১. যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভেজাবো না !!


‘এক চুলও নড়বো না’

শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি ‘একচুলও নড়বেন না’। তিনি যেভাবে তাঁর অধীনে নির্বাচন করতে চান, সেভাবেই নির্বাচন হবে। তাঁর ইচ্ছাই শেষ কথা। বলেছেন, কিভাবে হবে সেটা সংবিধানেই লেখা আছে। এরও সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে। অর্থ হোল, তিনি যেভাবে সংবিধান সংশোধন করে রেখেছেন, সেইভাবেই নির্বাচন হতে হবে: তিনি ক্ষমতায় থাকবেন, সংসদ জারি থাকবে; থানা-পুলিশ-প্রশাসন তার আজ্ঞাবহ থাকবে, তাদের সহযোগিতা করবে যুবলীগ-ছাত্রলীগের কর্মীরা; এই পরিস্থিতি মেনে নিয়েই বিরোধী দলকে নির্বাচনে আসতে হবে। শুধু তাই নয়, নির্বাচন কমিশনের এখন যতোটুকু এখতিয়ার তাকে সংকুচিত করা হবে, যতটুকু ক্ষমতা অবশিষ্ট আছে সেই তলানিটুকুও নির্বাচন কমিশন স্বেচ্ছায় বিসর্জন দেবে। নির্বাচন কমিশন নামে থাকবে, কাজে থাকবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণে ও শাসনের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। কথাটা এই ভাবে সিধা সরল আক্ষরিক অর্থেই বুঝতে হবে। একটা আদর্শ পরিস্থিতি এমন হতে পারত যে নির্বাচনের সময় সুষ্ঠ নির্বাচনের জন্য আবশ্যিক সকল নির্বাহী ক্ষমতা ও তা বলবৎ করবার উপযুক্ত আইনী ও প্রাতিষ্ঠানিক শর্ত বাংলাদেশে বাস্তবে হাজির। তাহলে সংবিধানের অধীনেই নির্বাচন হবে কথাটার ইতিবাচক অর্থ দাঁড় করানো যেত। সাংবিধানিক ভাবে দেশে যা চলছে তা সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র। প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে তার যে সহিংস ও একগুঁয়েমি রূপ দেখি তাকে নৃতাত্ত্বিক কি রাজনৈতিক যেভাবেই বিশ্লেষণ করিনা কেন, কোন ফল হবে না। শেখ হাসিনা বলছেন তাঁর এই একনায়কী অবস্থান থেকে তিনি একচুলও নড়বেন না।

খালেদা জিয়া প্রত্যুত্তরে বলেছেন, আন্দোলনে সব চুলই নড়বে, উড়ে যাবে সবকিছুই। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন বিএনপি ও আঠারো দলীয় জোট শেখ হাসিনাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নিতে বাধ্য করবে। সেটা যদি তিনি করতে চান তাহলে আন্দোলনের মাধ্যমেই করতে হবে। এখন অবধি যে-রাজনৈতিক বাস্তবতা তাতে তার সম্ভাবনা দেখি না। বিএনপিতে যারা ক্ষমতায় থেকে অঢেল টাকা পয়সা কামিয়েছে এবং সেই সুখ আরাম আয়েশের সঙ্গে ভোগ করে কাটাতে চায় তারা আন্দোলন করবে না। তারা আবার ক্ষমতায় যাবার আলিঝালি সম্ভাবনা দেখলে একটু চাঙ্গা হয়ে ওঠে মাত্র। এটা তো আমরা গত কয়েক বছর ধরেই দেখছি। বিডিআর বিদ্রোহ গেল, টিপাই মুখ গেল, তিস্তা গেল, শেয়ার বাজার কেলেংকারি গেল, হলমার্ক-ডেসটিনি গেল, পদ্মা সেতু গেল, বিশ্বজিৎ গেল, আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থিদের দমনপীড়ন হত্যাযজ্ঞ গেল বিএনপি কিছুই করতে পারে নি। তো এই বিএনপির পক্ষে আন্দোলন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায় করা অসম্ভবই বলতে হবে। খালেদা জয়া তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারেন, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। আন্দোলন করতে হবে। কিন্তু বিএনপিকে দল হিসাবে আন্দোলনে নামানো কঠিন।

