২. গুগি ওয়া থিয়োঙ্গো: নয়া-উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সাহিত্য  


শুধু সাম্রাজ্যবাদীর মুখোশ উন্মোচন নয়, নয়া-উপনিবেশ অধিকৃত দেশগুলোর স্বৈরশাসকদের মুখোশও উন্মোচিত হয় নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গোর উপন্যাসে। ২০০৬ সালে প্রকাশিত ‘উইজার্ড অফ দ্যা ক্রো’-কে সমালোচকরা চিহ্নিত করেছেন ‘অ্যান এপিক স্যাটায়ার অফ নিও কলোনিয়ালিজাম’ নামে; উপন্যাসটা ঠিক তেমন ধাঁচেরই একটা কালজয়ী উপন্যাস। ৭৬৬ পৃষ্ঠার বিশাল কাহিনীটি যাদু বাস্তবতার আদলে অত্যন্ত রসালোভাবে একজন নয়া ঔপনিবেশিক স্বৈরশাসক এবং তাকে বেষ্টন করে রাখা চাটুকার মন্ত্রী, অমাত্য আর উপদেষ্টাদের নিয়ে নির্মাণ করেছেন থিয়োঙ্গো। তার কালজয়ী এই উপন্যাস। ‘যে বছর আবুরিরিয়া-র স্বৈরাচারী শাসক পৃথিবীর সর্বোচ্চতম টাওয়ার বানানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করলেন, কামিতি নামে এক হতভাগ্য যুবক জঞ্জালের স্তুপের উপর ঘুম থেকে ঠিক সেদিনই জেগে উঠে আবিষ্কার করলো, তার উপর যাদু-শক্তি ভর করেছে’ -- এভাবে ‘উইজার্ড অফ দ্যা ক্রো’ উপন্যাসের শুরু। উপন্যাসের পটভূমি একটি কাল্পনিক আফ্রিকান শহর যার নাম ‘আবু রিরিয়া’। শহরটি আফ্রিকার একনায়ক-শাসিত বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিচিত্রই শুধু নয় তৃতীয় বিশ্বের আরও অন্যান্য গরীব দেশের প্রতিচিত্রও বটে। দেশের প্রধানকে কোন নির্দিষ্ট নামে চিহ্নিত করা হয় না শুধু ‘দ্যা রুলার (শাসক)’ নামে অভিহিত করা হয়। যে শাসক যখনই তার জন্মদিন পালনের ইচ্ছে হয়, তখনই সে দিন-মাস নির্ধারণ করে তা পালন করে। যে শাসকটির অস্তিত্ব শুধু টিভির পর্দায়, সেখানে তার দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত্ত -- যেমন খাওয়া, মলত্যাগ, হাঁচি বা নাক ডাকা এমনকি হাইতোলা পর্যন্ত খবরগুলো অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। এবং যখনই সে হাইতোলে জাতীয় জীবনে কোন না কোন দুর্ঘটনা ঘটে। যেমন, তার বিরোধীদের শহরের চৌমাথায় চাবকানো হয়, গুঁড়িয়ে দেয়া হয় গোটা গ্রাম বা তীরন্দাজ বাহিনী তীর বিধিঁয়ে মেরে ফেলে অসংখ্য মানুষ ইত্যাদি। যে তার বৈধ স্ত্রীকে একটি ঘড়ি-বিহীন বাড়িতে বন্দী করে রাখে। যেখানে ঘড়ির কাঁটা একটি স্থির সময়ে অবস্থান করে, একই গান, একই খাবারের পুনরাবৃত্তি চলে, টিভি এবং রেডিওতে একই অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। স্ত্রীর অন্যায় ? সে তার স্বামীকে স্কুলের শিশুদের বোকা বানানো থেকে নিবৃত্ত করতে চেয়েছিল। শাসকের চারপাশে চাটুকার মন্ত্রীরা ঘিরে থাকে। এই মোসাহেবের দলই দেশ শাসন করে। যে শাসনে শুধু ‘শো অফ’ বা দেখানেপনা আর নিষ্ঠুরতাই থাকে। দুর্নীতি এখানে অতি প্রচলিত বাস্তব। মন্ত্রীদের একজন প্লাসটিক সার্জারি করে চোখ দুটো ইলেকট্রিক বাল্বের মতো বড় করেছে যাতে শত্রু সনাক্ত করা যায়। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক মন্ত্রি কান বড় করেছে যাতে প্রতিটি জনসাধারণের কথা কান পেতে শোনা যায়। আরেজন মুখের প্লাসটিক সার্জারি করেছে যাতে সরকারের প্রপাগান্ডা চাপার জোরে প্রচার করা যায়। গল্পের গতি এভাবে রসাল বর্ণনার মাধ্যমে এগিয়ে যায়। ইতিমধ্যে গল্পের সেই নায়ক কামিতি যার যথেষ্ট বিদ্যাবুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও শুধু দরিদ্র হবার কারণে জনবিচ্ছিন্ন একজন প্রান্তিক মানুষ হয়ে সমাজে বসবাস করে। হঠাৎ সে একদিন এক অলৌকিক ক্ষমতা পেয়ে যায়; সেটা হলো, যাদুবলে সে পশুপাখিদের ভাষা বুঝতে পারে। শুরু হয় তার জনপ্রিয়তা। শহরের সবাই তার কাছে তাদের সমস্য নিয়ে ভীড় করতে থাকে। এক সময় সেই শাসকদলের এক মন্ত্রীও কামিতির কাছে হাজির হয়। মন্ত্রীর একটা বিশেষ অসুখ ধরা পড়েছে আর তা হলো কিছু জান্তব শব্দ ছাড়া সে কোন কথা বলতে পারে না। যাদুকর কামিতি তাকে দেখে তার অসুখের একটা অদ্ভূত নাম দেয়। আর তা হলো ‘হোয়াইটেক’ অর্থাৎ সাদা হবার উন্মত্ত বাসনা। তারপরেই কাহিনী তার স্থলসীমা ছাড়িয়ে চলে যায় সমাজ-ইতিহাসের বিস্তীর্ণ জগতে, যেখানে কামিতি বিস্ফোরক একটি বাক্য ব্যবহার করে: ‘একজন ক্রীতদাস প্রথমে হারিয়ে ফেলে তার নাম। তারপর তার মুখের ভাষা’।

