রুশ বিপ্লবের একশ বছর


রুশ বিপ্লবের একশ বছর পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বামপন্থিরা বিপ্লবের শতবর্ষ পালনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এই উদ্যোগ অবশ্যই দরকারি, তবে তখনই অর্থপূর্ণ হবে যদি রুশ বিপ্লব নিয়ে ‘উচ্ছ্বসিত’ না হয়ে একে বাস্তব ইতিহাস এবং বৈপ্লবিক রাজনীতি পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহন করা হয়। বাংলাদেশে বাস্তব পরিস্থিতি রাজনীতি নিয়ে নতুন ভাবে ভাববার দায় তৈরি করেছে। এই দায় আমাদের এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।

উদযাপনের জন্য সময়টা খুবই উপযোগী। ইউরোপে ১৯৯০ সালে বার্লিনের দেয়াল ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে; সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয় ১৯৯১ সালে; সমাজতন্ত্র ও পুঁজিতন্ত্র নামক দুই শিবিরে বিভক্ত দুনিয়া এবং উভয়ের মধ্যে চলতে থাকা ‘স্নায়ু যুদ্ধ’ নব্বইয়ে শেষ হয়, ইত্যাদি। এই সকল যুগান্তকারী ঘটনা ঘটবার মধ্য দিয়ে এই ধারণা প্রবল হয়ে উঠেছিল যে আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানান কিসিমের আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা, যেমন সমাজ বা সমষ্টির চেয়ে ব্যক্তিকে সার্বভৌম গণ্য করা, ব্যক্তির কামনা, বাসনা ও অধিকারের দাবিকে সামষ্টিক জীবনের উর্ধে স্থাপন করা, পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় বিশ্বের মানুষ পুঁজিপতি ও সর্বহারায় ক্রমাগত বিভক্ত হতে থাকলেও রাজনৈতিক বকোয়াজগিরি হিসাবে ‘সাম্য’, ‘সামাজিক ন্যায় বিচার’, ‘ন্যায়ের শাসন’, ‘গুড গভার্নেন্স ইত্যাদি মিষ্টি মিষ্টি কল্পকথা আওড়ানো, গণতন্ত্রের নামে আধুনিক কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্রের দমন, পীড়ন ও শোষণ অব্যাহত রেখে জনগণকে নিয়মতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক রাজনীতির উপদেশ খয়রাত করা – এই সবই বুঝি মানবেতিহাসের চূড়ান্ত পরিণতি। ‘লিবারেলিজম’ বা উদার রাজনৈতিক মতাদর্শ নামে এই সকল গালগল্পই আমরা শুনি, ওপরের তালিকার সব কটিকেই কমবেশী যার অন্তর্ভূক্ত করা যায়। 

অর্থাৎ অক্টোবর বিপ্লবের এক শ বছর আমরা পালন করছি বিশ্ব ইতিহাসে গণবিপ্লবী রাজনীতির অর্জনগুলো আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবার এমন একটা মূহূর্তে যখন পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরোধিতা ও তার বিলয় আশা করা পুরানা পাগলামি হিসাবে জালিম শ্রেণি গণ্য করে এবং হাসি তামাশা করে। এই দুঃসময়ে স্বৈরাচারী জারতন্ত্রকে উৎখাত করে রুশ দেশের বিপ্লবীরা আদর্শিক ও ব্যবহারিক রাজনীতির যে ঐতিহাসিক নজির স্থাপন করেছিলেন তাকে স্মরণ করা জরুরী। কিন্তু স্মরণ দরকার তার বিপ্লবী সারবত্তাসহ এবং একই সঙ্গে নির্মোহ পর্যালোচনার নজর জারি রেখে -- যাতে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ক্ষমতা উৎখাত করে কিভাবে জনগণের সত্যিকারের গণবিপ্লবী ক্ষমতা ও সমাজ ব্যবস্থাপনার প্রতিষ্ঠান গড়া যায় তার শিক্ষা রপ্ত করতে পারি।

বিপ্লব, বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিলয়, সারা দুনিয়ার সকল মানুষকে তাদের বৈচিত্র ও ভিন্নতা সহ নতুন এক বিশ্ব জনসমাজ বা ‘উম্মাহ’ গঠনের বিপ্লবী আকাংখা কোন আবেগী ও কাল্পনিক স্বপ্ন নয়। এটা নতুন কোন আকাংখাও নয়। সমষ্টি বা সমাজের অন্তর্গত হিসাবেই মানুষ নিজেকে বিদ্যমান দেখে এবং বিদ্যমান থাকে। সমাজের বাইরে একা একা দ্বীপবাসী হওয়া রবিনসন ক্রুসো মার্কা গল্প হতে পারে, কিন্তু কোন মানুষই বিচ্ছিন্ন কোন জগতে বাস করে না। মানুষ মাত্রই সামাজিক, নিজেকে সমাজ বিচ্ছিন্ন স্বাধীন ব্যক্তি হিসাবে ভাবা আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের ফল। ফলে মানুষের অন্তর্গত স্বভাব -- যাকে কার্ল মার্কস তরুন বয়সে প্রজাতিগত সত্তা (species being) হিসাবে গণ্য করতেন -- সেই সামাজিক সত্তা বা স্বভাবের সঙ্গে বর্তমান ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী। বর্তমান ইতিহাসেও অবশ্য আমরা তার এক চুল ব্যতিক্রম দেখছি না, ফলে এই দ্বন্দ্ব মীমাংসার চেষ্টায় মানুষের ক্ষান্তি নাই। যতক্ষণ উম্মাহর এই দায় বা সামষ্টিক ইচ্ছার বাস্তবায়ন না হয় মানুষ কোন না কোন ঝাণ্ডা হাতে বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়বে। লড়বেই। নতুন শতাব্দি শুরু হবার প্রথম থেকেই আমরা তা নতুন করে প্রত্যক্ষ করছি।

‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ শ্লোগান নিছকই শ্রমিকের রণধ্বণি ছিল না। সেটা ধর্ম, জাতি, সম্প্রদায়, ভাষা, ভূগোল – সমস্ত কিছু ছাপিয়ে বিশ্বজনসমাজ গঠনের ডাক।

