মানবাধিকার-বিরোধী ফ্যাসিবাদী শক্তিকে রুখে দিতে হবে


এক.

বেসামরিক লেবাসে সামরিক সরকারকে হঠাতে আমাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। কিন্তু যে কয়েকটি কারণে মইন-ফখরুদ্দীনের শাসনকে পিছু হঠতে হয়েছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং নির্যাতন। আমাদের দেশে কয়েকটি মুখচেনা মানবাধিকার সংগঠন মইন-ফখরুদ্দীন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে আন্তর্জাতিক ভাবে প্রচার চালাতে চেষ্টা করছে যে, দুষ্ট দুর্নীতিবাজ ও পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে শায়েস্তা করে ‘গুড গভর্নেন্স’ প্রতিষ্ঠার জন্য মইন-ফখরুদ্দীনের সামরিক সরকার এবং ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করা হয়েছে। এটা মন্দ কিছু নয়। এমনকি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো সংগঠনকেও একটি অসাংবিধানিক ও নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণ করে নেওয়া সরকারের বিরুদ্ধে সাফাই গাইতে দেখেছি। কিন্তু সেটা ধোপে টেকেনি। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা দেশে দেশে নির্যাতনের যে ঘৃণ্য নজির সৃষ্টি করেছিল, তার বিরুদ্ধে একটা জনমত গড়ে উঠেছিল। গুয়ানতানামো বে-সহ মার্কিন গোয়েন্দাদের পরিচালনায় বিভিন্ন দেশের কারাগারে বন্দীদের ওপর যে অমানবিক নির্যাতন ও অত্যাচারের কাহিনী পত্রপত্রিকায় আসতে শুরু করলো, তার একটা ফল বাংলাদেশও পেলো। বাংলাদেশে একই ধরণের নির্যাতনের কাহিনী যখন প্রচার হতে শুরু করলো তখন এক-এগারোর হোতারা আন্তর্জাতিক ভাবে নিজেদের ন্যায্যতা সহজে প্রমাণ করতে পারেননি। সেই সময় সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীল অফিসার ও সৈনিকদের কাছে আমাদের আবেদন ছিল এই যে, অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজনদের ধরে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদের নামে টর্চার করার দায় শেষমেশ প্রতিষ্ঠান হিশাবে সেনাবাহিনী এবং সাধারণ ভাবে প্রতিটি সৈনিকের কাঁধে এসে চাপবে। যাদের এই সব কাজে ব্যবহার করা হবে তারা অবশেষে এক অশুভ শক্তির কাছে নিজের পরিবার ও সন্তানসন্ততিসহ জিম্মি হয়ে পড়বেন। এই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব হবে। এখন টর্চারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কনভেনশান আছে। তারা অন্য দেশে গেলেও তাদের বিরুদ্ধে কেউ নালিশ জানালে সেই দেশে তারা গ্রেফতার হতে পারেন এবং তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন। তা ছাড়া নিরস্ত্র মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নিয়ে টর্চার করা সৈনিকোচিত আচরণ হতে পারে না। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তো নয়ই। আমি সব সময়ই সৈনিকের মর্যাদার পক্ষে লড়াই করে এসেছি। এর কারণ বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা ও গণপ্রতিরক্ষার নীতি ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নাই। অর্থাৎ আমাদের সকলকেই সৈনিক হতে হবে। একই সঙ্গে হতে হবে গণতান্ত্রিক নাগরিক। সেই কারণে বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবার জন্য সৈনিকতার তাৎপর্য এবং তার মর্যাদার পক্ষে না দাঁড়ালে আমরা রাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখতে পারবো না।

মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হবার পরেও যারা মইন-ফখরুদ্দীন সরকারের পক্ষে ওকালতি করেছিলেন, তাদের প্রচারে খুব কাজ হয়নি। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ নিয়মিত বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এবং বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের পক্ষে আনবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

