রাজনীতির বিকল্প নাই


বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান বাতিল !

আবার ইংরেজি দুই হাজার তেরো সালের ১৬ ডিসেম্বর আসছে। সামনে বিজয় দিবস। যে ‘বিজয়’ একাত্তরে আমরা অর্জন করেছি তার তাৎপর্য যদি আমরা উপলব্ধি করি তাহলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি যাই হোক এই দিনটি ঠিক ভাবে উদযাপন করা দরকার। সেটা সম্ভব হবে কিনা তার আশংকা দেখা দিয়েছে। একটি নিউজপোর্টালের খবরে দেখেছি চলতি বছরের বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ বাতিল করা হয়েছে। অথচ এই দিনটি জনগণের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক রচনার দিন – মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর ভুমিকা স্মরণ করা ও সৈনিকতার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য দিনটি গুরুত্বপূর্ণ। খবর অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এই অনুষ্ঠান বাতিল করারা ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানের স্বাক্ষরে ওই চিঠিতে বলা হয়, দশম জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সব বাহিনী নিয়োজিত থাকবে। তাই চলতি বছর বিজয় দিবসের প্যারেড অনুষ্ঠিত হবে না। প্রধানমন্ত্রীও বিষয়টিতে সম্মতি দিয়েছেন।বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খবরটি ভাল লাগে নি।

এটা সত্যি, সমাজ রাজনৈতিক ভাবে দুই পক্ষে ভাগ হয়ে গিয়েছে। নিজে ক্ষমতায় রেখে এক তরফা নির্বাচনে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। এই পরিস্থিতিতে কোন এক পক্ষ বলপ্রয়োগের ক্ষমতার দিক থেকে দুর্বল না হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক সংলাপ বা সমঝোতা অসম্ভব। এটাই রাজনৈতিক বাস্তবতা। রাজনীতিতে সংলাপ নানা কারনে বন্ধ হতে পারে, সমঝোতার পথ রুদ্ধ হওয়া রাজনীতিতে অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের গোড়া রাজনৈতিক সংলাপ বন্ধ হওয়া নয় – বরং সামাজিক সংলাপ ও বুদ্ধিবৃত্তিক তর্ক বিতর্কের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়া। বাংলাদেশে আমরা রুদ্ধ বিচারবুদ্ধির অসুখে পড়েছি।

সামাজিক সংলাপই রাজনৈতিক সংলাপের পরিবেশ ও শর্ত তৈরী করে। অথচ সামাজিক সংলাপ অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সমাজে অনেকগুলো গুরুত্ব বিষয় নিয়েই তর্কবিতর্ক চলছিল। কিন্তু একসময় সেইসবও বন্ধ হয়ে গেল। এটা রাজনৈতিক দলগুলো বন্ধ করে নি, করেছে একশ্রেণির দলবাজ বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যম। তর্কবিতর্ক দূরে থাক বিরোধী পক্ষের কথা বলে এমন পত্রিকা ও গণমাধ্যমের ওপর হামলা হয়েছে, দৈনিক আমার দেশ বন্ধ। মাহমুদুর রহমান এখনও কারাগারে। দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি ও চ্যানেল ওয়ান অন্যায় ভাবে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এমনকি মানবাধিকার কর্মীদের জেল জুলুম হয়রানি সহ্য করতে হয়েছে। আদিলুর রহমান খানকে কোন অভিযোগ ছাড়াই বাসার সামনে থেকে ধরে নিয়ে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জামিন না দিয়ে জেলে দীর্ঘদিন রেখে দেওয়া হয় তাকে। ছাড়া পান অনেক পরে।

