'আমরাও শার্লি'? হায় ইউরোপ !


ফ্রান্সে বেড়ে ওঠা ফরাসি নাগরিক দুই ভাই শরিফ কুয়াচি (Cherif Kouachi) ও সায়িদ কুয়াচি (Said Kouachi) অতর্কিতে শার্লি হেবদো পত্রিকায় হামলা চালিয়ে চারজন নামকরা কার্টুনিস্টসহ প্রায় বারোজন মানুষকে হত্যা করেছে। বিচ্ছিন্ন ভাবে বিচার করলে এটা, বলাবাহুল্য একটি হত্যাকাণ্ড। প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে পাশ্চাত্যের পত্রিকাগুলোর খবর হচ্ছে হামলাকারীদের মুখে ‘আল্লাহু আকবর’ শ্লোগান শোনা গিয়েছে এবং এটাও শোনা গিয়েছে যে তারা বলেছে ‘নবীর অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছি’। হত্যাকারীদের ধরবার জন্য ফ্রান্সে রীতিমতো যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তিনদিন ব্যাপী পরিচালিত এই অসম ও অস্বাভাবিক পুলিশি অপারেশানে শরিফ কুয়াচি ও সৈয়দ কুয়াচিকে প্রায় আশি হাজার ফরাসি পুলিশ সংঘবদ্ধ ভাবে ঘেরাও করে হত্যা করেছে। তারা একটি ছাপাখানার ভবনে লুকিয়ে ছিল। তাদের হত্যা এতোই জরুরী হয়ে পড়েছিল যে কালো কাপড় পরা কমান্ডোরা হেলিকপ্টারে চড়ে বিল্ডিং-এর ছাদে নেমে পড়ে। তারপর ভবনের ভেতরে তারা ফ্লেশ গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে। শরিফ আর সৈয়দ পুলিশের ভাষ্যানুযায়ী বিল্ডিং থেকে তাদের কালাশনিকভ নিয়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়, আর তাদের এই সশস্ত্র বেরিয়ে আসা তৎক্ষনাৎ হত্যার জন্য ভাল একটি যুক্তি হয়ে ওঠে। তাদের সহযোগী আঠারো বছর বয়েসী হামিদ মুরাদ নিজেকে নির্দোষ বলে স্বেচ্ছায় পুলিশের কাছে আগেই ধরা দিয়েছিল। শেরিফ কুয়াচি (৩২) এবং সাইদ কুয়াচি (৩৪) এতিম, বড় হয়েছে অন্যের কাছে। শরিফের বিরুদ্ধে ড্রাগ আর মাদকাসক্তির অভিযোগ আছে। তথ্য হিসাবে জেনে রাখা দরকার এই হামলায় শার্লি হেবদোর কপি-এডিটর মুস্তাফা ঔরাদ (Mustapha Ourrad) এবং পুলিশ অফিসার (Ahmed Merabet) -- এই দুইজনও নিহত হয়েছে। দুজনেই ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছিলেন।

ওদিকে প্যারিস শহরের ২৫ মাইল দক্ষিণ পূর্বের ইহুদি লোকালয়ে একটি ‘কোশার’ সুপার মার্কেটে আমেদি কুলেবালি (Amedy Coulibaly) ও হায়াত বুমেদিয়েন (Hayet Boumddiene) কিছু মানুষকে জিম্মি করে দুই ভাইকে বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়েছিল। সেখানেও পুলিশ তাৎক্ষণিক ভাবে জিম্মি উদ্ধার করতে গিয়ে আমেদিকে হত্যা করে এবং পনেরোজন জিম্মিকে উদ্ধার করে। তবে এতে চারজন জিম্মিও নিহত হয়। তবে হায়াত বুমেদিয়েন ঠিক কোথায় তা এখনও অবধি সঠিক জানা যায় নি।

কেউ ইসলামের নামে কোন হত্যাকাণ্ড ঘটালে কিম্বা ঘটনাচক্রে হত্যাকারী মুসলমান হলে তার দায় যেন ইসলামের কিম্বা দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানের। বর্ণবাদী খ্রিস্টিয় জঙ্গিতত্ত্বের ইশতেহার লিখে যখন ২০১১ সালে নরওয়ের খ্রিস্টান এন্ডারস ব্রেভিক (Anders Behring Breivik)  ঠাণ্ডা মাথায় ৭৭ জন মানুষ হত্যা করলো কই তখন তো দুনিয়ার খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে তার জন্য কেউ অভিযুক্ত করে নি। নরওয়ের কোর্ট  এই গণহত্যাকারীকে  'উন্মাদ' বলে নি, কিন্তু মানসিক রোগী বলে ঠিকই সাব্যস্ত করেছে। সে নাকি নিজেকে নিয়ে নিজে বিস্তর উৎকল্পনায় ভোগে। রোগের রকটা গুরুগম্ভির নাম আছে:  নারসিসিস্টিক পারসোনালিটি কারেক্টারিস্টিক। দারুন।  অন্য ধর্ম, কিম্বা অন্য কোন ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে না হলেও এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে অথচ আবদার ওঠে মুসলমানদের উচিত  উগ্র কর্মকাণ্ডের নিন্দা করা, জঙ্গিগিরির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। বড়ই বিচিত্র ও স্ববিরোধী জগতে আমরা বাস করি।

