বেগম রোকেয়া, ‘জেণ্ডার মেইনস্ট্রিমিং' ও নারী পুলিশ


মেডিকেল শিক্ষার্থীদের দাবি সমর্থন করি

প্রথমেই বলে রাখি মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের দাবি আমি সমর্থন করি। এমন দাবীর সাথে দেশের মেডিকেল শিক্ষার পুরো ভবিষ্যত জড়িত। একটা পরীক্ষার ফলাফল ঘোষনা করা হয়ে গেছে বলে আবার পরীক্ষা নেয়া যাবে না এমন কথা যারা বলছেন আমি তাদে্র সাথে একমত নই। শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থীরা ঢুকলে পরবর্তী সময়ে পুরো পেশার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে’’। কথাটি অযৌক্তিক নয়, কাজেই এখন এই ভর্তি পরীক্ষা বাতিল না করলে এই  অ-নিয়ম বন্ধ হবে না কোন দিনই।

মেডিকেল শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বড় অংশ হচ্ছে নারী শিক্ষার্থী। এই আন্দোলনে মেয়েরা সামনে রয়েছে; তাদের সমর্থন জানানো নারী আন্দোলনের কর্মী হিসাবে হিসাবে আমাদের দায়িত্ব।

মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, তাই এই ফল বাতিলের দাবিতে আন্দোলন চলছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে শাহবাগ মোড়ের দিকে যাওয়ার সময় পুলিশ বাধা দেয়। শুধু বাধা নয়, শিক্ষার্থীদের সাথে রীতিমতো ধস্তাধস্তি করা হয়। পত্রিকায় সেই ছবিগুলো খুব বিস্তারিত আছে। আন্দোলনকারীদের মধ্যে অনেক নারী ছিলেন। তাদেরকে নারী পুলিশরা যেভাবে ধস্তাধস্তি করেছে তা পুরুষের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। আবার নারী আন্দোলনকারীরাও খুব দৃঢ়তার সাথে সেই দমন পীড়ন মোকাবেলা করেছেন। তাদেরকে দেখে মোটেও দুর্বল মনে হয়নি। তাঁরা যে আন্দোলনের প্রশ্নে দৃঢ় আছেন তা তাদের চেহারায় ফুটে উঠেছে [ প্রথম আলোর ছবি দেখুন, ১ অক্টোবর, ২০১৫, পেছনের পাতায়]। সাবাশ।

মিছিলে মেয়েদের প্রথম সারিতে দেখা যাচ্ছে। হাতে ফেস্টুন, লেখা আছে ‘প্রশ্ন যদি হয় ফাঁস, পড়ব কেন বার মাস?’ সহজভাষায় মূল কথাটি বলে দেয়া হয়েছে। এদের দমন করতে নারী পুলিশ মাঠে নেমেছে নারীরা মিছিলে সক্রিয়ভাবে আছে বলে। নারী শিক্ষার্থীদের বাধা দিচ্ছে নারী পুলিশ। এটা নাগরিকদে্র গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি রাষ্ট্রের দমন নীতিরই অংশ। আমি দেখছি না যে নারী পুলিশ এভাবে দমন করছে বলে নারী শিক্ষার্থিরা তাদের আন্দোলন থেকে পিছু হটেছে। যদি তা হোত তাহলে এর নেতিবাচক ফল নিয়ে আমরা চিন্তিত হতাম। বরং তারা তাদের দাবী-দাওয়া ঠিকই তুলছে। আমরা কি বর্তমান অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পুলিশের কাছে কোন সহনশীল আচরণ আশা করি? নারী পুলিশ কি পুলিশ প্রশাসনের বাইরের কেউ যে দরদ দেখাবে? আর যদি নারী আন্দোলনকারীরা নারী পুলিশের নির্যাতনের ভয় পায় তাহলে পুরুষ শিক্ষার্থীদের যেভাবে বন্দুকের বাঁট দিয়ে ঘাড়ের ওপর মারা হচ্ছে তাহলে তারাও কি পিছিয়ে যাবে? এভাবে ভয় পেলে কোন আন্দোলনে নারীরা অংশগ্রহণ করতে পারবে না।

মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করবার এই আন্দোলন সমর্থন করতে গিয়ে আমি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ করছি। অনেকে নারী-পুলিশের নির্যাতনের চিত্র দেখে হা-হুতাশ করছেন। তাঁদের কথায় মনে হচ্ছে নারীরা পুলিশ পেশায় ঢুকেছেন বলেই নারীদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে। এটা তারা পছন্দ করছেন না। তাঁরা মনে করছেন নারী যদি পুলিশ হয় তাহলে তার মধ্যে নারীমুলক গুণাবলী থাকতে হবে। সে মায়া-মমতা দিয়ে প্রতিবাদকারীদের বলবে ‘বোনেরা কথা শোন, তোমরা ঘরে চলে যাও। না হলে সরকার রাগ করবে’।

রাষ্ট্র যেখানে চরিত্রের দিক থেকেই নিপীড়নের হাতিয়ার হিশেবে পুলিশকে ব্যবহার করে আর যেখানে স্পষ্টভাবেই রাষ্ট্র নিপীড়নের ভুমিকায় নেমেছে সেখানে পুলিশের চরিত্র কি হবে? নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তারা রাষ্ট্রের নিপীড়নের কাজকেই সহায়তা করবে। এর বাইরে তো কিছু নয়। নারী পুলিশরা তাদের প্রশিক্ষণের এবং কর্তৃপক্ষের দেয়া আদেশ-নির্দেশ মেনে কাজ করছেন। কাজেই নারী আন্দোলনকারীদের নারী পুলিশ দিয়ে দমন না করলে রাষ্ট্রে এই কাজ তার পুরুষ পুলিশ দিয়ে হলেও করতো। এতে কোন সন্দেহ নাই। পুলিশের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছি। 

কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় মেডিকেল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নারী পুলিশ দিয়ে নারীদের নির্যাতনের ছবি প্রকাশিত হয়েছে। এটাও এক ধরণের পুরুষতান্ত্রিকতার প্রকাশ। যেখানেই নারীরা থাকবেন বা মার খাবেন, পত্রিকার কাছে তা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। আবার এ নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। সেই সুত্র ধরে পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি আমি নারী মুক্তি প্রশ্নে নারীকে মূল স্রোতে  নিয়ে আসা যাকে ইংরেজীতে বলা হয় 'জেন্ডার মেইনস্ট্রিমিং'  ও বেগম রোকেয়া সম্পর্কে কিছু কথা বলব। প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাওয়া ভুল পরীক্ষা বাতিলের দাবি সমর্থন করার মধ্য দিয়ে আমরা মেয়েদের ডাক্তার হবার দাবিকে নিঃশর্তে সমর্থন করি। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে একই ভাবে একটি মেয়ের পুলিশ হওয়ার ইচ্ছার আমরা যেন প্রতিবন্ধক হয়ে না দাঁড়াই। পুরুষ পুলিশ নির্যাতন করে বলে আমরা কই পুরুষকে পুলিশ, র‍্যাব বা সৈনিক হবার জন্য নিষেধ করি না। নারীদের বেলায় ভিন্ন মানদণ্ড কেন? সমতা অর্জন বা বেগম রোকেয়ার ভাষায় ‘পুরুষের সমকক্ষতা’ অর্জন নারী আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি। আমরা খুব ভাল করেই জানি সমকক্ষতা অর্জন করলেই নারীর মুক্তি ঘটে না। কিন্তু ভবিষ্যতের ‘নারী মুক্তি’র আশায় – যা সমাজ ও রাষ্ট্রের গুণগত রূপান্তরের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত -- বর্তমানে বা এখন পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনের দাবি মেয়েরা স্থগিত রাখতে পারে না। সেই কথা বলার জন্যই এই নিবন্ধ।

‘আমাদিগকে যাহা করিতে হয় তাহাই করিব’ – বেগম রোকেয়া

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন একশত বছর আগে তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ তে লিখেছিলেন, “পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয় তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডী-কেরানী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডী-ব্যারিস্টার, লেডী-জজ সবই হইব। পঞ্চাশ বছর পরে লেডী Viceroy হইয়া এ দেশের সমস্ত নারীকে ‘রানী’ করিয়া ফেলিব। [ ১৩১১ বঙ্গাব্দ]