এ লেখা যখন লিখছি তখন সারা দুনিয়ার মানবাধিকার কর্মীরা অধিকারের ডিরেক্টার নাসিরুদ্দিন এলানের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে যোগাযোগ করছেন। তাদের প্রশ্ন, তিনি জামিন পেয়েছেন, কিন্তু এখনও কারাগার থেকে ছাড়া পাচ্ছেন না কেন? আদালত নাসিরুদ্দিন এলানের জামিন মঞ্জুর করেছে নভেম্বরের ২৪ তারিখে। কিন্তু তিরিশ তারিখ অবধি তিনি কারাগারে। অধিকারের ওয়েবসাইটে গিয়ে জানলাম, ডেপুটি জেলার আমানুল্লাহ জানিয়েছেন সরকারের নির্দেশেই নাসিরুদ্দিনকে ছাড়া যাচ্ছে না। কারন হচ্ছে, এটর্নি জেনারেলের অফিস ‘সুনির্দিষ্ট ভাবে’ নির্দেশ পাঠিয়েছেন নাসিরুদ্দিন এলানকে যেন এখনি ছাড়া না হয়। নাসিরুদ্দিনের পক্ষে আদালতে লড়ছেন রুহুল আমিন ভুঁইয়া। বলাবাহুল্য তিনি তাঁর মক্কেলকে কেন ছাড়া হচ্ছে না জানতে ডেপুটি জেলারকে ফোন করেছেন। ডেপুটি জেলার জানিয়েছেন, এটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে নির্দেশ না পেলে তাঁরা কিছুই করতে পারবেন না। এটা সুস্পষ্ট ভাবে মানবাধিকার লংঘন। তার প্রতিবাদ চলছে এবং চলবে। আদালতের রায় বলবৎ করবার ক্ষমতা বিচারবিভাগের নাই। এটর্নি জেনারেলের ক্ষমতা বাংলাদেশের সংবিধান, আইন ও আদালতের উর্ধে এটাই প্রমাণিত হয়েছে। এটর্নি জেনারেলের অফিস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারাগার কর্তৃপক্ষ দেখা যাচ্ছে কোন তোয়াক্কা না করে আদালত অমান্য করতে পারার ক্ষমতা রাখেন।

এই যখন অবস্থা তখন দেখছি নয়া পল্টনে বিএনপির দলীয় কার্যালয় থেকে রুহুল কবির রিজভীকে গ্রেফতার করছে পুলিশ। তিনি অফিসে বসেই নাকি শাহবাগে বাসে আগুন দিয়েছিলেন,বাস পোড়ানোর মামলাতেই রিজভীকে গ্রেফতার দেখান হয়েছে। যথারীতি তাকে রিমান্ডে নেওয়া হবে। বিরোধী দলের মুখপাত্র হয়ে রিজভী সম্প্রতি কথা বলছিলেন। সেই কন্ঠস্বরও স্তব্ধ করে দেওয়া হোল। এই হোল বিরোধী দলের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের সংলাপের ধরন বা চরিত্র। তারপরও ভাঙা ও কর্কশ রেকর্ডের মতো সরকারের পক্ষে গণমাধ্যমগুলো সংলাপ ও সমঝোতার কথা বলছে। বাসে আগুন লাগা ও পোড়ানোর জন্য কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়া এক তরফা বিরোধী দলের আন্দোলনকে দোষারোপ করে যাচ্ছে। বিরোধী দল এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও সরকার পক্ষীয় গণমাধ্যমগুলো তাদের প্রপাগান্ডা চালিয়েই যাচ্ছে।