যারা আন্দোলন সংগ্রাম করবে তাদের বড় অংশই ইসলামপন্থি। তারা তাদের আদর্শের জায়গা থেকে লড়াই করে, সে আদর্শ অনেকের অপছন্দ হতে পারে। ইসলামের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ পোষণ না করেও বাংলাদেশের ইসলামপন্থি রাজনীতি অপছন্দ করবার অনেক সঙ্গত কারণ থাকতে পারে। কিন্তু কমবেশি গত এক দশকে দুই রাজনৈতিক দলের দুর্নীতি, লুটপাট, চরম দুর্বৃত্তপনা, অসহনশীলতা ও মানবাধিকার লংঘনের নজির দেখে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ইসলামি রাজনীতির পক্ষে গণসমর্থন বেড়েছে। ইসলামপন্থি রাজনীতির বিভিন্ন ধারার সঙ্গে বিএনপির জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ঐক্য ও পার্থক্যের জায়গা সুস্পষ্ট না করে বিএনপির পক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ইসলামের বিভিন্ন আদর্শিক বয়ান এবং ইসলামপন্থী রাজনীতির সমর্থন বিএনপি এতদিন অনেকটা ফাও পেয়ে এসেছে। যেহেতু আওয়ামি লীগ সহ চৌদ্দ দল উভয়েরই বিরোধী পক্ষ হবার কারণে বিএনপি ও ইসলামপন্থিদের মধ্যে নির্বাচনী আঁতাত সহজেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেটা এতদিন ছিল কৌশলগত, আদর্শগত দিক ছিল ক্ষীণ। কৌশলগত সম্বন্ধ রক্ষা করেই কাজ হয়েছে। কিন্তু গত চার বছরে আওয়ামি লিগের সঙ্গে ইসলামপন্থিদের প্রধান অংশের বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে। সেই বিরোধকে সুনির্দিষ্ট আদর্শিক জায়গা থেকে বিবেচনা ও মীমাংসা করতে ব্যর্থ হলে বিএনপি ক্রমশ বাংলাদেশের রাজনীতিতে গৌণ দলে পরিণত হয়ে পড়বে। যা টিকে থাকবে তা হচ্ছে ইসলামপন্থি এবং তাদের বিরোধীরা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ক্রমশ সেইদিকেই মোড় নিচ্ছে। আওয়ামি রাজনীতি ও ইসলামপন্থি রাজনীতির মাঝখানে ধরি মাছ না ছুঁই পানি জাতীয় অবস্থান নিয়ে বিএনপি এতদিন কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল, তা ক্রমশ অসম্ভব হয়ে উঠবে। বিশেষত জামাতে ইসলামি ও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে যে বৈরি সম্পর্ক আওয়ামি লিগ তৈরি করেছে তার ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি আর আগের জায়গায় নাই। একটা গুণগত বদল ঘটে গিয়েছে। তার পরিণতি বাংলাদেশের জন্য কী দাঁড়াবে আমরা এখনও জানি না। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি – বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য এবং মিশরের চলমান ঘটনাবলী। বাংলাদেশে তার দৃশ্যমান প্রকাশ না থাকলেও তার প্রভাব রয়েছে, এটা সহজেই অনুমান করা যায়।

যদি সুষ্ঠ নির্বাচন হয়, বিএনপি জিতবে এতে বোধ হয় সন্দেহ নাই। কিন্তু বিএনপি যদি আন্দোলন করতে চায় তাহলে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে নিয়েই করতে হবে। সেই ক্ষেত্রে ইসলামপন্থিরা রক্ত দেবে আর বিএনপি তাদের পুরানা দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজদের নিয়ে ক্ষমতায় আসবে, সেটা হবে না। একটা আদর্শিক ঐক্যের জায়গায় বিএনপিকে যেমন আসতে হবে, একই সঙ্গে বাংলাদেশের এখনকার সুনির্দিষ্ট কর্তব্যগুলো কী, সেই ক্ষেত্রেও পরিষ্কার একটি জাতীয় ও গণমুখী কর্মসূচি দাঁড় করাতে হবে। কিন্তু ইসলামপন্থিদের নিয়ে একটি জাতীয় ও গণমুখি কর্মসূচি প্রণয়নের কথা বিএনপি ভাবছে না। এই ক্ষেত্রে বিএনপি ইসলামপন্থিদের অচ্ছুতের মতো তাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়েই রাখতে চায়। বেগম খালেদা জিয়া এই ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ভাবে সংবেদনশীল বা দু্রদর্শী হতে পারেন। কিন্তু বিএনপির যারা নীতি নির্ধারক ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি তারা রাজনীতির বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। তাদের অধিকাংশই সম্ভবত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবার জন্যই উদ্গ্রীব হয়ে আছেন। দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজদের হেদায়েত করা কঠিন।

এখনকার রাজনৈতিক কর্তব্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিএনপির মধ্যে দোদুল্যমানতা পরিষ্কার। সেটা ইসলাম প্রশ্নে যেমন, তেমনি আন্দোলনের ক্ষেত্রেও। অনেকটা ‘আমার যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভেজাবো না’ জাতীয় রাজনৈতিক অবস্থান। কিন্তু শেখ হাসিনার চুল নড়ুক বা উড়ুক, বিএনপিকে আন্দোলন-সংগ্রামে চুল ভেজাতে হবে। এর বিকল্প আছে মনে হয় না। কিন্তু এটা বিএনপির ব্যাপার নয়। আমাদেরও। অর্থাৎ তাদের যারা একাত্তর সালে বাংলাদেশের অভ্যূদয়কে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে নিজেদের আবির্ভাব মুহূর্ত হিসাবে গণ্য করে এবং নিজেদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে টিকিয়ে রাখা ও গণশক্তির বিকাশ ঘটানোকে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাবার আবশ্যিক শর্ত গণ্য করে। উপমহাদেশে শ্রেণি ও জাতপাত বিরোধী সংগ্রাম ও নিপীড়িত জাতিসত্তার মুক্তি সংগ্রামের সাফল্যও যার ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। তাহলে বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণ ও বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দায় মূলত আমাদেরই।

আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে পরিত্রানের উপায় নাই। সেই ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে চাইলে ইসলাম প্রশ্নে দোদুল্যমানতা কাটিয়ে উঠতে হবে। বিএনপি দোদুল্যমানতা কাটিয়ে উঠতে পারবে কিনা আমরা জানি না। সেই ব্যর্থতার পরিণতি তাকে বরণ করতে হবে,। কিন্তু ইসলাম নিয়ে বাংলাদেশে যে বিরোধ, বিসংবাদ ও হানাহানি তা নিরসন করা ছাড়া একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বাংলাদেশ টিকে থাকবার সম্ভাবনাও ক্রমশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।

