দেখলেই গুলি?


এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম, ‘এরশাদ তোমাকে দেখা মাত্রই গুলি করবে’। সে রকম একটা নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সেই সময়। তখনই বুঝেছিলাম এটা মরণকামড়ের মতো। শেষ মূহূর্ত হাজির। সামরিক শাসকের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া স্রেফ অল্পকিছু সময়ের ব্যপার মাত্র। তাই ঘটেছে। গতকাল দেখছি, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেছেন, ‘একজন ব্যক্তি যদি বোমা ফাটায়, তাহলে পাঁচজন লোক নিহত হতে পারে। এ দৃশ্য কোনো বিজিবি সদস্যের নজরে এলে ওই বোমা বহনকারীকে ক্যাজুয়ালটি (হতাহত) করা তার দায়িত্ব।’ 

না, এটা তাঁর দায়িত্ব না। তাঁর দায়িত্ব সীমান্ত রক্ষা করা। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর হাতে বাংলাদেশের নাগরিকদের গুলি করে হত্যার হাত থেকে বাঁচানো। কে বোমা হাতে চলা ফেরা করছে, কিম্বা কে বোমাসদৃশ কিছু ফাটাবে সেটা তিনি আগাম জানতে পারবেন না, সেটা সম্ভব নয়। তিনি বলছেন, কেউ বোমা ফাটাবে এমন সন্দেহ হলে তিনি গুলি করবেন। অথচ স্বীকার করছেন, ‘‘বিজিবির সবই লিথ্যাল (প্রাণঘাতী) অস্ত্র। বিজিবির সদস্যরা কাউকে গুলি করবে না। তবে কেউ আক্রমণ করলে জীবন বাঁচাতে গুলি করতে পারে’। যদি বিজিবি গুলি না করে, তাহলে এইসব বলার কী দরকার! আক্রমণ করলে আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালানো আর আগেভাগে কাউকে বোমাবহনকারী সন্দেহ করে গুলি করার মধ্যে ফারাক আছে। মানবাধিকার কর্মী হিসাবে আমি বিজেবির মহাপরিচালকের মন্তব্যের তীব্র নিন্দা করি। এটা তার এখতিয়ার বহির্ভূত মন্তব্য। এটা বলার কোন আইনী বা সাংবিধানিক অধিকার তার নাই। আশা করি তিনি এই বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেবেন। বাংলাদেশ এখন সামরিক শাসনের অধীনে নয়, যেখানে সংবিধানের মৌলিক অধিকার স্থগিত করে রাখা হয়। কিম্বা শেখ হাসিনা জরুরী অবস্থা জারি করেছেন বলেও আমরা শুনি নি। আইনের অধীনে থেকে নাগরিকদের সাংবিধানিক ও মানবিক অধিকার রক্ষা করাই আইনশৃংখলা বাহিনীর কর্তব্য। বিজেবির অস্ত্র প্রাণঘাতি জেনেও তা নাগরিকদের ওপর ব্যবহারের চিন্তাটাই বিপজ্জনক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। নাগরিকদের হত্যা তো দূরের কথা। ( দেখুন প্রথম আলো, ১৬ জানুয়ারি ২০১৫)।

মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদের বক্তব্য শুনবার পর থেকেই ভাবছিলাম। দেখা মাত্রই গুলির কথাবার্তা আমার কাছে এবারও মরণকামড়ের লক্ষণ বলেই মনে হয়েছে। আইনশৃংখলা বাহিনী তো অকাতরে আইন বহির্ভূত ভাবে গুলি করছে, এটা আবার সাংবাদিক সম্মেলন করে বলবার দরকার কি? এর উত্তর আছে দৈনিক যুগান্তরের খবরে। ‘কড়া নিরাপত্তার মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্পর্শকাতর ও জনবহুল স্থানে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে ককটেল, বিস্ফোরণ, গুলি ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা’ (দেখুন, ‘অপরাধী কারা?’ ১৬ জানুয়ারি ২০১৫)। যে ভাষাতেই খবরটি পরিবেশিত হোক সারকথা হোল অবরোধ কর্মসূচি চলছে, চলবে এবং তার মাত্রা বাড়তে থাকবে, কমবে না। একে এখন হুমকি দিয়ে থামিয়ে দেবার জন্যই দেখা মাত্র গুলির কথা বললেন বিজেবির মহাপরিচালক।

