চলমান রাজনীতির ইতিবাচক উপাদান।


এক

এই লেখা যখন লিখছি তখন হেফাজতের হরতাল চলছে। হেফাজতে ইসলাম ২৮ মার্চ রোববার জানিয়েছে ইতোমধ্যে শহিদ হয়েছেন ১৭ জন এবং কমপক্ষে ৫০০ জন আহত হয়েছেন। পুলিশ ও ছাত্রলীগ, অর্থাৎ রাষ্ট্র ও দলের যৌথ সহিংসতা এবং হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের ক্ষোভও তীব্র হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি একটা নতুন কালপর্বে প্রবেশ করেছে এবং সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক পরিসরের বেশ কিছু গুণগত রূপান্তর ঘটে গিয়েছে। সেই বিষয়ে এবং এর সম্ভাব্য পরিণতি কি হতে পারে তা নিয়েই এই লেখা। আগামি দিনে পরিণতে কি দাঁড়াবে আমি জানি না। তবে সমাজ, ইতিহাস এবং রাজনীতির অভিজ্ঞতার আলোকে কয়েকটি কথা আজ বলব।

বলা বাহুল্য রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সন্ত্রাসের বিপরীতে জনগণের প্রতিরোধের ধরণও সহিংস হবে। এই ক্ষেত্রে জনগণের পাল্টা প্রতিরোধ সাধারণত হয় বিচ্ছিন্ন এবং অগোছালো। অনেকে জেনে, না জেনে কিম্বা অন্যের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে কিম্বা সাময়িক উত্তেজনাবশে হঠকারি হয়ে উঠতে পারে। এতে আন্দোলনের ন্যায্যতা ক্ষুণ্ণ হবে। তরুণদের অনেকে বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। ধরতে পারেন না। ফলে তাদের ন্যায্য ক্ষোভ যদি অপরিণামদর্শী সহিংসতা কিম্বা অ-মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি হুমকির কারণ হয় আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক শক্তি সেটাকেই সূত্র ধরে আরো চরম রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও সন্ত্রাস দিয়ে জনগণকে দমন নিপীড়ন করবে। সেই নিপীড়নের শিকার হবে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ। বিশেষ ভাবে মাদ্রাসার টুপি-কোর্তা পরা তালেবে এলেম বা শিক্ষার্থী।

প্রথমে বুঝতে হবে মাদ্রাসা পড়ুয়া হোক কিম্বা না হোক তরুণরাই বাংলাদেশের আগামি রাজনীতির নির্ধারক।  মাদ্রাসার ছাত্ররা সাম্প্রতিক সময়ে দৃশ্যমান। কিন্তু নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা যে তরুণদের দেখেছি আগামি রাজনীতিতে তাদের শক্তিশালী ভূমিকা ক্রমে ক্রমে আরও স্পষ্ট হবে  বলে আমি মনে করি। ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনে মধ্য দিয়ে নারী আন্দোলনের নতুন পুনর্গঠনের সম্ভাবনাও আমরা দেখছি। বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ বাংলাদেশের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়, সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার ও অন্যান্য বৈষম্য দূরীকরণের উদ্দ্যেশ্যে ২০১৮তে প্রতিষ্ঠিত হয়।  এতে তরুণদের গণতান্ত্রিক শক্তি কয়েক কদম এগিয়ে গিয়েছে। এই নতুন গণতান্ত্রিক শক্তির চরিত্র গণতন্ত্র সম্পর্কে এলিট ও সেকুলারদের ক্লিশে ধারণা থেকে আলাদা। এটা বোঝা যায় তরুণদের সাম্প্রতিক আন্দোলনে তথাকথিত ডান এবং বাম কিম্বা প্রগতি বনাম প্রতিক্রিয়াশিল জাতীয় বাইনারি কম। নাই বললেই চলে। কয়েকটি চেনা গণমাধ্যম তরুণ নেতাদের জামাত-শিবির আখ্যা দিয়ে তাদের ম্লান করে দেবার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। তাতে কাজ হয় নি। এরপর তারা তাদের চরিত্র হনন করে তরুণদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন নস্যাৎ করে দিতে চেয়েছে। তাতেও কাজ হয় নি।  অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিপরীতে জনগণের বৃহত্তর ঐক্যের গুরুত্ব আগের চেয়েও অনেক পরিষ্কার। বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হোল যাদের ইসলামপন্থি ও প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দিয়ে এতোকাল গণতান্ত্রিক লড়াই থেকে বাদ রাখার চল ছিল, সেই চরম গণবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক ধারার বিপরীতে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র বিরোধী গণঐক্যের সম্ভাবনা আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হয়েছে।

