যুদ্ধের বিবিধ অপচয়


পেশোয়ারে একটি মিলিটারি স্কুলে পাকিস্তানী তালেবানদের হামলা আমাকে স্তম্ভিত ও শোকার্ত করেছে। সেই বিষয়েই কয়েকটি কথা বলব।

দুই হাজার ১০ সালের ১৮ অক্টোবর মার্কিন ড্রোন হামলায় প্রাণঘাতী লোহার টুকরা দশ বছরের বালক নাসিমুল্লার বুক ও শরীর ভেদ করে বেরিয়ে যায়। শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকা মৃত নাসিমুল্লার ছবিটি ইন্টারনেটে দেখেছিলাম। সেটা এখনও আমার মনে গেঁথে আছে। উত্তর ওয়াজিরিস্তানের ফাতিমা। তার বয়সও আট থেকে দশের বেশি হবে না। একুশে মে ২০১০ সালে ড্রোন হামলায় নিহত তার ছবিও মনে আছে। মনে আছে অনেকের ছবি। যাদের ইন্টারনেটের বদৌলতে দেখেছি। কল্পনা করতে পারি আরও নিষ্পাপ নিরপরাধ শিশুর মৃত মুখ।

যারা মার্কিন ড্রোন হামলায় হতাহতের পরিসংখ্যান জানেন না তাঁরা ইন্টারনেটে The Bureau of Investigative Journalism-এ ঢুঁ মেরে আসতে পারেন। তাদের একটি পরিসংখ্যান দিচ্ছি।

পাকিস্তানে ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে সি আইএ পরিচালিত ড্রোন হামলা হয়েছে ৪০৫টি, তার মধ্যে ওবামার সময়ে হয়েছে ৩৫৪টি। হত্যা করা হয়েছে ২৪০০ থেকে ৩৮৮৮ জন মানুষ। এদের মধ্যে বেসামরিক লোক হচ্ছে ৪১৬ থেকে ৯৫৯। শিশুদের সংখ্যা ১৬৮ থেকে ২০৪। আর শিশুসহ আহতের সংখ্যা ১১৩৩ থেকে ১৭০৬ জন।


wali Shah

সৈয়দ ওয়ালি শাহ। মাত্র সাত বছর বয়স। অগাস্টের ২১ তারিখে মার্কিন ড্রোন হামলায় শহিদ। যারা এই ছবিগুলো দেখতে চান বোঝার জন্য যে এরাও শিশু, নিষ্পাপ ও নিরপরাধ, অথচ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের এরাও লক্ষ্যবস্তু  -- তারা এখানে 'ওয়ার্ল্ড কেন ওয়েট' ডট নেটে যেতে পারেন।


সন্ত্রাস দমনের নামে একটি জনগোষ্ঠির ওপর যখন সামরিক হামলা চলে, কিম্বা ড্রোন বিমানে মৃত্যুর পরওয়ানা পাঠানো হয় তখন বেসামরিক মানুষ খুন হলেও সেটা অফিসিয়াল গণনায় আসে না। সেটা কোলেটারাল ডেমেজ। গণমাধ্যমও তা আড়াল করে। এই ধরনের হামলায় কতোজন শিশু মরল তাদের নাম, ঠিকানা, চেহারা, ছবি তো দূরে থাকুক সংখ্যা হিসাবেও তারা গণ্য হয় না। এর নামই ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’। একটি জনগোষ্ঠিকে নির্বিচারে হত্যা করতে চাইলে তাদের একটা খারাপ নাম দিতে হবে। সেই নামটা হচ্ছে ‘জঙ্গি’। বলা হয় কুকুরকে মারতে হলেও ‘কুত্তা’ বলে ডাকতে হয়। ‘জঙ্গি’ তো কুকুরেরও অধম। ইসলামি জঙ্গি হলে তো কথাই নাই। এই হত্যাযজ্ঞ বা যুদ্ধের নাম হচ্ছে “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ”।

এই যুদ্ধের চরিত্রও আলাদা। এই যুদ্ধের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জঙ্গিদের হত্যা করতে গিয়ে তাদের বেসামরিক নারী বা পুরুষ যদি মারা যায় সেটা বিবেচনায় নেওয়া যাবে না। এমনকি শিশুরাও না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ কোন নিয়ম কানুন মেনে চলে না। এর কোন আন্তর্জাতিক জবাবদহিতা নাই। প্রতিপক্ষ এই যুদ্ধে নিছকই ‘এনিমি কম্ব্যাটেন্ট’ – যেহেতু সে ‘লিগাল সাবজেক্ট’ বলে স্বীকৃত না, অতএব তথাকথিত সভ্য দুনিয়ার “বানানো আইন তার মানবিক সত্তা দূরের কথা কোন ‘আইনী সত্তা’ আছে সেটা স্বীকার করে না; কোন বিচার প্রক্রিয়ার অধীনে অতএব তার অধিকার রক্ষারও কোন আন্তর্জাতিক আইন নাই। তাদের হত্যা আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলেও বিবেচনা করার দরকার পড়ে না, কারণ তারা আইনের অন্তর্ভূক্ত নয়, আইনের বাইরে, স্রেফ ‘সন্ত্রাসী’। যে কোন ছুতায় তাদের হত্যা করা যায়। কিন্তু তারা যখন আবার পাল্টা আঘাত করে তখন সন্ত্রাস বিরোধীদের নীতি-নৈতিকতা, আবেগ, আইন, সামরিক বাহাদুরি, পাল্টা হত্যার তৃষ্ণা নিমিষে উথলে ওঠে, কিম্বা উথলে ওঠার জন্য প্ররোচিত বোধ করে। পেশোয়ারের ঘটনা বিচার করতে বসলে মনে রাখতে হবে আমরা এমনই এক বিকারগ্রস্ত বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে বাস করছি।