বিশ্ব জনসমাজকে আমি বাংলাদেশের জনগণের আবেগ ও উপলব্ধির জায়গা থেকে অনুধাবনের জন্য 'উম্মাহ' বলি। মানুষ নিজের জন্য নতুন কোন কাজের পরিকল্পনা করেনা -- কোথাও তরুণ কার্ল মার্কস তাঁর অল্প বয়সের লেখায় লিখেছিলেন --- মানুষ তার আদি বা পুরানা কাজটাই ঐতিহাসিক ভাবে সম্পন্ন করতে চায়। অতএব বিশ্ব জনসমাজ বা উম্মাহ গঠনের আকাঙ্ক্ষা মানুষের নতুন নয়। ইংরেজি 'কমিউনিজম' বা আরবি 'উম্মাহ' -- শব্দের ভেদ যেন আমাদের গোড়ার আকাংখাকে অস্পষ্ট ও বিরোধাত্মক না করে।

ধর্মীয় বলি কিম্বা আধুনিক সেকুলার ইতিহাস বলি আমাদের তাকাতে হবে মানুষের মধ্যে। তার সামাজিক অস্তিত্বের গোড়ায়। সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যর্থ হতে পারে, হয়তো এক দেশে সমাজতন্ত্র গড়বার ধারণার মধ্যেই ত্রুটি রয়েছে, ত্রুটি রয়েছে ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও -- কিন্তু ইতিহাসের এই অসাধারণ রণধ্বণির মর্ম বুঝতে সক্ষম হলেই কেবল অক্টোবর বিপ্লবের একশ বছর পালন অর্থপূর্ণ হবে।

‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ -- ইতিহাসের এই অসাধারণ রণধ্বণির মর্ম বুঝতে সক্ষম হলেই কেবল অক্টোবর বিপ্লবের একশ বছর পালন অর্থপূর্ণ হবে।

মানুষের নিয়তি অথবা ইতিহাসের পরম পরিণতি

কিন্তু নিত্য আমরা এই প্রচার শুনি যে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থাই বুঝি আমাদের অন্তিম নিয়তি। মানুষের স্বপ্ন, আশা-আকাংখা বিপ্লবী ইচ্ছা বা অভিপ্রায়ের এটাই বুঝি শেষ গন্তব্য। বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েই আমাদের নাকি বেঁচে থাকতে হবে। ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা (Francis Fukuyama) ১৯৮৯ সালে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন, শিরোনাম: ‘ইতিহাসের শেষ’ (End of History)। সেখানে জর্মান দার্শনিক হেগেলের বরাতে ফলাও করে তিনি দাবিও করেছিলেন যে ‘ইতিহাস’ – বিশেষত হেগেল ও মার্কস যে অর্থে ‘ইতিহাস’ কথাটা বুঝেছিলেন -- তার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। অনেকে এই বলে তাঁকে সমালোচনা করেছেন যে দুনিয়ায় আর কোন ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটবে না, ফুকুইয়ামা বুঝি সেই অবাস্তব দাবি করেছেন। ফুকুইয়ামা অবশ্য এতো সস্তা কথা বলেন নি, যদিও অনেকে সেভাবেই তাকে খামাখা ব্যাখ্যা ও সমালোচনা করেছেন।


Long Live

'বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক -- বলশেভিক রাশিয়ায় ১৯২০ সালের একটি পোস্টার


ফুকুইয়ামা দাবি করেছেন ইতিহাসের ধারণা তিনি আসলে ধার করেছেন হেগেল আর মার্কসের কাছ থেকে। এই ইতিহাস হিস্টরির প্রথম অক্ষর ইংরেজি ক্যাপিটাল ‘এইচ’ দিয়ে লেখা। অর্থাৎ স্রেফ ঘটনাঘটনের বর্ণনা হিসাবে ইতিহাস বলতে আমরা যা বুঝি সেই বুঝের জায়গা থেকে এই ‘ইতিহাস’ বুঝলে চলবে না। এই সেই ইতিহাস যার দাবি হচ্ছে দুনিয়ার ইতিহাস মাত্র একটাই, আর সেটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাঘটনের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে এক অখণ্ড প্রবাহে, গুছিয়ে গাছিয়ে ও বিবর্তনের অবিচ্ছিন্ন ধারা হিসাবে। ‘যার মধ্যে সকল মানুষের সকল সময়ের অভিজ্ঞতা আমলে নেওয়া হয়েছে’। উদ্ধৃতির মধ্যে রাখা এই শেষের বাক্যটি গুরুত্বপূর্ণ। সর্বকালের সকল মানুষের অভিজ্ঞতার আলোকেই ফুকুইয়ামার দাবি আমরা আমাদের নিত্য দিনের ভাষায় ‘আদিম’ অথবা ‘অগ্রসর’, ‘প্রথাগত’ অথবা ‘আধুনিক’ ইত্যাদি পরিভাষা বিভিন্ন সমাজ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ব্যবহার করি। হেগেল ও মার্কস উভয়েই মনে করতেন আদিম ট্রাইবাল, দাস, কৃষিভিত্তিক জীবন নির্বাহক সমাজ থেকে রাজতন্ত্র ও নানান কিসিমের সামন্ততন্ত্রের একটা গোছানো বিকাশ ধারার মধ্য দিয়ে আমরা ‘আধুনিক উদার গণতান্ত্রিক’ এবং টেকনলজির দ্রুতিতে গতিময় পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে পৌঁছেছি। ‘এটা কোন সরল রেখায় না ঘটলেও, এমনকি আমরা আগের চেয়ে ভালো ও সুখী কিনা সেই প্রশ্ন থাকলেও, বিবর্তনের এই প্রক্রিয়া এলোমেলো নয় কিম্বা আমরা বুঝব না তেমনও নয়’ (Fukuyama, 1992)। অর্থাৎ ‘সকল মানুষের অভিজ্ঞতা আমলে নিয়ে’ মার্কস এবং হেগেল যে ‘ইতিহাস’ কল্পনা করেছেন সেই ইতিহাসের জায়গা থেকেই ফুকুইয়ামা দাবি করছেন, ‘ইতিহাস’ তার অন্তিম পরিণতিতে পৌঁছে গিয়েছে, আমাদের এখন পুঁজিতন্ত্র ও উদার রাজনীতির বকোয়াজগিরিকেই মানুষের চরম নিয়তি হিসাবে মেনে নিতে হবে।