এই প্রসঙ্গে, ৩০ মার্চ, ২০০৫ সালে, আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ ওরেগনে দেয়া গুগির ভাষণের একটা অংশ স্মরণ করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হবে। সেই লেকচার বা ভাষণে গুগি, রবিনসন ক্রসো গল্পের একটা চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। উনি বলছেন, রবিনসন ক্রসোয় ফ্রাইডে নামে যে চরিত্রটি আছে গল্পে দেখা যায়, ফ্রাইডে কোনো ভাষা জানেনা। রবিসন তাকে শুধু ভাষাই শেখায়না, ফ্রাইডের নামটাও তাকে দিয়ে দেয়। গল্পের কোথাও, রবিনসন, ফ্রাইডেকে জিজ্ঞেস করেনা, কি তার নাম, উল্টো ফ্রাইডেকে সে বলে, আজ থেকে তোমার নাম দিলাম ফ্রাইডে, তোমার নাম ফ্রাইডে আর আমি তোমার মাস্টার। গুগি বলছেন, এই নামকরণের মধ্যে দিয়ে, ফ্রাইডের শরীরে, রবিনসন, ‘ক্রসিয়ো’ স্মৃতি রোপণ করে দিল। ফ্রাইডে জানতেই পারলোনা, আগে তার কি নাম ছিল বা আগে সে কে বা কি ছিল। এভাবে ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের বাহুবল এবং শিক্ষাবলের মধ্যে দিয়ে, নেটিভ দেশগুলোর স্মৃতিশক্তি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদির বিলোপ ঘটায়। নয়া-উপনিবেশ অধিকৃত দেশগুলোর স্বৈরশাসকেরা, একই কায়দায়, দেশের নাগরিকদের উপর, তাদের মনগড়া মতাদর্শ ইত্যাদি চাপিয়ে দেয়। নাগরিকদের মুখ-চোখ-কান বন্ধ করার মধ্যে দিয়ে, তারা কে বা কি সেসব শুধু ভুলিয়েই দেয়না, নাগরিকদের অস্তিত্বেরও বিলীন ঘটায়। ‘উইজার্ড অফ দা ক্রো’ কাহিনীর শেষে এভাবে দেখা যায়, সেই শাসক থেকে শুরু করে দেশের নাগরিক, যারা আগেই শাসনযন্ত্রের চাপে এবং তাপে তাদের বাকস্বাধীনতা হারিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তারা বাকরুদ্ধ হয়ে নৈঃশব্দের ভারে ন্যূব্জ হয়ে যায়। তাদের সবার মুখে একটা সংলাপই বলতে শোনা যায় এবং সেটা হলো: ‘উই ওয়ান্ট আওয়ার ভয়েস ব্যাক’।