প্ররোচিত হবার পেছনে মানসিক ও মতাদর্শিক কারন ছাড়াও আরেকটি বড় কারণ হল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রপাগান্ডার দিক। আবেগ বা নীতি-নৈতিকতা এই ক্ষেত্রে কতোটা কাজ করে তা তর্ক সাপেক্ষ, কারন প্রপাগান্ডা যে কোন যুদ্ধেরই গুরুত্বপূর্ণ দিক। একালের যুদ্ধে প্রপাগান্ডা মেশিন ও প্রচার ব্যবস্থার ভূমিকা অপরিসীম। অনেকের দাবি গণ্মাধ্যমের সর্ব্যাপী ভূমিকার যুগে অস্ত্রের চেয়েও প্রপাগান্ডার শক্তি বেশি। অস্ত্রের জোরের পাশাপাশি প্রপাগান্ডা করার ক্ষমতা, গণ সেন্টিমেন্ট -- বিশেষ করে মধ্যবিত্তের সেন্টিমেন্ট তৈরি অথবা দাবিয়ে রাখার ক্ষমতা, ভূরা তথ্য প্রচার বা ঠিক খবর প্রচার হতে না দেয়া অথবা ক্ষমতাবান পক্ষের তথ্যের অতিপ্রচারে মনমগজ ছেয়ে ফেলা ইত্যাদি যুদ্ধের অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ দিক। বিশেষত যখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, যেখানে প্রতিপক্ষ নন-স্টেইট এক্টর। সেই ক্ষেত্রে ‘জঙ্গি’দের নির্বিচারে হত্যা করার পক্ষে ন্যায্যতা ও জনমত তৈরি করা যুদ্ধ জয়ের নির্ধারক ও গুরুত্বপুর্ণ দিক হয়ে উঠেছে। পেশোয়ারের মিলিটারি স্কুলে হামলার ঘটনা অবিলম্বে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রপাগান্ডার বিষয়ে পরিণত হতে পেরেছে খুবই সহজে। পাকিস্তানে কী ঘটছে এবং পাকিস্তানের তালেবান কেন একটি স্কুলে হামলা করল সেটা খুঁজে দেখবার, জানবার ও বিশ্লেষণ করবার সময় হচ্ছে না কারুরই। জঙ্গিদের নিন্দা করা এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিচারে হত্যার নীতির পক্ষে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ মানুষ। বিশেষত দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক সামরিক অভিযানের পক্ষে। প্রপাগান্ডার শক্তির কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাময়িক বিজয় হয়েছে। আসলেই। এখন প্রতিদিন নতুন নতুন তালেবান হত্যার অপারেশন চালিয়ে যাওয়া সহজ হয়ে গিয়েছে, নেওয়াজ শরীফ জঙ্গিদের ফাঁসির কার্যক্রম তুলনামূলক নির্বিঘ্নে করতে পারছেন।  নেওয়াজ শরিফ এর আগে সন্ত্রাসের মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ওপর মোরাটরিয়াম ঘোষণা করেছিলেন। এখন সেই মোরাটরিয়াম রহিত করে পেশোয়ার হামলার পর আরও ছয় জনের মৃত্যদণ্ড কার্যকর করেছেন। আজ পত্রিকায় দেখছি আরও ৫০০ জনকে তিনি মৃত্যুদণ্ড দেবেন। এই হচ্ছে পেশোয়ারে সামরিক স্কুলে তালেবান হামলার নগদ প্রতিক্রিয়া। (দেখুন, 'Pakistan to execute 500 terror convicts in coming weeks' )

