কৃষক কন্যা নারী শ্রমিক: অর্থনৈতিক ও শ্রেণী বৈষম্য থেকে বেরুতে পারে নি


আজকের আন্তর্জাতিক নারী দিবস শ্রমিক নারীর সংগ্রামের ফসল। লাল সালাম। আজ নারী অনেক এগিয়েছে, সমাজের সর্ব স্তরে নারীকে দেখা যাচ্ছে; তারা সবাই মিলে পালন করছেন মার্চের ৮ তারিখ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিনটি একসময় ছিল শুধু নারী সংগঠনের এবং নারী শ্রমিক সংগঠনের নিজস্ব পালনের দিন। এখন তা হয় রাষ্ট্রীয় ভাবে, যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থাকেন এবং বক্তৃতা করেন। জাতিসংঘ ঘোষিত দিনের মধ্যে অন্যতম প্রধান দিন ৮ই মার্চ। বেগুনি শাড়ী বা বেগুনি পোষাক পরবার, নারীদের পরস্পরের প্রতি সংহতি প্রকাশের দিন।

কিন্তু এর ইতিহাস কতজন মনে রাখি? মনে হয় সকলের আর মনে রাখার প্রয়োজন হয় না, কারণ নারী দিবস এখন ‘বুর্জোয়া’ নারীদের ‘মুক্তি’ বা ‘স্বাধীনতা’র ধারণায় আচ্ছন্ন। অর্থাৎ নারী দিবস সামাজিক সম্পর্ক বা পারস্পরিক দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত বিমূর্ত নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মধ্যবিত্ত নারীদের জন্যেই বিশেষভাবে পালনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘নারী’কে স্রেফ বায়োলজিতে পর্যবসিত করে, দেশকালপাত্র ভেদে নারীর সঙ্গে অন্য নারীর শ্রেণিগত ফারাক এবং সামাজিক-ঐতিহাসিক পার্থক্য বেমালুম গায়েব করে দিয়ে ‘নারী’ নামক এক অভিন্ন বা ইউনিফর্ম ক্যাটেগরি তৈরি হয়েছে। এর ফলে বিমূর্ত ‘নারী’ নামক ধারণা বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বিভিন্ন নারীর সংগ্রামের পার্থক্যকেই মূলত অস্বীকার করা হয়। শ্রমিক নারী আর মধ্যবিত্ত ‘বুর্জোয়া’ নারী এক না। বুর্জোয়া নারীদের নারী স্বাধীনতার ধারণা পোশাক কারখানায় যে মেয়েরা পুড়ে মরে কিম্বা বিল্ডিং ধসে যাদের জীবন্ত কবর হয় তাদের কাছে তামাশা ছাড়া আর কিছু না। সস্তা দামে কারখানায় নিজেদের বিক্রি করে দিয়ে জীবনের কিছুই যাদের আর অবশিষ্ট থাকে না, তাদের কাছে নারী প্রশ্ন পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের বিরুদ্ধে লড়াই। পুরুষতন্ত্রও তার কাছে সমস্যা, কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক শোষণ থেকে পুরুষতন্ত্রকে আলাদা করা যায় না। কৃষকের কন্যা আর পোষাক কারখানার শ্রমিকও একই নারী নয়। তাদের জীবন, যাপন এবং বাস্তব সমস্যা ও লড়াই আলাদা। তাহলে এটা পরিষ্কার থাকা দরকার যে একাট্টা ‘নারী’ নামক কোন ক্যাটাগরি নাই। এই ধরনের বিমূর্ত ক্যাটাগরি সামাজিক-ঐতিহাসিক বিভিন্ন অবস্থান থেকে নারীর ভিন্ন সংগ্রাম এবং তার তাৎপর্যের ইতিহাসকে আড়াল করে বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত নারীর বাসনাকেই সকল নারীর বাসনা হিশাবে হাজির করবার চেষ্টা রয়েছে। নারী দিবসে সেটা সটান সামনে চলে আসে। এটা বাস্তব ইতিহাসের পথ থেকে সরে যাওয়া। তাই নারী দিবসে সবার আগে মনে রাখা দরকার মধ্যবিত্ত নারীদের আন্দোলন কিম্বা তাদের নারী স্বাধীনতার ধারণা থেকে নারী দিবসের উৎপত্তি