"অরক্ষিত" বাংলাদেশ


আমি যখন এই লেখা লিখতে বসেছি তখন বাংলাদেশে নতুন সেনাপ্রধান তার দায়িত্ব বুঝে নেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যার যাবার তিনি যাবার জন্য দেখাসাক্ষাৎ করছেন, বিদায় নিচ্ছেন। এই সময় বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করবার জন্য এই লেখা। আমি প্রকাশিত খবরাখবর থেকে নজির টেনে আমার কথা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করব। কিছু প্রশ্ন তুলেই ক্ষান্ত থাকব। যে বিষয় নিয়ে আলোচনা বিস্তৃত ভাবে করা দরকার, কিন্তু আমি এখানে বিশেষ আলোচনা করার সুযোগ পাব না, সেটা হচ্ছে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার "বিষয়"সম্পর্কে। অর্থাৎ কার বা কিসের নিরাপত্তা বা প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করব আমরা? তবে এই কালে, বিশেষত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের এই যুগে এবং বিজ্ঞান ও টেকনলজিই সব কিছুর সমাধান দিতে পারে এই ধরনের উৎকট মূর্খতা ও চরম অজ্ঞতার কালপর্বে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কে জ্ঞানীগুণীরা নিদেন পক্ষে দুটো সাধারণ বিষয়ের দিকে আমাদের সবার আগে নজর দিতে বলেছেন, সেই দুটো বিষয় উল্লেখ করে অন্য প্রসঙ্গে যাব।

একঃ নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার প্রথম কাজ হচ্ছে প্রাণ, প্রাণের পরিবেশ ও প্রাণ রক্ষার শর্তের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা যে কোন মূল্যে নিশ্চিত করা।
সাধারণ ভাবে যদি আমরা আমাদের জীবন ও জীবিকাই নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে কিভাবে জনগোষ্ঠী হিশাবেই আমরা টিকে থাকব? ভূখণ্ড আমাদের হাতে থাকতে পারে বা আমাদের সৈনিকেরা প্রাণ দিয়ে শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশের ভূখণ্ড রক্ষা করতে ঠিকই সক্ষম। কিন্তু সেটা বেকার হবে যদি প্রাণবৈচিত্র্যে ধনি বাংলাদেশের বীজ চলে যায় বহুজাতিক কম্পানির হাতে, কৃষকের বীজব্যবস্থা ধ্বংস হয়। যদি সার ও কীটনাশক নির্ভর কৃষি দিয়ে মাটির উর্বরতা আমরা ধ্বংস করি। কিংবা ফলন বাড়াবার ভুয়া ও মিথ্যা প্রতারণা করে বাংলাদেশকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরীক্ষাগারে পরিণত করা হয়। যে সরকার এই ধরনের নীতি গ্রহণ করে বুঝতে হবে সেই সরকার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য হুমকি। খাদ্য এবং পানি আমরা ধ্বংস করে দিয়েছি। পরিবেশ এমন অবস্থায় নিয়ে গিয়েছি যাতে প্রাণে বেঁচে থাকাই ক্রমশ দায় হয়ে উঠেছে। অথচ আমাদের হুশ নাই। এই পরিস্থিতি নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার প্রাথমিক বিষয় হয়ে উঠেছে এখন। ভূখণ্ড রক্ষার সঙ্গে যুক্ত হবে আমাদের কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থা ও পানি সম্পদ রক্ষা করে প্রাণ সংরক্ষণে সক্ষম ও পরিবেশসম্মত খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা ও মিষ্টি পানির ওপর নিজেদের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখা। এটা নাগরিকদের যেমন কর্তব্য, প্রতিটি সৈনিকের ক্ষেত্রে সেটা কর্তব্য শুধু নয়, দায়িত্বও বটে।