মাদ্রাসা কেন্দ্রিক এবং মাদ্রাসার বাইরে নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশে আসার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একটা স্বতঃস্ফূর্ত চরিত্র আমরা লক্ষ্য করেছি। বিশেষত মাদ্রাসা ও মসজিদ কেন্দ্রিক যে আন্দোলন ও প্রতিরোধ আমরা দেখেছে তার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততার উপাদান প্রবল ছিল।  মুসল্লি ও সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ এই প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করেছে, যাদেরকে হেফাজতে ইসলাম বলে চিহ্নিত করা কঠিন। নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশের আসার বিরুদ্ধে স্বতস্ফূর্ততার এই উপাদান খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

ইসলামপন্থি তরুনদের আবির্ভাব বাংলাদেশের রাজনীতিতে সম্পূর্ণ নতুন কর্তাসত্তার আবির্ভাবও বটে। রাজনৈতিক ভাবে এই কর্তাসত্তা বা এজেন্সির ছবি এখনও পুরাপুরি স্পষ্ট নয়। কিন্তু এদেরকে পত্রপত্রিকায় ‘হেফাজতে ইসলাম’ বলেই একাট্টা ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে। সেভাবেই আমরা এই নতুন শক্তির আবির্ভাবকে চিনতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি, কিন্তু তরুণ আলেম ও তালেবে এলেমদের মহলে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের দালাল নেতারা কমবেশী চিহ্নিত। হেফাজতের মধ্যে রাষ্ট্র এবং ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক আধিপত্য ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছে।

একদিক থেকে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে ইসলামপন্থিদের আন্দোলনকে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন বলা ভুল নয়। কারন এখনও নতুন রাজনৈতিক কর্তাসত্তা নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে দাঁড়ায়নি। কৌশল্গত কারনে সেটা ঠিকও নয়। তাই 'মুরুব্বি'দের বাদ দিয়ে নিজেদের ভিন্ন ভাবে সংগঠিত করবার সময় তরুণদের আসে নি। মুরব্বিরা তাদের স্বার্থে তরুণদের জিহাদি চেতনাকে পানশে করে দেবার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তরুণরা বাধা ভেঙে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।  তরুণদের সুবিধা হচ্ছে এই যে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ হেফাজতে ইসলামকে বাংলাদেশের মুসলমানদের সাধারণ স্বার্থের একচ্ছত্র প্রতিনিধি গণ্য করে। প্রতিনিধিত্বের সৌভাগ্য থেকে জামায়াতে ইসলামি তাদের একাত্তরের ভূমিকার জন্য দৃশ্যত কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না। কিন্তু ইসলামের মতাদর্শিক ছায়ার বড় ছাতার তলায় তাদের ভূমিকা আছে এবং থাকবে। ইসলামপন্থিরা একাটা কোন রাজনৈতিক ধারা না।  হেফাজতে ইসলামএর মধ্যেও নানান ধারা, স্রোত ও গুরুত্বপূর্ণ তর্ক বিতর্ক আছে। বাঙালি জাতিবাদী বা হিন্দুত্ববাদী ন্যারেটিভ দিয়ে জামাত কিম্বা ইসলামি ছাত্র শিবিরকে এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি না। তাদের সাংগঠনিক শক্তি ও অভিজ্ঞতার কারণে বাংলাদেশে ইসলামি আন্দোলনে তাদের শক্তিশালী ভূমিকা থাকবে। ইসলামপন্থিদের মধ্যে পরস্পরকে বোঝাবুঝি প্রক্রিয়ায় ঘাটতি আছে। আবুল আলা মওদুদী একজন আধুনিক ইসলামী চিন্তাবিদ, তাকে মতাদর্শিক ভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। বাঙালি জাতিবাদী ন্যারেটিভ দিয়ে এতোদিন ঠেকানো গিয়েছিল। এখন যাবে না। হেফাজতে ইসলাম এবং জামায়াতে ইসলামের মধ্যে মোটা দাগে দুই ধারার পরস্পর বিরোধী রাজনীতি থাকলেও ফ্যসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সম্ভাবনা বেড়েছে। তাদের বিরোধ ও মতাদর্শিক তর্ক ইসলাম ও বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে বলে আমি মনে করি।

