জিহাদ ও বাংলাদেশ: চাই জীবন্ত উদ্ধার


মাত্র সাড়ে তিন বছরের শিশু জিহাদ সারা দেশে কান্নার রোল তুলতে পেরেছে। সে কান্না এখনো থামে নি। শেষ পর্যন্ত জিহাদকে তোলা হোল, কিন্তু পাওয়া গেছে মৃত অবস্থায়। ছোট্ট ভেজা শরীরটা বিশেষ খাঁচার কারিগরি খাটিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্যোগে ওঠানো হয়েছে। ততক্ষণে ঘোষণা দিয়ে ফায়ার ব্রিগেড তার কাজ স্থগিত ঘোষণা করেছে। একজন মন্ত্রী বলেছেন, কেউ ওয়াসার পাইপের মধ্যে নাই, এটা গুজব। জিহাদকে রেখেই ফায়ারব্রিগেড পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যায়। সাধারন মানুষ তা বিশ্বাস করে নি, নিজেদের উদ্যোগে তারা জিহাদকে উদ্ধারে তৎপর হয়। ঠিকই  তাকে পাওয়া গেলো। কিন্তু হাসপাতালে নেয়ার পর জানা গেল জিহাদ আর বেঁচে নেই।

সঠিক হোক কি বেঠিক, মানুষের মনে ধারণা জন্মেছে যে জিহাদকে উদ্ধারের নামে ২৩ ঘন্টার যে প্রহসন ও সারা রাত ধরে ফায়ার ব্রিগেডের ব্যর্থতার কান্ডকারখানা -- তা না করে আরও আগে যদি তাকে তোলার জন্য জনগণের উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হোত তাহলে বুঝি জিহাদ বেঁচে যেতো। এই ধারণাকেই নাকচ করার জন্যেই কি জিহাদের পোস্ট মোর্টেম করতে দেরী করা হোল? সরকারের ভাষ্য ঠিক করার জন্যে? পোস্ট মোর্টেম রিপোর্টে বলে দেয়া হোল যে জিহাদ পড়ে যাওয়ার দুই ঘন্টার মধ্যে মারা গেছে; অথচ তাৎক্ষণিকভাবে মেডিকেল কলেজের ডিউটিরত ডাক্তার এতো আগে মারা গেছে বলে্ন নি। তোলার সময় জিহাদের মৃত দেহ দেখেও তা মনে হয় নি। তার শরীর তখনো নরম ছিল। হাত পা যেমন নড়ানো হচ্ছিল তেমনই নড়েছে। মৃত শরীর শক্ত হয়ে গেলে এমনভাবে জামা খুলতে পারার কথা নয়।

অনেক প্রশ্নই মনে জাগে। কারণ জিহাদের মৃত্যু সহজে গ্রহণ করার মতো নয়। পোস্ট মোর্টেমের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে শাজাহানপুরে না নিয়ে সরাসরি শরিয়তপুরে নিয়ে যাওয়াও কি প্রশ্নের উদ্রেক করে না? তার এলাকাবাসীরা তাকে একনজর দেখতে পারলো না। এটা কি কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা নয়, যে তারা এলাকাবাসীকে সন্তোষজনক কিছু জবাব দিতে পারবেন না। সোজা কথায়, মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে তাকে মোকাবেলা করতে চায়নি সরকার।

অদ্ভুতভাবে জিহাদ এখন বাংলাদেশের প্রতীক হয়ে উঠেছে। যদিও বাংলাদেশ আর সেই ছোট শিশুটির বয়সে নেই। কিন্তু রক্ষার প্রশ্নে জিহাদের ঘটনা যেন বাংলাদেশের সাথে মিলে যাচ্ছে। দেশের ভাল মন্দের জন্যে মানুষের যেমন প্রাণ কাঁদে ঠিক তেমনি কাঁদছে জিহাদের জন্য। জিহাদ বিশেষ কেউ নয়। আর দশটি শিশুর মতো হাসিখুশি দুষ্টু বাচ্চা ছিল। জিহাদের বাবা নাসির ফকির ও মা খাদিজার আদরের ধন। ভাই বোনেরও প্রিয়। শিশু জিহাদ খেলছিল, কখন গিয়ে ওয়াসার পরিত্যক্ত ১৭ ইঞ্চি ব্যাসের পরিত্যক্ত পাইপের মধ্যে পড়ে গেল। রেলের একটি স্থাপনায় ওয়াসার কাজ চলছিল কাছেই, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজে নিয়োজিত ছিল। এটি একটি গভীর নলকুপের জন্যে লাগানো হয়েছিল কিন্তু কোন কারণে পাইপটি খোলা অবস্থায় পড়ে ছিল দীর্ঘ এক বছরের বেশী সময় ধরে। এই ব্যাপারে ওয়াসার কোন ব্যাখ্যা এখনো পাওয়া যায় নি। দুঃখও প্রকাশ করেছে বলে শুনিনি। দুটি গুরুত্বপুর্ণ সরকারি বিভাগ এর সাথে জড়িত অথচ তাদের যেন কোন দায়িত্ব নেই, লজ্জাবোধও নেই। তাদের কারণে একটি নিঃষ্পাপ শিশুর এই মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটলো, কিছুই এসে যায় না তাদের?