তাহলে মার্কস, লেনিন ও মাওজেদং-এর অনুসারীদের জন্য ফুকুইয়ামা একটা চ্যালেঞ্জ বটে, কারন তিনি মার্কসের বরাতে কথা বলছেন। ফুকুইয়ামা ভুল বলেন নি, পাশ্চাত্য চিন্তার অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা মার্কসীয় চিন্তা ও আধুনিক বামপন্থার মধ্যে একটা সর্বজনীন ইতিহাসের ধারণা প্রবল ভাবে কাজ করে। সেই ধারণায় এই নির্বিচার অনুমান রয়েছে যে ‘সকল মানুষের সকল সময়ের অভিজ্ঞতা আমলে’ নিয়েই বলা হচ্ছে আধুনিক ইউরোপই মানবেতিহাসের পরম পরিণতি। 

এই ধারণা ইউরোপকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়, যে কারণে সর্বজনীন ইতিহাস মূলত ইউরোপকেন্দ্রিক ইতিহাসেরই নামান্তর। যে কারণে বামপন্থার মৌলিক রাজনৈতিক কর্মসূচি এখনও ইউরোপীয় ইতিহাসের অনুকরণে সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্যের অধীনস্থ পরাধীন জনগোষ্ঠিকে ইউরোপীয় করে তোলার অধিক কিছু নয়, হতে পারে না। যদি তাই হয় তাহলে ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা ঠিকই বলেছেন যে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থাই ইতিহাসের পরম পরিণতি এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে উদার গণতন্ত্রের চেয়ে পরম কিম্বা ঐতিহাসিক ভাবে পরিণত আর কোন ব্যবস্থা আদর্শ হিসাবে পাশ্চাত্যে টেঁকে নি। এই যুক্তিতে পুঁজিবাদ ও উদার গণতন্ত্রকেও মানবেতিহাসের ঐতিহাসিক নিয়তি হিসাবে ইউরোপের বাইরের জনগোষ্ঠিকেও কি মেনে নিতে হবে? বার্লিন ওয়াল ভেঙে গিয়েছে; সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে; চিন পুঁজিতান্ত্রিক পথে উন্নতির পথ ধরেছে। এই বাস্তবতার সামনে রুশ বিপ্লবের একশত বছর উদযাপন করবার মধ্য দিয়ে আমরা কি সেই ভাঙ্গনের উৎসব করছি? আসলে কী উদযাপন করতে চাইছি আমরা?

ফুকুইয়ামা এটা মানেন যে উদার গণতন্ত্রের আবির্ভাবের আগে এবং পরে সরকারের আরও নানান রূপ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু তাদের মারাত্মক ঘাটতি ছিল, কোন যৌক্তিক শৃংখলার ওপর সেই সকল ব্যবস্থা দাঁড়ায়নি। শেষাবধি সেই সব ব্যবস্থার‘মৌলিক আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সংঘাত’-এর কারনে তারা ভেঙে গিয়েছে। টিকে আছে উদার গণতন্ত্র। তার মানে এই নয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, কিম্বা সুইজারল্যান্ডে কোন গুরুতর সামাজিক সমস্যা কিম্বা বে-ইনসাফি নাই। অবশ্যই আছে। কিন্তু সেটা ফুকুইয়ামার মতে উদার গণতন্ত্র বা লিবারেলিজমের দুই নীতি – ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সাম্য – যার ওপর আধুনিক গণতন্ত্র দাঁড়ায় – তাদের অসম্পূর্ণ বাস্তবায়ন। অর্থাৎ গণতন্ত্র পুরাপুরি বাস্তবায়িত হলে এই অসাম্য ও অবিচার থেকে সমাজ মুক্ত হোত। হয় নি বলেই সমস্যা রয়ে গিয়েছে। বিদ্যমান রাষ্ট্রগুলো হয়তো গণতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হতে পারে, অধঃপতিত হতে পারে পুরানা একনায়কতান্ত্রিক কিম্বা সামরিক জবরদস্তি শাসনে। কিন্তু মোট কথা হোল, the ideal of liberal democracy could not be improved on -- ‘উদার গণতন্ত্রের আদর্শ’ হিসাবে শেষমেষ যা দাঁড়িয়েছে তার আর উন্নতি বা বিকাশ সম্ভব না। এই অর্থে মানবেতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা আর উদার গণতন্ত্রে উন্নতির যে চূড়া মানবেতিহাস স্পর্শ করেছে তার আর অধিক উন্নতি কিম্বা বিকাশ আর সম্ভব না’।

ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামাকে গায়ের জোরে বাতিল করে দেওয়া সহজ, কিন্তু তিনি তাঁর যুক্তি মার্কস আর হেগেলের বরাতে হাজির করছেন। ফলে সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্টদের অবশ্যই তাঁকে আমলে নিতে হবে। যেসকল বামপন্থা নিদেন পক্ষে নিজেদের মার্কসের অনুসারী বলে দাবি করে তাদেরকে অবশ্যই ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামাকে উত্তর দিতে হবে। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন চোখের সামনে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ার পরও যদি আমরা চোখকান বন্ধ রাখি আর অতি উচ্ছ্বাসে রুশ বিপ্লবের একশ বছর পূর্তি উদযাপন করবার সময় ভান করি সবকিছুই ঠিক ঠাক আছে, তাহলে নিশ্চিত করেই বলা যায় এই নির্জীব অবস্থা, চেতনাহীনতা ও অজ্ঞতা দিয়ে আর যাই হোক বিপ্লবী রাজনীতির পুনর্গঠন অসম্ভব। অথচ রুশ বিপ্লবের একশ বছর পূর্তিকে হতে হবে অতীতের ভুল ও অভিজ্ঞতা থেকে শিখে বিপ্লবী রাজনীতির পুনর্গঠনের আরম্ভ হিসাবে। সেটাই শুধু এই উদযাপনকে যথার্থ করে তুলতে পারে।