বাংলাদেশের জনগণকে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়াসহ ইসলাম-প্রধান দেশগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। সকলকেই ভাবতে হবে এই ধরণের ভয়াবহ আভ্যন্তরীণ সংঘাতে আমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে হানাহানিতে মেতে উঠতে চাই কিনা। যদি শিক্ষা গ্রহণ না করি তাহলে এই দেশ দ্রূত সর্বনাশের দিকেই ধেয়ে যাবে। ইতিহাসে বহু জাতি ধ্বংস হয়েছে, বহু দেশ খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গিয়েছে, বাংলাদেশও বিলুপ্ত হতে পারে। এ কথা শুনতে খারাপ লাগলেও বুঝতে হবে বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট এমন এক মাত্রায় গিয়ে ঠেকেছে যাতে উদ্বিগ্ন ও উৎকন্ঠিত হবার যথেষ্ট কারন রয়েছে। অথচ বাংলাদেশ সামন্তবাদী কিম্বা ট্রাইবাল সমাজ নয়; এই দেশে ক্ষুদ্র জাতি সত্তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র ও মর্যাদা স্বীকার করে নিলে ভাষা ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সমাজ মোটেও বহুধাবিভক্ত নয়। ফলে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের মীমাংসা কঠিন নয় মোটেও। কিন্তু একদিকে ভাষা ও সংস্কৃতি আর অন্য দিকে ইসলামকে দুষমন হিসাবে খাড়া করে একটি বিরোধ আমরা ৪২ বছর টিকিয়ে রেখেছি। এর সমাধান না হবার কারণ ইসলাম প্রশ্নকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্ন আকারে মোকাবিলা না করা। যার সঙ্গে যুক্ত ইস্লামের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক ভূমিকা। ধরে নেওয়া হয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হবার মধ্য দিয়ে ইসলামের ওপর বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতির বিজয় হয়েছে, একাত্তরের জয়-পরাজয়ই তার সমাধান করে দিয়েছে। এই অনুমান যাদের দৃঢ়মূল ইসলাম নিয়ে কোন কিছু বলার অর্থ তাদের কাছে দাঁড়ায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা। সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে ইসলাম কোন ভূমিকার দাবি করলে তাকে ক্রমাগত মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ/বিপক্ষ বিভাজনের ভিত্তিতে জবরদস্তি অস্বীকার করা হয়েছে। ধর্মকে ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে সমাজ, সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও রাজনীতি থেকে অপসারণের চেষ্টা হয়েছে। অধিকাংশ সময় সেটা করা হয়েছে বলপ্রয়োগ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে। এতে ক্রমাগত সংঘাত বেড়েছে। ক্রমাগত হামলার মুখে ইসলাম যে রাজনৈতিক রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে তাকে মোকাবিলার পথ এখন আমরা আর জানি না। একমাত্র ভরসা পাশ্চাত্য মতাদর্শ, ছকবাঁধা ফর্মুলা এবং পাশ্চাত্যের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি – দিল্লি-ওয়াশিংটন-ইংলণ্ড-ইউরোপের সহায়তা। এতে সংঘাত আরেক স্তরে উন্নীত হয়েছে। যেভাবেই হোক ইসলামপন্থিদের দমন করাই প্রধান কর্তব্য হয়ে উঠেছে। বলাবাহুল্য সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এতে ইসলামপন্থী রাজনীতি – বিশেষত তার সংগ্রামী ও লড়াকু বয়ান ও রূপকেই গ্রহণ করবে। সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষা করবার জন্য যাকে ‘গণতন্ত্র’, ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’, ‘আধুনিকতা’, ‘প্রগতিশীলতা’ ইত্যাদি নানান নামে ফেরি করা হয় তাকে গ্রহণ করবে না। বিরোধিতাই করবে। এটাই ঐতিহাসিক বাস্তবতা। ইসলামপন্থিদের সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, জঙ্গি ইত্যাদি নানান নামে অভিহিত করে দমন নিপীড়নে কোন কাজ হবে না। হিতে বিপরীত হবে।

এর শ্রেণিগত দিকটাও পরিষ্কার। মোটা দাগে এই লড়াই জালিম ও মজলুমের লড়াইয়ের চরিত্র পরিগ্রহণ করতে বাধ্য। আন্তর্জাতিক পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে বাংলাদেশে যে ধনি ও সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে ইসলামের প্রতি তাদের আতংক ও ভীতি সহজেই শনাক্ত করা যায়। এরাই পরাশক্তি ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষার এ দেশীয় দোসর। এদের শিক্ষিত ও পরিশীলিত অংশ সুশীলতা, প্রগতি, আধুনিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার নামে যে উদারবাদ ও বামপন্থা খাড়া করে সেটা মূলত সাম্রাজ্যবাদেরই স্বার্থ রক্ষা করে। তাদের কাছে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার অর্থ সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ নয়, বরং এই ব্যবস্থার মধ্যে তাদের নিজ দেশের বুর্জোয়া বা ধনি শ্রেণির জন্য সুবিধা আদায় করা। ধর্মের প্রশ্ন গ্রিক-খ্রিস্টিয় পাশ্চাত্যে যেভাবে সমাধান করা হয়েছে, বিমূর্ত ফর্মুলা আকারে তারা এই দেশে জনগণের ওপর সেটাই চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে। ইউরোপই তাদের কাছে সভ্যতার একমাত্র মডেল। ইসলাম্পন্থিদের সঙ্গে তাদের এই ক্ষেত্রে বিরোধ পরিষ্কার।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পুঁজি পেট্রোডলার থেকে আলাদা নয়। ইসলামপন্থার বিভিন্ন বয়ান ও ধারার মধ্যে অতএব পেট্রোডলার ও তার মতাদর্শিক বয়ানগুলোও সমান সক্রিয়। যার কারণে অকাতরে আত্মত্যাগের পরও ইসলামপন্থি রাজনীতি গণমানুষের রাজনীতির রূপ নিতে পারছে না। ইসলামপন্থার মধ্যেও এই শ্রেণিতে শ্রেণিতে লড়াই নানাভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।