দুই

পাকিস্তানী তালেবানদের দমন করবার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘যার্ব-এ আযাব’ (آپریشن ضربِ عضب‎) অপারেশান শুরু করেছে অনেক আগে। উর্দু এই ভাষ্যের অর্থ তীক্ষ্ণ ও নিখুঁত ভাবে হত্যার জন্য তরবারির আঘাত। এই অপারেশান শুরু করার পর থেকে ভাবছিলাম কতো নাসিমুল্লাহ আর ফাতিমার লাশ কোথায় কিভাবে নিস্পন্দ হয়ে পড়ে আছে কে জানে? কিভাবে সাধারণ মানুষ বোমার হামলা থেকে রক্ষা পাবে? মৃত্যু ছাড়া অনেকেরই অন্য কোন গতি আছে কিনা সন্দেহ। আল জাজিরার একটি ভিডিওতে দেখলাম ওয়াজিরিস্তানের সাধারণ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে আফগানিস্তানে ছুটছে। অর্থাৎ বোমা কে ‘জঙ্গি’ আর কে ‘জঙ্গি’ নয় সেটা আইডেন্টিটি কার্ড দেখে দেখে মারে না। একটি এলাকায় বোমা বর্ষিত হয়, সেনাবাহিনী দাবি করে সেখানে জঙ্গিরা আছে। এতে বসতবাড়ি ও জনপদ বিধ্বস্ত হয়, মারা পড়ে নিরীহ বেসামরিক মানুষ। ফাতিমা ও নাসিমুল্লারা শহিদ হয়। উত্তর ওয়াজিরিস্তান একটি ‘জঙ্গি’ উপদ্রুত এলাকা – অতএব এখানে বোমা নির্বিচারে মারবার বিপক্ষে বিশেষ কোন যুক্তি নাই। যদি একাত্তর সাল আমরা মনে রাখি তো এটাও মনে রাখতে হবে দেশকালের ফারাক ও বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য থাকলেও আমরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেই একই প্রকার অপারেশানের (Operation Searchlight) কথা বলছি। এখানে মনে রাখা দরকার যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপারেশানে 'যার্ব-এ আযাব'-এর পক্ষে বেশ কিছু ওলেমা সংগঠনও স্মর্থন দিয়েছে। যেমন, All Pakistan Ulema Council এবং Council of Islamic Idelogy। ইসলাম যেমন একাট্টা একরকমের নয়, অতএব ইসলামপন্থি সকলের বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি এক রকম নয়।

ওয়াজিরিস্তানে শিশুরা কে কোথায় কিভাবে মরছে কে তার খবর করবে? ইন্টারনেটে সেইসব ছবি আসবে না। কারন যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকার সঠিক খবর পাওয়া প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে যুদ্ধ নীতির অংশ হিসাবে উত্তর ওয়াজিরিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অপারেশানের ‘সুসংবাদ’গুলো ছাপা হচ্ছিল গণমাধ্যমে ক্রমাগত। অর্থাৎ কয়জন ‘জঙ্গি’ কোথায় কিভাবে মরেছে, কিভাবে তাদের বিরুদ্ধে বিমান হামলার বাহাদুরি দিয়ে হত্যা করা হোল তার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। অপারেশান শুরু করার পর থেকে আজ অবধি কতো বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে তার কোন খবর গণমাধ্যমে আসে নি। শুধু কতজন তালেবানকে হত্যা করা হয়েছে সেই খবরই জানানো হচ্ছিল।

যার্ব-এ আযাব অপারেশান শুরু হয়েছিল জুন মাসের ১৫ তারিখে। সামরিক বাহিনী দাবি করেছে পেশোয়ারের সামরিক স্কুলে পাকিস্তানী তালেবানদের আক্রমণের আগে পর্যন্ত পাকিস্তানী মিলিটারী ওয়াজিরিস্তানে ১২৭০ জনকে হত্যা করেছে। এই খবর আল জাজিরা থেকে জেনেছি। কিন্তু কতো বেসামরিক মানুষ মারা গেছে জানা যায় নি। কতোজন শিশু তারও কোন পরিসংখ্যান নাই। তবে গুরুত্বপুর্ণ দিকটা হল, পেশোয়ারে সামরিক স্কুলের হামলার পরেই কেবল ওয়াজিরিস্তানের হত্যার সংখ্যাটা জানা গেলো, পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেটা আমাদের জানালো। ফেইসবুকে মোতাসিম বিল্লাহ তিশাদ এই প্রসঙ্গে খুবই মর্মঘাতী মন্তব্য করেছেন, যা এখানে উদ্ধৃত করবার তাগিদ আমি সামলাতে পারছি না। তিনি লিখেছেন। মুদ্রার একদিক থেকে যদি দেখি তাহলে পেশাওয়ারের মিলিটারি স্কুলে পাকিস্তানি তালিবানদের হামলায় কমপক্ষে ১৩২জন বাচ্চাসহ ১৪১জন নিহত হয়েছে। এই খবর আমরা সঙ্গে সঙ্গেই জেনেছি। কিন্তু ১৫ জুন ২০১৪ থেকে অপারেশান যার্ব-এ আযাব ওয়াজিরিস্তানে ১২৭০ জন হত্যা করেছে, আর সেটা ঘটে আসছে ছয় মাস ধরে। অথচ এই পরের হত্যার খবরটা আমাদের কাছে পৌঁছালো একই সময়ে। আগে নয়। যখন অপারেশান চলছিল তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কিভাবে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে সাধারণ মানুষ হত্যা করছিল তার কোন খবর আমরা জানি না। তার কোন পরিসংখ্যানই ছিল না। মোতাসিম বিল্লাহ তিশাদ প্রশ্ন করছেন, “একটু কি কষ্ট হচ্ছে যে, কেন এই ১২৭০ জনের খবর আমাদের কাছে পৌঁছতে, সেটা বন্ধের দাবি জানাতে এই ১৩২টি বাচ্চাকে মরতে হলো”? অর্থাৎ পেশোয়ারের সামরিক স্কুলে পাকিস্তানি তালেবানদের এই হামলা না হলে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে কতো মানুষ হত্যা করা হয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তা আমরা জানতাম কিনা সন্দেহ।