ব্যক্তি ও সমাজের দ্বন্দ্ব

প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাবার পর যারা ধরে নিয়েছেন যে অক্টোবর বিপ্লবও অতএব ব্যর্থ, তাঁরা ঠিক বলেন না। রুশ বৈপ্লবিক কালপর্বের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হচ্ছে জারের পতন এবং রুশ সামন্ত সমাজের বিলোপ। রুশ বিপ্লব জারতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা সমূলে বিনষ্ট করেছে। এটা বিশাল বিজয় এবং রুশ ইতিহাসের বিশাল উল্লম্ফন। অতএব অক্টোবর বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে এটা নিছকই গুজব ও অনৈতিহাসিক প্রপাগান্ডা।


Petrograd 1917

পেত্রোগ্রাদ ১৯১৭: সোভিয়েত এসেম্বলি


কিন্তু ‘সমাজতন্ত্র’ ডাকনামে যে স্বপ্ন ও কল্পনা মানুষ লালন করেছে তা বাস্তবায়িত হয় নি। রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তা বাস্তবায়নের কথা ছিল কি? এটাই গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক। যা বলশেভিক মেনশেভিক কিম্বা লেনিনের ‘এপ্রিল থিসিস’ নিয়ে তর্কের জায়গা। সমাজতন্ত্র নির্মাণের পরীক্ষা নিরীক্ষা রক্তাক্ত ও নিপীড়নমূলক হয়েছে। প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়ায় স্টালিনের আমল যে কারণে বিস্তর অখ্যাতি কুড়িয়েছে। কেন বিপ্লবোত্তর রাশীয়ার এই দশা হয়েছে তা নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। তবে সোভিয়েত রাশিয়ার পতন পুঁজিতন্ত্রের বিজয় নয়, কিম্বা তথাকথিত ‘এন্ড অব হিস্টরি’ বা ইতিহাসের পরিসমাপ্তিও নয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে এতে সন্দেহ নাই। তবে তর্কের বিষয় মোটেও সেটা নয়। বরং সুনির্দিষ্ট ভাবে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সম্পন্ন সার্বভৌম আধুনিক রাষ্ট্রের অনুকরণে ‘সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ নির্মাণের ব্যর্থতাই আলোচনার বিষয়। এটা পরিষ্কার ডিক্রি জারি করে সমাজতন্ত্র কায়েম করা যায় না। সেটা বুর্জোয়া হোক কিম্বা হোক সমাজতন্ত্র – কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সম্পন্ন সার্বভৌম আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণার মধ্যেই গুরুতর মুশকিল রয়েছে। এর অন্তর্গত প্রকট গণবিরোধী মর্ম পর্যালোচনাই এই সময় বিশেষ ভাবে জরুরি।

সামন্ততন্ত্রের বিলোপ মার্কসের দার্শনিক ভাষায় পরস্পরের সঙ্গে মানুষের প্রাকৃতিক বন্ধন ও প্রত্যক্ষ নির্ভরশীলতার বিলোপ। এই বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে ‘বুর্জোয়া’ বা স্বাধীন ‘ব্যক্তি’র উত্থান ঘটে। যার কাছে নিজের ইচ্ছা, কামনা, সম্পত্তি লাভ ও ভোগের বাসনা প্রবল ও প্রকট। এই ইচ্ছাকে যান্ত্রিক কায়দায় দমন করে ‘সমাজতন্ত্র’ বা সামষ্টিক সমাজ গড়া কতোটা সম্ভব? প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়া এবং ইউরোপের অভিজ্ঞতা এই প্রশ্নকে প্রকট ভাবে সামনে নিয়ে এসেছে।

মার্কসের সূত্র ধরেই প্রশ্ন উঠছে এই ‘ব্যক্তি’ ব্যাপারটা আসলে কী? ইতিহাসে এর আবির্ভাব এবং তার পরিণতি ব্যাখ্যার যথার্থ পদ্ধতি কি হবে? একে কি বিপ্লবীরা পুরাপুরি চেনেন, বোঝেন ও মোকাবিলা করতে সক্ষম? না হলে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার রূপান্তর তাঁরা কিভাবে ঘটাবেন? ব্যক্তি কি পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ নিত্য যে চেতনা পয়দা করে যাচ্ছে একান্তই তার রূপ? নাকি পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার অতিরিক্ত কোন অর্থ ব্যক্তি ধারণ করে! রুশ বিপ্লবের একশ বছর উদযাপন একই সঙ্গে ব্যক্তির প্রশ্ন মীমাংসা এবং ব্যক্তিতান্ত্রিক সমাজ অতিক্রম করে যাবার সাংস্কৃতিক লড়াই সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা অতিক্রম করে যেতে হলে ব্যক্তি ও সমষ্টির সম্পর্ক বিচার জরুরি। উভয়েরই চরিত্র পুঁজি নির্ণয় করে। কিভাবে করে সেটা বুঝতে হলে ‘পুঁজি’ বোঝা জরুরি কাজ, মার্কস যেভাবে বুঝেছেন। পুঁজির বিচারের সঙ্গেই জড়িত রয়েছে তথাকথিত স্বাধীন ব্যক্তির ভূত অতিক্রম করে যাবার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক লড়াইয়ের রূপ নির্ণয়। মার্কস তা অনুমান করেছিলেন, যে কারণে দর্শন নিয়ে বকোয়াজগিরি না করে সারা জীবন তিনি ‘পুঁজি’র স্বভাব বিশ্লেষণে নিজের আয়ু খরচ করে ফেললেন। মার্কসের ‘পুঁজি’ কিংবা ‘অর্থশাস্ত্রের পর্যালোচনা’ বাদ দিয়ে সমাজতন্ত্রের চিন্তা অতীতের মতোই ব্যর্থ হতে বাধ্য। সোজা কথায় পুরানা সমাজতান্ত্রিক নীতি ও কৌশল দিয়ে ‘বিশ্বসমাজ’ গড়া সম্ভব নয় এই উপলব্ধি অর্জন করার ও অক্টোবর বিপ্লবের সফলতা উদযাপন অর্থপূর্ণ হতে পারে, নইলে নয়।

