হাসিনার নয় দফা ও আন্দোলনের ধরণ


বোঝা যাচ্ছে আন্দোলনের একটা বিরতি ঘটেছে। খালেদা জিয়া ১৫ তারিখে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। ২০ জানুয়ারি গণ সমাবেশ ও ২৯ তারিখে কালোপতাকা মিছিল। অন্যদিকে খবর খুব দ্রুত ঘটছে। অনেক খবর তাদের প্রিন্টিং প্রেস সমেত সিল গালাও হয়ে যাচ্ছে। তিনটি বিষয় খবর হিসাবে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি বিরতির ঘোষণা দিয়ে খালেদা জিয়ার সাংবাদিক সম্মেলন; এখান থেকে আন্দোলনের সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে একটা ধারণা আমরা করতে পারি, আন্দোলনের ধরণ সম্পর্কে একটা নির্মোহ বিচার দরকার। দ্বিতীয় খবর হচ্ছে, যুক্তরাজ্যের হাউজ অব কমন্স এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্টে বাংলাদেশ নিয়ে বিতর্ক; এ সকল বিতর্ক সম্পর্কে গণআন্দোলন-বিদ্বেষী গণ মাধ্যমগুলোর বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছে। সেই সকল ব্যাখ্যার বাইরে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে আন্তর্জাতিক জনমত ঠিক ভাবে বোঝা দরকার।

এবং তৃতীয়টি ‘গুজব’। বাস্তবতার কারণে কোন কোন ঘটনার সত্যমিথ্যার বিচার রাজনীতিতে গৌণ হয়ে যায়, গুজবই নির্ধারক হয়ে ওঠে। সাতক্ষীরায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অংশ গ্রহণ সত্য কি মিথ্যা সেই তর্ক এখন গৌণ। ক্ষমতাসীনদের কীসের এতো ভয় যে গুজবকেও সিল গালা করে দিতে হবে? সাংবাদিকদের অফিস থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে কারাগারে পুরতে হবে?

শুরুতে সাম্প্রতিক আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির বিচারের মধ্যে এ লেখাটিকে সীমিত রাখতে চেয়েছিলাম । কিন্তু বাংলাদেশে গণ আন্দোলনের ইতিহাস ও আন্দোলনের ধরণ সম্পর্কে খানিক ধারণা না নিলে আন্দোলনের বিচার একদেশদর্শী হয়ে যাবার ভয় রয়েছে। অন্যদিকে গণবিরোধী ফ্যাসিস্ট শক্তি গণআন্দোলনকে শক্তিশালী হতে দেবে না, এটা জানা কথা। একে বিরোধিতা করবার ক্ষেত্রে তাদের প্রধান মতাদর্শিক লক্ষ্য জামায়াত-শিবির ও হেফাজতে ইসলাম। এটা পরিষ্কার যে মাঠ পর্যায়ে গণশক্তির ভিত্তি এখানে। তাহলে আন্দোলনকে গতিশীল করতে হলে গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রাম ও গণশক্তি পরিগঠনের দিক থকে ইসলামপন্থী আন্দোলনের ভূমিকারও একটি নিরাবেগ ও নির্মোহ পর্যালোচনা দরকার।

আন্দোলনের চরিত্র আর আন্দোলনের নেতৃত্বের চরিত্রকে গুলিয়ে ফেলা নতুন কিছু নয়। অনেকে বিএনপি ও আঠারো দলীয় জোটের শ্রেণি চরিত্র দিয়ে বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের লড়াইয়ের চরিত্র মাপেন এবং তার সীমা ও সম্ভাবনা বোঝার চেষ্টা করে পেরেশান হয়ে যান। ফলে বিএনপির ব্যর্থতাকে গণ আন্দোলনের ব্যর্থতা বলে ভুল করেন। অন্যদিকে নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের ধারণা জনগণের এখন একটাই কাজ: বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানো। যাতে দুর্নীতি ও রাজনীতির দুর্বত্তায়ন আগের মতোই চলতে পারে। ক্ষমতাসীনদের গণমাধ্যমগুলো অবশ্য আন্দোলনকে নিরাশ করবার জন্য বেগম জিয়া কী ভুলটাই না করেছেন সেই কেচ্ছা দিনরাত গেয়ে যাচ্ছে। তাদের হাহাকার হচ্ছে খালেদা জিয়া আওয়ামি লীগের শর্তে নির্বাচন করলে এখন ক্ষমতায় থাকতেন। তাদের আশা ছিল ক্ষমতাসীনদের শর্তে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন এবং বাংলাদেশে সব কিছুই আগের মতোই চলতে থাকবে। অথচ সংবিধানের ন্যূনতম সংস্কারও যদি খালেদা করতে চান তাহলে তাঁকে দুই তৃতীয়াংশ আসন পেতে হবে। শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে নির্বাচন করলে সেটা সম্ভব হোত না। নির্বাচন যে সুষ্ঠ হোতনা সেটাতো চাক্ষুষ সকলেই এখন দেখল। ফলে সংবিধান সংস্কার দূরের কথা ক্ষমতায় ফিরে আসাও অসম্ভব হোত। সংস্কার না হলে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভুত সাংবিধানিক কারনে খালেদা জিয়াকে কিভাবে বহন করতে হোত সেটা যারা বুঝতে চান তারা পঞ্চদশ সংশোধনী মনোযোগ দিয়ে পড়বেন, আশা করি। খালেদা তাঁর নিজের রাজনৈতিক বিবেচনা থেকেই শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যান নি। তাঁর দিক থেকে দেখলে এই সিদ্ধান্ত সঠিক।

