ক্রসফায়ার প্রসঙ্গ: প্রথম অংশ


বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে পাক্ষিক চিন্তার গবেষণায় প্রকাশিত 'ক্রসফায়ার: রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড

বইয়ের প্রসঙ্গ কথাটি এখানে পাঠকের জন্য পত্রস্থ করা হলো। আজ প্রথমাংশ।

বাংলাদেশে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান

আমাদের দেশে যারা কমবেশি রাজনীতির খবরবার্তা রাখেন। আমার ধারণা আপনারা সবাই একটি বিষয় সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। বিষয়টি হলো, ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের পূর্বে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি একটি ওয়াদা করেছিল, যদি তারা নির্বাচিত হতে পারে তা হলে, দেশ থেকে সন্ত্রাস নির্মূল করে ছাড়বে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে আমরা দেশবাসী সন্ত্রাস নির্মূলের ক্ষেত্রে তাদেরকে একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখেছি। যাকে চার দলীয় জোট সরকার তাদের পাঁচ বছরের শাসনামলে সব থেকে কার্যকর এবং সফল পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করেছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া স্বয়ং তার বয়ানে অনেক সমাবেশে, অসংখ্যবার তাদের সেই সাফল্যের ফিরিস্তি দেশবাসীকে জানিয়েছেন। শুনিয়েছেন। অর্থাৎ সন্ত্রাস নির্মূলের প্রশ্নটি ছিলো বিএনপি-র কাছে রাজনৈতিক কর্মসূচি ও নির্বাচনী ওয়াদা।

অন্যদিকে আমরা প্রত্যেকেই জানি তাদের সন্ত্রাস নির্মূলের গৃহীত পদক্ষেপের সঙ্গে দেশে সংগঠিত চলমান ক্রসফায়ারের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। অর্থাৎ বিএনপি-র ঘোষিত রাজনীতি, সরকার গঠন ও ক্রসফায়ার পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বা অবিচ্ছেদ্য একটি বিষয়। কারণ আমরা কমবেশি সবাই জানি যে, একটি দেশে সরকারের পালাবদলের পর নবগঠিত সরকারের সামনে অনেকগুলো লক্ষ্যবস্তু থাকে। তার মধ্য থেকে যে কোনো একটি লক্ষ্যকে নবগঠিত সরকার প্রাধান্য দেয়। যেমন কোনো সরকার দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, পুনর্বাসন ও জনগণের উন্নতির প্রশ্নটাকে প্রাধান্য দিতে পারে। কোনো সরকার খাদ্য উৎপাদনকে প্রাধান্য দিতে পারে। কেউবা গণশিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে পারে। কেউবা নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতে পারে। কোনো সরকার প্রতিরক্ষার প্রশ্নে প্রাধান্য দিতে পারে। কোনো সরকার অপর একটি দেশ দখলের বিষয়টিতে প্রাধান্য নিতে পারে। আবার কোনো সরকারের কাছে দেশের আইন শৃঙ্খলার প্রশ্নটি প্রাধান্য পেতে পারে। এভাবে একটি সরকার যে বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করে বা প্রাধান্য দিয়ে থাকে, রাষ্ট্রক্ষমতা সেই প্রশ্নকে ঘিরেই প্রধানভাবে আবর্তিত হয়। ক্ষমতা কাঠামো সেই বিষয় ঘিরেই মূর্ত হয়ে ওঠে। যেমন আমাদের দেশে ২০০১ সালের নির্বাচনের পূর্বে বিএনপি-র নির্বাচনী ওয়াদা ছিলো দেশের আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন এবং সন্ত্রাস নির্মূল। এভাবে নির্বাচনী ওয়াদা বা অঙ্গিকার করা বরাবরই বিমূর্ত একটি বিষয়। কিন্তু সেই বিমূর্ত বিষয়টি যখন প্রয়োগে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তাদের রাজনীতি ওই কর্মসূচি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠে। অর্থাৎ তাদের সন্ত্রাস নির্মূলের ঘোষণা ছিলো বিমূর্ত। কিন্তু পদক্ষেপ হিসেবে ক্রমফায়ারের ঘটনা মূর্ত ও নির্দিষ্ট। যা জোট সরকারের দাবি অনুযায়ী তাদের পাঁচ বছরকালের মধ্যে সবচেয়ে সফল একটি কর্মসূচী এবং স্বয়ং খালেদা জিয়া দেশবাসীকে সরকারিভাবেও তা জানিয়েছেন। ফলে তাদের সরকার, ‘রাষ্ট্রক্ষমতাকে’ সন্ত্রাস নির্মূল বা ক্রসফায়ার সংগঠিত করার ক্ষেত্রে প্রধানভাবে কাজে লাগিয়েছেÑ এটাই তাদের দাবি।

জোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পরই সন্ত্রাস দমনে প্রথম দফায় সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে। যা আমাদের সবার কাছে অপারেশন ক্লিনহার্ট নামে পরিচিত। এতে করে দেশের সেনাবাহিনী একটি বিতর্কের মধ্যে পড়ে। নানা ধরনের প্রশ্ন ওঠে। সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সেদিন দুই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়। প্রথমত, সন্ত্রাস দমনের পদক্ষেপ থেকে সেনাবাহিনীকে উইড্র করা। দ্বিতীয়ত, দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করা। যার সহজ অর্থ হলো সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য যদি সত্যিকার অর্থে বিনাবিচারে কাউকে হত্যা করেও থাকে, সেই দায় থেকে রাষ্ট্র তাকে অব্যাহতি দিচ্ছে। উক্ত সেনাসদস্যের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা যাবে না। মামলা করা হলেও তা খারিজ হয়ে যাবে, ধোপে টিকবে না। ঘোষণাটি স্বয়ং রাষ্ট্রের। দায়মুক্তি অধ্যাদেশের মূল কথা ছিলো এটাই।

এরপর দ্বিতীয় দফায় আমরা জোট সরকারের দলীয় সন্ত্রাসী ও ইসালামী ধারার একটি রাজনৈতিক দল বা জেএমবি-র ক্যাডারদেরকে যৌথভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলে সন্ত্রাস নির্মূলে মাঠে নামতে দেখি। এই যৌথবাহিনীর হাতে অনেকেই খুন হন। তাদের অত্যাচারে অনেকেই চিরকালের জন্য পঙ্গু হয়ে যান। রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রত্যক্ষ মদদেই সেটা ঘটে। পদ্ধতি হিসেবে সরকারের গৃহীত এ পদক্ষেপ (দলীয় ও সংগঠিত সন্ত্রাসীদের দিয়ে ভিন্নমতালম্বীদের খুন) সেদিন ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়ে। দেশ-বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে থাকে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি সামনে চলে আসে। ফলে জোট সরকারকে এবারও পিছু হঠতে হয়। কারণ পদ্ধতিটি ছিলো সম্পূর্ণই আইন বহির্ভূত।

এর পর পরই তারা গ্রহণ করে তৃতীয় পদক্ষেপ, যা ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশে ক্রসফায়ার নামে খ্যাত। এবং সেটা দেশে জরুরি অবস্থা চলাকালীন সময় বা ফকরুদ্দিনের শাসনামলেও চলমান। তবে এক্ষেত্রে একটি লক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। জোট সরকারের গৃহীত ক্রসফায়ারের পদক্ষেপ পূর্বে বর্ণিত পদক্ষেপের তুলনায় অনেকটা ব্যতিক্রমধর্মী। যেমন অপারেশন ক্লিনহার্টে অংশগ্রহণকারী সেনা সদস্যদের দায়মুক্তির প্রশ্ন ছিলো। যে কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করতে হয়। আর দ্বিতীয় পদক্ষেপ অর্থাৎ সরাসরি রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় দলীয় ও সংগঠিত ক্যাডার বাহিনী দিয়ে ভিন্ন মতাবলম্বীদের হত্যা করা,এটা ছিলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে মানবাধিকার বা আইন লঙ্ঘনের কোনো বিষয় নাকি নেই। যদিও দাবিটা ছিলো জোট সরকারের। তা হলে, প্রশ্ন দাঁড়ায় ক্রসফায়ার কি রাষ্ট্রের আইনগত ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যেই ‘আইনি হত্যাকাণ্ড’, নাকি নাগরিকদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিনা বিচারে খুন। হ্যাঁ এটা নিয়ে বরাবরই একটা বিতর্ক রয়েছে।