তাহলে ব্যক্তি যতক্ষণ না বৈষয়িক বাস্তবতা এবং পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মধ্য দিয়ে এই উপলব্ধিতে না আসবে যে সমষ্টির মধ্যে ব্যক্তির এবং ব্যক্তির মধ্যে সমষ্টির স্বার্থ ও কল্যাণ নিহিত তার আগে স্বাধীন ব্যক্তিদের নিয়ে নতুন ধরনের সমাজ গঠন অসম্ভব। আদিম সমাজ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রাকৃতিক বন্ধনের ওপর নির্ভরশীল কৌম সমাজের কথা অনেকে বলেছেন, কিন্তু মানবেতিহাসে স্বাধীন ও মুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে সামষ্টিক সমাজ গঠনের অভিজ্ঞতা কখনই অতীতে ছিল না। অতীতের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিভ্রান্তি ও অসম্পূর্ণতার অধিকাংশ কারন এই অনভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত। এই দিকটি বুঝতে পারলে সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মানের পরীক্ষা নিরীক্ষাকে স্রেফ ব্যর্থ গণ্য করবার সুযোগ নাই। বরং মানবেতিহাসে হাতেনাতে সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের অভিজ্ঞতা আগামি দিনের জন্য অপরিসীম মূল্যবান অভিজ্ঞতা হিসাবে অর্জিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতের সমাজ গড়বার লক্ষ্যে পর্যালোচনার জন্য জমা রয়েছে।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় রুশ বিপ্লবের ইতিহাস পর্যালোচনার ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষ আগ্রহ থাকা উচিত চিন্তা এবং ব্যবহারিক রাজনীতির মধ্যে সঙ্গতি রক্ষা করে কিভাবে বিদ্যমান ক্ষমতা ব্যবস্থার উৎখাত সম্ভব সেটা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের তত্ত্ব ও চর্চার বিচার করে যথাসাধ্য বোঝা। বিদ্যমান রাষ্ট্রশক্তির বিপরীতে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কিভাবে পালটা গণশক্তি তৈরি করতে হয় তার নীতি ও কৌশল নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন আজ অবধি তুলনাহীন। চিনের মতো কৃষি প্রধান দেশে মাওজে দং-এর কাছ থেকে আমরা গণশক্তি নির্মাণের আরেকটি অভিজ্ঞতা লাভ করি। অতএব লেনিন ও মাও জে দং-এর চিন্তা এবং তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা পর্যালোচনা ছাড়া বাংলাদেশের বিপ্লবী রাজনীতির বিকাশ সম্ভব নয়। সাধারণ ভাবে ‘ক্ষমতা’ এবং বিশেষ ভাবে ‘গণশক্তি’র বিচার একালের বিপ্লবী রাজনীতির মুখ্য পর্যালোচনার বিষয়। তবে মার্কস, লেনিন ও মাও জে দং-এ আমরা ‘ক্ষমতা’ সম্পর্কে যে ধারণা পাই তা এ কালের রাজনীতির জন্য আদৌ যথেষ্ট কিনা সেটা এখন অবশ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। পাশাপাশি গণশক্তি ও গাঠনিক ক্ষমতার (Constituent Power) ধারণাও একালের বিপ্লবী রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয়।

বিপ্লবী রাজনীতি ও ‘উদার গণতন্ত্র’

ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার কথা দিয়ে লেখাটি শুরু করবার খুব একটা ইচ্ছা আমার আসলে ছিল না। তার বক্তব্যের সমালোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে বিস্তর। ফলে অন্যত্র তা নিয়ে লেখা যেতো। কিন্তু দৈনিক নয়াদিগন্তে ২৫ অগাস্ট ২০১৭ শ্রদ্ধাভাজন এবনে গোলাম সামাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখেছেন। তাঁর লেখাটি পড়তে গিয়েই ফুকুইয়ামার কথা মনে হোল। তাঁর লেখার শিরোনাম ছিলঃ ‘রুশ বিপ্লব নিয়ে অবান্তর উচ্ছাস’। তিনি লিখছেন:

“বর্তমানে বাংলাদেশে যখন মানুষ চাচ্ছে উদার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, তখন এ দেশের বেশ কিছু পত্রপত্রিকা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশ কিছু সংখ্যক অধ্যাপক করছেন লেনিনবাদের জয়গান। মনে হচ্ছে তারা চাচ্ছেন এ দেশে এক ভয়াবহ স্বৈরশাসনেরই প্রবর্তন। রুশ বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৯১ সালে ভেঙে পড়েছে ১৫টি রিপাবলিক নিয়ে গঠিত সোভিয়েত ইউনিয়ন। এখন এরা প্রত্যেকে পরিণত হয়েছে একেকটি পৃথক রিপাবলিকে। আর এসব রিপাবলিকে মানুষ চাচ্ছে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনীতিতে চাচ্ছে ধনতন্ত্রের আরেক কথায় বাজার অর্থনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা”।

এবনে গোলাম সামাদের লেখা সম্পর্ক যারা পরিচিত নন তারা হয়তো তাঁর এই লেখাটিকে বামপন্থার বিরোধিতা গণ্য করতে পারেন। অবশ্য তিনি বিরোধিতা করতেই পারেন। যেমন তিনি বলেছেন, ‘লেনিনের রুশ বিপ্লব আসলে ছিল একটা সফল সামরিক ক্যুদেতা মাত্র’। এটা অবশ্য একদমই ঠিক নয়, কিন্তু সেই তর্ক এখানে এখন করছি না। তারপরও আমি বরং তাঁর লেখা খুবই সময়োপযোগী ও সঠিক সতর্ককরণ হিসাবে পড়েছি। প্রথমত তিনি ‘অবান্তর উচ্ছ্বাস’-সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকতে বলেছেন। ঠিকই বলেছেন। রুশ বিপ্লব নিয়ে অবান্তর উচ্ছাসের কোন সুযোগ নাই। দ্বিতীয়ত এই উদযাপনের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশের জনগণের জন্য কী ধরণের রাজনীতির প্রস্তাব করছি সেই দিকটাও খেয়াল রাখতে হবে। ‘উদার গণতন্ত্রের জায়গায় আমরা যেন আবার স্টালিনের শাসনামলের মতো ‘ভয়াবহ স্বৈরশাসন বা ‘একনায়কতন্ত্র’ কায়েমের স্বপ্ন না দেখি’। এই সতর্কীকরণ দরকারী।

