প্রতিরোধের কবিতা : ফাদওয়া তওকন


ফিলিস্তিনের প্রেক্ষাপটে আধুনিক কালে প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার প্রশ্নে পথিকৃত কবি হিসাবে পরিচিত কবি ইব্রাহীম তওকনের সহোদরা কবি ফাদওয়া তওকনের জন্ম ১৯১৭ সালে নাবলুসের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পন্ন এক অভিজাত পরিবারে ।

ত্রিশ ও ১৯৩৫-৩৬’র গণঅভ্যুত্থানসহ চল্লিশের এবং পঞ্চাশের দশকগুলোতে কবিতায় ফাদওয়ার উপস্থিতি ছিলো অসাধারণ প্রতিরোধ মুখর। ১৯৬০ সালে লন্ডন সফর এবং সেখানে দুবছরের অবস্থান তার জীবনে ও কবিতাশৈলী সহ সামগ্রিক চিন্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন বয়ে আনে। আধুনিক হয়েও ঐতিহ্যনিষ্ঠ এবং মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী এই নারী দেশ, রাষ্ট্র, স্বাধীনতা ও জনগণের প্রশ্নে ছিলেন আপোষহীন। ফাদওয়া তওকনকে আরবী কবিতা ও নন্দনকলার ঐতিহ্যের সেই সব ক্ষণজন্মা নারীদের অন্যতম হিশাবে বিবেচনা করা হয় যারা আরবী প্রাচীন কাসীদার ধ্রুপদী কাব্যনৈপুণ্যরীতি থেকে বেরিয়ে এসে একইসাথে প্রাচীন সংগীতিয় ছন্দ-মাত্রা এবং আধুনিক কালের দেশীয় পরিমন্ডলের অন্তর্গত সুরের বিন্যাসে নতুন কাব্যভাষা নির্মাণে নিবেদিত ছিলেন। প্রতিরোধের কবিতা ছাড়াও সূফীবাদী, প্রকৃতিবাদী ও রোমান্টিকধারার প্রচুর কবিতা লিখেছেন ফাদওয়া। ফিলিস্তিনের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারসহ বহু আরব দেশ থেকে বিপুল সম্মাননা অর্জন করেন তিনি। তিনি ৮৬ বছর বয়সে ২০০৩ সনে মৃত্যুবরণ করেন। এখানে তাঁর বহুল পরিচিত ও পাঠক সমাদৃত তিনটি অসাধারণ কবিতার তরজমা পাঠকদের জন্য দেওয়া হল।

যায়নবাদীদের দখলের দিনে

আমি মৃত্যুকে দেখেছি একদা, দেখেছি বিশ্বাসঘাতকরা

গতির মুখে বারবার ফিরে আসছে

তারা আকাশের জানালাগুলো রুদ্ধ করে দিয়েছে

তারা তরঙ্গের পরাজয়ের দিনে

নগরীর শ্বাস-প্রশ্বাস টেনে ধরেছে

আর আমাদের আশারা ছাই হয়ে যায়

যখন বিকৃত মুখে তারা আলোর সামনে এসে

নিজেদের চেহারা তুলে ধরলো

এরপর বিপদের গলগ্রহে আটকে লুকিয়ে থাকলো

আমার দু:খ ভারাক্রান্ত নগরী।

শিশুরা লুকিয়ে গেছে, লুকিয়ে গেছে সংগীত

কোনো ছায়া নেই। কোনো শব্দ নেই।

শুধু আমার নগরীর ভেতর দু:খরা উলঙ্গ হয়ে

উর্বর পদক্ষেপের কাছে হামাগুড়ি খায়।

এখন আমার নগরীর ভেতর নীরবতা

নীরবতা পাহাড়ের মতো নিস্তব্ধ। উপুড়।

নিস্তব্ধতা রাতের মতো অস্পষ্ট।

নিস্তব্ধতা মৃত্যু আর পরাজয়ের গ্লানি বহন করা এক ট্রাজেডি।

হায় শোকাতুর নিস্তব্ধ নগরী

বুঝি এমনি ফসল তোলার দিনে

ফলফলাদি-শস্যরা পুড়ে যায় ?

