১. গুগি ওয়া থিয়োঙ্গো: নয়া-উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সাহিত্য


১৯৯৬ সালে ভারতের হায়দ্রাবাদের নিজাম মহাবিদ্যলয়ে কেনিয়ার নাট্যকার,ঔপন্যাসিক এবং প্রাবন্ধিক গুগি ওয়া থিয়োঙ্গো  ( Ngũg wa Thiong'o) যখন নয়া ঔপনিবেশবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আফ্রিকার জাতীয় আন্দোলনগুলো নিয়ে আলোচনা করছিলেন, তখন ইদি আমিন, গাদ্দাফি এবং সাদ্দাম হোসেন সম্পর্কে তার অভিমত জানাতে চাওয়া হয়। উত্তরে বলেন “ আমার কাছে কি ধরণের উত্তর আশা করছেন তা আমি জানি। দুচার কথায় এর জবাব দেয়া কঠিন। তবে একটা কথা আমি জোর দিয়ে বলতে চাই -- আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারজাত মৌলবাদ অন্য সমস্ত রকম মৌলবাদের চেয়ে বিপজ্জনক”। মৌলবাদের সংজ্ঞার পরিধি ব্যাপ্তির কারণে লেখক থিয়োঙ্গো যথার্থভাবে সব থেকে বিপজ্জনক মৌলবাদকে সনাক্ত করতে যে পেরেছেন সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যে মৌলবাদ আমাদের ক্ষুদ্র পরিধির মৌলবাদের (যেমন ধর্মীয় মৌলবাদ, বিভিন্ন মতাদর্শগত মৌলবাদ ইত্যাদি) চাপে এবং দমনের কারণে দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়। গুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর এই দৃষ্টিভঙ্গীর স্বচ্ছতার পেছনে কেনিয়ার ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের একটি দীর্ঘ ইতিহাস যুক্ত হয়ে আছে। যে ঔপনিবেশিক পরিবেশে তার কৈশোর, যৌবন অতিবাহিত হয়।

কেনিয়ার সমস্যার সূত্রপাত ১৮৮৪ সালে। যখন জার্মানির বার্লিন শহরে ইউরোপের পুঁজিবাদী দেশগুলো পুরো আফ্রিকা মহাদেশকে নিজেদের প্রভাবের অধীন অঞ্চলে ভাগাভাগি করে নেয় এবং আমাদের “ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি”র মতো কেনিয়ায় “ ব্রিটিশ ইস্ট আফ্রিকা কম্পানি ”র আগমন ঘটে। সেই আগমন আফ্রিকার বিভিন্ন ভাষাভাষী ও সংস্কৃতি সম্পন্ন মানুষকে ঔপনিবেশিক দাসত্বে বেঁধে ফেলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে এসব দেশগুলির উপর উপনিবেশ থেকে নয়া উপনিবেশ স্থাপনের উত্তরনের মহড়াও ঘটেছে লণ্ডন, প্যারিস, ব্রাসেলস্ এবং লিসবনের রুদ্ধদ্বার ঘরে। তবে ১৯৫২ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কেনিয়ায় জেমো কেনিয়াট্টার নেতৃত্বে দেশব্যাপী কৃষকদের জমি ও স্বাধীনতার লড়াই চলেছে। সে লড়াই ‘মাউ মাউ আন্দোলন (১৯৫২-৫৬)’ । মাউ মাউ আন্দোলন দমনের অজুহাতে দেশে জরুরী অবস্থার ঘোষণা করা হয় এবং তার পরপরই আবার সরাসরি বৃটিশ উপনিবেশ স্থাপন করা হয়।