কিন্তু শেখ হাসিনার অধীনে বেগম জিয়ার নির্বাচনে না যাবার যুক্তি আর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নিজস্ব গতি ও সম্ভাব্য পরিণতি সমান্তরাল নয়। এই টানাপড়েন খালেদা জিয়া যেভাবে বোঝেন তিনি সেভাবেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ও দেবেন। আন্দোলন তিনি কতোটুকু নিয়ে যেতে চান এবং জনগণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের রাজনীতি কী হবে সেটাও নির্ভর করবে তাঁর এই উপলব্ধির ওপর। তেমনি আন্দোলনের মাঠ পর্যায়ের কর্মীদেরও নিজেদের মাঠের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে হবে জনগণ কী চায়, আর সেই প্রত্যাশার ভার বইবার ক্ষমতা বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোটের কতোটুকু। এই বিবেচনা থেকেই আন্দোলনের নীতি ও কৌশল তাদের ঠিক করতে হবে। বলা বাহুল্য, আমাদের আগ্রহ ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলনে, তাদের সাহসী সংগ্রামে। আমাদের লেখালিখিও সেই আলোকেই পাঠ করলে খুশি হবো।

বলা রাখা দরকার, আমরা দাবি করিনা জামায়াতে ইসলাম কিম্বা হেফাজতে ইসলাম সমালোচনার উর্ধে, অবশ্যই নয় – সাধারণ ভাবে ইসলামপন্থী ধর্মান্দোলন ও রাজনীতির পর্যালোচনা বাংলাদেশে খুবই জরুরী, কিন্তু ফ্যাসিস্টরা তাদের মতাদর্শ ও গণবিরোধী ভূমিকা আড়াল করবার জন্যই নরম লক্ষ্যবস্তু হিসাবে বারবার ইসলামকে সামনে হাজির করে। একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার জন্য এটা সবচেয়ে সস্তা ও সহজ কাজ। অথচ একটি ২০/২৫ বছরের যুবক – যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখে নি – সেই ছেলেটি কী আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে শহিদ হয় কিম্বা শহিদ হতে চায় – সেই দিকগুলো আমরা কখনই বোঝার চেষ্টা করি নি। যারা তাদের আদর্শ ও সংকল্পের জন্য জীবন দিতে রাজি থাকে, তাদের গুলি করে দমানো যায় না। সেই আদর্শ বা সংকল্প যতোই ভুল হোক, তাকে মোকাবিলার পথ নির্মূল নয়। এ কথাটাই আমরা বারবার বলছি। তাকে সঠিক আদর্শ ও আরও পরিণত সংকল্প দিয়েই মোকাবিলা করতে হয়। গুলি আদর্শের বিকল্প হতে পারে না -- এই সহজ সত্য যতো তাড়াতাড়ি আমরা বুঝবো ও নির্মোহ ভাবে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী আন্দোলন পর্যালোচনা করতে শিখব, ততো তাড়াতাড়ি বাংলাদেশের বর্তমান ভয়াবহ পরিস্থিতি আমরা অতিক্রম করে যেতে পারব।

আমরা দেখছি যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও দমনপীড়নের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আন্দোলনের ধরণ সমালোচনার প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মতাদর্শিক বিভাজন দিয়ে আন্দোলনকে বিভক্ত করবার জন্য যেমন জামায়াত ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম ফ্যাসিস্টদের টার্গেট, ঠিক তেমনি আন্দোলনের ধরণও ফ্যাসিস্টদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। এটা খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। যারা রাষ্ট্র ও আইনশৃংখলা বাহিনীকে সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে তারা আন্দোলনে সন্ত্রাস ও সহিংসতা বন্ধ করবার জন্য উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। এতে বোঝা যায় তাদের যুদ্ধকৌশল হিসাবে আন্দোলনের সবচেয়ে কার্যকর রূপের নিরাকরণ ঘটাতেই তারা আগ্রহী। তাছাড়া তাদের ভাবখানা এরকম যে বাংলাদেশে আন্দোলনের বর্তমান সহিংস ধরণ নতুন। অথচ আন্দোলনের বর্তমান ধরণ আওয়ামি লীগের হাত ধরেই বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি ও তাদের রাজনৈতিক চর্চাকে ভুলে গিয়ে ও বাদ রেখে আন্দোলনের ধরণ নিয়ে সমালোচনা চরম অসততা ও কপটতা। আজ তাই শুরুতে একটু পুরানা তথ্য নাড়াচাড়া করব।

‘দেশে এখন কার্যত কোন বৈধ সরকার নেই...’

একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করি। উদ্ধৃতিটি এরকম:

“দেশবাসী ... সরকারের একদলীয় নির্বাচন প্রত্যাখান করেছে। ... নীল নকশার নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন ... সরকারের আর কোন আইনগত ও সাংবিধানিক বৈধতা নেই। সরকার এখন অসাংবিধানিক। তাই দেশে এখন কার্যতঃ কোন বৈধ সরকার নেই”

না। এটা খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন নয়, শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন। সাল ১৯৯৬। বৈধ সরকার নাই, আছেন শুধু রাষ্ট্রপতি, রাষ্ট্রের প্রধান, সংবিধানের প্রতীকী উপস্থিতি। শক্তিও অতোটুকুই। শেখ হাসিনা তখনকার রাষ্ট্রপতিকে তাঁর ওপর অর্পিত সাংবিধানিক ক্ষমতা ব্যবহার করবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে রাষ্ট্রপতিএকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করবেন, আর ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবেন। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর রাষ্ট্রপতিকে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘অবৈধ সরকারকে বরখাস্ত করে নতুন নির্বাচন দিন।’

আমাদের স্মৃতিশক্তি কম। সেটা অপুষ্টি বা আয়োডিনের অভাব থেকে হতে পারে। ডাক্তার কিম্বা পুষ্টিবিদরা সেটা ভালো বুঝবেন। তবে পৃথিবীতে অন্য কোন জনগোষ্ঠির স্মৃতিপদার্থ এতো স্বল্প মনে হয় না। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গে পরে আসি, আরেকটু পেছনে ১৯৮৮ সালে যাই।

বাংলাদেশে ৪র্থ জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়েছিল ৩ মার্চ ১৯৮৮ সালে। তখন গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো বাংলাদেশের প্রায় সব কয়টি প্রধান রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করেছিল। বাংলাদেশ আওয়ামি লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তো ছিলই, এই দুটো দল ছাড়াও নির্বাচন বর্জন করেছিল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামি লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টী (মোজাফফর) এবং ওয়ার্কার্স পার্টি। নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৫১ আসনে জাতীয় পার্টি জিতেছে বলে দাবি করা হয়। ভোট পড়েছিল সরকারী হিসাবে ৫২.৫০%।

নির্বাচনের দিন বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনা সেই সময়ের আট দলীয় জোটের পক্ষে সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু ভবনে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল পরিষ্কার: সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে হবে। তাঁর যুক্তি, জনগণ নির্বাচনে ভোট দেয় নি, ভোট প্রত্যাখান করেছে। তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘নির্বাচন প্রতিরোধ আন্দোলনে’ এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের সংঘর্ষে ১০ ব্যক্তি নিহত হয়েছে। তার মধ্যে ঢাকায় ঢাকায় ৮ জন ও চট্টগ্রামে ২ জন। সেই সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ হাসিনা গর্ব করে বলেছিলেন, ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, পাবনা, সিলেট, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুরসহ দেশের প্রায় সর্বত্র বহু জায়গায় জনগণ ভোট কেন্দ্র পুড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকার আরমানিটোলা, শেরেবাংলা নগর, মীরপুর, মগবাজার, টিএন্ডটি, পল্টন মহিলা কলেজ, গাবতলী, লালবাগ, লেডিজ ক্লাব, আজিমপুর, নুরজাহান রোড, ভূতের গলি, গ্রাজুয়েট স্কুল, নবাবপুর, ওয়ারী, সুত্রাপুর, গোলাপবাগ, লালকুঠিসহ নানান জায়গায় জনতা প্রতিরোধ রচনা করে। ব্যাপক সহিংসতা ঘটে। নির্বাচন বানচাল করতে সহিংসতায় আওয়ামি লীগ নেতৃত্ব দিয়েছিল। নির্বাচন কেন্দ্র করে সন্ত্রাস ও সহিংসতা মোটেও নতুন কিছু নয়।

সেই সময় শেখ হাসিনা কি বলেছিলেন তা আমাদের জন্য এখনও দারুন শিক্ষণীয় হতে পারে। আমি ১৯৮৮ সালের ৪ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাক থেকে টুকছি তাদের তখনকার ভাষার বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে, তাদের সাংবাদিকতার সততার ওপর আস্থা রেখে। তাছাড়া হাতের কাছে ইত্তেফাক আর দৈনিক সংবাদের প্রতিবেদন পেয়েছি, আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন একজন তরুণ সাংবাদিকের অনুসন্ধানী পরিশ্রমের ফল হিসাবে। পত্রিকার সংবাদ পরখ করবার সময় ও সুযোগ না পেলেও, আমি নিশ্চিত এই উদ্ধৃতি প্রামাণ্য। যে কেউই খুঁজে দেখতে পারেন। সেই সময়ের দৈনিক পত্রিকাগুলো থেকে আরও অনেক ইন্টারেস্টিং মালমসলা গবেষণা করে বের করা যেতে পারে।

ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী শেখ হাসিনা সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন: “আমরা আগেই বলিয়াছি, একটি গোষ্ঠির স্বার্থরক্ষার জন্যই এ নির্বাচনের আয়োজন করা হইয়াছে। দুর্ভাগ্যবশত: উন্নয়ন, রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সরকার গঠনে জনগণের কোন ভূমিকা নাই। কোন অবস্থাতেই এ পরিস্থিতি মানিয়া নেওয়া যায় না। তিনি দলীয় নেতা আবদুল মান্নান, বেগম সাজেদা চৌধুরীসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি এবং বাংলার বাণী, খবর, বিবিসিসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত সকল সংবাদপত্র ও সংবাদসংস্থার উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবী জানান”। তাঁর এই বক্তব্যে যে-পরিস্থিতির তিনি উল্লেখ করেছেন তার সঙ্গে এখনকার অবস্থা আমি সকল বিবেকবান মানুষকে তুলনা করতে বলি। ঠিকই। ‘কোন অবস্থাতেই এ পরিস্থিতি মানিয়া নেওয়া যায় না’। সেই ১৯৮৮ সালে যেমন তেমনি এখনও। দুই হাজার চৌদ্দ সালেও। (দেখুন, ‘জনগণ এই নির্বাচনে ভোট দেয় নাই’ –শেখ হাসিনা; দৈনিক ইত্তেফাক ৪ মার্চ ১৯৮৮)। সাংবাদিক সম্মেলনে অনেকে ছিলেন, তাঁদের মনে থাকার কথা। ড. কামাল হোসেন, আবদুল মমিন, আবদুল জলিল, তোফায়েল আহমেদ, শেখ সেলিম, খ.ম.জাহাঙ্গীর ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তো সেই সংবাদ সম্মেলনে হাজির ছিলেন। শেখ হাসিনার এই বক্তব্যের সাক্ষী তাঁরাও।

দৈনিক সংবাদ (৪ মার্চ ১৯৮৮) থেকে জানা যায় শেখ হাসিনা বলেছিলেন এরশাদ সরকারের হাতে সংবিধান ও গণতন্ত্র কোনটাই নিরাপদ নয়। এই সরকার বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় টিকে আছে। সরকার ভোটের প্রক্রিয়া নষ্ট করে দিয়েছে এবং যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। সরকার দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। স্বৈরশাসন পাকাপোক্ত করতে এবং গণধিকৃত বিশেষ একটি গোষ্ঠির স্বার্থ রক্ষার জন্য ‘চক্রান্ত’ চলছে। জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারের নির্বাচনী চক্রান্ত ব্যর্থ করেছে। ইত্যাদি বিস্তর কথা। শেখ হাসিনা এটাও জানিয়েছিলেন সেই সময় সংসদ ও ৪টি পৌর কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজধানী এবং চট্টগ্রামে ১০ জন নিহত হয়েছে। আবারও বলা দরকার, সন্ত্রাস ও সহিংসতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে মোটেও নতুন কিছু নয়।

এবার আসা যাক ১৯৯৬ সালে। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে। তার আগে থেকেই আওয়ামি লিগ হরতাল, ধর্মঘট ও বিভিন্ন সহিংস কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের চেষ্টা করে। তারা ১৯৯৪ সালের পর থেকে পার্লামেন্টও বর্জন করে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য তীব্র আন্দোলন শুরু করে দেয়। প্রায় সব বিরোধী দলই ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করেছিল। ভোট পড়েছিল মাত্র শতকরা ২১ ভাগ। তিনশ আসনের মধ্যে অধিকাংশ আসনেই, বলা বাহুল্য, বিজয়ী হয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। এই নির্বাচন মূলত আওয়ামি লীগের আন্দোলনের মুখে জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্যই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী ২৮ মার্চ ১৯৯৬ তারিখে গৃহীত হবার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জুন মাসে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার পর সেদিনই সন্ধ্যায় ধানমন্ডিতে তাঁর বাসভবনে শেখ হাসিনা যথারীতি সাংবাদিক সম্মেলন করেন। এবারও শেখ হাসিনা বলেন, বিরোধী দলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘জনগণ প্রহসনের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে’।সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি প্রেসিডেন্টকে ৯০ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে নির্বাচন করবার আহ্বান জানান। কিন্তু কিভাবে সেটা আইনী বা সাংবিধানিক ভাবে সম্ভব? তাঁর যুক্তি ছিল প্রেসিডেন্ট তার ‘সাংবিধানিক ক্ষমতা’ প্রয়োগ করে সেটা করতে পারেন। সে ক্ষমতা প্রয়োগ করে তিনি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি অথবা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কোন একজন বিচারক কিম্বা দেশের একজন বিশিষ্ট নাগরিকের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করবেন এবং নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন।

