বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে?


অনেকে প্রায়ই প্রশ্ন করেন বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে? কিন্তু প্রশ্ন হওয়া উচিত আমরা একে কোন দিকে নিতে চাই?

বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে শ্রমিক ও কৃষকদের উপস্থিতি না থাকলেও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও ছাত্র অধিকার পরিষদের অধিকাংশ সংগ্রামী তরুণেরা গরিব কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের সন্তান। আন্দোলনে শ্রেণিগত ছাপ স্পষ্ট না হলেও এটা পরিষ্কার সড়ক দুর্ঘটনায় যারা মরে কিম্বা পঙ্গু হয়ে দুঃসহ জীবন কাটায় তাদের অধিকাংশই 'মফিজ' -- অর্থাৎ তাদের পরিচয় বা নাম থাকে না। এছাড়া আছে মেহনতি ও নিম্নবিত্তের মানুষ -- যাদের খবর কেউ রাখে না। তাহলে আমাদের উচিত হচ্ছে যে কোন আন্দোলনে অন্তর্নিহিত শ্রেণি প্রশ্নটা ধরতে পারা এবং অন্যদের বোঝানো। দিনশেষে লড়াইটা হচ্ছে অল্প কয়েকটি মাফিয়া পরিবার এবং তাদের তৈরি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাস ও সহিংসতা একচেটিয়া ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের হাতেই কুক্ষিগত।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন হচ্ছে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং তার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ছাত্র অধিকার পরিষদ। শ্রেণির দিক থেকে মিশ্র কিন্তু গরিব, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ছাত্রছাত্রীদেরকেই এই আন্দোলন প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলাদেশে আগামি দিনের রাজনীতিতে সম্ভাব্য যে সকল ধারার ভেতর থেকে নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনা বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলনে তার সর্বাগ্রে। কিন্তু কি তার রূপ দাঁড়াবে তা আগাম বলা সম্ভব না। বিভিন্ন সময়ে তাদের দোদুল্যমানতা এবং হোঁচট খাওয়াও আমরা দেখেছি। শ্রেণিগতভাবে মিশ্র হওয়ার কারণে দোদুল্যমানতা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এটা পরিষ্কার এই আন্দোলন ধনি বা উচ্চবিত্তদের আন্দোলন নয় এবং ফ্যাসিস্ট শক্তির সঙ্গে এই আন্দোলনের দ্বন্দ্ব বাস্তব। এই আন্দোলনের যে দিকটি সম্প্রতি বিপুল ভাবে জনসমর্থন লাভ করেছে সেটা হোল বাংলাদেশের নরেন্দ্র মোদীর আগমনের বিরোধিতা করা। হেফাজতে ইসলামের তরুণদেরও যা অনুপ্রাণিত করেছিল। বাম ডান নির্বিশেষে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়বার রণধ্বণি এই প্রথম আমরা মোদী বিরোধী আন্দোলনে দেখলাম। সম্প্রতি ছাত্র পধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের বিপুল ধড়পাকড়ের কারণ এটাই। যার ধারাবাহিকতায় সম্ভাবনাময় তরুণ রাজনৈতিক কর্মী আকরম হোসেন গ্রেফতার হয়েছে। এর আগে আখতার হোসেন সহ বহু কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এই আন্দোলনের তরুন নেতৃবৃন্দের কাছে একটি সত্য আগের চেয়েও অনেক স্পষ্ট। সেটা হোল পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের যুগে লিবারেল ও নির্বাচনসর্বস্ব ফাঁপা রাজনীতির কোন ভবিষ্যৎ নাই। সেটা এক মাফিয়া গ্রুপকে সরিয়ে আরেক মাফিয়া গ্রুপকে ক্ষমতাসীন করার শামিল । মাফিয়াদের টাকায় নির্বাচন করে কোন তরুণ নেতা একালে আর জাতীয় নেতা হতে পারবে না। মাফিয়াতন্ত্র ও ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা থেকেও জনগণের মুক্তি মিলবে না। মাফিয়া পরিবারের দাসত্ব বরণ করবারও কোন অর্থ হয় না। বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে নির্বাচন করতে হলে টাকা লাগবেই। ফলে নির্বাচন নয়, এখনকার রাজনীতি হচ্ছে রাষ্ট্রকে নতুন ভাবে গড়া। কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন আছে। কারণ পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের যুগে স্বাধীন সার্বভৌম ওয়েস্টফিলিয়ান রাষ্ট্র অবাস্তব বা আকাশকুসুম হয়ে গিয়েছে। কোভিড-১৯ আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে কিভাবে রাষ্ট্রের জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে অল্প কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি, যারা সারাবিশ্বকে সমরাস্ত্র, টেকনলজি, নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির জাল দিয়ে আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। কিন্তু বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট শক্তির পরাজয় এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা দ্রুত বদল না করলে আসন্ন বিপর্যয় আমরা এড়াতে পারব না।