এই কাহিনীর সাথে, আরেকটা বাস্তবতা আমরা মিলিয়ে দেখতে পারি যা,১৯৮৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরে আদ্দিস আবাবা থেকে ফেরার সময় প্রেসিডেন্ট মোইয়ের ভাষণের অংশবিশেষ। নগুগি তার ‘ডিকলোনাইজিং দ্যা মাইন্ড’ বইয়ের একটি ফুটনোটে সেটা তুলে ধরেন: “ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ, ব্যাপক ও বিস্তৃত খরা সত্ত্বেও আমরা বেশ ভালো আছি। আপনাদের বলতে চাই আমরা যখন উন্নয়নের পথে তখন পত্রপত্রিকায় এটাওটা নিয়ে বিতর্ক না করাই ভালো-----আমি সকল মন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং সর্বসাধারণকে বলেছি তোতাপাখির মতো কথা বলতে। ---আমি যেখানে পূর্ণ বিরতি ব্যবহার করি আপনারাও সেখানে পূর্ণ বিরতি ব্যবহার করবেন। এভাবেই আমাদের দেশ সামনে এগিয়ে যাবে” ইত্যাদি ইত্যাদি।

১৯৭৭ সালে নগুগিকে বিনা অভিযোগ এবং আদালতে প্রেরণ ছাড়া এক বছর জেলে বন্দী করে রাখা হয়। ১৯৮২ সালে তাকে স্বেচ্ছানির্বাসনে যেতে হয় প্রথমে ব্রিটেনে, সেখান থেকে পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (যেখানে যাবার কোন ধরণের ইচ্ছাই তার কোন সময় ছিল না)। ২০০৪ সালে সামান্য সময়ের জন্যে তিনি দেশে আসেন এবং ১১ আগষ্ট তার জীবনে ঘটে আরেকটি দুর্ঘটনা। যে হোটেলে তিনি অবস্থান করছিলেন সেখানে অতর্কিত আক্রমনের মাধ্যমে তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয় এবং তার স্ত্রীকে করা হয় ধর্ষণ। ঘটনাগুলো পর পর সাজালে বুঝতে অসুবিধা হয় না বাস্তবের এসব ঘটনা তার মনে কতটা প্রভাব পড়লে এমন প্রতিবাদী উপন্যাস নির্মিত হয়। যেসব ঘটনা তৃতীয় বিশ্বের অনেক দরিদ্র দেশগুলোতেও খুব বিরল নয়। আমরা যদি আবুরিরির বদলে বাংলাদেশের নাম বসিয়ে দেই তাহলে একটু গভীরে যেয়ে দেখতে পাবো আবুরিরিয়ার সঙ্গে খুব বেশি পার্থক্য এখানে নেই। তার অন্যান্য উপন্যাস পেটেলস্ অফ ব্লাড, উইপ নট চাইল্ড, দ্যা রিভার বিটউইন, দ্যা গ্রেইন অফ উইট এবং নাটক দ্যা ব্ল্যাক হারমিট, দ্যা ট্রায়াল অফ দিদান কুমাথি সহ অন্য সব লেখা একই ভাবে বিশ্বসাহিত্যে সমাদৃত।