তাঁর কথাকে আমি ক্ষমতাসীনদের সম্ভাব্য পতনের অগ্রিম আলামত হিসাবে নির্ণয় করেছি। তবে আমার বিচারে এটা তিন নম্বর লক্ষণ। লক্ষণ আরও আছে। এবার কবিতা না লিখে আলামতগুলো বোঝাবার জন্যই এই কলামটি পাঠকদের দরবারে পেশ করছি।

দুই

ডিজিটাল টেকনলজি ও ডিজিটাল বাংলাদেশের রমরমা সময়েও বাস্তবে কী ঘটছে সেটা জানা বেশ কঠিন। মাঠের খবর জানতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। অথচ মাঠের খবরের ওপর এখন নির্ভর করছে বাংলাদেশের আগামি রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বাংলাদেশ ছোট দেশ। কঠিন হলেও কী ঘটছে জানতে চাইলে জানা কঠিন নয়। এটা পরিষ্কার যে উত্থানপতন সত্ত্বেও বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচী সফল। সেটা একান্তই তৃণমূলের কর্মীদের জন্য। দুই একটি ব্যাতিক্রম ছাড়া গণমাধ্যম ক্ষমতাসীনদের নির্বিচারে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে নাগরিকদের দমনপীড়ন আড়াল করবার জন্য বিরোধী দলের সহিংসতা মুখ্য করে তুলছে তারা। সহিংসতা ঘটছে এবং এতে আনন্দিত হবার কিছু নাই। তাকে নিন্দা করার মধ্য দিয়ে রাজনীতিকে নীতিকথায় পরিণত করবার সততা থাকলে দুই পক্ষের সন্ত্রাসের খবর তারা দিতো। গণমাধ্যম সেটা দিচ্ছে না।

ফলে মাঠের ভূমিকা জাতীয় রাজনীতিকে কিভাবে আগামি দিনে প্রভাবিত করতে পারে এবং করছে সেটা সকলের কাছে স্পষ্ট নয়। অধিকাংশ গণমাধ্যম তাদের ভূমিকা অব্যাহত রেখেছে। সেই ভূমিকা হচ্ছে ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধী আন্দোলন স্তব্ধ করে দেবার জন্য ক্রমাগত প্রপাগাণ্ডা চালানো। এতে আসল খবর জেনে বাস্তবোচিত বিশ্লেষণ সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। এমনকি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের জন্যও। সাধারণ মানুষ – যারা সরকারের পক্ষে নন, কিন্তু সরাসরি আন্দোলন সংগ্রামেও নাই তারা কিছুটা বিভ্রান্ত বটে।

সরকার ক্রমে সব নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসছে এই প্রপাগাণ্ডায় অনেকের মনে একটি দ্বিধান্বিত প্রশ্ন জারি আছে যে এই সরকারের পতন ঘটবে কি? উত্তর: অবশ্যই। সেটা আসন্নই বলা যায়। পতনের প্রশ্ন বিতর্কিত নয়, বিতর্কের জায়গা হোল পতনের চরিত্র কী রূপ নেবে? সেটা কি একটি গণতান্ত্রিক রূপান্তরের, নাকি শুধু হস্তান্তর? নাকি ক্ষমতাসীন ও তাদের প্রতিপক্ষের বাইরে তৃতীয় কোন শক্তি। সেনাবাহিনী যেমন। এটা এখন জাতীয় নেতানেত্রীদের ওপর পুরাপুরি নির্ভর করবে না। নির্ভর করবে যারা মাঠে আন্দোলন করছেন তারা তাদের সংগ্রামের পরিণতি কিভাবে দেখতে চান তার ওপর। অর্থাৎ নির্ভর করবে তৃণমূল নেতাদের রাজনৈতিক উপলব্ধি, দূরদৃষ্টি এবং তা বাস্তবায়নের চেষ্টা।