প্রখ্যাত চিন্তাবিদ তারিক রামাদান তড়িঘড়ি এই ‘বর্বর’ হামলা সম্পর্কে বললেন, “এটা নবির অপমানের প্রতিশোধ নয়, আমাদের ধর্ম, আমাদের মূল্য এবং ইসলামি নীতিনৈতিকতার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে”। ব্রেভিকের ক্ষেত্রে যদি খ্রিস্টান ধর্মের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না হয় শরিফ আর সৈয়দের ক্ষেত্রে ইসলামের হবে কেন? কিভাবে? তিনি কেন এ কথা বললেন বোঝা গেলনা। শরিফ আর সৈয়দ সারা দুনিয়ার মুসলমানদের প্রতিনিধি নয়। কিম্বা রসুলের ইজ্জত রক্ষা করবার জন্য বারোজনকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত তাদের নিজেদের। এর সঙ্গে ‘ইসলাম’ নামক ডাকনাম যুক্ত করবার কোন কারণ নাই। তাদের হত্যাকাণ্ডের দায় কিভাবে ‘আমাদের’ বা দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানদের হতে হবে? যদি তারা আল কায়েদার ইয়েমেনি শাখার নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকে তাহলে সেটা আল কায়দার সেই বিশেষ শাখারই দায়। সেটা সকল প্রকার ইসলামের কিম্বা ইসলাম নামধারী অন্য সকল ধারা বা প্রবণতার ওপর চাপিয়ে দেবার যুক্তি কি? একজন তো ওয়াশিংটন পোস্টে দাবি করেই বসলেন এটা আদতে কোরান শরিফের সমস্যা। ধর্ম বিরোধীরা তো যতো দোষ নন্দঘোষ ধর্মের বলে তারস্বরে চিৎকার করেই যাচ্ছে।

তারিক রামাদান ইউরোপীয় উদারনীতির অধীনে যে উদারনৈতিক ইসলামের চর্চা করেন ইউরোপীয় বাস্তবতায় তার যৌক্তিকতা বোঝা কঠিন নয়। কিন্তু যারা ইউরোপীয় উদারনৈতিকতার সমালোচক – যার আড়ালে সাম্রাজ্যবাদ এখন ইসলামকে তার প্রধান মতাদর্শিক দুষমন আকারে চিহ্নিত করে এবং ইসলামকে সভ্যতার দুষমণ হিসাবে নিরন্তর চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে নিজ সভ্যতার বর্তমান স্থিতাবস্থা বজায় রাখে – তারা এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ইউরোপের চরিত্র কিভাবে উদাম হয়ে পড়ছে সেই দিকটা বুঝতে বেশি আগ্রহী। এই বোঝাবুঝির চেষ্টা হত্যাকাণ্ডকে যেমন ন্যায্য প্রমাণ করে না, তেমনি এই  হত্যাকাণ্ডকে পৃথিবীর বর্বরতম হত্যাকাণ্ড বলেও চিহ্নিত করে না। ইসলাম নিয়ে বিপন্ন বোধ করার কোন কারন ঘটেনি। বর্বর হত্যাকাণ্ড কি তা আমরা আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়াসহ মুসলিম দেশগুলোতে দীর্ঘদিন ধরেই দেখছি। সেই অভিজ্ঞতা সকলের আছে। গাজার যুদ্ধের স্মৃতিও এখনও ম্লান  হয় নি।

লিবারেলিজম বা উদারগিরি বিশ্ব ব্যবস্থার রূপান্তরের ক্ষেত্রে বর্তমানের প্রধান মতাদর্শিক প্রতিবন্ধকতা। তারিক রামাদান যতোটা না ইসলামের তার চেয়ে অনেক বেশী ইউরোপীয় উদারনীতির পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন। ইউরোপের স্ববিরোধিতা সম্পর্কে তাঁর সমালোচনা ও বিরোধিতার পরও তিনি উদারনীতির পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি। ডবল স্টান্ডার্ড পরিহার করে ইউরোপের পক্ষে উদার হওয়া অসম্ভব। সেটা তাদের ‘আমরাও শার্লি’ প্লাকার্ড হাতে বিশাল র‍্যালির মধ্য দিয়েই প্রমাণ পাচ্ছি। এর মধ্য দিয়ে সারা দুনিয়ার মুসলমানদের তারা এটাই বলতে চাইছে যে শার্লি এবদোর মতো তারাও মুসলমান, ইসলাম ও ইসলামের নবির অপমান ও অমর্যাদা করে যাবেন, কুন্ঠিত হবেন না। কারন মত প্রকাশের স্বাধীনতা  ধর্ম বিশ্বাসের মতোই অন্ধ ও অলংঘনীয় বিশ্বাস। যারা সত্যিকার অর্থে অসাম্প্রদায়িক, উদার এবং অন্যকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করবার মধ্যে কোন মহিমা বা গৌরব দেখেন না , তাদের কাছে এই ইউরোপ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

