খালেদার জয়-পরাজয়


এক

আগের লেখায় আন্দোলনের ধরণ নিয়ে আলোচনা করেছি (দেখুন, ‘হাসিনার নয় দফা ও আন্দোলনের ধরণ’ - নয়াদিগন্ত, ১৯ জানুয়ারি ২০১৪)। সেই প্রসঙ্গে ছিয়ানব্বইয়ের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচন সম্পন্ন হবার পর তখনকার বর্জনের নেত্রী শেখ হাসিনার বিখ্যাত ‘নয় দফা’র কথাও সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছি। বেগম খালেদা জিয়া ১৫ জানুয়ারিতে যে কর্মসূচী ও বক্তব্য দিয়েছেন তার সঙ্গে শেখ হাসিনার নয় দফা তুলনা করলে মনে হয় বিএনপি আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট অর্জন সম্পর্কে অস্পষ্ট। অন্যদিকে গণমাধ্যমের প্রপাগান্ডায় আন্দোলনের ধরণ নিয়ে উৎকন্ঠিত।

বিএনপি আইন মেনে চলা ভোটাভুটির দল। উদার ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যেই তাকে থাকতে হবে। তাই এই উৎকন্ঠা স্বাভাবিক। কিন্তু উৎকন্ঠাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে বিএনপি অতীতে বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলনে যেভাবে সন্ত্রাস ও সহিংসতা ঘটেছে তার ইতিহাস মনে রাখে নি। অস্বীকার করবার উপায় নাই যে স্বাধীনতার পর অতীতের যে কোন আন্দোলনের চেয়ে এবার আন্দোলনের ছিল ব্যাপক ও জনগণের অংশগ্রহণও ছিল বিপুল। ঢাকা অন্যান্য জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ঘটনা এর আগে একাত্তরের পর দেখা যায়নি। আন্দোলনের দিক থেকে এটা ছিল সুস্পষ্ট বিজয়; জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের এই শক্তিকে খালেদা জিয়া কতোটা মূল্যায়ন করতে পেরেছেন, বলা মুশকিল। কারণ ২৯ ডিসেম্বরের শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্রের অভিযাত্রা সরকারের মারমুখী সহিংসতার কারনে সফল করা যায় নি। আইনশৃংখলা বাহিনীর নিষ্ঠুর দমন পীড়নের মাত্রা অতীতের যে কোন আন্দোলনের তুলনায় সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। রাস্তার নামার সঙ্গে সঙ্গে গুলি করবার নজির অবিশ্বাস্য। আন্দোলনের বিস্তার ও বিপুল অংশগ্রহণের ফলে সহিংসতা অতীতের তুলনায় অনেক বেশী দৃশ্যমান ছিল।

তবে জনগণের প্রতিরোধের রূপ বা ধরণের দিক থেকে, এবারও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস মোকাবিলা অতীতের গণআন্দোলনের ধরণ কিম্বা মাত্রা অতিক্রম করে নি। এই দিকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইনশৃংখলা বাহিনীর নিষ্ঠুর দমন পীড়নের বিরুদ্ধে কেউ গ্রেনেড বা স্বয়ংক্রিয় কোন অস্ত্র নিয়ে নেমে পড়েছে এমন কোন নজির বা অভিযোগের কথা জানা যায় নাই। গান পাউডার দিয়ে বাস ও বাসের আরোহীদের পুড়িয়ে মারা, মলটভ ককটেল (১৮ দল ছুঁড়লে যার নাম বদলে গিয়ে হয় ‘পেট্রল বোমা) মেরে যানবাহন আগুনে ছাই করে দেয়া, রেল স্টেশন পুড়িয়ে ফেলা, রেল লাইনের স্লিপার উপড়ে ফেলা – ইত্যাদি সকল প্রকার ‘তাণ্ডব ও সন্ত্রাস’ আওয়ামি লীগ ও শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে দেখিয়েছেন এবং শিখিয়েছেন, তার খালেদা জিয়ার সরকার বিরোধী আন্দোলনে দুইপর্বে। এটাই এদেশে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ বা ফর্ম হিসাবে আন্দোলনের ধরন হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এবার বিরোধী দল বারবার অনেক ঘটনাকে সরকার পক্ষেরই করা অন্তর্ঘাতমূলক কাজ বলে নিন্দা ও প্রতিবাদ করেছে, এই ক্ষেত্রে তাদের দায়দায়িত্ব অস্বীকার করেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ তদন্ত হয় নি। সরকারপক্ষীয় গণমাধ্যমগুলোর একপক্ষীয় মিথ্যচারে সত্য আড়াল হয়ে গিয়েছে।

ক্ষুব্ধ হয়ে বাসে আগুন দেয়া এক জিনিষ আর গানপাউডার সাথে বয়ে নিয়ে বাসে আগুন দেয়া চরিত্রের দিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ধরণ। এমনকি যাত্রীদের নামার সময় ও সুযোগ দেওয়া হয় নি। যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ক্ষেত্রে এই দুই ধরণের রূপ আরও ঘনিষ্ঠ পর্যালোচনার দাবি রাখে। মানুষকে বাস থেকে বের হতে না দিয়ে গান পাঊডার দিয়ে আগুন লাগানো এবং পুড়ে যাওয়া অসহায় মানুষগুলোকে বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসা ও ক্রমাগত জনগণের ন্যায় সঙ্গত আন্দোলন-বিক্ষোভের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রচারের কাজে ব্যবহারের মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে কিনা সে প্রশ্ন উঠেছে। এর কোন জবাব এখনও মেলে নি। এ ভাবে পুড়িয়ে মারা ও বার্ন ইউনিটে তা প্রদর্শনের প্রপাগাণ্ডা কৌশল ক্ষমতাসীনদের দমনমূলক রাজনীতিকেই মদদ জোগায়। অপকর্মটি বিরোধী রাজনীতির কাণ্ড কিনা সন্দেহ তৈরী করে। ফলে এর নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠ তদন্ত হওয়া খুবই জরুরী।