সরকার-পক্ষীয় গণমাধ্যমের নির্লজ্জ ভূমিকা

গণমাধ্যমের নেতিবাচক ভূমিকা ও ক্ষমতাসীনদের পক্ষে বিবেকবুদ্ধি বিসর্জন দেবার এই ছবি করুণ, কিন্তু তার আর্থ-সামাজিক কারনও আছে। কখন সমাজের চিন্তা, বুদ্ধি ও বিকের দরজা জানালাগুলো দৃশ্যমান ভাবে বন্ধ হওয়া শুরু হোল তা সনতারিখ দিয়ে চিহ্নিত করা কঠিন নয়। বাংলাদেশে এর শুরু নব্বই দশকের শেষ কি দ্বিতীয় সহস্রাব্দ শুরুর সময় থেকে। অর্থনীতিতে আশির দশকের কাঠামগত সংস্কারের ফল ততোদিনে ফলতে শুরু করেছে। রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে মুনাফা নিয়ন্ত্রণ ও পাচারের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা, উৎপাদনের খাতগুলোর অগ্রাধিকার নিশ্চিত করার দায়দায়িত্ব থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত রাখা, গৃহ ও আবাসন খাতে দ্রুত মুনাফার সুযোগ বৃদ্ধি, মুদ্রাব্যবস্থায় কেন্দীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে ছাড়, শেয়ার বাজারে মানুষের সঞ্চয় বের করে আনা – ইত্যাদি সংস্কারের মধ্য দিয়ে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক বিস্তারের পথ প্রশস্ত করা হয়। দ্রুত এর সঙ্গে যুক্ত হয় অবাধ বাজার ব্যবস্থার কাছাখোলা নীতি। এসবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে কর্পোরেট বাণিজ্য ও বিনিয়োগের রমরমা সুযোগ তৈরী হয়। বাংলাদেশ দ্রুত স্থানীয় ব্যবসায়ী ও কর্পোরেট স্বার্থের অধীনে চলে যায়। অর্থনৈতিক ভাবে ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রভাব আগেও ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব এবং তার প্রতিপত্তি বৃদ্ধি সাম্প্রতিক। দুটো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র জনগণের নাগাল ছাড়া হয়ে নতুন শ্রেণি ও শক্তির অধীনে চলে যায়। এক, গণমাধ্যম এবং দুই, রাজনীতি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই দুটি ক্ষেত্রের নির্ধারক ভূমিকা ছিল অবিসংবাদিত। গণমানুষের পক্ষে সেই ভূমিকার আশা করা এখন বাতুলতা।

রাজনৈতিক দলগুলোর ভু্মিকা প্রশ্নবিদ্ধ – এতে কোন সন্দেহ নাই। বিদ্যমান রাজনীতি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা রাজনৈতিক চর্চা গণমানুষের ইচ্ছা, আকাংখা, সংকল্প বা স্বার্থ কোন কিছুই রক্ষা করতে পারে না। কিন্তু বিতর্ক অন্যত্র। রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্কে এগুলো পুরানা কথা। মুল কথা হচ্ছে এই পরিস্থিতিতে জনগণ কি করবে? এ প্রশ্নও নতুন নয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারন লক্ষ্য করলেই আমরা দেখব গণমাধ্যমের একট অংশ যখন ক্ষমতাসীনদের নির্বিচার পক্ষ নিয়েছে, আরেকটি অংশ দাঁড়িয়েছে রাজনীতির বিরুদ্ধে। এক এগারোর বিরাজনীতিকরণ আবার এজেন্ডা হিসাবে ফিরে এসেছে।

যে কোন সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রথম সত্য হচ্ছে রাজনীতির বিকল্প নাই। সমাজের দ্বন্দ্ব-সংঘাত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যেভাবে হাজির হয়েছে সেই ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবিতার একটাই সদর্থক ভূমিকা হতে পারে: সাধারণ নাগরিকদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও শক্তি অর্জনের সম্ভাব্য পথ কি হতে পারে তা দেখিয়ে দেওয়া, সেই শক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে নাগরিক ও মানবিক অধিকার অর্জনের গুরুত্ব বোঝানো। রাষ্ট্র, সরকার কিম্বা রাজনৈতিক দলগুলো নাগরিক ও মানবিক অধিকার না মানলেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘোষণা ও সনদে গণমানুষের অধিকার স্বীকৃত। বাংলাদেশের জনগণ তাদের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রেখে কিভাবে আন্তর্জাতিক জনমত তাদের পক্ষে আনতে পারে এবং তাদের গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামকে চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে নিতে পারে সেই নীতি ও কৌশল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করাই এখনকার প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ। নতুন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের উচিত ছিল রাষ্ট্রের সংস্কার কিম্বা রূপান্তরের গোড়ার প্রশ্নগুলো তোলা এবং সমাজের বিভিন্ন পক্ষের মতামত হাজির করা।

