৩. ইসলামের কোরবানি: 'মনের পশু' তত্ত্ব ও খ্রিস্ট ধর্ম


 এক

সুরা আস-সাফফাত ও কোরবানি নিয়ে আমাদের আলোচনার প্রধান উদ্দেশ্য কোরান ঠিক যেমন আছে তেমন পাঠের মধ্য দিয়ে এ সময়ের ধর্মতত্ত্ব, দর্শন ও রাজনীতির পরিমণ্ডলে প্রবেশ করা। তাফসীর, হাদিস কিম্বা ইসলামের নিজের আভ্যন্তরীণ তর্ক বিতর্ক (discursive tradition) খুবই গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু ইসলামের চোখে কোরানুল করিম আল্লার ‘ওহি’। ‘ওহি’ সবার উর্ধে। কোরানুল করিমকে ‘ওহি’ হিশাবে সবার আগে আলাদা গণ্য করতে না শিখলে বর্তমান সময়কালের জিজ্ঞাসাগুলোকে কোরানের ভেতর থেকে এবং কোরানের আলোকে আমরা তুলতে পারব না, পিছিয়ে থাকব। তাফসির নানানজনের নানান রকম হতে পারে, হাদিস নিয়ে জাল বা ছহি তর্ক উঠতে পারে। কিন্তু আল্লার ‘ওহি’ তার নিজের জায়গাতেই আল্লার কালাম হয়ে বিরাজ করে এবং যুগে যুগে আমাদের হেদায়েত করে যায়। জটিল ও অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে, শুধু মুসলমানদের নয়, মানবজাতিকে পথ দেখায়।

আল্লার কালামের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বিরোধ ও বিভিন্নতা দোষ নয়, বরং শক্তির লক্ষণ। কারন কোরান ছাড়াও আল্লা মানুষকে বিচারবুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও আরো নানান বৃত্তি দিয়েছেন। বাংলার ভাবচর্চায় তা ‘সহজ’ নামে পরিচিত। জন্মের সময় থেকেই আল্লার কাছ থেকে আমরা সেই সকল বৃত্তি নিয়ে আসি। এটাই যার যার ‘পুঁজি’। জন্ম মানে মানুষের সকল বৃত্তিরও জন্ম। জীবনব্যাপী কিভাবে মহাজনের পুঁজি অর্থাৎ আমাদের সহজ মানবীয় বৃত্তি আমরা ব্যবহার করেছি, একদিন মহাজনকে তার হিশাব দিতে হবে।

ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মতো স্রেফ ‘বিশ্বাস’ নয়। বিশ্বাস অন্ধ, কিন্তু আল্লার ‘ওহি’ অন্ধ হতে পারে না। আল্লার কালাম ঘোর অন্ধকারেও আলো ফেলে, আমাদের পথ দেখায়। কে কিভাবে আল্লার কালাম বুঝেছে ও আমল করেছে সেটা যার যার পরীক্ষা। তার জবাব তাকেই দিতে হবে। অতএব দেশকালপাত্রভেদে কোরানুল করিম নতুন তাৎপর্য নিয়ে হাজির হবে, এতে বিস্ময়ের কিছু নাই। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বদলায়, কিন্তু কোরান বদলায় না। ইতিহাস নতুন নতুন জিজ্ঞাসা তৈরি করে, আর আমরাও তার উত্তরের সূত্র সন্ধানের জন্য আল্লার ওহি বা তাঁর কালামের কাছে বার বারই ফিরে আসি। কোরান আমাদের হেদায়েতের জন্য চিরকাল হাজির। নতুন জিজ্ঞাসার যথাযথ উত্তর দেবার হিম্মত কোরানুল করিমের সঙ্গে সঠিক সম্বন্ধ নির্ণয়ের মধ্য দিয়েই আমরা অর্জন করি।

আমরা জানি পাশ্চত্য সভ্যতা মূলত ইহুদি-খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্ব ও গ্রিক চিন্তার ফল, যাকে আমরা ‘আধুনিকতা’ বলে থাকি। যদি আমরা কোরানের অন্তর্গত চিন্তার সঙ্গে সরাসরি সম্বন্ধ স্থাপন করতে না পারি এবং আধুনিকতার মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হই, তাহলে এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয় যে একালে কোরানুল করিম আমাদের গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে অক্ষম। আমাদের এই অভিযোগ শুনতে হবে যে কোরান কেন্দ্রিক ধর্মতাত্ত্বিক চিন্তা ও ঐতিহ্যের ইতিহাস আছে বটে, তবে সেটা একান্তই ধর্মতত্ত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আধুনিক কালের জিজ্ঞাসা ও চিন্তা চর্চায় কোরানের কোন ভূমিকা আর নাই।

বলাবাহুল্য এটা ভুল এবং আমরা তা মনে করি না। এখানে আমাদের সঙ্গে কোরানে অবিশ্বাসীদের মধ্যে পার্থক্য। তারা কোরান বাদ দিয়ে আমাদের বোঝায় তাদের ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত । তারা কোরানকে তাদের নিজেদের তাফসির গ্রন্থ বানাতে চায়, কারন তারা দাবি করে তাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণই চূড়ান্ত, কোরানের কাছে আমাদের আর ফিরে যাবার দরকার নাই। তাদের ব্যাখ্যাকেই কোরানের ব্যাখ্যা হিশাবে আমাদের মানতে তারা বাধ্য করে। তারা কোরান মানতে চায় না। বলাবাহুল্য এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠির ধৃষ্টতা আমরা মানি না। অন্যদিকে আমাদের প্রমাণ করে দেখাতে হবে একালের নতুন নতুন জিজ্ঞাসা মোকাবিলার পরামর্শ কোরানুল করিমে রয়েছে। কোরান নিজেই দাবি করেছে আমি মানবজাতিকে হেদায়েতের জন্য নাজিল হয়েছি। কোরান ধরো তক্তা মারো পেরেক জাতীয় গ্রন্থ নয়।

তাহলে আমাদের প্রমাণ করে দেখাতে হবে একালের জিজ্ঞাসা মোকাবিলার জন্য কোরান আমাদের হেদায়েত করতে পারে। নতুন নতুন জিজ্ঞাসার মোকাবিলা যদি আমরা করতে না পারি তাহলে পাশ্চাত্যের অনুমান, প্রচার ও প্রপাগাণ্ডাই সত্য প্রমাণিত হবে যে কোরান বিশ্বাসীদের ধর্মগ্রন্থ হতে পারে, কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে পশ্চাৎপদ -- । কোরান সর্বকালে মানুষের হেদায়েতের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে আমাদের এই দাবি তখন অন্তঃসারশূন্য হয়ে ওঠে। তাই আমরা কোরানের ভেতর থেকে পাশ্চাত্য দর্শনের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিকের সাম্প্রতিক চিন্তার পর্যালোচনা করতে চাই। যেমন, সোরেন কিয়ের্কেগার্ড, ইম্মেনুয়েল লেভিনা, জাক দেরিদা, স্লাভো জিজেক প্রমুখ। হয়তো ফ্রানৎজ কাফকা নিয়েও আমাদের কিছু আলোচনা থাকবে। এই জন্যই আমরা নজির হিশাবে সুরা আস-সাফফাত ও কোরবানি প্রসঙ্গ বেছে নিয়েছি।

