সংবিধান নয়, জনগণের অভিপ্রায়ই শেষ কথা


পাঁচই জানুয়ারির নির্বাচন আদর্শ নির্বাচন ছিল না; এ বিষয়ে সমাজে কোনো বিতর্ক নাই। ক্ষমতাসীনরা শুরুতে বলতেন নির্বাচন ছিল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, তবে বিরোধী দল অংশগ্রহণ না করায় একে আদর্শ নির্বাচন বলা যায় না। তারা অচিরেই আরেকটি নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা তারা আর মানেন নি। প্রতিশ্রুতি পালন করার কোন নৈতিক কিম্বা রাজনৈতিক দায়ও বোধ করেন নি। বরং আরও পাঁচ কি দশ বছর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন বলে অহংকারী হয়েছিলেন। ভাষা, কথা বলার ধরন ও শরীরের ভঙ্গি দিয়ে ক্ষমতাসীনরা বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন শেখ হাসিনা বুঝি চিরকালের জন্যই ক্ষমতায় এসেছেন। সমাজে এর প্রতিক্রিয়া হয়েছে মারাত্মক নেতিবাচক। এই বছরের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার অচলাবস্থায় পতিত হবার সাড়ে ষোল আনা দায় তাদের ওপরই বর্তায়।

দ্বিতীয়ত, একশ’ তেপান্নজন অনির্বাচিত ব্যক্তিকে নিয়ে পার্লামেন্ট গঠন এবং তাদের সংখ্যার জোরে সরকার গঠনের যে কোন নৈতিক ভিত্তি নেই, এটা বোঝা কারও পক্ষেই খুব কঠিন ছিল না। তা নিয়েও কোনো তর্ক দেখিনি। এ নিয়ে তর্ক ওঠার সুবিধা বা সুযোগ কোনোটাই নেই। কিন্তু তারপরও ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার দম্ভে ভাটা পড়েনি। দম্ভোক্তি থামেনি। সমাজে এর প্রতিক্রিয়াও কম হয়নি। ক্ষমতাসীনদের পক্ষের গণমাধ্যমগুলোর বিচার-বিবেচনাহীন পক্ষাবলম্বন এ কারণে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে যায়নি। বরং জনগণ আরও ক্ষুব্ধ হয়েছে।

ব্যর্থ হয়ে ক্ষমতাসীনরা এরপর প্রচার করতে শুরু করে যে ‘গণতন্ত্রের দরকার কী, দরকার উন্নয়ন’! তাদের পক্ষের গণমাধ্যমগুলো এই মহান তত্ত্ব নিয়ে বেশ বাগাড়ম্বরও শুরু করে। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার প্রান্তিক দেশগুলোতে অর্থনৈতিক উন্নতির আকাক্ষার সঙ্গে গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা কেন সঙ্গতিপূর্ণ তা নিয়ে গুরুতর চিন্তা-ভাবনার দরকার আছে, সন্দেহ নেই। কাছা খোলা বাজার ব্যবস্থার ওপর সামাজিক, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাণ ও পরিবেশ রক্ষার জন্য শক্ত বাধা-নিষেধ আরোপ ছাড়া বাংলাদেশের মতো প্রান্তিক দেশগুলোর দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি অসম্ভব। সমাজে ভুঁইফোঁড় সিন্ডিকেট ও মাফিয়া গোষ্ঠীসহ নানা কিসিমের লুটেরা ও ডাকাতগোষ্ঠীকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা কঠিন। রাষ্ট্র জনগণের না হলে তা জনগণের পক্ষে কাজ করতে পারে না।

কিন্তু গণতন্ত্র নয়, দরকার উন্নয়ন বলে যে তত্ত্ব দেয়া শুরু হল, তাতে জনগণ বুঝে নিল এসব লুটেরা ও দুর্বৃত্তদের পক্ষ হয়েই ক্ষমতাসীনরা কথা বলছে। এদের লুটপাট জারি রাখতেই ক্ষমতাসীনরা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে রেখেছে। বুঝল, উন্নয়নের কথা বলে অল্প কিছু পরিবার বাংলাদেশকে লুট করে যাবে, আর তাকেই আমাদের ‘উন্নয়ন’ বলে স্বীকার করতে হবে। সাধারণ মানুষ গ্যাস, তেল, পানি ও বিদ্যুৎ চড়া দামে কিনতে বাধ্য হবে আর পকেট ভারি হবে লুটেরাদের। বলাবাহুল্য জনগণ এই বিকৃত উন্নয়ন তত্ত্বে বিরক্ত বোধ করেছে। ক্ষমতাসীনদের এই স্মার্ট প্রপাগাণ্ডাও কাজ করেনি, মুখ থুবড়ে পড়েছে।