বলাবাহুল্য ক্ষমতাসীনদের বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বৈধ মনে করে না। বল প্রয়োগ ছাড়া সরকারের কোন নৈতিক ভিত্তি আছে সেটাও অধিকাংশ মানুষ মনে করে না। এই পরিস্থিতি থেকে নিস্তারই মানুষের এখনকার প্রধান প্রত্যাশা। সে প্রত্যাশা মিটবে, দ্রুত, এতে কোনই সন্দেহ নাই। নৈতিক ভাবে অন্যায্য, সাংবিধানিক ভাবে অবৈধ ও নিরন্তর নাগরিকদের সাংবিধানিক ও মানবিক অধিকার লংঘনকারী কোন সরকারের পক্ষেই বেশীদিন ক্ষমতায় থাকা সম্ভব না। এটা স্রেফ কাণ্ডজ্ঞানেই বলা যায়। তুলনায় সামরিক শাসন কিম্বা সংবিধান বহির্ভূত একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা টিকে থাকতে পারে, কারন মানবাধিকার বা সাংবিধানিক বিধিবিধানের প্রতি তার কোন দায় থাকে না। সেই ক্ষেত্রে বল প্রয়োগই ক্ষমতার ভিত্তি। ক্ষমতার চরিত্র তখন স্ববিরোধী নয়। কিন্তু সংবিধান ও গণতন্ত্রের নাম করে ক্ষমতা দখল করে রাখা কঠিন ব্যাপার। ক্ষমতা তখন অস্থির ও নিরন্তর অস্বস্তিতে ভোগে।

এই ধরনের ক্ষমতা গত বছর ৫ জানুয়ারির পর এতোদিন টিকে থাকার কথা ছিল না। বিরোধী দল অকস্মাৎ আন্দোলনে বিরতি দিয়ে ক্ষমতাসীনদের জীবৎকাল দীর্ঘ করেছে। এবার যখন খালেদা জিয়া নতুন করে আন্দোলনে নেমেছেন বোঝা যাচ্ছে তিনি পুরাপুরি তৃণমূলের নেতা ও কর্মীদের ওপর নির্ভর করে এই বিপজ্জনক কৌশল গ্রহণ করেছেন। তাঁর দিক থেকে এটা শেষ প্রতিরোধ। এর জয় পরাজয়ের ওপর তাঁর নিজের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এই কর্মসূচি থেকে তাঁর এখন আর পিছু ফিরে আসার কোন সুযোগ নাই। অবরোধের কর্মসূচির ডাক দিয়ে অবরুদ্ধ হয়ে থাকাই তাঁর সাময়িক নিয়তি। তাঁর ভাগ্য তিনি এক হিসাবে তুলে দিয়েছেন তৃণমূলের কর্মীদের হাতে। তাদের ওপর এখন বিএনপির ভাগ্য নির্ভর করছে।

প্রশ্ন হচ্ছে বাস্তবে – অর্থাৎ অবরোধ কর্মসূচি শুরু হবার পর কী এমন ঘটনা মাঠে ঘটল যাতে ক্ষমতাসীনদের পতন আসন্ন হয়ে উঠতে পারে। কী আলামত দেখছি যাতে আমরা অনুমান করি যে বিদ্যমান পরিস্থিতি বদলে যাতে পারে।

ঘটনা আসলে আগেই ঘটেছে। ক্ষমতাসীনরা দাবি করছিল গণতন্ত্রের কী দরকার? এখন দরকার উন্নয়ন। নির্বাচন একটা হয়েছে ৫ বছর পর আবার দেখা যাবে। বিরোধী দল আন্দোলনে হঠাৎ ক্ষান্তি দেওয়ায় এই আওয়ামি থিসিস বল পেয়ে যায়। দ্রুত একটি সুষ্ঠ ও স্বচ্ছ নির্বাচন না করলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়বে – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশ যে কথা বলে আসছিল তা মিথ্যা হয়ে গিয়েছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়া সাত দফা দাবি নিয়ে নতুন ভাবে আন্দোলনে এলেন। তিনি নির্বাচনের কোন নির্দিষ্ট দিন বেঁধে দিলেন না। কার্যত কিছুই প্রায় বললেন না। মাহমুদুর রহমানকে অন্যায় ভাবে বন্দি করে রাখা থেকে মুক্তির দাবি ছিল, ঠিক, কিন্তু এর বাইরে তিনি শুধু সুষ্ঠ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের কথাই বললেন। দেখা গেল শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার প্রস্তাবিত অতি নিরীহ সাত দফা দাবি মেনে একটা সংলাপ বা সমঝোতার কোন উদ্যোগই নিলেন না। বরং বিএনপিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করবার নীতিতেই অবিচল থাকলেন। খালেদা জিয়া মামলায় হাজির হবার জন্য আদালতে গিয়েছিলেন। সেখানে সশস্ত্র ভাবে লিগ-সমর্থকদের লেলিয়ে দেওয়া হোল। খালেদা ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালন করবেন বলে একটি সমাবেশ করতে চাইলেন। তাঁর কার্যালয় বালুর ট্রাক ও পুলিশের গাড়ি দিয়ে ঘেরাও রাখা হোল। পুলিশের নিশ্ছিদ্র বেষ্টনি দিয়ে ঘিরে রেখেও ক্ষমতাসীনরা স্বস্তি পাচ্ছিল না, অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সাবেক প্রধান মন্ত্রী ও তাঁর দলের মহিলা সদস্যদের চোখে টেলিভিশান ক্যামেরার সামনেই কোন প্রকার উসকানি ছাড়া পিপার স্প্রে ছুঁড়ে মারা হোল। বোঝা যাচ্ছিল ক্ষমতাসীনরা যারপরনাই ভীতি ও অস্থির। বোঝা যায় ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার কোন নৈতিক শক্তি ক্ষমতাসীনদের আর নাই। খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে তালা লাগাবার মধ্য দিয়েই ক্ষমতাসীনরা তাদের ক্ষয়ের খবর ঘোষণা করে দিয়েছেন। যারা তালা মেরেছে ক্ষমতা থেকে তাদের পতন ছাড়া তালা খুলবার চাবি খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই সত্য ফর্সা হয়ে উঠেছে।