হয় নি। কারখানার নারীশ্রমিক যেভাবে তাদের প্রতি অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল, মধ্যবিত্ত নারীদের সেভাবে নামতে হয় নি। কিন্তু এখন সেই আন্দোলনের সুবিধাটুকু তারা নিচ্ছে। এতে কোন দোষ নাই। কিন্তু ভুলে যাওয়াটা অপরাধ। বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত নারীর আন্দোলনও ঐতিহাসিক বাস্তবতা। নারীকে তাই নারীর প্রশ্ন সামগ্রিক ভাবে বিচার করতে শিখতে হবে। এটাই হবে নারী দিবসে নারীর জন্য সঠিক বার্তা।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমেই নারী শ্রমিকের দাবী পুরণের জন্য আবির্ভুত হয়েছে। উনিশ শতকের শেষ কয়টি বছর এবং বিশ শতকের প্রথম কয়েক বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে শ্রমিক নারীদের দাবী প্রতিষ্ঠার লড়াই, এই দিবস ঘোষণার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। মার্চের ৮ তারিখ নির্দিষ্টভাবে বেছে নেয়ার কারণ পর পর কয়েক বছরের আন্দোলনের ঘটনা একই তারিখে, অর্থাৎ ৮ মার্চ, ঘটেছিল। যেমন ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ তারিখে ন্যূইয়র্ক সুঁই কারখানার মহিলা শ্রমিকরা অমানবিক কাজের পরিবেশ, নিম্ন মজুরি এবং দৈনিক ১২ ঘন্টা খাটুনির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মিছিল করেছিলেন। তাদের শান্তিপূর্ণ মিছিল পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বহু মহিলা আহত হন, অনেককে পুলিশ গ্রেফতার করে। এর তিন বছর পর ১৮৬০ সালের ৮ মার্চ সুঁই কারখানার মহিলা শ্রমিকরা তাদের নিজস্ব ইউনিয়ন গঠন করতে সক্ষম হন। এটা তাদের আন্দোলনের অগ্রগতি। এই আন্দোলনের জের হিশাবে ১৯০৮ সালে ন্যুইয়র্ক শহরে আবার মার্চের ৮ তারিখে ন্যূইয়র্ক শহরে নারী শ্রমিকদের একটি মিছিল বের হয়। তাদের দাবি ছিল কাজের ঘন্টা কমানো, মানবেতর কাজের পরিবেশের উন্নতি, শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে আইন এবং ভোট দেবার অধিকার। লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, নারী শ্রমিক আন্দোলনে যারা ছিলেন তাঁরা মার্চের ৮ তারিখের ঘটনা মিলে যাওয়াকে ইতিহাসের দিক থেকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য এই কাজটি করেছিলেন সেই সময়ের সমাজতান্ত্রিক নারী সংগঠন সমূহ। [দেখুন, ৮ই মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস, নারী গ্রন্থ প্রবর্তনা, ২০০৪]

আরও দেখতে হবে যে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন শ্রমিক আন্দোলনে, (বেশিরভাগ পুরুষ শ্রমিক) ১৮৬০ সালে মজুরি না কমিয়ে কাজের ঘন্টা কমানোর দাবি তুলেছিলেন; এবং ১৮৮৬ পয়লা মে তারিখে শ্রমিক আন্দোলন ৮ ঘন্টা কাজের ঘন্টা নির্ণয়ের আইনী ভিত্তি তৈরি করে। যা পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে শ্রমিক দিবস বা মে দিবস হিশেবে পালিত হচ্ছে। কাজেই ৮ই মার্চের ইতিহাস এবং ১লা মে দিবসের ইতিহাস ভিন্ন নয়, এবং নারী শ্রমিকের আন্দোলন আর পুরুষ শ্রমিকের আন্দোলন ঐতিহাসিক ভাবে প্রায় সমান্তরালভাবেই এগিয়েছে।