শুধু ইসলাম বিদ্বেষী ও বিরোধীদের দোষ দিলেও লাভ হবে না। বাংলাদেশের ইসলামপন্থী রাজনীতির ধারা ও প্রধান প্রধান মতাদর্শিক বয়ান ও কর্মকাণ্ড যেভাবে হাজির তাতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণশক্তির বিকাশ ঘটছে না, বরং বিভক্তি ও বিভাজনই আরও চরমের দিকে যাচ্ছে। তাছাড়া ইসলাম যদি বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে তার সম্পর্ক নির্ণয়ে ব্যর্থ হয় এবং তার জায়গায় আরবীয় বা মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি ধর্মের নামে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে, সেখানেও সংঘাত তৈরী হয়।  পরাশক্তির হস্তক্ষেপ অনিবার্য করে তোলার শর্ত অপরিণামদর্শী সংঘাত থেকেই তৈরি হয়, যাকে মোকাবিলার ক্ষমতা বাংলাদেশের জনগণের নাই। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণকে যদি এগিয়ে যেতে হয় তাহলে তাকে অবশ্যই গণ আন্দোলন গড়ে তোলা ও বিকশিত করবার সঠিক নীতি ও কৌশল নির্ণয়ের জন্য পুরানা ছক কাটা চিন্তা পরিহার করে খোলা মনে ভাবতে হবে। কয়েকটি কিস্তিতে ভাবনার ক্ষেত্রগুলো কী হতে পারে সেই কথাই এখানে বলার চেষ্টা করব।

শেখ হাসিনার প্রতিপক্ষের দুর্বলতা বোঝার ক্ষমতা

এই পরিস্থিতিতে বিএনপিকে যদি আন্দোলন করতে হয় তাহলে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে এখন আর আগের মতো শুধু প্রচলিত জোটমূলক সম্পর্ক বজায় রাখলে কাজ হবে না। আরো ঘনিষ্ঠ হতে হবে। ইসলাম প্রশ্নের মীমাংসা না করে ঘনিষ্ঠ হতে গিয়ে বিএনপি নিজেকে মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক এবং জঙ্গিবাদের উসকানিদাতা প্রমাণিত করবে, শেখ হাসিনা যা চান। এই বাস্তবতা যদি কেউ ভাল বোঝেন তবে তিনি শেখ হাসিনা। যে কারণে আমি বিভিন্ন সময় শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলের প্রশংসা করি। তাঁর এক চুলও না নড়ার নীতি হচ্ছে বিএনপিকে আন্দোলনে বাধ্য করা এবং এই অপবাদ মাথায় নিয়ে পরাশক্তির দুষমনে পরিণত করা। বিএনপির একা আন্দোলনের মুরোদ নাই। তাকে অবশ্যই ইসলামপন্থিদের সহায়তা নিতে হবে। শেখ হাসিনা সেটা জানেন। অন্যদিকে অন্য যে কোন দেশের মতো ইসলামপন্থি রাজনীতিও একাট্টা কিছু নয় বা ইসলামপন্থিরা একই আদর্শ, প্রবণতা ও দলেরও অন্তর্ভুক্ত নয়। তারা নানান দলে ও গ্রুপে বিভক্ত। শেখ হাসিনা মনে করেন এদের এই বিভাজন ও বিভক্তি এখনও কার্যকর রাখা সম্ভব। ইসলামপন্থিদের বিভক্তি ও দমনের নীতই তিনি গ্রহণ করবেন। তিনি তাই করে যাচ্ছেন।

তবে গত কয়েকবছরে বাংলাদেশে ইসলামপন্থিদের মধ্যে ঐক্যের একটি তাগিদ দেখা যাচ্ছে। নানান বিষয়ে ব্যাখ্যা বা বয়ান এবং আকিদার জায়গায় ফারাকের তর্ক প্রবল ভাবে থাকলেও ‘ঈমান’-এর ক্ষেত্রে ঐক্যের জায়গাটা আরও মজবুত করতে ইসলামপন্থিরা আগের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী। যারা ইসলামের জন্য রক্তাক্ত হচ্ছেন এবং শাহাদাত বরণ করছেন তাদের ঈমান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যে তরিকারই হোক, এখন কেউই আর ভাল চোখে দেখে না। তাছাড়া রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের পার্থক্য বহাল রাখা যারা দরকারী মনে করেন তাঁদের মধ্যেও অনেকে বাংলাদেশে ইসলামের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা থাকা জরুরী ও ন্যায্য মনে করেন। তারা বিশ্বাস করেন, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে থেকে ইসলাম চর্চা সম্ভব। সামগ্রিক ভাবে বিচার করলে ইসলামপন্থি ও ইসলাম অনুরাগীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি প্রবল, তবে জাতীয় রাজনীতিতে তার প্রকাশ কিভাবে ঘটবে সেটা এখনও সুনিশ্চিত নয়। তার অভিমুখ নির্ণয় করে দেওয়াই ছিল ইতিবাচক ‘জাতীয়তাবাদী’ রাজনীতির কাজ। কিন্তু বিএনপি সেই সামর্থ আগেও দেখাতে পারে নি। এখনও পারবে তার নিশ্চয়তা খুবই সামান্য। আওয়ামি লিগ বা ইসলামবিদ্বেষীদের চেয়েও বিএনপির এই অক্ষমতা বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বিপদের জায়গা।