আপাতত আড়াল, কিন্তু হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বের সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকলেও যাদের আবির্ভাবের কথা বলছি সেই নতুন রাজনৈতিক কর্তাসত্তা বর্তমান আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কয়েক কদম সামনে আগুয়ান হয়ে গিয়েছে। সেটা বুঝতে পারা গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ ও ছাত্রলীগের দৃশ্যমান হামলার পরেও সেকুলারদের পত্রপত্রিকায় হেফাজতে ইসলামকে ‘উস্কানিদাতা’ বলে দায়ী করার অর্থ একটাই। হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দকে ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে আপোষ করতে বাধ্য করা। হেফাজতের মধ্যে তাই আমরা আপোষ ও লড়াইয়ের পরস্পর বিরোধী ধারা দেখি। আগামিতেও দেখব। এতে বিভ্রান্ত হওয়ার কোন কারন নাই।

বাংলাদেশের তরুণদের বড় অংশ জামায়াতে ইসলামকে এখনও স্বাধীনতার শত্রু গণ্য করে। তবে জামায়াতে ইসলামের নেতাদের ফাঁসি দেবার পর মতাদর্শিক কারণে একাত্তরের বিরোধিতা করা বা না করা আগামি দিনে বাংলাদেশের রাজনীতির নির্ধারক কোন ইস্যু হবে না। রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় হবে ইসলাম বনাম ইসলাম বিরোধী অপরাপর শক্তি। রাজনৈতিক পরিসরে দ্বন্দ্বের এই সুনির্দিষ্ট রূপের সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্ক -- বিশেষত পুঁজির আন্তর্জাতিক চলন ও বিচলন কিভাবে যুক্ত সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে বাধ্য। একই ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে টেকনলজি -- বিশেষত গণমাধ্যম, ইলেকট্রনিক এবং ডিজিটাল  টেকনলজির ভূমিকা। চিন্তা চেতনা আবেগ কল্পনা ইতিহাস বোধ কিভাবে টেকনলজির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত হচ্ছে তার দ্বারা রাজনীতির পরিণামও নির্ধারিত হবে।

জামাতে ইসলামি ছাড়া বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব কটি ইসলামি রাজনৈতিক দল হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত। হেফাজতে ইসলামের ঝাণ্ডার তলে থাকার অর্থ বাঙালি মুসলমানের চোখে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে থাকা। বাংলাদেশের সেকুলার ও লিবারেল সমাজ যে কোন প্রকার মুসলমান কর্তাসত্তাকে ভীতির চোখে দেখে। মুসলমান হিশাবে কেউ নিজের রাজনৈতিক সত্তাকে ব্যক্ত করলে তাদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়, সম্বন্ধ তৈরি করতে হয়, লিবারেল সেকুলার রাষ্ট্রে এক সঙ্গে বাস করবার জায়গা তৈরি করতে হয় ইত্যাদি তারা জানে না। কিম্বা জানলেও তাকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের প্রতাপে উপেক্ষা করেছে। এর ফলে সেকুলার ও লিবারেল রাজনীতির পরাজয় ত্বরান্বিত হয়েছে। বিদেশী সহায়তা ছাড়া এখন বাংলাদেশে তাদের শক্তিশালী অবস্থান আগামিতে কায়েম রাখা আর সহজ হবে না।

সাধারণ মানুষ হেফাজতকে একাট্টা ইসলামি শক্তি  হিশাবে চিহ্নিত করে ও স্বীকার করে। অথচ হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের মধ্যে টানাপড়েন আছে, দ্বন্দ্ব বিরোধ আছে। সেটা খুবই স্বাভাবিক।  ইসলামের মতাদর্শিক বয়ানের মধ্যেও যে বিভিন্ন ধারা, স্রোত ও সংগ্রাম রয়েছে সেটা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির উপস্থিতির কারণে ইসলাম নামে বিভিন্ন রাজনোইতিক ধারার উপস্থিতি খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রাম  জনগণকে শেখায় এবং তাড়াতাড়ি শত্রু মিত্র চিনিয়ে দেয়। বিভিন্ন মতাদর্শের মধ্যে জনগণ নিজ শ্রেণীর স্বার্থ খুঁজে নেবার শিক্ষা পায়।


Baitul
বাইতুল মোকাররমকে রণক্ষেত্র বানানো এবং ভহেতরে মুসল্লিদের ওপর হামলা চালিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে নরেন্দ্র মোদীর তরফে একটি কঠিন ম্যাসেজ দেওয়া হোল। মসজিদ রেহাই পাবে না। খুনি ও গণহত্যাকারী মোদীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানালে মসজিদও রেহাই পাবে না, হোক তা জাতীয় মসজিদ।  সহিংস ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে ও দলীয় গুণ্ডা বাহিনীর হামলা চলবে।


