নারীর মান-মর্যাদার প্রশ্ন


সম্প্রতি ‘নারীর প্রতি কটূক্তি’ করার কারণে সমাজের প্রভাবশালী একটি অংশ হঠাৎ ভীষণ রকম সক্রিয় হয়েছে। ফলে নারীর প্রতি যিনি কটূক্তি করেছেন, তার বিরুদ্ধে দ্রুত বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং জামিনযোগ্য হলেও আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন।

বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চলছে, কথা বলা, সভা-সমাবেশের অধিকার গায়েব হয়ে গেছে। মানহানির মামলায় ত্বরিত অভিযুক্তকে গ্রেফতার ও কারাগারে পাঠানোর ঘটনাকে বাংলাদেশের বিদ্যমান ক্ষমতাচর্চার পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার করতে হবে। কিন্তু এ ঘটনায় অনেকে এমন ধারণা দিতে চাইছেন যে বাংলাদেশে ‘নারীবাদ’ খুব শক্তিশালী। প্রমাণ হচ্ছে নারীকে কোনো অবস্থায় বাংলাদেশে অবমাননা করা যায় না। যত বড় বা উচ্চপর্যায়ের হোক না কেন, সাজা ভোগ করতেই হয় এবং তা হতে পারে অতি দ্রুত সময়ে। বিচার বিভাগ সোচ্চার, প্রশাসন সক্রিয়, মিডিয়ায় নারীর প্রতি সহানুভূতি বিস্তর। এমন একটি বাংলাদেশ আমরা অনেক দিন দেখিনি।

নারীকে অপদস্থ করা, হেয় করা বা অপমান করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অবশ্যই করতে হবে। আইনি ব্যবস্থা যদি সেক্ষেত্রে উপযুক্ত মনে হয়, আইনের আশ্রয়ও নিতে হবে। কিন্তু নারীর প্রশ্ন যখন ক্ষমতাসীনদের দ্বারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার কাজে ব্যবহূত হয়, সেক্ষেত্রে উত্কণ্ঠিত হওয়ার কারণ ঘটে। এই কিছুদিন আগেও প্রচণ্ড হতাশ হয়ে দেখেছি, নারী লাঞ্ছিত হচ্ছেন, অপমানিত হচ্ছেন, নির্যাতিত হচ্ছেন। কোনো নারী সংগঠন, কোনো নারীবাদী বা নারী সাংবাদিক তাদের জন্য এগিয়ে আসেননি। নির্যাতিত নারী নিভৃতে কেঁদেছেন। যারা একটু প্রতিবাদ করতে চেয়েছেন, হুমকির মুখে তাদের লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। কোটা আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের হামলা থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীকে বাঁচাতে গিয়ে ছাত্রী মরিয়ম নির্যাতিত হয়েছেন; পুলিশের কাছে গিয়ে আরেক দফা হেনস্তা হয়েছেন। তার পরও কোথাও কোনো টু শব্দটি হয়নি। ভয়ে, নাকি অন্য কোনো কারণে? মরিয়ম কারো অপেক্ষায় থাকেননি। তিনি সংবাদ সম্মেলন করে পুরো ঘটনা বর্ণনার পরও দোষীদের কোনো শাস্তি হয়নি, উল্টো মরিয়মকে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে গিয়ে থাকতে হচ্ছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ও কিশোরীদের ইতিবাচক সংগ্রামী ভূমিকা আমাদের মুগ্ধ করেছে। সড়কে প্রাণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নারীবাদের বাইরের কোনো ইস্যু নয়। সে আন্দোলনে নারীদের অনেকে আন্দোলনকারীদের জন্য খাবার নিয়ে গেছেন, কেউবা নিয়ে গেছেন পানি। মায়েরা তাদের সন্তানদের আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য সমর্থন দিয়েছেন, পাশাপাশি নিজে রাস্তার ধারে এসে দাঁড়িয়ে থেকেছেন সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে। ‘গুজব’ ছড়ানোর অভিযোগে অনেক নারীর ওপর অকথ্য নির্যাতন, মামলা, জেলজুলুম হয়েছে। একজন অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে সরকারপক্ষের অনেকে অকথ্য ও অপমানকর ভাষায় কথাবার্তা লেখালেখি করেছে। কিন্তু যেন নারীবাদ বাংলাদেশে ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাষ্ট্রের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি এবং নারী নির্যাতনের যেসব নজির আমরা দেখেছি, তার বিরুদ্ধে ‘নারীবাদী’দের বিশেষ প্রতিবাদ দেখিনি। তাহলে সরকারবিরোধী জোটের অন্তর্ভুক্ত বলে নারীকে অপমান করার জন্য সুবিচারের তোয়াক্কা না করে যে শাস্তি দেয়া হয়, তাকে নারীর নামে ন্যায্য প্রমাণের অনর্থক চেষ্টাটা কেন? দেশের যেকোনো নাগরিককে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পরিবর্তে অভিযুক্তের রাজনৈতিক পক্ষপাতের জন্য শাস্তি দিতে উতলা হয়ে উঠলে নারী কিংবা নারীবাদ উভয়ের জন্যই মহাবিপদ হয়ে দাঁড়ায়।