আমি নিশ্চিত খুব কম মানুষই আমরা পাবো পেশোয়ারের স্কুলে পাকিস্তানী তালেবানদের হামলাকে নৈতিক জায়গা থেকে মেনে নিতে সক্ষম হবেন। আমি নিজে স্তম্ভিত হয়েছি, মারাত্মক কষ্ট ও শোকার্ত হয়েছি। মার্কিন ড্রোন হামলার নিহতদের জন্য যে কষ্ট পাই, কোন অংশে এই ক্ষেত্রেও বেদনার মাত্রা কম নয়। কেউই এই ধরণের সফট টারগেটকে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করাকে নৈতিক জায়গা থেকে সমর্থন করবেন না।

কিন্তু এটা নীতিবাদিতা প্রচার  বা নীতিবাগীশ হবার সময় নয়; নীতিবাগীশতা আমাদের বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে সহায়তা করে না। সেই বিচার পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রতি সমর্থন হয়ে ওঠে। তাছাড়া নৈতিক বিচার রাজনৈতিক পর্যালোচনাও নয়। ঘটনার নৈতিকতার বিচারে ওপর দাঁড়িয়ে তালেবান্দের  বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডায় তারা  উতরাতে পারল কি পারল না সেটা তালেবান রাজনীতির বিচারও নয়। বাস্তবতার পর্যালোচনা ও রাজনীতির বিচার করতে চাইলে তার তরিকা আলাদা। সেটা বশ্যই নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে নয়, কিন্তু কার নীতি? কার মানদণ্ড? যারা নিজেরে নীতিনৈতিকতা বিবর্জিত তাদের মানদণ্ড মেনে এবং সামগ্রিক বাস্তবতা পর্যালোচনা ও বিচার ছাড়া  আগেই রায় দিয়ে দেওয়া কোন আদর্শের মধ্যেই পড়ে না।


school

পেশোয়ারে সামরিক স্কুলে আহত একজন ছাত্রকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী


তাহলে শুরুতেই বুঝতে হবে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী একটি যুদ্ধ চালাচ্ছে এর শিকার শুধু তথাকথিত জঙ্গিরা নয়। বেসামরিক জনগনও। তাদের মধ্যে শিশু ও বাচ্চারাও আছে। পেশোয়ারে স্কুলের বাচ্চাদের মত তারাও বাচ্চাই, ভিন্ন কিছু না। কোন ড্রাগনের ছানা বা দানবের বাছুর নয়। কিন্তু তাদের খবর আমরা জানি না। যে নৈতিকতার জায়গা থেকে মিলিটারি স্কুলে হামলাকে আমরা নিন্দা করি, সেই একই নৈতিকতা দিয়ে অন্যদিকে জঙ্গিদের হত্যা করবার জন্য জঙ্গি এলাকায় ড্রোন হামলা কিম্বা বিমান হামলাকেও জায়েজ গণ্য করা হয়। ওয়াজিরিস্তানে সাধারণ মানুষসহ শিশুরাও মরছে তার জন্য আমাদের কোন নৈতিক সংবেদনা নাই। আফটার অল তারা ‘জঙ্গি’, এবং তাদের বাচ্চারাও জঙ্গিদেরই বাচ্চা। জঙ্গির বাচ্চা জঙ্গি হয় তাদের তো মরতেই হবে। তাই কি?