তবে তিনি রুশ বিপ্লবের এক শত বছর উদযাপনের বিরোধিতা করছেন কি? আমি ঠিক জানি না। তিনি স্পষ্ট করেন নি। আমি অবশ্য সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করি। রুশ বিপ্লবের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী যাই থাকুক, মানবেতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসাবে তার পর্যালোচনা অবশ্যই জরুরী। ফলে এই উদযাপন যদি ‘অবান্তর উচ্ছাস’ না হয়ে পর্যালোচনা হয় তাহলে তা আমাদের ইতিহাস সচেতন করে তুলবে এবং অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে অনুপ্রাণিত করবে। তবে এটা স্পষ্ট এবনে গোলাম সামাদ ‘উদার গণতন্ত্র’ চান, আর উদার গণতন্ত্রের যে রূপকে তিনি আদর্শ গণ্য করছেন সেটা হচ্ছে ‘বহু দলীয় গণতন্ত্র’। এইটুকুন ছাড়া এবনে গোলাম সামাদ “উদার গণতন্ত্র’ বলতে ঠিক  কী বোঝাচ্ছেন তা আমাদের স্পষ্ট করেন নি। যদি কখনও করেন, আমরা তা নিয়ে আলোচনা করব।

ওপরের আলোচনায় খেয়াল করব যে ফুকুইয়ামার কাছে উদার গণতন্ত্রের প্রধান চরিত্র লক্ষণ হচ্ছে ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং সাম্য। রাজনীতিতে বহুদল থাকা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বাহ্যিক দিক। এই অর্থে বাহ্যিক যে বিদ্যমান সংবিধান মেনে যে কোন ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলেরই দেশ শাসনের অধিকার আছে তা সমাজে বহুদল থাকার দাবির মধ্য দিয়ে উদার গণতন্ত্র স্বীকার করে। কিন্তু মর্মের দিক হচ্ছে রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র (Constitution)। রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রে যদি ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকে এবং বুর্জোয়া সাম্যের নিশ্চয়তা কায়েম আর তা বাস্তবায়নের উপযুক্ত রাষ্ট্র কাঠামো না থাকে – যেমন, কার্যকরী আইন, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন ইত্যাদি -- তাহলে বাংলাদেশের জনগণ ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ দিয়ে কি করবে? রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক না, কিন্তু সমাজে অনেকগুলো অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল! এই দিয়ে কী ফল লাভ হবে! এটাতো বারবারই অনেকে বলেছেন বাংলাদেশের কোন দলেই গণতন্ত্র নাই এবং তারা গণতন্ত্র চর্চা করে না। তাহলে এই ধরণের দল বহু হোক কিম্বা একটি হোক তাতে জনগণের কী আসে যায়!।

পক্ষান্তরে বাংলাদেশের বাস্তবতায় ফুকুইয়ামার উদার গণতন্ত্র কায়েম করাটাই রীতিমতো একটি বিপ্লবী কর্মসূচি। সত্য বলতে কি ইতিহাসের প্রহসন এই যে উদার গণতন্ত্র কায়েম করতে হলে বাংলাদেশে এখন একজন লেনিনেরই প্রয়োজন হবে। লেনিনের ভাষায় এই কাজটা হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণি এবং তাদের পার্টির নেতৃত্বে ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ সম্পন্ন করা – সমাজতন্ত্র নয়। লেনিনের সঙ্গে পার্থক্য হতে পারে তাঁর ‘এপ্রিল থিসিস’ নিয়ে। অর্থাৎ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ঐতিহাসিক কর্তব্য শেষ না করে এক লাফে সমাজতন্ত্র কায়েম করা। এই উল্লম্ফন ঠিক হয়েছে কিনা সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ তর্কের বিষয়। সেই তর্ক আমরা করতেই পারি। বলশেভিক ও মেনশভিক মতাদর্শ ও রাজনীতির প্রধান ফারাক এখানেই। এবনে গোলাম সামাদ রুশ রাজনীতির  দুই গুরুত্বপূর্ণ ধারা -- বলশেভিক ও মেনশেভিক- উল্লেখ করেছেন। ফলে রুশ ইতিহাসের এই পর্ব আমাদের বিশেষ ভাবে পর্যালোচনা করার মধ্য দিয়েই আমরা রুশ অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারি।

আমি এবনে গোলাম সামাদের লেখাকে এভাবে বুঝেছি যে যাঁরা লেনিনবাদের নামে স্বৈরশাসন বা একনায়কতন্ত্র কায়েমের স্বপ্ন দেখছেন তিনি তাঁদের সম্পর্কে আমাদের হুঁশিয়ার করতে চাইছেন। আমি তাঁর সঙ্গে একমত। সেটা ঠিক আছে। তবে তার মানে দাঁড়ায় সামরিক কিম্বা বেসামরিক স্বৈরশাসন ও অগণতান্ত্রিক ক্ষমতার বিপরীতে গণতন্ত্র আগে কায়েম করতে হবে। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিলে হবে না। যেখানে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দল গণবিরোধী ও স্বৈরতান্ত্রিক সেখানে 'বহুদল' থাকা না থাকা অর্থহীন। এই পরিস্থিতিতে লেনিনের নীতি হিসাবে বামপন্থি দল যদি দাবি করে তারা বাংলাদেশে এখন একটি গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে চায় এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করাই তাদের লক্ষ্য বা কর্মসূচি – তাহলে আপত্তি করার কিছু আমি দেখি না। বরং যারা গণতন্ত্র চান এই ধরণের ‘লেনিনবাদী’ রাজনীতি সমর্থন করাটাই হবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় ‘উদার গণতন্ত্র’ চাওয়া।