এটা তাহলে পরিষ্কার প্রতিপক্ষের প্রতি শেখ হাসিনার নীতি হচ্ছে বিএনপি জামাত-হেফাজতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা একটি মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক দল এটা বারবার প্রমাণ করা। এর মধ্য দিয়ে বিএনপির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে্র চেতনাধারীদের তিনি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিতে পারেন। সেই দিক থেকে শেখ হাসিনা খুবই সফল। আদর্শিক দেউলিয়াপনার কারণে বিএনপি ইসলামপন্থিদের সঙ্গে শুধু সুবিধাবাদী সম্পর্ক রচনা করতে সক্ষম, কিন্তু ইসলামের ইতিহাস ও চিন্তাধারাকে ইতিবাচক অর্থে ‘জাতীয়তাবাদী’ রাজনীতিতে আত্মস্থ করবার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশ্রম কিম্বা রাজনৈতিক বিচক্ষণতা বিএনপির নাই। বিএনপির বুদ্ধিজীবীদের লেখালিখি পড়লেই সেটা অনায়াসে টের পাওয়া যায়। এক দঙ্গল সুবিধাভোগী নিম্নশ্রেণির প্রপাগাণ্ডাবাজ ছাড়া বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে এদের কারো কোন অবদান আছে কিনা সন্দেহ। শেখ হাসিনা চাইছেন আন্দোলনে ঠেলে দিয়ে বিএনপিকে ইসলামপন্থিদের আরও ঘনিষ্ঠ হতে বাধ্য করা। যাতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভাবে প্রচার করা সম্ভব হয় যে বিএনপি যদি আবার ক্ষমতায় আসে তবে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা আগের মতো প্রশ্রয় পাবে এবং মাথা চাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াবে। ইতিমধ্যে ‘জঙ্গি’দের গ্রেফতার করা শুরু হয়েছে এবং ভারতীয় পত্রপত্রিকায় প্রচার চলছে কোন ভাবেই বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া যাবে না। দিলে তার মানে দাঁড়াবে বাংলাদেশকে পুরানা ইসলামি সন্ত্রাসের অভয়রান্যে পরিণত করা। ভরতের নিরাপত্তার জন্য যা হুমকি।

শেখ হাসিনা সুস্পষ্ট ভাবে তাঁর অবস্থান থেকে এক চুলও নড়বেন না বলায় বাংলাদেশে আগামি দিনে কি হতে যাচ্ছে তা নিয়ে জলনা কল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে। এতে শেখ হাসিনার পক্ষ ও বিপক্ষে উভয় দিকেই অধিকাংশের মধ্যে আতংক দেখা গিয়েছে। তাহলে কি বাংলাদেশ সংঘাতের দিকে যাচ্ছে? ঠিক যে এই সম্ভাবনা আগের চেয়েও এখন প্রবল। কিন্তু এই ধরণের সংঘাতের রাজনৈতিক পরিণতি কি হতে পারে তার উত্তর সম্ভবত নির্ভর করছে বিরোধী দলের ভূমিকার ওপর। আন্তর্জাতিক চাপে শেখ হাসিনা তাঁর অবস্থান বদলাবেন তার সম্ভাবনা এখন অনেক কম। সে চাপের শর্ত হিসাবে বিএনপিকে ডক্টর ইউনুস বা আন্তর্জাতিক ভাবে গ্রহণযোগ্য কোন ব্যক্তির মধ্যস্থতা বা ভূমিকা মেনে নিতে হতে পারে। ডক্টর ইউনুস আদৌ এই ধরণের ভূমিকা পালন করতে চান কিনা সেটা আগামি দিনেই বোঝা যাবে। অন্যদিকে বিএনপি যদি আন্দোলন করতে চায় তাহলে তাকে ইসলাম, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সংশ্লিষ্ট মতাদর্শিক প্রশ্নকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা ও পর্যালোচনা করতে হবে। সেই ক্ষেত্রে বিএনপিসহ বাংলাদেশে বিরোধী দলীয় রাজনীতিকে যে সকল বিষয় বিবেচনা করতে হবে এই আলোচনা সেই ক্ষেত্রেও সহায়ক হতে পারে।

বাংলাদেশ সংঘর্ষের মধ্যেই আছে

শুরুতেই মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ কিন্তু সংঘাতের মধ্যেই আছে। রাজনৈতিক ‘সংঘর্ষ’, খুনাখুনি, একে ধরে নিয়ে যাওয়া, ওকে খুন করা, মানুষ গুম করে ফেলা কিন্তু চলছে। আইন, বিচার ব্যবস্থা পুলিশ র্যালব সবকিছু দিয়েই শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন থাকার সুবিধা নিয়ে বিরোধীদের বিরুদ্ধে ঠিকই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এর একটা আইনী মোড়ক আছে। ফলে এই সংঘর্ষের নগ্ন দিকটা আড়াল করে রাখা সহজ হয়। তাহলে যারা ক্ষমতাসীনদের পক্ষে, তারা সংঘর্ষের মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকলেও আবার সংঘর্ষের কথা বলেন কেন? মূলত আতংকটা অন্যত্র। যে সশস্ত্র নিপীড়নের তারা অংশীদার সেই নিপীড়ক ব্যবস্থার আইনী মোড়ক খসে যাবার ভয়। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রের যে সশস্ত্র শক্তিকে ক্ষমতাসীনরা এখন সাংবিধানিক কিম্বা আইনী মোড়কের আড়ালে ব্যবহার করতে পারছে সেটা আদৌ সম্ভব হবে কিনা সেই আশংকাতেই তারা তটস্থ হয়ে পড়েছে। বিরোধী পক্ষের দমনপীড়নকে রাষ্ট্রের সুরক্ষার নামে আইনী চরিত্র দেওয়া তখন কতোটা সম্ভব হবে সে আতংক তাদের লেখালিখিতে ফুটে উঠছে। লড়াই তখন চৌদ্দ দলীয় জোট বনাম আঠারো দলীয় জোটের হবে কিনা সেটাও সন্দেহ। সেটা হয়ে উঠতে পারে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরে থাকা সকল অগণতান্ত্রিক, গণবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের লড়াই। রাষ্ট্রের সশস্ত্র শক্তি যদি তখন শেখ হাসিনা সংবিধান ও আইনের দোহাই দিয়ে ব্যবহার করতে না পারেন তখন সেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে তার দল কতোটা টিকে থাকতে পারবে সেটা সন্দেহের বিষয়। ক্ষমতাসীনদের আতংক এখনেই।