ইসলামের নবীর কার্টুন এঁকে ধর্মপ্রাণ মানুষের মর্যাদাবোধকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করবার ক্ষেত্রে শার্লি হেবদো কুখ্যাতি অর্জন করেছে অনেক আগেই। আল কায়দার চোখে শার্লি হেবদো এবং তার কার্টুনিস্টরা দুষমন। এটা তারা ঘোষণা দিয়েই রেখেছে। এরকম হামলা হতে পারে সে সম্ভাবনা সবসময়ই ছিল। পুলিশ পত্রিকাটিকে পাহারা দিতো। অবশেষে যে আশংকা সবাই করছিল, সেটাই সত্য প্রমাণিত হোল। নিজেকে নীতিবাগীশ ভালমানুষ প্রমাণ করার জন্য এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা খুব সহজ একটা কাজ। যারা করবার, তারা তা করবেন। যেমন আয়ান হারসি আলী কিম্বা সালমান রুশদি। এই ধরনের ঘটনা কেন ঘটে সেদিকে নজর না দেওয়া বুদ্ধিবৃত্তিক আলস্য শুধু নয়, একে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু হয়েছে তার উত্তাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করবার সুবিধাবাদিতা মাত্র। এই ঘটনা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত নয়, ইসলাম বনাম সেকুলারিজমও নয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে ইউরোপের বর্ণবাদী সংস্কৃতির ফুটা হয়ে যাবার মর্মান্তিক ঘটনা।

আমরা সব নিহত মানুষদের জন্য শোক জানাই। অল্প বয়েসী শরিফ, সৈয়দ, হামিদ ও আমেদির জন্যও সমভাবে। আস্তিক কি নাস্তিক, ইসলামপন্থি কি ইসলামবিরোধী, অপরাধী কি নির্দোষ -- কিম্বা এই দুই প্রান্তের মাঝখানে যে যেখানেই থাকুক যে কোন প্রাণের অপচয়ই আমাদের মর্মাহত করে।

দুই

মত প্রকাশের স্বাধীনতা কিম্বা সহনশীলতার সীমা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু শার্লি হেবদো সকল ধর্মকেই অপমানিত করে, এরকম একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা প্রবল। এটা সত্য নয় মোটেও। অন্যকে অপমানিত করবার ক্ষেত্রে তারা উদার আর সকলের বিরুদ্ধেই কার্টুন এঁকে অপমান ও লাঞ্ছনা সমভাবে বিতরণ করেন এটা একটা মিথ মাত্র। ইউরোপীয় সেকুলারিজম এক্ষেত্রে নিজেদের সহনশীল দাবি করলেও ইহুদি ধর্মের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ইউরোপ সহ্য করে না। ফ্রান্সের আইন দারুন। সেখানে ইসলাম কিম্বা ইসলামের নবি নিয়ে কদর্য, কুৎসিত ও অপমানজনক কথাবার্তা বলা যায়, কিন্তু ফরাসি আইন অনুযায়ী 'হোলকস্ট' অর্থাৎ হিটলারের ইহুদি নিধন নিয়ে কোন ঠাট্টা-মশকরা করা যাবে না। তাদের ভাষায় এটা ‘এন্টি-সেমিটিক’। ইহুদি ধর্মের কোন অপমান করাও এন্টি সেমিটিজম হবে, কারন এতে ইহুদিদের হেয় করা হয়। কিন্তু মুসলমানদের হেয় করলে কোন অসুবিধা নাই।  সেটা করা আরামেরও বটে। তারা হিজাব পরে, লম্বা দাড়ি রাখে, আর অপমানিত হলেও সংখ্যালঘু ও দুর্বল বলে চুপ থাকতে বাধ্য হয়।