সরকারি সশস্ত্রতার বিরুদ্ধে অনন্যোপায় হয়ে পালটা ভয় দেখানোর শব্দ তৈরি করা বা ঘরে বোমা তৈরী করে ভীতিকর ধোঁয়া সৃষ্টি করার ‘’আরবান টেররাইজেশন’’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচারে গণআন্দোলনের সীমার মধ্যেকার তৎপরতা বলেই স্বীকার করে নেওয়া হয়। একেও অনেকে নিন্দা করতে পারেন, ঠিক আছে। কিন্তু এর কারণে গণবিক্ষোভের ন্যায্যতাকে নাকচ করে দেবার রাজনীতি সমর্থনের সুযোগ নাই। সেটা হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি,তাদের প্রপাগান্ডার অস্ত্র। অথচ তারা নিজেরা এর চেয়েও অনেক বেশী সন্ত্রাস ও সহিংসতা করেই আজ ক্ষমতায় বসে আছেন। লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় হত্যাকাণ্ডের কথা নাইবা তুললাম!

আন্দোলন-সংগ্রামে ক্ষুব্ধ ও সীমিত সহিংস চরিত্র থাকা, আর মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া এক কথা নয়। গানপাউডার ব্যবহার আর সর্বোপরি যাত্রীদের নেমে যাবার সময় ও সুযোগ না দিয়ে আগুনে পোড়ানো সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া সহিংসতা। কারা তা করেছে তা খুঁজে বের করা ও অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রধান নভি পিল্লাইও তাঁর হুঁশিয়ারিমূলক বিবৃতিতে, “আরোহি যাত্রীদের নামার সময় ও সুযোগ না দিয়ে” যানবাহনে আগুন দেবার কথা স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছিলেন। প্রাণহানিতে নিহত মানুষ ফিরিয়ে আনা যায় না, অন্য সব ক্ষতি হয়ত পূরণীয়। ফলে এ কাজ নিন্দনীয় এবং আন্দোলনের এই আওয়ামী ধরণকে অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। কিন্তু পটকা বা ঘরে তৈরী বোমা এর আগেও ব্যবহার করা হয়েছিল। এবারও হয়েছে।

যেটা নতুন সেটা হচ্ছে রাস্তায় মিছিল নিয়ে নামা মাত্রই পুলিশের গুলি চালানো। বুক ও মাথা লক্ষ্য করে হত্যার জন্য গুলি ছোঁড়া এর আগে ছিল না। নতুন প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীদের থেকে শোনা, তাঁরা বলছেন দশজনেরও একটা মিছিল নিয়ে যদি রাস্তায় নামতে চাই আর সাথে যদি দুইটা ককটেলও না থাকে তবে পুলিশের গুলি খেয়ে মরতে হবে। কারণ পুলিশ আমাদের দেখে ফেললে তাদের ভয় দেখানোর জন্য আমাদের কয়েক সেকেন্ড সময় দরকার যাতে দ্রুত নিরাপদ একটা অবস্থানে সরে গিয়ে আশ্রয় জুটিয়ে নিতে পারি। একাজে ককটেলের ভয় দেখানো ধোঁয়া আর শব্দ একটু কাজের হয়, কিছুটা সময় দেয়। বেশ কিছু জায়গায়, বিশেষত রাজশাহীতে ও লক্ষ্মীপুর জেলায় দেখা গিয়েছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে সাধারণ পোশাকে কিছু ব্যক্তি আইন শৃংখলা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা করছে। রাষ্ট্র বা সরকারী বাহিনীর সন্ত্রাস ও তার সঙ্গে যুক্ত থেকে তাদেরই আশ্রয়ে ক্ষমতাসীনদের দলীয় সহিংসতার এই ধরনগুলো অতীতে মুজিব আমলেও দেখা যেতো। বলা বাহুল্য গণমাধ্যমগুলোর অধিকাংশই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কিভাবে মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে সে ব্যাপারে নিশ্চুপ থেকে আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধকেই তাদের প্রপাগান্ডার কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত করেছে। এই সময় কতজন মানুষ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি এবং নির্যাতনে নিহত হয়েছেন এবং বিপরীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধে কি পরিমাণ প্রাণহানী ঘটেছে এই দুই পরিসংখ্যানের মধ্যকার ফারাক বিস্ময়কর। বাংলাদেশের বেয়াল্লিশ বছরের ইতিহাসে এতো বড় হত্যাযজ্ঞ এর মাঝে ঘটেনি।

তবুও বলা দরকার যারা রাজনীতিতে সন্ত্রাস ও সহিংসতা চান না,তাদের সংবেদনার সঙ্গে আমরা একদমই একমত। কিন্তু সেটা বন্ধ করতে হলে প্রথমে নজর দিতে হবে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও সন্ত্রাসের ওপর। নাগরিকরা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ভঙ্গ করলে রাষ্ট্র ও সমাজ তৎক্ষণাৎ ভেঙ্গে পড়ে না। কিন্তু রাষ্ট্র ও সরকার যখন সংবিধান,আইন,মানবাধিকার কিম্বা নীতিনৈতিকতা, নাগরিক ও মানবিক অধিকার কিছুই মানে না, নিজেই নিজের নাগরিকদের বিচার ছাড়া হত্যা করে তখন রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। তখন সন্ত্রাস ও সহিংসতা যে উচ্চ মাত্রায় পৌঁছায় তা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো ছাড়া তুরীয় উত্তাপ থেকে নেমে আসা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ে।