তিন

না। আমি গণক নই, এটা গণকদারি নয়। বাস্তবতার বিচার। ক্ষমতাসীনদের সম্ভাব্য পতনের প্রথম আলামত হচ্ছে সাধারন মানুষের দোদুল্যমানতা সত্ত্বেও অবরোধ কর্মসূচির অভাবিত সাফল্য। দমন পীড়নের মুখে অবরোধ ধীরে ধীরে স্তিমিত না হয়ে বরং আরও জোরদার হচ্ছে। ঢাকা শহরে থেকে যা বুঝে ওঠা কঠিন। সরকারকে বিজেবি মোতায়েন করতে হয়েছে, বেসরকারী প্রশাসন আর সামাল দিতে পারছে না।

দ্বিতীয় আলামত হচ্ছে নতুন করে আরও কঠোর ভাবে দমন নিপীড়ন শুরু করবার সরকারী সিদ্ধান্ত। দমন নিপীড়ন হত্যা গুম নতুন কিছু নয়। কিন্তু অবরোধ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীনদের কঠোরতা কর্মসূচিকে আরও বেগবান করবে। নতুন করে কঠোর হওয়া ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক পরাজয় ও নৈতিক দুর্বলতার লক্ষণ। এটা করতে গিয়ে বিভিন্ন জেলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ নিয়োগ এবং যৌথ বাহিনীর অপারেশান চালিয়ে বিরোধী দল ও তাদের সমর্থকদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, হত্যা ও গ্রেফতার রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

গুম, গুমখুন, হত্যা ও নির্যাতন নতুন কিছু নয়। ক্ষমতাসীনদের মানবাধিকার লংঘনের মাত্রা অতীতের যে কোন রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে। আন্দোলনে সহিংসতা কেউই চায় না, কিন্তু ক্ষমতাসীনরা নিজেই যেখানে আইনী বিধিবিধান মানে না, নাগরিকদের মানবাধিকার নিশ্চিত করে না, সেখানে বিরোধী পক্ষের আন্দোলন সহিংস ও বেআইনী হতে বাধ্য। যদি সংবিধানিক বিধিবিধান শুধু বিরোধী দলেরই মান্য, ক্ষমতাসীনদের মান্য নয়, তাহলে সে ক্ষমতা সাংবিধানিক নয়। পাল্টা বলপ্রয়োগ ছাড়া তার অন্য কোন মীমাংসা নাই। বাংলাদেশে তাই ঘটছে। নীতিবাগীশরা বিস্তর হিতোপদেশ দিচ্ছেন দেখতে পাই। ক্ষমতাসীনদের যদি আইন ও সংবিধান মেনে চলতে আমরা বাধ্য করতে না পারি তাহলে বিরোধী পক্ষকে এই ক্ষেত্রে হিতোপদেশ দিয়ে লাভ নাই। অবরোধ ও আন্দোলন জেল জুলুম দিয়েও প্রতিপক্ষকে দমানো যাবে না, বরং তা বাড়বে।