বেগম রোকেয়ার এই উক্তিটি মনে পড়লো এই কারণে যে নারী পুলিশ দিয়ে নারী প্রতিবাদকারীদের ওপর নিপীড়ন করতে দেখে অনেক পুরুষদের চিন্তিত হতে দেখছি। এটা ঠিক ইদানীং নারীরা কোন প্রতিবাদ সমাবেশ করতে গেলেই সেখানে নারী পুলিশের ব্যাপক সমাগম ঘটে। বলা বাহুল্য, তারা সেখানে নারীদের রক্ষা করার জন্য নয়, সোজা কথায় তাদের দমন করার জন্যেই হাজির হন। তারা বেগম খালেদা জিয়াকেও ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে গুলশান অফিস থেকে বের হতে না দেয়ার কাজে নিয়োজিত হয়েছিলেন। একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেত্রী হিশেবে তিনি নিশ্চয়ই তাদের সাথে ধস্তাধস্তি করতেন না, কিন্তু মনে হচ্ছিল এই অল্প বয়সী নারী পুলিশরা তেমন কাজ করার জন্যও প্রস্তুত ছিল বা নির্দেশিত ছিল!

বর্তমান আন্দোলনে প্রতিবাদকারী নারীদের যদি আদৌ কোন লাভ থাকে তবে তা এতোটুকুই যে পুরুষ পুলিশদের সাথে ধস্তাধস্তি না হয়ে সেটা নারী পুলিশের সাথে হচ্ছে। এতে অন্তত নির্যাতনের অন্য একটি মাত্রা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। বেগম রোকেয়া নারীদেরকে সকল ধরণের কাজে দেখতে চেয়েছিলেন। তার মধ্যে পুলিশ হওয়াও অন্তর্ভুক্ত। এটা বলেন নি, সব হওয়া যাবে কিন্তু মেয়েদের পুলিশ কিম্বা সেনাবাহিনীতে যাওয়া যাবে না। এতে অনেক পুরুষের খটকা লাগতে পারে, তবে ‘সমকক্ষতা লাভ’ কথাটার মানে আমাদের বুঝতে হবে। রোকেয়া ‘আমাদের যাহা করিতে হয় তাহাই করিব’ কথাটা বলে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোন ভুল করেছেন বলে আমি মনে করি না। কোন বাস্তব পরিস্থিতিতে সুনির্দিষ্ট ভাবে কী অর্জন করবার জন্য কথাটা বলা হয়েছে সেই দিকে আমাদের নজর রাখতে হবে। একইভাবে নারী উন্নয়নের চিন্তা চেতনা নারীকে যখন শুধু তার পারিবারিক গন্ডির মধ্যে রেখে অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে তখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে নারীকে ‘মুলস্রোত’(mainstream)-এ নিয়ে আসার দাবিও উঠেছে, সঙ্গত কারণেই। সেটা বিশ্বের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সব কিছুর সাথে মিলিয়েই হয়েছে। সেই অবস্থা সব সময় নারীর পক্ষে গিয়েছে বলা যাবে না, কিন্তু নারীর জন্যে সবক্ষেত্রে কোটার বাইরে তার যোগ্যতার ভিত্তিতে কাজ পাওয়া বা প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

নারী পুলিশ হওয়ার ব্যাপারটা তারই অংশ। কিন্তু নারী পুলিশ দিয়ে নারী নিপীড়নের ছবি অনেকের অস্বস্তি এবং সে জন্যে নারী আন্দোলনকে দোষ দেবার কারণ বুঝতে পারছি না। নারী পুলিশ দিয়ে নারীদের পেটানো কোন ভাবেই ভাল লাগার কথা নয়। ফলে অস্বস্তি এবং সেই অস্বস্তি থেকে নারী পুলিশ দিয়ে নারী পেটানোর বাস্তবতা থেকে নারীমুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলা এবং এতদিন পর্যন্ত নারী অধিকার কর্মীরা কী করলেন? কী দাবি তুললেন? কী ফল পেলাম? ইত্যাদি প্রশ্ন তোলার মধ্যে একটু পুরুষতান্ত্রিকতার ছোঁয়া আছে। তবে এই দেশে যারা নারী অধিকার নিয়ে আসলেই কাজ করেছেন – বিশেষত ‘নারীমুক্তি’র মতো জটিল প্রশ্ন নিয়ে নারী আন্দোলনের বাস্তব জায়গা থেকে ভেবেছেন এই ব্যাপারগুলো কখনই তাঁদের চিন্তার বাইরে ছিল না। বিশেষত যাঁরা রোকেয়ার উত্তরসূরি। নারীর প্রশ্ন যখন পুরুষরা তোলেন – হয়তো আন্তরিক জায়গা থেকেই – তখন তাঁরা ধরে নেন বাংলাদেশের নারী আন্দোলন পুলিশ কিম্বা সেনাবাহিনীর সদস্য হওয়া নিয়ে বুঝি কিছু ভাবে নি। নারীর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত মধ্যে যে স্ববিরোধিতা নারী আন্দোলন বুঝি সে সম্পর্কে অনবহিত। মোটেও ব্যাপারটা তা নয়। সম্প্রতি ব্যাক্তিগত পর্যায়ে ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কিছু মন্তব্য শুনে ও পড়ে মনে হোল নারী আন্দোলন সম্পর্কে কিছু কথা বলে রাখা জরুরী।