মার্চের ৮ তারিখকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে সেই সময়ের অর্থাৎ বিংশ শতাব্দির শুরুতে রাশিয়া, আমেরিকা ও ইওরোপের সমাজতান্ত্রিক দলগুলো্র নেতৃত্বে, যেমন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানী, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া সবখানে নারী শ্রমিকরা আন্দোলন করেছে। এবং সেই যুগে ইন্টারনেট না থাকলেও তাদের পরস্পরের মধ্যে যথেষ্ট যোগাযোগ ছিল। শেষ পর্যন্ত ১৯১০ সালে ডেনমার্কে অনুষ্ঠিত ১৭টি দেশের ১০০ জন সমাজতান্ত্রিক নারীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা সেৎকীন মার্চের ৮ তারিখকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের ডাক দেন। দাবী ছিল শ্রমিকের অধিকার এবং নারীদের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা।

ভোটের অধিকার

বিংশ শতাব্দি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে নারীদের ভোট দেয়ার অধিকার ছিল না। ইংল্যান্ডে উনিশ শতকে ভোটের অধিকার বলতে কেবল সম্পত্তির মালিক পুরুষরাই ভোট দিতে পারতেন। নারীদের মধ্যে ভোটের অধিকারের দাবি ওঠে সম্পত্তি আছে এমন ধনি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীদের মধ্যেই। সম্পত্তিবান নারীদের নিজেদের জন্যে। অন্যদিকে শ্রমিক নারীরা সকল নারীর, জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণী নির্বিশেষে নারী ও পুরুষদের ভোটের অধিকারের দাবি তোলেন এবং ১৯০৭ সালে জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে সমাজতান্ত্রিক নারীদের সম্মেলনে এই দাবি উত্থাপন করেন।

ইওরোপ ও অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের নারীরা ভোটের অধিকার অনেক আগেই পেয়েছেন, ব্রিটিশ রাজত্ব শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। বঙ্গ প্রদেশে (পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গ) নারীদের ভোটের অধিকার স্বীকৃত হয় ১৯৪৭ সালেই। এ অধিকার সেই সময়ের নারীদের আন্দোলনের কারণেই পেয়েছেন। ১৯২১ সালে প্রাদেশিক সংসদে নারীদের ভোটের অধিকারের প্রস্তাব নাকচ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু নারী নেত্রীরা ভোটের অধিকারকে দেশ গড়ার কাজে অবদান রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে এ দাবিতে অটল থাকেন। ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট ১৯৩৫-এ নারীদের আলাদা ভোট ও আলাদা আসন প্রস্তাব করে। নারী নেত্রীরা তা নাকচ করে দেন। শেষ পর্যন্ত নারী-পুরুষ সবার জন্য ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৭ সালে। বাংলাদেশের নারীরা প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে এবং পরে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবেই এ ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে পারছেন।

কেন নারী শ্রমিক আবির্ভুত হোল?

নারী শ্রমিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল উনিশ শতকের পশ্চিম ইওরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় শিল্প বিপ্লবের কারণে। যুক্ত রাষ্ট্রের নিউ ইংল্যান্ডের বস্ত্র কারখানায় ব্রিটিশ নিয়মে পুরো পরিবারকেই শ্রমিক হিশেবে নিয়োগ দেয়া হোত যার অধিকাংশই ছিল শিশু, যারা মূলত কার্ডিং এবং স্পিনিংয়ের কাজ করতো। অন্যদিকে হস্ত চালিত তাঁতেই কাপড় বোনা হোত। কিন্তু বস্ত্র কারখানায় বিদ্যুত চালিত পাওয়ার লুমের ব্যবহার একই ছাদের তলায় সব ধরণের কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করে, যা একই সাথে শ্রম প্রক্রিয়ার ধরণও পালটে দেয়। পাওয়ার এবং ড্রেসিং ফ্রেমের উচ্চতা শিশুদের নাগালে বাইরে ছিল। কাজেই গ্রাম থেকে যুবতী এবং অবিবাহিত মেয়ে বা সিঙ্গেল নারীদের নিয়ে আসা হোল বস্ত্র কারখানার শ্রমিক হিশেবে।

