‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ বিতর্ক


সম্প্রতি দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়াশান মিলনায়তনে ২৮ জানুয়ারি তারিখে ‘চলমান জাতীয় সংকট: উত্তরণের পথ’ শীর্ষক একটি সভায় 'জাতীয় ঐকমত্যের সরকার' গঠন এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব করেছেন। সেই সভায় বিচারপতি আব্দুর রউফ, খোন্দকার মাহবুব হোসেন, লে: কঃ (অঃ) মোহাম্মদ সেলিম, রুহুল আলম গাজী সহ আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে আমাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তার জন্য তাঁকে ও সভার উদ্যাক্তাদের আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। দৈনিক পত্রিকায় এ বিষয়ে খবর অনেকেই দেখেছেন।

বলাবাহুল্য বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সময় পারস্পরিক আলাপ আলোচনা ও সমাধান অন্বেষণ অবশ্যই ইতিবাচক। সভায় ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ গঠনের প্রস্তাব পেশ করা হবে তা আমি আগে জানতাম না এবং আমার সঙ্গে আগে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয় নি। প্রফেসর ডক্টর এমাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া কারা এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটাও জানি না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা জটিল এবং সমাধানের নীতি ও কৌশল নির্ধারণ আগের যে কোন পরিস্থিতির তুলনায় কঠিন। এই ধরনের সংবেদনশীল সময়ে কোন প্রস্তাব পেশ করার আগে তা নিয়ে প্রচুর আলাপ আলোচনা দরকার এবং বাস্তব ও যুক্তিসঙ্গত হলেও কখন কিভাবে কোন ভাষায় তা হাজির করতে হবে সেই বিষয়েও বিচক্ষণ ও দুরদৃষ্টিসম্পন্ন হওয়া খুবই জরুরী।

এটা ঠিক যে ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ কথাটি নামকরণের দিক থেকে আওয়ামি লীগের পুরানা রাজনীতির অনুরণন, এমনকি ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ মার্কা ‘জাতীয় ঐকমত্য’কে প্রাধান্য দিয়েই ক্ষমতাসীনরা নির্বাচন ও সরকার গঠন করেছে। হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেননকে নিয়ে বর্তমানে যে সরকার রয়েছে সেটা জাতীয় ঐক্যের আওয়ামী ধারণা অনুযায়ী ‘ঐকমত্য’-এর সরকারই বটে। প্রফেসর এমাজ উদ্দীন আগামী দিনের জন্য এই ধরণের একটি সরকারের অধিক কিছু ভাবতে পারছেন কিনা সেটা স্পষ্ট নয়। তাঁর লেখালিখির মধ্যে আমি তা খুঁজে পাই নি। সে যাই হোক, সম্প্রতি তিনি শ্রীলংকার নির্বাচনী অভিজ্ঞতায় বেশ উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন; বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী মেনে নিয়ে নির্বাচন হতে তো সমস্যা নেই’ । তাঁর মন্তব্য অনেকের মতো আমাকেও বিস্মিত করেছিলো।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও পরিস্থিতি কোনভাবেই শ্রীলংকার মতো নয়। যে কারনে তাকে যোগ করতে হচ্ছে, শেখ হাসিনার 'রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ-সুবিধা নেওয়া বন্ধ করতে হবে। নিয়ম মানতে হবে।' প্রশ্ন হচ্ছে সেটা করবেটা কে? প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছায় সেটা করবেন?  শ্রীলংকায় হয়েছে বলে বাংলাদেশেও সেটা সম্ভব এটা ভাবার কোন কারন নাই। তাদেরশক্তিশালী  নির্বাচন কমিশনের কথাটও তিনি মনে রাখছেন না।  কিন্তু তারপরও তিনি চাইছেন শেখ হাসিনার অধীনেই একটা নির্বাচন হোক। এ কথা বলার আরও অর্থ আছে। শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন না করে বিশ দলীয় জোট ভুল করেছে! এখন তা সংশোধন করতে হবে। তাই কি?

