‘সেইম টু সেইম। আমরা আমরাই তো!’


সরকারের সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে বিস্তর তর্ক বিতর্ক হয়েছে এবং হচ্ছে। পত্রিকায় দেখছি সম্পাদক পরিষদও বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁরা আশংকা প্রকাশ করেছেন, সরকার গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন। প্রশ্ন হচ্ছে গণমাধ্যম তো পুরোটাই সরকারের নিয়ন্ত্রণে, আর কি নিয়ন্ত্রণ করবে ক্ষমতাসীনরা? সংশয় ও সমালোচনা সত্ত্বেও সম্পাদক পরিষদের এই বিবৃতি আমি সমর্থন করি। সেটা বলার জন্যই এই লেখা।

যাঁরা বিবৃতি দিয়েছেন তাদের মধ্যে এমন সম্পাদকও আছেন যারা অন্যের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে এর আগে অস্বীকার করেছেন। তারা সরকারের দলীয় সমর্থক। নির্বিচারে তারা সরকারের পক্ষাবলম্বন করেছেন। বিরোধী চিন্তা ও মতের বিরুদ্ধে হেন কোন অপপ্রচার বা কুৎসা নাই যা তারা করেন নি বা করেন না। নিজের মত প্রকাশের অধিকার তাদের আছে, সেখানে আপত্তির কিছু নাই। কিন্তু গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে অন্যের মত দমন করবার নীতি তারাও চর্চা করেন। এই ধরনের মিডিয়া সেটা আইন করে বা রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের মাধ্যমে করে না। প্রথমত করে নিজেকে অধঃপতিত করে। অর্থাৎ গণমাধ্যমের চরিত্র বিসর্জন দিয়ে স্বেচ্ছায় নিজেকে সরকারী বা রাষ্ট্রীয় মাধ্যমে পরিণত করার মধ্য দিয়ে। শুধু সরকারী চিন্তার প্রচার প্রপাগাণ্ডা করলেই এই অধঃপতন ঘটে না – বিরোধী চিন্তাকে গণমাধ্যমে অনুপস্থিত করে দেওয়া, গৌন করে দেওয়া বা তাকে বিকৃত ভাবে হাজির করা ইত্যাদি নানান পন্থায় সেটা হতে পারে। চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ শুধু রাজনৈতিক দল, সরকার বা রাষ্ট্রই করে এটা ভুল ধারণা। গুটেনবার্গ, ইলেক্ট্রনিক বা ডিজিটাল যাই হোক অনেক মিডিয়া স্বেচ্ছায় আনন্দচিত্তেই এই যজ্ঞে হরহামেশাই যোগ দেয়।

বাংলাদেশে এমনকি অনেকে সরাসরি রাষ্ট্রের দমন পীড়নের যন্ত্র ব্যবহার করে বিরোধী চিন্তা বা মতের ধারকদের শায়েস্তা করেছেন এমন উদাহরণও আছে। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এখনও কারাগারে। বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কথা বলে এমন কোন গণমাধ্যমকে সচল থাকতে দেওয়া হয় নি। দৈনিক আমার দেশের ছাপাখানা বেআইনী ভাবে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। আইন বহির্ভূত ভাবে দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ। বিরোধী রাজনৈতিক চিন্তা প্রকাশ ও প্রচারের স্বাধীনতা বাংলাদেশে নাই। যা লিখালিখি প্রচার প্রপাগাণ্ডা সব নিজেদের মধ্যেই। কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা নাই, প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনাও নাই।

এই পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রচার নীতিমালা সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি কিছুটা কৌতুহলও সৃষ্টি করে বৈকি। তাঁদের আপত্তি যেন এরকম যে বিরোধী রাজনৈতিক চিন্তা যেখানে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত এবং কার্যত খামোশ সেখানে সরকার পক্ষীয়দের নিজেদের মধ্যে সমালোচনা আত্মসমালোচনার ওপর এই ‘নিয়ন্ত্রণ’ কেন? কেন নিজেদের মাধ্যমকে সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে? আসলেই? কেন?