উনিশ শতকে মার্কিন দেশে গ্রামের কৃষি পরিবারের মেয়েদের শহরে এসে কাজ করার সুযোগ পেয়ে অনেক মেয়েই নিজের আগ্রহে ঢুকে পড়ে। কারণ বাণিজ্যিক কৃষির প্রবর্তনের কারণে কৃষি শ্রমের ধরণও পালটে যাচ্ছিল। যেসব নারী কারখানায় কাজের জন্যে শহরে আসে তাদের মধ্যে অনেকে বাধ্য হয়ে গ্রাম ছেড়েছিল কারণ কৃষি কাজে মজুরির তুলনায় কারখানার মজুরি বেশি ছিল। আবার কেউ কেউ সরাসরি অর্থনৈতিক চাপে না থাকলেও নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য, বিশেষ করে একটু স্বাবলম্বি হয়ে বিয়ে করার উদ্দেশ্যেও, মিল কারখানায় কাজ করতে শুরু করেন। গরিব, কালো ও অভিবাসি নারীদের কারখানায় কাজ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। মুলতঃ মার্কিন দেশে শিল্প কারখানায় যারা এসে যোগ দিয়েছিল তারা ছিল গ্রামের ‘কৃষকের কন্যা’।

ধরেই নেয়া যায় যে কারখানার মালিকদের জন্যে এই সময় নারী সস্তায় পাওয়া জরুরি ছিল; যার কোন অধিকার বোধ নেই, কাজের পরিবেশ ভাল-মন্দ বাছ-বিচারের সুযোগ নেই, তাদেরকেই শিল্প কারখানায় বিশেষ করে বস্ত্র মিলে নিয়োগ করা ছিল লাভজনক । এর সাথে বাংলাদেশের বিংশ শতাব্দির আশির দশকে রেডিমেড গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে মেয়েদের নিয়োগের পুরো মিল আছে। লাখে লাখে মেয়েরা গ্রামের গরিব কৃষকের ঘর থেকেই বেরিয়ে এসেছে, প্রথমে চট্টগ্রাম শহরে, পরে ঢাকায়। বাংলাদেশে যারা গার্মেন্ট শ্রমিক হিশেবে কাজ করছেন তাঁরাও গ্রামের কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংস হবার কারণে “অনাবশ্যক” ও বেকার হয়ে যাওয়া ‘কৃষকের কন্যা’।

যুক্তরাষ্ট্রে নারী মিল শ্রমিকদের কাজ সহজ ছিল না। তবুও হাজারে হাজারে মেয়েরা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে শ্রমিক হয়ে গেছে। গ্রামের মতো তাদের নিজেদের থাকার ঘর ছিল না, থাকতে হোত বোর্ডিং হাউজে, সেখানে তাদের ভাড়া দিতে হোত। একসময় বোর্ডিং হাউজের ভাড়া বেড়ে গেল, অথচ বেতন বাড়লো না, কাজের সময় ১২ ঘন্টা, তাদের বিশ্রাম ও অন্যান্য সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজের সুযোগ ছিল না। ফলে ক্ষোভ বাড়তে থাকলো। এক সময় এই কৃষক-কন্যারাই রাস্তায় নামলেন নিম্ন মুজুরি ও বারো ঘন্টা কাজের বিরুদ্ধে। নিউ ইংল্যান্ডে ১৮৪০ সালে Lowell Female Labor Reform Association এর আন্দোলন সংগঠিত রূপ নেয়, প্রায় ২৫০০ নারী প্রতিবাদে নেমে পড়ে, তাদের আন্দোলনকে ১০-ঘন্টা কাজের আন্দোলন (Lowell’s ten-hour movement) বলা হোত। এভাবে তারা একের পর এক বিভিন্ন ধরণের সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে ১৮৪৮ এ নিউ ইয়র্ক এবং ১৮৫১ সালে মাসাচুসেটস-এ তাদের নেত্রী মেরি এমারসন নারী আন্দোলন সম্মেলনে যুক্ত হয় এবং নারী শ্রমিক আন্দোলন নারী আন্দোলনের একটি অন্যতম প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে।