ইহুদিদের প্রশ্নে ইউরোপের রক্ষণশীলতা শুধু আইনে নয়, শার্লি হেবদোও তাদের নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করে না। সকলের বিরুদ্ধেই কার্টুন এঁকে অপমান ও লাঞ্ছনা শার্লি হেবদো সমভাবে বিতরণ করে না। মরিস সনে (Maurice Sinet ) নামের ৮০ বছর বয়সী এক কার্টুনিস্ট নিকোলাস সারকোজির ছেলেকে নিয়ে একটি কার্টুন এঁকেছিলেন। নিকোলাস সারকোজির ২১ বছর বয়েসী ছেলে জাঁ সারকোজিকে নিয়ে তামাশা।  মরিস সান শার্লি হেবদোতে ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন, জাঁ সারকোজি তার প্রেমিকা জেসিকা সিবাওঁ-দার্তি (Jessica Sebaoun-Darty) কে বিয়ে করার আগে ইহুদি ধর্মে ধর্মান্তরিত হবার পরিকল্পনা করছেন। এর সঙ্গে কার্টুনের লেখা হোল ‘এই ছেলেটা্র জীবন বহু দূরই যাবে!'। শুরুতে এ নিয়ে বিশেষ বিতর্ক হয় নি। কিন্তু  রেডিওর একজন কথক আপত্তি তুললেন। বামপন্থি পত্রিকা ‘লিবারেশান’ সেই সূত্রে তর্ক তুলল এই কাহিনী বয়ান ও ঠাট্টার মধ্যে ইহুদি বিদ্বেষ পুরা মাত্রায় হাজির আছে। কিভাবে? কারণ এখানে টাকা, ইহুদি, লোভ সবই হাজির আর তাদের সঙ্গে ইহুদির সম্পর্কের ইঙ্গিত দেওয়া আছে। তো ব্যস। এটা এন্টি-সেমিটিক – ইহুদি বিদ্বেষ। শার্লি হেবদোর তখনকার সম্পাদক ফিলিপ ভাল বললেন, জীবনে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে ইহুদি হবার যে সম্পর্ক টানা হয়েছে সেটা ইহুদিদের সম্পর্কে চিরাচরিত ধারণাই এই ক্ষেত্রে পেশ করা হয়েছে, অতএব এটা এন্টি-সেমিটিজম। মরিস সানকে তাঁর লেখা ও কার্টুনের জন্য মাফ চাইতে বলা হোল। তিনি অস্বীকার করলেন। শার্লি হেবদো তাঁকে ইহুদি বিদ্বেষের অভিযোগে বরখাস্ত করলেন। তাহলে  ইহুদি বা ইহুদি ধর্মকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করা না গেলেও ইসলাম ও মুসলমানদের অনায়াসেই অপমান ও লাঞ্ছিত করা যায়। তাদের নবিকে নিয়ে কুৎসিত ও কদর্য কার্টুন আঁকা যায়। এই হোল ইউরোপের ফ্রিডম অফ স্পিচ। এই ডবল স্টান্ডার্ড ইউরোপে চালু। শার্লি হেবদোর কার্টুনিস্টরাও এই অসম আচরণে অভ্যস্ত। ইসলামের নবীকে নিয়ে কুৎসিত ও কদর্য কার্টুন আঁকা যায়, কিন্তু ইহুদি বা ইহুদি ধর্মের সঙ্গে অর্থ বা সমৃদ্ধির কোন যোগ আছে সেই ইঙ্গিত দিলেও ইহুদি বিদ্বেষী বলে নিন্দিত হতে হবে।

এটাও প্রশ্ন যে শার্লি হেবদো ইসলাম ও ইসলামের নবিকে ব্যঙ্গ করার নামে কদর্য ও কুৎসিত কার্টুন আঁকতে পারে, কিন্তু কৌতুক শিল্পী দুদন মাবালা মাবালার (Dieudonne M'bala M'bala) বিরুদ্ধে ইহুদিদের নিয়ে ঠাট্টা ও  ঘৃণা ছড়াবার অপরাধে মামলা করা হয়েছিল। কেন? ইসলাম ও ইসলামের নবিদের নিয়ে কার্টুন আঁকা যায়, ঠাট্টা-তামাশা করা যায়, কিন্তু ইহুদিদের নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করা যাবে না কেন? ফ্রান্স যদি মত প্রকাশের স্বাধীনতা এতোই বিশ্বাস করে তাহলে মাবালা মাবালার মত প্রকাশ রুদ্ধ করবার কারন কি?