বিরোধী দলীয় জোটের চলমান আন্দোলনের মাঝখানে তাঁর হঠাৎ একথা বলা বিস্তর বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। আগামি দিনে শেখ হাসিনার সরকারে যেভাবে এরশাদ, হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেনন আছে তেমনি কি তিনি বিএনপির নেতাদেরও যোগদান চান? তাঁর কাছে সম্ভবত রওশন এরশাদের অধিক মর্যাদা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাই। তিনি কি চান রওশন এরশাদের মতোই খালেদা জিয়া হাসিনার সরকারে বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসাবে যোগদান করুক? বিরোধী দলের আন্দোলনে যারা অত্যাচার নির্যাতন, হত্যা, গুম খুন ও বুকে গুলি নিয়ে শহিদ কিম্বা পঙ্গু হচ্ছেন আগুনে পুড়ে মরছেন সেই সকল নেতাকর্মীদের কাছে এই ধরণের প্রস্তাব চরম অবমানকর বলে গণ্য হতে পারে। এই দিকগুলো বিবেচনায় না নিয়ে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন করবার কথা বলা ঠিক হয় নি।


emaj

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে আমার বক্তব্যের বিকৃতি ঘটিয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের একটি ক্ষুদ্র সাংবাদিক গোষ্ঠি যখন মিথ্যা অপপ্রচার শুরু করে ও থানায় জিডি দায়ের করে আমাকে গ্রেফতার করবার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে তখন আরও অনেকের সঙ্গে  বাক, ব্যক্তি ও চিন্তার স্বাধীনতাসহ মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য প্রফেসর ড. এমাজুদ্দীন আহমদ আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এই ছবি প্রেসক্লাবে প্রতিবাদ সভার অংশ। দেশের সামগ্রিক স্বার্থে তাঁর প্রস্তাবের পর্যালোচনা করলেও তাঁর অবদান আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। সম্প্রতি হুকুমের আসামি বানিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা ও হয়রানির তীব্র ক্ষোভ ও  প্রতিবাদ জানাই। এই লড়াইয়ে আমি তাঁর পাশে আছি। অবশ্যই।


তারপরও বলব প্রফেসর ডক্টর এমাজ উদ্দীন আহমদ যা সঠিক মনে করেন তা বলার অধিকার তাঁর আছে, এবং তার কিম্বা অন্য যে কারো প্রস্তাব নিয়ে আলোচনাতে আমার কোনই আপত্তি নাই। তবে ২৮ তারিখে সভায় যখন ঘোষণা করা হোল যে এই প্রস্তাবে আমি স্বাক্ষর করেছি তখন মঞ্চ থেকেই আমি প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। জানাতে হয়েছে বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচির কোন দৃশ্যমান পরিণতি বিচার না করে এই ধরণের কোন প্রস্তাব আন্দোলন-সংগ্রামের বর্তমান চলমান মুহূর্তে আমি সমর্থন করি না, স্বাক্ষর করার প্রশ্নই আসে না। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামো যেমন আছে তেমনি অক্ষত রেখে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এক পক্ষের হাত থেকে আরেকটি পক্ষের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর আমার রাজনীতি না। এই রাজনীতি আমি করি না। সাতদফার সীমাবদ্ধতা এবং ব্যাপক জনগণকে সম্পৃক্ত করবার ক্ষেত্রে বিরোধী জোটের আন্দোলনে ও কৌশলে ব্যর্থতা থাকতে পারে কিন্তু জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন চায়। অতএব আমাদের কাজ হচ্ছে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিবাদী শক্তি ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক শক্তি আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কিভাবে বিকশিত হতে পারে তার প্রতি মনোযোগী হওয়া। নির্বাচন তো হতেই হবে। সেটা কখন কিভাবে কোন পদ্ধতিতে হবে সেটা আন্দোলনের সাফল্য বা পরিণতির ওপর ছেড়ে দেওয়াই সমীচিন।