তবে ‘লেনিনবাদ’ নামক পরিভাষা -- এবনে গোলাম সামাদ যেমন ব্যবহার করেছেন -- আমাদের পরিহার করা উচিত। প্রথমত ‘লেনিনবাদ’ মূলত স্টালিনের আবিষ্কার, লেনিনের রাজনৈতিক আদর্শ ও চর্চাকে স্টালিন তাঁর নিজের বোঝাবুঝি ও রাজনৈতিক ইচ্ছা-আকাংখার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ব্যাখ্যা করেছেন। তাহলে লেনিনের চিন্তা ও রাজনীতির যদি সনিষ্ঠ পর্যালোচনা আমর চাই তাহলে ‘লেনিনবাদ’ জাতীয় ক্লিশে পরিভাষা আমাদের বর্জন করাই উত্তম। লেনিনকে দার্শনিক, রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে বোঝা অনেক জটিল বিষয়। সরলীকরণ করে বোঝা যাবে না। বিপ্লবী রাজনীতি ও আধুনিক রাষ্ট্র চিন্তার ইতিহাসে লেনিনের গুরুত্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ার পরও কোন অংশে কমেনি। বুঝতে পারছি লেনিন সম্পর্কে এবনে গোলাম সামাদের ধারনা নেতিবাচক। সেটা হতেই পারে। তবে লেনিন নিয়ে এবং ‘লেনিনবাদ’ সম্পর্কে এবনে গোলাম সামাদ তাঁর ব্যাখ্যা আরও স্পষ্ট করলে আলোচনা হতে পারে।

বাংলাদেশের বামপন্থিদের সঙ্গে আপত্তির জায়গাটা আসলে ‘লেনিনবাদ’ নিয়ে নয়। বরং তারা কিভাবে লেনিনকে বুঝেছেন বা বোঝেন সেই জায়গায়। স্টালিনীয় ব্যাখ্যা ও পরিভাষা হিসাবে ‘লেনিনবাদ’ বাদ দিয়ে রুশ বিপ্লবের ইতিহাস পর্যালোচনা করেই লেনিনের চিন্তা, রাজনীতি ও ভূমিকা বুঝতে হবে। লেনিনকে মহামানব তৈরি করবার জন্য নয়, বরং মানবেতিহাসে নির্যাতিত, বঞ্চিত বা মজলুম জনগোষ্ঠির লড়াই সংগ্রামকে কিভাবে লেনিনীয় কৌশল অনুযায়ী সংগ্রামী ‘সোভিয়েত’ বা বিদ্যমান কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিপরীতে আন্দোলনের সংস্থা (সোভিয়েত) হিসাবে গড়া এবং তার ইতিবাচিক পরিণতি হিসাবে নতুন ধরণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপায়িত করে তোলা যায়, সেটাই আমাদের বিচার্য হওয়া উচিত। যেন সংগ্রামের স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে বিদ্যমান রাষ্ট্রশক্তির বিপরীতে গণশক্তি গড়ে ওঠে এবং জনগণ রাষ্ট্রের সকল স্তরে গণতান্ত্রিক ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ পায়। রাজনীতির এই অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক দিকের প্রতি সনিষ্ঠ হওয়াই আমাদের কাজ। গণশক্তি নির্মান ও তাকে ‘বিজয়ী গণ অভ্যূত্থান’-এর দিকে নিয়ে যাবার নীতি ও কৌশল রপ্ত করার জন্য এখনও লেনিনের কোন বিকল্প নাই। এই দিক থেকে রুশ বিপ্লব খুবই গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা। রুশ বিপ্লব ঘনিষ্ঠ ভাবে পাঠ ও পর্যালোচনার কোন বিকল্প আসলেই নাই। সে কারনে ‘রিপিট লেনিন’ বা বাংলাদেশের দেশগুলোতে লেনিনের পুনরাবৃত্তি ঘটাবার বাস্তব নীতি ও কৌশল নিয়ে আলোচনা এখনও বিপ্লবী রাজনীতির প্রধান বিষয় হিসাবে বিবেচ্য।

এখানে অবশ্য একটি কথা বিশেষ ভাবে বলা দরকার। গণশক্তি নির্মাণের মতাদর্শিক প্রচার ও সাংঠনিক প্রক্রিয়া হিসাবে লেনিন শ্রমিক-কৃষক-সর্বহারার মুক্তির সংগ্রামকে শ্রেণী রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ধর্মের বিরুদ্ধে পরিচালিত করেন নি। ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে রুশ দেশ ছিল একটি ধর্ম প্রাণ ও গোঁড়া খ্রিস্টিয় সমাজ। শহরের শ্রমিক ছিল মোট জনসংখ্যার তুলনায় অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ -- শতকরা এক ভাগ ছিল কিনা তা নিয়েও তর্ক আছে। তাহলে ভাবতে হবে রুশ বিপ্লবীরা -- যারা নিজেদের শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি করছেন বলে দাবি করছিলেন তারা কিভাবে নিরানব্বই ভাগ জনগণকে তাঁদের পক্ষে রেখেছিলেন?  কিভাবে তাঁদের নিজ দেশের ধর্ম প্রাণ গোঁড়া খ্রিস্টানদের মোকাবিলা করেছেন? তাদের সমর্থন আদায় করেছেন? এর উত্তর খুবই সোজা। বলশেভিকরা শ্রেণি রাজনীতি বাদ দিয়ে খেয়ে না খেয়ে খ্রিস্ট ধর্ম বা চার্চের বিরুদ্ধে লড়াইকে প্রধান করে তোলেন নি। অর্থাৎ বাংলাদেশের মতো সর্বহারা শ্রেণির রাজনীতিকে ‘মৌলবাদ বিরোধী’ আন্দোলনে পর্যবসিত করেন নি। বাংলাদেশি বামপন্থা ইসলাম বিদ্বেষের কারণে জনগণকে শ্রেণির প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ করবার কাজকে অগ্রাধিকার দেয় নি, বরন বিপরীত কাজই করেছে। এখনও করে যাচ্ছে।  ধর্ম এবং জাতিবাদী বিভাজন ও বিভক্তি খেটে খাওয়া শ্রেণি ও জনগণকে যেন বিভক্ত না করে তার দিকে যারপরনাই সতর্ক থাকার কর্তব্যে চরম অবহেলা হয়েছে।