সেই সময় শেখ হাসিনা ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে যা বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া বর্তমান নির্বাচন সম্পর্কেও হুবহু একই কথা বলতে পারেন। শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে ‘দেশের ৯৫ ভাগ লোক সরকারের প্রতি অনাস্থা ব্যক্ত করেছে’। ফলে সরকার ‘দেশ শাসনের কর্তৃত্ব ও বৈধতা’ হারিয়েছে। জনগণের এই রায়ের পর বাংলাদেশের মাটিতে বিএনপি সরকারের আর কোন অস্তিত্ব নাই বলেও তিনি দাবি করেছেন। বিএনপি সরকারের ‘একদলীয় প্রহসনের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান’ করে তিনি দেশবাসীর প্রতি অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘অতীতেও জাতি কোন স্বৈরাচার ও তাদের সহযোগীদের হুমকি ও ভয়ভীতির কাছে মাথা নত করে নি। বলেছেন, ‘বিএনপির নির্লজ্জ মহড়া কাউকেই ভোট কেন্দ্রে নিতে পারে নি’।

জনগণকে এই ‘সংকটময় মুহূর্তে ধৈর্য ধারণ’ করবার আহ্বান জানাতেও তিনি ভোলেন নি। নিরাপত্তা বাহিনী এবং বিএনপির ক্যাডারদের হাতে কিছু সংখ্যক নিরীহ মানুষ নিহত ও বহু আহত হওয়ায় সেই দিন ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এখন অবশ্য ২০১৪ সালে তার হাতেই নিরীহ মানুষ নিহত ও আহত হচ্ছে। বহু বিরোধী দলীয় কর্মীকে গ্রেফতার করার প্রতিবাদ করেছিলেন। এখন অবশ্য বিএনপির প্রায় পুরা নেতৃত্বকে গ্রেফতার করেও ক্ষান্ত হন নি, বেগম খালেদা জিয়াকেও গৃহবন্দী করে রেখেছেন যাতে তিনি নিজের ডাকা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে না পারেন। হিংসাত্মক কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন সেই দিন। এখন যেমন খালেদাও জানাচ্ছেন।

ভোট সম্পর্কে তিনি সংবাদপত্রের বরাত দিয়ে নিজের একটা বর্ণনাও হাজির করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী সত্যিকার ভোটার ভোট কেন্দ্রে যায় নি, কোন কোন কেন্দ্রে একজনও না। বিদেশি পর্যবেক্ষকসহ নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের অভিমত অনুযায়ী অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র ছিল সারাদিন জনশূন্য। বিপুল সংখ্যক কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার পোলিং অফিসার ছিলেন না। তারা পেশাজীবী সংগঠন সমূহের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রহসনের নির্বাচন বর্জন করেছে। তবে আলোকচিত্র সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার লক্ষ্যে কিছু কিছু কেন্দ্রে ভয়-ভীতি দেখিয়ে বা অর্থ ছড়িয়ে গরীব মানুষদের হাজির করেছে সরকার। তাদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা হয়েছিল। কাজেই ভোট পড়েছে বলে সংখ্যা যতই দেখানো হোক সেই সংখ্যা আসলে বানোয়াট এবং অগ্রহণযোগ্য। তত্ত্ব কথাও বলেছেন শেখ হাসিনা । যেমন, সামরিক একনায়কতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য। সামরিক একনায়কতন্ত্রে ক্ষমতার উৎস হোল বন্দুকের নল, কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে দেশ শাসনের জন্য ভোটের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নিতে হয় । শেখ হাসিনা তখন এই নীতি বিশ্বাস করতেন কিনা বলা কঠিন। তবে এখন যে এইসব শীতকালীন সর্দি অনেক আগেই নাক থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন তা পরিষ্কার। এ সবই তিনি বলেছিলেন ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালের সাংবাদিক সম্মেলনে। আগ্রহী পাঠক ১৬ ফেব্রুয়ারির ইত্তেফাকের খবর পড়ে দেখতে পারেন। শিরোনাম: ‘প্রেসিডেন্টের প্রতি শেখ হাসিনার আহ্বান, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করিয়া ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দিন’।

শেখ হাসিনা তখন দাবি করেছিলেন, “আমাদের লক্ষ্য একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। যেহেতু এ সরকার ক্ষমতায় থাকার আইনগত বৈধতা হারাইয়াছে, সেহেতু আমি দেশবাসী এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদেও সুহৃদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলতে চাই এখন থেকে এ সরকারের আদেশ-নির্দেশ, কার্যক্রম, অঙ্গীকার কোন কিছুরই আর কোন আইনগত বৈধতা থাকিবে না”। ঠিক একই ঘোষণা বিএনপিও এখন দিতে পারত। কিন্তু বিএনপির সেই হিম্মত নাই, রাজনৈতিক দূরদর্শিতারও প্রকট অভাব রয়েছে। স্মৃতিপদার্থের অভাব অন্যদের কম থাকলে অসুবিধা হয় না। কিন্তু জাতীয় রাজনৈতিক দল যখন ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, তখন তার দায় তার নিজেকেই নিতে হয়।