গার্মেন্ট শ্রমিকরা যখন আন্দোলন করেন, তাদের ওপর পুলিশ চড়াও হয়। এরা রাস্তায় আন্দোলন করেন বলে তাদের টেনে-হিঁচড়ে নিলেও কারো অবমাননা হয় বলে মনে হয় না। সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে বাম দল করেন এমন ছাত্রীদের পুলিশ পিটিয়েছে, সে ছবি পত্রিকায় এসেছে। কারো কাছেই সে ছবি ‘অশোভন’ কিংবা নারী নির্যাতন ও অপমান মনে হয়নি। বিরোধী রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিএনপির নারী নেত্রীরা মাঠে নামলে পুলিশ তাদের চুলের মুঠি ধরে টানা-হেঁচড়া করে। আজকাল শাড়ি পরে সমাবেশ মিছিল করা যায় না। নেত্রীরা সালোয়ার-কামিজ পরা শুরু করে দিয়েছেন পুলিশের বর্বর আচরণের কারণে। ঢাকায় এসব দেখে রংপুর-দিনাজপুরের নারীদের অবমাননা হয় না। তারা কোনো মামলা দেয়ার কথা ভাবেন না।

জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন আরো ২৫ বছর থাকার বিধান রেখে গত ৮ জুলাই জাতীয় সংসদে সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী বিল ‘সংবিধান (সপ্তদশ সংশোধন) বিল-২০১৮’ বিভক্তি ভোটে পাস হয়েছে। এ সংশোধনীতে ৫০টি নারী আসনের সংখ্যা বাড়ানো হয়নি এবং নির্বাচন পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। শুধু মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২৫ বছরের জন্য। যদিও এ আসন সংরক্ষিত রাখার সঙ্গে নারীর প্রতি বিশেষ বিবেচনা জড়িত, কিন্তু বর্তমানে নারী আসন রাজনৈতিক দলের, বিশেষ করে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া দলের জন্য বোনাস হিসেবে কাজ করছে এবং দলীয়ভাবে নারীরা কিছু সুবিধা পেলেও সার্বিকভাবে নারীদের জন্য এ আসন কোনো কাজে লাগছে না। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নেও এ আসন বাধার সৃষ্টি করছে, দলীয়ভাবে নারীরা জনগণের কাছে না গিয়ে দলের পুরুষ নেতাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। তাই নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিন দাবি হচ্ছে মেয়াদ ও আসন সংখ্যা বাড়ালে এর সঙ্গে সরাসরি নির্বাচনের বিধান রাখতে হবে, নইলে এ আসন নারীদের জন্য সম্মানজনক নয় এবং নারীদের রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে। নারী আন্দোলন আরো দাবি করেছে, সাধারণ আসনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ নারীদের দিতে হবে। এ বিষয়ে সার্বিকভাবে নারী সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ থাকলেও সংবাদ সম্মেলন ও দু-একটি মানববন্ধন ছাড়া জোরালো কিছু দেখা যায়নি। রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নারীরা এখানে নিজেদের এ আসনে পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হওয়ার সুবিধা পাওয়ার আশায় আছেন, তাই তাদের দিক থেকে সাড়া নেই।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে নারী কোটা ১০ শতাংশ, এ বিষয়ে নারী সংগঠন নিজেদের কোনো মতামত দেয়নি। নারী কোটা কি এখনো প্রয়োজন আছে নাকি সংস্কার প্রয়োজন, সেটাও খুলে বলেনি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যেন নারীদের ডিজিটাল নির্যাতন ও হয়রানি থেকে রক্ষা করবে, এমন ভাব করা হচ্ছে। অথচ পুলিশ যখন নারীর ভিডিও ছেড়ে দেয়, সেই পুলিশের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা কেন হয় না, সে প্রশ্ন তোলারও কেউ নেই। সম্প্রতি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে আক্রমণ করে ছাত্রীদের প্রতি অশোভন আচরণ করা হয়েছে, তাদের গালিগালাজ করা হয়েছে। এটা কি নারীর প্রতি অবমাননা নয়? এ নারীরা এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য কেউ নেই।