মূলত উপমহাদেশে মাদ্রাসা ‘আধুনিকীকরণ” কিম্বা মাদ্রাসা নির্মূলের নীতি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের গৃহীত সামরিক নীতি। একদা কন্ডিলিসা রাইস এর প্রধান প্রবক্তা হিশাবে খ্যাত ছিলেন। সেটা জারি রয়েছে। সোভিয়েতের ভাঙন এবং চিনের পুঁজিতান্ত্রিক রূপান্তরের পর গ্রিক-খ্রিস্টিয় সভ্যতার ধারক পাশ্চাত্যের কাছে কমিউনিজম নয়, ইসলামই প্রধান মতাদর্শিক দুষমন। বলাবাহুল্য সেটা রাজনৈতিক ইসলাম। অর্থাৎ ইসলামের সেই ধারাই শত্রু, যারা মতাদর্শিক, রাজনৈতিক ও সামরিক ভাবে পাশ্চাত্যকে মোকাবিলার কথা বলে। লিবারেল চেহারার আড়ালে পাশ্চাত্যের ইসলাম ভীতি বা আতংক এখন চেনা সহজ। এর সঙ্গে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছে হিন্দুত্ববাদ। দুর্বল দেশ হিশাবে বাংলাদেশের জনগণ এখনও নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পুরাপুরি তৈরি নয়।

 

ক্ষমতাসীনদের কাছে হিশাব নিকাশ মোটামুটি সোজা। হিন্দুত্ববাদ এবং ভারতীয় আগ্রাসন মোকাবিলা প্রচারিত হবে এই ভাবে যে বাংলাদেশে ইসলামি সন্ত্রাসী বা জিহাদিরা শক্তিশালী হয়েছে। টুপি পরা কোর্তা পরা লোকজনের বিক্ষোভ তার প্রমান। এখন কাজ হচ্ছে শক্ত হাতে তাদের দমন করা। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের নামে যে যুদ্ধের ময়দান পাতা হয়েছে, সেখানে বহু শহিদের তাজা রক্তের স্রোত বইবে, বহু লাশ গুম হবে, বহু মানুষ অদৃশ্য হয়ে যাবে। আগামি দিনের যুদ্ধ একাত্তরের চেয়েও তীব্র হবে, যা বাংলাদেশের সীমানায় আটকে থাকবে না। সীমান্ত উপচে উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়বে।

দুই

খুনি ও গণহত্যাকারী মোদীর বাংলাদেশে আসা প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে সাধারণ মানুষের মনে যে দোনামোনা সমর্থনের তলানিটুকু ছিল সেই ময়লা পরিষ্কার হতে শুরু হয়েছে। পুড়ে যাওয়া মাংসের হাঁড়ির মতো সেই ময়লা পাতিলে লেপ্টে ছিল। গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক চেতনার গুণগত পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তির গণসমর্থনের ভিত্তি দুর্বল হয়েছে। এর আর পরিবর্তনের সম্ভাবনা নাই। ২০১৩ সালকে যদি আমরা শাহবাগ ও শাপলার স্টেইলমেইট বা দুই পক্ষই সমানে সমান মানি, তাহলে ২০২১-এ পাল্লার ভারকেন্দ্র ইসলামপন্থিদের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। কিন্তু জাতীয় ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবার প্রজ্ঞা ইসলামপন্থি কোন ধারাই অর্জন করতে পারে নি। সেটা এখনও অনেক দূরের ব্যাপার। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে ‘ইসলাম’ তার রুহানি শক্তি নিয়ে মজলুমের মুক্তির ঝান্ডা তুলে নিতে না শিখলে ইসলাম পরিচয়বাদী সংকীর্ণ জাতিবা্দের অধিক কোন অবদান রাখতে পারবে না। সেই দিক থেকে ইসলামবাদ হবে হিন্দুত্ববাদেরই অপর পৃষ্ঠা। হিন্দুত্ববাদের বিপরীতে ইসলাম পরিচয় সর্বস্ব সাম্প্রদায়িক ইসলামবাদে পর্যবসিত হবার সমূহ ঝুঁকি রয়েছে।

কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম সরল রেখা না। এখানে ভুলভ্রান্তি, পতন, পিছিয়ে পড়া কিম্বা পরাজয় থাকে। প্রবল ঝুঁকি সত্ত্বেও খুনি ও গণহত্যাকারী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে সমাজের অন্যান্য রাজনৈতিক ধারার পাশাপাশি ইসলামপন্থিদের এই আন্দোলন গভীর পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা দাবি করে।