 

২০১০ সালের ৮ অক্টোবর, দ্যা গার্ডিয়ান পত্রিকায় বেশ দুঃখের সঙ্গে একটি খবর প্রকাশিত হয় আর তা হলো গুগির নোবেল না পাবার বিষয়টি। সেই বছর প্রায় সবাই ধরে নিয়েছিল সাহিত্যে নোবেল বিজয়ের মুকুটটি গুগির মাথায় পরানো হবে। কিন্তু ৭ অক্টোবরে যখন মারিও ভারগাস লিওসার নাম ঘোষণা করা হলো, তখন অনেকেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। ১৯৮৬ সালে সোয়েঙ্কা প্রথম আফ্রিকান অশ্বেতাঙ্গ সাহিত্যিক যিনি প্রথম নোবেলজয়ী হন। দ্যা গার্ডিয়ানে গুগির মাতৃভাষায় লেখার সাহসিকতাকে প্রশংসার সঙ্গে স্বাগত জানানো হয়। এবং আরও বলা হয় ১৯৮৮ সালে নাগিব মাহফুজ আরবি ভাষার লেখক হওয়া সত্ত্বেও তাকে নোবেল পুরস্কারে নোবেল কমিটি সম্মানিত করে। এটি যেমন একটি অর্থবহ কাজ, অর্থাৎ ইংরেজির দাপটের মাঝেও ভিন্ন ভাষা যে জায়গা করে নিতে পারে তার স্বীকৃতি, ঠিক তেমনি এবারের নোবেল গুগি ওয়া থিয়োঙ্গোকে প্রদান করা হলে আরো একবার সেই নজির স্থাপন করা যেতো। কিন্তু তা করা হয়নি। তবে গুগির লেখার ধার তাতে কমে যায়নি বরং আরও বেড়েছে।

 

ইতিহাস, মাতৃভাষা এবং নয়া ঔপনিবেশবাদ --প্রধানত এই তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গুগির বিদ্রোহী কলম আবর্তিত হয়ে উঠে। তার নাটক ‘দ্যা ব্ল্যাক হারমিট (১৯৬২)’ রচিত হয় কেনিয়ার জাতিগত সমস্যাকে কেন্দ্র করে। যেখানে নায়ক হারমিট জাতিগত গোঁড়ামির শিকার হওয়ায় শহরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। অপর আরেকটি নাটক ‘দ্যা ট্রায়াল অফ দেদান কুমাথি (১৯৭১)’ র নায়ক ঐতিহাসিক মাউ মাউ আন্দোলনের বাস্তব নায়ক। একজন প্রান্তিক নায়ক। যাকে সবাই ভুলে গিয়েছিল। কেননা কিমাথি তখন অতীত। গুগি তার অতীত ইতিহাস খুঁটে খুঁটে খুঁজে বের করলেন। নাটকে দেখা যায় ১৯৫৪ সালে সেই আন্দোলনে প্রতিনিধিত্ব করার কারণে কিমাথিকে দেশদ্রোহী আখ্যা দেয়া হয়। অতঃপর যথারীতি ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ‘দ্যা গ্রেইন অফ উইট (১৯৬৭)’ উপন্যাসেও দেখা যায় আফ্রিকার জনগণ কিভাবে জমি থেকে উৎখাত হয় এবং কিভাবে তাদের জীবিকা ধর্ম ও উপজাতি সংস্কৃতির বিলুপ্তির ভয়ে ভীত হয়ে বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়। ‘পেটেলস্ অফ ব্লাড’ (১৯৭৭)’ আরেকটি অন্যতম সাড়া জাগানো উপন্যাস।