একই আতংক বিরোধী রাজনৈতিক দলের মধ্যেও আছে। তবে তার চরিত্র ভিন্ন। তাদের আশংকা আন্দোলনের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে। শেষাবধি বিএনপির অবস্থান কোথায় থাকবে সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত নন। এ কারনে বিএবপির ভেতরে একটি শক্তিশালী অংশ সবসময়ই আন্দোলন সংগ্রামের বিরোধিতা করে আসছে। ভবিষ্যতেও করবে।

শেখ হাসিনা এটা জানেন না বা বোঝেন না তা নয়। দেখা যাচ্ছে আন্দোলনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে দুটো কৌশল তিনি চর্চা করতে চাইছেন। সম্ভবত কৌশলগুলো যতো না দলীয়, তার চেয়ে বেশি তার পরামর্শকদের। প্রথম কৌশলের নাম প্রপাগাণ্ডা। যেহেতু রাষ্ট্র ও রাজনীতির গোড়ার সংকট অনুধাবন করতে তাঁর দল ও সমর্থকরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ, ফলে প্রপাগাণ্ডার মূল জায়গাটা হবে উন্নয়ন। তারা বোঝাতে চাইবেন যে অবিশ্বাস্য দুর্নীতি ও অকথ্য লুটতরাজের পরও তারা দেশের উন্নতি করেছেন। তাদের আমলে কতো কি উন্নয়ন হয়েছে তার ফিরিস্তি তারা প্রচার করবেন। করছেনও। হঠাৎ ঢাকার দিগন্ত ঈদের ছুটির হপ্তাখানেক আগে বিলবোর্ডের সৌন্দর্যে একাকার হয়ে গেল। বিলবোর্ডগুলো ক্ষমতাসীনদের উন্নয়নের ফিরিস্তিতে ভরা। সরকারের যদি উন্নয়নের ক্ষেত্রে সফলতা থাকে তবে তার প্রচার করা মোটেও দোষের কিছু নয়। সেই সফলতার খতিয়ান জানাটাও সকলের শিক্ষণীয় হতে পারে।

কিন্তু প্রপাগাণ্ডা আলাদা জিনিস। সেটা সত্যমিথ্যায় জড়ানো আর তার প্রধান উদ্দেশ্য মূল সমস্যা বা সংকটকে আড়াল করা। বাংলাদেশের এখনকার সমস্যা রাজনৈতিক –উন্নয়নের নীতি কিম্বা তার সফলতা-বিফলতাও রাজনৈতিক সংকটের অধীনেই এখন আলোচ্য বিষয়। কিভাবে সমাজের অর্থনৈতিক বাস্তবতা এখনকার রাজনৈতিক সংকটের পেছনের কারণ সে আলোচনার অবশ্যই দরকার আছে। সেই অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সমাজের শ্রেণি ও শক্তির অবস্থান, সম্পর্ক ও ক্ষমতার ভারসাম্য আমরা অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির বিচার করে বুঝতে পারি। কিন্তু উন্নয়নের প্রপাগাণ্ডা দিয়ে রাজনৈতিক সংকট আড়াল করবার কৌশল সফল হবার সম্ভাবনা কম। ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞান আছে এমন কোন সাক্ষী সরকার পক্ষে খুঁজে পাওয়া কঠিন যারা বোঝে না যে আওয়ামি লিগের জনপ্রিয়তায় ধসের কারণ ক্ষমতাসীনদের উন্নয়নের সফলতা প্রচারে ব্যর্থতা নয়। এর কারন একান্তই রাজনৈতিক। কিন্তু আওয়ামি লিগ এখন যে অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে, তার পক্ষে সংবিধান, রাষ্ট্র ও রাজনীতির সংকট বোঝা অসম্ভবই বটে। তাকে উনয়নের গীতই গাইতে হবে।

অর্থনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে চৌদ্দ দল ও আঠারো দলের মধ্যে কোনই বিরোধ নাই। ‘অবাধ বাজার ব্যবস্থা’ বিএনপির অতি সাধের ঘরোয়া মতাদর্শ। গণমানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থ আর রাজনীতির সঙ্গে বিএনপির মৌলিক বিরোধ এখানে। কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও দিল্লীর আগ্রাসনের বিরোধিতা করতে গিয়ে জনগণ বিএনপির পেছনে এসে দাঁড়ায়। একই ভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তার আত্মপরিচয়কে যেভাবে তার ধর্ম ও জীবনাচার থেকে বিভক্ত করে তার বিরোধিতা করবার দরকারেও জনগণের বৃহৎ একটি অংশ বিএনপি সমর্থন করে। আওয়ামি লিগ ও আওয়ামি ধারার বাম রাজনীতি এই ইস্যুগুলোকে সম্প্রতি কালে আরও তীব্র করে তোলার পরেও বিএনপি একে কোন আদর্শিক পরিণতির দিকে নিতে পারে নি।