দেশের পরিবেশ বিপন্ন করে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা নিয়ে নারীবাদীদের কি কোনো বক্তব্য থাকতে পারে না? বিশ্বে এখন নারীবাদ বা ফেমিনিজমের চেয়েও বেশি সক্রিয় হচ্ছে ইকো-ফেমিনিজম; যা পরিবেশ-প্রকৃতি রক্ষার জন্য লড়াই করছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় নারীরা নিউক্লিয়ার পাওয়ারের বিরুদ্ধে লড়ছেন, লড়ছেন জেনেটিক্যালি মডিফাইড প্রযুক্তির সম্ভাব্য ক্ষতির বিরুদ্ধে। কৃষিতে নারীকে কোণঠাসা করে ফেলার নীতি দেখেও সবাই যেন বুঝতে পারছেন না। তামাক সেবন ও উৎপাদনে স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি নিয়ে সোচ্চার হচ্ছেন পুরুষের পাশাপাশি নারীরা। বাংলাদেশে দু-একটি প্রতিবাদ শোনা গেলেও সার্বিকভাবে নারী আন্দোলনের প্রতিবাদ হিসাবে আসে না।

তাহলে বাংলাদেশে নারীবাদ কি আদৌ আছে? নারীবাদ একটি মতবাদ; যা পুরুষতন্ত্রের বিলুপ্তির জন্য লড়াই করে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগঠিত নারী আন্দোলন এখানে শক্তিশালীভাবে সক্রিয় ছিল একসময়, কিন্তু এখন অপরাধী কে এবং নির্যাতিত কে, তা দেখেই আন্দোলন সোচ্চার হয়। ১৯৯৫ সালে সংঘটিত দিনাজপুরের ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে যে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে সম্মিলিত নারী সমাজ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, সেটা ছিল সরকারবিরোধী আন্দোলন। এখানে সরকার, প্রশাসন সবকিছুর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ হয়েছিল। এখন ব্যাপারটা হয়ে গেছে উল্টো। সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের কেউ অপরাধী হলে সবাই চুপ করে যাচ্ছে আর বিরোধী কেউ অপরাধী হলেই সবাই সোচ্চার হচ্ছে এবং সাজা দিচ্ছে। নারীর অবমাননা নিয়ে রাজনীতি করা নিশ্চয়ই নারীবাদ নয়।

তবু ইতিবাচক দিকটি হলো, সমাজে একদিকে যেমন নারীর প্রতি অবমাননা চরম অবস্থায় আছে, নারীর নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে, তেমনি নারীর সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। এবং সে সুযোগ নারী কাজে লাগাতে পারলে, বিশেষ করে সফলতা দেখাতে পারলে তার প্রতি গ্রহণযোগ্যতাও বেড়েছে। তা না হলে গ্রামের কিশোরী মেয়েরা ক্রিকেট ও ফুটবল খেলে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করার সুযোগ পেত না। গ্রামে এ নিয়ে কোনো ফতোয়া জারি হয়নি বা তাদের প্রতি কেউ খারাপ আচরণ করেনি। তবে নারীবাদ বলি আর নারী আন্দোলন বলি, শ্রেণীবৈষম্য বিচার ছাড়া নারীর প্রশ্ন অসম্পূর্ণ থেকে যেতে বাধ্য। শ্রেণীবৈষম্য গরিব নারীর ক্ষেত্রে দ্বিগুণ নির্যাতন হয়ে বহাল আছে। শ্রেণীবৈষম্য নারীবাদের বাইরের কোনো ইস্যু নয়। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের সাফল্য বা তাদের প্রতি বিরূপ আচরণে যে প্রতিক্রিয়া হয়, গরিব ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর নারীদের বেলায় তার চেয়ে একটু কম দেখা যায়।

এছাড়া যেসব নারী ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অন্তর্গত, তাদের প্রতি নিপীড়ন ও জুলুমের প্রতি বিশেষভাবে সতর্ক থাকার ব্যাপার রয়েছে। শ্রেণী ছাড়াও জাতি ও বর্ণ মোকাবেলাও নারীবাদের বিষয়। সম্প্রতি আমরা দেখছি ধর্মীয়ভাবেও বৈষম্য হচ্ছে, হিজাব পরা নারীদের প্রতি অসম আচরণ হচ্ছে। তাদের প্রতি জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে অনেক নারী সংগঠনের মধ্যে রক্ষণশীলতা লক্ষ করা যায়।

বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে নারীর প্রশ্নকে সামনে আনতে হলে বিভিন্ন দিক থেকে আমাদের ভাবতে হবে।

লেখক: নারীনেত্রী

নির্বাহী পরিচালক, উন্নয়ন বিকল্পের নীতি-নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ)

এই লেখাটি ৩ নভেম্বর ২০১৮ দৈনিক বণিক বার্তা-য় প্রকাশিত হয়

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।