গুগির জন্ম ১৯৩৮ এর ৫ জানুয়ারি। উপনিবেশকালের প্রত্যক্ষ ভুক্তভুগিদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন গুগি ওয়া থিয়োঙ্গো। যে কারণে তার বিখ্যাত ‘ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড’ বইয়ে আমরা দেখতে পাই তিনি বলছেন “ স্কুলে সবচেয়ে অপমানজনক বিষয় ছিল স্কুলের গণ্ডিতে গিকুইউ (গুগির মাতৃভাষা) ভাষায় কথা বলে ধরা পড়া। মাতৃভাষায় কথা বলা অবস্থায় ধরা পড়লে কঠিন শারীরিক শাস্তি ভোগ করতে হতো। পাছার ওপর তিন থেকে পাঁচ ঘা বেত অথবা গলায় ধাতুর পাত ঝুলিয়ে দেয়া হতো আর সেখানে লেখা থাকতো ‘আমি আহাম্মক’ বা ‘আমি গাধা’।” স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে ঔপনিবেশিক শক্তির আধিপত্য, কিভাবে কেনিয়ার জনগণের কাছ থেকে তাদের মাতৃভাষা ছিনিয়ে নিচ্ছিলো।

শুধু তাই না, ঔপনিবেশিকোত্তর সময়ে অর্থাৎ নয়া-ঔপনিবেশিক সময়েও সেই আধিপত্যের রকমফের ঘটেনি। শুধু শ্বেতকায় বর্ণের শাসকের স্থলে অশ্বেতকায় বর্ণের শাসকের স্থানান্তর ঘটেছে মাত্র। যে কারণে সেই ১৯৯৬ সালে ভারতে অবস্থানকালে একটি বিশেষ আলোচনা সভায় ১৫ জন প্রতিনিধির ( সেখানে গুগি দম্পতি এবং উইলিয়াম হিনটন কে প্রধান অতিথি করা হয়) সমাবেশ দেখে বিস্ময়ে তাকে বলতে শোনা যায় -- “ আমাদের কেনিয়ায় কেউ যদি চার জনের বেশি মানুষকে সান্ধ্যভোজে ডাকে, তাহলে তাকে পুলিশের অনুমতি নিতে হয়, নইলে তারা মনে করবেন ওটা কোন ভোজসভা নয়, শুধু সভা।” এখানে “ সভা ” বলতে গুগি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বুঝিয়েছেন। গুগির প্রায় সব লেখায় তাই আমরা দেখতে পাই নয়া-ঔপনিবেশকবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠার লেখা। অনেক জেল-জুলুম-নির্যাতন যার কলমকে রুদ্ধ করতে পারে নাই। যার কলম শুধু সোচ্চার হয়ে ওঠে কেনিয়ার শোষিত মানুষের জন্যে। যার লেখার প্রতি স্তরে কেনিয়ার করুন আর সমস্যাবহুল ইতিহাসকে পাওয়া যায়। নাটক, উপন্যাস বা প্রবন্ধ-- কোথাও তিনি নয়া ঔপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের সাথে এতটুকু আপোষ করেননি। আপোষ করেননি মাতৃভাষার সঙ্গে। আমরা তার বিভিন্ন লেখার ভিতর দিয়ে তার নয়া-ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চরিত্রের বিভিন্ন দিক উন্মোচনের চেষ্টা করবো।