আইসিস বা ইসলামিক স্টেইট-এর মাথা কেটে নেওয়া নিয়ে ঠাট্টা ইউরোপ মত প্রকাশের স্বাধীনতা হিসাবে মেনে নেয় নি। মাবালা মাবালা এইসব নিয়েই ব্যঙ্গ করতেন। তাঁর  সাম্প্রতিক কিছু কথা ও তামাশার সার কথা কথা হচ্ছে শিরচ্ছেদ তো নতুন কিছু না। আর ফরাসিদের এতে এতো আহত হবার কী আছে? তারা কি ফরাসি বিপ্লবে গিলোটিনে এক কোপে ধড় থেকে মাথা আলাদা করে নি? অবশ্যই করেছে। শিরচ্ছেদের ইতিহাস তুলে আনলে আইসিসের সঙ্গে কমপিটিশানে ফরাসিরা নির্ঘাৎ জিতে যাবে, কোন সন্দেহ নাই। মানুষের ধড় থেকে মাথা আলাদা করেই তো ফরাসিরা বিপ্লব করেছে। একে ইউরোপ সভ্যতা বলেছে। তাহলে ধড় থেকে মাথা কাটার পথ ধরেই যদি ইউরোপ সভ্য হয় তো আইসিস সেই পথেই হাঁটছে। এতে অসুবিধা কি? যে বিপ্লবের কেচ্ছা শুনে কালো মানুষ বা দুনিয়ার প্রান্তিক  মানুষ সভ্য হবার স্বপ্ন দেখে, সেটা তো এই ফরাসি বিপ্লব। তো আইসিস মাথা কাটছে তো কী হয়েছে?  তারা সভ্যদের কাছ থেকে সভ্য হবার জন্য যা শিখেছে সেটাই করছে। শিরচ্ছেদকে অসভ্যতা বা বর্বরতা বলবার কোন যুক্তি নাই। বলা বাহুল্য ফ্রান্সসহ গোটা সভ্য ইউরোপ মাবালা মাবালার এই ঠাট্টাটা মেনে নিতে পারে নি। তার অধিকাংশ পারফরমেন্স ইউটিউব থেকে নামিয়ে ফেলা হয়েছে। আর এখন তার বিরুদ্ধে কর ফাঁকির মামলা আনার চেষ্টা চলছে। এই হোল ইউরোপের মত প্রকাশের স্বাধীনতার নমুনা। ইসলাম নিয়ে ঠাট্টা করা যাবে, কিন্তু ফরাসি বিপ্লব নিয়ে তামাশা করা যাবে না। গিলোটিন ও শিরচ্ছেদের রক্তাক্ত ও বীভৎস ইতিহাস থেকে 'বিপ্লব'কে বিযুক্ত করে আমাদের ভাবতে হবে। আর নিরন্তর ইসলামের দিকেই আঙুল তুলে বর্বরতার নজির দেখাতে হবে। তাই না?

বলাবাহুল্য, বিচ্ছিন্ন ভাবে বিচার করলে শার্লি হেবদোর ঘটনা নিঃসন্দেহে একটি হত্যাকাণ্ড এবং প্রথাগত নীতিনৈতিকতা ও আইনী বিচারে নিন্দনীয় ও বিচারযোগ্য অপরাধ। কিন্তু এর জন্য ফরাসি প্রশাসনের দায় কতোটুকু সেটাও ভেবে দেখা দরকার। শরিফ তথাকথিত জিহাদি কর্মকাণ্ডে জড়িত এটা প্রশাসনের জানা ছিল। দুই হাজার পাঁচ সালে ফরাসি টেলিভিশানে একটি ডকুমেন্টারি প্রচারিত হয়।সেখানে উগ্র ইসলামপন্থায় জড়িয়ে পড়বার আগে যে তরুণ ফরাসি নাগরিকদের মধ্যে যাদের পরামর্শ ও সহায়তা দরকার ডকুমেনটারিটি ছিল তাদের নিয়ে। সেখানে শরিফকে ডকুমেন্টারির শুরুতেই দেখা যায়। এখন বলা হচ্ছে, শরিফ কিছুকাল আগে সিরিয়ার যুদ্ধ শেষে ফিরেছে এবং তার অপারেশান ইয়েমেনের আল কায়েদার নির্দেশে।


editor

শার্লি হেবদোর সম্পাদক  স্তেফান শার্বনিয়ের (Stephane Charbonnier), কার্টুন পত্রিকাটিতে হামলায় নিহত বারোজনের মধ্যে তিনিও একজন।