গণতন্ত্র না, দরকার উন্নয়ন- এই প্রচারে গিয়ে আসলে ক্ষমতাসীনরা স্বীকার করে নিল তারা অগণতান্ত্রিক শক্তি। অগণতান্ত্রিক সরকার অগণতান্ত্রিক কায়দায় ক্ষমতায় আঁকড়ে ধরে রাখে জনগণের উন্নতির জন্য নয়, বরং জনগণের অর্থনৈতিক দুর্দশা আরও বাড়াবার জন্য- এটা বুঝতে সাধারণ মানুষের খুব একটা অসুবিধা হয়নি।

বাকি থাকল সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্ন। এই সরকার বৈধ নয় এবং অবৈধ সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতায় আছে এই উপলব্ধিটুকু সমাজে প্রবল। জনগণ দেখল, পাঁচ বছরে একবার এমপিদের ভোট দিয়ে বা না দিয়ে শাস্তি দেবার অধিকারটুকুও এই সরকার কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা অবৈধ প্রমাণিত হলে তাদের পক্ষে ক্ষমতায় থাকা মুশকিল। এই কারণেই অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার গঠনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে তর্ককে ক্ষমতাসীনরা অমীমাংসিত রাখা জরুরী মনে করেছে। তর্কটিকে জবরদস্তি সমাজে জারি রাখতে বাধ্য হয়েছে। কেন এই অমীমাংসার বাহানা? কারন তর্কের মীমাংসা হলে ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় থাকতে পারে না। বাহানার প্রধান কারণ ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখা। কিন্তু ক্ষমতা বৈধ না হলে কিভাবে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব? সেটা সম্ভব হয়েছে বৈধতার বিষয়টি অমীমাংসিত রেখে। যদি ক্ষমতাসীনরা সাংবিধানিকভাবে অবৈধ প্রমাণিত হয়, তাহলে তারা ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। অতএব বৈধতার তর্ক অমীমাংসিত রেখেই ক্ষমতাসীনদের পক্ষে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করে রাখা সম্ভব। এই তর্ক জারি না রেখে ক্ষমতাসীনদের কোনো উপায় ছিল না। অনির্বাচিত ব্যাক্তিদের দিয়ে সরকার গঠন আদৌ বৈধ কিনা এই তর্ককে পরিণত করা হয়েছে জানুয়ারির পাঁচ তারিখের নির্বাচন সম্পর্কে কোন প্রশ্ন তোলা যাবে কি যাবে না সেই তর্কে।

বিষয়টি আদালতে উঠেছিল। ব্যারিস্টার রফিকুল হক বলেছেন, ‘৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের কথিত নির্বাচন আইনের চোখে কোনো নির্বাচনই নয়। এটা ছিল একটি তামাশার নির্বাচন। নির্বাচন নয়, এটা ছিল সিলেকশন। এটা ছিল এমন একটি ফুটবল খেলা যাতে কোনো গোলকিপার ছিল না। আমাদের সংবিধান সরাসরি নির্বাচন না করে কাউকে পার্লামেন্টের সদস্য করার অনুমোদন দেয় না। সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাগুলো থেকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরাসরি সংসদ সদস্য নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে, সিলেকশন নয়’।

ডঃ কামাল হোসেনও প্রায় একই কথা বলেন। তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ত্রুটিযুক্ত। তাই আরেকটি নির্বাচন চাই। না হয় জনগণ এবং ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। তিনি ঠিকই বলেছেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সরকারি প্রেসে মুদ্রিত গেজেট প্রকাশ করাই নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। যে নির্বাচনে ৮০ ভাগ ভোটার অংশ নেয় না, সে নির্বাচনকে নির্বাচন বলা যায় না। এমনকি তিনি বলেছেন, 'উচ্চ আদালত গণতন্ত্র হত্যা করেছে'। বলেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিতদের বৈধতা দিয়ে কার্যত আদালত গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। তিনি রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে নাগরিক ঐক্যের আয়োজিত একটি সভায় এমন মন্তব্য করেছেন। (দেখুন, ‘উচ্চ আদালত গণতন্ত্র হত্যা করেছে’, Reader’s 24.com, ২১ জুন ২০১৪)