শেখ হাসিনার নয় দফা ও আন্দোলনের ধরণ

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে। বিএনপি সরকারের অবর্তমানে দেশে যাতে কোন সংকট সৃষ্টি না হয় সেই লক্ষ্যে জনগণ ও সকল রাজনৈতিক দল মিলে প্রেসিডেন্ট ও তার প্রশাসনকে সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করবার কথাও বলেছিলেন। অর্থাৎ শেখ হাসিনা বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করবার জন্য আইনী পরিমণ্ডলের মধ্যে থেকে যা যা বুদ্ধিমান কৌশল অবলম্বন করা দরকার তার সবই করেছিলেন।

এই সংবাদ সম্মেলনেই শেখ হাসিনা তাঁর বিখ্যাত ৯-দফা নীতিমালা ঘোষণা করেন। ইতিহাসের রহস্য বা প্রহসন বুঝতে হলে এই নয় দফা আমাদের ভুলে যাওয়া মোটেও ঠিক না। এখানে তাই শেখ হাসিনার নয় দফা আমি উদ্ধৃত করছি। (ইত্তেফাক ১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৬)

১। বিএনপি সরকারে আহ্বানে দেশের ৯৫ শতাংশের অধিক জনসাধারণ ভোটদান না করার মধ্য দিয়ে সরকারের প্রতি অনাস্থা ব্যক্ত করেছে এবং একই সঙ্গে বিরোধী দলের প্রতি তাদের আস্থা ও সমর্থন ব্যক্ত করিয়াছে।

২। জনসাধারণের বিপুল রায়ে বিএনপি সরকার দেশ শাসনের কর্তৃত্ব ও বৈধতা হারাইয়াছে। জনসাধারণের এই রায়ের পর বাংলাদেশের মাটিতে বিএনপি সরকারের আর কোন অস্তিত্ব নাই।

৩। যেহেতু বিএনপি সরকার এখন আর বৈধ সরকার নয়, সেহেতু সাংবিধানিক সংকট এড়াবার জন্য দেশের সকল আইনসঙ্গত কর্তৃত্ব ও প্রশাসন এখন প্রেসিডেন্টের উপর ন্যস্ত হতে হবে।

৪। সকল প্রশাসনিক কাঠামো, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সশস্ত্র বাহিনীসহ সকল আইনসঙ্গত সংস্থা এখন সরাসরি প্রেসিডেন্টের নিকট হইতে আদেশ গ্রহণ করবে।

৫। প্রেসিডেন্টের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট সচিবগণ বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনা করিবেন।

৬। টিএনও, ডিসি, বিভাগীয় কমিশনার, এসপি, পুলিশ কমিশনার এবং থানা, জেলা ও বিভাগের অন্যান্য আইনসঙ্গত সংস্থাগুলি সরাসরি সংশ্লিষ্ট সচিবগণের নিকট থেকে আদেশ গ্রহণ করবেন।

৭। তিন বাহিনী প্রধান, ক্যাবিনেট সচিব এবং সকল সচিব প্রেসিডেন্টের নির্দেশে সরকার পরিচালনা করিবেন।

৮। দেশে যেন কোন সংকট সৃষ্টি না হয় সেজন্য বিএনপি সরকারের অনুপস্থিতিতে দেশের শান্তিপ্রিয় জনগণ এবং সকল রাজনৈতিক দল প্রেসিডেন্ট ও তার প্রশাসনকে সার্বিক সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করবে, এবং

৯। দেশের জনগণের পক্ষে আমরা এখন অবিলম্বে প্রেসিডেন্টের সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ এবং ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি অথবা এ্যাপিলেট ডিভিশনের একজন বিচারপতি অথবা দেশের একজন বিশিষ্ট নাগরিকের নেতৃত্বে একটি তত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ জানাচ্ছি।

(দেখুন, দৈনিক ইত্তেফাক ১৬ ফেব্র“য়ারি ১৯৯৬)।

আজ এতোটুকুই থাক। লেখাটি শেখ হাসিনাকে নিন্দা করার জন্য লিখি নি। যারা এতদিন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিলেন তাদের একটু ইতিহাস সচেতন করবার চেষ্টা করছি মাত্র।