রাষ্ট্র ও রাজনীতির সংস্কার নিয়ে বাংলাদেশে কথাবার্তা হয় না তা নয়। আন্তর্জাতিক বিশ্বব্যবস্থার সুবিধাভোগী শ্রেণিগুলো এইসব বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে যে জায়গা থেকে কথাবার্তা বলতে পছন্দ করে সেটা হচ্ছে ‘সুশাসন’, গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্র রাষ্ট্র ক্ষমতার চরিত্রের তর্ক, ক্ষমতাসীনরা কিভাবে তাদের শাসন ভাল ভাবে সম্পন্ন করবে সেই তর্ক নয়। ক্ষমতার চরিত্র অগণতান্ত্রিক – এমনকি ফ্যাসিস্ট – অথচ আলোচনা করছি ‘সুশাসন’ – এর চেয়ে পরাবাস্তব আর কী হতে পারে ! আসলে গণতান্ত্রিক সংস্কার ও রূপান্তরের বিপরীতে কিভাবে বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক শক্তিগুলোর শাসন অব্যাহত রাখা যাবে তার আলোচনাই ‘সুশাসন’ নামে পরিচিত। এর লক্ষ্য বিরাজনীতিকরণ। অর্থাৎ বাংলাদেশের সমস্যা ও সংকটকে রাজনৈতিক ভাবে মীমাংসার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের শাসন ব্যবস্থার সমস্যা হিসাবে সমাধান করার বৃথা চেষ্টা করা। ফলে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে আমরা সুশাসনের গল্প ছাড়া আর কিছু পয়দা করতে পারি নি।

সামাজিক সংলাপ জরুরী

তাহলে গণতন্ত্র সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সামাজিক সংলাপ জরুরী। এ কথাটাই আমি বার বার জোর দিয়ে বলে আসছি। রাজনৈতিক সংলাপের আগে, সামাজিক সংলাপ হতে পারে। যে-সংলাপ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের আশা দুরাশা মাত্র। পুঁজিতান্ত্রিক গোলোকায়ন ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের এই কালে সেটাই দরকার ছিল সবার আগে। সমাজের গোড়ার আর্থ-সামজিক দ্বন্দ্ব ও অমীংসিত বিরোধ যখন সমাজের ওপর তোলার রাজনীতিতে সংঘাত হিসাবে হাজির হয়, তার মীমাংসার জন্য গোড়ার অসুখ সারাতে হয়। । অথচ কর্পোরেট স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত গণমাধ্যমগুলো বিদ্যমান রাজনৈতিব বাস্তবতার যুক্তিসঙ্গত সমালোচনার পরিবর্তে খোদ রাজনীতিকেই বাংলাদেশ থেকে নির্মূল করতে চায়। এটা মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলবার পরামর্শ দেওয়া। বিরাজনীতিকরণের এই চেষ্টা এক এগারোর সময় আমরা দেখেছি। তার ফলও আমরা জানি। তার কুফল আমরা এখন ভোগ করছি। এখন আবার নতুন উদ্যমে রাজনীতির বিরুদ্ধে নগ্ন প্রচার চালাচ্ছে একটি দৈনিক পত্রিকা। রাজনীতির বিরুদ্ধে পত্রিকাটির এই প্রচার নিন্দনীয়।