শার্লি হেবদোর হত্যাকাণ্ডের পর পত্রপত্রিকায় এ যাবত যতো তথ্য আমরা পাচ্ছি তাতে পরিষ্কার যে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ফরাসি পুলিশ তাদের গ্রেফতার করবার চেষ্টা করে নি; যে বিল্ডিং-এ তারা আশ্রয় নিয়েছিল সেই ভবন আত্মসমর্পনে বাধ্য না হওয়া অবধি ঘিরে রাখার ধৈর্য তারা দেখায় নি। আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করবার কোন ভিন্ন কৌশলও তারা গ্রহণ করে নি। বরং হেলিকপ্টার দিয়ে ছাদে নেমে সেখান থেকে তারা ভেতরে ফ্লাশ গ্রেনেড ছোঁড়ে। এটা ছিল শরিফ ও সৈয়দকে উদভ্রান্ত করবার কৌশল যাতে তারা তাদের অস্ত্র সহ বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয় এবং তাদের সহজে হত্যা করা যায়। বাংলাদেশে আমরা ‘ক্রস ফায়ার’ নামে যে ব্যাপারে পরিচিত এ ক্ষেত্রেও পুলিশি হত্যাকাণ্ডের ধরণ একই। ফরাসি পুলিশের তৎপরতা বাংলাদেশের র্যােব বা পুলিশের চেয়ে ভিন্ন কিছু না। পার্থক্য হচ্ছে পুরা ঘটনাই ঘটেছে মিডিয়ার সামনে। দুই ভাইকে আইনের অধীনে এনে বিচারের চেয়েও ‘ক্রস ফায়ারে আইন বহির্ভূত ভাবে হত্যা’ করা হয়েছে। কালাশনিকভ হাতে বেরিয়ে আসা এবং এরপর আত্মরক্ষার জন্য তাদের পুলিশ হত্যা করা বাংলাদেশি পুলিশের মতোই গল্প। আইনী কায়দায় সাজানো হয়েছে। পত্রিকায় পুলিশের বরাতে প্রচার করা হয়েছে তারা নাকি শহিদ হতে রাজি, ধরা দেবে না। সেটা সত্য কি মিথ্যা জানার আর উপায় নাই। কারন শরিফ ও সৈয়দ তাদের ঈমান বা বিশ্বাস অনুযায়ী শহিদ। ফরাসি বা পাশ্চাত্য বিচার ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে তারা কেন শার্লি হেবদো পত্রিকায় হামলা করে কার্টুনিস্টদের হত্যা করেছে তার কোন ব্যাখ্যা আমরা আর তাদের মুখে শুনতে পাবো না। কিম্বা এটা ইসলামের নীতিনৈতিকতার দিক থেকেও ভুল সেই উপলব্ধি তাদের মধ্যে সঞ্চার করার মধ্য দিয়ে এই ধরণের হত্যাকাণ্ডে কেউ যেন আর উদ্বুদ্ধ না হয় সেই সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করাও আর সম্ভব নয়। এর একটা নীট ফল হবে এই যে শরিফ ও সৈয়দ বহু মুসলিম তরুণকে তাদের নবী রসুলের অপমান ও অমর্যাদার জন্য ‘প্রতিশোধ’ নিতে অনুপ্রাণিত করবে। মুসলিম তরুণ তরুণীর জীবনে নবী-রসুলদের জন্য যে সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত তার মর্যাদা ও মূল্য তাদের নিজের জীবনের সঙ্গে অভিন্ন – ফলে নবীর মর্যাদা রক্ষার জন্য জীবন বিসর্জনের মধ্য দিয়েই অনেকে নিজের জীবনের মর্যাদা ও মূল্য রক্ষাকে শ্রেয় মনে করবে।

তিন

তাহলে আমরা মেনে নিতে পারি উদ্দেশ্য যাই হোক শার্লি হেবদোর হত্যাকাণ্ড একটি অপরাধ্মূলক ঘটনা, কিন্তু অপরাধের বিচার পাল্টা আইন বহির্ভূত পুলিশি হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। এই অধ্যায় আমরা আপাতত ভবিষ্যতের পর্যালোচনার জন্য তুলে রাখতে পারি। শার্ল হেবদোর কার্টুনিস্টদের দেবতা বানানোর যেমন কোন কারন ঘটে নি। ঠিক তেমনি তাদের হত্যাকারীদের দানব জ্ঞান করবারও কোন যুক্তি নাই।

ফরাসি সমাজ আন্তর্জাতিক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, যারা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত তারা ফরাসি নাগরিক। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ফরাসি সমাজ ‘আমরা’ আর ‘ওরা’ হয়ে গিয়েছে। এই ক্ষেত্রে ‘ওরা’ হচ্ছে মুসলমানরা। বলা হচ্ছে, শার্লি হেবদো না হয় কদর্য ও কুৎসিত ভাবে ইসলামের নবীর কার্টুন এঁকেছে তাতে মুসলমানদের এতো ক্ষিপ্ত হবার কী আছে? এটাই ইউরোপের প্রশ্ন। শার্লি হেবদো তো অন্য ধর্ম এবং ব্যক্তিকে নিয়েও তামাশা করে। কই তারাতো এসে কালাশনিকভ দিয়ে গুলি করে মানুষ হত্যা করে না? এই যুক্তি থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে যেহেতু ইসলাম একটি অসহনশীল ও নিষ্ঠুর ধর্ম অতএব মুসলমান মাত্রই এ ধরণের ভয়ংকর কাজ করে। ইসলাম ধর্মের কারনেই প্রতিটি মুসলমানেরই সন্ত্রাসী ও সহিংস হয়ে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা।  থাকে। সবসময়ই। শরিফ, সৈয়দ কিম্বা আমেদির ফরাসি দেশে জন্ম হওয়া আর সেখানেই বেড়ে ওঠা; কিন্তু তারপরও তারা ‘ফরাসি’ নয়, শেষ বিচারে তারা ‘মুসলমান’। ফলে খুনের দায়ে অভিযুক্ত হলেও এটা ইসলামেরই দায়। ফরাসি সমাজ তাদের অপরাধ প্রবণতা বদলাতে পারলোনা কেন সেটা ফরাসি সমাজের সমস্যা নয়, সেটা ইসলামের সমস্যা।