সন্ত্রাস ও সহিংসতা বাংলাদেশের রাজনীতির ধর্ম। এটা ষাট দশক থেকেই শুরু হয়েছিল। এই ক্ষেত্রে আওয়ামি লীগের প্রতিভা অবিসংবাদিত। এটা সমালোচনা নয়। বিদ্যমান ক্ষমতার দমনমূলক ও সশস্ত্রতার চরিত্র অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, গণবিক্ষোভ গণআন্দোলন ও গণসংগ্রাম রাজনৈতিক বাস্তবতার কারনেই সহিংস ও সশস্ত্র হয়। হতে বাধ্য। এটা চাওয়া না চাওয়া ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার নয়, সহিংসতা ত্যাগ করা না করার মামলাও নয়। যে রাষ্ট্রে নাগরিক ও মানবিক অধিকার স্বীকৃত, বিচার বিভাগের কাছে অন্যায়ের নালিশ জানালে প্রতিকার পাওয়া যায়, নাগরিকদের কথা বলার স্বাধীনতা স্বীকৃত, আইন যেখানে নাগরিকদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেয়, পুলিশ ও আইন শৃংখলা বাহিনী যে দেশে নাগরিকদের রক্ষা করে, গুম করে না, আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালায় না, কিম্বা যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বে যে দেশের সরকার নিজের নাগরিকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ও সহিংস অভিযান চালায় না – সেই দেশে অবশ্যই শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন সম্ভব। কিন্তু নাগরিকদের অধিকার পদদলিত করে যে দেশের সরকার নিজেই নিজের নাগরিকদের উপর সশস্ত্র ও সহিংস অভিযান চালায় সেই দেশে প্রতিরোধ গণআন্দোলন গণসংগ্রামকে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ থাকতে বলা চূড়ান্ত কপটতা কিম্বা বিশুদ্ধ আহাম্মকি ছাড়া কিছু নয়। অথচ মানুষ ঠিক এই অধিকারগুলো আদায়ের জন্যই আন্দোলন-সংগ্রাম করে। পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের হিংস্র ক্ষমতার মুখে বাংলাদেশের জনগণকে অস্ত্র ধরতে হয়েছিল, যাকে আমরা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বলি। মুক্তিযুদ্ধ সহিংসই ছিল অহিংস ছিল না। বাংলাদেশে জনগণের মুক্তির সংকল্প পাকিস্তানী সংবিধান আইন কিছুই মানে নি।

যারা ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের লড়াই সংগ্রামকে সহিংস ও সশস্ত্র বলে এক তরফা নিন্দা করছেন, আশা করি তাঁরা ইতিহাস পড়বেন। ফ্যাসিবাদ নিজে সশস্ত্র ও সহিংস অথচ জনগণকে শান্তি ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা বলে। এই কপটতার পক্ষে কোলাহল আরও কপট। যারা শান্তির নসিহত করতে শুরু করেছেন তাদের জন্য করুণা ছাড়া কী আর করার আছে!

তবু বলব, আমরা নিয়মে বিশ্বাস করি, নইলে সমাজ টেঁকে না। হিংসা পরিহার করাই শ্রেষ্ঠ নীতি, কারণ হিংসা যে কাউকেই গ্রাস করতে পারে। আসলে নৈতিক সংবেদনার প্রতি সাড়া দেওয়া কিম্বা অপরের প্রতি উদার ও সহনশীল হবার সামাজিক তাগিদে অহিংসা চর্চা আমাদের সহজাত; নিয়মের মধ্যে দাবিদাওয়া আদায়ের চেষ্টাই মানুষ করে। কিন্তু যাদের নিয়ম রক্ষা করবার কথা তারা যখন তা ভঙ্গ করে তখন নিয়মের মধ্যে থাকবে কে? নিয়মের মধ্যে চলা নিয়মের অভ্যাসে বেড়ে ওঠা মানুষের স্বাভাবিক চরিত্র। কিন্তু যে রাষ্ট্র নিরন্তর সেই নিয়্ম ভঙ্গ করে সেই রাষ্ট্রে নিয়ম মানার অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র। নিয়মের মধ্যে থাকার নৈতিক প্রবণতা ও হিংসার বিরুদ্ধে মানুষের সংবেদনা অমূল্য এবং তার চর্চা সমাজে অবশ্যই দরকার। কিন্তু যে নিয়ম আদতে অনিয়ম, তাকে ভাঙা ছাড়া নিয়মের প্রবর্তন কি করে সম্ভব? যে অহিংসার বয়ান হিংসার ওপর দাঁড়ানো -- যার পেছনে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দানবের মতো দাঁত বের করে আমাদের গিলে খেতে চায়, তাকে জনগণ মানবে কেন? এরপরও অনেককে দেখছি রাষ্ট্রের অনিয়ম ও হিংসা অক্ষত ও বহাল রাখার জন্যই গণ আন্দোলন গণ সংগ্রামকে নিয়মতান্ত্রিক ও অহিংস হবার নসিহত দিয়ে যাচ্ছে। নির্বিচারে। এই অসম্ভব দাবি সরব হয়েছে নৈতিক সংবেদনা থেকে নয়, ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার মতাদর্শ হিসাবে।