দ্বিতীয় দিক হচ্ছে গণবিরোধী শক্তি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিপরীতে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের তাগিদ গড়ে উঠছে যা এর আগে দেখা যায় নি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি নতুন উপাদান। রাজনৈতিক ঐক্য আমরা এর আগেও দেখেছি। কিন্তু এবারের ঐক্য সজ্ঞানে তথাকথিত ডান এবং বাম রাজনীতির একসঙ্গে আন্দোলন করবার উপলব্ধি। অর্থাৎ বাংলাদেশের বর্তমান লড়াই বিমূর্ত মতাদর্শ ভিত্তিক হয়ে থাকতে চাইছে না। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের বাস্তবিক ঐক্য দাবি করছে। আমার কাছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা নতুন, কিন্তু খুবই ইতিবাচক উপাদান বলে মনে হয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিকে ডান ও বাম বিভাজনের দ্বারা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রশক্তি এ যাবতকাল সফল ভাবে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। সেই বিভাজন অর্থহীন হয়ে পড়েছে। কারণ বিভাজনের ভে্দরেখা জনগণের কাছে পরিষ্কার: একদিকে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা। আর তার বিপরীতে রয়েছে নির্যাতীত, পড়ে পড়ে মার খাওয়া, স্বাধীনতার পর থেকে দিনে দিনে সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া মজলুম জনগণ। ডান বাম বিভাজনের বাইরে সাধারণ মানুষের ঐক্যের উপলব্ধি এবং তার রাজনৈতিক সম্ভাবনা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এই উপলব্ধি আগামি দিনের রাজনীতির নির্ধারক অভিমুখ হয়ে উঠবে। এটা আমি মনে করি।

সমাজে মতাদর্শিক পার্থক্যের গোড়ায় রয়েছে বিভিন্ন শ্রেণী এবং তাদের হাতে গড়ে ওঠা নানান সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বয়ান। সেই সকল শ্রেণী যতোদিন আছে মতাদর্শিক পার্থক্য প্রবল ভাবেই থাকবে। এই ফারাক হঠাৎ বাংলাদেশ থেকে উবে যাবে না। কিন্তু যে কোন বৈপ্লবিক পরিস্থিতি জনগণের চেতনায় উল্লম্ফন ঘটাতে পারে। গত কয়েকদিনে সেই উল্লম্ফন ঘটেছে। সেই উল্লম্ফনের মূলকথা হোলঃ ডান বামের বিভাজন অতিক্রম করে সবাইকে খুনি মোদী, ভারতীয় আগ্রাসন ও হিন্দুত্ববাদ মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু সেটা করতে হলে হিন্দুত্ববাদের বাংলাদেশী প্রতিনিধি বিদ্যমান গণবিরোধী রাষ্ট্রশক্তি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইটাই মুখ্য। তথাকথিত ডান বামের বিভাজন জারি রাখা মূলত ফ্যাসিস্টদের হাত শক্তিশালী করা এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বর্তমান রাখা। কিন্তু ইসলামপন্থিদের কাছে সেটা স্পষ্ট নয়। তারা দাবি করছেন তাদের আন্দোলন ক্ষমতাসীন সরকার কিম্বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়। যদি নরেন্দ্র মোদীকে বাংলাদেশে আসতে দেওয়া না হয়, তাহলে বর্তমান প্রধান মন্ত্রী কিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন সেটা তাদের কাছে বিবেচ্য নয়। তিনি যতোদিন খুশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। হেফাজত মনে করে তারা রাজনীতি করছে না, মুসলমান হিশাবে তারা তাদের সঙ্গত দাবি দাওয়া পেশ করছে মাত্র। তারা কাউকে ক্ষমতা থেকে নামায় না, কাউওকে বসায়ও না। কিন্তু মাঠের লড়াই বহু আবর্জনা উড়িয়ে নিয়ে যায়। রাস্তা সাফ হয়ে যায়। সেটা উনসত্তরের গণ আন্দোলনে আমরা দেখেছি। যে আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটেছে। এবারের আন্দোলনেও অনেক ময়লা সাফ হয়ে যাবে।