জিহাদ পাইপের ভেতর পড়ে যাওয়ার পর হয়তো কিছুই জানা যেতো না যদি দুজন কিশোরীর ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়ে কর্ক সেই পাইপের কাছে না পড়তো, এবং ওরা পাইপের ভেতর থেকে “আম্মু, আম্মু” কান্না না শুনতো। এই দুটি শিশু সাথে সাথেই ওয়াসার ঠিকাদারদের জানিয়েছে, তারা কথাটি হেসেই উড়িয়ে দিয়ে অন্য দিকে চলে যায়। তবুও মেয়ে দুটি হাল ছাড়ে নি। তারা অন্যান্যদেরও জানায়। এক পর্যায়ে খবরটি মিডিয়ায় ব্রেকিং নিউজ হয়। ছুটে আসে ফায়ার ব্রিগেড, এবং নির্মম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে শিশু জিহাদের মৃত্যু ঘটায়। সচেতনভাবেই বলছি, তাদের এই দায়ীত্বহীনতার জন্যে মারা গেছে জিহাদ। তারা যখন দেখছে উদ্ধার করতে পারবে না তাহলে কেন আগেই জানিয়ে দিয়ে সেনা বাহিনী বা আরও উচ্চতর পর্যায়ের বাহিনী ডাকা হোল না?

পচিশে ডিসেম্বর, টিভিতে যারা রাতভর উদ্ধার অভিযান দেখেছে তাদের মধ্যে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে জিহাদের জন্য দোয়া করেনি। সবাই একটি আশা করেছে, জিহাদ জীবিত উদ্ধার হবে। সে তার আম্মুর কাছেই ফিরবে। তাকে উদ্ধারের চেষ্টা সবাই টেলিভিশনে দেখেছেন, ‘লাইভ’। আমি নিজে যখন দেখি প্রথমে শুধু একটি চ্যানেলে দেখেছি, পরে দেখি অন্যান্য সব চ্যানেলেই লাইভ দেখাচ্ছে শুধু বিটিভি ছাড়া। সে সময় বিটিভি নির্ধারিত গানের প্রোগ্রাম চলছিল, তাদের পঞ্চাশ বছর পুর্তির কর্মসুচিরও কোন ঘাটতি দেখা যায় নি। মিডিয়ার ভুমিকা ও তাদের নীতি নৈতিকতার প্রশ্ন রানা প্লাজার দুর্ঘটনার সময় যেমন ছিল, এবারও ঘটেছে। একটি চ্যানেল ফায়ার ব্রিগেডের সফল হওয়ার ব্যাপারে এতোই নিশ্চিত ছিল যে তারা অনেকটা খেলার ধারা বিবরণীর মতো ভাষা ব্যবহার করে বলেছে “টান টান উত্তেজনা চলছে”। শিশু জিহাদ উদ্ধার হলে তা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ইতিহাসে নতুন ঘটনা হবে। টিভি চ্যানেলের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। কে আগে উদ্ধারের ব্রেকিং নিউজ দেবে। হয়তো উদ্ধার হলে স্বয়ং প্রধান মন্ত্রী সেখানে চলে আসতেন এবং অভিনন্দন জানাতেন, না হলে আমরা স্ক্রলে হয়তো দেখতাম প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, স্পীকার, বি্রোধী দলীয় নেত্রী বিবৃতি তাই তাদের মধ্যে এমনও চেষ্টা ছিল যে উদ্ধ্বার কর্মীদেরও দুটো কথা বলার জন্যে 'বোম' মাইক্রোফোন এগিয়ে দিচ্ছিলেন। মাত্র দুএকটি টিভি চ্যানেল দুরত্ব বজায় রেখে ঘটনা প্রবাহ দেখিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি নিজে টেলিভিশনের সামনে বসে ছিলাম রাত দুটো পর্যন্ত, তারপর কিছুক্ষণ পর পর ঘুম থেকে উঠে দেখেছি।

সকালের দিকে টেলিভিশনের খবরে বলা হোল পাইপের ভেতরে কোন মানব দেহের বা মানুষের উপস্থিতি পাওয়া যায় নি। জানানো হোল, সেখানে নাকি তেলা পোকা, টিকটিকি, ইত্যাদী প্রাণী ছিল, আর ছিল শোলা।