আমরা সবাই জানি বিগত সরকার ক্রসফায়ার সংগঠিত করার জন্য র‌্যাব নামের আরেকটি বিশেষ বাহিনী তৈরি করেছে। তার আরেকটি ভিন্ন নাম আছে, এলিট বাহিনী। অনেকের দৃষ্টিতে আমাদের দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটকারী নব্য এলিট শ্রেণীর প্রয়োজনে এই এলিট বাহিনী। দেশের আর্মস ব্যাটেলিয়ন অধ্যাদেশের অধীনে এই ফোর্স গঠন করা হয়। তার পরপরই জোট সরকার ক্রসফায়ারে নামে। অর্থাৎ ক্রসফায়ার সংঘঠনের সঙ্গে এলিট বাহিনী যেমন যুক্ত, বিএনপি-র রাজনীতিও তেমনি যুক্ত বলে অনেকে মনে করেন।

অন্যদিকে আমরা সবাই জানি জোট সরকারের পক্ষ থেকে ২১ শে জুন, ২০০৪ সালে র‌্যাব গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। ২৪ শে জুন, ২০০৪ সালে প্রথম র‌্যাবের হাতে ক্রসফায়ারের ঘটনায় একজন মারা পড়ে। তারপর থেকে ক্রসফায়ার প্রতিনিয়ত ঘটমান একটি বিষয়। যেমন ১৮ ই অক্টোবর, ২০০৪ সালে দেশের ৬৪ টি জেলায় র‌্যাব একযোগে অপারেশনে নামে। ২৬ শে অক্টোবর, ২০০৪ সালে র‌্যাব গঠনের বৈধতা নিয়ে আদালতে একটা মামলা দায়ের হয়। কিন্তু তার ফলাফল শূণ্য। কারণ তার পরপর শুধু র‌্যাবই নয়, দেশের পুলিশ বাহিনীও প্রতিযোগিতামূলকভাবে ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটাতে থাকে এবং সংখ্যাগতভাবে ক্রসফায়ারের ঘটনা বাড়তে থাকে। দেশ-বিদেশে নানামুখি প্রশ্ন ওঠে। অনেকেই ক্রসফায়ারকে বিনাবিচারে হত্যাকাণ্ড হিসাবে চিহ্নিত করেন। অনেকে এটাকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় হিসেবে দেখেন। অনেকে ক্রসফায়ারকে দেশের সংবিধানে ঘোষিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেন। অনেকেই ভাবেন র‌্যাবের জন্যও দায়মুক্তি অধ্যাদেশের অথবা ইনডেমনিটির প্রয়োজন হবে। আবার অনেকেই র‌্যাব বাহিনীর অস্তিত্ব বিলুপ্তির কথা বলেন। এভাবে র‌্যাব গঠন এবং ক্রসফায়ারের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা চলতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ২৯ শে অক্টোবর, ২০০৪ সালে বাংলাদেশে ক্রাইম রিপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এক ইফতার মাহফিলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ঘোষণা দেন, র‌্যাবের জন্য ইনডেমনিটির কোনো প্রয়োজন নেই; কারণ সন্ত্রাসীরা র‌্যাবকে আক্রমণ করলে, তখন আত্মরক্ষার তাগিদে র‌্যাবও পাল্টা গুলি করে, এতে করে সৃষ্ট ক্রসফায়ারে সন্ত্রাসীর মৃত্যু ঘটছে। ফলে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থায় ইনডেমনিটির কোনো প্রসঙ্গ আসে না। অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্যে যে বিষয়টি স্পষ্ট ছিলো তা হলো, ক্রসফায়ারে ঘটা হত্যাকাণ্ডের একটা আইনগত নায্যতা রয়েছে। তবে এখানে আমাদের আরো একটি কথা স্মরণ রাখা জরুরি যে, জোট সরকার আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছিলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অধীন।