পুরুষদের অভিযোগটা ঠিক কী? (হয়তো কিছু কিছু নারীরও)। সেটা হোল, এদেশে নারী অধিকারকর্মীদের অনেকে দীর্ঘদিন এডভোকেসি করেছেন-রাষ্ট্রের শাখা-প্রশাখায় নারীদের অন্তর্ভুক্তি ঘটাতে হবে। এ ধরনের কর্মসূচির মুখরোচক নাম ছিল ‘জেন্ডার মেইনস্ট্রিমিং’। ঠিকই এটা আসলে মেইনস্ট্রিম এনজিও প্রজেক্ট। বড় বড় দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক সাহায্য ও বিনিয়োগ পরিকল্পনার অন্তর্গত। তবে এটা যে নারী আন্দোলনের বাইরের কোন দাবী ছিল তাও কিন্তু নয়। শুধু পার্থক্য এটাই যে এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার ইচ্ছা ছিল নারীদের ‘মূলধারা’য় আনতে হবে। কারণ আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারে তাদের দরকার আছে। যাতে তাদের শ্রম সস্তায় কেনা যায়। তাদের শিক্ষা দিতে হবে যেন তারা শ্রম বাজারের প্রয়োজন মেটাতে পারে। আর সাম্রাজ্যবাদী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতির অংশ হিশেবেও নারীকে মূল ধারায় এনে বহুজাতিক কোম্পানির তৈরি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধ্বতির বাজারে পরিণত করা একটি উদ্দেশ্য ছিল। এতে কী ফল হয়েছে? মেয়েরা গার্মেন্টে শোষিত ও নিপীড়িত হচ্ছে; এই গার্মেন্ট শ্রমিকরা ন্যায্য দাবী করতে গেলেই নারী পুলিশ গিয়ে মেয়েদেরকেই পেটাচ্ছে! এগুলো এখন সার্বিকভাবে নারী অধিকার আন্দোলনের অনেক মাত্রার সাথে যোগ হয়েছে। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি যে এতো দিকগুলো না দেখে কেবল মেয়ে পুলিশ মেয়েদের পেটাচ্ছে সেই সব ছবি দেখে সোশাল নেট ওয়ার্কগুলোতে গিয়ে অনেকে নারী আন্দোলন কর্মীদের কটাক্ষ করতেও দ্বিধা করছেন না। কিন্তু নারী অধিকার কর্মীরা কখনো কি বলেছেন যে সবক্ষেত্রে নারীদের সমান সুযোগ সৃষ্টি করলেই ‘নারীমুক্তি’ ঘটবে? নারী পুলিশদের জিজ্ঞেস করেই দেখুন না, তাদের কি সব অধিকার আছে? নাই। কিন্তু তবুও তাদের সব ক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার বিরোধিতা আমরা করতে পারি না। রোকেয়া কি তাহলে মারাত্মক ভুল দাবি করেছিলেন, পুরুষের ‘সমকক্ষ’ হবার জন্য নারীদের ‘যাহা করিতে হয় তাহাই করিব’। না, তাঁর এই দাবি নারীদের অনুপ্রাণিত করেছে। এর সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মেয়েরা তাদের জীবনের লড়াই-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে এই দাবির মর্মার্থ গ্রহণ করে। পুরুষের পক্ষে যা বোঝা বা উপলব্ধি কঠিন।

