সুশীলদের তামাশা


শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সমঝোতা হলে দশম সংসদ ভেঙে তিনি একাদশ সংসদের নির্বাচন দেবেন। এই প্রস্তাবের পেছনে পরাজয়ের সুর আছে। কিন্তু এটা কি পিছু হটা? মোটেও নয়। তাঁর এই প্রস্তাব কি তথাকথিত সমঝোতার ইঙ্গিত? তাও নয়। তিনি যা বলছেন আসলেই কি তা করবেন? না, করবেন না। এটা অসম্ভব। এর কারন, সিদ্ধান্ত তিনি নিজে নেবেন না, সিদ্ধান্ত নেবে দিল্লী। যদি তার নিজের সিদ্ধান্ত নেবার জায়গাগুলো অবশিষ্ট থাকতো তাহলে তাঁর এই ঘোষণাকে ভিন্ন ভাবে বিচার করবার সুযোগ থাকতো। তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত নেবার যে জায়গাগুলো ছিল তিনি তা অপচয় করেছেন। নির্বাচনের নামে যে কাণ্ড করলেন তাতে শুধু তাঁর নিজের নয়, বিশ্বে বাংলাদেশের মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে। এখন তিনি সমঝোতার কথা বলছেন না। বরং তাঁর লজ্জা ঢাকবার জন্য বলছেন, বিরোধী দল যেন দশম সংসদ মেনে নেয়; তিনি তাহলে নতুন করে একাদশ সংসদের নির্বাচন করবেন। এটা সমঝোতার প্রস্তাব নয়, নিজের লজ্জা সামাল দেবার আরেকটি নির্লজ্জ চেষ্টা। একই সঙ্গে বিরোধী রাজনীতিকে বিভ্রান্ত করবার কৌশল।

সুশীলদের লেখালিখিতে দেখছি তারা এত কিছুর পরেও শেখ হাসিনার পিছু ছাড়ছে না। তারা এখনও ভাবছে সমস্যাটা সাংবিধানিক।ফলে তাদের দাবি, এখনও নাকি নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সংবিধানে একটা ‘উপযুক্ত সংশোধনী’র সুযোগ আছে। কিন্তু এখন যে-সংসদ বহাল হতে যাচ্ছে সেটা তথাকথিত দশম সংসদ। সংশোধনী আনতে হলে আনতে হবে দশম সংসদে। যদি দশম সংসদ এই সংশোধনী আনে তাহলে বিরোধী জোটকে তুমুল তামাশার দশম সংসদকেই ‘বৈধ’ বলে মেনে নিতে হবে। বিএনপি এই মহা ভুল করবে কিনা জানি না। শেখ হাসিনা নাগরিকদের ভোটের অধিকার হরণ করে যেভাবে ‘নির্বাচন’ (??) করেছেন সেই নির্বাচন মেনে নেওয়া কিভাবে সম্ভব? প্রশ্নই আসে না। ক্ষমতাসীনরা মুলত এখন সব অর্থেই অবৈধ। অর্থাৎ সাংবিধানিক কিম্বা রাজনৈতিক। কোন ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন লোক এখন আর দাবি করতে পারে না যে তথাকথিত ‘ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া’ ধরে রাখতে চাইলে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সংবিধানের একটি ‘উপযুক্ত সংশোধনী’ লাগবে’। প্রস্তাব হচ্ছে, শেখ হাসিনা যদি মুখে যা বলেছেন তা মন থেকেই বলেন তাহলে দশম জাতীয় সংসদে তার উচিত হবে একটি ‘উপযুক্ত সংশোধনী’ আনা। এর ফলে দশম সংসদকে ‘বৈধ’ সংসদ হিসাবে রাজনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে এবং এই ‘বৈধতা’ অর্জনের পর ‘উপযুক্ত সংশোধনী’ এনে একাদশ সংসদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া যাবে। খুবই প্রতিভাবান প্রস্তাব। দৈনিক প্রথম আলো এই প্রস্তাব দিয়েছে। (দেখুন, “দশম সংসদের বৈধতা ও একাদশের ভাবনা”, প্রথম আলো ২৩ ডিসেম্বর ২০১৩)।