এরপরও কালের কন্ঠ পত্রিকায় একটি খবর দেখা আমি অবাক হয়েছি। ‘শত নাগরিক’ নামক সংগঠনটির জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব হিসাবে কবি আবদুল হাই সিকদার স্বাক্ষরিত সংবাদের বরাত দিয়ে প্রকাশিত সংবাদে ডঃ এমাজউদ্দীন আহমেদের প্রস্তাবে যারা ‘একমত পোষণ করেছেন’ তাদের নামের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে আমার নাম দেখে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়! ফলে আমাকে আবারও প্রতিবাদ করতে হচ্ছে। আমি সুস্পষ্ট ভাবে সকলকে জানিয়ে দিতে চাই এই ধরনের প্রস্তাব বা উদ্যোগের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নাই এবং সকলের প্রতি শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি কখনই কোন কালে ‘শত নাগরিক’ এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না বা যুক্ত নই। (দেখুন, ‘এমাজুদ্দীনের প্রস্তাবে শত নাগরিকের সমর্থন’)

যেখানে চলমান সংকট নিরসন দূরে থাকুক, তাকে আরও তিক্ত, কুৎসিত ও হিংস্র পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্য খালেদা জিয়ার বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া হচ্ছে, তাকে না খেয়ে মারবার হুমকি দেওয়া হচ্ছে, ডিশ লাইন ইন্টারনেট সংযোগ ছিন্ন করা হচ্ছে -- সেই সময় শত নাগরিকদের উচিত ছিল ঐক্যবদ্ধ ভাবে রাস্তায় নেমে আসা, প্রতিবাদ করা এবং আন্দোলনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও নানাবিধ ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত জবাব দেওয়া। কিন্তু সেই দিকে মনোযোগ না দিয়ে অনেককেই এখন দেখছি আওয়ামী লীগের অনুকরণ কিম্বা অনুরণনে প্রস্তাবিত ‘জাতীয় ঐকমত্য সরকার’ গঠনের প্রস্তাব সমর্থন করছেন।

বিরোধীদের উপর সরকারি দলের কথা ও কাজে নিরন্তর নগ্ন ও কুৎসিত আক্রমণের মুখে ন্যূনতম প্রতিবাদে না গিয়ে উলটা সেই সরকারকে সাথে নিয়েই কি তারা ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের' প্রস্তাব করছেন? কেন করছেন আমি জানি না। এই আবেদন নিবেদনের অর্থ কি তা আমি বুঝতে অক্ষম। ফলে আমার রাজনীতির সাথে ক্ষমতাসীনদের কাছে এই অবাস্তব আবেদন নিবেদনের কোন মিল আমি খুজে পাই না। চলতি রাজনৈতিক ক্রাইসিসে এটা কোন বাস্তবোচিত প্রস্তাব নয়। তাই আমি তাদের পরিষ্কার জানিয়ে দিতে চাই, যদি তাই হয়, তাহলে আমি তাদের সাথে একমত নই।

দুই

‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ ধারণা যদি ক্ষমতাসীন আওয়ামি লীগের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে আসত তাতে হয়ত কিছু আবেদন থাকত। এটা বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে আসায় আমি মনে করি এই মুহূর্তে ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনকে এই দাবি বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করতে পারে। দেশকে আরও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই ধরণের প্রস্তাব সাধারণ জনগন – বিশেষত যারা আন্দোলন সংগ্রামে জীবন দিচ্ছেন তাদের কাছে ষড়যন্ত্র গণ্য করবার কারণ হতে পারে। আশা করি যারা প্রস্তাব করছেন তারা এইসব বিবেচনায় নেবেন।