একটি মোবাইল ফোন কম্পানির বিজ্ঞাপন দেখি, সেখানে কাউয়ার চরের এক লোক ‘চান্দিছিলা’ এক টেকো লোকের টেকো মাথা নিয়ে ঠাট্টা করতে গিয়ে ধমক খেয়ে নিজের মাথার পরচুলা খুলে দেখালো। তারও ‘চান্দিছিলা’। বলল, তোমার ‘চান্দিছিলা তো মুইও চান্দিছিলা, এক্কেবারে সেইম টু সেইম। আমরা আমরাই তো!’ এরপর মোবাইল কম্পানির বয়ান: ‘নিজেদের মধ্যে সম্পর্কটাই অন্যরকম, দাবির সম্পর্ক’। সকলেই কম্পানির ‘পরিবারের সদস্য’, সুবিধাভোগী। তো ঝগড়া বিবাদটা বাইরের প্রদর্শন। আমরা আমরাই তো! সরকারের সঙ্গে গণমাধ্যমের এখনকার সম্পর্কও ‘দাবির সম্পর্ক'। আমরাতো সরকারেরই লোক; তো আমাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ কেন? সরকারের সঙ্গে গণমাধ্যমের বিরোধ ‘আমরা আমরাই তো’-র বেশী ভাববার কোন কারন ঘটে নি। এটাই তো মনে হয়। কিন্তু তারপরও সম্পাদকদের বিবৃতি আমি সমর্থন করি। কারন গণমাধ্যমের ওপর দলীয় ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি গণতন্ত্রের খুবই প্রাথমিক একটি দাবি। সেটা সমাজে যে কারনেই তোলা হোক, তাকে সমর্থন করা দরকার।

দুই

মিডিয়া ক্ষমতাবানদের পক্ষে সম্মতি তৈয়ার করে। অর্থাৎ জনগন যেন ক্ষমতাবানদের নীতি সমর্থন করে এবং তাদের পক্ষে থাকে তার জন্য কোন প্রকার দমন পীড়নের পথ না নিয়েই অহিংস কায়দায় মিডিয়া কাজটি করে – এটা নতুন কোন তত্ত্ব নয়। পুরানাই বলা চলে। মার্কিন ভাষাতত্ত্ববিদ ও মার্কিন নীতির ঘোর সমালোচক এডওয়ার্ড হেরমেন ও নোয়াম চমস্কির ‘মেনুফেকচারিং কনসেন্ট’ (Manufacturing Consent) বইটির সুবাদে আমরাও এখন ব্যাপারটা কমবেশী বুঝি। তাঁরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া সম্পর্কে বিশ্লেষণ করছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাবান শ্রেণির পক্ষে মিডিয়া কিভাবে কার্যকর ভূমিকা পালন করে সেটা তথ্য ও বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে বোঝানোই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। এই বইটির মধ্যে বাজার ব্যবস্থার মধ্যে গড়ে ওঠা এবং বাজার ব্যবস্থার মধ্যে সক্রিয় মাধ্যমগুলো ক্ষমতাসীনদের সমর্থন এবং কিভাবে প্রচার প্রপাগাণ্ডা (system-supportive propaganda function) চালাবার ভূমিকা পালন করে তার একটা তত্ত্বও খুঁজে বের করা যায়। প্রপাগান্ডা চালাবার তিনটি কারন গুরুত্বপূর্ণ।

এক. বাজার ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীলতা – এর দুটো দিক আছে। মিডিয়া হাউসগুলো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, অতএব তার পরিচালনার আদর্শ মুনাফা অর্জনের তাগিদের ওপর নির্ভরশীল। মিডিয়ায় যিনি টাকা ঢেলেছেন, তিনি তাঁর বিনিয়োগ যেমন তুলে আনতে চাইবেন, তেমনি বিনিয়োগ থেকে মুনাফাও কামাতে চাইবেন। যদি সরাসরি মিডিয়া থেকে তাঁর মুনাফা না আসে তাহলে মিডিয়া তাঁকে যে বিশেষ ক্ষমতা দেয় তাকে ব্যবহার করে তাঁর অন্য ব্যবসা থেকে তিনি ফায়দা আদায় করবেন, এটাই স্বাভাবিক। বাজার ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীলতার এটা প্রাথমিক দিক।