প্রথম আলোর যুক্তি হচ্ছে, শাসকগোষ্ঠী একদিকে ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ রক্ষাকে জরুরি মনে করছে, অন্যদিকে আবার মধ্যবর্তী নির্বাচনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু এখন আর সংসদ ভেঙে ৯০ দিন সময়ের সুযোগ গ্রহণ করা যায় না। কারণ, সংবিধান তা সমর্থন করে না। তাই সমঝোতার জন্য কান্নাকাটি করে কোন লাভ নাই। বৃথা। আরও ইন্টারেস্টিং যুক্তি হচ্ছে, “সমঝোতা নয়, সংবিধান বড়”। বিএনপিকে সংবিধানই মানতে হবে। শেখ হাসিনা তো বারবার এই কথাই বলছেন। সংবিধানই সব। প্রথম আলো শেখ হাসিনার কথারই প্রতিধ্বনী তুলছে মাত্র।

প্রধানমন্ত্রী একাদশ সংসদ গঠনের জন্য মধ্যবর্তী নির্বাচনের শর্ত দিচ্ছেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তাঁরা দশম সংসদ নিয়েই কথাবার্তা চালাচ্ছেন। প্রথম আলো একই লেখায় বলছে, জানুয়ারি মাসের পরে ‘দশম সংসদ নির্বাচন’ কথাটি জাদুঘরে ঠাঁই পেতে পারে। অর্থাৎ দশম সংসদ নিয়ে কোন কথা বলার আর সুযোগ নাই। এইসব কথা বলে বিএনপি “অপরিপক্বতার পরিচয় দিচ্ছে”। অথচ প্রথম আলোর লেখার চরম ‘অপরিপক্ক’ দিক হচ্ছে তারা ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ আর ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে’ একাকার গণ্য করে। প্রথম আলো যখন বলে, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া’ ধরে রাখতে চাইলে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে ‘সংবিধানের একটি ‘উপযুক্ত সংশোধনী’ লাগবে। তখন আসলে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার কথাই বলা হয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। সেই দিকে তাদের হুঁশ থাকে না। কিম্বা রাজনীতি ও সানহবিধানকতার পার্থক্য সম্পর্কে তদেরধারণা অপরিচ্ছন্ন। যদি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষাই এখন তাদের রাজনীতি হয়, তাহলে তাদের তাহলে প্রমাণ করতে হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান সাংবিধানিক ভাবে সম্ভব। যদি তাই হোত, তাহলে এতো সমঝোতা, সংলাপ, দুই নেত্রীকে কথা বলানোর ঝক্কি ঝামেলা আমাদের পোহাতে হোত না। আর এ সবই সংবিধান বা আইনের বাইরে ‘রাজনৈতিক’ সমাধান – সাংবিধানিক নয়। তাছাড়া সংবিধান যদি অগণতান্ত্রিক ও গণবিরোধী হয় তখন সংবিধানের ভেতরে থেকে সংবিধানের বদল ঘটানো যায় না। রাজনীতি ও সংবিধানের সম্পর্ক সেখানে সাংঘর্ষিক হবেই। অগণতান্ত্রিক ও গণবিরোধী রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামের রাজনীতি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনে চলে না। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সব সময় সাংবিধানিক বা আইনী প্রক্রিয়া নয়। আইন আর গণতান্ত্রিক রাজনীতি সর্বাবস্থায় সমার্থক নয়। বিশেষত যখন রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কাঠামো দুটোই চরিত্রের দিক থেকে অগণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। আইন দিয়ে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে ‘অপরিপক্ক’ চিন্তা আর কিছুই হতে পারে না। প্রথম আলোর লেখাটি মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করলে আমরা দেখব এটা আসলে অপরিপক্কতার মামলাও নয়। বরং শেখ হাসিনার সরকারকে উদ্ধারের চেষ্টা।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির কী করা উচিত তার নসিহতও দেওয়া হয়েছে। বিএনপির উচিত হবে কেবল নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে তা নিয়ে সমঝোতা করা নয়, বরং তাদের উচিত ‘গুচ্ছ প্রস্তাব’ নিয়ে আসা। যেমন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজানোর ফর্মুলা, ইত্যাদি। সুশীলদের এই আকুতিকে আমরা সাধুবাদই জানাবো। ঠিকই বিএনপি সংবিধানের কী ধরণের সংস্কার করতে চায় সেটা তাদের পরিষ্কার করেই বলা উচিত। অর্থাৎ বিদ্যমান সংবিধান -- বিশেষত পঞ্চদশ সংশোধনীর পরে রাষ্ট্রব্যবস্থার যে-চরিত্র দাঁড়িয়েছে তার রূপান্তর বা সংস্কার ছাড়া বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কোন ভবিষ্যৎ নাই, এটা আমাদের সকলের কাছে -- যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন -- পরিচ্ছন্ন থাকা দরকার। কিন্তু সেটা নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে ১৪২ অনুচ্ছেদের শক্তির বলে সংস্কার, নাকি বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধান সভা ডাকা ও নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণ সেটা আন্দোলনের অভিমুখ ও মাত্রা দিয়েই স্থির হবে। গণবিরোধীরা বিদ্যমান সংবিধান নানান ছুতায় বহাল রাখতে চায়, আর গণতান্ত্রিক জনগণ চায় নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান বা গঠনতন্ত্র। বাংলাদেশের রাজনীতির এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা অসম্ভব।