দুইঃ প্রতিটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠিরই কিছু সার্বজনীন বিশ্বাস, নীতি বা মানবেতিহাসে অবদান রাখতে সক্ষম চিন্তা, ভাব বা আদর্শ থাকে। নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার প্রধান বিষয় হচ্ছে তার সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
সংক্ষেপে অনেকে একে "মূল্যবোধ" (core values) বলে থাকেন। কোন জনগোষ্ঠি শুধু খেয়ে দেয়ে জীবের জীবন জন্তুর মতো পালন করে "মানুষ" হতে পারে না। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হয়ে ওঠা তো দূরের কথা। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সংবিধান সভায় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই "মূল্যবোধ" জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের অভিব্যক্তি হিশাবে দানা বাঁধে এবং তাকে ধারণ করে রাষ্ট্রের "গঠনতন্ত্র" (constitution)। রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র কোন ব্যক্তির, কোন দলের কিম্বা কোন স্বনামধন্য উকিলের অন্য দেশের "সংবিধান" নকল করে লেখা মুসাবিদা নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য আমরা সেই ধরনের গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করতে পারি নি। নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার দিক থেকে সেই ধরনের সংবিধান রক্ষা বা তার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা প্রাথমিক কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়। রাষ্ট্রের পরিচালনা এবং নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এই কারণেই রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র রক্ষার শপথ নিতে হয়।
গণতান্ত্রিক ইচ্ছা ও সংকল্পকে কোন মূর্ত নির্দিষ্ট গঠনতন্ত্রে রূপ দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এর ফলে জনগোষ্ঠি হিশাবে আমরা বিভক্ত। হানাহানি, মারামারি ও আভ্যন্তরীণ সহিংস ভেদাভেদের কারণে বাংলাদেশের ক্ষয় আমরা সে কারণে রোধ করতে পারছি না। আমরা কেউ মুসলমান, কেউ বাঙালি, কেউ আদিবাসী, কেউ সংখ্যালঘু, কেউ আবার ভিসা পেলে এই মুহূর্তেই অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিতে রাজি। কেউ গোপনে বা প্রকাশ্যে বাংলাদেশ ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য হয়ে যাক চায়, কেউ চায় বরং আবার পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হয়েই থাকুক বাংলাদেশ, তবে তাদের সংখ্যাই বেশি যারা চায় বাংলাদেশ ইউরোপ বা আমেরিকার হাতে তুলে দিয়ে নিজেরা ভোগী বিশ্বব্যবস্থার উচ্ছিষ্ট ভোগ করে জীবন কাটিয়ে দিতে। এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা নিয়ে আলোচনা পরিহার ছাড়া আর কী হতে পারে? কিন্তু নিদেন পক্ষে জীবের জীবন রক্ষার দিক থেকে হলেও নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। ধরে নিচ্ছি, আগামি দিনে বাংলাদেশের জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সংবলিত গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করতে সক্ষম হবে। এই আশা অন্যায় নয়, কিন্তু ততদিন "বাংলাদেশ" নামে যা আছে তাকে তো অন্তত আমাদের রক্ষা করতে হবে।