রাজনীতিতে সন্ত্রাস ও সহিংসতা কমিয়ে আনা দ্বিতীয়ত নির্ভর করে আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের ভূমিকার ওপর। যদি সরকারের নীতি হয় দিল্লীর আত্মঘাতী রণনীতি বাস্তবায়ন -- অর্থাৎ যেভাবেই হোক বাংলাদেশ থেকে ইসলামপন্থীদের শারিরীক অর্থে নির্মূল, তাহলে আন্দোলনকে সহিংস করবার দায়দায়িত্ব ষোল আনা ক্ষমতাসীনদের। অথচ আইনের শাসন ও শক্তিশালী নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতি চর্চার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সহিংসতা কমিয়ে আনার কার্যকর শর্ত তৈরী করা সম্ভব।

এমনিতেই নাগরিক ও মানবিক অধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্র, সরকার, রাজনৈতিক দল বা গ্রুপ এবং সকল নাগরিককে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রাখার রাজনৈতিক গুরুত্ব বোঝার সামর্থ আমাদের নাই বললেই চলে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি তখনই সম্ভব যখন নাগরিক অধিকারের সীমার মধ্যে সকল ধরণের রাজনীতি ও মতাদর্শ চর্চা করার সুযোগ অবাধ থাকে। এই মৌলিক সুত্রের দিকে নজর ফেরানোর মত রাজনৈতিক দিশা সমাজে ও সংস্কৃতিতে অনুপস্থিত। বিএনপিও এসব দিকে খোঁজখবর রাখে বলে মনে হয় না, তাদের আগ্রহও দেখা যায় না। অথচ এটাই হতে পারত জনগণকে বিভক্ত নয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ করার মূলনীতি।

হাসিনার নয় দফার সঙ্গে তুলনা করলে আমরা দেখব গণ আন্দোলনের কৌশল সম্পর্কে বিএনপি যারপনাই অস্পষ্ট, এখন অবধি আন্দোলনের সফলতা ব্যর্থতা নিয়ে তারা গভীর ভাবে ভাবেনি। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার ক্ষেত্রে নীতি ও কৌশল নির্ণয় করবার দুর্বলতাগুলো তাদের মধ্যে প্রকট। এটা এখন বেশী ধরা পড়ছে কারন বাংলাদেশের জন্য এই আন্দোলন অতীতের যে কোন আন্দোলনের তুলনায় অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ এবং দেশের ভবিষ্যৎ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নির্ধারক হয়ে উঠেছে। বিএনপির নেতারা খেয়াল করলে দেখতেন, শেখ হাসিনা কিভাবে আন্দোলন করতে চাইছেন। সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ হাসিনা বিরাট কোন থিসিস হাজির করেন নি। যে বক্তব্য নির্বাচনী ইশতেহারে থাকার কথা সে বক্তব্য আন্দোলনের মাঝখানে খালেদা জিয়ার সাংবাদিক সম্মেলনে দেওয়াটাও দুর্বল সিদ্ধান্ত ছিল। এই মুহূর্তে সেটা ছিল বেদরকারী। মনে হয়েছে অপ্রাসঙ্গিক ভাবে কাটপেস্ট করে বেখাপ্পা ভাবে বেগম জিয়ার বক্তব্যের মাঝখানে কিছু বক্তব্য জুড়ে দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা গত আন্দোলনে সরকার উৎখাতের কথাই বলেছিলেন, যে সরকারকে ‘অবৈধ’’ বলেছেন, তাদের সঙ্গে সমঝোতার কথা বলেন নি। সংবিধান ব্যবহার করে প্রেসিডেন্টের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কিভাবে ‘অবৈধ’ সরকার উৎখাত করতে হবে তার ফর্মুলাই তিনি হাজির করেছিলেন। সাংবিধানের মধ্যে থেকেও কিভাবে ক্ষমতাসীন সরকারকে উৎখাত করা যায় সে কথাই নয়টি দাবির মধ্য দিয়ে পেশ করেছেন। যে কারনে গত লেখা আমি নয় দফার ওপর লিখেছি।

খালেদা জিয়া বর্তমান সরকারকে অবৈধ বলছেন,তাহলে নিয়মতান্ত্রিক দল হিসাবে আইন ও সংবিধানের মধ্যে থেকে এই ধরণের সরকারকে উৎখাতের ফর্মুলাই জনগণ তাঁর কাছে চেয়েছে। শিখতে হবে, খালেদার বিরুদ্ধে যখন সহিংস আন্দোলন করছিলেন তখন ‘অবৈধ’ সরকারের সাথে সমঝোতা বা সংলাপ করতে হাসিনা চাননি, আহবানও জানাননি।