অতএ বিএনপি সংবিধান প্রশ্নে সীমাবদ্ধতার পরিচয় দিচ্ছে এই অভিযোগ মিথ্যা নয়। সুশীল রাজনীতির ধারক প্রথম আলো তার যে সমালোচনা করছে তাতে কিছুটা সায় দেওয়া হয়তো যায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় রাজনীতির কেন্দ্রবিব্দুতে সংবিধান বারবারই ক্ষতস্থানের মতো যন্ত্রণা হয়ে হাজির হচ্ছে। হবেই। কিন্তু প্রথম আলোর সমালোচনার মধ্যে প্রত্যক্ষ কিম্বা পরোক্ষ ভাবে আওয়ামী প্রীতি যতোটা প্রবল, ঠিক ততোটাই বিএনপির প্রতি নিরপেক্ষ বিচারবুদ্ধির নমুনা কমই লক্ষ্য করা যায়। প্রায়ই দেখি, বিএনপির বিরুদ্ধে এক ধরণের ঘৃণা বিষের মত গল গল করে বেরিয়ে পড়ে। সুশীল রাজনীতির সঙ্গে যা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারো মত বা রাজনীতি বিএনপি বিরোধী হতেই পারে। সেটা বিকারে পরিণত হলে মুশকিল। ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম বিদ্বেষের অসুখের কারণে প্রথম আলো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের সহকারী। তাদের এই মানসিক বিকারও কাটিয়ে তোলা কঠিন, এটাও স্বীকার করি। কিন্তু যদি আমরা ইতিবাচক কোন সুশীল চিন্তা ও রাজনীতির দ্বারা সমাজে অবদান রাখতে চাই তাইলে নসিহত দেবার ভাষা কিম্বা প্রকাশের ধরণের একটা নিরপেক্ষ ও স্বাধীন অবস্থা থাকা দরকার। বক্তব্য যুক্তিসঙ্গত হবার প্রয়োজনীয়তা তো রয়েছেই। এই অভাবের কারনে প্রথম আলো শেষাবধি একটি আওয়ামি পন্থী পত্রিকায় পরিণত হয়। এটাই হয়তো পত্রিকার নীতি। কিম্বা পত্রিকায় আওয়ামী ক্যাডার ও ভারতপন্থীদের প্রাবল্যের কারণে ইতিবাচক নিরপেক্ষ ভূমিকা পত্রিকাটি পালন করতে পারে না। সেখানে ঘাটতি ঘটছে সীমাহীন।

কথাগুলো বলার কারন রয়েছে। এর আগে আমি কয়েকবারই বলেছি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার কারনে সুশীল রাজনীতির, যাকে সাধারণত ইংরেজিতে লিবারেলিজম বলা হয়, একটা ইতিবাচক ভূমিকা আছে। বিশেষত যেখানে আমাদের সমাজ নাগরিক ও মানবিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়, চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলতে বোঝে প্রথম আলোর স্বাধীনতা। কিন্তু দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, কিম্বা ইসলামিক টিভির স্বাধীনতা নয়। যেখানে ভিন্ন চিন্তাকে আমরা সহ্যই করতে পারি না, ইত্যাদি। এই পরিস্থিতিতে উদার চিন্তা ও মানসিকতার চর্চা প্রশস্ত করার দরকার রয়েছে কোন সন্দেহ নাই।