দুই

জুন মাসের ১০ তারিখে অল হেডলাইন নিউজের (AHN) খবর হচ্ছে মার্কিন সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এড স্মিথ (অব) বাংলাদেশ সরকার, সেনাবাহিনী এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের নেতানেত্রীদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য ঢাকা সফর করছেন। তিনি এশিয়া স্পেসিফিক সেন্টার পর সিকিউরিটি স্টাডিজ (APCSS)-এর ডিরেক্টর। ঢাকা থেকে মার্কিন দূতাবাসের দেওয়া একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে হাওয়াই ও সারা এশিয়া-পেসিফিক অঞ্চলে এপিসিএসএস আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ক্ষেত্রে যে সকল সুনির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম ও কর্মসূচির আয়োজন করে সেখানে সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানায়।
সাধারণ ভাবে এপিসিএসএস-এর মনোযোগ আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত ইস্যু ও সেই সব ক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়ানোর ওপর। এর অর্থ কি? খবরটির মধ্যে মার্কিন দূতাবাসের প্রেস বিজ্ঞপ্তির একটি উদ্ধৃতি এপিসিএসএস-এর উদ্দেশ্য বিশদ করে তুলেছে। 'It also helps develop professional and personal ties among national security establishments through the region'. এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের জাতীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে জড়িত সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের সঙ্গে ব্যক্তিগত ও পেশাদারি সম্পর্ক গড়ে তোলাই এপিসিএসএস-এর উদ্দেশ্য। সোজা কথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষার জন্য এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর সেইসব সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের সঙ্গে ব্যক্তিগত ও পেশাদারি সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। সেই দেশের জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। আরো সোজা ভাবে বললে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা স্বার্থ নিশ্চিত করবার জন্য এই সব দেশের জাতীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্ত সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের মধ্য থেকে স্থানীয় এজেন্ট তৈরি করা। গোয়েন্দাগিরি, প্রপাগান্ডা বিশারদ, নীতিনির্ধারক মহলে প্রভাব বিস্তারকারী, সামরিক বাহিনীর ওপর খবরদারি ও মার্কিন স্বার্থের পক্ষে গবেষণা ও প্রচার ইত্যাদি সবই এপিসিএসএস-এর "ব্যক্তিগত" ও "পেশাদারি" সম্পর্ক তৈরির মধ্যে পড়ে।

বাংলাদেশের "প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এড স্মিথের দেখা করার কথা। তিনি বাংলাদেশের "থিংকট্যাংক" গুলোর সঙ্গেও কথা বলবেন। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট তার জন্য একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করবে এবং সেখানে তিনি অতিথি বক্তা থাকবেন। (দেখুন, http://www.allheadlinenews.com/articles/701545199)।

এপিসিএসএস যে শুধু এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে কাজ করে তা নয়, অনেকের সঙ্গেই করে। উদাহরণ হিশাবে Bangladesh Institute for International & Strategic Studies (BIISS)--এর উল্লেখ করা যেতে পারে। ১১ জানুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সমূলে বিনষ্ট করবার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তার পরপরই ১ থেকে ১৬ আগস্টে এপিসিএসএস এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে একটি কর্মশালা করে। লক্ষ্য হচ্ছে এগারোই জানুয়ারির পর কিভাবে বাংলাদেশের "শাসন ব্যবস্থার সংস্কার" (reforming governance in Bangladesh) করা যায় সেই বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিসহ, রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, নীতিনির্ধারক, গবেষক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার সঙ্গে যুক্ত সামরিক ব্যক্তিদের সঙ্গে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক শক্তিশালী করা যায়। "শক্তিশালী" করার মানে হচ্ছে একদিকে সুনির্দিষ্ট ভাবে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ নির্মূল করার প্রক্রিয়া বা তথাকথিত "মাইনাস টু" থিওরি কার্যকর করা এবং সাধারণ ভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে সেখানে কতিপয় উচ্চাভিলাষী সামরিক অফিসার, বহুজাতিক কোম্পানি ও সুশীল সমাজের একচ্ছত্র "শাসন" কায়েম। বাংলাদেশকে কিভাবে "শাসন" করা যায় সেটাই ছিল এই কর্মশালার সমস্যা, বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্প ধারণ করে কিভাবে এই রাষ্ট্রটিকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তর করা যায় এই ধরনের সামরিক ও অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার উদ্দেশ্য কখনোই সেটা ছিল না, হতেও পারে না। সেই কর্মশালার একটি প্রতিবেদন ইন্টারনেটেও পাওয়া যায়। উদ্যোক্তারা এপিসিএসএস-এর কর্মশালা প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। 'this workshop provided a forum where systematically and through meticulously controlled discussions thought-provoking ideas were generated which led to concrete proposal[s] on the theme of the workshop.'
কংক্রিট কী প্রস্তাব বেরিয়ে এসেছে তার উল্লেখ না থাকলেও সেই প্রতিবেদন থেকে কর্মশালার কী ফল পাওয়া গিয়েছে সেই সম্পর্কে উদ্যোক্তারা নিজেরা কিভাবে ব্যাখ্যা করছেন তা পাঠকদের বোঝাবার জন্য আমি একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
'This forum provided an opportunity to all the representatives of the security organizations and force [them] to sit [at the] table [and] look into their weaknesses in light of the present political situation of Bangladesh. Ideas streaming from all the actors of security sector; i.e., defense forces, police, paramilitary, etc. and Inteligensia, lawyers, business personality, civil society, etc. were cross examined, problems identified and recommendations made. This increased understanding and improved dialogue between parties will help harmonize views and improve chances for reformation in ' (দেখুনঃ www.apcss.org/core/Conference/CR_ES/Bangladesh% 20Exec%20Sum%20Aug%2007.doc