দুই

হাউস অব কমন্স ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশ নিয়ে বিতর্কের সারকথা হচ্ছে জবরদস্তি ঢাকায় যারা ক্ষমতায় রয়েছে তাদের ওপর দ্রুত নির্বাচন করবার জন্য মৃদু চাপ তৈরী। ধারণা করা যায়, যে চাপই আসুক কাজ হবে না। শেখ হাসিনা খানিক বিরক্ত হবেন হয়তো, যথারীতি তিনি তা এড়িয়ে চলবেন। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য নির্ধারিত দিল্লীর রণনীতিটাই তিনি অনুসরণ করবেন। তাঁর গণবিচ্ছিন্নতা বিবেচনায় রেখে নির্মোহ ভাবে বিচার করলে এই নীতি অনুসরণই তাঁর দিক থেকে সঠিক। তার সামনে আর কোন পথ খোলা নাই। এর সঙ্গে ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিশেষত দক্ষিণপূর্ব ভারতের প্রশ্ন জড়িত। বাংলাদেশে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরী করবার মধ্য দিয়ে উত্তরপূর্ব ভারতের সমস্যা সমাধানের নীতি দিল্লীর চোখ দিয়ে দেখতে হবে। দেখলে দিল্লীর রণনীতি ও শেখ হসিনার রণরঙ্গিনী মুর্তি মোটেও ভুল বা মন্দ বলা যাবে না। অর্থাৎ দিল্লীর স্বার্থের দিক থেকে তাকালে এটাই উভয়ের জন্য সবচেয়ে লাভজনক নীতি। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর বিদ্রোহ সমূলে উৎখাত করতে চাইলে দিল্লীর কাছে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির চেয়ে ভাল সুযোগ ভবিষ্যতে দিল্লীর জন্য আসবে কিনা সন্দেহ। অতএব শেখ হাসিনাকে নিঃশর্ত ভাবে সমর্থনই দিল্লী ঠিক মনে করছে। সম্ভবত এই ধরনের নির্বাচনই দিল্লী চেয়েছে। হাসিনার বিপক্ষে বাংলাদেশের জনগণের ভোট দেওয়া ও তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবার প্রক্রিয়াটাই দিল্লী রুখতে চেয়েছে। এখন অবধি দিল্লী ভারতীয়দের কাছে বাংলাদেশের “স্বাধীনতা বিরোধী” অর্থাৎ “ইসলামী সন্ত্রাসীদের” দমন করা দু’দেশের নিরাপত্তার জন্য দরকারী বলে জনমত তৈরী করতে পারছে। এটা ছল হলেও দিল্লী এখনও এতে সফল। সফলতার অর্থ হচ্ছে ভারতীয়দের এই প্রচারণায় বোঝানো যাচ্ছে, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে ইসলামপন্থীদের দমন করা না গেলে বাংলাদেশে আবারও উত্তরপূর্ব ভারত ও কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ক্যাম্প গাঁড়বে এবং সীমান্তের ওপার থেকে ভারতের অভ্যন্তরে সহিংস কার্যকলাপ চালিয়ে যাবে। অতএব দিল্লী-ঢাকা যৌথ অভিযানের এই রণনীতি ভারতের নিরাপত্তার জন্যই জরুরী। ঘন ঘন বাংলাদেশের অ-মুসলমান জনগোষ্ঠির উপর অত্যাচার নির্যাতন নিজে সৃষ্টি করে হলেও হিন্দু সম্প্রদায়কে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িক ও হিন্দু বিদ্বেষী মুসলমানদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এই নীতিটা চালিয়ে যাওয়া দরকার।

অন্যদিকে দিল্লীর ধারণা, বাংলাদেশের জনগণকেও বোঝানো যাচ্ছে এটা একাত্তর সালের মতো স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তির রণধ্বণিও অভিন্ন। দিল্লীর এই রণনীতির পক্ষে বাংলাদেশে শক্তিশালী সংবাদমাধ্যম রয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশপন্থী গণমাধ্যম নাই বললেই চলে। সর্বশেষ দৈনিক ইনকিলাবও সিল গালা হয়ে গেল, তার প্রকাশনা আটকে দেয়া হয়েছে ।

শাহবাগের আন্দোলন দিল্লীর রণনীতির পক্ষে শক্তিশালী যুক্তি। শাহবাগের বিশাল ‘গণজাগরণ’ এটাই প্রমাণ করে বাংলাদেশের জনগণ জামায়াতে ইসলামি, হেফাজতে ইসলাম ও নানান কিসিমের ইসলামি দলের হাত থেকে নিষ্কৃতি চায়। দিল্লী যুক্তি দিচ্ছে, এই “অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ” শক্তিকে ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে কাজে লাগানো উচিত। অতএব একাত্তর সালে ভারতীয় সৈন্যসহ দিল্লী যেভাবে বাংলাদেশকে সরাসরি যুদ্ধে সমর্থন করেছিল সেই একই ভাবে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন করে ইসলামপন্থীদের এখনই ‘নির্মূল’ করতে হবে। আফটার অল, এটা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। খালেদা জিয়ার সঙ্গে সংলাপ তখনই করা হবে যখন তিনি জামায়াত ও হেফাজতকে ত্যাগ করে আসেন। তিনি যদি না আসেন তাহলে বিএনপির মধ্যে জামায়াত বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নেতা ও কর্মীদের বড় একটি অংশই তাঁকে ত্যাগ করে নতুন দল গঠন করবে এবং দিল্লীর রণনীতি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে। এ প্রসঙ্গে গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক টাইমসের দ্বিতীয় রিপোর্টে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা গওহর রিজভিকে উদ্ধৃত করে লেখায় তার মন্তব্য পাঠক পড়ে দেখতে পারেন। বাংলাদেশের একাত্তরের অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পূর্ণ করার মধ্য দিয়ে দিল্লী ভারতের উত্তরপূর্ব অঞ্চলের সকল প্রকার বিদ্রোহের সমুচিত জবাব দিতে চায়।