সজীব চিন্তার পরিমণ্ডলে যেসকল গুরুত্বপূর্ণ তর্কবিতর্ক আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চলছে সেখানে কোরানুল করিম আশ্রয় করে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা কতোটুকু? কোরান বোঝাবুঝির পদ্ধতি কি হতে পারে? বলা বাহুল্য, আরও নানান প্রশ্ন আমরা এখন তুলতে পারি। তোলা যেতে পারে। আলবৎ আমরা তুলব এবং সাধ্যমতো আলোচনা করব। যেন আমাদের দেশের তরুণদের চিন্তাশীলতা ও আত্মবিশ্বাস দ্রুত বিকশিত ও দৃঢ় হয়, আমরা যেন বাংলাদেশে চিন্তা, সংস্কৃতি, রাজনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে নতুন নেতৃত্বের আবির্ভাব ত্বরান্বিত করতে পারি। নিজেদের বিকাশের শর্ত নিজেরা তৈরি করতে পারি।

অতএব আমাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য চিন্তার হিম্মত অর্জন। কোরান আমাদের সেই দিশা দিতে পারে। তার জন্য সবার আগে উচিত কোরানুল করিম সঠিক, সনিষ্ঠ ও সতর্ক পাঠে মনোযোগী হওয়া। কেবল তখনই আমাদের আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হতে শুরু করবে। কারো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মুখাপেক্ষি না হয়ে নিজে বোঝা ও যাচাই করার সংকল্প দৃঢ় করা দরকার।

এ যাবতকাল আমরা চিন্তা চর্চার ক্ষেত্রে ইহুদি ও খ্রিস্টিয় চিন্তার আধিপত্যকে মেনে নিয়েছি, গ্রিক-খ্রিস্টিয় অনুমান ও তর্কবিতর্কের ঐতিহ্যই আমাদের একমাত্র নিয়তি গণ্য করেছি। তাই আমাদের চিন্তার যে অভ্যাস গড়ে উঠেছে, সেটা পাশ্চাত্য চিন্তার অনুকরণ হয়ে থেকেছে। গ্রিক খ্রিস্টিয় চিন্তা মানেই মন্দ, এটা আমরা মনে করি না। সেটা ভিন্ন তর্ক। কিন্তু গ্রিক-খ্রিস্টিয় চিন্তার আধিপত্যের কারণে কোরানের মর্ম সহজে আমাদের কাছে আর ধরা দেয় না। এটা ভয়ংকর বিপদের জায়গা। যাদের ধর্ম ইসলাম তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে জীবন ও জগত নিয়ে কোন বুদ্ধিবৃত্তিক তর্কবিতর্কে কোরানুল করিমের কোন ভূমিকা নাই। তারা কোরানকে নিছকই একটি ধর্মগ্রন্থ মনে করে, যার ভূমিকা শুধুমাত্র পরকালের জন্য। কোরানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও তখন পরকালকেন্দ্রিক -- অর্থাৎ সংকীর্ণ অর্থে ধর্মতাত্ত্বিক হয়ে ওঠে। অথচ বর্তমান ইহলৌকিক বাস্তবতা আমাদের নিত্যই নতুন নতুন জিজ্ঞাসার  মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কোরানকে নিছকই পারলৌকিক ধর্মগ্রন্থ বানিয়ে ফেলায় ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীরা নিজেরাও আর বিশ্বাস করে না যে নিত্য নতুন ইহলৌকিক জিজ্ঞাসা মোকাবিলার 'হেদায়েত' -- উপদেশ, ইঙ্গিত, ইশারা, পরামর্শ কোরানের 'আয়াত'-এ থাকতে পারে বা রয়েছে। ফলে একালে সমগ্র মানবজাতির চিন্তার বিকাশের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মাবলম্বিরা ভয়ানক পিছিয়ে রয়েছে। অন্যদের মধ্যেও ইসলাম সম্পর্কে একই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায়। অজ্ঞান অভ্যাস, অনুমান ও বদ্ধমূল ধারণা থেকে বের হয়ে আসা আমামদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। আমাদের আল্লার দরবারে আল্লার ‘ওহি’র সম্মুখে মুখোমুখি দাঁড়াবার অভ্যাস করতে হবে।

যে দিকটা কমবেশী স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে সেটা হোল পাশ্চাত্য তার অনুমান ও চিন্তাকেই সার্বজনীন গণ্য করে। সার্বজনীনতার দোহাই দিয়ে পরাধীন জনগোষ্ঠির ধর্ম, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভাবচর্চাকে প্রান্তিক বা অদৃশ্য করে ফেলে। গ্রিক-খ্রিস্টিয় সেকুলার চিন্তার ধারাই তাই সার্বজনীন দর্শন হিশাবে হাজির হয়। মুসলমানদের দর্শনের নাম হয়, ‘ইসলামী দর্শন’। অথচ আধুনিক দর্শন যদি দাবি করে তাদের উদ্দেশ্য সীমিতের সঙ্গে অসীমের সম্বন্ধ বিচার, ধর্মতত্ত্ব সেই বিচারটাই তার নিজের রূপ ও সীমার মধ্যে করে। চিন্তা করে চিন্তার স্বরূপে। সে কথাই আরও সহজ করে বলা যায় মানুষের সঙ্গে আল্লার সম্বন্ধ উপলব্ধি কিম্বা জীবের সঙ্গে পরমের সম্পর্ক নির্ণয় মানুষের গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা ও তৎপরতার ক্ষেত্র। এই উপলব্ধি কোরানের ভাষায় ‘শাহাদা’ বা সাক্ষ্য দিতে পারার ক্ষমতা অর্জন। তাহলে সেই উপলব্ধির সাক্ষী হবার হিম্মত অর্জন করতে হবে। সাক্ষী হওয়া শুধু উপলব্ধির কারবার না। সক্রিয় ও সজীব চিন্তার কাজ। অতএব আমাদের নিজ নিজ ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ, ঐতিহ্য ও ভাবপরিমণ্ডলের সঙ্গে আমাদের নতুন করে সম্বন্ধ রচনা অতীব জরুরি। যেন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক বা চিন্তার স্তরে নিজেরাই নিজেদের উপলব্ধির সাক্ষী হতে পারি।

ইতোমধ্যে খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনাতেই আমরা বুঝে গিয়েছি কোরবানির বয়ান কোরানুল করিম এবং বাইবেলে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোরবানির গল্প বাইবেলে এবং কোরানে এক নয়। অথচ এই অতি স্পষ্ট পার্থক্য এতোকাল আমরা মনোযোগ দিয়ে খেয়ালই করি নি। গ্রিক-খ্রিস্টিয় অনুমান ও চিন্তার আধিপত্যের কারনে সাধারন ভাবে ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থের প্রতি আমাদের অনীহা রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় বাধা এক শ্রেণীর আলেমের দিক থেকে আসে। যারা ঘোর সংকীর্ণতা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগে। আত্মবিশ্বাসের অভাব বিপজ্জনক। তখন নিজেদের কর্তৃত্ব বহাল রাখবার জন্য তারা দাবি করে কোরানের পঠন-পাঠন ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে তাদেরই এচেটিয়া অধিকার। তারা নিজেদের ইসলামের অন্দর মহলের একমাত্র পাহারাদার দাবি করে। সেখানে আর কারো প্রবেশাধিকার নাই। কিন্তু ইসলামে কোরান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কাউকে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব দেওয়া হয় নি। ইসলামে কোন ভ্যাটিকান নাই। আল্লার সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক সরাসরি। কোন ভায়া মিডিয়া নাই।