তিন
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে যদি কোন সারগর্ভ আলোচনা আমরা করতে চাই তাহলে যে নজিরগুলো দিয়েছি তার মধ্য দিয়ে যে বাস্তব পরিস্থিতি ব্যক্ত হচ্ছে সেই বাস্তবতাকে মনে রেখেই কথা বলতে হবে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই তাদের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার স্বার্থে বাংলাদেশে গোয়েন্দা চক্র বা তাদের স্থানীয় এজেন্ট গড়ে তুলেছে এমন নয়। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব, তেল ও অন্যান্য জ্বালানি সম্পদের প্রাচুর্য, খনিজ সম্পদ, বায়োটেকনলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য একদিকে বিনা পয়সায় "কাঁচামাল" সংগ্রহ ও অন্যদিকে অবাধ গবেষণার ক্ষেত্র গড়ে তোলার জায়গা, বিভিন্ন রকমের ওষুধ, জন্মনিরোধক ও ডাক্তারি পরীক্ষা- নিরীক্ষার জন্য গিনিপিগের চেয়েও কম দামে সরাসরি মানুষ ব্যবহার করবার সুযোগ, মোবাইল কম্পানি, কসমেটিক কম্পানিসহ বিভিন্ন বহুজাতিক কম্পানির বিশাল বাজারের উপস্থিতি, গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপন ও তা নিজেদের কব্জায় রাখার সুযোগ, ইত্যাদি নানা কারণে বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর জন্য লোভনীয় ক্ষেত্র। এটাও মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ বিদেশি পণ্যের একটি বিশাল বাজার। এর একটা কারণ হচ্ছে সস্তা শ্রমশক্তির বিশাল একটি অংশ নিজের ঘাম ও রক্ত ঢেলে বিদেশে পরিশ্রম করে এবং সেই ঘাম ও রক্ত মেশা অর্থ দেশে পাঠায়। এটাও বাংলাদেশের জন্য কাল হয়েছে। বহুজাতিক কম্পানি- বিশেষত মোবাইল কম্পানিগুলো অতি অনায়াসেই রক্তে-ঘামে শ্রমিকদের এই আয়ের টাকা কোন উৎপাদনশীল বা দরকারি কথার বিনিময়ে নয়, শুধু ফালতু কথা বলা বেচাবিক্রি করে আমাদের বৈদেশিক আয়ের টাকা ফতুর করে দিচ্ছে। খেয়াল করতে হবে যে সকল টেলিভিশন বা সংবাদপত্র বাংলাদেশে টিকে আছে তার প্রায় সবই আবার টিকে আছে প্রধানত মোবাইল কম্পানির বিজ্ঞাপনে। সম্প্রতি আমার দেশ গ্রামীণ ফোনের অর্থ পাচারের কাহিনী প্রকাশ করে আমাদের ধন্যবাদের পাত্র হয়েছে। কোন গণমাধ্যমই এই ভয়াবহ ডাকাতি সম্পর্কে এক ফোঁটা উচ্চবাচ্য করেনি। অর্থ পাচার করবার এই অপরিমিত সুবিধা বাংলাদেশকে পরাধীন করে রাখার পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে। আমাদের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রশ্নগুলোর মধ্যে এই বৃহৎ ফাঁকিগুলোকে চিহ্নিত করে তুলতে হবে ও মীমাংসা করতে হবে। লোভ চরিতার্থ করবার সুযোগ বাংলাদেশে অবারিত।