তারপরও বলব, ““দুই-তৃতীয়াংশের চেরাগ পেলে বিএনপি কোন কোন অনুচ্ছেদ বদলাবেন? কোনটার পরিবর্তে কোনটা আনবেন? দেখবেন আবোলতাবোল বকতে শুরু করেছে” -- প্রথম আলোর এই অভিযোগ সঠিক। অর্থাৎ যদি বিএনপি বা বিরোধী দলীয় জোট দুই তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় তাহলে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব তাদের কী? ঠিক, বিএনপি এটা জানে না। কিন্তু জানেটা কে? প্রথম আলো? সুশীল সমাজ? সমাজের বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা? টক শোর পারফরমাররা? সংবিধান বিশেষজ্ঞরা? না, কেউ জানে না। আজ অবধি বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলতে হলে কি ধরণের ‘গঠনতন্ত্র’ আমাদের দরকার এবং কী ধরণের গঠনতন্ত্র ও রাষ্ট্রকাঠামো বাংলাদেশের উপযোগী সেই তর্কের কিনারেই আমরা পৌঁছাতে পারি নি। কিন্তু এটা তো বিএনপির একা করবার কথা নয়। সংবিধানের সংস্কার কী করে হতে পারে, তার উত্তর শুধু কি বিএনপির কাছ থেকে আমরা চাইবো? এটা শুধু রাজনৈতিক দলেরই কাজ সেটা তো কাজের কথা হতে পারে না। আজ অবধি সুশীলদের মধ্যে কি আমরা কোন গণতান্ত্রিক চিন্তা দেখেছি? দেখি নি। বাহাত্তরের পূত পবিত্র সংবিধানকে মাথায় তুলে তো ৪২ বছর কেটেছে। শেখ মুজিবর রহমান বাকশাল করেছেন, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা পঞ্চদশ সংশোধনী করে আজ দেশকে ক্ষতবিক্ষত করেই ক্ষান্ত থাকেন নি, খোদ সার্বভৌমত্বকেই বিপন্ন করে তুলেছেন, বাংলাদেশকে তুলে দিয়েছেন দিল্লীর হাতে – এই গেঁড়াকল থেকেই তো দেশ মুক্ত করা যাচ্ছে না। ইসলামাবাদ থেকে দেশকে মুক্ত করা গেছে, দিল্লীর কবল থেকে মুক্ত হবো কিভাবে? গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র বা সংবিধান নিয়ে চিন্তা ভাবনা তো অনেক দূরের কথা। বিএনপি যদি গণতান্ত্রিক ও গণমানুষের দল হোত তাহলে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটতো অনেক আগেই। এটা আমাদের রাজনৈতিক দুর্ভাগ্য। ফলে সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমাদের পক্ষে আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকা যেমন অসম্ভব, একই ভাবে বিএনপি বা বিরোধী দলের পক্ষাবলম্বনও কঠিন।

প্রথম আলো বিএনপি ও আঠারো দলের বিরোধী, এটা তাদের রাজনৈতিক অধিকার। কিন্তু তারা আওয়ামীপন্থী – এখানেই তাদের রাজনৈতিক চরিত্র আমরা বুঝতে পারি। সেটা করতে গিয়ে তারা রাজনীতিকেও সাংবিধানিক ভাবে সমাধান করবার উদ্ভট চিন্তা প্রায়ই হাজির করে। আইনী বিষয়ে তারা আওয়ামী লীগকে সমালোচনা করে তাকে রক্ষার জন্য, গণমানুষের গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা বা রাজনীতির বিকাশ ঘটানোর জন্য নয়। এখন নির্লজ্জ ওকালতি হচ্ছে দশম সংসদ মেনে নেবার পক্ষে জনমত তৈরী করা।

প্রথম আলো দাবিটি কৌতুককর। যে-তামাশার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ‘সংসদ’ নামে এক প্রকার বিচিত্র জিনিস জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেই সংসদকে ‘বৈধ’ বলে আমাদের মেনে নিতে হবে। কারণ সেই সংসদই ‘উপযুক্ত সংশোধনী’ আনবে। আর তাতেই ‘সমঝোতা হবে, আর বাংলাদেশের বর্তমান সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এর চেয়ে হাস্যকর, গণতন্ত্র বিরোধী, এমনকি বিদ্যমান আইন ও সাংবিধানিক ধ্যানধারণার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ চিন্তা আর কী হতে পারে?