যদি আমরা বুঝতে পারি কোরবানির বয়ান কোরানুল করিম এবং বাইবেলে পৃথক ও ভিন্ন তখনই আমরা এই ভিন্নতার তাৎপর্য অন্বেষণ ও নির্ণয়ের তাগিদ উপলব্ধি করব। তখনই এই পার্থক্যকে বোঝার জন্য আমাদের সকল বৃত্তিকে সজাগ করে তুলব। দেখা যাবে পার্থক্যের উপলব্ধি নতুন চিন্তার সম্ভাবনা দ্রুততর করে। সেই সম্ভাবনার সূত্রগুলো চিহ্নিত করবার মধ্য দিয়ে সম্ভাব্য প্রাথমিক কাজগুলো আমরা শুরু করতে পারি। সেটাই আমরা করতে চাইছি। আশা করি ধীরে ধীরে আমরা আমাদের কথা আরও স্পষ্ট বোঝাতে পারব। নতুন ভাষা রপ্ত করাও আমাদের সাধনার একটা জায়গা।

তাই এখানে বৈশ্বিক পেক্ষাপট খানিক আলোচনা করা হয়েছে, যাতে আমাদের আগামি কিস্তিগুলো ভালভাবে বোঝা যায়। সন্ত্রাস এবং সহিংসতার জন্য ইসলাম ও মুসলমানকে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে কোরানকে দায়ী এবং অভিযুক্ত করবার শক্তিশালী ধারা রয়েছে। আমরা তা নাকচ করি। ধর্ম এবং সেকুলার চিন্তার মধ্যে 'আধুনিকতা' যে ভেদ আবিষ্কার করে এবং ধর্মকে সেকুলার চিন্তার বাইরে রাখার ভান করে -- তারই পরিণতি। একে বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক ভাবে মোকাবিলা করতে হবে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস ও সহিংসতার জন্য ইসলাম ও মুসলমানদের বিশেষ ভাবে দায়ী করা হয়। এই দায় চাপানো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সমরনীতির অন্তর্গত। অর্থাৎ ইসলাম সন্ত্রাসীদের ধর্ম বলে এই যুদ্ধ মুসলিম প্রধান দেশ কিম্বা অন্যান্য দেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য চালাতে বাধ্য হচ্ছে। এই যুক্তি দিয়ে তারা আধুনিক ক্রুসেড অর্থাৎ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পক্ষে ন্যায্যতা ও সম্মতি তৈরি করে। ইসলাম ও মুসলিম জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে জর্জ বুশের কথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ‘ক্রুসেড’ই বটে।
তবে এই ক্রুসেড আদতে ইহুদি বা খ্রিস্টান ধর্ম বিশ্বাসীদের ক্রুসেড না, বরং সারা দুনিয়ার মজলুম জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে বিশ্ব পুঁজির যুদ্ধ। এটা মর্ডান পুঁজিতান্ত্রিক ক্রুসেড। এর মর্মে রয়েছে সারা দুনিয়ার মজলুম জনগণের বিরুদ্ধে অল্পকিছু বহুজাতিক কোম্পানির সামরিক আগ্রাসন। যা এখন বিশ্বব্যাপী বহুজাতিক কোম্পানির পক্ষে নজরদারি, 'বিগ ডাটা' এবং জীবন ও জগতকে ডিজিটাল বাইটে রূপান্তরিত করবার প্রক্রিয়ায় পরিণত হচ্ছে। সেকুলার রূপ নিয়ে, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ হাজির বটে কিন্তু তার রাজনৈতিক মর্ম আধুনিক বিজ্ঞান ও টেকনলজি্র বিশেষ চরিত্র থেকে আলাদা না। সেকুলার জোব্বা পরালেও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের ক্রুসেড বা ইহুদি-ক্রিস্টিয় মর্ম আমাদের ধর্ম, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে রাজনৈতিক বর্গে রূপান্তরিত করে। কিন্তু ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক পর্যালোচনা একটা পর্যায়ে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার বিচার এবং সম্ভাব্য বিপ্লবী রাজনীতির দিশাও আমাদের দেবে।

সেই লক্ষ্যে এখানে 'গুড মুসলিম' ও 'ব্যাড মুসলিম' নিয়ে কিছু প্রাথমিক আলোচনা করেছি। আশা করি সুনির্দিষ্ট বৌদ্ধিক বিচার কিম্বা রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক আলোচনা-পর্যালোচনা বাদ দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে কারা ‘গুড’ এবং কারা ‘ব্যাড’ – এই দুই প্রকার বিভাজনের রাজনীতি সম্পর্কে আমরা সতর্ক হয়ে যাব।

দুই

ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী কালপর্বে গ্রিক-খ্রিস্টিয় চিন্তা পরাধীন জনগোষ্ঠির ধর্ম, ঐতিহ্য ও ভাবচর্চার ধারাকে ধ্বংস করেছে অথবা প্রান্তিক করে রেখেছে। বৈশ্বিক চিন্তার বিপরীতে পরাধীন জনোগোষ্ঠির চিন্তা ও ভাবচর্চার ইতিহাস ‘স্থানীয়’ গণ্য করা হয়। তাদের গণ্য করা হয় সার্ব্জনীন চিন্তার বাইরে বিশেষ বা সীমিত চিন্তা হিশাবে। যেমন, পাশ্চাত্যের ইহুদি বা খ্রিস্টানদের দর্শনকে আলোচনার সময় তাকে বলা হয় ‘দর্শন’। কিন্তু মুসলমানদের চিন্তা বা দর্শনের সার্বজনীন দিক আছে এটা মেনে নেওয়া হয় না। তাদের দর্শনকে তাই বলা হয় ‘ইসলামি দর্শন’। একই ভাবে আছে হিন্দু বা ভারতীয় দর্শন, বৌদ্ধ দর্শন, ইত্যাদি। শুধ্য দর্শন না। এর ফলে পরাধীন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির চিন্তা ও ঐতিহ্য নৃতাত্ত্বিক বিষয়ের অধিক কিছু হয়ে উঠতে পারে না। ইসলাম তখন এনথ্রপলজি বা নৃতত্ত্ব হয়ে যায়। সার্বজনীন, সজীব ও সক্রিয় চিন্তা চর্চায় স্বীকৃতি পায় না। এটাই মোটামুটি বাস্তবতা।


bush_whitehouse
"The attack took place on American soil, but it was an attack on the heart and soul of the civilized world. And the world has come together to fight a new and different war, the first, and we hope the only one, of the 21st century. A war against all those who seek to export terror, and a war against those governments that support or shelter them." President George W. Bush, October 11, 2001


 

টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগন হামলার পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতিতে শুধু নয়, চিন্তার পরিমণ্ডলেও তুফান তৈরি করেছে, নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগন হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট তাকে ‘ক্রুসেড’ বলেছিলেন। এর পর পরই বুশের নিজের দেশেই এর প্রতিবাদ হয়। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের শিরোনাম করে 'Crusade' Reference Reinforces Fears War on Terrorism Is Against Muslims। তারা আশংকা প্রকাশ করেন জর্জ বুশের বক্তৃতায় ‘ক্রুসেড’-এর রেফারেন্স দেওয়ায় এই আশংকাই তীব্র হবে যে যুদ্ধটা আসলে বিশ্বের মুসলমানদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হচ্ছে।

