করার সামর্থ অর্জন করেছেন। এখানে একটা বড় কমিউনিটি তৈরি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরিবর্তন হচ্ছে। তার সাম্রাজ্যবাদী নীতির পরিবর্তন হয়ে যাবে সেটা বলছি না, কিন্তু মার্কিন নাগরিক হিসাবে বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা রাখবার জায়গা অনেক প্রশস্ত হবে। চলুন আমরা সবাই মিলে দেশটা গড়ি। সেটা করতে গিয়ে কীভাবে কাজ করতে পারি একসাথে, আসুন আলোচনা করে ঠিক করি। সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাই।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।