যদি আসলেই আমরা সত্যিকারের উদার কিম্বা নৈতিকতার জায়গা থেকে পেশোয়ারের মিলিটারি স্কুল হামলাকে নিন্দা করতে চাই তাহলে অবশ্যই উভয়কেই আমাদের নিন্দা করা কর্তব্য হয়ে ওঠে। ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তালেবানদের মধ্যে যুদ্ধ – ধরা যাক উভয় পক্ষেরই এই যুদ্ধ পরিচালানার ক্ষেত্রে সবার জন্য মান্য এক যুদ্ধ-কনভেনশন কি হতে পারে তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। এমন বিচারে – কোন পক্ষই যুদ্ধের টার্গেট হিসাবে যুদ্ধরত ব্যক্তি ছাড়া জনপদ, পড়শি, আত্মীয় বা পরিবারকে হত্যা বা আক্রমণ করতে পারবে না এটা হতে পারে। তবেই এটা সাধারণভাবে প্রযোজ্য একটা নৈতিক বিধান হতে পারে। নৈতিক বিচারের একটা মাপকাঠি দাঁড়াতে পারে যাতে স্কুল হামলা আগাম প্রতিরোপধ করা যায় । কিন্তু ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযান ও বিমান হামলার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে শুধু পেশোয়ারের মিলিটারি স্কুলে পাকিস্তানী তালেবানদের হামলাকে আমলে নেওয়া কোন নৈতিক অবস্থান বলা যাবে না। সেটা হবে নৈতিকতার আড়ালে ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানের পক্ষে জনমত তৈরির ভলান্টিয়ার বনে যাওয়া।

ধরা যাক একজন প্রশ্ন করলেন “পাকিস্তানে তালেবান হামলার বিষয় টা কিভাবে মূল্যায়ন বা পর্যালোচনা করব”? একে কি নিন্দা করব না? বাচ্চা বা নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষ হত্যা মন্দ কাজ এতে কোন সন্দেহ নাই। অবশ্যই করব। যে কোন যুদ্ধ বা হিংসাকেও তো আমরা নিন্দা করতে পারি। প্রশ্ন হচ্ছে সামগ্রিক বাস্তবতা থেকে আলাদা করে ঘটনার মুল্যায়ন বা পর্যালোচনা মানে কি? সেটা নৈতিক নাকি রাজনৈতিক পর্যালোচনা। এই ধরনের প্রশ্ন তা উহ্য রাখে। তবে বোঝা যায় বিচ্ছিন্ন ভাবে ঘটনা বিচারের পেছনে প্রশ্ন কর্তার আকাঙ্খা মূলত বাস্তবতার নিরাকরণ ঘটিয়ে বিচ্ছিন্ন ঘটনার নৈতিক মুল্যায়ন। অথচ এই ধরনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দরকার বাস্তব পরিস্থিতির যথাসম্ভব সামগ্রিক পর্যালোচনা। বিপদের দিকটা হল, প্রশ্ন কর্তা নৈতিক মুল্যায়নের মানদণ্ড দিয়ে রায় দিতে চান সেটা প্রশ্নের ধরন দেখেই বোঝা যায়। নীতিবাগীশতা দিয়ে প্রশ্নকর্তা তালেবানের রাজনৈতিক মুল্যায়ন বা বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিচারের কাজটা সেরে ফেলতে চান। এভাবে নীতিনৈতিকতার মানদণ্ড দিয়ে রাজনৈতিক বাস্তবতা ও তার ভালমন্দ বোঝার চেষ্টা ভুল।

তারপরও তর্ক থেকে যায়। নৈতিকতার কথাও যদি বলি তাহলে সেটা কার নৈতিকতা? কোন পক্ষের? দ্বিতীয়ত আমরা একটি যুদ্ধ পরিস্থিতির বিচার করছি। এই পরিস্থিতিতে নৈতিকতার মানদণ্ড তো একপক্ষীয় হলে তা সার্বজনীন মানদণ্ড হবে না। অতএব তা নৈতিক বলে দাবিও করতে পারবে না। যুদ্ধাবস্থায় একপক্ষকে নৈতিকতার বয়ান মেনে চলার কথা বলা, আর অন্যপক্ষ তা লঙ্ঘন করলে সেই ক্ষেত্রে নীরব থাকা কোন নীতি হতে পারে না। নৈতিকতা জরুরী, যুদ্ধাবস্থাতেও। কিন্তু কোন পক্ষকে দায়মুক্তি দিয়ে নয়। জঙ্গি দমনের নামে ওয়াজিরিস্তানে হত্যাযজ্ঞ চালানোর লাইসেন্স দেওয়া কোন কাজের কথা হতে পারে না। যারা পেশোয়ারের মিলিটারি স্কুলে পাকিস্তানী তালেবানদের হামলার নিন্দা করছেন, আমি তাদের অবশ্যই নৈতিক দিক থেকে সমর্থন করি। কিন্তু তাঁরা যখন ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধাভিযান সম্পর্কে নীরব থাকেন তখন বিস্মিত ও মর্মাহত হই। কারন এই নীরবতা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ‘জঙ্গি’ দমন নীতির নামে নির্বিচারে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়ার সমার্থক। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে সন্তুষ্ট রাখবার জন্য পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর যে সকল কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে তার সমর্থন। সকল নীতিনৈতিকতা ভঙ্গ করে হত্যাযজ্ঞ চালাবার শামিল। একে মেনে নেওয়া ভুল