এর প্রমাণ আমরা দেখি যখন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসে তখন তাদের আন্তর্জাতিক মহলে এই ওয়াদা করে আসতে হয়েছে যে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করবে না, নির্যাতন করবে না-- বিশেষত আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে তাদের ‘জিরো টলারেন্স’ থাকবে। কিন্তু অতি দ্রুত আমরা দেখলাম সরকার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কয় দিন আগে ঘোষণা দিলেন যে ভারতের প্রধান রাজনৈতিক সমস্যা হচ্ছে মাওবাদীদের মোকাবেলা করা। অর্থাৎ যারা গরিব, নিপীড়িত, বঞ্চিত, সর্বহারা অসহায় জনগণকে পড়ে পড়ে মার খাবার পরিবর্তে শোষকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস জোগায়, তারাই ভারতের ধনী ও শোষকদের শত্রু। এরপর ভারতে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে রীতিমতো একটি যুদ্ধ চলছে। কিন্তু বাংলাদেশে মনমোহন সিংয়ের কথার সূত্র ধরে হঠাৎ আমরা দেখলাম চরমপন্থি, উগ্রপন্থি, সর্বহারা বা অন্য যেকোন নামের রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মীদের নির্বিচারে ক্রসফায়ারে হত্যার একটি উৎসবই যেন লেগে গেল। অন্য ‘সন্ত্রাসী’দের আইনবহির্ভূত ভাবে হত্যার ঘটনা তো আছেই।

জিরো টলারেন্স বড়ো দ্রুতই ইনটলারেন্সে পরিণত হোল। নির্বাচিত সরকারের মুখোশটা খসে পড়তে বেশি সময়ের প্রয়োজন হোল না, সন্ত্রাসী ও ফ্যাসিবাদের চেহারা আমরা অতি দ্রুতই দেখতে পেলাম। সৌভাগ্য আমাদের! এর আগে আমি লিখেছিলাম ভোট দিয়ে আমরা পরাধীনতা অর্জন করেছি। পৃথিবীর ইতিহাসে এই ধরণের নজির নাই। এখন বলতে হচ্ছে, ভোট দিয়ে আমরা আমাদের মৃত্যুর পরোয়ানা লিখিয়ে নিয়েছি। কাফন পরাবার ও জানাজা পড়বার সুযোগও আমরা পাবো না। ভয়াবহ পরিস্থিতি।

নাগরিকরা অপরাধ করতে পারে অবশ্যই। রাষ্ট্র আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার করে তাকে যেকোন শাস্তি এমনকি চরম শাস্তি মৃত্যুদণ্ডও দিতে পারে। সাধারণ অপরাধীদের কথা আমরা বাদ দেই। রাজনৈতিক আলোচনায় ফৌজদারি অপরাধ ভিন্ন একটি বিষয়। এমনকি কার্ল মার্কসও বারবার বলেছেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কখনও অস্ত্র ধরবে না, যদি নিশ্চিত না হওয়া যায় যে শোষকদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা যাবে না, তাহলে সশস্ত্র সংগ্রাম আপদ ডেকে আনবে। যদি বিপ্লব ব্যর্থ হয়, রাষ্ট্রের কাছে প্রাণভিক্ষার কোন সুযোগ নাই। বল প্রয়োগ ও আইন পরস্পরের হাত ধরাধরি করে চলে। বল প্রয়োগের সর্বময় বা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী থাকে রাষ্ট্র। যদি সেই ক্ষমতাকে উৎখাত করা না যায় তাহলে বিপ্লবী যেকোন উদ্যোগে নিজেরই উৎখাত হয়ে যাবার দশা তৈরি হয়। বাংলাদেশ তার ভাল একটি নজির।

অপরাধী, সন্ত্রাসী বা যেকোন নাগরিককে যেকোন একটা অজুহাত দেখিয়ে হত্যা করা সহজ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেও। প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক হয় এবং সরকার যদি নিজেদের গণতান্ত্রিক সরকার বলে মনে করে তাহলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গাইবার কোন সুযোগ নাই। একমাত্র ফ্যাসিস্ট, অগণতান্ত্রিক ও গণবিরোধী শক্তি ছাড়া আইন নাই, বিচার নাই একটি মানুষকে অভিযুক্ত করে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে তারপর গুলি করে ঠাণ্ডা মাথায় মেরে ফেলার মতো ভয়ানক পরিস্থিতি আর কিছুই হতে পারে না। রাষ্ট্্েরর বড়ো গভীর অসুখ চলছে এখন।

নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান গত ৩ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে বিবিসি বাংলাদেশ সংলাপে বলেছেন, ‘সন্ত্রাসীদের কোনোভাবে দমন করা যাচ্ছে না বলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটছে। সন্ত্রাস বন্ধের বিকল্প পন্থা হিসেবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এক সময় এমনিই সন্ত্রাস বন্ধ হয়ে যাবে। তখন আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রয়োজন হবে না।’ (যায়যায়দিন ০৪.১০.২০০৯)। নৌ পরিবহন মন্ত্রী গত ৮ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লাতেও বলেছেন, ‘দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এনকাউন্টারে কোন সন্ত্রাসী নিহত হলে তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় না। বর্তমানে এনকাউন্টারের কারণেই চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস বন্ধ রয়েছে। (প্রথম আলো ০৯.১০.২০০৯)

এই ধরণের চিন্তার নগদ ফল কী হতে পারে তার একটি উদাহরণ হচ্ছে কায়সার মাহমুদ বাপ্পীর মৃত্যু। গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার রামপুরায় র‌্যাবের ক্রসফায়ারে কায়সার মাহমুদ বাপ্পীকে খুন করা হয়। তার মা আছিয়া আক্তার গত ২০ অক্টোবর ঢাকা ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে অভিযোগ করেছেন, বন্দুকযুদ্ধের নামে তার অভিনেতা ছেলে কায়সার মাহমুদ বাপ্পীকে সন্ত্রাসী কামরুল ইসলাম বাপ্পী বানিয়ে হত্যা করেছে র‌্যাব।

বিচার ছাড়া অভিযুক্তদের খুন করবার রেওয়াজ বর্তমান সরকারের আমলে অবিশ্বাস্য ভাবে ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি লাভ করেছে। মন্ত্রীদের বক্তব্যের কারণে এই আশঙ্কা মোটেও অমূলক হবে না যে সরকার আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে বিচার ছাড়া নাগরিকদের হত্যা করাকে এখন নীতি হিশাবে গ্রহণ করেছে। আমরা এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছি। বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার বিভাগের ৩১ অনুচ্ছেদ সুস্পষ্ট ভাবে বলে যে, ‘আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত: আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে’। তা ছাড়া অনুচ্ছেদ ৩২ পরিষ্কার বলছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না’। এটা এখন স্পষ্ট যে বিচার ছাড়া হত্যার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সংবিধানবিরোধী কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে উৎসাহিত করছে এবং হত্যার রেওয়াজকে রাজনৈতিক বৈধতা দেবার চেষ্টা চালাচ্ছে।

দুই.

আমি মানবাধিকার নিয়ে কথা তুলেছি। মানবাধিকারের অবস্থান থেকেই পাঠকদের আরো একটি প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলব। সেটা হোল, সরকার চাইলেই কোন রাজনৈতিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করতে পারে কি না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের এই কালে ‘ইসলাম’ নিয়ে কোন কথা বলা বা উচ্চারণও বিপজ্জনক। একটি কুকুরকে হত্যা করতে হলেও তাকে ‘পাগলা’ প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে একটি শ্রেণীর কাছে ইসলাম সম্পর্কে এই ধরণের কিছু প্রমাণেরও প্রয়োজন পড়ে না। আপনি ‘ইস...’ বলবার আগেই মৌলবাদী, সন্ত্রাসী, জঙ্গি ইত্যাদিতে পরিণত হয়ে যাবেন। রাজাকার হওয়া তো ডালভাতের ব্যাপার। আমি বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মানবাধিকার কর্মীদের এক সভায় একবার তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম। আমি প্রশ্ন তুলেছিলাম যে একজন নাগরিক নিছকই সন্দেহের বশে গ্রেফতার হয়েছে, কিন্তু তার টুপি-পাঞ্জাবি-লুঙ্গি পরবার কারণে সন্দেহর মুখে পড়ায় তার মাজায় দড়ি দিয়ে গরুছাগলের মতো নিয়ে যাওয়া কি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়? যেকোন ব্যক্তির মর্যাদা রক্ষাই মানবাধিকারের প্রাথমিক কাজ। আমাদের অবশ্যই তার প্রতিবাদ করা উচিত। কিন্তু অনেকে দাবি করলেন টুপি-দাড়িওয়ালা মোল্লা মৌলবিদের এইভাবে ছাড়া আর কোনভাবে নেবে? জামাই আদর দিয়ে? এরা তো সন্ত্রাসী কিম্বা কিছু দিন পরেই সন্ত্রাসী হবে।