সোজা কথায় বাংলাদেশ অরক্ষিত। "অরক্ষিত" কথাটা যদি আমরা শুধু সামরিক অর্থে বুঝি তাহলে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে আমাদের এখনকার কর্তব্য সম্পর্কে কিছুই আমরা বুঝবো না। অতএব ওপরে আমরা যে নজিরগুলো দিয়ে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার প্রশ্ন আলোচনা করছি সেই দিকে আমাদের মনোযোগ আরো গভীর ও নিবিষ্ট হতে হবে। যদি শুধু সামরিক অর্থেই বুঝি তাহলে প্রশ্ন করতে হবে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো বাংলাদেশকে অরক্ষিত অবস্থায় টিকে থাকতে দিচ্ছে কেন? এর অতি প্রাথমিক ও সহজ উত্তর হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য বা হস্তক্ষেপ সামরিক হবে তার কোন কথা নাই। যতক্ষণ এই দেশের জনগণ মনে করে তারা এখনো স্বাধীন, তারা একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে কিছুটা হলেও "সার্বভৌমত্ব" ভোগ করে সেই বিভ্রান্তির সুযোগে যদি বাংলাদেশে অবাধ লুণ্ঠন, সেই লুণ্ঠনের অর্থ পাচার এবং রাজনৈতিক ভাবে এই দেশকে পঙ্গু করে রাখা যায় তাহলে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের কী দরকার? যেখানে প্রকাশ্যেই স্থানীয় দূতাবাস প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েই কার্যত ঘোষণা দেয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের মধ্য থেকে মার্কিন স্বার্থ রক্ষার পক্ষে কাজ করবে এই ধরনের ব্যক্তিদের খুঁজছে, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিভাগের সঙ্গে "ব্যক্তিগত" ও "পেশাদার" সম্পর্কে যুক্ত হয়ে মার্কিন স্বার্থের এজেন্ট হয়ে কাজ করবে, কিংবা বাংলাদেশের স্থানীয় থিংকট্যাংকগুলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর্থিক ও নৈতিক সহায়তা দেবে যাতে তারা নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে গবেষণা করতে ও প্রচার প্রপাগান্ডা চালাতে পারে -- ততক্ষণ সেই দেশে আবার বাড়তি ঝুট-ঝামেলা বাধিয়ে আর কী লাভ? এর চেয়ে অধিক একটি দেশকে আর কতোটা পরাধীন করা যেতে পারে। পরাধীন রাখবার এই ব্যবস্থায় খরচ অত্যন্ত কম, ঝুঁকি নাই বললেই চলে এবং ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে কোন সশস্ত্র যুদ্ধও মোকাবিলা করতে হচ্ছে না।