ওয়াল স্ট্রিট জর্নলের নিজস্ব সাংবাদিক Peter Waldman এবং Hugh Pop লিখেছিলেন, ‘তাহলে এটা ‘ক্রুসেড’? এর মর্ম যাই হোক ক্রুসেড শব্দ ব্যবহার যে কৌশলগত ভুল সেটাই আসলে তাঁরা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন। তাঁরা ব্যাখ্যা করে বলেন, “যদি এর খাঁটি মানে ধরি তাহলে ক্রুসেড হোল হাজার বছর আগে মুসলমানদের কাছ থেকে তাদের পবিত্র ভূমি দখল করে নেবার জন্য খ্রিস্টানদের সামরিক অভিযান। কিন্তু ইসলামি দুনিয়ার প্রায় সর্বত্র যেখানে ধর্ম আর তাদের দৈনন্দিন জীবন এমন ভাবে ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে যা অধিকাংশ মার্কিনের পক্ষে বোঝা অসম্ভব। ‘ক্রুসেড’ শর্টহেন্ডে তাদের কাছে অন্য কিছু বোঝায়: ক্রুসেড হচ্ছে সেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক হামলা; মুসলমানদের ভয়, মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্য তাদের পরাধীন করা এবং তাদের ধর্ম ইসলামকে অপবিত্র করা”।

কিন্তু যা বলার বুশের মুখ থেকে সেটা বেরিয়ে গিয়েছে। থুতু ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। সারা দুনিয়ার ইসলাম ধর্মালম্বিরা বুঝে গিয়েছে যুদ্ধটা তাদের ভূমি, তাদের ধর্ম বিশ্বাস, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই পরিচালিত হচ্ছে। সেই সময়কালের প্রেসিডেন্ট বুশ দাবি করেছিলেন টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনের ওপর হামলা মার্কিন ‘ভ্যালু’ বা মার্কিনীদের মূল্যবোধ বা আদর্শের ওপর হামলা। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ‘ক্রুসেড’ কথাটা তার ‘ওয়ার্ল্ড ভিউ’ বা তার বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বলেছেন। কিন্তু তাঁর বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গী ইসলাম ধর্মালম্বীরা মেনে নেবে তার তো কোন যুক্তি থাকতে পারে না। বরং দুনিয়ার মুসলিম মনে করবে টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগন হামলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার বর্তমান পররাষ্ট্র নীতি থেকে সরিয়ে আনবার মরিয়া চেষ্টা। বিশেষত ইসরাইলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরংকুশ সমর্থন এবং মধ্য প্রাচ্যে সকল অগণতান্ত্রিক ও গণবিরোধী শাসকদের পূর্ণ সমর্থনের নীতি। এই নীতির ফলে ফিলিস্তিনী জনগণের ওপর চরম অবিচার হয়েছে এবং হচ্ছে। অন্যদিকে মধ্য প্রাচ্যে মার্কিন সমর্থিত একনায়কতান্ত্রিক সরকারকে নিরংকুশ সমর্থন দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই সব দেশের জনগণের সকল গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রচেষ্টা নস্যাত করে দেবার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। তাহলে জর্জ বুশ যেভাবে বিশ্ব নিয়ে ভাবছেন, মুসলিম বিশ্ব সেভাবে বিশ্ব নিয়ে ভাবে না। জীবন ও জগতের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দৃষ্টিভঙ্গী পরস্পর বিরোধী। ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নালের এই বক্তব্যেই বোঝা যায় প্রেসেডেন্ট যখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে ‘ক্রুসেড’ বলেন, তিনি আদতে পুরানা খ্রিস্টিয় ধর্মযুদ্ধকেই আধুনিক কালে চালিয়ে যাবার ডাক দিচ্ছেন।

বলাবাহুল্য, জর্জ বুশ এরপর এই শব্দ ব্যবহার থেকে বিরত থেকেছেন। এটা অবশ্য করতেই হোত নইলে এটাই প্রতিষ্ঠিত হোত যে খ্রিস্টিয় পাশ্চাত্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বের সকল মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। একে এরপর ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধ যুদ্ধ’ হিশাবেই যুক্তরাষ্ট্র তাদের সরকারী ভাষ্যে বদলে নেয়। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (War on Terror) কথাটা জর্জ বুশ প্রথম ব্যবহার করেন ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০১ তারিখে। সারা দুনিয়ার ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ‘ক্রুসেড’কে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ বলার কৌশল গ্রহণ করা হয়। এর ফলে মার্কিন সমর নীতি ও কৌশলেও বদল এলো।

মুসলমানদের দুই ভাগে ভাগ করা হোল। এক দিকে রয়েছে যারা ‘ভাল মুসলমান (Good Muslim), গুড মুসলিম। ‘ভাল মুসলমান কি? যারা ‘সন্ত্রাস’ করে না। সবসময় নামাজ-কালাম আল্লা-বিল্লা করে। রাজনীতি থেকে দূরে থাকে। সেকুলারদের মতো বিশ্বাস করে রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম সাংঘর্ষিক। দুইটাকে তারা আলাদা রাখে, মেলায় না। ধর্মকে পাশ্চাত্য সেকুলারদের মতোই গুড মুসলিম ইহকাল ও পরকালে ভাগ করে। দাবি করে ধর্ম প্রাইভেট ব্যাপার, পরকালের বিষয়। ইহলোকে ধর্মের কোন ভূমিকা নাই। যফি থাকে তবে তার ভূমিকা একটাই। সেটা হোল ‘মুসলমান’ হিসাবে আইডেনটিটি কার্ড বহন করা, অর্থাৎ নিজের ধর্মীয় পরিচয়কে প্রধান করে তোলা। নিজেকে স্রেফ মুসলমান হিশাবে পরিচয় দেওয়া। বাংলাদেশের মতো দেশে এই আইডেনটিটি কার্ডধারী বা পরিচয় সর্বস্ব গুড মুসলিমদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় অন্য ধর্ম সম্প্রদায়ের চেয়ে তাদের ধর্ম কতো ছহি, কতো ভাল ইত্যাদি প্রমাণে ব্যস্ত থাকা। তাদের দ্বিতীয় প্রধান কাজ হচ্ছে কে মুশরিক, কে মুসলমান না, কে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছে ইত্যাদি। বিভিন্ন ব্যাক্তি বা গ্রুপকে ট্যাগ দিয়ে সমাজকে ক্রমাগত বিভক্ত ও বিষাক্ত করে রাখাই তাদের প্রধান কাজ হয়ে ওঠে। যেন ঐক্যবদ্ধ ভাবে পাশ্চাত্যের এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়বার নৈতিক শক্তি মুসলিম সমাজ হারিয়ে ফেলে। এই বিভাজন ও খণ্ডীভন পাশ্চাত্যের সমর নীতির অংশ, কারন একটি জনগোষ্ঠিকে দাবিয়ে রাখতে হলে প্রথম কাজ হচ্ছে তাদের বিভক্ত এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে হানাহানিতে লিপ্ত থাকার কাজে উস্কানি দিতে থাকা এবং হানাহানি জারি রাখা।