এরপর রয়েছে রেভিনিউ বা সরাসরি আয়ের প্রশ্ন। সেই ক্ষেত্রে মিডিয়া যারা দেখেন বা পত্রিকা যারা পড়েন তাদের কাছ থেকে মিডিয়া বিশেষ কিছুই আয় করে না। অতএব বিজ্ঞাপনের জন্য মিডিয়াকে বড় দেশী কম্পানি বা বহুজাতিক কম্পানির ওপর নির্ভর করতেই হয়। এই নির্ভরশীলতা ছাড়া টেলিভিশান, পত্রিকা বা রেডিও স্টেশান চালানো অসম্ভব। কোন মিডিয়া টিকে থাকতে চাইলে টাকা আয়ের উৎসগুলোর বিরুদ্ধে তারা দাঁড়াতে পারে না। দেশী বা বিদেশী বহুজাতিক কম্পানির স্বার্থের সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকলে মিডিয়া গণমাধ্যমের চরিত্র নয়, কম্পানির বা বিদেশী স্বার্থের চরিত্র পরিগ্রহণ করে। আর সেটা সরকারী নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে ওঠে, কারন রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা থাকে বা থাকতে চায় তারা ক্ষমতাবান শ্রেণি বা শক্তির বিপরীতে দাঁড়ায় না। দাঁড়ানো অসম্ভবই বলা যায়।

দুই. ক্ষমতাসীনদের চিন্তাধারা বহন করা, তাদের অনুমান, বিশ্বাস, ইতিহাসের ব্যাখ্যা, বয়ান বা গল্প ইত্যাদি নির্বিচারে মেনে নেওয়া ইত্যাদি হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের প্রপাগাণ্ডা হাতিয়ার হয়ে ওঠার দ্বিতীয় কারন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ সম্পর্কে আওয়ামি লিগ পন্থিদের দলীয় ব্যাখাকে বিশ্বাস করা ও সেই অনুমানকে সত্য ধরে নিয়ে সমাজে ঘটনাঘটনের বিচার করা একটি ভাল উদাহরণ হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধে আসলে কি ঘটেছিল, কিম্বা আওয়ামিপন্থিদের বয়ানই সঠিক বয়ান কিনা সেটা বিচার বা পর্যালোচনা না করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম যতোই সরকারের বিভিন্ন কাজের সমালোচনা করুক মতাদর্শিক ভাবে তারা আওয়ামি পন্থি ভূমিকাই পালন করে।

manufacturingতিন. নিজেদের ওপর নিজেদের সেন্সরশিপ চর্চা ক্ষমতাসীনদের পক্ষে প্রপাগান্ডা মডেলের তৃতীয় সূত্র। অর্থাৎ কোন খবর ছাপা হবে, কোন লেখককে জায়গা দেওয়া হবে কাকে হবে না, কী ধরণের সম্পাদকীয় নীতি গ্রহণ করা হবে ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের জন্য বিপজ্জনক খবর, বিশ্লেষণ, উপ সম্পাদকীয় ইত্যাদি পরিহার করা হয়। এটা করতে সরকার বা রাষ্ট্র মিডিয়াকে বাধ্য করে তা নয়। মিডিয়া নিজেই নিজের লেজ আগেই স্বেচ্ছায় কেটে দেয়, যাতে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাদের কোন বিরোধ বা গোল না বাঁধে।