শেখ হাসিনা তো নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যদি এটাই এখন চাই তাহলে সেই প্রস্তাব তখন লুফে নেওয়া হোলনা কেন? যারা ক্ষমতাসীন রয়েছেন তাদের সমর্থনের বাইরে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার ধরণের কোন অন্তর্বর্তী সরকার যদি আদৌ রাজনৈতিক কারণে গঠন জরুরী হয়ে পড়ে তাহলে ক্ষমতাবানরাই সেটা গঠন করে। তাহলে এখন এই ধরণের সরকার গঠনের শক্তি কার কাছ থেকে আসবে? কারা জাতীয় ঐক্যমতের সরকার গঠনের শক্তি ধারণ করে? শক্তির ভিত্তি কি? অর্থাৎ কারা এই সরকার গঠন করতে চাইছে? এটা কি আন্দোলন-সংগ্রামে বিজয়ী রাজনৈতিক পক্ষ? নাকি ক্ষমতাসীন সরকার সদাশয় হয়ে এই ধরণের সরকার কবুল করবেন? নাকি কোন তথাকথিত 'তৃতীয় শক্তি'।

এই ধরণের প্রস্তাবের রাজনীতিকরণ না ঘটিয়ে – অর্থাৎ এখনই সমাধানের প্রস্তাব হিসাবে পেশ না করে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কিভাবে নতুন অন্তর্বর্তী ক্ষমতা তৈরি হয়, কিম্বা বিদ্যমান বাস্তবতা বিচার করে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া কী হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। সেটা তাত্ত্বিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ রাখাই বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সতর্ক প্রজ্ঞার কাজ। এই ক্ষেত্রে যে প্রশ্নগুলো শুরুতেই, আগে যেমন বলেছি, উঠে আসে যে কারা এই সরকার গঠন করবে? জাতীয় ঐকমত্যের সরকার তো বললেই গঠিত হয়ে যাবে না, বা চাইলেই গঠন করা যায় না; এর সঙ্গে সরাসরি ক্ষমতার প্রশ্ন জড়িত। সেই ক্ষমতা তৈরি হবে কিভাবে? কিম্বা সেই ক্ষমতা হাজির থাকলে সেটা কোথায় কিম্বা কারা? যারা ক্ষমতায় আছেন এবং ক্ষমতাবান তারা এই ধরনের সরকার চাইবেনই বা কেন? কিম্বা এই ধরণের সরকার গঠন করবার ক্ষমতা যাদের আছে তারা আদৌ এই ধরনের সরকার গঠনে শক্তি জোগাবে কি? যদি ক্ষমতাসীনরা এই ধরনের সরকারে সমর্থন না দেয় – অর্থাৎ যদি এই সরকার শেখ হাসিনার অধীন রওশন এরশাদ-ইনু-মেনন জাতীয় না হয় তাহলে এর পেছনের অনুমানটি কি ? সেটা কি এই যে এর সমর্থন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, কিম্বা বিদেশী দেশগুলোর কাছ থেকে আসতে হবে। অতীতে আমরা এমন দেখেনি যে তা নয়, কিন্তু তা সবসময়ই জনগণের স্বার্থ নয়, বরং বিদেশী স্বার্থ রক্ষার নির্দেশ পালনের বিপদে আমাদের নিক্ষিপ্ত করেছে। জনগণের গণতান্ত্রিক শক্তিকে বিকশিত না করে এবং জনগণের ওপর আস্থা না রেখে রাষ্ট্রের সশস্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা কিম্বা বিদেশী কোন পরাশক্তির সঙ্গে হাত মেলানো বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত কিম্বা আদর্শ রাজনীতি নয়।