দ্বিতীয় পক্ষে রয়েছে , বলা বাহুল্য, খারাপ বা বা ‘বদ মুসলমান’। যেমন ওসামা বিন লাদেন, মোল্লাহ ওমর, প্রমুখ। কিম্বা দুনিয়ার যেখানেই নিপীড়ত জনগণ কোরানকে আদর্শগত হাতিয়ার গণ্য করে পাশ্চাত্যের অন্যায় ক্রুসেডের বিরুদ্ধে নিজেদের জনগোষ্ঠিকে রক্ষা করবার জন্য লড়তে নেমেছে তারা ‘ব্যাড মুসলিম’। এরপর তাদের নতুন নাম হয় ‘ইসলামী জঙ্গী’। বিপরীতে পাশ্চাত্যের ক্রুসেডের বলী হয়েও যারা পাশ্চাত্যের পরাধীনতা মেনে নেয় তারা ‘ভাল মুসলমান’। আইডেন্টিটি কার্ডধারী পরিচয় সর্বস্ব মুসলমানদের প্রধান কাজ হয়ে ওঠে তারা কতোটা ভাল, কতোটা ‘গুড’ সেটা প্রমাণ করা। যেমন হিন্দুরা কতো খারা বৌদ্ধরা কতো মন্দ, কিন্তু দেখ আমরা মুসলমানরা কতো ভাল। অর্থাৎ পরিচয়সর্বস্ব বা পরিচয়বাদী মুসলমান ভালমন্দ নির্ণয় করে অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিপরীতে। অন্য ধর্ম দিয়ে নিজের ধর্মের তুলনাই তার নিজের ধর্মকে বোঝার একমাত্র পথ হয়ে ওঠে। যে সমাজে সে সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই সমাজে এই পরিচয়বাদ অনিবার্য ভাবেই হয়ে ওঠে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষদের উপর আধিপত্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা ও মতাদর্শ । অন্যদিকে নিজের জনগোষ্ঠিকে পাশ্চাত্য হানাদারদের হামলা ও অন্যায় যুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করার বাস্তব কর্তব্য তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। পাশ্চাত্য শক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে তাদের তার নিজের জনগোষ্ঠির একাংশকে ‘জঙ্গী’ আখ্যা দিতে দ্বিধা করে না। নিজেকে সে শার্মিক পরিচয় দিতে তৎপর থাকে, কোনটা ছহি বা কোনটা প্রকৃত ইসলামে সেই তর্কে তার বিপুল আগ্রহ দেখা যায়। কিন্তু অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে জিহাদ বা লড়াইকে সে তার ধর্মীয় বা নৈতিক কর্তব্য গণ্য করে না। ধর্মের কোন ইহলৌকিক ভূমিকা নাই, আধুনিক সেকুলারদের এই মতাদর্শের সঙ্গে তার কোন ফারাক থাকে না। তার কাছে শরিয়া পালনই ধর্ম হয়ে ওঠে। সে দাবি করে ধর্ম কোন ইহলৌকিক ব্যাপার না। যদি ধর্মের কোন ইহলৌকিক ভূমিকা না থাকে তাহলে ধর্মের কাজ কি? ‘গুড মুসলিম’-এর কাছে দোজখের আজাব থেকে রক্ষা পাওয়া কিম্বা জান্নাতে যাওয়ার বাসনা পূরণ, ইত্যাদি।

বিস্ময়কর হলেও গুড মুসলিমদের সঙ্গে সেকুলার বা ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীদের বিশ্বাসের সঙ্গেই প্রগাঢ় মিল। তাদের অতিরিক্ত ধর্ম প্রীতির কারনে যা আমরা সাধারণত সহজে ধরতে পারি না। তাদের সঙ্গে সেইসব সেকুলারদের সঙ্গেই মিল যারা মনে করে ইহলৌকিক কোন পরিমণ্ডলে ধর্মের কোন ভূমিকা থাকা উচিত না। সেকুলারদের দাবি, ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। একে কোন ভাবেই রাজনীতিতে, সংস্কৃতিতে কিম্বা আর্থ-সামাজিক পরিসরে নীতিগত সিদ্ধান্ত নির্ণয়ের ক্ষেত্রে টেনে আনা যাবে না। সেটা ঠিক হবে সেকুলার অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি দ্বারা। অর্থাৎ গুড মুসলিমরা, সোজা কথায় মুখে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলুক বা না বলুক সমাজ সংস্কৃতিতে রাজনীতিতে ধর্মের কোন ভূমিকা আছে মনে করে না। কারণ ধর্ম তাদের কাছে একান্তই পারলৌকিক ব্যাপার। জগত সুস্পষ্ট ভাবে ইহলোক ও পরলোকে ভাগ হয়ে যায়। কিন্তু তাদের ‘পারলৌকিকতা’ সেকুলারদের ‘ব্যক্তিগত পরিসর’ বা প্রাইভেট ধর্মেরই আরেক নাম মাত্র।

এদের বিপরীতে তথাকথিত ‘বদ মুসলমান’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্য শক্তির উদ্যোগে পরিচালিত ক্রুসেডের বিরুদ্ধে জানপ্রাণ দিয়ে লড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের সমর্থকরা, বলা বাহুল্য, খারাপ মুসলমানদের ‘জঙ্গী বলে আখ্যায়িত করে। ক্রুসেডের বিপরীতে স্বভাবতই তাদের মতাদর্শও ধর্মীয় মতাদর্শ অর্থাৎ কোরান ও ইসলামি ধর্মতত্ত্ব থেকেই তৈয়ার হয়। যুদ্ধের রূপ যদি ধর্মযুদ্ধ হয় তার জবাবও অনিবার্য ভাবে ধর্মযুদ্ধের ভাষায় বা জিহাদের ভাষাতেই ঘটে। সেই ক্ষেত্রে গুড মুসলিম ও ব্যাড মুসলিমদের মধ্যে ‘জিহাদ’-এর ব্যাখ্যা নিয়ে তুমুল তর্ক শুরু হয়। সেই তর্ক প্রবল ভাবে জারি রয়েছে। উভয় পক্ষই নিজ নিজ ভূমিকার ন্যায্যতা ধর্মগ্রন্থ থেকে প্রমাণ করবার জন্য তীব্র বাদানুবাদে জড়িত রয়েছে। এর ফলে কোরানুল করিম আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ বা ক্রুসেডের সমরনীতি নির্ণয়ের কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠেছে।