আইনবহির্ভূত ভাবে অপরাধীদের হত্যাকাণ্ড সাঙ্গ করা হোল। সেখানেই শেষ নয়। পাশ্চাত্য এখন ইসলামকে কাঠগড়ায় তুলতে চায়। দ্বিতীয়ত তারা বলতে চায়, এটা ‘ফ্রি স্পিচ’ বা যা খুশি তাই বলা, লেখা ও কার্টুন আঁকার স্বাধীনতা। অন্যের মর্যাদা ক্ষুন্ন করা কিম্বা অন্যকে অপমানিত করা এতোই পবিত্র অধিকার যে এর সঙ্গে নাকি ঠাট্টা-তামাশা, ব্যঙ্গ বা ইয়ার্কির কোন পার্থক্য নাই। পাশ্চাত্য যদি এই পার্থক্য করতে অক্ষম হয় তাহলে সেটা তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি বা সমাজের সমস্যা নয়, সেটা ইসলামেরই সমস্যা। ফ্রিডম অব স্পিচ বা যা খুশি তাই বলা, লেখা বা কার্টুন আঁকার অধিকার একটি ‘পবিত্র’ অধিকার। কোন ভাবেই এই ‘পবিত্র’ অধিকার লংঘন করা যাবে না। সীমাহীন ও অলংঘনীয় অধিকারের এই পবিত্রতা ফ্রিডম অফ স্পিচকে স্রেফ ধর্ম ও ধর্মতত্ত্বে পরিণত করে ফেলে। সেই দিকে অধিকারবাদীদের বিশেষ হুঁশ নাই। অথচ এই ধার্মিকতাকেই সেকুলার দাবি করে পাশ্চাত্য ধর্মের বিরুদ্ধে – বিশেষত ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। বেশ কৌতুকের ব্যাপার বটে।

শার্লি এবদোর অফিসে বন্দুকধারীর হামলায় নিহতদের প্রতি শোক জানাতে গিয়ে শোকার্তরা বলছেন, ‘'আমরাও শার্লি’। সেটা ঠিক, কারণ তাঁরা সকলেই যে নীতিতে বিশ্বাস করেন সেটা হচ্ছে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ – পাশ্চাত্য লিবারেল চিন্তা ও সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে যার ভূমিকা নির্ণায়ক। সারকথা হচ্ছে, কেউ মুখের কথায়, কিম্বা লেখালিখিতে কারো ধর্ম, সংস্কৃতি, পরিচয় কিম্বা ব্যাক্তির আত্ম-মর্যাদার সঙ্গে যুক্ত কোন কিছুকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করলেও সেটা মেনে নিতে হবে। নবী-রসুলদের নিয়ে কুৎসিৎ ঠাট্টা, মশকরা, কার্টুন কিম্বা লেখালিখি এই নিয়মের বাইরে নয়। কারণ সেটা লাঞ্ছনাকারীর মত প্রকাশের স্বাধীনতা। তারা ধর্ম বা নবী-রসুলদের নিয়ে যা খুশি বলতেই পারে। অতএব যাকে আহত করা হয়েছে তাঁকে সেটা মেনে নিতে হবে। এর নাম সহনশীলতা। টলারেন্স। উদার সমাজে বাস করতে হলে সহনশীল হতে হবে। কথা বা কার্টুন দিয়ে প্রতিপক্ষকে পাল্টা আঘাত করা যাবে, কিন্তু সেটা শারীরিক হতে পারবে না। আহত হওয়াটা মানসিক। যিনি আঘাত পেয়েছেন তাঁকে অলংঘনীয় পবিত্র ব্যাক্তি অধিকারের সুবাদে সেটা মনে মনে মেনে নিতে হবে।