স্বাধীন কেনিয়ায় মাউ মাউ বিপ্লবীদের কোন স্থান ছিল না। কেনিয়া স্বাধীন হলে দেখা যায় শাসকদের শুধু গাত্র বর্ণ বদলেছে আর কিছু বদলায় নাই। ‘পেটেলস্ অফ ব্লাড’কে তাই বলা হয় স্বাধীন কেনিয়ার দুর্নীতির মহাকাব্য। এটা গুগির ইংরেজিতে লেখা শেষতম উপন্যাস। তারপরেই তিনি তার মাতৃভাষা ‘গুকুইউ’ ভাষার দিকে মনোনিবেশ করেন। কাজটা শুরুতে তার জন্যে খুব সহজ ছিল না। কেননা গুকুইউ ভাষায় কোন লেখা বা উপন্যাস পড়ার মতো মানুষ কেনিয়ায় তখন খুব বেশি ছিল না। তাছাড়া বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষাপটে এই ভাষায় উপন্যাস পড়ার সংখ্যাধিক্যের প্রশ্নই উঠে না। তবে নাইজিরিয়ার কবি এবং সাহিত্যিক গ্যাবব্রিয়েল ওকারা ইংরেজি ভাষার ক্ষেত্রে যেমন বলেছিলেন ‘জীবন্ত ভাষা যে কোনো জীবের মতোই ক্রমাগত বাড়তে থাকে’, ঠিক তেমনিভাবে গুকুইউ ভাষার ক্ষেত্রেও দেখা যায় একই নিয়মে পড়ুয়ার সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটেছিল। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের মধ্যে। গুকুইউ ভাষায় প্রকাশিত গুগির প্রথম উপন্যাস ‘ক্রুশের উপর শয়তান’ প্রকাশিত হবার পর, সে সম্পর্কে ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতার বিস্তারিত বর্ণনা তার ‘ডিকলোনাইজিং দ্যা মাইন্ড’ বইয়ে পাওয়া যায়:

 

“পারিবারিক পর্যায়ে পড়া হতো উপন্যাসটি। পরিবারের সবাই সন্ধ্যার সময় এক সঙ্গে বসতেন উপন্যাস পাঠ শোনার জন্যে। পরিবারের যারা পড়ালেখা জানতেন তাদের মধ্যে একজন উপস্থিত সবাইকে পড়ে শোনাতেন। শ্রমজীবী মানুষেরাও তাদের কর্মস্থলে দলবব্ধ হয়ে পড়তেন। পড়া হতো বাসে, ট্যাক্সিতে এমনকি পানশালাতেও।--- উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮০র এপ্রিলে এবং ডিসেম্বরের মধ্যে মোট পনের হাজার কপি ছাপা হয়েছিল। এতো অল্প সময়ে কেনিয়াতে কোনো ইংরেজি উপন্যাসেরও এতটা ভালো ফল পাওয়া যায় নাই কখনো। প্রকাশকেরা জানান এখনও বছরে এক হাজার কপি বিক্রি হয়ে থাকে।”

শুধু তাই না তার এই উদ্যোগে সাড়া দিয়ে পরবর্তীতে কেনিয়ার আরও লেখক গুকুইউ ভাষায় লেখা শুরু করেন। অথচ গুগির আগে কেনিয়ায় তাদের মাতৃভাষায় লেখার সাহস কেউ কখনও করেনি।