বিএনপি ঘোষণা দিয়েই পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার স্থানীয় দালাল বা মুৎসুদ্দি হয়েছে। সেখানে কোন কপটতা নাই। একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে তার উত্থান ও টিকে থাকার এটাই প্রধান মতাদর্শিক কারণ। কিন্তু আওয়ামি লিগ ও তাদের বামপন্থি লেজুড়রা করেন ‘সমাজতন্ত্র’। এটা যে কি গৌরবের সমাজতন্ত্র সেটা বোঝা মুশকিল কারন তারাও এখন এই অবাধ বাজার ব্যবস্থারই ধারক ও বাহক। এই কপট রাজনীতি জনগণ ঠিকই বোঝে। গণমানুষের সঙ্গে আওয়ামি লিগ ও তাদের সমর্থকদের দুষমনি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শুধু নয়। সেটা বিএনপির বিরুদ্ধে যেমন, তাদের বিরুদ্ধেও। উভয়কেই অবাধ বাজার ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্তদের দল বলেই জনগণ চিহ্নিত করে। দুঃশাসনের এই দ্বিপাক্ষিক আয়তক্ষেত্র থেকে গণমানুষ মুক্তি চায়। কিন্তু এখন মূল লড়াই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। এটা সুস্পষ্ট ভাবে বুঝতে হবে।

শেখ হাসিনার দ্বিতীয় কৌশল হচ্ছে ইসলামপন্থি আন্দোলনকে যথারীতি সন্ত্রাসী ও জঙ্গী বলে প্রতিষ্ঠা করা। সেই ক্ষেত্রে ইসলামপন্থিদের দাবি দাওয়া পেশ ও আন্দোলনের ধরণ তাঁকে এই প্রচারে সহায়তা করে। লক্ষ করার বিষয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইসলামপন্থিদের আন্দোলন গণতন্ত্র এবং নাগরিক ও মানবিক অধিকারের দিক থেকেও বিচার করা সম্ভব। এই লড়াইয়ের প্রকাশ ঘটছে দুটো রূপ নিয়ে। সেই দিকগুলো পরিচ্ছন্ন করা যাক।

প্রথমত নাগরিক ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। একজন নাগরিকের রাজনৈতিক বিশ্বাস যাই হোক --- জঙ্গি কি শান্তিবাদী -- তার কিছু নাগরিক ও মানবিক অধিকার রয়েছে। নাগরিক ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই মূলত ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধেই লড়াই। সেই অধিকার আদায়ের লড়াই বিকশিত হতে থাকলে সেটা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা রূপান্তরের লড়াই হিসাবে ক্রমশ হাজির হতে থাকবে। এতে সন্দেহ নাই। সেই দিকেই নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার লড়াই ধাবিত হতে বাধ্য। বিরোধী দলের দিক থেকে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে এটা প্রাথমিক কিন্তু সবচেয়ে কার্যকর জায়গা। কারও নাগরিক ও মানবিক অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোর অর্থ তার মতাদর্শ কিম্বা রাজনৈতিক কৌশল সমর্থন করা নয়। কিন্তু এই সম্পর্ক রচনা মতাদর্শিক পার্থক্য নিরসনের লড়াই-সংগ্রামকে একটা নৈতিক পরিমণ্ডলে উন্নীত করতে পারে। এতে ফল পাবার সম্ভাবনা বেশী।

দ্বিতীয় রূপ হচ্ছে ইসলাম বিদ্বেষ ও ইসলামি আতংকের বিরুদ্ধে গণমানুষের সংগ্রাম। ইসলাম বিদ্বেষ ও ইসলামি আতংকের (Islamophobia) বিরুদ্ধে জনগণের বড় একটি অংশ তাদের লড়াইকে দেখছে ঈমান-আকিদা ও ইসলামি সংস্কৃতি ও পরিচয় রক্ষার লড়াই হিসাবে। আধুনিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসীরা একে রাজনৈতিক ইসলামের দিক থেকে বিপজ্জনক হুমকি হিসাবে দেখছেন। অথচ এর মর্মে রয়েছে তাদের মানবিক মর্যাদার স্বীকৃতি পাবার গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু যারা প্রগতি, আধুনিকতা কিম্বা ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেন বলে দাবি করেন তারা মুসলমানদের ঈমান-আকিদার লড়াইকে সেভাবে বিচার করতে নারাজ। ইসলামপন্থিরাও তাঁদের দাবি দাওয়া নাগরিক অধিকার বা মানবিক মর্যাদার প্রশ্নের জায়গা থেকে হাজির করতে পারেন নি। অনেকে হাজির করতে চানও না। পাশাপাশি এটাও বোঝা দরকার ‘আধুনিকতা’, ‘প্রগতি’ ও ‘ধর্ম নিরপেক্ষতার’ কঠোর পর্যালোচনা ছাড়া বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলা অসম্ভব। বিরোধী রাজনৈতিক ধারাগুলো শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইলে পরস্পরের মধ্যে আদর্শিক ঐক্য গড়ে তুলবার জায়গাগুলোস্পষ্ট করতে হবে। এই বিষয়গুলো উপেক্ষা করলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যের মতো রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের পরিণতি লাভ করতে পারে। সে সম্ভাবনা অস্বীকার করারা উপায় নাই।