শুরুতেই বলা রাখা দরকার ‘নারীমুক্তি’র তর্ক একটি জটিল ও বহুস্তরীয় তর্ক। বাংলাদেশের নারী আন্দোলনে আমরা কখনই দাবি করি নি যে রাষ্ট্রের শাখা প্রশাখায় নারীদের অন্তর্ভূক্তি ঘটালে কিম্বা নারীকে তথাকথিত ‘মূলধারা’য় নিয়ে এলে ‘নারীমুক্তি’ ঘটে যাবে। রোকেয়াও এভাবে ভাবেন নি। ‘জেন্ডার মেইনস্ট্রিমিং’ ঘটলেই নারীর ‘মুক্তি’ আসবে, এটা পুরুষরা ভেবেছেন হয়তো, যারা নারী উন্নয়নের সংকীর্ণ পরিসরে নারী নিয়ে ভাবেন, তাঁরাও এই রকম ভাবতে পারেন কিন্তু বাংলাদেশের নারী আন্দোলন কখনই এভাবে ভাবে নি। নারী আন্দোলনের কর্মী হিসাবে  আমি সেটা হলফ করেই বলতে পারি। বলা হচ্ছে, এনজিও প্রজেক্টে রাষ্ট্রকে সংস্কারের বা বদলানোর স্ববিরোধিতা ফুটে উঠেছে মেয়ে পুলিশ দিয়ে মেয়েদের পেটানোর সাম্প্রতিক ছবিগুলোতে। বলা হচ্ছে হায়, আদৌ যদি আমরা কিছু শিখি! এই ধরনের কথা শুধু একজনের নয়, মনে হয় অনেকের। তাঁরা নারী আন্দোলনের সমালোচনা করলেও মনে প্রানে নারী আন্দোলনের স্বপক্ষের মানুষ বলেই আমি বিশ্বাস করি। তাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ নেই। কিন্তু এই মনোভাবের মধ্যে কিছু বিভ্রান্তি আছে, যা একজন নারী আন্দোলন কর্মী হিশেবে চুপ করে থাকার উপায় নেই। উত্তর দেওয়া দরকার।

শ্বাশুড়ী রাষ্ট্রের ননদিনি পুলিশ

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েকে বিয়ে দিতে গেলেও শ্বশুড়ী-বউ- ননদীর সম্পর্ক জেনেই বিয়ে দেয়া হয়। এই সম্পর্কের মধ্যে নিহিত আছে পরের বাড়ীর মেয়েটির প্রতি ‘বিশেষ’ আচরণ করতে হবে। তাই শিল্প-সাহিত্য, গানে, নাটকে সব জায়গায় ননদী রায়বাঘিনী ও শ্বাশুড়ী ডাকিনির চরিত্র থাকে। তাই বলে কি বিয়ে শাদী দেয়া বন্ধ হয়ে গেছে? বরং আইন করা হয়েছে এমনভাবে যে এখন নারী-নির্যাতন মামলায় শুধু স্বামী নয় শ্বাশুড়ী-ননদও আসামী হতে পারে। এখন অনেক নির্দোষ শ্বাশুড়ী বা ননদ মামলার আসামী হয়ে সাজা ভোগ করছেন। বলা হচ্ছে এটা আইনের অপ-ব্যবহার। তাই মূল শত্রু পুরুষতন্ত্র গোড়া থেকে উপড়ে না ফেললে নারী যে ভুমিকায় থাকুক না কেন তার ভিক্টিম হবার সম্ভাবনা শতভাগ। এখানে রাষ্ট্র সেই শ্বাশুড়ী যার সাথে নারী পুলিশ ননদীর ভুমিকায় নেমেছে। রাষ্ট্রের পুরুষতান্ত্রিক এই চরিত্র বদল না ঘটানো পর্যন্ত নারী পুলিশের চরিত্র বদল হবে না। প্রতিষ্ঠান হিশেবে পুলিশ সেবা দেয়ার চেয়ে দমনে ব্যস্ত বেশী আছে এবং থাকবে। এই বিষয়ে পুরাপুরি সচেতন থেকেই রোকেয়া বলেছিলেন , লেডী-কেরানী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডী-ব্যারিস্টার, লেডী-জজ সবই হইব। পঞ্চাশ বছর পরে লেডী Viceroy হইয়া এ দেশের সমস্ত নারীকে ‘রানী’ করিয়া ফেলিব। তিনি কি জানতেন না যে লেডী কেরানি, লেডি জজ, লেডি ম্যাজিস্ট্রেট সবই ঔপনিবেশিক শাসন যন্ত্রেরই নিপীড়ক ভূমিকা। আর নারী ভাইসরয়? বিদ্যমান ব্যবস্থায় পুরুষের সমক্ষতা অর্জনের মানে যদি এটাই হয়, তাহলে নারীদের যে কোন কাজে অংশগ্রহণ করে ‘স্বাধীন ভাবে জীবিকা নির্বাহ’ করবার দাবি জানাচ্ছিলেন তিনি। তাহলে বিদ্যমান ব্যবস্থায় স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে নারীর যতোটুকু ‘স্বাধীনতা লাভ হয়’ – তার গুরুত্ব তিনি যথার্থই বুঝেছিলেন। নারীমুক্তির বৃহৎ প্রকল্পের তুলনায় এই অর্জন সীমিত সন্দেহ নাই। কিন্তু তাকে উপেক্ষা করবার কোন সুযোগ নাই। রোকেয়ার এই সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান আন্তর্জাতিক ভাবে দানা বাঁধতে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। আর সেটা ঘটেছে ১৯৯৫ সালে।