এতো সময় ৩০০ ফুট, বা ৬০০ ফুট গভীরে থাকার পর শিশুটি বেঁচে আছে এই কথা বিশ্বাস করার কথা নয়। সারারাত তারা ক্যামেরা পাঠিয়ে কি দেখলো? সকালে ফায়ার ব্রিগেডের পক্ষ থেকে আদৌ সেখানে কোন ‘মানব দেহ’ এই কুপে ছিল না, এই কথা বিশ্বাস করা খুব কষ্ট হয়ে গেল। শুনে মনে হোল সারারাত ফায়ার ব্রিগেড এই তামাশা তাহলে কেন করলো? মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষকে সন্তুষ্ট করতে তারা বাচ্চাটি জুস খেয়েছে, টর্চ ধরেছে, চারবার রশি ধরে ওঠার জন্যে চেষ্টা করেছে এতো সব কথা আসলো কোথা থেকে? ফায়ার ব্রিগেডের মতো একটি পেশাদার প্রতিষ্ঠানের কাছে এতো অপেশাদারি বক্তব্য কি আশা করা যায়? নাকি এই কথা তারা এই কারণে বলেছেন যে ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলে ফেলেছেন যে এটা গুজব। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ঘটনা স্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন, এটা ভাল কিন্তু তিনি সাংবাদিকদের যখন বলেন,উদ্ধারকর্মী (ফায়ার ব্রিগেড) দলের সঙ্গে কথা বলে তার ধারণা হয়েছে যে “পাইপের ভেতরে শিশুটি নেই”।

সরকার শিশু জিহাদকে উদ্ধারে ব্যর্থ হয়েছে, তাই বলে ব্যর্থটা ঢাকতে কোন উদ্যোগ নেবে না তাতো হয় না। পরদিনের পত্রিকায় দেখে অবাক হয়ে গেলাম যে জিহাদের বাবা মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নৈশ প্রহরী নাসিরউদ্দিনকে শুক্রবার (২৬ তারিখ) ভোর রাতেই পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। সকাল পর্যন্ত তাকে ছাড়া হয়নি।পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে তাঁকে সে সময় তার পরিবার থেকে দূরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ‘তদন্ত এবং নিরাপত্তার স্বার্থেই’। সে সময় কি পরিস্থিতি অস্বাভাবিক ছিল? কিসের তদন্ত? কিসের নিরাপত্তা? তার দোষ ছিল কি এই যে সে তার সন্তান উদ্ধারের জন্যে আকুতি জানিয়েছে? জিহাদ পাইপে পড়ে গেছে এই কথা জিহাদের মা, প্রতিবেশী ও এলাকার কিছু মানুষও দেখেছে। এখন তারা উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে জিহাদ আদৌ কুপে পড়ে নি এই কথা প্রচার করার জন্যেই কি তার ওপর চাপ সৃষ্টি? শুধু জিহাদের বাবা নয়, সেই দুটি মেয়ে পুষ্পিতা ও ফাতেমাকেও ডাকা হয়েছিল যারা প্রথম তার কান্না শুনেছে। জিহাদকে উদ্ধারের চেষ্টা যখন চরম পর্যায়ে তখন সরকারের এই আচরণ স্থানীয় মানুষ এবং দেশবাসীকে বিক্ষুব্ধ করেছে চরমভাবে।

আজ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী কোন সমবেদনা জানান নি, শুধু হাল্কাভাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী একটু খোঁড়া ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি আসলে কি বলতে চেয়েছেন। পাইপের মধ্যে শিশু নেই বলে ফেলেছেন অথচ ফায়ার ব্রিগেড গুটিয়ে নেয়ার বিশ মিনিটেই জিহাদ উদ্ধার হোল সাধারণ মানুষের হাতে!

জিহাদকে বাঁচানো গেল না, কিন্তু জিহাদকে নিয়ে কিছু করতে গেলেই পুলিশের বাধা আসছে। তার পরিবারকে মিটিং বা সমাবেশে আসতে দেয়া হচ্ছে না।

জিহাদ হচ্ছে সেই বাংলাদেশ যে বাংলাদেশে এখন মানুষের নিরাপত্তা নেই, নেই কথা বলার অধিকার। কেউ দেশের জন্যে কিছু করতে চাইলেও আছে শুধু নিপীড়ন। কী লেখা থাকবে তখন বাংলাদেশের পোস্ট মোর্টেম রিপোর্টে ? কী লিখবেন ইতিহাসবিদেরা। না আমরা অতীত হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ অবশ্যই চাই না।

সাধারণ মানুষকে পাইপে আটকে যাওয়া বাংলাদেশকে উদ্ধার করতে হবে। তবে সেটা করতে হবে বাংলাদেশ মৃতদেহ হয়ে যাবার আগেই। চাই জীবন্ত উদ্ধার।

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।