যারা নিয়মতান্ত্রিক অহিংস গণআন্দোলন দেখতে পাবার আবদার করছেন তারা ধরে নিয়েছেন যে রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন সেই রাষ্ট্র  ও সরকার বুঝি নিয়মতান্ত্রিক আচরণ করছে; মানে, নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার রাষ্ট্র মানে, জনগণের মৌলিক ও মানবিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই  আইন শৃংখলা বাহিনী বুঝি তাদের আচরণ ঠিক  করছে। গণআন্দোলন সহিংস নাকি অহিংস হয়ে উঠবে তার নির্ধারক ক্ষমতাসীন শক্তি। ক্ষমতাসীনদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা আন্দোলনকে নিয়মতান্ত্রিক ও অহিংস পরিমণ্ডলের মধ্যে সীমিত রাখতে চায় কিনা। গণআন্দোলন অহিংস নাকি সহিংস হবে তার ট্রিগার সবসময়ই সরকারেরই হাতে থাকে। রাজনৈতিক বিরোধ সহিংস বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে দমন এবং  তার পালটা প্রতিক্রিয়া থেকে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের সরকারী আচরণ থেকেই এখনকার সহিংসতার জন্ম। এই পরিস্থিতিতে একতরফা গণআন্দোলনের ধরন বিশেষত সহিংসতাকে নিন্দা করার একটাই অর্থ:  ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়ানো, সাফাই গাওয়া।

রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে অসঙ্গতি থাকলেও দুই পক্ষের কারো প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন না করে নিরপেক্ষ জায়গায় দাঁড়িয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশের দাবি জানাচ্ছেন অনেকে। তাঁদের সংবেদনাকে সম্মান করা ছাড়া পথ থাকে না। কিন্তু বিদ্যমান সংগঠিত হিংসা ভিন্ন জিনিস। এই ক্ষেত্রে শান্তির দাবি সহিংস রাষ্ট্রের উকিলগিরির অধিক কিছু নয়। রাজনীতি ও রাষ্ট্রের নির্মোহ বিচারে আদৌ তা কোন কাজে আসে না। নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে বিদ্যমান হিংস্র ব্যবস্থার নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা ও হত্যাযজ্ঞ সমর্থন করবার জন্য দুনিয়াতে কখনই লোকের অভাব হয় নি। আর সেটা সবসময়ই হয়েছে শান্তির নামে, নিয়মের নামে, আইনের শাসনের নামে। তারপরও প্রতিরোধ গণআন্দোলন গণসংগ্রামের ধরণ নিয়ে পর্যালোচনার প্রয়োজন অস্বীকার করা যাবে না। সেটা অবশ্যই জরুরী। কিন্তু রাষ্ট্রের ধরণ, সরকারের সন্ত্রাসী চরিত্র ও আন্দোলনের রাজনৈতিক মর্ম বাদ দিয়ে তাকে নীতিবিদ্যায় পর্যবসিত করলে ফায়দা নাই। এতে নীতি ও রাজনীতি দুটোই অস্পষ্ট হয়ে পড়ে।

শেখ হাসিনা কি করে বিরোধী দলকে দমন করতে হয় জানেন। সেখানে তিনি নীতি মানেন না। নিয়ম মানেন না, সংবিধান আইন কিছুই মানেন না। কিন্তু বিএনপি আওয়ামি লীগের তুলনায় এই ক্ষেত্রে এখনও শৈশবাবস্থা পার করে নি বলা যায়। তবে ক্ষমতাসীন থাকার সময় এই প্রতিভার চর্চা তারাও করেছিল। কিন্তু সত্য এই যে সন্ত্রাস ও সহিংসতায় আওয়ামি লীগের জুড়ি মেলা ভার। বাংলাদেশে আন্দোলনের যে সকল ধরণ নিয়ে এখন বিরোধী দলের সমালোচনা হচ্ছে তার সবই আওয়ামি লীগের রাজনৈতিক চর্চা থেকে গড়ে উঠেছে, আওয়ামি লীগ একে জাতীয় ঐতিহ্যে পরিণত করেছে।

আবারও বলি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সন্ত্রাস ও সহিংসতা মোটেও নতুন কিছু নয়। কিন্তু স্মৃতিভ্রংশ কপটদের হঠাৎ সহিংসতার প্রশ্নে ভাজা মাছ উলটে খেতে জানিনা ভাব দেখে বিস্মিতই হতে হয়। সহিংসতা কখনই কাম্য হতে পারে না, নীতিও নয়। ঠিক। কিন্তু রাষ্ট্র যেখানে সহিংস ও ত্রাস সৃষ্টি কারী সেই বাস্তবতায় আন্দোলনের ধরণ সহিংস কি অহিংস হবে সেটা আগাম নির্ধারণ করা কিভাবে সম্ভব?

এটাই তো প্রশ্ন।

১৮ জানুয়ারি ২০১৪। ৫ মাঘ ১৪২০। আরশি নগর।

 

 

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।