এটা ভাববার কোনই কারন নাই যাঁরা শাহবাগে অংশগ্রহণ করেছেন এবং যারা একে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন গণ্য করেন তাদের সকলের সঙ্গে দিল্লীর এই রণনীতির আদৌ কোন সম্পর্ক রয়েছে। বরং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী সালমান খুরশিদ শাহবাগকে সমর্থন দেওয়ায় শাহবাগের আন্দোলনের ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশের একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার যারা আন্তরিক ভাবেই চেয়েছেন তাঁরা কোন ভাবে দিল্লীর এই রণনৈতিক পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত নন। বিশাল একটি অংশ শেখ হাসিনার রাজনীতিরও সমর্থক কিনা সন্দেহ। আওয়ামি লীগের প্রতি পক্ষপাত রয়েছে, কিন্তু দলটির এখনকার রাজনীতির সমর্থক নন তাঁদের সংখ্যাও শাহবাগে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কম নয়। তবে ক্ষুদ্র একটি অংশ এখনও আওয়ামী রাজনীতির গুটি হিসাবে এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে।

দিল্লীর এই রণনীতির পক্ষে ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণ থাকবে এই অনুমানও ভুল। আমরা শুধু দাবি করতে চাইছি বে-আইনী ও অবৈধ সরকার বিষয়ক সঙ্কট ও বর্তমান গণবিচ্ছিন্নতার কারণে শেখ হাসিনা বিপদে আছেন, দুর্বল তিনি। এই দুর্বলতার জন্য দিল্লীর এই রণনৈতিক অবস্থানের ফাঁদে আরও গভীর ভাবে জড়িয়ে যেতে তিনি বাধ্য এবং তার পরিণতি বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের জন্য শুভ পরিণতি বয়ে আনবে না। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক দাবি করেন যে দিল্লীর পররাষ্ট্র নীতি যে রাজনৈতিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় তা ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা ঠিক হয় না। বরং ঠিক হয় সাউথ ব্লকে, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে; আর তা ঠিক করেন আমলারা। এটা পরিষ্কার,বাংলাদেশের প্রতি দিল্লীর বর্তমান নীতি বাস্তবতা বর্জিত, এই নীতির মধ্যে প্রাজ্ঞতা, বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টির প্রকট অভাব রয়েছে। শেখ হাসিনার দুর্বলতার সুযোগ দিল্লী পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ করছে। দিল্লীর নিঃশর্ত সমর্থনের জোরে অন্যান্য দেশের পক্ষ থেকে দেওয়া চাপ হাসিনা তোয়াক্কা করবেন না; এটাই বলতে চাইছি।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ফরাসি,ওলন্দাজ ও জার্মানদের বর্ণবাদ ও ইসলাম বিদ্বেষ অপরিচিত কিছু নয়। তারা শেখ হাসিনার ইসলাম দমনকে প্রশংসার চোখেই দেখে। দিল্লী জানে একটা পর্যায়ে “ইসলামী সন্ত্রাসের” বিরুদ্ধে দিল্লী-ঢাকা যৌথ অভিযানের প্রতি ইউরোপের সমর্থন থাকবে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

তিন

এবার ‘গুজব’। ইন্টারনেটে ওয়েবসাইট ও ফেসবুকসহ বিভিন্ন আসমানি নেটওয়ার্কগুলো ‘বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতি’র কথিত তথ্যে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে এবং ১৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেইসব তথ্যকে ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ বলে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে। পাশাপাশি দৈনিক ইনকিলাবের সাংবাদিকদের গ্রেফতার ও প্রেস সিলগালা করে দিয়েছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। তারা সেই কথিত-তথ্যের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অস্বীকারের কথাও ছেপেছিল। খবরটির শিরোণাম করেছিল,“সাতক্ষীরায় যৌথবাহিনীর অপারেশনে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তা! : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অস্বীকার ” -- এভাবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুযায়ী ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতির খবর ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। সেটা অবশ্যই হতে পারে বা হয়ত আসলেই তাই। কিন্তু সুষ্ঠ তদন্তের মধ্য দিয়ে প্রমাণ না করে গণমাধ্যমের ওপর দমনপীড়ন চালানোর কারনে বিষয়টির মীমাংসা হবে না। বরং আরও জটিল হবে; সন্দেহকে আরও তীব্র করবে। বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে ভারতীয় গোয়েন্দারা উত্তর পূর্ব ভারতের বিদ্রোহীদের এর আগেও ধরে নিয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে ভারতীয় অপারেটিভসদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তৎপরতা চালানো নতুন তথ্য নয়। দ্বিতীয়ত নিজের দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ দমনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, এক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতাও প্রচুর। এই অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে সাতক্ষীরার পরিস্থিতি দমনে রাজনৈতিক ভাবে দুর্বল ও গণবিচ্ছিন্ন সরকার দিল্লীর কাছে সামরিক সাহায্য চাইতেই পারে। দিল্লী নিজ দেশের বাইরে এই ধরণের গোপন অভিযানে অংশ নিয়েছে কিনা সেটা ভিন্ন তর্ক। কিন্তু রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা ও গোপনীয়তাই এই তর্ককে বিপজ্জনক করে তুলেছে।