সরকার অসাংবিধানিক ও বে-আইনি কাজ করলেও প্রশাসনের একাংশ সরকারকে মদদ দিয়ে পরিস্থিতিকে আরও সহিংস করে তুলছেন। প্রশাসনকে বুঝতে হবে, ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে তারা আইন বহির্ভূত কাজ করতে পারেন না। খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা দিতে গিয়ে তাকে তালাবদ্ধ করে রাখবার এখতিয়ার তাদের নাই। আশা করি এই ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর লিখিত নির্দেশ তাদের কাছে আছে, যাতে তারা আগামিতে নিজের সাফাই কিছুটা হলেও গাইতে পারেন। লিখিত নির্দেশ থাকলে বলতে পারবেন তারা স্রেফ হুকুমের গোলামগিরি করেছেন, নিজেদের বিবেক বুদ্ধি মানবিক সংবেদনার তোয়াক্কা করেন নি। আইন শৃংখলাবাহিনী আন্দোলনকারীদের আইনবহির্ভূত ভাবে হত্যা করতে পারে না। মনে রাখা দরকার শেখ হাসিনা পুলিশ ও প্রশাসনের জন্য কোন দায়মুক্তির বিধান করেন নি, করলেও সেটা আইনে দেশীয় আইনে টিকবে না, আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের দিক থেকে তো নয়ই। ফলে পুলিশ ও প্রশাসন যা কিছুই করছে তার দায় ক্ষমতাসীনদের পতন হলে তাদেরই ঘাড়ে এসে পড়বে। এর জন্য তাঁরা তৈরি কিনা কে জানে। আমার ধারনা শেখ হাসিনা দায়মুক্তির বিধান না করার মানে পুলিশ, র‍্যাব ও প্রশাসনের কাছে স্পষ্ট নয়। স্পষ্ট হতে শুরু করলে ক্ষমতাসীন শক্তি প্রশাসনকে আগের মতো জনগনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে না। শেখ হাসিনা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করতে পারেন, কিন্তু প্রধ্নমন্ত্রী হলেও তাঁর কোন সাংবিধানিক ক্ষমতা নাই যাতে বেগম জিয়াকে বলতে পারেন তিনি বাড়ি যেতে চাইলে যেতে দেওয়া হবে, কিন্তু অন্য কোথাও নয়। একজন স্বাধীন নাগরিক যেখানে খুশি সেখানে তিনি যেতে পারেন। নাগরিক আইনের অধীন, কিন্তু কারও হুকুমের চাকর নয়। এখন ক্ষমতাসীনরা বলছে, খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ রাখা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। তাহলে প্রশাসনকেই দায় নিতে হবে।

ক্ষমতাসীনদের দমন-পীড়নের মুখে মার খেয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সাময়িক চুপ থাকতে পারে, কিন্তু শক্তি সঞ্চয় করে তারা আবার ফিরে আসবে। কারন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যেই তাদের প্রত্যাবর্তনের শর্ত হাজির রয়েছে। সেটাই ঘটছে এবার। এটা হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের সম্ভাব্য পতনের তৃতীয় আলামত। তারা পারছে কারন জনসমর্থন তাদের বিরুদ্ধে নয়, ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে। সরকার ও প্রশাসন যেখানে সহিংস ও সন্ত্রাসী সেই ক্ষেত্রে আন্দোলনকারীদের নিয়মতান্ত্রিকতা বা আইনের বিধান মেনে চলার কথা বলা হাস্যকর। গাড়ি পোড়ানো ও পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করার নজির খুবই নিন্দনীয় কাজ। অতীতে এ কাজ আওয়ামি লিগ করেছে, তারাই প্রথম নজির সৃষ্টি করেছিল । তার অনুকরণ বিরোধী জোট করছে সেটাও সমান নিন্দনীয় সন্দেহ নাই। যদিও বোঝা মুশকিল ক্ষমতাসীনরা নিজেরাই কুকাণ্ড করে বিরোধী দলের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে কিনা। সন্ত্রাসের জন্য জনগণ যখন সরকারের ওপর বিশ্বাস হারায়, তখন এভাবে চিন্তা দোষনীয় নয়। কিন্তু, নিন্দা, উদ্বেগ প্রকাশ কিম্বা হতাহতের জন্য দুঃখ প্রকাশ রাজনৈতিক বাস্তবতার মীমাংসা হতে পারে না। দুই পক্ষের কঠোর সমালোচনা নিজের বিবেককে চোখ ঠার দিয়ে রাখার মতো ব্যাপার, কিম্বা নিজেকে নীতিবাগীশ প্রমাণ করে বাহাবার নেবার চেষ্টা।বাংলাদেশের বাস্তবতায় সংঘাত অনিবার্য। ন্যূনতম রাজনৈতিক সংস্কারও মেলা রক্তের দাবি করে। ইতোমধ্যে বহু প্রাণের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের পক্ষে জনমত তৈরির জন্য বিরোধী দলের ওপর দায় চাপিয়ে দেওয়া কিম্বা বিরোধী দলকে এক তরফা নিন্দা করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পক্ষে দাঁড়ানো মহৎ কোন কাজ নয়। এই ধরণের যুক্তির সারকথা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও আইনশৃংখলা বাহিনীর দ্বারা ক্ষমতাসীনদের সহিংসতা ন্যায্য। এটা তো হয় না।

চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় যৌথবাহিনীর অভিযানের খবর কিছুটা এসে পৌঁছাচ্ছে। পত্রিকার খবরই বলছে, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ ও আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এর আগে সাতক্ষীরায় একই ধরণের অভিযানে ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর অংশ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছিল। সত্য কি মিথ্যা সেটা ভিন্ন তর্ক। মানুষ বিশ্বাস করেছে। কথা হোল, দেশের আইন শৃংখলা বাহিনী তাদের নিজেদের নাগরিকদের ওপর এই ধরণের যুদ্ধাভিযান চালায় সেটাই বিস্ময় ও সন্দেহ তৈরি করে।

পত্রিকার রিপোর্ট হচ্ছে, “ সকাল থেকে র‍্যাব, পুলিশ ও বিজিবি’র সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর একাধিক দল বিভক্ত হয়ে অভিযান শুরু করে। পুরো উপজেলায় পরিচালিত হয় এ অভিযান। অভিযানে বিভিন্ন বাড়িতে তল্লাশির নামে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে কমপক্ষে ৩০টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছাই হয়েছে বাড়ির আসবাবপত্র। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় পুরো এলাকা এখন পুরুষশূন্য। এলাকার সকল দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত এসব এলাকা সন্ত্রাসমুক্ত না হবে ততক্ষণ তাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে” (দেখুন দৈনিক মানব্জমিন ১৬ জানুয়ারি ২০১৫) । অভিযানে ২৫ জামায়াত-বিএনপি’র কর্মীকে আটক করা হয়েছে। চাঁপাই নবাবগঞ্জের কানসাটে র্যািবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মতিউর রহমান (৩০) নামে এক ছাত্রদল নেতা নিহত হয়েছেন। মতিউর রহমান শ্যামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহ-সভাপতি।

সার কথা হচ্ছে সরকারের অবিশ্বাস্য দমন পীড়নের পরেও তৃণমূল থেকে অবরোধ কর্মসূচি সফল চেষ্টা জোরেসোরেই জারি আছে। এটা সম্ভবত এখন স্পষ্ট যে বিরোধী দলের কর্মসূচি কেবল একটি কারনেই ব্যর্থ হতে পারে। যদি খালেদা জিয়া আন্দোলনে অবিচল না থেকে দোদুল্যমানতা প্রদর্শন করেন। আমার অনুমান পিছু হটে আসা তাঁর পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়। তাঁকে গ্রেফতার করলেও তিনি তৃণমূলে যে সংবাদ পৌঁছয়ে দেবার সেটা খানিক পেরেছেন। ফলে তাঁর চারদিকে ঘিরে থাকা জাতীয় নেতৃবৃন্দ তাঁর কর্মসূচি আগে যেভাবে বানচাল করে দিয়েছিল, তিনি অবিচল থাকলে সেটা আর সম্ভব হবে না। কারন অবরোধ কর্মসূচি নেতাদের গুণে নয়, নিম্নস্তরের কর্মীদের কারনে বেগ পাচ্ছে। এটা দীর্ঘস্থায়ী হলে নেতৃত্ব অপেক্ষাকৃত তরুণদের হাতে চলে যাবে। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য তার পরিণতি কী দাঁড়াবে, সেটা বলবার সময় আসে নি। তবে অবরোধ আন্দোলন নতুন চরিত্র নিয়ে দাঁড়াবে। আন্দোলন আরও এক স্তর তীব্র হলে সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে আমার ধারণা।

আপাতত আমরা বোমা হাতে সন্দেহে কাউকে হত্যার চিন্তায় গভির ভাবে উদ্বিগ্ন। একে ক্ষমতাসীনদের পতনের আওয়াজ গণ্য করলেও এই ধরণের মানবাধিকার বিরোধী চিন্তার নিন্দা জানানো আমাদের কর্তব্য।

১৬ জানুয়ারি ২০১৫। ৩ মাঘ ১৪২১। শ্যামলী।

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।