সামরিক অর্থে বাংলাদেশ "অরক্ষিত" কথাটা নতুন নয়। বিডিআর বিদ্রোহ ও পরবর্তীতে দোষীদের শনাক্ত করাকে মুখ্য কাজ জ্ঞান না করে বিডিআর জওয়ানদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে হত্যা করা হয়েছে যার ফলে সাক্ষী ও তথ্য গোপন করবার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে দোষীদের শনাক্তকরণ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে তার ফলে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে বিশাল একটি ক্ষত তৈরি হবে। বিডিআর বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যে রক্তাক্ত অধ্যায়ের সূচনা ঘটল সেই ক্ষত শুকাবে কিনা সন্দেহ, বরং বাড়বে। মূলত বিডিআরের ঘটনা ও তার পরের ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে মূলত এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়েছে। বিডিআর ও সেনাবাহিনী উভয়েরই বিনাশ নিশ্চিত করা হয়েছে এবং সামরিক দিক থেকে সেনাবাহিনী বা বিডিআর আদৌ আমাদের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে কোন ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারবে কিনা সেটা তুমুল আশঙ্কায় পরিণত হয়েছে।
বিডিআরের পোশাক ও নাম পরিবর্তনের জন্য আগ্রহ এবং ঘটনার মূল নায়কদের রক্ষা করার জন্য তদন্তের নামে বিভিন্ন ধরনের স্ববিরোধী রিপোর্ট প্রকাশ সেই ক্ষতের ওপর নুনের ছিটার মতো হয়েছে। সর্বোপরি আমাদের সীমান্ত রক্ষার জন্য ভারত যে আমাদের নতুন ভাবে বিডিআর পুনর্গঠনের প্রস্তাব দিতে পেরেছে সেটা বাংলাদেশের গালে জুতা দিয়ে চড় দেওয়া ছাড়া অন্য কোন অর্থ বহন করে না। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে আমরা শুধু অরক্ষিতই নই, দেশকে যেখানে আমরা নিয়ে গিয়েছি তাতে যে কেউই আমাদের লাথি-গুঁতা-থাপ্পড় দিতে পারে। আমাদের সীমান্ত অন্য রাষ্ট্রের অধীন এবং সীমান্ত রক্ষা করবার নৈতিক বল, প্রতিষ্ঠান ও শক্তি সবই আমরা হারিয়েছি। বাংলাদেশের সীমান্ত অরক্ষিত।

সামরিক নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার এই দুর্দশা যে শুধু বিডিআরের ঘটনার কারণেই ঘটেছে মোটেও তা নয়, মূলত সংবিধান ও জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার পরিবর্তে সেনাবাহিনীকে যখন অর্থের বিনিময়ে আন্তর্জাতিক শান্তি মিশনে পাঠানো শুরু হয়েছে তার মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর "বি-জাতীয়করণ" (denationalisation) প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সাংগঠনিক ভাবে বিডিআর ও সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন এমন কোন কঠিন কাজ নয়, যাঁরা পেশাদার সৈনিক তাঁরা এটা খুব ভালো করেই জানেন। কিন্তু বিরাজনীতিকরণের চেতনা, নিজ দেশের স্বার্থ ত্যাগ করে অন্য দেশের স্বার্থের প্রতি আনুগত্য ও অরাজনৈতিক ভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় ভূমিকা গ্রহণের সুযোগ ও তাকে ব্যক্তিগত অভিলাষ চরিতার্থ করবার কাজে লাগানো" এই সকল আপদকে তো নিছক সেনাবাহিনী নতুন করে পুনর্গঠন করে মোকাবিলা করা যাবে না। অন্যদিকে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বে থাকা সাবেক কর্মকর্তাদের গ্রেফতার এবং বাচ্চা ধোবার নাম করে বাচ্চাসহ গামলার পানি আবর্জনায় ফেলে দিয়ে দেবার ঘটনাকে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার দিক থেকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কে আমাদের রাজনৈতিক অস্বচ্ছতার জন্য নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য জরুরী প্রতিটি সামরিক প্রতিষ্ঠানই আজ ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছে।