গুজব হোক কি সত্য হোক আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে এই খবরের রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। বাংলাদেশের জনগণ কিম্বা বাংলাদেশের সরকার এই ধরনের গুজবের প্রতি কী ধরণের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে তার দ্বারা দিল্লীর প্রতি বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক সংবেদনা পরিমাপ করা যাবে। এই অঞ্চলে আগ্রহী প্রতিটি পরাশক্তি তাকে গুরুত্বের সঙ্গেই পর্যালোচনা করবে। ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র কেমন হতে পারে তা এই প্রতিক্রিয়া থেকে আন্দাজ করা যাবে অনায়াসেই। দিল্লী চাইলেও এই ‘গুজব’ কে হাল্কা করতে পারবে না।

অন্যদিকে ‘সার্বভৌমত্ব’ সংক্রান্ত প্রাচীন ধারণা মাথায় রেখে শক্তিশালী দেশগুলো আজকাল আর কাজ করে না। সেটা আমরা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে -- বিশেষত লিবিয়া, সিরিয়ায় দেখেছি। ফলে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে বিদেশী সৈন্য ঢুকে পড়তেই পারে। এটা অবাক হবার মতো কোন অবাস্তব ‘গুজব’ নয়। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাই বলে বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক ভাবে বিভক্ত ও দুর্বল দেশকে দিল্লী যেমন খুশী তার রণনীতির জন্য ব্যবহার করতেই পারে। করবে না কেন? দিল্লী যদি মনে করে বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি তাহলে প্রকাশ্য বা গোপন যে কোন সামরিক অভিযান চালানো গোলকায়নের (গ্লোবালাইজেশনের) এই যুগে খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দুনিয়া ব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধেরই অংশ। দিল্লী সেই যুদ্ধেরই আঞ্চলিক সম্প্রসারণ ঘটাতেই পারে। ফলে এই ‘গুজব’ শাঁখের করাতের মতো কাজ করবে। স্বীকার করলে যা, না করলেও তাই।

ফেইসবুকে আফসান চৌধুরী ইতোমধ্যে জনমত বোঝার জন্য প্রশ্ন করে সকলের কাছে জানতে চাইছেন, ভারতীয় সৈন্য যদি জানমাল রক্ষার জন্য সাতক্ষীরার অভিযানে অংশগ্রহণ করে তাদের সমর্থন করা যায় কিনা। যদি না যায় তার মানে একাত্তর সালে ভারতের সমর্থন -- অর্থাৎ ভারতীয় সৈন্য আমাদের রক্ষা করবার জন্য বাংলাদেশে প্রবেশ ও যুদ্ধ করার বিপক্ষেই আমরা তর্ক করছি। আর, ভারতীয় না হয়ে অন্য কোন দেশের সেনাবাহিনী যৌথ অভিযানে অংশ গ্রহণ করলে সেটা গ্রহণযোগ্য হোত কিনা। আফসান চৌধুরী এই জনমত জরিপে কেন আগ্রহী হলেন তিনিই ভাল বলতে পারবেন। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যমতে যদি তা ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ হয় তবে সেই ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ ‘গুজব’ নিয়ে মতামত জরিপের আয়োজনও কি সমান ‘ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ নয়? এছাড়া এসব সেন্সেটিভ “গুজব” নিয়ে ছেলেখেলাও মারাত্মক বিপদজনক সন্দেহ নাই। তবে তিনি ঠিকই ধরেছেন আমাদের সমাজে এই ভাবে চিন্তা করবার মানুষও আছে। তাদের মতামত জানার চেষ্টা একদিক থেকে অনেক প্রশ্ন তৈরী করলেও যে কারুরই এই প্রশ্নগুলো সম্পর্কে অন্যদের মত জানার অধিকার হয়ত আছে, কিন্তু উস্কানির দিকটা উপেক্ষা করবেন কি করে? আর মানুষের জানমাল রক্ষার নামে হিউমেনিটারিয়ান ইন্টারভেনশান বা মানবিক অভিযান তো দেশে দেশে চলছেই। নিজের পছন্দের হলে জাতিসংঘও তা অনুমোদন করে।

চার

এবার খালেদা জিয়ার সাংবাদিক সম্মেলন পরবর্তী বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় সকলেই উদ্বিগ্ন ও উৎকন্ঠিত। গণতন্ত্র সম্পর্কে সমাজে ধারণা ও চর্চার যে পার্থক্য সেই তর্ক থাকলেও নানা কারণে দেশে একটি সহনশীল পরিবেশ বজায় থাকুক এবং বর্তমান সংকটের একটি মীমাংসা হোক সমাজের বড় একটি অংশ সেটাই চায়। যদিও আমি আমার লেখায় বারবার বলেছি রাজনৈতিক বিভাজনের যে বিষে বাংলাদেশ আক্রান্ত সেই বিষ থেকে মুক্তি খুব সহজে ঘটবে বলে মনে হয় না। সেই তর্ক এখানে নতুন করে তুলব না।

মাঠের আন্দোলনের ধরণে সাময়িক বিরতি দিয়ে খালেদা জিয়া ২০ জানুয়ারি গণ সমাবেশ ও ২৯ তারিখে কালোপতাকা মিছিলের ডাক দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতা এবং বিএনপির চরিত্রের কারনে উদার রাজনীতির পরিমণ্ডলের বাইরে খালেদা জিয়ার পক্ষে যাওয়া কঠিন। সেই দিক থেকে তাঁর বিরতির সময় নির্ধারণ ছিল সঠিক। বিশেষত হাউস অব কমন্স ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্টে বিতর্কের আগে আবারও সমঝোতার পথ খোলা রেখে নতুন ভাবে আন্দোলন গোছানোর জন্য সময় নিয়েছেন তিনি। তার বক্তব্য ও অবস্থানের দুর্বলতা আগে উল্লেখ করেছি। এখন তার অর্জনের দিকগুলো বলব।