ব্যাক্তিতান্ত্রিক অধিকারের এই ধর্মতাত্ত্বিক পরিণতি কিম্বা তাকে অন্ধ ও গোঁড়া বিশ্বাসে রূপান্তর আধুনিক সেকুলারিজমের সমসাময়িক বৈশিষ্ট। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক ব্যাক্তি ও সমাজের সম্পর্কে যে রূপান্তর ঘটায় তার বিচার ছাড়া ব্যক্তিতন্ত্রের এই আধ্যাত্মিক পরিণতি ভালভাবে বোঝা যাবে না। এখানে সেই ব্যাখ্যার সুযোগ সীমিত। যে সমাজে ব্যাক্তির চেয়ে সমাজ ছোট, কিম্বা সমাজের উর্ধে ব্যক্তি অধিষ্ঠিত সেই সমাজের পক্ষে কেন নবী-রসুলদের অমর্যাদাকে পুরা সমাজের অমর্যাদা হিসাবে গণ্য করা হয় সেটা অনুধাবন করা মুশকিল। ফলে ফ্রান্স শার্লি হেবদোর হত্যাকাণ্ডের স্মরণে মোমবাতি জ্বালিয়ে ‘Je Sui Charlie’ বা ‘আমরাও শার্লি’ প্লাকার্ড হাতে নিয়ে শোক মিছিল করতে পারে সহজে। কারন তারা তাদের ধর্ম বিশ্বাসেরই প্রতিনিধিত্ব করছে – যা খুশি তাই বলা, লেখা ও কুৎসিত ও কদর্য কার্টুন লিখবার গোঁয়ার্তুমি। আর তাদের এই অন্ধ বিশ্বাসকে লিবারেলিজম আখ্যা দিয়ে তাকে প্রতিস্থাপন করছে ইসলামের বিরুদ্ধে। বিশেষত তাদের বিরুদ্ধে যারা তাদের সমাজে সংখ্যালঘু ও দুর্বল। তাদের ধারণা ‘মর্যাদাবোধ’ যার যার ব্যক্তিগত সংবেদনার ব্যাপার। মর্যাদা আহত হবার মানদণ্ড দিয়ে ব্যাক্তির অধিকার সংকুচিত করা যাবে না। বলা যাবে না এই হচ্ছে ঠাট্টা-তামাশা ব্যঙ্গ-রসিকতা করবার সীমা -- এই সীমা লংঘন করবার অর্থ শুধু অপর কোন ব্যাক্তিকে নয়, পুরা একটি কমিউওনিটি বা সমাজকেও অমর্যাদা ও অপমানিত করা। ব্যাতিক্রম থাকলেও ফরাসি সমাজ সাধারণ ভাবে এতোই সংবেদনহীন হয়ে পড়েছে যে ‘আমিও শার্লি’ বলার মধ্য দিয়ে তারা নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করার চাইতে বিশ্বব্যাপী সেই রটনাকেই প্রবল করছে যে শার্লি হেবদোর মতো ইসলামের নবী রসুলদের অপমান করা তাদের আদপ বা সংস্কৃতির মধ্যেই পড়ে। তারা নিজেরাও শার্লি হেবদোর মতো অন্যদের অপমান ও অবমাননা করতে প্রস্তুত। কারন ‘আমরাও শার্লি’। বেশ।

আমরাও শার্লি প্রমাণ করবার জন্য ইউরোপ ও আমেরিকার পত্রপত্রিকায় শার্লি হেবদোর কার্টুনগুলো আবার ছাপবার হিড়িক পড়েছে। তারা প্রমান করতে চায় এই ধরনের হামলায় ভীত হয়ে মুখে, কথায়, কিম্বা কার্টুনে যা খুশি তাই বলতে লিখতে ও আঁকতে পারার অন্ধ বিশ্বাস তারা ত্যাগ করবে না। ইউরোপ ফ্রিডম অফ স্পিচ রক্ষা করার নামে মূলত যেভাবে নগ্ন ভাবে তাদের বর্ণবাদী ও ইসলামের প্রতি আতংক করছে তা এক দর্শনীয় ব্যাপার বটে।

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে দুনিয়াব্যাপী তারা যে যুদ্ধ করছে ইউরোপের এই দৃশ্যমান বর্ণবাদ যুদ্ধেরই সম্প্রসারণ মাত্র। তারা নিজেরাই দাবি করছে যে শরিফ আল কায়িদার ইয়েমেনি শাখার নির্দেশ পালন করছে। জানি না এটা সত্য কিনা। যদি তাই হয় তাহলে যে যুদ্ধ ইউরোপ অন্যের ভূখণ্ডে করছিল তা ক্রমে তার নিজ দেশের সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়ছে।

যদি সত্যিই তাই হয় তাহলে নিজেদের পক্ষে ইউরোপে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটাবার কৌশলের দিক থেকে আল কায়িদা খুবই সফল বলতে হবে। যে গর্ত ইউরোপ অন্যদের জন্য খুঁড়েছিল, সেই গর্তে তারা নিজেরাই পা দিচ্ছে।

ইউরোপের বিবেক ফিরে আসুক। এ ছাড়া দূর থেকে আমরা আর কীইবা বলতে পারি।

১২ জানুয়ারি ২০১৫। ২৯ পৌষ ১৪২১। শ্যামলী।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।