ঘটনা যাই হোক না কেন, এরপর ১৩ই ডিসেম্বর ২০০৪ সালে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল হক ভূঁইয়া, স্বাস্থ্য ও জীবাণুবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. খায়ের আহমেদ, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. ইসমাইল হোসেন, প্রফেসর সাজেদা আক্তার, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান, কৃষি অর্থায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রইস উদ্দিন মিয়া, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক রেহানা আক্তার, বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রভাষক সাবিনা ইয়াসমিনসহ ২০৬ জন শিক্ষক এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে র‌্যাব গঠনকে স্বাগত জানায়। অর্থাৎ র‌্যাব গঠনের পক্ষে বিপক্ষে যে বিতর্ক চলছিল, ওই বিতর্কের সূত্র ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০৬ জন শিক্ষক একটি পক্ষ নেন। র‌্যাব গঠনকে তাঁরা ন্যায্য মনে করেন বা ঘুর পথে ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ডের স্বীকৃতি দেন বা ক্রসফায়ারকে ন্যায্য মনে করেন।

এর কিছু কাল পরে আমরা র‌্যাবের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরেকটি ভিন্ন বিষয় লক্ষ্য করি। ২৫ শে ডিসেম্বর শনিবার, ২০০৪ সালে র‌্যাবের চট্রগ্রাম শাখা তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ‘ক্রসফায়ার’ শব্দের পরিবর্তে ‘এনকাউন্টার’ শব্দ ব্যবহার করে। প্রসঙ্গটিতে র‌্যাব চট্টগ্রামের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী এমদাদুল হক দেশবাসীকে জানান, সন্ত্রাসীরা হামলা চালালে, সেটা প্রতিরোধের অধিকার র‌্যাবেরও রয়েছে। আত্মরক্ষার্থে র‌্যাবকেও অনেক সময় গুলি চালাতে হয় এবং দুইপক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় কালে কোনো সন্ত্রাসীর মৃত্যু হলে তাকে এনকাউন্টার বলে। ক্রসফায়ার থেকে এনকাউন্টার শব্দটি আরো যুক্তিযুক্ত।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, র‌্যাবের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর, তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে হুবহু একই ভাষায় কয়েকশত ক্রসফায়ার নামক খুনের গল্প ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। এতে করে এক পর্যায়ে তারা তাদের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কাহিনীটা একই রেখে ‘ক্রসফায়ার’ -এর পরিবর্তে ‘লাইন অব ফায়ার’ নামে একটা টার্ম ব্যবহার করে। কিন্তু তাতেও খুব বেশি ফল দেয় না। সমালোচনা চলতেই থাকে। তার পরপরই তাদের এই এনকাউন্টার শব্দের ব্যবহার। প্রশ্ন উঠতে পারে এটা কেন? এ প্রসঙ্গে দেশের অনেক গবেষকদের মতামত হলো আমাদের উপমহাদেশের ক্ষেত্রে ‘এনকাউন্টার’ শব্দের একটি রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। যেমন আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ৭০-এর দশক জুড়ে নকশাল ধারার রাজনৈতিক কর্মীদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিনাবিচারে হত্যা করার সময় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে এনকাউন্টার শব্দের প্রচলন ঘটানো হয়েছিল। নেপালেও মাওবাদীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে হত্যা করার সময় একই শব্দের ব্যবহার হয়েছে। আমাদের দেশেও র‌্যাব গঠন এবং ক্রসফায়ার নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা চলছিল, সেটা নিরসনেই হয়তবা লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী এমদামুল হক এনকাউন্টার শব্দটি ব্যবহার করে সুস্পষ্টতই একটি বিশেষ ইঙ্গিত দেন। অর্থাৎ কারা প্রকৃত অর্থে এনকাউন্টারের টার্গেট? যাতে করে দেশের অশান্ত বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হতে পারেন।