গণতান্ত্রিক রূপান্তরের রাজনীতি সরল ও সিধা পথে চলবে তার কোন গ্যারান্টি নাই। বিপ্লবী শ্লোগান বা কর্মসুচী বিপ্লব ঘটায় না। কার্ল মার্কসের একটা শিক্ষা সবসময়ই কাজে লাগে। তার সারমর্ম হচ্ছে বড় বড় শ্লোগান ও বিপ্লবী কথাবার্তার চেয়েও সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। নিরীহ সংস্কারমূলক কর্মসূচিও রাজনৈতিক সংকটের চরিত্র ভেদে সমাজ ও রাজনীতির মৌলিক রূপান্তর ঘটিয়ে দেবার শর্ত তৈরী করতে পারে। যারা সমাজের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত কিভাবে সমাজের ওপরতলায় বুর্জোয়া রাজনীতির সংকট হিসাবে অনিবার্য ভাবে হাজির হয় সে বিষয়ে সচেতন তারা ঠিকই সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে জানেন। রাজনীতির দ্বন্দ্বসংকুল বাস্তবতার বাইরে গিয়ে ‘যতদিন তোমার হাতে দেশ, পথ হারাবে না বাংলাদেশ’ বললে কোন লাভ নাই। রাজনৈতিক পথ ও পদক্ষেপ নির্ণয়ের কর্তব্য পালনের পরিবর্তে ‘আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ...’ জাতীয় শ্লোগান’ কোন গণতান্ত্রিক মর্ম হাজির করে না। দেশ হাতের মোয়া নয়, সেটা কখনই কারো হাতে থাকে না। রাজনৈতিক ক্ষমতাই দেশ ও দশ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বৈধ অধিকার দেয়। তাহলে জনগণের গণতান্ত্রিক ক্ষমতার নির্মানের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি নিয়েই আলোচনা করা দরকার। কিন্তু তা না করে জনগণকে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে দাঁড় করাবার পুরানা চেষ্টা বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক। তাতে কোনই সন্দেহ নাই।

যারা এই ভুল প্রচার করছেন তাদের শুভ চিন্তার উদয় ঘটুক সেই আশা করব। আমি এর আগে কোন এক লেখায় লিখেছি বাংলাদেশে উদার রাজনৈতিক চিন্তার ইতিবাচক ভূমিকা আছে। এটা অনস্বীকার্য যে সার্বজনীন ভোটাধিকার নিশ্চিত করা এবং স্বাধীন ভাবে নিজের ভোট নিজে দেবার নিশ্চয়তা চেয়ে বিরোধী দলের আন্দোলন কঠিন কোন দাবি নয়, একান্তই নির্বাচনী দাবি। উদার রাজনীতির বাইরের কোন দাবি তো নয়ই। ক্ষমতাসীনদের এটা না মানার কোন কারনই ছিল না। কিন্তু আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির কারনে এই ভোটের অধিকার আদায়ের পথ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াইয়ে রূপ নিচ্ছে। দিল্লি চায় যেভাবে হোক শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকুক; বিরোধী দলের ওপর ভয়াবহ ও অকথ্য দমনপীড়ন যে মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছে নির্লজ্জ না হলে কেউই তাকে সমর্থন করতে পারে না। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো চায় সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী ইসলামপন্থি রাজনীতি কোন ভাবেই যেন বাংলাদেশে আশ্রয় প্রশ্রয় না পায়। কিন্তু গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে তাদের উৎখাত ও নির্মূল করারা মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনরা ইসলামপন্থিদের এই সংকেতই দিয়েছে যে বাংলাদেশের বর্তমান লড়াই একই সঙ্গে ইসলাম রক্ষার লড়াই। গণতন্ত্রে প্রত্যকেরই মত প্রকাশের স্বাধীনতা সভা সমাবেশের অধিকার রয়েছে। সেকুলারদের যেমন, তেমনি ইসলাম্পন্থিদেরও। কিন্তু ইসলামপন্থিদের ক্ষেত্রে তা অস্বীকার করারার অর্থ হচ্ছে নাগরিক ও মানবিক অধিকারের আন্তর্জাতিক নীতি ভঙ্গ করা। ইসলামপন্থিরা তাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করাকে তাদের ইমান-আকিদা রক্ষার বিপদ হিসাবেই দেখছে। অথচ উদার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল বহাল রেখে অধিকাংশ সমস্যারই সুষ্ঠ সমাধান খুবই সম্ভব ছিল। উদার রাজনৈতিক পরিবেশে ইসলামপন্থিদের গণতান্ত্রিক বিধিবিধান মেনে রাজনীতি করবার সুযোগ বন্ধ করা মূলত উদারনৈতিক রাজনীতির জন্য মারাত্মক আত্মঘাতী হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা ও তার সমর্থকদের সেটা বোঝার সময় নাই। তারা বিএনপিকে নির্মূল করতে চায়, আঠারো দলীয় জোটের সঙ্গে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্য জোট ও অন্যান্য ইসলামপন্থী দল। শেখ হাসিনা তাদেরকেও নির্মূল করতে চান। হেফাজতে ইসলাম তার কাছে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। কিন্তু ইসলাম পন্থিরা কেউই রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ নয়। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতা সম্পর্কেও তারা হুঁশিয়ার। তাঁরা কারো চেয়ে এই দেশকে কম ভালবাসেন না। অথচ আমরা চোখের সামনে দেখছি কিভাবে ভোটের অধিকার চাইবার নিরীহ বুর্জোয়া নির্বাচনী রাজনীতি দিল্লীর আগ্রাসন ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং জনগণের ইমান-আকিদা রক্ষার লড়াইয়ে পরিণত হচ্ছে। আসলে এ লড়াই জনগণের সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই। আমরা চাই বা না চাই সে জায়গাতেই শেখ হাসিনা এ সংগ্রামকে ঠেলে দিয়েছেন। অল্পকিছু মানুষ আগে দিল্লির ভুমিকার কথা বলত। কিন্তু রাজনৈতিক সমনপীড়নের মধ্য দিয়ে এখন সাধারণ মানুষের কাছে শেখ হাসিনা সেই বার্তা পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন যে তিনি দিল্লির মিশন পূর্ণ করবেন।