বলা বাহুল্য, ধর্ম শাসক ও শোষক শ্রেণির মতাদর্শিক হাতিয়ার হয়, অবশ্যই। কিন্তু এঙ্গেলসের ‘জর্মানিতে কৃষক যুদ্ধ’ বইটিতেও যদি আমরা চোখ বুলাই তো অনায়াসেই বুঝতে পারি ধর্ম শোষক ও জালিমের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবার শক্তিও রাখে। দুর্ভাগ্য যে একাট্টা ধর্মের বিরোধিতার কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বামপন্থা গৌণ শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তবে আমি মনে করি এই দুর্বলতা কাটিয়ে তোলা মোটেও অসম্ভব নয়। সেটা কাটিয়ে তোলার বাস্তব শর্তও এখন তৈরি হয়েছে। গত শতাব্দিতেই এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আধুনিকতা ও শিক্ষা মানুষকে ধর্ম থেকে মুক্ত করবে এবং মানুষের জীবনে বিশ্বাস বা ধর্মের কোন ভূমিকা থাকবে না -- এই অনুমান বহু আগেই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছেন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় এটা প্রমাণিত যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বা এবনে গোলাম সামাদের ভাষায় ‘উদার গণতন্ত্র’ কায়েমের সংগ্রাম ধর্ম প্রাণ মানুষের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে যুক্ত হবার সমস্যা হিসাবে হাজির হয়েছে।


anti-fascism

বলশেভিক রাশিয়ায় ফ্যাসিস্ট বিরোধী পোস্টার


ফ্রান্সিস ফুকোইয়ামার প্রসঙ্গে আমরা নাহয় আবার ফিরি। মতাদর্শের ইতিহাস অর্থে তিনি চিন্তার যে পরিসমাপ্তি উদার গণতন্ত্রে আবিষ্কার করেছেন বর্তমান শতাব্দির শুরু থেকে তা ক্রমশ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে চলেছে। বিংশ শতাব্দির শেষ এবং একুশ শতক শুরু হবার পর থেকেই টের পাওয়া শুরু হোল ইতিহাস শেষ হয়নি তো বটেই, এমনকি শুরুই হয়েছে কিনা সেটাই বরং সন্দেহের। এতোকাল ইউরোপের ইতিহাসকেই বিশ্ব ইতিহাস গণ্য করা হোত। অন্য জনগোষ্ঠির চিন্তা ও ইতিহাস বিচার করা হোত ইউরোপের মানদণ্ডে। এমনকি যুদ্ধও বিশ্বযুদ্ধ কিনা সেটা নির্ধারন করা হোত ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে। যেমন, প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। অন্যদিকে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াসহ মধ্য প্রাচ্যে যে যুদ্ধ পাশ্চাত্য আমাদের চোখের সামনে চালিয়ে যাচ্ছে সেটা পাশ্চাত্যের চোখে স্থানীয় যুদ্ধ। বর্বরদের বিরুদ্ধে সভ্য জাতির লড়াই। তার চরিত্র ও ফলাফল বৈশ্বিক হলেও তা বিশ্বযুদ্ধ নয়। কারণ এই যুদ্ধ পাশ্চাত্যের রাষ্ট্র সমূহের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ নয়, বরং পাশ্চাত্য সভ্যতা সুরক্ষার জন্য বর্বরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসাবে হাজির করছে। তাদের ভাষায় সন্ত্রাসবাদী ইসলামের সঙ্গে যুদ্ধ। তারা অতএব একে বিশ্বযুদ্ধ বলা যাবে না। অথচ বাস্তবে একটি বিশ্বযুদ্ধই চলছে। ইতিহাস এই যুদ্ধের পরিণতির জন্য অপেক্ষা করছে।

এই যুদ্ধে ইউরোপের বাইরে বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত নির্যাতীত জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়ে নেতৃত্বে থাকার কথা ছিল বামপন্থার – বিশেষত যারা নিজেদের সমাজতন্ত্রী বা কমিউনিস্ট বলে দাবি করেন। তাঁদেরই শক্তিবৃদ্ধির কথা কারণ তাঁরাই সরবে মজলুম বা নির্যাতীতের পক্ষে রাজনীতি করেন। কিন্তু দেখা গেল পাশ্চাত্যের সাম্বিরাজ্রুযবাদী যুদ্দ্ধেধের বিরুদ্ধে লড়ছে নানান আদর্শ ও ঝাণ্ডার ইসলামপন্থিরা। অন্যদিকে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে মুক্তিবাদী খ্রিস্টিয় চিন্তা (liberation theology) ও রাজনীতি। বাংলাদেশে আমরা দেখলাম জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইয়ের চেয়ে বামপন্থার কাছে শুরুর দিকে প্রধান হয়ে উঠল ‘ইসলামি মৌলবাদ’। এরপর যখন পাশ্চাত্য সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ শুরু করল, তখন তাদের লড়াইয়ের মূল সুর হয়ে উঠল ‘ইসলামি জঙ্গি’ দমন।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে ধর্মকে প্রথমত মতাদর্শ হিসাবে এবং দ্বিতীয়ত ধর্মের বাস্তব ঐতিহাসিক ভূমিকা পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে বোঝা। মতাদর্শ হিসাবে বোঝার অর্থ হচ্ছে ধর্ম ও ধর্মতত্ত্বকে দার্শনিক অবস্থান থেকে পর্যালোচনার ক্ষমতা অর্জন। ধর্মের বাস্তব ঐতিহাসিক ভূমিকা বোঝার অর্থ হচ্ছে সমাজে ও ইতিহাসে বিশেষ বিশেষ ধর্মের সুনির্দিষ্ট বা কংক্রিট ভূমিকা পর্যালোচনা। আরও সহজ ভাবে বললে বলা যায় ধর্ম সম্পর্কে আজগবি ও বিমূর্ত ধ্যানধারণা বাদ দিয়ে ধর্ম কোথায় কিভাবে কি ধরনের ভূমিকা রাখছে তা বাস্তবে সুনির্দিষ্ট ভাবে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করা। সত্যি বলতে কি এটা মোটেও কঠিন কোন কাজ নয়। এই কাজ করতে পারলেই মজলুমের পক্ষে লড়াইয়ে ধর্ম কোথায় প্রতিবন্ধক এবং কোথায় জনগণে্র পক্ষের শক্তি তা শনাক্ত করা সহজ।

বামপন্থার ভুলগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য বামপন্থিরা আন্তরিক হলে রুশ বিপ্লবের একশ বছর উদযাপন অর্থপূর্ণ হবে। এই আশা আমি অবশ্যই রাখি।

সূত্র

Fukuyama, F. (1992).
The End of History the Last Man. New York: The Free Press.

 ... ... ... 

১৯ অক্টোবর, ২০১৭/৪ কার্তিক ১৪২৪, শ্যামলী, ঢাকা।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।