আন্দোলনে বিরতি দেওয়া ও সময় নেওয়াকে ক্ষমতাসীনরা পরাজয় হিসাবে গণ্য করছে। ক্ষমতাসীনদের পক্ষের গণমাধ্যমগুলো আন্দোলনের কর্মীদের মনোবল ভেঙ্গে দেবার জন্য এই দিকগুলো ফলাও করে প্রচারও চালাচ্ছে। বিএনপি একটি নির্বাচনের দল। ফলে নির্বাচনের বাইরে থাকা এই দলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। তারপরও বলা দরকার খালেদা জিয়া আন্দোলন মাঠে রেখে কোন আপোষের মধ্য দিয়ে এখনও ক্ষমতায় যেতে চান নি; এই দিকটা স্পষ্ট। তবে সামনে খোলা দুটো পথের একটার দিকে তিনি হাঁটছেন এটাই আমরা হয়ত এখন দেখব। যদিও দুটোই ‘যদি’’, ‘কিন্তু’ ’ ইত্যাদিতে ভরা।

প্রথম পথ; আপাত দৃষ্টিতে সহজ পথ। বিএনপির এখনকার চরিত্র আমলে নিয়ে কূটনৈতিক মহলের ওপর নির্ভর করে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে থাকা। এ পথেই তিনি থাকতে চান, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্য ভাবেই তিনি তা চাইলে দেখাতে পারেন। যদিও শেখ হাসিনা তাকে সেদিকে থাকতে দেবেন, নাকি ঘরে অথবা জেলে আটকে রাখবেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। শেখ হাসিনার সরকার বে-আইনী ও অবৈধ। এই সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। দিল্লী ছাড়া প্রায় সব দেশই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে আদৌ কোন নির্বাচন বলে গণ্য করছে না। তারা নতুন নির্বাচন চায়। জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে। কাজেই বিএনপির দিক থেকে বিচার করলে এগুলো স্পষ্টই আন্দোলনের নগদ বিজয়ের দিক। তিনি ক্ষমতার বাইরে আছেন, সন্দেহ নাই। কিন্তু সেটা সাময়িক। তাঁর ক্ষমতায় যাবার পথ বাস্তব পরিস্থিতির নিজস্ব লজিকের কারনেই ঘটতে থাকবে। বেশ কিছু দেশের নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশের পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে এই সিদ্ধান্তেই পৌছাচ্ছে যে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে সহনশীল ও উদার রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগের বিপরীতে বিএনপিকে দুর্বল করার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশকে, তাদের ভাষায়, ‘উগ্র রাজনীতির রণক্ষেত্রে’ পরিণত করা। ফলে নতুন নির্বাচনের জন্য শেখ হাসিনার ওপর চাপ অব্যাহত থাকবে। এই দিক থেকে বিচার করলে আন্দোলন বিএনপির জন্য ইতিবাচক ক্ষেত্র তৈরী করেছে। এটা আমরা কমবেশী নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি।

যদিও এই লেখার শুরুতে বলেছি গণ আন্দোলন সহিংস থাকবে নাকি অহিংস হবে তা মূলত নির্ভর করে ক্ষমতাসীনদের আচরণের উপর। অর্থাৎ খালেদার ভুমিকা সেকেন্ডারি। আর দমনপীড়নে ক্ষমতাসীনেরা যদি লাভের গুড় বেশি দেখে তবে গণ আন্দোলনকে সহিংস দিকে তারাই ঠেলে দিবে। এই পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে হাতপা বেঁধে ঘরে বা জেলে রাখতে ক্ষমতাসীনরা কুন্ঠিত হবে না। আসলে এই পথে খালেদার সাফল্য নির্ভর করছে মূলত হাসিনার উপর কূটনৈতিক মহলের চাপ সৃষ্টি করা ও সেই চাপের সাফল্যের ওপর। তার অর্থ তাকে দ্রুত আরেকটি নির্বাচনে বাধ্য করা। এই সম্ভাবনার ওপর আস্থা রাখার মত পরিস্থিতি এখনও তৈরী হয় নি। এককথায় বললে, পরাশক্তির ভাষায় বাংলাদেশকে “উগ্র রাজনীতির রণক্ষেত্রে পরিণত করার” বিপদ ঠিক তাদের মত করে দেখতে হাসিনাকে এখনও তারা রাজি করাতে পারে নি; এমনকি রাজি করানোর ধারে কাছেও যেতে পারে নি। ফলে এপথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের সুরাহা হবে কিনা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। চূড়ান্ত ভাবে কি ধরনের চাপ পারাশক্তিগুলো শেখ হাসিনার ওপর প্রয়োগ করছে তার ওপর সেটা নির্ভর করবে।

খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় যে জয় সেটা হচ্ছে একটি অসাম্প্রদায়িক ও লিবারেল গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দল হিসাবে আন্তর্জাতিক ভাবে আওয়ামি লীগের ভাবমূর্তি নস্যাৎ করে দেওয়া। আমাম্র মনে হয় খালেদা জিয়ার ক্ষমতায় যাবার চেয়ে আওয়ামী রাজনীতির এই ভণ্ড দিক্টির উন্মোচন আন্দোলনের বিশাল সাফল্য। আওয়ামি লিগের যে ভাবমূর্তি ছিল খালেদা জিয়া তা দেশে বিদেশে মারাত্মক ভাবে ক্ষুণ্ণ করতে পেরেছেন। আওয়ামী লীগের যাঁরা সমর্থক তাঁরা দলটিকে অসাম্প্রদায়িকতার জন্য সমর্থন করেন। কিন্তু আওয়ামি লীগের যারা সমালোচক তারা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে যে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক দল নয়। তাদের মুখে ফুলচন্দন দিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের সাম্প্রদায়িক চরিত্র এবার প্রকট ভাবেই দেখিয়ে দিয়েছে। নিজের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি উদ্ধার করা আওয়ামী লিগের জন্য খুবই কঠিন হবে। যে সকল এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও উপাসনার জায়গাগুলো ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে সেই সকল এলাকায় আওয়ামী লীগের ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রশাসনের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয় এবারই প্রথম হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদসহ যারা নিজেদের “সেকুলার জনগোষ্ঠি” মনে করে তারা দাঙ্গার জন্য প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগকেও দায়ী করেছে। এর দায় এক তরফা ইসলামপন্থী দল ও বিএনপির ওপর চাপিয়ে দেবার প্রাণান্ত চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগ সফল হয় নি।

খালেদা জিয়া হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠি ও নাগরিকদের সুরক্ষার কথা বারবার বলেছেন, কিন্তু তাকে কার্যকর করবার ক্ষেত্রে তার জোটের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কোন পদক্ষেপ ও তৎপরতা দেখা যায় নি। হতে পারে, সরকারী দমন পীড়নের মুখে সেটা সম্ভব ছিল না। এই অজুহাত দেওয়াই যায়। কিন্তু দুর্বল ও অসহায় নাগরিকদের জান, মাল ও উপাসনার ক্ষেত্র এবং আক্রান্ত জনপদ্গুলোতে সরাসরি হাজির থেকে প্রাণ দিয়ে তাদের রক্ষা করার মধ্য দিয়েই বিএনপিসহ তাঁর জোটের সদস্যরা বাংলাদেশের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হতে পারেন। এটাই একমাত্র পথ, কাগুজে ঘোষণা দিয়ে নয়। সাম্প্রদায়িকতাকে কোন ভাবেই বরদাশ্‌ত না করবার যে নীতির কথা খালেদা জিয়া বলেন, এবার তাকে যে কোন মূল্যে সেটা প্রমাণ করতে হবে।

তৃতীয়ত; আওয়ামী লীগ দিল্লীর বশংবদ একটি রাজনৈতিক দল এই ভাবমূর্তি আরও গভীর হয়েছে। সাধারণ জনগণের বিশ্বাস অর্জন শেখ হাসিনার পক্ষে আগের চেয়েও তুলনামূলক ভাবে কঠিন হবে। এই ক্ষেত্রে কতিপয় গণমাধ্যমের নীতিনৈতিকতা বিবর্জিত নির্লজ্জ মিথ্যাচার ও প্রপাগাণ্ডা কোন কাজে আসবে না। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নিরন্তর দমন পীড়ন ছাড়া শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনা কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠবে।

পাঁচ

খালেদা জিয়ার সামনে দ্বিতীয় যে পথ খোলা আছে সেটা কঠিন। সেটা বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের পথ। সেই পথে তিনি অনেকদূর এসেছেন। আগামি দিনে কতোদূর যাবেন এই মূহূর্তে বলা মুশকিল। তাঁকে ভেবে দেখতে হবে কূটনৈতিক মহল হাসিনার উপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে নতুন নির্বাচনে বাধ্য করতে আদৌ সক্ষম হবার সম্ভাবনা আছে কিনা। ইতোমধ্যেই আমরা দেখেছি হাসিনা এই ধরনের চাপের তোয়াক্কা করেন না। খালেদা জিয়াকে ভাবতে হবে শুধু বাইরের চাপে শেখ হাসিনার অবৈধ ও বেআইনী সরকার পরাস্ত হবে না। যদি হোত সেটা অনেক আগেই ঘটত। কূটনৈতিক মহলের ঘাড়ে বসে একটা নির্বাচন পাবার সম্ভাবনা আগের চেয়ে এখন হয়তো একটু বেশী। কিন্তু কূটনৈতিক সমর্থন তা নিশ্চতিত করবার জন্য যথেষ্ট নয়। খালেদা একটি সুষ্ঠ নির্বাচন চাইলেও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ছাড়া তা আদায় করা সম্ভব কিনা তা নি্যেও ঘোর সন্দেহ রয়ে গিয়েছে।

শেখ হাসিনা গগণবিচ্ছিন্ন এবং ক্ষমতায় থাকার বৈধতা তাঁর নাই -- এর সবই সত্য। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়াকে বুঝতে হবে, শেখ হাসিনা নয়, তাঁকে কার্যত লড়তে হচ্ছে দিল্লীর বিরুদ্ধে। বিশেষ ভাবে দিল্লীর দক্ষিণ এশীয় রণনীতির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই বাস্তবতাই আজ নির্ধারক শর্ত। এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনরত জনগণের সঙ্গে তিনি কতোদূর যাবেন সেই সিদ্ধান্ত তাঁর।

ইতিহাসের সদর রাস্তায় সকলে হাঁটবার হিম্মত রাখেন না। তাঁদের সংখ্যা স্বল্পই হয়। খালেদা জিয়া নিজেকে তাদের অন্তর্ভূক্ত করবেন কিনা সেটা একান্তই তাঁর নিজের। দেখা যাক ভবিষৎ আমাদ্র কি দেখাতে পারে!

১৮ জানুয়ারি ২০১৪। ৫ মাঘ ১৪২০। আরশিনগর।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।