তিন

বলাবাহুল্য, তেহরিখে তালেবান পাকিস্তানের অফিসিয়াল মুখপাত্র মুহাম্মদ খোরাসানি পেশোয়ারে স্কুলে হামলার পক্ষে তাঁদের যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের স্পষ্ট বক্তব্য, এটা ছিল একটি মিলিটারি স্কুল। (এখানে তাদের পুরা বক্তব্য ও ছবি দেখুন)।  খোরাসানির দাবি তালেবানরা সেখানে উপস্থিত আর্মি অফিসার এবং তাদের যুবক ছেলেদেরকে হত্যা করেছে। কোন শিশুকে নয়। “এই যুবক ছেলেরাই ভবিষ্যতে তাদের পিতার পদে আসীন হয়ে, পাকিস্তানে সীমান্তবর্তী অসহায় গোত্র (FATA )এলাকার এবং সারা দেশজুড়ে পারিচালিত সেনা অভিযানে অংশ নিতো। এজন্যই তাদেরকে গড়ে তোলা হচ্ছিল”। আর্মি অফিসারদের আঠারো ও পঁচিশ বছরের যুবকদের ছবি দিয়ে তাঁরা ক্যাপশান দিয়ে বলেছেন, “ আর্মি অফিসারদের আঠার এবং পঁচিশ বছরের সন্তানরা ‘মাসুম’ শিশু...!! কিন্তু সোয়াত ওয়াজিরিস্তানের মাসুম বাচ্চারা তবে সন্ত্রাসী কেন...??” তিনি এটাও জানিয়েছেন, মিলিটারি স্কুলের অপারেশানে একজন কর্নেল, গোয়েন্দা সংস্থার কয়েক ডজন অফিসার, দুইশরও বেশি সামরিক অফিসার এবং তাদের যুবক ছেলেরা নিহত হয়েছে।

খোরাসানি প্রশ্ন করেছেন, “পাকিস্তানের নাপাক সৈন্যরা বিগত ছয় বছর ধরে, পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী গোত্রগুলোর ওপর যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে কত নিরপরাধ, অসহায় গরীব মুসলমান শহীদ করেছে, তার হিসাব কি কেউ রেখেছে?” পাকিস্তানি সেনারা মুজাহিদদের বাপ-ভাইদেরকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে শহীদ করে দেয়। এটা অহরহই ঘটছে। তারা মেরে ফেলার পর লাশগুলোও ফেরত দেয় না। অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে ফেলে দেয়। চলতি বছরেই শুধু ছয়শরও বেশি নিরপরাধ মানুষকে গুপ্তভাবে শহীদ করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এই নারকীয়তার প্রতিবাদ কেউ করে না। শুধু ২০১৪ সালেই ছয়শরও বেশি নিরপরাধ মানুষ শহীদ হয়েছে। এই মজলুম শহীদদের অপরাধ কী ছিলো তা কি কেউ কোনও দিন জানার চেষ্টা করেছিলো?” ‘রাহে রাস্ত’, “রাহে নাজাত”, ‘শের দিল’, ‘যরবে আযব’ ও ‘খায়বর’-সহ আরো বিভিন্ন নামে অসংখ্য অভিযান চালানো হয়েছে। প্রশ্ন: “কত হাজার হাজার মুসলিমকে শহীদ এবং কত লাখ মুসলমানকে ঘরছাড়া করা হয়েছে তার হিসাব কি কেউ রেখেছে?”

এরপর খোরাসানি বলেছেন, “বেলুচিস্তান থেকে কাবায়েল পর্যন্ত পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি নিখোঁজ মানুষের স্বজনরা আর কতদিন আহাজারি করে বেড়াবে? এই স্বজনহারা মানুষদের ব্যথা পাক জেনারেলরা তখনই বুঝবে, যখন তারাও তাদের স্বজনকে হারাবে”।

তেহরীকে তালেবান পাকিস্তান এই ধরনের ‘নারকীয় হত্যাযজ্ঞ’ সরকার এবং গোয়েন্দা সংস্থাকে না চালাতে বারবারই নিষেধ করছিলো। সরকারকে নিখোঁজদের লাশ হস্তান্তর করতে বলেছে, কিন্তু কোনও পক্ষই এসব আবেদনে কান দেয় নি। অতএব তেহরিকে তালেবান পাকিস্তান, “সরকার এবং সেনাদের দ্বারা পরিচালিত পাশবিক হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে, বাধ্য হয়েই চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে”। অর্থাৎ পেশোয়ারের কড়া সামরিক নিরাপত্তাবেষ্টিত এলাকায় সামরিক স্কুলে পাকিস্তানি তালেবানরা ‘বাধ্য হয়ে’ এই হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানি তালেবানদের দাবি, “আমরা সামরিক বাহিনী পরিচালিত স্কুল এন্ড কলেজকে টার্গেট করেছি। আমরা শুধু প্রাপ্ত বয়স্কদের ওপরই হামলা করেছি”।