জেন্ডার মেইনস্ট্রীমিংয়ের ধারণা আন্তর্জাতিক বিষয়, এবং ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব নারী সম্মেলনে জাতিসংঘের ঘোষনায় একটি অন্যতম প্রধান কৌশল হিশেবে নেয়া হয়েছে। এবং স্বাক্ষরকারী দেশ হিশেবে বাংলাদেশও এই কৌশলের অংশীদার। উদ্দেশ্য ছিল নারীর সমতা অর্জন। নারীরা এর আগে বিভিন্ন কাজে যোগদানের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ‘নারী’ বলে তাকে সেই কাজে নেয়া হয়নি। এই কৌশলের কারণে সেই সব বাধা দূর করা হয়েছে। নারী যোগ্যতার গুনে যে কোন কাজেই যেতে পারে। এবং সেই সুযোগ তারা লুফে নিয়েছে। সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়া, তিনি জাতিসংঘের দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন। আর এখন তাঁর দলের নারী কর্মীদের ওপর নারী পুলিশের আচরণ দেখে কি বলতে হবে নারীদের পুলিশের চাকুরী্তে আনাটা উচিত হয় নি? কিম্বা তিনি সেই সময় জাতিসংঘের দলিলে স্বাক্ষর করে ভুল করেছিলেন? জেন্ডার মেইনস্ট্রিমিংয়ের জন্য দাতা সংস্থার সহযোগিতা ছিল প্রচুর এবং এনজিওরা প্রচুর এডভোকেসির কাজও করেছে। তবে মজার ব্যাপার ঘটেছে যে যখন নারীদের কাজের সুযোগ বেড়ে গেল তখন গ্রামে কাজ করার জন্যে নারী কর্মী কম পাওয়া যাচ্ছে। এনজিওরা সেই হিশেবে নিজেরা খুব লাভবান হন নি, স্বার্থের দিক থেকে দেখতে গেলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। কিন্তু তাই বলে তারা নারীদের নিজস্ব পছন্দের কাজ নেয়ার সুযোগ বন্ধ করে দিতে পারেন না। এটা নারী আন্দোলন কর্মী বা সংগঠনের কাজও নয়।

একসময় গার্মেন্ট শিল্প হওয়ার কারণে বাসা-বাড়ীতে কাজের মানুষের অভাব ঘটেছিল, যা এখনো অব্যাহত আছে। কিন্তু গার্মেন্টে শত শোষণ বঞ্চনার পরেও এই কাজকে নিজেদের স্বাধীন কাজ হিসেবে দেখছে নারী শ্রমিকরা। নারী আন্দোলন কর্মীরা এই দিকটিকে কোন ভাবেই উপেক্ষা করতে পারে না।

আসলে জেন্ডার মেইন স্ট্রিমিংয়ের সাথে নারীর ‘মুক্তি’ আসবে এমন দাবী কখনই করা হয়নি। এটা করা হয়েছিল নারীর সমতা অর্জনের প্রশ্নে। নারী ‘মুক্তি’ অনেক ব্যাপক বিষয়। সমতা অর্জন তার একটি অংশমাত্র। বেগম রোকেয়া পাঠ তাই গুরুত্বপুর্ণ। তিনি মূল লক্ষ্য এবং কৌশলের মধ্যে কখনো গুলিয়ে ফেলতেন না। আমরাও যেন না গুলিয়ে ফেলি।

রাষ্ট্রের নিপীড়নমুলক চরিত্র বদলানোর কাজ নারীর একার নয়, আমাদের প্রগতিশীল পুরুষরা এখন এই কাজটি বাদ দিয়ে ঘরে ঢুকে বসে আছেন। তাদের একটু বেরিয়ে আসতে হবে। তখন নারী-পুরুষ উভয়ে মিলে এই কাজটি করা যাবে।

৩ অক্টোবর ২০১৫। ১৮ আশ্বিন ১৪২২।

 

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।