ডান বামের বিভাজন অতিক্রম করে ঐক্যের উপলব্ধির প্রথম প্রমাণ হচ্ছে খুনি ও গণহত্যাকারী মোদীর বাংলাদেশে আসা প্রতিরোধের কর্মসূচী একই ভাবে হেফাজতে ইসলাম, ছাত্র অধিকার আন্দোলন, ভাসানী পরিষদ এবং বামদের কয়েকটি সংগঠনেরও কর্মসূচী। উদ্দেশ্য বা এই মূহূর্তের লক্ষ্যের ঐক্য তথাকথিত বাম ও ডান পরস্পরকে বুঝবার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। মতাদর্শিক এবং সাংগঠনিক পার্থক্য থাকার পরও ছাত্র অধিকার আন্দোলন এর আগে হাটহাজারিতে কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের ওপর পুলিশী নিপীড়নের নিন্দা করেছে। অন্যান্য দিক ছাড়াও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্র অধিকার আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে লিবারেল রাজনীতির পরিমণ্ডলে থেকে তথাকথিত ডান ও বাম বিভাজনের দেয়াল ভাঙা। মূলত বাংলাদেশের নতুন তরুণ নেতৃত্বই এই দেয়াল ভাঙতে শুরু করে। এর প্রভাব কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের মধ্যেও পড়ে। বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর অনেক কর্মীর মধ্যেও ধর্মের বিরুদ্ধে একাট্টা বিদ্বেষী অবস্থান আগের মতো নাই। কমেছে। ধর্মের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে সমাজে ধর্মের ভূমিকাকে বাস্তবোচিত ভাবে বোঝার চেষ্টা গত এক দশকে অনেকে অনেক পরিণত হয়েছেন। যদিও বাম গণতান্ত্রিক জোট নামক চরম ইসলাম বিদ্বেষী পেটি বুর্জোয়া ক্লাবগুলোর খাসিলতে বিশেষ কোন পরিবর্তন আসে নি। সেটা তাদের সাম্প্রতিক বিবৃতিতে পরিষ্কার।

ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তি তথাকথিত বাম ও ডানের বিভাজন জারি রেখে তাদের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভকেও বিভক্ত রাখে। তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দানা বাঁধতে দেয় না। ইসলামি আন্দোলনের দিক থেকে এই বিভাজন ভাঙবার নজির এবার আমরা পেলাম। আমি একজন নেতাকে আমার বক্তব্যের সপক্ষে উদাহরণ হিশাবে পেশ করব।

ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে হেফাজত ইসলামের কয়েকজন নেতার চরম সুবিধাবাদী সম্পর্ক তরুণ আলেম এবং তালেবে এলেম বা শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই মেনে নেয় নি। প্রবল ক্ষোভ অধিকাংশের মধ্যেই তুষের আগুণের মতো জ্বলছিল। ফলে হেফাজতে ইসলাম কোন কর্মসূচী না দিলেও তারা রাস্তায় বিক্ষোভ করতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেমে পড়েছে। মওলানা মোমিনুল হক এদের কাছে প্রিয় ছিলেন। ২০২০ সালের ১০ অক্টোবরে তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ও ১৫ নভেম্বর হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম-মহাসচিব নির্বাচিত হন। তাছাড়া ২৬ ডিসেম্বর হেফাজতের এক সভায় তাকে ঢাকা মহানগরীর মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতির ক্ষেত্রে তিনি শেখ মুজিবের ভাস্কর্য বিতর্ক এবং খুনি ও গণহত্যাকারী মোদীর বিরুদ্ধে গণ প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে সামনের সারির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিশাবে সামনে চলে এসেছেন।

হেফাজতে ইসলামের আভ্যন্তরিণ দ্বন্দ্ব বোঝার জন্য জানা দরকার সাবেক আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী হত্যার অভিযোগে মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হকসহ হেফাজতে ইসলামের বর্তমান কমিটির কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা। মামলা করেছে হেফাজতেরই আরেক পক্ষ। গত ১৭ ডিসেম্বর ২০২০ সালে চট্টগ্রামে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৩-এ মামলাটি করেন আহমদ শফীর শ্যালক মাইনুদ্দিন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন। যারা হেফাজতে ইসলামকে একাট্টা ইসলামি দল গণ্য করেন তারা ভুল করেন।

সম্প্রতি আমি আল্লামা মামুনুল হকের বক্তব্যের একটি দিক বিশেষ ভাবে খেয়াল করছি। সেটা হোল ও গণহত্যাকারী মোদীর বিরুদ্ধে বায়তুল মোকাররমের মসজিদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বাম ডান নির্বিশেষে সকলকে তিনি রাজপথে আহ্বান করছেন। এটা পরিণত রাজনৈতিক উপাদান। শুধু তার জন্য আমি তাঁকে নজির হিশাবে এখানে পেশ করছি না। তিনি বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে উপমহাদেশে একটি বিস্তৃত ইতিহাস একটি বক্তৃতায় পেশ করেছেন। এই ইতিহাস সচেতনতা আমি খুব কম আলেমের মধ্যে দেখেছি। তবে আমি নিশ্চিত, আমাদের আরও আলেম রয়েছেন।