তেহরিকে তালিবান পাকিস্তানের দাবি হচ্ছে:

১. তালেবানের বিরুদ্ধে অপারেশনের নাম দিয়ে FATA এলাকার মুসলিমদের সন্তান হত্যা করা, এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে।
২. গোপন এজেন্সি গুলোর হাতে বন্দী মুজাহিদদের নিরপরাধ নিকট আত্মীয়-স্বজনদের নামে মিথ্যা অভিযোগ করে, তাদেরকে হত্যা করার প্রক্রিয়া এই মুহুর্তে বন্ধ করতে হবে...
৩. মুজাহিদদের পরিবারভূক্ত যেসব নারীদের নিরাপত্তা বাহিনী বন্দী করে রেখেছে তাদেরকে এই মুহূর্তে ছেড়ে দিতে হবে।

মিলিটারি স্কুল হামলার পক্ষে তেহরিকে তালিবান পাকিস্তানের মুহাম্মদ খোরাসানির বক্তব্য গ্রহণযোগ্য কিনা সেই বিচার আমি পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিতে চাই। তবে মন্দ দিয়ে মন্দ কাজকে জায়েজ করা যায় কিনা অনেকে সঙ্গত কারনে এই তর্ক তুলছেন। সেটা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ তর্কের বিষয়। কিন্তু একটি যুদ্ধ পরিস্থিতির বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে তাকে বিমূর্ত নৈতিক তর্কে পর্যবসিত করা আবার রাজনৈতিক তর্ককে নৈতিক তর্ক দিয়ে মীমাংসা বা বোঝাবুঝির চেষ্টা চিন্তার অপরিপক্কতা মাত্র। সেটা যেন আমরা পরিহার করি।


পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখন উত্তর ওয়াজিরিস্তানে ব্যাপক হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু তার আগেই সাধারণ মানুষ ভয়ে আতংকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছে। সামরিক ইস্কুলে হামলা্র কারনে  ওয়াজিরিস্তানের সাধারন সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পক্ষে ভাল জনমত আদাদ্য করে নিয়েছে সেনাবাহিনী।


এই আলোচনায় আর একটা গুরুত্বপুর্ণ দিক আছে। সেটা আইনী দিক থেকে বুঝতে হবে। অনেকে খেয়াল করেছেন ইংরাজিতে FATA শব্দটা ওপরে অনেক জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে। সংক্ষেপ ভাঙলে এর অর্থ ফেডারেল এডমিনিষ্ট্রটিভ ট্রাইবাল এরিয়া (Federal Administrative Tribal Area)। আইনত এই এলাকা পাকিস্তানের কন্সটিটিউশ্নে নির্ণিত ভুখণ্ড নয়। লিগাল ষ্টাটাসের দিক থেকে ১৮৮৯ সালে এই এলাকা সেই সময়ে বৃটিশ-ইন্ডিয়ার প্রধান ভাইসরয়ের সাথে এক সন্ধিচুক্তি বলে আবদ্ধ। কিন্তু তখন থেকেই তা বৃটিশ-ইন্ডিয়ার ভুখণ্ডের অংশও নয়। তবে বৃটিশ-ইন্ডিয়ার সামরিক ও পররাষ্ট্র নীতি ঐ এলাকার উপর প্রযোজ্য হবে এই হল ঐ চুক্তির সারকথা। বিনিময়ে পশতুনরা আফগানিস্তানসহ পুরা এলাকায় অবাধে চলাচল করতে ও নিজস্ব ট্রাইবাল প্রশাসন চালাতে পারবে। বৃটিশ-ইন্ডিয়ার বর্ডার আউটপোস্টও ঐ এলাকা ছেড়ে ভিতরে পেশোয়ারে সরে আসবে। মানচিত্রে তাকালে আমরা দেখব আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সীমানার মাঝে নো-ম্যানস ল্যান্ডের মত এই এলাকা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠন করার সময়ও ঐ চুক্তি বহাল থাকে। সংশোধিত হয় কেবল বৃটিশ ভাইসরয়ের জায়গায় পাকিস্তান গভর্নর জেনারেল (প্রেসিডেন্ট) হিসাবে জিন্নাহর নাম সন্নিবেশ করা। সেজন্য এখনও পাকিস্তানের সংসদের পাশ করা কোন আইন আপনা আপনি ঐ এলাকায় প্রযোজ্য হয় না। এনিয়ে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের রায়ও আছে। জেনারেল মোশারফের সময়ে ২০০৭ সালে জবরদস্তি করে এই এলাকাকে “প্রশাসনের” অধীনে আনা হয়। তখন থেকেই FATA শব্দের উৎপত্তি। এখানে ফেডারেলের অর্থ কেন্দ্রীয় সরকার বা রাষ্ট্রপতির অধীনে, এই এলাকা পাকিস্তানের কোন প্রদেশের অংশ নয়, বা প্রাদেশীক প্রশাসনের অধীন নয় সেটা বোঝাতে। আবার এই প্রশাসনিক ব্যবস্থার মুখ্য বিষয় ১৯০১ সালে বৃটিশদের হাতে প্রণীত Frontier Crimes Regulations (FCR) নামের কালো আইন। ফলে FATA এলাকায় গ্রেপ্তার, হত্যা অপারেশন কোন আইনি পরিমণ্ডলে ঘটে কিনা সেটাও বিতর্কিত বিষয়। কোন বেআইনি গ্রেপ্তার, হত্যা বা অপারেশনের বিরুদ্ধে প্রতিকারের আশায় কোন আদালতে যাবার সুযোগই এলাকার অধিবাসীদের নাই। কারণ FATA এলাকা পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রাদেশিক হাইকোর্ট অথবা ফেডারল সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ারের বাইরের এলাকা। কেবল ১৯৯৬ সালের এক অদ্ভুত আইনে অধিবাসীরা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিতেদের এক ধরনের মজলিসে শুরায় নির্বাচিত করার জন্য ভোত দিতে পারে। কিন্তু তাদের কোন রাজনৈতিক দল করবার অধিকার নাই। এমন রাজনৈতিক অধিকারবিহীন অবস্থা ও রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে আইনি প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ নাই বললেই চলে। পাকিস্তানের কোন রাজনৈতিক দল সেখানে শাখা খুলতে পারে না। এই দমবন্ধ পরিস্থিতির দিকটা মনে রেখে যেন FATA এলাকার বাসিন্দাদের তৎপরতাকে আমরা বিচার করি।