আইনজীবীদের কাছ থেকে সত্য কথা শুনতে আমাদের অবশ্য ভালো লাগে। আদালতের এমিকাস কিউরি হিসেবে বক্তব্য দিতে গিয়ে কামাল হোসেন বলেছেন, ‘নির্বাচন রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। আর নির্বাচন হয়ে গেছে বলে পাঁচ বছর বসে থাকার সুযোগ নাই। এ মামলায় যদি সমাধান না হয় তাহলে নির্বাচন কমিশনের এখনও সুযোগ রয়েছে আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ চাওয়া’।

বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিধানের বৈধতা নিয়ে গত বছর ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রুল জারি করেছিল। জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার আবদুস সালাম রিট আবেদন দায়ের করেছিলেন। রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রুল জারি করেন।

রিট আবেদনে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১৯ ধারার সঙ্গে সংবিধানের অসঙ্গতি তুলে ধরা হয়। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের ১৯ ধারা অনুসারে, মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর বা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর একক প্রার্থী থাকলে তাকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা যায়। এ ক্ষেত্রে ‘না’ ভোটের কোনো বিধান রাখা হয়নি। অথচ সংবিধান স্পষ্ট বলছে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সংসদ গঠিত হবে। জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ ছাড়া কাউকে নির্বাচিত ঘোষণা করা সংবিধানের পরিপন্থী। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১৯ ধারা সংবিধানের ৭, ১১, ২৭, ৩১, ৬৫(২), ১২১ ও ১২২(২) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’ সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিন শত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে; সদস্যগণ সংসদ সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন।’ ১২২(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকারভিত্তিতে সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’ ইত্যাদি। (দেখুন, ‘৫ জানুয়ারি ছিল তামাশার নির্বাচন’, আমার দেশ, ৬ জুন ২০১৪)

কিন্তু আদালত ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হওয়া ব্যক্তিদের বৈধতার প্রশ্ন তুলে করা আবেদন খারিজ করে দেয়। হাইকোর্ট বলেছে, ‘এই ১৫৩ জনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই’। আবেদন খারিজ হয়ে যাবার পর একটি সভায় ব্যারিস্টার ডক্টর কামাল হোসেন বলেছেন, ‘উচ্চ আদালত গণতন্ত্র হত্যা করেছে’। খুবই কঠিন মন্তব্য।

এর মধ্য দিয়ে সরকারের বৈধতার প্রশ্ন একটি বিতর্কিত বিষয় হিসেবে টিকে যায় এবং বৈধতার বিষয়টিকে বিতর্কিত করে রাখবার সাফল্যের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেয়ে যায়। আদলতের এই ভূমিকার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার বৈধতা আর অবৈধতার তর্ক সংবিধান কিংবা আইন দ্বারা মীমাংসার সুযোগ রইল না। বাংলাদেশ প্রকট সংকটের আবর্তে নিমজ্জিত হল। রাজনৈতিক সংকট মীমাংসা করবার ক্ষেত্রে সংবিধান, আইন বা আদালতের কোনো সুযোগ ছিল কিনা সেটা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিম্বা আর আছে কিনা সেটাও তর্ক সাপেক্ষ।সংবিধান বিশেষজ্ঞরা হয়ত মানবেন সে সুযোগ ছিল, কিন্তু জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সিদ্ধান্তের কারণে রাজনৈতিক সংকট নিরসনের সাংবিধানিক বা আইনি সুযোগ আর রইল না। এরপর বিরোধী দলের কর্মসূচি, টানা অবরোধ ও রক্তপাত আমাদের সবার জানা।