উনিশ শতকের শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে মার্কিন দেশে বস্ত্র শিল্পে নারী শ্রমিকের আধিক্য এই কারণে ছিল না যে নারীদের প্রতি সমাজ বেশি সদয় ছিল। বরং পুরুষের তুলনায় নারীকে অর্ধেক বেতনে নিয়োগ করার সু্যোগ নিয়েছিল শিল্পপতিরা। সেটাও সাদা নারীদের জন্যে নয়, বরং বৈষম্যই গড়ে উঠেছিল সাদা বনাম কালো শ্রমিক ও ইমিগ্রেন্ট শ্রমিকের বিরুদ্ধে। নারীদের মধ্যেই বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল, বর্ণবাদী ও শ্রণি আচরনের কারনে। কালোদের প্রতি বর্ণবাদী আচরণ এতো বেশি ছিল যে তাদের বোকা, ইডিয়ট ও চরিত্রহীন আখ্যা দিয়ে অন্য সাদা নারীদের চেয়েও কম বেতন দেয়া হোত; কোন কোন ক্ষেত্রে দেয়া হোত মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ। এই অন্যায় এবং বর্ণবাদী আচরণ কালো নারীদের প্রতিবাদী করে তোলে, দ্রুত তাদের সংগঠন গড়ে ওঠে। এতে যুক্ত হয় গরিব সাদা নারীদের একটি অংশ। তাঁরা দাসত্ব বিরোধি সংগঠন Anti-slavery movement গড়ে তোলেন ১৮৩২ সালে। দাস প্রথা বিরোধি আন্দোলনে সাদা শ্রমিক নারীরা সংহতি প্রকাশ করেন। প্রথম সফলতা আসে কাজের সময় কমানোতে। কাজের সময় ১২ ঘন্টা থেকে কমিয়ে ১০ ঘন্টা করা হয়।

নারীদের মধ্যে শ্রেণী বিভেদ

বাংলাদেশে এবং অন্যান্য দেশেও ‘কৃষকের কন্যা’ শ্রমিক হয়ে নারী আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক রূপ দিয়েছেন। কিন্তু তাদের প্রতি শ্রেণী বৈষম্য কমে নি। গরিব, মধ্যবিত্ত ও ধনি নারীর মধ্যে ফারাক বা তাদের শ্রেণীগত অবস্থানের পার্থক্য অনুযায়ী নারীর অবস্থানের পরিবর্তনের বিষয়টি কেমন সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে না।