Fata Area

Federally Admistered Tribal Area


আমার নিজের কথা শুরুতেই বলেছি। পেশোয়ারে মিলিটারি স্কুলে হামলার ঘটনায় আমি স্তম্ভিত ও শোকার্ত হয়েছি। সন্দেহ নাই। অন্যদের শুধু এতোটুকুই মনে করিয়ে দিতে চাই উত্তর ওয়াজিরিস্তানের বাচ্চারাও বাচ্চা। পেশোয়ার হামলার পরে যদিও ‘প্রাপ্ত বয়স্ক’ ছাড়া কোন আহত বা নিহত শিশুর ছবি ইন্টারনেটে আমার চোখে পড়ে নি তবুও উভয় ক্ষেত্রেই আমি মনে করি শিশু, কিশোর কিম্বা নিরপরাধ যুবক বা নিরস্ত্র বেসামরিক ব্যক্তির ওপর হামলা কোন যুদ্ধ নীতির মধ্যে পড়ে না। প্রতিপক্ষ কোন নৈতিক কিম্বা আন্তর্জাতিক বিধি বিধানই মানে না, এই নিষ্ঠুর সত্য বা নির্মম বাস্তবতাও নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলাকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করে না। সেটা নিজেদের লড়াইয়ের পক্ষে কোন বৈধ নৈতিক যুক্তি হতে পারে না। তারপরও বলি, পাকিস্তান ও তার সীমান্তবর্তী পশতুন এলাকার জটিলতা সম্পর্কে আমাদের আরও অনেক বেশী সতর্ক থাকা জরুরী। কিন্তু সেটা নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে রেখে নয়। যদি মিলিটারি ইস্কুলে তেহরিখে তালিবান পাকিস্তানের হামলার নিন্দা করি তাহলে তার চেয়ে একশ গুণ বেশি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও পকিস্তানের শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে আমামদের নিন্দা জানানো জরুরি হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে তাদের মিত্র মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী যেন আমরা না হই। সতর্ক পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই আমরা জটিল বাস্তবতা মোকাবিলার পথ সন্ধান করতে পারি।

কোন একটি পক্ষের – বিশেষত উত্তর ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের এক তরফা সাফাই গাইবার ভলান্টিয়ার আমরা, বাংলাদেশিরা, হতে পারব না।

দুঃখিত আমরা একাত্তর  দেখেছি, ভুলি নি।

২১ ডিসেম্বর, ২০১৪/ ৭ পৌষ, ১৪২১; শ্যমলী, ঢাকা

[ এই লেখাটি দৈনিক যুগান্তরে ‘ন্যায়যুদ্ধের নীতি’ শিরোনামে ২২ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে ছাপা হয়েছিল। ‘ন্যায়যুদ্ধ’ একটি তর্কসাপেক্ষ ধারণা। আলাদা করে তা বিস্তৃত না লিখলে পাঠক ভুল বুঝতে পারেন মনে করে এখানে শিরোনাম বদলিয়ে বর্ণনাত্মক রেখেছি যাতে  মানবিক সংবেদনা, আইন ও রাজনীতির জটিল সম্পর্ক সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা দেওয়া সম্ভব হয়। এই আলোকে চিন্তা ওয়েবে তোলার আগে কিছু পরিমার্জন ও সম্প্রসারণ করেছি। -ফম ]


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।