মাহমুদ মামদানি ভাল মুসলমান ও বদ মুসলমানের বিভাজনের কারণ আরেক দিক থেকে বিচার করেছেন। দুই হাজার এক সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে ইসলাম ও সন্ত্রাসবাদের মধ্যে যোগসূত্র আবিষ্কার দেশে বিদেশে গণমাধ্যমগুলোর কেন্দ্রীয় বিষয় ও প্রধান উদ্বেগ হয়ে ওঠে। ফলে সংস্কৃতি ও সভ্যতার তর্ক আবারও পুরা দমে সামনে চলে আসে। স্বভাবতই সংস্কৃতি ও সভ্যতার তর্কে ধর্ম প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। কিন্তু ইন্টারেস্টিং হোল, সেটা নাগরিক বনাম সন্ত্রাসী হিশাবে শুরু হোল না। শুরু হোল ‘গুড মুসলিম’ আর ‘ব্যাড মুসলিম’ হিশাবে। পাশ্চাত্য ঠিক করা শুরু করল কারা ভাল মুসলমান আর কারা খারাপ বা সন্ত্রাসী। ব্যক্তির ধর্মীয় অভিজ্ঞতাটাই হয়ে উঠল রাজনৈতিক বর্গ। গুড মুসলিমরা ভাল, আর ব্যাড মুসলিমরা সন্ত্রাসী – এই বিভাজন শুরু হয়ে গেল তপ বটেই কিন্তু ধর্মীয় অভিজ্ঞতা রাজনৈতিক বর্গ হয়ে ওঠাটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইসলামও আগের মতো স্রেফ ধর্ম হিশাবে রইল না, বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বর্গ হয়ে উঠল। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি মুসলমানকে নতুন করে প্রমাণ করতে হোল সেকি শুধু ধর্ম কর্ম রোজা-নামাজ করে, নাকি রাজনীতিও করে? যদি রাজনীতি করে তবে সেটা ব্যাড মুসলিমের উদাহরণ। কারণ রাজনীতি তাকে সন্ত্রাসীতে রূপান্তরিত করতে পারে।

এই বিভাজনেরই আরেক রূপ হচ্ছে ইসলাম বনাম পলিটিকাল বা রাজনৈতিক ইসলামের ধারণা। শুধু ইসলাম ভাল, কিন্তু রাজনৈতিক ইসলাম খারাপ। হেফাজতে ইসলাম যখন ঘোষণা দেয় যে আমরা কাউকে ক্ষমতায় বসাতে কিম্বা নামাতে আসি নি – এটা হেফাজত করতে বাধ্য হয় বিশ্বব্যাপী এই গুণগত পরিবর্তনের ফলে। এই চাপ নিছকই রাষ্ট্রযন্ত্রের বা গোয়েন্দাদের চাপ নয়। কারন প্রতিটি ইসলামী আন্দোলন আভ্যন্তরীণ বা ভেতর থেকে এই নৈর্ব্যক্তিক চাপে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যেতে বাধ্য। প্রতিটি মাদ্রাসাকে প্রতিদিন প্রমাণ করতে হয় তারা সন্ত্রাস লালন পালন করছে না, মাদ্রাসা থেকে কোন সন্ত্রাসীও বেরুচ্ছে না। তারা ‘গুড’ মাদ্রাসা, তারা শুধু ‘গুড মুসলিম’ বানায়। কোন ‘ব্যাড মুসলিম’ বানায় না। কিন্তু অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এই প্রমাণ দিতে হয় না। কিন্তু প্রতিটি মাদ্রাসা সার্বক্ষণিক ভাবে দেশবিদেশের গোয়েন্দাদের নজরদারির অধীনে থেকে প্রমাণ করে যেতে হয় হয় যে তারা ‘গুড’ মাদ্রাসা। অতএব প্রতিটি মুসলমানকেও এখন প্রমাণ করতে হবে সেকি ‘গুড’? নাকি ‘ব্যাড’? ইসলাম নিয়ে কোন বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা করলেই তাকে আগে প্রমাণ করতে হবে তার উদ্দেশ্য কি? সে কি মৌলবাদ ও ইসলামী সন্ত্রাস উসকে দিচ্ছে? নাকি উদ্দেশ্য অন্য কিছু?

ইসলামী আন্দোলনের মধ্যেও এই বিভাজন স্পষ্ট। কারা ‘মানহাজি’ বা কারা ‘মানহাজি’ না ইসলামি আন্দোলনের মধ্যে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিভাজন। এই বিভাজনের মানদণ্ড অনুযায়ী মানহাজিরা ‘ব্যাড মুসলিম’, বিপরীতে যারা লিবারেল ডেমোক্রাসির সুবিধা নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন সহ দাওয়া ও প্রচার করে, নির্বাচনের মাধ্যমে ইসলাম কায়েম করত্যে চায় তারা ‘গুড’। মানহাজিরা ব্যাড, কারন তারা সশস্ত্র জেহাদ চায়।

আমরা চাই বা না চাই বাংলাদেশে ইসলাম আগামি দিনে নির্ধারক ভূমিকা পালন করবে। প্রশ্ন হচ্ছে সেই ভূমিকার রূপ কেমন হবে? সেই রূপ নির্ণয়ে সক্রিয় ও সজীব চিন্তার কোন ভূমিকা থাকবে কিনা? আমাদের আগ্রহ সুনির্দিষ্ট ভাবে এখানেই। সেটা নির্ভর করবে ইসলাম নিয়ে ইসলামের ভেতর থেকে এবং ইসলামের আভ্যন্তরীণ ঐতিহাসিক তর্কবিতর্কের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আমরা ইসলাম নিয়ে নতুন ভাবে ভাবতে সক্ষম কিনা। আমাদের দাবি সেটা সুষ্ঠ ভাবে সম্ভব যদি আল্লার কালাম এবং আমাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকে আমরা কঠর ভাবে আলদা রাখার অভ্যাস করি। নিজেদের খোদা ভেবে আমামদের ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত ব্যাখ্যা দাবি না করি। আগামি দিনে ইসলামের ভূমিকার বাস্তবোচিত ও কার্যকর ভূমিকার দিশা দিতে পারার ওপর বাংলাদেশের জনগণের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে। তার জন্য আমাদের অবশ্যই স্থানীয় ও বৈশ্বিক অবস্থা এবং বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতা বোঝা দরকার। সঠিক ও কার্যকর রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল নির্ণয়ের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।

মাহমুদ মামদানি তার বইয়ে লিখেছেন ইসলাম ও মুসলমানদের ধর্মীয় অভিজ্ঞতাকে রাজনৈতিক বর্গে রূপান্তরিত করবার করবার উদ্দেশ্য লুকানো। কেমন সেই গুপ্তাগুপ্তি? সেটা বঝা সহজ। যেমন, ‘ক্রুসেড’-কে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে লুকানো বা আড়াল করে রাখা। হোক আফগানিস্তান, প্যলেস্টাইন, কাশ্মির বা বাংলাদেশ বা যে কোন দেশ, ইসলামকে অবশ্যই কোয়েরেন্টাইন বা লকড ইন করে রাখতে হবে। গুড মুসলিম /ব্যাড মুসলিম বর্গ ইসলামের সঙ্গে সোশাল ডিস্ট্যান্সিং রক্ষা করার দরকার, ইসলামের ভেতরে যে ‘ইভিল’ বা দুষ্ট দানব লুকিয়ে আছে সেই ভূত ঝাড়তে হবে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে কি করতে হবে মামদানি তার একটা প্রস্তাব করেছেন। প্রথম কাজ হচ্ছে ইসলামকে কোয়ারান্টাইন রাখার পাশ্চাত্য নীতি ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। ইসলাম যাদের চিন্তা, সংস্কৃতি ও জীবন যাপনের অংশ তাকে সেভাবেই গণ্য করতে হবে। যেখানে মুসলমান জনগোষ্ঠি অন্যান্য ধর্ম, ধর্মীয় অভজ্ঞতা ও ধর্মীয় জীবনের পাশা পাশি বাস করছে সেখানে ইসলাম হয়ে উঠবে আরও বৃহত্তর জীবনের পরিসর গড়ে তোলার জন্য সমগ্র মানবজাতির সঙ্গে সম্বন্ধ রচনার ভিত্তি। সেই সম্বন্ধ হবে আল্লাহ, ঈশ্বর বা গড যে নামেই ডাকি সেই রুহানিয়াতের মধ্যস্থতায়। কারণ ইসলাম বিশ্বাস করে আমরা সকলেই এক জোড়া মানব ও মানবীর পরিণতি। তাহলে কিভাবে আমরা আলাদা হয়ে গেলাম? আমাদের চিন্তার গলদ্গুলো কোথায় সেটা নির্ণয়ের জন্যই আমদের কোরানুল করিমের কাছে ফিরে যেতে হবে।