বিএনপির বিরুদ্ধে জনগণ রায় দিয়েছে। কারচুপি বা ভোট ইঞ্জিনিয়ারিং হোক বা না হোক, বিএনপি সেটা মেনে নিয়েছে। বিএনপির পররাষ্ট্র নীতি অবশ্যই বর্তমান সরকার বদলাতে পারে, এবং অনেক ক্ষেত্রে বদলানো উচিত। গোয়েন্দা বিভাগ দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে অনেক কিছু করেছে এবং অনেক কিছু করে থাকতে পারে যা সাধারণ মানুষের জানার কথা নয়। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জায়গায় দাঁড়িয়ে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের দক্ষতা বাড়ানোর পরিবর্তে এই সংস্থাগুলোকে রাজনীতির ভাঙা গড়ার খেলায় ব্যবহৃত হয়েছে। দলীয় স্বার্থে রাজনীতি বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তাদের ক্রমাগত ব্যবহার এবং সেই ব্যবহারে তাদের উৎসাহ সামগ্রিক ভাবে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে সেই অবস্থা থেকে পার পাওয়া সহজ নয়। এখনও দেখছি ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় এসে আগের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার জন্য হুঁশ হারিয়ে ফেলেছে। তারা আন্তর্জাতিক ভাবে এই সত্যই প্রমাণ করতে ব্যস্ত যে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আন্তর্জাতিক অস্ত্র চালানির সঙ্গে যুক্ত। সেটা ঠিক বা বেঠিক সেটা আমাদের তর্কের বিষয় নয়। আমরা দেখছি, বিশাল বাহাদুরি প্রদর্শন করবার জন্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে প্রকাশ্য আদালতে সেই সাবেক উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের হাতে হাতকড়ি পরিয়ে সাধারণ "ক্রিমিনাল" হিশাবে হাজির করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের নিজেদের নাগরিকদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার বিরোধী ভয়াবহ নির্যাতনমূলক ভূমিকা রেখে জনগণের সমর্থন যেমন হারিয়েছে, আজ অস্ত্র মামলার আসামি হয়ে আন্তর্জাতিক ভাবে খোদ বাংলাদেশ সরকারই তাদের এখন "ক্রিমিনাল" হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করে মহা আমোদ উপভোগ করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য রাষ্ট্রের আদৌ কি তথ্যসংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও নীতিনির্ধারকদের কাছে সময়মতো জানানোর জন্য কোন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নাই? সেটা শোষক ও শাসকদের রাষ্ট্রই হোক, কিম্বা হোক জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র?

চার

ওপরে যে আলোচনা করেছি তার মূল অভিমুখ হচ্ছে এই যে জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা মর্ম অনুধাবন করতে হলে সুনির্দিষ্ট ভাবে "সীমান্ত অরক্ষিত" এবং সামগ্রিক ভাবে "বাংলাদেশ অরক্ষিত" --এই দুইয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য খেয়াল করতে হবে। শুরুতেই বলেছি, আমাদের প্রাণরক্ষাই এখন কঠিন হয়ে উঠেছে। কোন গণতান্ত্রিক "মূল্যবোধ" আমাদের নাই যার মধ্য দিয়ে আমরা একটি একক রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে নিজেদের দাবি করতে পারি।

সীমান্ত অরক্ষিত বলে ভারত বাংলাদেশের সীমান্তে ঢুকে যাবে ব্যাপারটা এতো সহজও নয়। এর ফলে আন্তর্জাতিক শক্তি দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হবে, নিঃসন্দেহে। তাছাড়া সীমান্তে বাংলাদেশের জনগণ শুধু এই আগ্রাসন অবলোকন করে যাবে সেটা ভাবাও ঠিক নয়। জনগণের দিক থেকে কোন না কোন প্রতিরোধের সম্মুখীন ভারতকে হতেই হবে। সেই প্রতিরোধের শক্তির মাত্রা ও চরিত্র কেমন হবে সেটা আগাম বলা সম্ভব নয়। ভারতের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরাও নিশ্চয়ই এই দিকটি ভেবেছেন।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার প্রশ্ন নিয়ে যদি আমরা গণমানুষের দিক থেকে কার্যকর আলোচনা করতে চাই তাহলে "বাংলাদেশ অরক্ষিত" কথাটাকে আরো ব্যাপক ও সামগ্রিক ভাবে বোঝানোর জন্য আমরা এতো কথা তুলছি। জনগণের দিক থেকে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ধারণাকে এমন ভাবে হাজির করতে হবে যাতে জনগণ দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্যেই এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারে। দ্বিতীয়ত, সমরসর্বস্ব বা যুদ্ধকেন্দ্রিক ধারণা থেকে খসিয়ে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার প্রশ্নকে আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, তথ্য ব্যবস্থাপনা এবং বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশল পর্যালোচনা ও বিচার করবার ক্ষমতার দিক থেকে ভাবতে শিখতে হবে। যদি আমরা তা চাই তাহলে আমাদের তৃতীয় কর্তব্য হচ্ছে অস্থির বিশ্বে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার সম্ভাব্য হুমকিগুলো শনাক্ত করার প্রয়োজনে দরকারি সামাজিক-বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির বিকাশ। সেই দিকে এখনই, অবিলম্বে, গভীর ভাবে মনোযোগ দিতে হবে।