রাষ্ট্র মেরামত করবার যে কথা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে উঠেছিল, বাংলাদেশের রাজনীতি সেই দিক থেকে এক কদম এগিয়ে গিয়েছে বলা যায়। ছাত্র অধিকার পরিষদ নিস্ফল ও গণবিরোধী নির্বাচনসর্বস্ব রাজনীতির ফাঁদ এড়িয়ে যদি গণ আন্দোলনকে তার যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিতে পারে তাহলে বাংলাদেশ একাত্তরের মতো বিশ্বে আবার নতুন ইতিহাস সৃষ্টির পূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে।

হেফাজতে ইসলামের ডাকে চিড়াগুড় বেঁধে যারা শত শত মাইল হেঁটে ঢাকায় এসেছিল তারা গরিব কৃষক কিম্বা মেহনতি মানুষেরই সন্তান। এটা সত্য যে হেফাজতের দাবি কিম্বা নেতৃত্বের চরিত্রের মধ্যে আমরা এই শ্রেণীর আর্থ-সামাজিক স্বার্থ কিম্বা রাজনৈতিক চেতনার সরাসরি প্রতিফলন দেখি নি। না দেখার কারন কিছুটা বাস্তবতা এবং কিছুটা আমাদের কাণ্ডজ্ঞানের অভাব। সমাজে এই কাণ্ডজ্ঞানটুকু এখনও তৈরি হয় নি যে খুঁড়িয়ে চলা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের অধীনে সর্বহারা শ্রেণীর কাছে আত্মিক ও মানসিক আশ্রয় তার ধর্ম, বিশেষত তার নবী। রাসুলের উম্মত হবার কারণে সর্বহারা ন্যায়বিচার পাবার আশায় বাঁচে কিম্বা বেঁচে থাকবার চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাদেশের নাস্তিককুল সেই নবীকেও অশ্লীল ভাবে অপমান করে, নাস্তিকতার নামে গরিব ও সর্বহারার শেষ এবং একমাত্র আশ্রয় নবীকেও তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায়। গণমানুষের মধ্যে তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া আমরা ২০১৩ সালে দেখেছি।

এসবের পাশাপাশি চলেছে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে আন্দোলনে শহরের এলিট ও মধ্যবিত্ত নারীদের দাপট আমরা দেখি। অন্যদিকে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনকে এনজিওদের প্রজেক্ট বা এক্টিভিটিতে পরিণত করার কারণে তার কোন নগদ ইতিবাচক ফল আমরা পাই নি। ফলে পুঁজিতান্ত্রিক-পুরুষতন্ত্রের (Capitalist Patriarchy) বিরুদ্ধে নারীর লড়াইয়ের তাৎপর্য বাংলাদেশের গরিব ও মেহনতি জনগণ এখনও পরিষ্কার বোঝে নি। কিন্তু সেখানেও তরুণ নারী নেতৃত্বের পদচারণা আমরা দেখছি যাদের নিয়ে বাংলাদেশ একদিন গর্ব বোধ করবে। জাতীয় রাজনীতির পুরা ছকের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক সম্পর্ক, নিপীড়ন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে নারীর লড়াই আগামি দিনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