একই বইয়ে নগুগি লিখছেন, ‘প্রত্যেক ভাষারই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি থাকে। মানসিক বৃদ্ধি, প্রক্রিয়া এবং মূল্যবোধ বিচারের ক্ষমতা তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে এই ভিত্তি’। শুধু তাই না গুগি আরও মনে করেন মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক তা সংস্কৃতি বিকাশের ভিত্তি হিসেবেও কাজ করে। আর এই সম্পর্ক দাঁড়িয়ে থাকে মানুষের মূল্যবোধের ওপর। মানুষের আদর্শ, অভ্যাস, মনোভাব, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ইত্যাদি প্রজন্মের পর প্রজন্মে হস্তান্তরিত হবার পর সেই মূল্যবোধ গড়ে ওঠে। পরবর্তী প্রজন্ম তাদের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, সুন্দর বা কুৎসিত, কিম্বা সাহসী বা কাপুরুষচিত ইত্যাদি নির্ধারিত হয়ে থাকে মূল্যবোধের পরম্পরায়। এসব মূল্যবোধই পরবর্তীতে সংস্কৃতি এবং ইতিহাস সৃষ্টি করে থাকে। সংস্কৃতি বলতে গুগি ন্যায়নীতি, নন্দনতাত্ত্বিক মূল্যবোধ এবং আত্মিক চশমার বিমূর্ত রূপকেই বুঝিয়েছেন। এই আত্মিক চশমার স্বচ্ছতা খোঁজার প্রয়াসেই তার সন্ধান নিয়ত আবর্তিত হয় নয়া উপনিবেশবাদের দিকে। কেননা ঔপ্নিবেশিক আগ্রাসন যতটা সরাসরি প্রত্যক্ষ করা যায় নয়া-উপনিবেশবাদে সেই প্রত্যক্ষের উপস্থিতি থাকে পরোক্ষ ভাবে, দৃষ্টির আড়ালে। অস্বচ্ছ কাঁচের ভেতর দিয়ে স্বচ্ছতার প্রদর্শন করা হয়। ‘বিশ্বায়ন’ বলতে যেমন আপাতদৃষ্টিতে গোটা বিশ্বকে বোঝানো হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে তা আসলে গুটিকয়েক দেশের বিশ্বায়ন, ঠিক তেমনি ভাবে নয়া-উপনিবেশিক আগ্রাসনের উপরিকাঠামো এবং অন্তরকাঠামোর মাঝে থাকে বিস্তর পার্থক্য। নব্য-উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরে গুগি তাই বলেন, “যে সমাজে আমার সুস্থতা অন্যের কুষ্ঠরোগের উপর নির্ভরশীল নয়; আমার পরিচ্ছন্নতা অন্যের কীটপতঙ্গভরা শরীরের উপর নির্ভরশীল নয় এবং আমার মানবতা অন্যের দাফন হয়ে যাওয়া মানবতার উপর নির্ভর করে না, সেই সমাজের জন্য যে সংগ্রাম সেই সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলো শিল্প-সাহিত্য” ( ডিকলোনাইজিং দ্যা মাইন্ড)। কৃষকপরিবারে জন্ম নেয়া গুগি তার ছোটবেলায় গুকুইউ ভাষায় শোনা দেশীয় গল্পগুলো থেকে শিখেছিলেন আপাতদৃষ্টিতে কেউ দুর্বল হলেও বুদ্ধিতে যে বলবানের বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পারে সে-ই প্রকৃত বলবান। দেশীয় জীবজন্তুর বর্ণনা দিয়ে সাজানো হতো সেসব গল্প। তারপর উপনিবেশ অধিকৃত স্কুলে ভর্তি হবার পর থেকে ধীরে ধীরে সেসব গল্পের স্থলে আসতে লাগলো অন্য গল্প। যেসব গল্পে আফ্রিকানদের শুধু বোকা, গাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। ঘরের ভাষা থেকে শিক্ষার ভাষার বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে সঙ্গে নিজের সঙ্গে নিজের বিচ্ছেদ ঘটতে শুরু করলো। যে বিচ্ছেদের রেশ উপনিবেশের স্থলে নয়া-উপনিবেশের সময়েও দূর হলো না। ১৯৮১ সালে ‘ডিটেইন্ড: আ রাইটার্স প্রিজন ডায়েরি’ তে গুগি নয়া উপনিবেশের মুৎসুদ্দি শাসকশ্রেণীকে একজন বেশ্যার দালালের সঙ্গে তুলনা করেছেন; যে দালাল তার মাকে পর্যন্ত নির্মমভাবে ধর্ষিতা হবার জন্যে বিদেশীদের হাতে তুলে দিতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করে না। তারপর একমুঠো ডলার হাতে নিয়ে সেই দালাল বলে ওঠে ‘দেখো ডলারগুলো কি চকচকে’। এসব শাসকের হয়ে যারা সাহিত্য রচনা করে তাদের গুগি আখ্যায়িত করেছেন দালাল সাহিত্যিক বলে। আগে তাদের সাহিত্যে যে গ্রামীণ প্রবাদ, প্রবচন, কাহিনী, ধাঁধা, উপকথা পাওয়া যেত তা যেন এসব দালাল সাহিত্যিকদের হাত ধরে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গেলো। তার স্থলে সাহিত্য হয়ে উঠলো সমালোচনামুখর, নৈরাশ্যবাদী, চিরবিষন্ন, সাধারণ মানুষের বাস্তব গল্প থেকে চিরবিচ্ছিন। গুগি তাই দুঃখ করে বলেন, আফ্রিকার সবচেয়ে সংখ্যালঘু ভাষাতেও খ্রিস্টানদের বাইবেল পাওয়া যায় অথচ মাতৃভাষায় খুব বেশি সাহিত্য রচিত হতে দেখা যায় না। নয়া উপনিবেশের এসব নয়া শাসকদের প্রতি গুগি এতোটাই বিরক্ত যে ২০০৪ সালের আগষ্টে তেলেগু কবি ও সাংবাদিক অফসরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তার মাতিগারি উপন্যাসের প্রসঙ্গে বলেন, “পুলিশের থেকে বড় কমেডিয়ান কেউ হয় না। কেনিয়ায়, ইন্ডিয়ায়, পাকিস্তানে --- সব দেশে! সরকারযন্ত্র-পুলিশতন্ত্র দেখতে একই রকমের। সত্যিই এসব দেশে বাইরের জনসংখ্যার চেয়ে জেলের জনসংখ্যা বেশি। এই জেলগুলোকে এক করলে নিজেই একটা দেশ হয়ে যায়। আচ্ছা ধরেন, দেশের জনসংখ্যার চেয়ে জেলের জনসংখ্যা যদি বেড় যায়, তাহলে ‘নেশান’ এর অর্থই বদলে যায়”।

গুগি তাই অন্য সব ধরণের মৌলবাদের চেয়ে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারজাত মৌলবাদ, পুঁজিবাদী মৌলবাদকে অধিকতর ভয়াবহ মনে করেন, কেননা এসব মৌলবাদে ‘অর্থ’, ‘বাজার’ নামক ঈশ্বরের বসবাস। যে ঈশ্বর ক্ষমাহীন দৃষ্টিতে ধনীর দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাখে, দরিদ্রদের রাখেন দৃষ্টিসীমানার বাইরে। নয়া উপনিবেশবাদ নিয়ে গুগির তাই এতো শঙ্কা আর ভয়। এই শঙ্কা আর ভয় থেকেই আরো প্রতিবাদী হয়ে ওঠে তার নাটক, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ । অন্য দিকে সেসব যারা পাঠ করেন অর্থাৎ পাঠক, তারা হয়ে ওঠে সাহসী।

গুগি ওয়া থিয়োঙ্গো পাঠ আমাদের জন্যে অত্যন্ত জরুরী এই কারণেই ।

(প্রথম অংশ এই লিঙ্কে পড়ুন, ১. গুগি ওয়া থিয়োঙ্গো: নয়া-উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সাহিত্য

 

 

 

 

 

 

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।