এরপর টেবিল পাশ্চাত্যের দিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে। মুসলমানদের মধ্যে যদি গুড/ব্যাড থাকে তাহলে পাশ্চাত্য ধোয়া তুলসি পাতা না, তাদের মধ্যেও ‘গুড পশ্চিমা’ ও ‘ব্যাড পশ্চিমা’ আছে। মামদানি ‘সভ্যতার দ্বন্দ্ব’ নামক পাশ্চাত্য সমর নীতি সংক্রান্ত থিসিস নাকচ করে দিতে চান। স্যামুয়েল হান্টিংটনের এই তত্ত্বের অনুমান হচ্ছে প্রতিটি সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে পরস্পরের কাছ থেকে স্বাধীন ভাবে। এমনই যে তারা যেন কোন দিন পরস্পরের মুখোমুখি হয় নাই। তাদের মধ্যে কোন সংমিশ্রণ, আদান-প্রদান, চিন্তার দ্বন্দ্ব, বিরোধ আর বিনিময়ের ইতিহাস নাই। কিম্বা শত্রু হিশাবেও তারা পরস্পরের মুখোমুখি হয় নাই। এর ফলে হান্টিংটন ধরে নিয়েছেন ভাল হোক মন্দ হোক ইসলামি রাজনীতি এই রকম বিচ্ছিন্ন ভাবে গড়ে ওঠা ইসলামি সভ্যতার পরিণতি, আর পাশ্চাত্যের চোখ ধাঁধানো ক্ষমতা একান্তই পশ্চিমা সভ্যতারই ফল মাত্র। মামদানি হান্টিংটনের এই অনুমান ঠিক বলে মানেন নি। বরং তিনি মনে করেন ইসলামি রাজনীতি এবং পাশ্চাত্যের ক্ষমতার জন্ম দুইয়ের মুখোমুখি হবার বা ‘এনকাউন্টারের’-এর ফল হিশাবে। দুটোর একটিকেও এই মুখোমুখি হবার ইতিহাস থেকে আলাদা করে কিছুই বোঝা যাবে না। সিভিলাইজেশান বা সভ্যতার দ্বন্দ্ব তাই আগাগোড়াই অন্তঃসারশূন্য দাবি। এই দাবি দীর্ঘ ইতিহাস এবং ইতিহাসের অন্তর্গত নানান জটিল জিজ্ঞাসা এড়িয়ে যেতে চায়। তাই সংস্কৃতি বা সভ্যতার কেচ্ছা বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চায়ের দীর্ঘ ও জটিল এনকাউন্টার আমরা বুঝব না। ইসলামের সঙ্গে প্রাচ্যের দ্বন্দ্ব হান্টিংটনের কায়দায় বোঝা যাবে না।

যদি মুসলিম ব্যক্তি চেতনাকে ‘অকৃত্রিম’ (authentic) ভাবে বোঝার জন্য শুধু তার সংস্কৃতি ও সভ্যতার অন্দর মহল থেকে আমরা বোঝার চেষ্টা করি, তখন ব্যক্তির কিম্বা সমষ্টির রাজনৈতিক পরিগঠনকে আমরা অনৈতিহাসিকতায় (dehistoricise) পর্যবসিত করি। এটা ব্যক্তিকে তার ইতিহাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে পরিচয় জিজ্ঞাসা করা। বাংলাদেশে এটা আমরা সহজে বুঝব যদি আমরা সাংস্কৃতিক ভাবে আনিসুজ্জামানের ‘মুসলিম মানস’ এবং আহমদ ছফার ‘বাঙালি মুসলমান মন’ মির্ণয়ের পদ্ধতির প্রতি খানিক নজর দেই। উভয়েই বাঙালি মুসলমানের ‘অকৃত্রিম’ সত্তা নির্ণয় করতে চেয়েছে রাজনৈতিক কর্তা হিশাবে তাদের লড়াই সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসের বাইরে সমাজে, ভাষায় এবং ছফার ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে বট তলার পুঁথি ও মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদসিন্ধু’ গ্রন্থে। তাহলে আমাদের শুধু সাহিত্য ও সংস্কৃতির হদিস নিলে হবে না ব্যক্তির পরিচয় নির্ণয়ের ঐতিহাসিক ও ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সব সময়ই মনে রাখতে হবে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে মাহমুদ মামদানির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হচ্ছে সন্ত্রাস বা সহিংসতাকে সবচেয়ে ভাল বোঝা যাবে আধুনিক নির্মাণ হিশাবে। এটা হান্টিংটনীয় ধর্ম, ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির ব্যাপার না। হয়তো ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উপাদান একটু আধটু এখান সেখান থেকে এসে থাকতেই পারে, কিন্তু শেষ মেষ এটা আধুনিকতার প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিণতি, আধুনিকতারই বাদ্য, মর্ডানিটির বাজনা। এই ক্ষেত্রে আমরা তাঁর সঙ্গে একমত। যেমন, আমরাও দেখিয়েছি  ‘মনের পশু’ কোরবানির তত্ত্ব কিভাবে খ্রস্টীয় চিন্তা থেকে এসেছে। কিন্তু একে হাজির করা হচ্ছে নীতিবাগীশ তর্ক হিশাবে, পশুপ্রেমের বরাতে।

আমাদের কোরবানি সংক্রান্ত আলোচনায় এর প্রাসঙ্গিকতা কি?

সন্ত্রাস এবং সহিংসতার জন্য ইসলাম ও মুসলমানকে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে কোরানকে দায়ী এবং অভিযুক্ত করবার শক্তিশালী ধারা রয়েছে। আমরা তা নাকচ করি। এটা  ধর্ম এবং সেকুলার চিন্তার মধ্যে আধুনিকতা যে ভেদ আবিষ্কার করে এবং ধর্মকে সেকুলার চিন্তার বাইরে রাখার ভান করে তারই পরিণতি। একে বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক ভাবে মোকাবিলা করতে হবে। সবার আগে বোঝা দরকার আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস ও সহিংসতার জন্য ইসলাম ও মুসলমানদের বিশেষ ভাবে দায়ী করা হয়। এই দায় চাপানো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সমরনীতির অন্তর্গত। অর্থাৎ ইসলাম সন্ত্রাসীদের ধর্ম বলে এই যুদ্ধ মুসলিম প্রধান দেশ কিম্বা অন্যান্য দেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য চালাতে বাধ্য হচ্ছে। এটা ইসলাম ও মুসলিম জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে জর্জ বুশের কথিত ‘ক্রুসেড’ই বটে।