চার. মোটা দাগে আদর্শগত দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে অবস্থান গ্রহণ চতুর্থ আরেকটি কারন। নোয়াম চমস্কি বোঝাতে চেয়েছিলেন স্নায়ু যুদ্ধের সময় কমিউনিজমের খেয়ে না খেয়ে বিরোধিতা আদর্শগত অবস্থান গ্রহণের প্রধান ক্ষেত্র ছিল। মার্কিন মিডিয়াগুলো কমিউনিস্ট বিরোধী ছিল। এণ্টি-কমিউনিজম ছিল মিডিয়াগুলোর আদর্শ।

পুরানা স্নায়ু যুদ্ধ এখন নাই। অতএব মিডিয়ার কমিউনিজম বিরোধিতাও আগের মতো প্রবল নয়। কিন্তু সম্প্রতি নোয়াম চমস্কি তার বইয়ের তত্ত্ব সংশোধন করতে গিয়ে বলেছেন, এন্টি কমিউনিজমের জায়গায় এখন প্রতিস্থাপিত হয়েছে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের’ আদর্শ। সন্ত্রাস দমন করতে হবে এই অজুহাতে দেশের আইন বদলানো থেকে শুরু করে, এ যাবত চিন্তা ও মতের স্বাধীনতার পক্ষে যে সকল কথা বলা হোত তার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে মিডিয়াগুলো। যারাই বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়ছে কিম্বা লড়তে বাধ্য হচ্ছে, তাদেরকে সন্ত্রাসী বলা হচ্ছে, এবং এদের বিরুদ্ধে মিডিয়া সুসংগঠিত প্রপাগান্ডা চালায়। এই প্রপাগান্ডা কমবার কোন লক্ষণ নাই। অচিরে কমবার কোন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের অধিকাংশ মিডিয়া স্বেচ্ছায় এই প্রপাগান্ডার ধারক ও বাহক।

তিন

মিডিয়া কিভাবে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে জনগণের কাছ সম্মতি আদায় করে নেয়, এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে হেরমেন ও চমস্কির প্রসঙ্গ এনেছি বাংলাদেশের সম্পাদনা পরিষদের সম্পাদকদের এটা বোঝানোর জন্য যে দুই একজনের কথা বাদ দিলে মিডিয়ার ভূমিকার মূল্যায়ন কোন সম্পাদকের ব্যাক্তিগত বিশ্বাস অবিশ্বাস বা তাদের ভাল মন্দ ভূমিকা দিয়ে বিচার করা যায় না। একটা ব্যবস্থার অধীনে থেকেই মিডিয়া কাজ করে, অতএব সেই ব্যবস্থাই মিডিয়ার চরিত্র কমবেশী নির্ণয় করে – হেরমেন ও চমস্কি যেভাবে বলেছেন।

মিডিয়া মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যবস্থার পক্ষে সমর্থন আদায় করবার ‘প্রপাগাণ্ডা মডেল’ নিয়ে আরও ভাবনাচিন্তা করা যায়। বিশেষত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই মডেল প্রয়োগের জন্য আমরা আরও কিছু যোগ করতেই পারি। কিন্তু এ লেখার উদ্দেশ্য সেটা নয়। তবে চমস্কির এই তত্ত্বকে বাংলাদেশে যেভাবে আমরা পড়ব ও বুঝব তার মধ্য দিয়ে নতুন অনেক কিছুই যুক্ত হয়ে পড়বে।