তিন

বাম ও ডানকে এক সাথে রাস্তায় আহ্বান যতো সহজ মনে হয়, রাজনৈতিক দিক থেকে তার মর্ম বোঝা অতো সহজ নয়। তাছাড়া নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশে আসা প্রতিহত করতে রাস্তায়  ডান ও ডান একের ডাক বা আহ্বানকে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ডাক ভাবাও ভুল। মওলানা মামুনুল হক পরিষ্কার বলেছেন, “যদি মোদির সফর বাতিল করা হয় তাহলে “আপনি [শেখ হাসিনা] যেইভাবেই নির্বাচিত হয়েছেন আর আমাদের কোন আপত্তি থাকবে না”। অর্থাৎ মোদীকে আসতে না দিলে মামুনুল হক ফ্যাসিস্ট সরকার এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা মেনে নেবেন।

কিন্তু রাজনীতি শুধু তত্ত্ব দ্বারা ঠিক হয় না। চলমান আন্দোলনের ক্ষেত্রে ঠিক হয় সঠিক পদক্ষেপের ওপর। চরম ইসলাম বিদ্বেষী ছাড়া ডান ও বামকে একত্র বা কাছাকাছি আনা উপলব্ধি করা এবং আহ্বান জানানো একটি সঠিক পদক্ষেপ। এর ইতিবাচিক ফল ফলতে বাধ্য।

পদক্ষেপের প্রশ্ন বাদ দিলে বলা বাহুল্য বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের সঙ্গে মামুনুল হকের অবস্থান সাংঘর্ষিক। এমনকি নির্বাচন সর্বস্ব লিবারেলদের অবস্থানেরও বিরোধী। কারন নির্বাচনবাদী লিবারেলরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। বর্তমান সরকারকে অনির্বাচিত সরকার মনে করে। রাত্রে ভোট চুরি করে অবৈধ ভাবে ক্ষমতায় রয়েছে মনে করে। কিন্তু মামুনুল হক কিম্বা হেফাজতে ইসলামের কাছে সেটা কোন বিতর্কিত রাজনৈতিক ইস্যু নয়। নরেন্দ্র মোদীর হাত মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত। অতএব ক্ষমতাসীন সরকার তাকে দেশে আসতে না দিলেই তারা মনে করেন, তাদের দাবি পূরণ হয়ে যাবে। এরপর শেখ হাসিনা যতোদিন খুশী ক্ষমতায় থাকুক হেফাজতে ইসলামের কোন আপত্তি নাই। হেফাজতে ইসলাম বুঝতে অক্ষম যে বাংলাদেশে নরেন্দ্র মোদীকে নিমন্ত্রণ একমাত্র বর্তমান গণবিরোধী এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে পারঙ্গম রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব।

তবে হেফাজতে ইসলামের অনেকে নেতা দাবি করেন এটা একটা হেকমত বা কৌশল। এই যুক্তি দিয়ে ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তরুণদের ক্ষোভকে প্রশমিত করবার সক্রিয় চেষ্টা হেফাজতে ইসলামে প্রবল ভাবে রয়েছে। গত কয় দিনে এই ‘হেকমত’-এর বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ তরুণ আলেমরা জয়ী হয়েছে। অপরদিকে এই স্বার্থান্বষী হেকমত বা কৌশলের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামের মধ্যে অপ্রকাশ্য ও প্রকাশ্য ক্ষোভ রয়েছে। হেফাজতে ইসলামের আরেকজন জনপ্রিয় তরুন ওয়াজিয়ান রফিকুল ইসলাম মাদানী ‘হেকমত’ তত্ত্বের সমালোচক। তার যুক্তি হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম হেকমতের নাম করে নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশে আসা প্রতিহত করতে কোন কর্মসূচী দেয় নি। তিনি তা অমান্য করে অন্যান্য দলের সঙ্গে রাস্তায় বিক্ষোভ করেছেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেছিল, তবে আবার মুক্ত করে দেয়।