তাহলে আমাদের আশু কর্তব্য ও কাজ কি? বিচ্ছিন্ন ও বিভিন্ন গণ আন্দোলনকে একটি সুতায় বাঁধতে পারার সামর্থ অর্জন। যেন আন্দোলন যেখানে যেভাবেই গড়ে উঠুক দিন শেষে লড়াই একটাই: অল্প কয়েকটি মাফিয়া পরিবারের গড়ে তোলা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মজলুম জনগণের লড়াই।

এটাই সদর রাস্তা। আন্দোলনকে কোন গলিঘুঁজিতে ঢুকে পড়তে বা শর্টকাট মারতে দেবেন না।

সবার আগে দরকার গণক্ষমতার বিকাশ। বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংসদ সদস্য হওয়া কোন তরুণের আরাধ্য হতে পারে না। সেটা হলে মানে দাঁড়াবে কোন না কোন মাফিয়া চক্রের কাছে নিজেকে বেচে দেওয়া।

দ্বিতীয়ত দরকার বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার উৎখাত এবং নতুন ভাবে গণক্ষমতাকে এমন ভাবে রূপ দেওয়া যেন অর্থনৈতিক ভাবে আমরা দ্রুত শক্তিশালী দেশে পরিণত হতে পারি।

কিভাবে সেটা সম্ভব? সেটা মোটেও কঠিন কোন পথ না। দরকার শক্তিশালী জাতীয় বিনিয়োগ নীতি প্রণয়ন যেন ব্যবসা, ব্যাংক আর শেয়ার বাজার দিয়ে গড়ে ওঠা মাফিয়া ও ভূমি দস্যুদের সাম্রাজ্য আমরা ধূলায় মিশিয়ে দিতে পারি; দরকার বিনিয়োগ, প্রাণ-প্রকৃতি বান্ধব প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ এবং বিপুল কর্মসংস্থান বৃদ্ধি।

কোন তরুণ বেকার থাকবে না। থাকবার সুযোগই থাকবে না। আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কোন শ্রমিক অশিক্ষিত ও অদক্ষ থাকবে না, কারন প্রতিটি গ্রাম, কৃষি ও কারখানাকে এমন ভাবে গড়ে তোলা হবে যেন সেটাই হয়ে ওঠে আমাদের খেটে খাওয়া মানুষদের স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের ঝটপট দ্রুত অগ্রসর হতে হবে। বহুজাতিক কর্পোরেশানের বিপরীতে জনগণের জ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ ঘটানোই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জ্ঞানই একালে উন্নত অর্থনীতির ভিত্তি।

মানবসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার আমরা নিশ্চিত করব। জ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চা ও আবিষ্কারের জন্য প্রতিটি কারখানা এবং কৃষকদের গ্রাম হয়ে উঠবে নতুন ধরণের জ্ঞানচর্চা ও আবিষ্কারের জায়গা, যারা তাদের লোকায়ত কারিগরি ও ঐতিহ্যের ওপর শক্তিশালী ভাবে দাঁড়াবার সূত্রগুলো আবার ফিরে পাবে।

শিক্ষার ধারণার খোলনলচে আমরা বদলে দেব, কারণ এখনকার গোলাম তৈয়ারির কারখানাগুলো দ্রুত ভেঙ্গে ফেলতে হবে। সোজা কথায় জীবন যাপন ও জীবিকার সঙ্গে জ্ঞানচর্চার কোন ভেদ থাকবে না।

তৃতীয়ত দরকার শক্তিশালী গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, প্রতিটি নাগরিককে সৈনিক এবং প্রতিটি সৈনিককে নাগরিক হতে হবে। দেশ রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সকলের। নইলে আঞ্চলিক দস্যুদের হাত থেকে আমরা বাংলাদেশের জনগণকে নিরাপদ রাখতে পারব না।

যে দেশে প্রতিটি নাগরিকই সৈনিক সেই দেশকে যমও ভয় করবে।

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।