হায় শেষ চক্র!

হায় শেষ চক্র!

তুফান এবং বৃক্ষ

অভিশপ্ত ঝড়ের দিন চরম তান্ডব লীলা খেলে গেছে

ব্যাপক বিস্তৃত হয়ে গেছে ঘোর কালো টর্নেডোর দিন।

বর্বর উপকূলেরা সবুজ সুষম এই মাটির বুকে

ছুঁড়েছে উন্মাতাল তুফান।

 

তারা বাকুম বাকুম চিৎকার করলো, আর অমনি পশ্চিমের জগত অতিক্রম করে

মানবময় ধ্বনিত হলো অনেক অনেক খবর!-

বৃক্ষরা ভেঙে গেছে!!

পর্বতকঠিন ডালপালা, কড়িকাঠি সবকিছু চূর্ণ হয়ে গেছে

আর কিচ্ছু নেই

নেই আর এতোটুকু বৃষ্টি

যেখানে আবার জেগে উঠবে বৃক্ষ!

 

বৃক্ষরা ভেঙে গেছে

মুছে গেছে আমাদের রক্তলাল নদীনালা

মুছে গেছে গতিমান আশক্ত শিকড়রাজি

যেখানে শরাবের বিকল্পে অসংখ্য লাশের টুকরোরা বইয়ে দিয়েছে রক্তের স্রোত

মুছে গেছে আরব বেদুঈনের কঠিন শিকড়

পাথরের মতো শক্ত হয়ে যা গভীরে প্রবেশ করতো

অনেক অনেক দূর বিস্তৃত হতো বিপুল গভীরে।

দেখো তবু বৃক্ষরা আবার তৎপর হয়ে উঠবে

শীঘ্রই সোজা দাঁড়িয়ে যাবে বৃক্ষ এবং সমস্ত ডালপালা।

অচিরেই সূর্যের আলোর মুখে

অংকুরিত হবে বৃক্ষের যাবতীয় হাসি।

এবং দেখো সেখানে অচিরেই পাখিরা আসবে

নিশ্চয়ই পাখিরা আসবে

পাখিরা আসবে অবশ্যম্ভাবী

নিশ্চিত পাখিরা আসবে

অবশ্যই পাখিরা আসবে

খুবই দ্রুত পাখিরা আসবে।

অস্তিত্ব

আমি ছিলাম পৃথিবীর পর

ঝুলন্ত অন্ধকারে তাড়িত এক প্রশ্ন।

জবাব থাকে গোপনে আড়ালে।

অথচ আমিই আমার জন্য

অজানা অন্ধকারের

এক নতুন আলোর উদ্ভাস।

নিয়তি তাকে ব্যক্ত করে

তাকে ঘিরেই

জগত ঘোরে

তাকেই ঘিরেই

জগত ঘোরে বারবার সারাক্ষণ।

এমনকি তার এক-অদ্বিতীয় আলোর বিকিরণে মিলে

নিঃশেষ হয়ে যায়।

নিকষ ঘন অন্ধকার লুপ্ত হয়ে যায়।

এবং দুটি ইন্তিফাদার ভেতর এখন

আমি আমার হাতে পেয়ে যাই

হারানো জবাব।

হে তুমি, তুমি হে সুদূর

হে নৈকট্য

স্মরণ করো না ডুবে যাওয়া। স্মরণ করো না অস্ত যাওয়া।

তোমার আত্মা জগতের আকার ধারণ করে

আমার জন্য, তোমার জন্য,

আমাদের জন্য, কবিদের জন্য।

তবু অস্তিত্ব সমস্ত দূরের সীমানা

মিলিয়ে দেয়!!


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।