শ্রেণীগতভাবে নারীদের মধ্যে অনেক বিভেদ আছে। নারীর ক্ষমতায়ন বললে সব নারীর ক্ষমতায়ন একই ভাবে হয় না। আন্তর্জাতিকভাবে নারী অধিকার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নারীর শ্রমের অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই ঘটেছে। নারী আন্দোলনের ইতিহাস তার স্বাক্ষ্য দেবে। তবে ‘নারীবাদী’ হওয়ার সাথে শ্রমিক নারীর অধিকার সব সময় গুরুত্ব পায় নি। শ্রমিক নারীর পক্ষে বলার কাজ যেন শ্রমিক নারী সংগঠনের, নারী আন্দোলনের নয়। তার একটি কারণ হচ্ছে নারীবাদী আন্দোলন বা ফেমিনিজম নিয়ে যারা কাজ করেছেন তাঁরা নিজেরা শ্রেণীগতভাবে শ্রমিকের পর্যায়ে পড়েন না। তাঁরা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কিংবা বর্ণের দিক থেকেও শ্রমিক নারী থেকে ভিন্ন। তাঁরা ‘কৃষকের কন্যা’ নন, গ্রাম থেকে উৎখাত হয়েও আসেন নি। যুক্তরাষ্ট্রে এই পার্থক্য বোঝা গেছে সাদা ও মধ্যবিত্ত নারী বনাম কালো ও শ্রমজীবী নারীদের দাবী-দাওয়া ও সংগ্রামের ধরণের পার্থক্য দেখে। তবে নিঃসন্দেহে ফেমিনিজমের অবদান আছে নারীর ব্যাক্তি অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, যার সুফল নারী শ্রমিকও নিতে পারছে। কিন্তু ক্রূর সত্য এই যে নারী শ্রমিকের অধিকারের বিষয়টি এখনও মুল স্রোতের নারী আন্দোলনের অংশ নয়। সেখানে বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত নারীদেরই আধিপত্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দুঃখজনকভাবে এটাই সত্যি।

বাংলাদেশে নারী মুক্তির চিন্তা চেতনায় বেগম রোকেয়াও নারীকে পুরোপুরি শ্রমিক হিসেবে দেখেন নি; তিনি দেখেছেন সার্বিক বঞ্চনার, স্ত্রীজাতির অবনতি এবং সেখান থেকে মুক্তির জন্যে নারীকে প্রস্তুত করবার জায়গা থেকে। নারী মুক্তির জন্যে নারীকে কেরানি হোক বা জজ ব্যারিস্টার হোক, কিছু একটা হওয়ার স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছেন। বর্তমানে নারীরা সেই কাজটি করছেন সফলভাবেই। সার্বিকভাবে নারীকে কর্মক্ষেত্রে আনার বিষয়টি রোকেয়া কখনোই ভুলে যান নি। সেদিক থেকে বলবো পশ্চিমা নারীবাদের তুলনায় বেগম রোকেয়ার চিন্তা সেই সময়ের প্রেক্ষিতে অগ্রসর ছিল। অবশ্য বেগম রোকেয়ার সময়কালেই বিভিন্ন দেশে ‘সুঁচ কারখানার’ বা পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকরা আট ঘন্টা কাজের দাবীতে রাস্তায় নেমেছিলেন। বাংলাদেশে তখন সেই পরিবেশ ছিল না, কিন্তু নারীদের অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণে বৈষম্য ও স্বীকৃতি না পাওয়া, নারীর ঠিকানাহীন হয়ে যাওয়া এসবই ‘পদ্মরাগ’-এর মতো রচনায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি শ্রেণীর কথা আলাদাভাবে বলেন নি। তবে সকল শ্রেণীর নারীর দুঃখ কষ্ট সম্পর্কে রোকেয়ার সংবেদনা আমাদের সকলেরই জানা।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস জাতি সংঘের ঘোষণায় আসার পর থেকে এই দিবসটি সরকার এবং নারী উন্নয়নে নিয়োজিত এনজিওদের মধ্যে প্রচুর আগ্রহ বাড়ায়। লক্ষ্যণীয় যে ১৯৯৬ সাল থেকে যেসব প্রতিপাদ্য জাতিসংঘ ঠিক করে দিয়েছে তার মধ্যে কোন একটিতেও শ্রমিকদের অধিকারের কথা বিন্দুমাত্র উল্লেখ নাই। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। যেমন নারী ও শান্তি (১৯৯৭), নারী ও মানবাধিকার (১৯৯৯), সংঘাত নিরসনে নারী (২০০১), আফগান নারীর বাস্তবতা ও সম্ভাবনা (২০০২), নারীর সমতা ও এমডিজি (২০০৩), নারী ও এইডস (২০০৪), নারী ও সিদ্ধান্তগ্রহণ (২০০৬) গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র ও ক্ষুধা নিরসন (২০১২), ইত্যাদী। খুবই বিস্ময়কর বৈকি!