প্রথমত বুঝতে হবে, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটেছে বহু বছর আগে (১৭৬৫ – ১৭৮৩)। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে একটি গঠনতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রয়েছে তাদের যেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের হয়রানি ও নির্যাতন থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এই গণতন্ত্র তারা দীর্ঘদিন ধরে চর্চা করছে এবং চর্চার জন্য বিচার বিভাগ সহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান যেমন তারা গড়ে তুলেছে তেমনি গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে নাগরিকদের সচেতনতার চর্চাও তারা করে। চমস্কি আসলে বলছেন এই ধরণের রাজনৈতিক গণতন্ত্র এবং চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবার পরেও গণমাধ্যম একটি গণতান্ত্রিক দেশে শাসক বা ক্ষমতাসীনদের স্বার্থই রক্ষা করে – জনগণের নয়। বাজার ব্যবস্থায় গণমাধ্যম ক্ষমতাবানদের পক্ষাবলম্বনের ভূমিকা থেকে সহজে বেরিয়ে আসতে পারে না। শাসক শ্রেনির স্বার্থ রক্ষার ভূমিকাই তারা পালন করে। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা রক্ষা করার অর্থ তখন হয়ে ওঠে বহুজাতিক কম্পানি ও ক্ষমতাবান ক্ষুদ্র একটি শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। হেরমেন ও চমস্কির সারকথা হচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য রাজনৈতিক দাবি তুলে এবং তা বাস্তবায়িত করেই গণতন্ত্র কায়েম হয়েছে। কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক বাজার ব্যবস্থায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর সরকার ও রাষ্ট্র কোন হস্তক্ষেপ না করলেও বাজার ব্যবস্থার অন্তর্গত চরিত্রের কারণে গণমাধ্যম ক্ষমতাসীনদের স্বার্থই রক্ষা করে। গণতন্ত্রের জন্য ভিন্ন একটি সংকট তৈরি হয়।

জনগণের সম্মতি আদায়ের যে প্রপাগান্ডা মডেল চমস্কি পেশ করেন তাকে তাহলে বাংলাদেশে আকাট প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। আমরা গণতান্ত্রিক বিপ্লব করি নি, বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। যারা এখন ক্ষমতায় তাদের নৈতিক ও আইনী বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র কায়েমের রাজনৈতিক প্রশ্নের বাইরে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কথাটার কোন অর্থ হয় না। অর্থাৎ গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্ন সরাসরি একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের সঙ্গে জড়িত। অনেকটা শ্রমিকদের প্রতি লেনিনের যুক্তির মতো। গণতন্ত্র পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের জোয়াল থেকে শ্রমিককে মুক্ত করতে পারে না, কিন্তু তার রাজনৈতিক অধিকার আদায় করে নিয়ে শ্রমিককে পরবর্তী স্তরে লড়াইয়ের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। রাজনৈতিক অর্থে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অর্জনের দাবি ও তা আদায় করে নিলে বাংলাদেশে গণমাধ্যম স্বাধীন হয়ে যাবে না, কিন্তু রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রনের শেকল বা শৃংখল থেকে গণমাধ্যমের মুক্তির অবশ্যই দরকার আছে, নইলে পরবর্তীতে অর্থনৈতিক শৃংখলের দাসত্ব থেকে মুক্তির প্রশ্ন তোলার কোন সুযোগ তৈরি হবে না।

এই সকল দিক থেকেই সম্পাদক পরিষদ যে বিবৃতি দিয়েছেন, আমি তার বিরোধিতা করি না, সমর্থন করি। আমার সংশয় অন্যত্র। এই ধরনের সম্প্রচার নীতি তৈরিতে যেসব সাংবাদিক সরকারকে সহায়তা করেছেন তাদের সঙ্গে রেখে সম্পাদক পরিষদ আদৌ কোন ফল পাবেন কিনা। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কর্তব্য উহ্য রেখে নৈতিক ও আইনী দিক থেকে অবৈধ সরকারের কাছ থেকে গণমাধ্যমের ওপর থেকে দলীয় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ অপসারণ করা কঠিন।

সেটা করতে হলে গণমাধ্যমকে জনগণের রাজনৈতিক ইচ্ছা আকাংখার সঙ্গে সম্পৃক্ত হবার চেষ্টা করতে হবে। সেখানে মারাত্মক ঘাটতি আছে। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা গণমাধ্যমের চেয়েও জনগণেরই দরকার। কে কিভাবে এই দাবির পক্ষে দাঁড়ায় ও লড়ে তার দ্বারাই জনগণ বিভিন্ন মিডিয়ার মূল্যায়ন করবে।

২২ আগস্ট, ২০১৪, ৭ ভাদ্র, ১৪২১, শ্যামলী, ঢাকা

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।