আমাদের আইনজীবীরা চেষ্টা করেছেন, তার জন্য আমি তাদের প্রশংসা করি।

দুই

কিন্তু আমরা ভারি এক অদ্ভূত সমাজ গড়ে তুলেছি। এখানে সংবিধান ও আইন নিয়ে কথাবার্তা বলার এখতিয়ার শুধু উকিল-ব্যারিস্টারদের। আইন একটি পেশাগত চর্চা, ফলে আইন-আদালত কোর্ট-কাছারির কাজে আইনজীবীরাই পারদর্শী হবেন তা নিয়ে তর্ক নাই, আমি পেশাগত দক্ষতার তর্ক করছি না। কিন্তু কন্সটিটিউশন বা সংবিধান -- যার মূলনীতি ও গাঠনিক ভিত্তি মেনে জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়ন করে -- সেই সংবিধান তো নিছকই আইনি ব্যাপার নয়। যদি তাই হতো তাহলে উকিল-ব্যারিস্টার আর আদালতই রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন, আমাদের আর আদালতের বাইরে আলাদাভাবে আইন প্রণয়ন করবার জন্য নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে জাতীয় সংসদ বা আইনপ্রণয়নী সংস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন পড়ত না। মতাদর্শ, সংস্কৃতি ও রাজনীতিরও দরকার থাকত না। আদালত রায় দিয়ে সব বিরোধের অবসান করে দিতেন। কারোরই কোনো দরকারই থাকত না। আদালতের হাতে সব সমস্যার সমাধানের ভার দিয়ে আমরা ঘরে গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতাম। দুর্ভাগ্য যে, আমাদের জীবন তেলের মতো এত মসৃণ নয়, তৈলাক্ত তো একদমই না।

আমি ভেবে দেখেছি আমার বন্ধু-বান্ধব ও সুহৃদদের মধ্যে অধিকাংশই আইন পেশার সঙ্গে জড়িত। উকিল, ব্যারিস্টার কিংবা বিচারক ইত্যাদি। কিন্তু আমি যখন উকিলি আর ব্যারিস্টারি বুদ্ধিকে কঠোরভাবে সমালোচনা করি, তখনও এই মহৎ পেশার প্রতি আমার শ্রদ্ধার কোনো কমতি থাকে না। কিন্তু অনেকে, যারা ঘনিষ্ঠভাবে আমার লেখা ও চিন্তায় আমাকে চেনেন না তারা একে উকিলি বা ব্যারিস্টারি পেশার সমালোচনা হিসেবে দেখেন। কিংবা উকিল বা ব্যারিস্টারদের আমি ভালো চোখে দেখি না বলে ধারণা করেন। কথাটা মোটেও ঠিক না। ঠিক যে, আমি প্রায়ই সমাজে উকিলি বা ব্যারিস্টারি বুদ্ধির প্রাদুর্ভাব নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করি, কিন্তু সেটা ব্যক্তি কিংবা সামষ্টিকভাবে কোন উকিল, মোক্তার বা ব্যারিস্টারদের বিরুদ্ধে মত নয়।

উকিলি বা ব্যারিস্টারি বুদ্ধির প্রাদুর্ভাব ব্যাপারটা তাহলে কী? সেটা হল- একটি দেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক প্রশ্নকে আইনের বিষয় হিসেবে গণ্য করা এবং কোনো সমস্যা বা সংকট যে স্তরে সমাধান করা উচিত সেই স্তরে সমাধান না করে একে সংবিধান ও আইন দিয়ে সমাধান করার চেষ্টা। আইন সমাজের বাইরের বিচ্ছিন্ন কোনো ক্রিয়াকাণ্ড নয়, অতএব একইভাবে অর্থনীতি, সমাজ, ইতিহাস, শ্রেণী, লিঙ্গ, ধর্ম, সংস্কৃতি ইত্যাদিও আইন ও সংবিধানের নির্ণায়ক এবং তাদের প্রতিচ্ছবিও বটে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও শক্তির ক্ষমতার সংঘাত ও ভারসাম্য সংবিধান ও আইনে বদল ঘটাতে পারে এবং আইনের চরিত্রও নির্ধারণ করে। সমাজের নানান স্তরে নানান বিতর্ক ও মতভেদ ঘটতে পারে বা স্বার্থের বিরোধ দেখা দিতেই পারে। কিন্তু সব বিরোধকেই আইনী বিরোধ হিসাবে দেখে তাকে আদালতের নজরে এনে আইনী সমাধান টানা যায় না। সেটা আদালতের কাজও নয়, অনেক সময় এখতিয়ারও নয়। সংবিধান বা আইন কোনো ঐশ্বরিক ব্যাপার নয়। মানুষই এই সব প্রণয়ন করে এবং মানুষই তাদের প্রয়োজনে সেগুলো বদলায় ও নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে। ‘পবিত্র’ সংবিধান নামক কোনো পবিত্র গ্রন্থ দুনিয়ার কোথাও নাই। প্রয়োজনে তার বদল হতে পারে এবং হয়। অবশ্যই।