নারীদের শ্রেণী প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে আসতে হলে আন্তর্জাতিক নারী দিবস খুব ভাল একটি উপলক্ষ্য। বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক নারী আন্দোলন আছে, কিন্তু মুল ধারার আন্দোলনে তারা আলাদাভাবে তাদের মতাদর্শিক অবস্থান পরিস্কার করতে পারছেন না। আমাদের সমাজের পুঁজিতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটছে দ্রুত। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ নারীকে যতোটুকু প্রয়োজন শুধু ততটুকুই ব্যবহার করছে, বিশেষ করে সস্তাশ্রম হিশেবে তাদের কদর খুব বেশী। অথচ শ্রমজীবী নারী যখন বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় মজুরি এবং কারখানায় কাজের নিরাপত্তা চাইছে, কিম্বা নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ করার বিরোধিতা করছে, তাদের কথার কোন গুরুত্ব দেয়া হয়না। পুঁজিতন্ত্রের ধর্মই হচ্ছে শ্রম শোষণ করা এবং সেটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনি দেশও নারীদের সমমুজুরী নিশ্চিত করতে পারেনি, বরং নারী শ্রম শোষণ তাদের অর্থনীতির চরিত্রের মধ্যেই রয়েছে।

নারী আন্দোলন করতে গিয়ে আমরা কি পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার রূপান্তর চাই, নাকি এই অসম ও শোষণমূলক সম্পর্কের অধীন থেকে মুড়ি-মুড়কির ভাগের জন্য বিমূর্ত ভাবে শুধু বায়লজিকাল নারীর কথা বলবো? পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীর শোষণের অবস্থার এতে কোন হেরফের হবে না। পুরুষতান্ত্রিক ও পুঁজিতান্ত্রিক শোষন এক সূত্রে গাঁথা এবং নারীর জন্য তা নির্মম ও নিষ্ঠুর হয়েই হাজির হয়। পুঁজিতান্ত্রিক শোষণের কথা বাদ দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক অত্যাচারের বিরোধিতা যেমন খেটে খাওয়া শ্রমিক নারী কিম্বা কৃষকের কন্যার সঙ্গে প্রতারণা, তেমনি পুঁজিতান্ত্রিক শোষণের বিরোধিতা করতে গিয়ে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে না দাঁড়ানোর অর্থ নারীকে ক্ষমতাহীন করে রাখার হাজার বছরের ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার মধ্যে কোন পরিবর্তন না এনে উচ্চ পর্যায়ে বসিয়ে দিলেই নারীদের অবস্থার কোন পরিবর্তন আসবে না। সমাজের অংশ হিসেবে নারীদের মধ্যেও শ্রেণী বিভাজন আছে। তাই উচ্চ ও মধ্যবিত্ত নারীরা যখন (তাদের ভাষায়) গরিব, অশিক্ষিত, অসুস্থ, সাংস্কৃতিকভাবে অনগ্রসর নারীদের প্রতিনিধিত্ব করেন তখন তাদের ভাষায় অসম শ্রেনীগত অবস্থান ফুটে ওঠে। কাজেই যে নারীবাদ পুঁজিতান্ত্রিক শোষণ কায়েম রেখে নারীর ক্ষমতায়ন চায় তারা মুলত নারীদের দ্বারা নারী শোষনের পথ তৈরি করছেন। আবার যারা শ্রম বাজারে আছেন এবং শুধুমাত্র মুজুরী বৃদ্ধির আন্দোলনে নিয়োজিত আছেন তাদের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসতে দেরী হবে কারণ তারাও অজান্তে পুঁজিতন্ত্রকে মেনে নিয়েছেন। তাদের আন্দোলন ট্রেড ইউনিয়নের বেশী কিছু নয়। পুঁজির সুবিধার জন্যে নারীকে সামনে নিয়ে আসার যে নীতি তা নারীর পক্ষের নয়। এই সত্য আমাদের উপলদ্ধি করতে হবে।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।