কিন্তু এই ক্রুসেড আদতে ইহুদি বা খ্রিস্টান ধর্ম বিশ্বাসীদের ক্রুসেড না, বরং সারা দুনিয়ার মজলুম জনগোষ্ঠির  বিরুদ্ধে বিশ্ব পুঁজির যুদ্ধ। এটা মর্ডান পুঁজিতান্ত্রিক ক্রুসেড।  এর মর্মে রয়েছে সারা দুনিয়ার মজলুম জনগণের বিরুদ্ধে অল্পকিছু বহুজাতিক কোম্পানির যুদ্ধ। সেটা চলছে সেকুলার রূপ নিয়ে, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামে। কিন্তু সেকুলার জোব্বা পরালেও এর অন্তর্গত ইহুদি ও খ্রস্টিয় ধর্মীয় রূপটা আমরা সহজেই ধরতে পারি যখন আমাদের ধর্ম, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে রাজনৈতিক বর্গে রূপান্তরিত করা হয়। বুঝতে পারি সুনির্দিষ্ট বৌদ্ধিক বিচার কিম্বা রাজনৈতিক তর্ক ও  আলোচনা-পর্যালোচনা বাদ দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে কারা ‘গুড’ এবং কারা ‘ব্যাড’ – এই দুই প্রকার রাজনৈতিক বর্গে শত্রু মিত্র  চিনবার এবং চিনিয়ে দেবার চর্চায়। জর্জ বুশ পরিষ্কার বলেছেন, হয় তোমরা আমাদের পক্ষে, অথবা তোমরা শত্রু শিবিরে। মুসলমানদের এখন জর্জ বুশের কাছে প্রমাণ করতে হবে তারা গুড মুসলিম নাকি ব্যাড মুসলিম। যদি ব্যাড হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট  তাদের নির্মূল করবে। সেকুলার পাশ্চাত্যের শত্রু মিত্র নির্ধারণের ক্ষেত্রে ধর্ম  প্রধান মানদণ্ডে পরিণত হয়েছে।

একই বিভাজন দ্বারা ইসলামকে একদিকে নিছকই ধর্ম ও ধর্মতত্ত্ব আর অন্যদিকে মার্কিন ও পাশ্চাত্য শক্তির দুষমন হিশাবে ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ নামক নতুন বর্গ তৈরি করা হয়। এই বর্গবিভাগ ইসলামপন্থিদেরও বিভক্ত করে। একপক্ষ মনে করে ইসলামকে রাজনীতি থেকে মুক্ত করা ও মুক্ত রাখা উচিত। আরেক পক্ষ তাদের রাজনৈতিক তৎপরতাকে ধর্মীয় ভাবে ন্যায্য প্রমাণ করবার জন্য সচেষ্ট থাকে। সেটা তারা করে নিজেদের ইসলামের একচ্ছত্র, একমাত্র,  প্রকৃত বা ছহি ধারক ও বাহক গণ্য ও প্রতিষ্ঠিত করবার দরকারে। ইসলাম একদিকে হয়ে যায় পাশ্চাত্য অর্থে ‘রিলিজিয়ন’, প্রাইভেট ব্যাপার এবং অন্যদিকে রাজনৈতিক ইসলাম। ইসলাম আর ‘দ্বীন’ থাকে না। আমরাও বিশ্বাস করতে শুরু করি ইসলামকে এভাবে বিভক্ত করা যায়।  তাহলে কেন যায় না এবং না গেলে কিভাবে ইসলাম নিয়ে আলোচনা করলে এই বিভক্তি আমরা এড়াতে পারব তা নিয়েই আমাদের  আলোচনা ও পর্যালোচনা

তাহলে শুরুতেই বুঝতে হবে এই যুদ্ধ ইসলাম বা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদি বা খ্রিস্টানদের যুদ্ধ নয়, মর্ডান ক্রুসেডের ফ্রন্ট লাইনে আছে বহুজাতিক কোম্পানি। অন্যদিকে শত্রুর বিরুদ্ধে ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্বব্যাপী গণমানুষের বোঝাপড়া ও ঐক্য কিভাবে গড়ে তোলা যায় সেই কাজের নীতি ও পদ্ধতি নির্ণয় করাই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য। সেই লক্ষ্যে এই তিনটি ধর্ম পরস্পর থেকে কিভাবে আলাদা কিন্তু একই সঙ্গে কিভাবে তারা ঐতিহাসিক ভাবে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত সেই ইতিহাস কোরানুল করিম ঘনিষ্ঠ ভাবে পাঠ করে অনুধাবন অতীব জরুরী  হয়ে পড়েছে। মানবেতিহাসের চিন্তার বিকাশের দিক থেকে কিভাবে তারা তিনটি পর্যায়  বা পর্ব সেই দিকটাও বুঝে নেওয়া এই সময়ের অত্যন্ত জরুরি কাজ।

শুধু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নয়, পাশ্চাত্যের সেকুলার ক্রুসেড চেতনা বাংলাদেশের চিন্তা চেতনাতেও গভীর ও প্রকট ভাবে হাজির রয়েছে। সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তার প্রবল উপস্থিতি অনায়াসেই আমরা টের পাই। ইসলাম বিদ্বেষ ও ইসলাম নির্মূলের রাজনীতির বিরুদ্ধে আমি দীর্ঘকাল ধরে লড়ছি। শাহবাগের ঘটনার সময় আমার উৎকন্ঠা দৃশ্যমান রূপ নিয়ে প্রকট ভাবে দুই হাজার তেরো সালে হাজির হয়। এর বিপরীতে একটি জাতিবাদী ইসলামী ধারা গড়ে ওঠে, যারা দাবি করে ইসলাম হেফাজত করবার একমাত্র এবং একচ্ছত্র রক্ষাকারী তারা। তাদের দাবি ইসলাম আমাদের ধর্ম হলেও আমাদের সরাসরি কোরান পড়া ও পাঠের অধিকার নাই। আমরা কোরান পড়ে বুঝব না। একমাত্র তাদের মাধ্যমেই আমাদের কোরান পড়তে হবে। শুধু তাদের তাফসির ও ব্যাখ্যাই মানতে হবে। নতুন বিশ্ব বাস্তবতায় কোরানকে নতুন ভাবে পাঠ এবং বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় কোরানুল করিমের তাৎপর্য অনুধাবনে আর কারো অধিকার নাই। 

বিপজ্জনক দিক হোল, তারা কোরান ও ইসলামকে সমগ্র মানব জাতির জন্য নাজিল হয়েছে মনে করে না। তাদের ধারণা কোরানুল করিমে শুধুমাত্র ‘মুসলমান জাতি’র এখতিয়ার। বাহ্যিক ভাবে পরস্পর বিরোধী মনে হলেও ইসলাম বিদ্বেষী এবং  ইসলাম রক্ষার একচ্ছত্র দাবিদার -- উভয়েই আধুনিকতার করুণ কিন্তু হিংস্র পরিণতি। জাতিবাদী ইসলাম ইসলাম বিদ্বেষী বাঙালি জাতিবাদেরই অপর পিঠ।

একই সাপের দুই মুখ আমরা মোকাবিলা করব। ইনশাল্লাহ।

০২ অগাস্ট ২০২১।। শ্যামলী।

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।