প্রথম আলো এখনই বিএনপির কাছ থেকে কথা বের করতে চায়। তারা ক্ষমতায় গেলে দেশশাসনের কার্যপ্রণালিটা কী করবে? “আসলে কী ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সংবিধানে নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অবস্থান কী হবে, তা নির্দিষ্ট করতে হবে। মৌখিক নয়, একটি লিখিত অবস্থান আদায়ে বিএনপিকে চাপ দিতে হবে। শুধু অবরোধ বা তার নামে নাশকতা দিয়ে নির্বাচন ভণ্ডূল করা যাবে না”।

যে-দলকে রাস্তায় দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছে না। যাদের নেতাদের জেলে পুরে রাখা হয়েছে। যাদের কর্মীদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে – আন্দোলনের এই তুঙ্গ মুহূর্তে বিএনপির কাছ থেকে ‘লিখিত অবস্থান’ আদায় করা তামাশা ছাড়া কিছু না। একটি গণমাধ্যম বা টেলিভিশান চ্যানেল নাই, যারা নিরপেক্ষ ভাবে সংবাদ পরিবেশন করে। ক্রমাগত মিথ্যা প্রচার করা হচ্ছে। প্রচার করা হচ্ছে বিকৃত তথ্য। এই পরিস্থিতিতে বিএনপির কাছ থেকে আমি কিছুই প্রত্যাশা করি না। কিন্তু যেটা প্রত্যাশা করি, সেটা হচ্ছে আন্দোলনের পদক্ষেপ ও ধরণ সম্পর্কে হুঁশে আসা। প্রথম আলো বলতে চাইছে ‘আন্দোলন ও নাশকতা’ দিয়ে বিএনপি নির্বাচন ভণ্ডুল করতে পারবে না। কেন তারা বলছে সেটা বুঝতে পারি, কারন দশম সংসদের নির্বাচনকে তারা ‘বৈধ’ করবার জন্য ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে হাত মেলাতে চাইছে। এটা ভুল রাজনীতি। এতে বর্তমান পরিস্থিতির কো্ন মীমাংসা হবে না। বরং কিভাবে আন্দোলন করলে সরকারের পতন ঘটবে সেই পরামর্শই বিএনপিকে দেওয়া দরকার। এরপরই আসবে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ণের প্রশ্ন।

বিরোধী রাজনৈতিক জোটের সামনে আন্দোলন ছাড়া কোন পথ নাই। এ জন্য একথা বলছি না যে রাজনৈতিক সমঝোতার কোন সুযোগ নাই। না তা নয়। আছে। কিন্তু সে সুযোগের ব্যবহার শেখ হাসিনা করতে পারবেন না। কারণ লড়াইটা স্পষ্টতই দিল্লীর বিরুদ্ধে। এই গোড়ার সত্যকে অস্বীকার করলে সুশীলরা যে সিদ্ধান্তে পোঁছাবে তা শেষতক দিল্লীর পক্ষেই নগ্ন দালালী ছাড়া আর কিছুই হবে না।

বিএনপিকে অবশ্যই পরামর্শ দেওয়া উচিত। কিন্তু সেটা দশম সংসদ ‘বৈধ’ প্রমাণ করবার জন্য ‘উপযুক্ত সংশোধনী’র প্রস্তাব নয়। বরং আন্দোলনের ধরণ ও কৌশল নিয়ে পরামর্শ। যাতে আন্দোলন গণতান্ত্রিক চরিত্র পরিগ্রহণ করতে পারে এবং বর্তমান সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের উপাদান ও শর্ত তৈয়ার করা সম্ভব হয়।

শেখ হাসিনা নির্বাচন নিয়ে যা করেছেন তারপরও তাকে রক্ষার চেষ্টা দেখে লজ্জা বোধ হয়।

২৩ ডিসেম্বর ২০১৩। ৯ পৌষ ১৪২০। রিদয়পুর।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।