কিন্তু তারপরেও বলা যায় বর্তমান জাতীয় সংকট থেকে বেরুতে হলে একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক ভাবে প্রয়োজনীয়। এটা আইনী বা বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী বৈধ হতে হবে তার কোন যুক্তি নাই। যদি সাংবিধানিক বা আইন মতোই তা সম্ভব হোত তাহলে তো সেটা আপানা আপনিই হোত। সেটা করা যাচ্ছে না বলেই জাতীয় ঐকমত্যের সরকার বা এই জাতীয় কোন না কোন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা উঠেছে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মীমাংসার তর্ককে শুধু আইনী ও সাংবিধানিক তর্ক হিসাবে দেখা ও দেখাবার জন্য আইন পেশার অনেককেই অতি উৎসাহিত হয়ে উঠতে দেখা যায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা নিয়ে তারা বেজায় চিন্তিত হয়ে পড়েন। অধিকাংশ উকিল ব্যারিস্টাররা এখনও বুঝতে পারেন না পাকিস্তানের সংবিধানের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সমস্যার সমাধান হয়নি বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ কোন কন্সটিউটিউশনাল বৈধতার তোয়াক্কা করেনি। জনগণের ইচ্ছা ও আকাংখাই সকল ক্ষমতা এবং তার বৈধতার উৎস, উকিলদের ওকালতি নয়, কিম্বা কোন সংবিধানও নয়। উকিল মোক্তারের প্রাদুর্ভাব আমাদের দেশে প্রায়ই প্রকট রাজনৈতিক বিপর্যয় তৈরি করে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর বিদ্যমান সংবিধানের মধ্যে থেকে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা ও আকাংখার বাস্তবায়ন অসম্ভই বলা চলে। গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া বিদ্যমান সংবিধানের ভেতরে নয়, তার বাইরে থেকেই তৈরী হতে বাধ্য, এটা কাণ্ডজ্ঞানেই বলা যায়।

সংবিধানের বাইরে ক্ষমতার ধারণা ও তার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জনগণের নাই তা নয়। একাত্তরতো বটেই। সামরিক শাসক হোসেন এরশাদের ক্ষমতা দখল বা ক্ষমতাচ্যূতি কোনটিই সাংবিধানিক ভাবে হয় নি। এরশাদ নিজে যেমন অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন তেমনি ত্রিদলীয় জোটের রূপরেখা – অর্থাৎ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই গড়ে ওঠা ক্ষমতার জোরেই তাকে তাড়ানো সম্ভব হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তকে পরে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। তর্ক আছে, গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠন করবার সম্ভাবনা তখন দেখা দিয়েছিলো। তাকে নস্যাৎ করে দিয়েই সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নামে পুরানা অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। যার কুফল আমরা এখন হাড়ে হাড়ে ভোগ ভোগ করছি।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসাবে ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’-এর প্রস্তাব কোন পরিণত বিবেচনা থেকে পেশ করা হয় নি। অর্থাৎ ক্ষমতা ও সাংবিধানিকতার সম্পর্ক শেষাবধি আন্দোলন সংগ্রামের সফলতা/ব্যর্থতা দিয়েই ঠিক হয় এই বাস্তবতাকে আমলে নেওয়া হয় নি। রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা রাজনৈতিক ভাবেই হয়। রাজনৈতিক প্রশ্নের রাজনৈতিক মীমাংসা কথাটা আমরা মুখে বলি বটে তবে ক্রান্তিকালীন সময়ে তার মানে আসলে কী সে বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনা আমাদের সমাজে হয় নি। গণ আন্দোলন ও রাজনীতিই একাত্তর কিম্বা সাতই নভেম্বরের মতো নির্ধারণ করে দেবে জনগণ কিভাবে রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা করবে। এটা আইনী বা সাংবিধানিক ব্যাপার মাত্র নয়। কোন প্রস্তাব দিয়ে নয়, বরং সঠিক রাজনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সেই মূহূর্ত আদায় করে নিতে হয়। ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই বারবার দেয়।