আমাদের সমাজ খুব ভালো, কিংবা মুসলমান মাত্রই অসাম্প্রদায়িক-- এই দাবি আমরা করি না। সাম্প্রদায়িকতা উপমহাদেশের গভীর অসুখ। এর ইতিহাস আছে। ইসলামের নামে জঙ্গি রাজনীতি নাই এটাও কোনো দাবি নয়। রাজনীতিতে শান্তিপূর্ণ ও সহিংস দুই ধরনের পদ্ধতির ভালমন্দ নিয়ে তর্ক আজকের নয়। বহু দিনের। কোন আন্দোলন ন্যায্য কি অন্যায্য সেই তর্কও অবান্তর। বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর সন্ত্রাস আমরা হরহামেশা দেখছি। মাদ্রাসায় সন্ত্রাসের চেয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান থেকে সন্ত্রাসের জন্ম হয়। বিচ্ছিন্ন ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে এর উত্তর আমরা খুঁজে পাবো না। খুঁজে পাবো সামগ্রিক ভাবে সমাজের অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদির মধ্যে।

আমরা বিনয়ের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ভাবে এবং বাংলাদেশে প্রদত্ত মৌলিক মানবিক অধিকারের দিক থেকে একটি প্রশ্ন তুলতে চাই। সেটা হোল বাংলাদেশ সরকার হিযবুত তাহরীর নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। গত ২২ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (রাজনৈতিক) ড. মো: কামাল উদ্দিন স্বাক্ষরিত একটি প্রেস নোটের মাধ্যমে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করবার কথা জানান। প্রেস নোটে বলা হয়, সংগঠনটি ‘জননিরাপত্তার জন্য হুমকি’। অতএব ১০ অক্টোবর থেকে সংগঠনটি নিষিদ্ধ। কেন হিযবুত তাহরীর জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে সরকার তার কোন ব্যাখ্যা দেয় নি। কোন প্রমাণও হাজির করে নি।

hizb-ut Tharirহিযবুত তাহরীর-এর বিভিন্ন লেখালিখি আমি পড়েছি। পড়ি। ঠিক যেমন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সিপিবি, জামায়াতে ইসলামী, ওয়ার্কার্স পার্টি-- প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য সকল দলের চিন্তা-ভাবনা জানা নাগরিক হিশাবে আমার অধিকার বলে আমি মনে করি। সব রাজনৈতিক দলের চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখার চেষ্টা করি বলেই ভুল বা ক্ষতিকর রাজনীতির বিরুদ্ধে আমি কলম ধরতে পারি। বুদ্ধিজীবী হিশাবে এটা আমার দায় এবং কাজ। হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে আমার চিন্তার পার্থক্য কোথায় সেটা বহু দিন আগে পাক্ষিক চিন্তায় আমি সুস্পষ্ট ভাবেই লিখেছি। কিন্তু আমি মনে করি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও বাংলাদেশের সাংবিধানিক অধিকারের বলে তারা তাদের চিন্তা ও মত অবশ্যই প্রচার করতে পারে। এই অধিকার যেমন তাদের রয়েছে, তার বিরোধিতার অধিকারও আমার বা অন্য যেকোনো নাগরিকের আছে।

হিযবুত তাহরীরের বিভিন্ন লিখিত ও সভা সমিতির বক্তব্যে সংগঠনটি বারবারই সন্ত্রাসী বা সহিংস কর্মকাণ্ডের নিন্দা করে এসেছে। তারা শান্তিপূর্ণ ভাবে বাংলাদেশের সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক মানবাধিকারের ভিত্তিতেই তাদের চিন্তা ও মত প্রচার করে চলেছে। তারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে শুধু মুখে কথা বলে ক্ষান্ত হয় নি; রাস্তায় মিছিল, সমাবেশ ও নিয়মতান্ত্রিক ভাবে বিক্ষোভ জানিয়েছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রণতরী যখন আমাদের সমুদ্রসীমানায় নোঙর করেছিল তারা প্রতিবাদ জানিয়েছে। বিডিআরের হত্যাকাণ্ড ভারতীয় ষড়যন্ত্র বলে তারা দাবি করেছে। ভারতের বিরুদ্ধে লিফলেট বিতরণ করে তাদের কর্মীরা গ্রেফতার হয়েছে। আমরা কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত বা ইসরাইলের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবো না? আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র ও সরকার যদি চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করে দেয়, তবে তা সমাজে ব্যাপক অস্থিরতা ও অসহনশীলতার সৃষ্টি করে। মূলত রাষ্ট্রই এই ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী রাজনীতি দানা বাঁধবার বা জন্ম দেবার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটাও আশ্চর্যের যে হিযবুত তাহরীরের অধ্যাপক মহিউদ্দীনকে বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া এবং কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া তাঁর বাড়ি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা ঘিরে রাখা হয়েছে। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং তাঁর নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা।

হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করবার অন্য অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে, সরকার যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে তাকে শক্তিশালী কিন্তু নিয়মতান্ত্রিকভাবে মোকাবিলা করবার হিম্মত এই সংগঠনটির রয়েছে। এই সংগঠনটির অধিকাংশ সদস্য উচ্চশিক্ষিত। তারা খিলাফত কায়েম করতে চায়। আমার বন্ধু মাহমুদুর রহমান টেলিভিশনে বলেছেন, খেলাফত কায়েম বলতে তারা ঠিক কী চায় আমরা কেউই পরিষ্কার নই। কিন্তু সেই বিষয়ে সমাজে তর্কবিতর্ক হতেই পারে-- গণতান্ত্রিক সমাজের যা চরিত্র-লক্ষণ। বাংলাদেশে কী ধরণের শিক্ষানীতি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে বাংলাদেশকে শক্তিশালী করবে, সেই বিষয়ে তাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা আছে। সেই ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে আমাদের বা অন্যদের মতপার্থক্য থাকতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক ভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা কোন অর্থে জননিরাপত্তার জন্য হুমকি? ইতিহাসের প্রহসন হচ্ছে এই যে, এই সেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যারা শেখ হাসিনাকেও জননিরাপত্তার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে ফিরতে দেয় নি। নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ কোন কাজের প্রমাণ ছাড়া হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে সরকার এটাই প্রমাণ করলো যে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের যে নীতি অনুসরণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের দোসররা দুনিয়ায় নতুন ‘সাম্রাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর; সেই নীতি বাস্তবায়নের অংশ হিশাবেই রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করবার এই নগ্ন হামলা শুরু হয়ে গিয়েছে।

হয়তো হিযবুত তাহরীরের জন্য এটা শাপে বর হয়েছে। কারণ সাম্রাজ্যবাদী ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করবার ক্ষেত্রে জনগণের আস্থা এই দলটির ওপর বাড়বে। কমবে না। দমন-নিপীড়ন করে কোন রাজনৈতিক মতাদর্শকে নস্যাৎ করা যায় না। রাজনৈতিক ভাবেই রাজনীতির মোকাবেলা করতে হয়।

আমি মৃত্যুভয়ে কখনই ভীত নই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও ছিলাম না। হয়তো তখন বয়স কম ছিল বলে সেই বীরত্বের জন্য গর্ব করা বালখিল্যতা হবে। কিন্তু জীবনের কোন মুহূর্ত আমার মনে পড়ে না যখন মৃত্যু আমাকে তার কালো মুখ দেখিয়ে ভয় দেখাতে পেরেছে। মইন-ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে বহু কুৎসিৎ ই-মেইল, টেলিফোন পেয়েছি, মরবার হুমকি পেয়েছি অনেক বার। লেখালেখি ছাড়া আমার আর কোন অস্ত্র নাই। সেইসব কাপুরুষদের শুধু বলেছি আমি নিরস্ত্র মানুষ, আমাকে মারতে হলে আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে মারতে হবে।

এই শক্তিটা আসতে পারে একমাত্র নৈতিক অবস্থান থেকে। সেই নৈতিক অবস্থান থেকেই আজ দাবি করছি-- মানবাধিকার-বিরোধী ফ্যাসিস্ট শক্তিকে গণতান্ত্রিক ভাবে রুখে দেওয়া ছাড়া আমাদের সামনে আর কোন পথ খোলা নাই।

১১ কার্তিক ১৪১৬। ২৬ অক্টোবর ২০০৯। শ্যামলী।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।