প্রথমেই ধরা যাক তার ‘মাতিগারি’ উপন্যাসের কথা, যা ১৯৮৬ সালে কেনিয়ায় প্রকাশিত হয়েছিল। মাতিগারি উপন্যাসের প্রেক্ষাপট দেশপ্রেমিকদের প্রত্যাবর্তনের জন্য জগগণের আকুল আকুতি। মাতিগারি উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মাতিগারি। যে নিজেকে পরিচয় দিত ‘মাতিগারি মা নিজুরুজি’ বলে। যার অর্থ ‘সেসব দেশপ্রেমিক যারা তাদের বুলেট থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছিল’ অথবা ‘ সেসব যোদ্ধা যারা তাদের যুদ্ধকে বাঁচিয়ে রেখেছিল নয়া-ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে’। উপন্যাসটি তাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিদ্রুপ করে যায় যারা কখনো কোন বীজ বপন করেনি অথচ ফসলটুকু তুলে নিয়ে যায়। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রুপ যারা দেশের জন্যে কাজ না করে দেশের সম্পদ লুন্ঠন করে নিয়ে যায়। যেমনটা করেছিল প্রাক্তন উপনিবেশ শাসকেরা আর বর্তমানে করছে তাদেরই আদলে গড়া নব্য শাসকদল ও তাদের দেশীয় দোসররেরা। কাহিনীর শুরুতে দেখা যায় মাতিগারি স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করে এবং প্রত্যাবর্তনের পর দেখে দেশটা একেবারে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। মাতিগারি অনেক চেষ্টা করেও তার নিজের বাড়ির দখল ফিরে পায় না --যা গল্পের আকারে এবং রূপকের আকারে পাওয়া যায়। নিজের বাড়ি দখলের চেষ্টা সে চালিয়ে যায়। ক্রমাগতভাবে সে সত্য আর ন্যায় বিচার নিয়ে নানান প্রশ্ন তুলতে থাকে। রেডিও ভাষ্যে তার সম্পর্কে অনেক কথা শোনা যেতে থাকে। ক্রমে শাসকের দৃষ্টিতে সে এমন এক সন্দিহান চরিত্র হয়ে দাঁড়ায় যে তাকে গ্রেফতার করা হয় ও জেল হাজতে প্রেরণ করা হয় এবং পরে মানসিক হাসপাতালে। কিন্তু সেখান থেকে সে পালিয়ে যায়। এখানে একটি মজার বিষয় হচ্ছে উপন্যাসটি প্রকাশিত হবার পর তা এতটাই আলোড়ন তোলে যে উপন্যাসটি সম্পর্কে বিভিন্ন গোয়েন্দা রিপোর্ট যেতে থাকে দেশের প্রেসিডেন্টের কাছে। প্রেসিডেন্ট আদেশ দেন মাতিগারিকে খুঁজে বের করার জন্যে। কিন্তু যখন জানা গেল মাতিগারি নামে বাস্তবে কোন মানুষ নেই সেটা শুধুমাত্র উপন্যাসের চরিত্র তখন সেই বই সহ সমস্ত প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত করা হয়। উপন্যাসে যা ঘটেছিল সেটাই যেন বাস্তবে রূপ নিল। শিল্প আর বাস্তব যেন মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। গুগি তার ‘শিল্প ও রাষ্ট্র : সম্পর্কের টানাপোড়েন’ প্রবন্ধে বলেন: “ সাম্প্রতিক আফ্রিকায় লেখকদের মনে করা হয় উপনিবেশ উত্তর শক্র হিসেবে। তাদের কাজকে মনে করা হয় রাষ্ট্রনেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মতো। ---আসলে রাষ্ট্র ও শিল্পের চরিত্রের মধ্যে ক্রমাগত এক দ্বন্দ্ব চলে। রাষ্ট্রের চরিত্র রক্ষণশীল। রাষ্ট্রের সন্ধান স্থায়িত্বে। শিল্প বিপ্লবী। শিল্প সব সময় গতিময়তায় স্থিতি এবং স্থিতিশীলতায় গতির সন্ধান করে। রাষ্ট্র গতিকে থামাতে চায়, মুহূর্ত্তের পুনরাবৃত্তি চায়।---- শিল্পের কাছে উত্তরের চেয়ে প্রশ্নের সংখ্যা বেশি। রাষ্ট্রের কাছে অনেক উত্তর এবং প্রায় কোন প্রশ্নই নেই। রাষ্ট্র যত স্বেচ্ছাচারী হবে, তত নিজেকে কম প্রশ্ন করবে। তার চেয়ে আরও কম অন্যের প্রশ্ন শুনতে চাইবে। সরকার এমন একটা ভাব করে যেন সঠিক উত্তরটা কেবল তার কাছেই আছে। শিল্প উচ্চারণের ভূমি পুনরুদ্ধার করে। নির্বাকদের কাছে উচ্চারণ ফিরিয়ে দেয়। রাষ্ট্র জনগণের উপর সামগ্রিক নিস্তব্ধতা চাপিয়ে দেয়। সমাবেশের অধিকার কেড়ে নেয়”।