তবে এত কিছুর পরেও অধ্যাপক এমাজুদ্দীনের প্রস্তাবের ইতিবাচক দিক আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। তিনি নির্বাচনকেই সমাধান গণ্য করেছেন বটে, কিন্তু বর্তমান সংকটের সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার দিকটাও তিনি নজরে এনেছেন। অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের পথ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বন্ধ করে দিয়েছে। সংশোধনীতে সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি এটা বদলাতে চান এবং যেসব প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের সঙ্গে সংযুক্ত সেইসব প্রতিষ্ঠানের সংস্কারও করতে চান। কিন্তু বর্তমান সংবিধান মানবিক ও নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করেছে এবং একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেছে সেই বিষয়ে তিনি নীরব। তিনি ততোটুকুই সংস্কার চান যতোটুকু নির্বাচনের জন্য দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের জন্য দরকার একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান; সেই প্রয়োজনীয়তার কোন ইঙ্গিতই তিনি তাঁর প্রস্তাবে দেন নি। 

সুষ্ঠ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সংবিধানের সংস্কার দরকার। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনী বর্তমান সংবিধানের সংস্কার রুদ্ধ করেছে, এটা তিনি ঠিক বলেছেন। যদি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের জন্য সংবিধান দিয়ে সংবিধান তিনি সংশোধন করতে চান তাহলে সেটা কি তিনি ক্ষমতাসীনদের দিয়ে করাবেন? সেটা হবে তাঁর ভাষায় বিদ্যমান সংবিধান দিয়ে সংবিধান সংশোধন করা। অথচ সেটা সম্ভব নয় সেটাও তিনি জানেন। তবু বলেছন, 'সংবিধান সংশোধন করে তা করা সম্ভব। আবার সংবিধান সংশোধন না করেও তা করা সম্ভব'। যদি ক্ষমতাসীন্রা রাজি না হয় তাহলে সংবিধানের সংস্কার করতে হবে অসাংবিধানিক ভাবে। তাঁর ভাষায় ‘সংবিধান সংশোধন না করে’ করা। 

সেটা কেমন? বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? এই মহৎ কর্ম নাকি করবেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু সংবিধানে প্রেসিডেন্টের তো সেই ক্ষমতা নাই। তবুও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজুদ্দীন বলছেন, তিনি প্রেসিডেন্টকে দিয়ে একটি অধ্যাদেশ জারি করে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করবেন। পরবর্তীকালে যে সংসদ গঠিত হবে ওই সংসদ প্রেসিডেন্টের অধ্যাদেশকে অনুমোদন দেবে। কায়দাটা পুরানা। অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা বদলাও, তারপর সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে ‘অবৈধ’ কাজ বৈধ করে নাও। কিন্তু প্রেসিডেন্ট অসাংবিধানিক ভাবে সংবিধান বদলাতে চাইলে তাঁকে তা করতে দেবে কে? তার কোন উত্তর আমার জানা নাই। শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক এমাজুদ্দীনের তা জানা থাকলে তিনি আশা করি আমাদের জানাবেন। যদি জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পই ক্ষমতার উৎস ও বৈধতা হয় তাহলে জাতীয় ঐকমত্যের সরকারে বৈধতার জন্য এতো সাংবিধানিক ক্যারিকেচারের কী দরকার? (দেখুন, ‘প্রেসিডেন্ট অধ্যাদেশ জারি করে ঐকমত্যের সরকার গঠন করতে পারেন’, মানবজমিন ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)।

তিন

আমার বিভিন্ন লেখায় আমি বারবার বলেছি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নির্বাচনে না, সেটা রাষ্ট্রগঠনের গোড়ায় নিহিত। একাত্তরে আমরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে এই ধরণের একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য যুদ্ধ করেছি ও জীবন দিয়েছি। স্বাধীনতার ঘোষণায় যা সুস্পষ্ট ভাবে ঐতিহাসিক দলিল হয়ে রয়েছে। এই ইতিহাস অস্বীকার করবার কোন সুযোগ নাই। কিন্তু স্বাধীনতার এই অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করে একটি দলের আদর্শ ও কর্মসূচীকে বাংলাদেশের জনগণের সংবিধান হিসাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশ বিভক্ত হয়েছে, সমাজ বিভক্ত হয়েছে আজ আমরা পরস্পরকে নির্মূল করতে উদ্যত।