সমাজে উকিলি বা ব্যারিস্টারি বুদ্ধির প্রাদুর্ভাব কথাটার সরল মানে হচ্ছে - মানুষই সংবিধান ও আইন প্রণয়ন করে এবং মানুষ তা চাইলে বদলাতে পারে এই সত্য ভুলে যাওয়া। দ্বিতীয়ত সংবিধান ও আইনকে সামগ্রিক দিক থেকে বিচার করার ক্ষমতা হারিয়ে তাকে নিছকই ক্ষমতা চর্চার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। এ যাবতকাল বাংলাদেশে যারাই ক্ষমতায় এসেছেন তারা প্রত্যকেই এই কুকাণ্ড করেছেন। পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের জোরে নাগরিক ও মানবিক অধিকার যেভাবে হরণ করা হয়েছে, তেমনি অসাংবিধানিকভাবে অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখল করে সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের বদৌলতে অবৈধ ক্ষমতাকেও বৈধ করা হয়েছে অনায়াসে। কিন্তু যখনই গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়ন কিংবা নতুনভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের কথা ওঠে, তখনই জনগণকে সংবিধানের দোহাই দেয়া হয়। বলা হয়, সংবিধানের বাইরে কিছু করা যাবে না। শাসক ও শোষক শ্রেণী যে সংবিধান বারবার পুরনো কাপড়ের মতো ফালি ফালি করে ছিঁড়েছে অথবা অস্ত্রে ও বেয়নেটে বারবার ফুটা করেছে, সেই সংবিধান দিয়েই জনগণের উত্থানকে দমন করা হয়। উকিলি ও ব্যারিস্টারি বুদ্ধির প্রধান কাজ হচ্ছে সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার কিংবা নতুনভাবে বাংলাদেশ গঠন করার গণতান্ত্রিক প্রয়াসকে নস্যাৎ করা। জুজুর ভয় হয়ে সংবিধান উকিলি ও ব্যারিস্টারি বুদ্ধির ভূত হয়ে সামনে হাজির হয়ে যায়। এই ভুত রাষ্ট্রের মৌলিক গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঠেকিয়ে দিতে পারে।

কেন উকিলি বুদ্ধির প্রাদুর্ভাব নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন? কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট আজ যে জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে তার রাজনৈতিক সমাধান দরকার। সংবিধানের মধ্যে এর কোনো সমাধান নেই। পঞ্চদশ সংশোধনী তা বন্ধ করে দিয়েছে। এটা ধীশক্তিসম্পন্ন সবাই স্বীকার করেন। কিন্তু এর পরেও আবার রাজনীতির সমস্যাকে বিদ্যমান সংবিধান বা আইন দিয়ে নিরসনের চেষ্টাই উদ্বিগ্নতার কারণ। বিশেষত যখন বিদ্যমান সংবিধান বিশেষত পঞ্চদশ সংশোধনী নিজেই একটি সমস্যা।

তাছাড়া এক ভুতুড়ে চিন্তা সমাজে জারি রয়েছে। সেটা হল এই বিচিত্র ধারণা যে, ইতিহাস ও রাজনীতির বিতর্কিত বিষয় সংবিধান, আইন ও কোর্ট-কাচারি দিয়ে সমাধান করা সম্ভব। স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছেন সেটা আদালতকে স্থির করে দিতে হয়, ইতিহাসবিদরা না। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে কতজন মারা গেছেন সেটাও স্থির হয় কোর্টে। এর মধ্য দিয়ে আমরা আসলে আদালতকেই বিতর্কিত করে তুলছি কিনা সেই হুঁশ আমাদের নাই। এর পরিণতি ভয়ংকর, অতিশয় ভয়ংকর হতে পারে।

আদালতের রায় বলবৎযোগ্য বটে, অর্থাৎ আদালতের সিদ্ধান্ত বল প্রয়োগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের দায়। কিন্তু নির্বাহী বিভাগ আদালতের শক্তির ভিত্তি নয়। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে আদালতের শক্তির ভিত্তি কি সংবিধানে, আইনে, নাকি অন্যত্র? আবারও জোর দিয়ে বলা যায়, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সেই শক্তির ভিত্তি অবশ্যই জনগণ।