মাতিগারির কাহিনী শেষ হয় নতুন প্রজন্মের অস্ত্র সন্ধানের ঘটনার ভেতর দিয়ে। যে অস্ত্র ডুমুর গাছের নিচে উপনিবেশ বিরোধী যোদ্ধারা লুকিয়ে রেখেছিল এবং লুকিয়ে রাখার অর্থ পুনরায় প্রয়োজনে তাকে খুঁজে বের করে আরও অভ্রান্তভাবে প্রয়োগ করা আরও ভয়ঙ্করতর শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে। বালক মোরুয়ূর যার সন্ধান পায়। অর্থাৎ নয়া ঔপনিবেশবাদের যুদ্ধ, পরবর্তী প্রজন্মের হাতে চলে যায়। যে যুদ্ধ তখনই থামবে যখন নয়া ঔপনিবেশবাদীর আদলে গড়া দেশীয় শাসকের অবসান হবে। এই কারণেই পশ্চিমাদের কাছে এই উপন্যাস ভালো লাগেনি। আসলে ‘মাতিগারি’ একটি উদ্দীপনা। একটি সাহসিকতা। যে উদ্দীপনা মানুষকে তার দেশপ্রেমকে সদা জাগ্রত রাখে। এই উপন্যাসে নগুগি আরো দেখিয়েছেন নয়া উপনিবেশবাদী দেশে দুই ধরণের মানুষ থাকে, এক দল যারা দেশকে প্রকৃত অর্থেই ভালোবাসে আরেক দল দেশকে বিকিয়ে দিতে চায়। সেনাবাহিনীর মধ্যেও দুই দল আছে। এক দল আছে জনগণকে রক্ষা করার জন্যে অন্য দল আক্রমনের জন্যে। এভাবেই নয়া ঔপনিবেশবাদ দুর্বল দেশের জনগণকে দুই বা ততোধিক ভাগে বিভক্ত করে সেই দেশগুলিকে আরও দুর্বলতর করে তোলে।


চিন্তার পাঠকরা গুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর এই সাক্ষাতকারটি শুনতে পারেন।