এই বিশ্বাসঘাতকতার ধারাবাহিকতায় আজ পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। তার সাংবিধানিক, আইনী ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি আছে। যে ফ্যাসিবাদ দেশে কায়েম হয়েছে তার সমাধান চলতি কনষ্টিটিউশনের মধ্যে নাই। ফলে নতুন ভাবে রাষ্ট্র গঠনের কথা জনগণকে ভাবতেই হবে।  মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে যারা বাংলাদেশকে বিভক্ত, রক্তাক্ত হানাহানি, হত্যা, গুম ও সহিংস দলবাজির ক্ষেত্রে পরিণত করেছে তাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক জনগণের লড়াই ছাড়া কোন স্থিতিশীল রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজ গঠন অসম্ভব বলেই আমি মনে করি। সাধারণ মানুষ বারবার প্রাণ দিতে থাকবে এবং তার ফল নেবে দুই পক্ষের লুটেরা দুবৃত্ত ও দুর্নীতিবাজ বিভিন্ন গোষ্ঠি। নিজ কোটারি স্বার্থের জন্য যারা হেন কোন হীন কাজ নাই যা করে না, বা করতে পারে না। এই ভাবে দেশ চলতে পারে না।

যারা আমার লেখালিখির সঙ্গে পরিচিত তারা যেন বিভ্রান্ত না হন তার জন্যই আমার এই লেখা। আমি আবারও জোর দিয়ে বলছি শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক এমাজুদ্দীনের জাতীয় ঐকমতের সরকার গঠনের প্রস্তাব বা উদ্যোগের সঙ্গে একমত হওয়া তো দূরের কথা আমার কোন দূরবর্তী সংশ্রবও নাই। এধরণের প্রস্তাব চলতি সংকট মেটাতে কাজে আসবে না। প্রেসিডেন্টকে দিয়ে অধ্যাদেশ জারির কথা বলা নতুন অন্তবর্তী ক্ষমতা তৈরি বা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে সংলাপ শুরুর প্রস্তাবও হতে পারে কিনা সে ব্যাপারেও আমার ঘোর সন্দেহ রয়েছে। এই ধরনের প্রস্তাবের গুরুত্ব তখনই থাকতে পারে যদি এ প্রস্তাব ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে আসে। রাজনীতির পক্ষগুলো যদি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে আদৌ কোন রাজনৈতিক সমাধান চায় তাহলে প্রস্তাব ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকেই আসতে হবে।

নইলে রাজনৈতিক প্রশ্নের সমাধান রাজনৈতিক ভাবেই হবে। সংবিধান এই ক্ষেত্রে কখনই কোন বাধা নয়। হয়ও না।

২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫। ২০ মাঘ ১৪২১। শ্যামলী।

বি: দ্র:  এ লেখাটি লেখার পরপরই জেনেছি লাগাতার অবরোধ ও হরতালে নাশকতার মাধ্যমে ৪২ জনকে হত্যার অভিযোগে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। বাকি তিন জনের  মধ্যে প্রফেসর এমাজুদ্দিন আহমদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী রয়েছেন। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে হামলা, মামলা, নির্যাতন ও দমন পীড়নের এই নজির নতুন কিছু নয়। এর নিন্দা জানাবার ভাষা আমার নাই। এখানে প্রফেসর এমাজুদ্দীনের প্রস্তাবের পর্যালোচনা করছি বলে তাঁর প্রতি আমার গভীর একাত্মতা ও সঙ্ঘতি জানাচ্ছি।

মহানগর হাকিম আতিকুর রহমানের আদালতে জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এবি সিদ্দিকী মামলাটি দায়ের করেন।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।