আমাদের উচিত ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক সংলাপের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। আলোচনা ও তর্কবিতর্ক একটি সমাজের শক্তির লক্ষণ। আমরা তর্ক করতে পারি, বাংলাদেশ রাষ্ট্র কিভাবে গঠিত হলে তা নাগরিক ও মানবিক অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে? রাজনীতিতে ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের ভূমিকা কিভাবে নিশ্চিত করা গেলে আমরা শক্তিশালি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বিশ্বসভায় মাথা তুলে ইজ্জতের সঙ্গে দাঁড়াতে পারব? আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থায় বহুপাক্ষিক সম্পর্ক রচনাকে গৌণ করে টিকফা জাতীয় দ্বিপাক্ষিক চুক্তি কেন অর্থনৈতিক বিকাশ ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য আত্মঘাতী? কেন আমাদের শক্তিশালী সেনাবাহিনী দরকার এবং সৈনিকতার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী গড়ে তোলা ছাড়া বৈরী প্রতিবেশী পরিবেষ্টিত হয়ে কেন আমরা টিকে থাকতে পারব না? কেন শক্তিশালী সীমান্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া আমরা আমাদের নাগরিকদের কুকুরবেড়ালের মতো গুলি করে হত্যা বন্ধ করতে পারবো না? – ইত্যাদি আমাদের জাতীয় প্রশ্ন। আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে এই ধরনের প্রশ্ন জড়িত। এই সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন মীমাংসা না করে আমরা চিৎকার করছি, বদলে যাও বদলে দাও। এতে কি বদলাবে? কে বদলাবে? আর এখন গরিব ও মেহনতি মানুষদের দেখিয়ে বলছি ‘আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ...! আর কিনা বলছে তারাই যারা কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষা করে। এই স্ববিরোধিতা নিয়ে রাজনৈতিক দলের সমালোচনা হাস্যকর। আবারও বলছি, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কোন বিকল্প নাই। বিরাজনীতিকরণের রাজনীতি আমরা চিনতে পারি। দেশের মানুষকে বোকা ভাবা ঠিক না।

এই আত্মঘাতী পথ পরিহার করা দরকার। যারা নগ্ন ভাবে ক্ষমতাসীনদের পক্ষাবলম্বন করছে সেইসব গণমাধ্যমের ব্যাপারে আমার কিছু বলার নাই। আমি তাদেরই সমালোচনা করছি যারা নিরপেক্ষ ভাবে উদার রাজনৈতিক পরিবেশ রক্ষার মধ্য দিয়ে এখনও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমি মনে করি।

বাকি তাদের শুভবুদ্ধি ও ইচ্ছা।

৩০ নভেম্বর ২০১৩। ১৬ অগ্রহায়ন। আরশিনগর।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।