সর্বোপরি নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার "বিষয়"গুলো আসলে কী? আসলেই। কিসের নিরাপত্তা বা কিসের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করব? এই প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর ছাড়া যদি বিমূর্ত ভাবে বলি, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা আর নিরাপত্তা চাই আমরা। তাহলে সেটা ফাঁকা বুলি ছাড়া অধিক কিছুই হবে না। এর কোন অর্থই দাঁড়ায় না। সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে হবে কী চাই? কিভাবে চাই? কী চাইলে সেটা বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার "বিষয়" হয়ে উঠতে পারে? সুনির্দিষ্ট ভাবে এই সময়ে এই অসম বিশ্বে কী চাইলে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয় আমরা নির্ধারণ করতে সক্ষম হবো? যে বিষয়ে দুটো পয়েন্ট আমরা শুরুতে আলোচনা করেছি। সোজা কথায় প্রচলিত অর্থে জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কে আমাদের যে সকল প্রাচীন, পশ্চাদপদ, অকেজো ও ফালতু চিন্তা-ভাবনাগুলো আছে সেই সব ঝেড়েপুছে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুনভাবে ভাববার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

খেয়াল রাখতে হবে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ধারণার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সামরিকতা, সৈনিকতা এবং উভয়ের বিকাশ ও কার্যকর প্রয়োগের জন্য সাংগঠনিক প্রশিক্ষণ, শক্তিবৃদ্ধি ও কঠোর শৃঙ্খলার প্রয়োজনীয়তা। এটা ফলাও করে প্রচার অনাবশ্যক। কিংবা এটা এতোই বিশদ যে একে আলাদা করে উল্লেখের প্রয়োজন পড়ে না। অতএব আমরা যখন বলি নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ধারণাকে সমরসর্বস্ব বা যুদ্ধকেন্দ্রিক ধারণা থেকে খসিয়ে আনতে হবে, তার মানে এই নয় যে, সৈনিকের মর্যাদা বা তার পেশাদারি ভূমিকা কিংবা সৈনিকতার সাংগঠনিক শক্তি ও সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর গুরুত্বকে আমরা খাটো করছি। কিন্তু নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার সামগ্রিক ধারণা থেকে যদি সামরিকতাকে আমরা প্রধান করে তুলি তাহলে বিদেশি স্বার্থে ভাড়া খাটবার জন্য সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া ছাড়া বাংলাদেশ আর কিছুই হয়ে উঠতে পারবে না। নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার জন্য গণমানুষকে অবশ্যই সম্পৃক্ত করতে হবে। বাংলাদেশে এর কোন বিকল্প নেই। নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ধারণাকে গণনিরাপত্তা ও গণপ্রতিরক্ষার জায়গা থেকে আমাদের অবিলম্বে অনুধাবন করতে হবে।

ওপরের আলোচনা থেকেও এটা স্পষ্ট হওয়া উচিত যে গণনিরাপত্তা বা গণপ্রতিরক্ষার ধারণা শুধু বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা বা সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করবার জন্য নাগরিকদের সামরিক প্রস্তুতি নিশ্চিত করে মেটানো যাবে না। বরং সাম্রাজ্যবাদ, আগ্রাসন ও জীবন ও জীবিকার ভয়াবহ হুমকির মুখে একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি নিছকই জীব হিশাবে প্রাণে এবং "মানুষ" হিশাবে তার মূল্যবোধ নিয়ে কিভাবে অসম বিশ্বে টিকে থাকতে পারে তার মামলা।


(সুত্র, নয়া দিগন্ত, ১৬/০৬/২০০৯)


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।