দাড়িওয়ালা টুপিওয়ালা বোরখা পরা মানুষ, মাদ্রাসার ছেলেমেয়ে ও আলেম ওলামাদের প্রতি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনুমান, দৃষ্টিভঙ্গী আচরণের মধ্যে মারাত্মক সমস্যা রয়েছে। এর পেছনে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানের অসাম্য যেমন কাজ করে, তেমনি কাজ করে শ্রেণি ঘৃণা। সম্প্রতিকালে আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থিদের ‘দানবীয়’ শক্তি হিসাবে হাজির করা, তাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত গণমাধ্যমে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও হিংসা প্রচার এবং তাদের ওপর দমন পীড়ন জেল জুলুম ও নির্বিচারে হত্যার কারনে প্রশ্ন উঠেছে যে-রাজনীতি ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে এই পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে সেই রাজনীতি ও সংস্কৃতির অধীনে এই দেশের মানুষ নিরাপদ কিনা। আরও গুরুতর প্রশ্ন এই রাজনীতি ও সংস্কৃতির আধিপত্য বজায় রেখে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখা আদৌ সম্ভব কিনা। এই রাজনীতি ও সংস্কৃতি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে এবং দিল্লীর দাসত্ব মেনেই ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছে। মানবাধিকার লংঘন ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার কারণে দিল্লী ছাড়া পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশের সমর্থনও তারা হারিয়েছে। আওয়ামি দুঃশাসন বাংলাদেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এটাই কমবেশী আন্তর্জাতিক অভিমত।

ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে প্রতিপক্ষের। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা দাবি করলেও সেই জীবনে ইহলোকের জায়গা কম। অভিযোগ হচ্ছে ইসলামপন্থিরা মানুষের ইহলৌকিক জীবনের চেয়েও পারলৌকিক জীবনকে অধিক সত্য গণ্য করে; তারা ইসলামের শান্তি ও কল্যাণের কথা বললেও সাম্প্রদায়িক হয়ে যায়। ইসলাম কায়েমের চেয়ে ‘মুসলমান’ পরিচয় প্রধান করে অন্যান্য সম্প্রদায় ও ভিন্ন পরিচয় যারা ধারণ করে তাদের রাজনৈতিক শত্রু গন্য করতে শুরু করে, নারীর প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গী পশ্চাতপদ– ইত্যাদি। অনেক অভিযোগ রয়েছে যার বিরুদ্ধে ইসলামের আদর্শের দিক থেকেও কঠোর সমালোচনা করা সম্ভব। সেই সমালোচনা করবার জন্য নাস্তিক বা ধর্মনিরপেক্ষ হবার দরকার পড়ে না। এই সকল অপরিচ্ছন্ন দিক ছাড়াও ইসলামবিরোধিরা মনে করে ইসলামী রাজনীতির লক্ষ্য একটাই। সেটা হোল দুনিয়ায় শুধু মুসলমানরাই থাকবে আর কেউই থাকবে না, যদি কেউ থাকতে চায় তাহলে মুসলমানদের অধীনস্থতা মেনেই থাকতে হবে। জিজিয়া কর দিয়ে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

বলাবাহুল্য, ইসলামপন্থিরা বলবেন এই অভিযোগগুলো ঠিক নয়। কিন্তু ঠিক কি বেঠিক সেই তর্ক এখানে এখন করব না।। এই ধরণের কোন ধারা বাংলাদেশে যদি থাকে সেটা ইসলামি আন্দোলনের মূল ধারা নয়, এই দাবি করলেও বাংলাদেশের জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ সেটা মেনে নেবে কিনা সন্দেহ। ইসলামি রাজনীতির প্রতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির আতংকের এই দিকটা ইসলামপন্থিদের বুঝতে হবে। এই কঠিন জায়গাগুলো অতিক্র্ম করবার একটাই পথ। সেটা হোল একদিকে যেমন ‘আধুনিকতা’, ‘প্রগতি’, ‘সভ্যতা’ ইত্যাদি ধারণাগুলোর কঠোর পর্যালোচনা, অন্যদিকে একালে ইসলামের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা কি হতে পারে তার বিচার। সেটা ধর্মতাত্ত্বিক কিম্বা সাম্প্রদায়িক জায়গা থেকে হলে হবে না। তাকে বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক বিচার হতে হবে। শুধু বিশেষ সম্প্রদায়ের স্বার্থ কিম্বা ধর্মীয় বিষয় হিসাবে না দেখে সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রচিন্তার দিক থেকেও বিচার করতে শিখতে হবে। বলাবাহুল্য, এই কাজ শুধু ইসলামপন্থিদের নয়, যারা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান তাদেরও।

যদি আন্দোলন ছাড়া বিকল্প না থাকে তাহলে আন্দোলনকে ফলপ্রসূ করতে মতাদর্শিক তর্কবিতর্কের কোন বিকল্প থাকতে পারে না। শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক কৌশলের বিরুদ্ধে দুটি পদক্ষেপ বিরোধী দলগুলো অবিলম্বে গ্রহণ না করলে রাজনীতি দ্রূত ঘোলা হতে থাকবে। একটি পথ হচ্ছে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটছে এই প্রপাগান্ডার উপযুক্ত জবাব দেওয়া, দ্বিতীয় পথ হচ্ছে যে কোন মূল্যে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই দুটি দিকে তীক্ষ্ণ নজরদারি রেখে বাংলাদেশে ইসলাম প্রশ্ন আন্তরিক ভাবে বিচার করবার প্রয়োজন আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি তীব্র হয়েছে। বাংলাদেশ আসন্ন ঝড় মোকাবিলা করতে পারবে কিনা জানি না, কিন্তু চেষ্টা করতে হবে। (অসমাপ্ত)

 

২২ আগাস্ট ২০১৩। ৭ ভাদ্র ১৪২০। শ্যামলী।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।