উকিলি বুদ্ধির প্রাদুর্ভাবকে নানাভাবে বিচার করা যায়। যেমন উকিলদের হাতে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে বলে তারা ইংরেজি ‘কন্সটিটিউশনের’-এর বাংলা করেছেন, ‘সংবিধান’। অথচ হওয়া উচিত ছিল রাষ্ট্রের গঠনতান্ত্রিক ভিত্তি, ছক বা নকশা, কিংবা সংক্ষেপে ‘গঠনতন্ত্র’। উকিলের হাতে মুসাবিদা হয়েছে বলেই লেখা হয়েছে, ‘সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন’। কিন্তু ইচ্ছা ও অভিপ্রায় তো শুধু আইন নয়, তার ধর্মীয়, আদর্শিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক দিক রয়েছে, যাকে কেবল আইন দিয়ে বোঝা বা ধরা যায় না। যেসব ধর্ম, নীতি, আদর্শ ও সাংস্কৃতিক চেতনা ধারণ করে একটি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিকতা অভিব্যক্ত হয় সেটা শুধু আইন নয়। সেটা একই সঙ্গে নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র কায়েম করার অন্তর্নিহিত তাগিদ। আইনি বুদ্ধি দিয়ে রাজনীতি, জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিকতা শব্দগুলোর অর্থের নাগাল পাওয়া যাবে না। এই প্রশ্নগুলো তুলছি কারণ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান বিদ্যমান সংবিধানে নেই, এ কথাটা জোর দিয়ে বলার জন্য। এটা কোনো সংবিধান বিশেষজ্ঞ বা আইনজীবী সমাধান করতে পারবেন না। রাজনৈতিক প্রশ্নের সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। একে আইনি সমস্যায় পরিণত করার চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য।

উৎকণ্ঠা এ কারণে যে, সমাজে উকিলি বা ব্যারিস্টারি বুদ্ধির প্রাদুর্ভাব অনেক সময় মারাত্মক ব্যাধি হিসেবে হাজির হয় এবং দেশের রাজনৈতিক প্রশ্নের রাজনৈতিক মীমাংসার পথকে বারবারই ঘোলাটে ও ভুল পথে নিয়ে যায়। জনগণ যদি মনে করে, বিদ্যমান সংবিধান তাদের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তাহলে তার সংস্কার বা নতুনভাবে সংবিধান প্রণয়নের অধিকার জনগণের অবশ্যই আছে। থাকতেই হবে। জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছা ও অভিপ্রায় সব সময়ই সংবিধানের ঊর্ধ্বে, সংবিধানের অধীন নয়, এই অর্থে যে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে সংবিধান সঙ্গতিপূর্ণ না হলে সেই সংবিধান শক্তি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া যায় না। কার্যকর করা যায় না। তাকে গণতন্ত্র বলে না।রাজনীতির এই সত্যের প্রতিষ্ঠা ও উপলব্ধি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সময় খুবই জরুরি। ইতিহাসের যে কোনো মুহূর্তে সংবিধানের সংস্কার বা নতুনভাবে রাষ্ট্র গড়বার সংকল্প ও দায় জনগণ বোধ করতেই পারে এবং গণতান্ত্রিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায় অনুযায়ী নতুন সংবিধান বা গঠনতন্ত্র প্রণয়নের অধিকার সব সময়ই জনগণের এখতিয়ার। এই সত্য বারবার বলা এখন জরুরি।

বাংলাদেশের সংবিধানও এই সহজ সত্যটা মানে। সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদ পরিষ্কারই বলছে, “জনগণের অভিপ্রায়ের সর্বোচ্চ অভিব্যক্তিরূপে (solemn expression of the will of the people) এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপুর্ণ হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে”। এর অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে, সংবিধান কেবল ততক্ষণই ‘প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন’ যতক্ষণ তা ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি’। যদি তা না হয় তাহলে তা মানতে জনগণ বাধ্য নয়। আদালতও জনগণের অভিপ্রায়ের বাইরের কোনো সংবিধান কিংবা গণঅভিপ্রায়ের বিরোধী অথবা জনগণের ইচ্ছার বাইরে প্রণীত কিংবা সংশোধিত কোনো সংবিধান কিংবা আইন মানতে বাধ্য নয়।

জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি বাংলাদেশের জনগণ বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে তাদের অভিপ্রায় কিভাবে ব্যক্ত ও কার্যকর করে সেটাই আগামী দিনে দেখার বিষয়।

১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫। ১ ফাল্গুন ১৪২১। শ্যামলী।

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।