ইসলাম বনাম ইসলাম বিরোধী রাজনীতি হিশাবে যা এখন সামনে হাজির গোড়ায় তা বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণীর লড়াইয়ের অভিপ্রকাশ-  বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা। অর্থনৈতিক ও সামাজিক  দ্বন্দ্ব মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক পরিসরে কি ধরণের পরিভাষা গ্রহণ করে সেটা একসসময় আমি 'ক্রুসেড, জেহাদ ও শ্রেণিসংগ্রাম' নিবন্ধে আলোচনা করেছি। ব্যাপারটি আরও স্পষ্ট ভাবে বোঝার জন্য বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিভাষা নিয়ে আমরা আলাদা আলোচনা করব। তবে এখন মনে রাখতে হবে নিজ শ্রেণীর পরিচয়ে মেহনতি শ্রেণি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করছেন না। গরিব, সর্বহারা নিম্নবিত্ত  এবং পড়ন্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিশাল অংশ ইসলামকে তাদের শ্রেণীর মুক্তির মতাদর্শ হিশাবে দেখতে চাইছে। হেফাজতে ইসলামের প্রতি সাধারণ জনগণের বড় একটি অংশের সমর্থন তার পরিষ্কার প্রমাণ। অবশ্য ইসলামের পুরনা তাফসির, বয়ান বা ব্যাখ্যা দিয়ে জনগণকে সন্তুষ্ট করা যাবে না, যা জালিম ও শোষকদের স্বার্থ রক্ষা করে। কিন্তু সমাজে দ্বন্দ্ব গভীর এবং লড়াই তীব্র হলে ইসলামের প্রচলিত ব্যাখ্যাতেও বদল ঘটবে । সেটা অনিবার্য।  কিছু কিছু ওয়াজিয়ানের ওয়াজে তার লক্ষণ সুস্পষ্ট। এটি ইতিবাচক। জনগণের অধিকার ও ইনসাফ কায়েমের  সংগ্রাম এই প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করতে হবে। উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদের উত্থান এবং আওয়ামী লীগের নরেন্দ্র মোদীকে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে প্রধান অতিথি করার মধ্যে দিয়ে ইসলাম গণরাজনীতির বয়ান হিশাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরও স্পষ্ট ভাবে হাজির থাকবে।  সেটা অনিবার্য ভাবেই সেটা ঘটবে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা, দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামের কারনে। কিন্তু উপমহাদেশে এর ফল হবে ইতিবাচক এবং সুদূর প্রসারী।

তবে সেটা নির্ভর করবে বিপ্লবী রাজনীতির যে সম্ভানাময় ধারাগুলো তরুণদের মধ্যে সক্রিয় তাদের সঠিক অবস্থানের ওপর। 

এই ক্ষেত্রে বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনের কিছু বক্তব্য আমার চোখে পড়েছে। এখনও মাদ্রাসা ছাত্রদের ন্যায্য সংগ্রাম কিম্বা তাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো বাংলাদেশের বাম মহলে রীতিমতো অপরাধ হিশাবে গণ্য করা হয়।বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলন হেফাজতের কোন কর্মসূচিতে সমর্থন জানায় নি।কিন্তু তারা ইসলামপন্থিদের মত প্রকাশ ও সভাসমিতি করার অধিকারের পক্ষে স্পষ্ট ভাবে্ দাঁড়ায়। তারা সকল আওয়ামী-রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে। এই অবস্থান তাদের ঘোষিত নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তারা হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে পুলিশ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বাধা ও নিন্দা জানানোর নিন্দা করে। তারা ‘ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ’-এর বিরুদ্ধে, যা আসলে ধর্মীয় জাতিবাদের রাজনৈতিক রূপ মাত্র। মাদ্রাসা ছাত্র হত্যার নিন্দা জানাতে তারা কামরাঙির চরে মাদ্রাসা অঞ্চলে বিক্ষোভ ও সভা করেছে। মাদ্রাসা ছাত্রদের প্রতি কোন আগাম অনুমান কিম্বা বিদ্বেষ পোষন ত্যাগ করে তাদের কাছ শ্রেণী রাজনীতির অবস্থা ব্যাখ্যা করা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এখানেও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গণ ঐক্য রচনার তাগিদ আমরা দেখি। যা বাংলাদেশে বিপ্লবী রাজনীতির ইতিবাচক লক্ষণ।

সামগ্রিক ভাবে  সম্প্রতিকালের  সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দুটো ইতিবচক রাজনৈতিক ধারার সূচনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একটি হচ্ছে তরুণ আলেম ও মাদ্রাসা ছাত্রদের রাজনৈতিক কর্তা সত্তা বা এজেন্সির আবির্ভাব। দুই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরের গুণগত রূপান্তর। রাজনৈতিক পরিসরে ইসলামপন্থিদের বাইরে রাখাই ছিল সেকুলার রাজনীতির বিধান। সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। এর সুফল কতোটা ঘটবে তা আমাদের ইতিহাস সচেতনতা এবং দেশে দেশে বিপ্লবের ইতিহাস থেকে শিখবার হিম্মতের ওপর নির্ভর করবে। কারণ লড়াইটা যারা সরাসরি মাঠে আছেন তাদের নয়। সকলের।

 

২৮ মার্চ ২০২১। ১৪ চৈত্র, ১৯২৭

 

 

 

 

 

 

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।