নয়া ঔপনিবেশবাদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায় তার’ডিকলোনাইজিং অফ মাইন্ড’ বইয়ের প্রতি পাতায় পাতায়। সেই বইয়ের প্রথম দিকে তিনি বলছেন, “১৮৮৪ সালের বার্লিননীতি ছিল তরবারি আর বন্দুকের। কিন্তু তরবারি আর বন্দুকের কালো রাত পার হয়ে এখন আবির্ভূত হয়েছে চক আর ব্ল্যাকবোর্ডের প্রত্যুষ। যুদ্ধক্ষেত্রের পেশি-শক্তির সংর্ঘষের স্থান দখল করেছে শ্রেণিকক্ষের মনস্তাত্ত্বিক সংঘর্ষ”। এই সংঘর্ষ কতটা প্রবল হয় তা তিনি কেনিয়ার আরেকজন লেখক এবং বিজ্ঞ পণ্ডিত প্রফেসর মিসেরে মুগোর বক্তব্য থেকে তুলে ধরেন, বক্তব্যে মিসেরে মুগো উল্লেখ করেছিলেন অনেক দিন আগে তিনি রাইডার হ্যাগার্ডের ‘কিং সলোমনস মাইন্ডস’’পড়তে গিয়ে গ্যান্ডেল নামের একজন বয়োবৃদ্ধা চরিত্রের বর্ণনা পেয়েছিলেন। বর্ণনা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, পরবর্তীতে তিনি যতবার কোন আফ্রিকান বৃদ্ধার দেখা পেয়েছেন ততবারই ভয়ে আঁতকে উঠেছেন। বহুদিন তিনি ওই আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন”। শুধু তাই না, গুগি আরও জানান, পাশ্চাত্যের হেগেল, হিউম সহ অনেক পণ্ডিতবর্গ এবং আরও পাশ্চাত্য ভাবধারার অনেক উপন্যাসে কালো বর্ণের মানুষদের সম্পর্কে এভাবেই লেখা হয়েছে। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ বাস্তবতাকে উল্টো অবস্থানে নিয়ে যায় : অস্বাভাবিকটাকে দেখা হয় স্বাভাবিক বলে এবং স্বাভাবিককে অস্বাভাবিক রূপে। নিজেদের কোন কিছুই ভালো না, যা ভালো সব আছে পশ্চিমে --এই ধারণা একেবারে শিশু অবস্থা থেকে মনের গভীরে গেঁথে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, নয়া ঔপনিবেশবাদ নিজের দেশকে নিজের দেশের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শেখায় না বরং অপরের চোখ দিয়ে অর্থাৎ পশ্চিমের চোখ দিয়ে দেখতে শেখায়। এই দৃষ্টির অন্যথা হলে জেল-হাজত এবং কারাবরণ। তার প্রমাণ মেলে গুগির বিখ্যাত সব নাটক ‘পেটালস অফ ব্লাড’, ‘আই উইল ম্যারি হোয়েন আই ওয়ান্ট’, ‘মাদার সিং ফর মি’ নাটকগুলো মঞ্চস্থ হবার পর। এসব নাটক মঞ্চস্থ হবার পর, ১৯৭৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর কেনিয়ার উপরাষ্ট্রপতি দানিয়েল আরাপ মই’য়ের নির্দেশে তাকে জেলে বন্দী করা হয়। এক বছর তাকে জেল হাজতে থাকতে হয়। কিন্তু এই জেল জীবন তার জীবনে শাপে বর হয়ে দেখা দেয়। ১৯৭৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত গুগি ইংরেজি ভাষায় জেমস গুগি নামে লিখতেন, কিন্তু জেলে গিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তার মাতৃভাষা গুকুউইউ ভাষায় লিখবেন এবং কাগজের অভাবে জেলের টয়লেট পেপারে (তার প্রিজন ডায়রিতে বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন এই বিষয়ে), যা কিছুটা খসখসে তার ওপর লেখেন তার অনবদ্য আরেকটি উপন্যাস ‘ডেভিল অন্ দা ক্রস’ বা ‘ক্রুশের উপর শয়তান’।

উপন্যাসে যাবার আগে একটা কথা উল্লেখ করা দরকার, গুগি তার মাতৃভাষা সম্পর্কে কে.টি.এন. নিউ কেনিয়া টিভি চ্যানেলে জেফ কইনানঙ্গেকে দেয়া একটা সাক্ষাৎকারে গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেন। তিনি বলেন, “তুমি যদি পৃথিবীর সব ভাষা জানো শুধু নিজের মাতৃভাষা ছাড়া সেটা হলো দাসত্ব। অন্যদিকে তুমি যদি পৃথিবীর অন্যান্য ভাষা কিছু কিছু জানার পাশাপাশি নিজের মাতৃভাষাটা ভালো করে জানো সেটা হলো ক্ষমতায়ন।” এভাবে গুগি ভাষার ভেতরে রাজনীতি কিভাবে প্রচ্ছন্ন ভাবে বিরাজ করে তা বুঝিয়ে দেন।

‘ডেভিল অন দা ক্রস’-এর কাহিনীটা সংক্ষেপে বলি। ওয়ারুঙ্গ এবং আরও ছয়জন লোক নাইরবি থেকে মাতাতুর যাচ্ছে ট্যাক্সিতে করে। তাদের সবার মধ্যে মিল থাকে একটা বিষয়ে আর তা হলো তাদেরকে চোর-ডাকাতের এক ভোজে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। ভোজের আয়োজন করেছে শয়তান। সেই ভোজে একটা প্রতিযোগিতা থাকে। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বেছে নেয়া হবে সাতজন সেরা চোরকে অর্থাৎ কারা জনসাধারণের সম্পদ সবচেয়ে বেশি পরিমাণে এবং সবচেয়ে বেশি দক্ষতার সঙ্গে হাতিয়ে নিয়েছে। তাদেরকে বেছে নেয়া হবে। তাদের মধ্যে এমন একজন থাকে যার চুরি করা সম্পদের পাহাড় তার মনের মধ্যে আফসোস তৈরি করে। কারণ তার এত বিপুল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই তার একটা হৃদপিন্ড, একটাই জীবন। কথাটা মাথায় আসতেই হৃদপিন্ড প্রতিস্থাপনের একটা কারখানা নির্মাণের পরিকল্পনা তাকে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে দেয়। পরিকল্পনা মোতাবেক সেই কারখানায় অতিরিক্ত অঙ্গ প্রতঙ্গ তৈরি করা হবে, এমনকি পুরুষদের জন্য তৈরি করা হবে অতিরিক্ত শিশ্ন। ধনী লোকেরা শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে অমরত্ব লাভ করবে এবং গরীবদের একচেটিয়া বিষয় হয়ে থাকবে শুধু মৃত্যু। স্ত্রীকে এই পরিকল্পনার কথা জানাতেই সে খুশী হয়ে ওঠে। কেননা তাকেও তখন গরীব লোকদের স্ত্রী থেকে আলাদা করা যাবে। কেননা তারও দুটো মুখ, দুটো পেট, দুটো হৃদপিন্ডের সঙ্গে থাকবে দুটো জননেন্দ্রিয়। কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা ক্ষেপে উঠে জানায় তার স্ত্রী যত খুশী পেট, মুখ বা শরীরের যে কোন অঙ্গ অতিরিক্ত প্রতিস্থাপন করতে পারে কিন্তু জননেন্দ্রিয় কেনো ? অসম্ভব। স্ত্রীও নাছোড়বান্দা। স্বাভাবিক ভাবেই সে প্রশ্ন তোলে তার স্বামীর দুটো শিশ্ন থাকলে তার কেন থাকবে না। লিঙ্গ সমতার অধিকার। লোকটা তখন বলে সেসব অধিকার সে পশ্চিমে স্থাপন করতে পারে, কিন্তু অফ্রিকায় কিছুতেই না। কিন্তু স্ত্রী তার সিদ্ধান্তে অটল। শুরু হয়ে যায় স্বামীর নির্যাতন। শেষে স্ত্রী হার মানে। লোকটি তখন চিৎকার করে বলে ওঠে, “আমাদের টাকাপয়সাই আমাদের জন্য অমরত্ব কিনে দিবে। মৃত্যুকে পাঠিয়ে দিব হতভাগ্য গরিবদের কাছে। হা হা হা !!”। শেষে সেই ব্যক্তিটিই নির্বাচিত হলো মুকুটের যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে। পৌরানিক কাহিনীর মোড়কে মোড়া তার গল্প এভাবেই আমাদের দেখিয়ে দেয় সাম্রাজ্যবাদ এবং নয়া ঔপনিবেশবাদ ধনী আর গরিব এর ব্যবধান কিভাবে বৃদ্ধি করে যায়। যে ব্যবধানের শিকার কেনিয়ার সঙ্গে প্রায় সব তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। গুগির গল্প তখন শুধু কেনিয়ার একক গল্প হয়ে ওঠে না, তা হয়ে যায় কম-বেশি পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের বাস্তব কাহিনী।

( চলবে। বাকি অংশ পরে আসছে)

 

 

 

Ngũgĩ wa Thiong'o 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।