র‌্যাব পরিচালকের উক্ত ঘোষণার ১২ দিন পর, ৬ই জানুয়ারি ২০০৫ সালে বিএনপি-র একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব, যিনি আবার একইসঙ্গে ছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ নারায়ণগঞ্জে আইনজীবীদের এক সমাবেশে তাদের সরকারের পক্ষ থেকে আরো স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দেন, আমরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে এটি র‌্যাবের যুদ্ধ। ফলে ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার ঘটনা কোনোভাবেই মানবাধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। অর্থাৎ শুরুতেই যে প্রশ্নটা তোলা হয়েছে, ২০০১ সালের নির্বাচনী ইস্তেহারে বিএনপি যে রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল, সান্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আইনমন্ত্রী সেটা সেদিন আরো স্পষ্ট করে দেশবাসীকে জানিয়ে দেন। ফলে আমরা ধরে নিতে পারি। বিগত চার দলীয় জোট সরকারের ঘোষিত যুদ্ধের নাম ছিলো ক্রসফায়ার এবং সেই যুদ্ধের সৈনিক নবগঠিত র‌্যাব। এবং তাদের ঘোষিত যুদ্ধ যেহেতু তাদের রাজনৈতিক প্রোগ্রাম, সেহেতু তাদের ভাষায় সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে পারে না। সেটা ছিলো তৎকালীন আইন মন্ত্রী ও প্রধান মন্ত্রীর ভাষ্যের মূল কথা।

ক্রসফায়ার কি তা হলে প্রচলিত আইনেরই বিশেষ একটা রূপ

আমরা যারা সংবাদপত্র ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার নিয়মিত পাঠক, শ্রোতা ও দর্শক। তারা সকলেই চলমান ক্রসফায়ারকে কেন্দ্র করে র‌্যাব- পুলিশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি থেকে একটা বিষয়ে স্পষ্ট। সেটা হলো ক্রসফায়ার মানে গ্রেফতারকৃত বন্দীকে বিনা বিচারে খুন করা। এবং এদেশের জনগণ প্রক্রিয়াটিকে বিনাবিচারে হত্যাকাণ্ডই বলে থাকেন। কিন্তু বিগত জোট সরকার তা অস্বীকার করেছে। অস্বীকার করেছে র‌্যাব-পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাদের দাবি ছিলো ক্রসফায়ারের বিষয়টি কোনোভাবেই বেআইনি প্রক্রিয়া নয়। আমরা এ-প্রশ্নে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরসহ তাদের সমর্থিত বুদ্ধিজীবীদের ভাষ্যেও সেটা দেখেছি। কিন্তু ক্রসফায়ার নিয়ে আলোচিত বইটির কাজ করতে গিয়ে সমাজের নানান বর্গের মানুষ অনেক মন্তব্য করেছেন। তার উপরে দাঁড়িয়ে একটা প্রশ্ন প্রথমেই উঠিয়েছি। সেটা হলো ক্রসফায়ার কি তা হলে রাষ্ট্রের আইনি কাঠামোর মধ্যে সংঘঠিত হত্যাকাণ্ড? যাকে সরাসরি রাষ্ট্রীয় গণহত্যা বলা চলে? ফলে বিষয়বস্তু হিসেবেই এর একটি পর্যালোচনা হওয়া দরকার।

দেশে যখন ক্রসফায়ার শুরু হয়, তখন অনেক আইনজ্ঞই নানান কিসিমের মতামত রাখেন। তার উপরে ভিত্তি করে একটি কথা স্পষ্টভাবেই বলা চলেÑ দেশের সংবিধানে যতই মানবাধিকারের ঘোষণা থাকুক না কেন। ক্ষমতাসীন সরকারগুলো চাইলেই বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপি) ৫৪ ও ১৬৭ ধারাকে ভিত্তি করে অনায়াসেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে। ক্ষমতার অপব্যবহার বলতে এখানে স্পষ্টতই আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে হত্যাকাণ্ড বা খুন করা বোঝানো হচ্ছে তাদের মতে এসব ক্ষমতা সংক্রান্ত আইনের মধ্যে বিশেষ ক্ষমতা আইনটি জারি করেছিল শেখ মুজিবের আওয়ামী সরকার ১৯৭৪ সালে এবং ৫৪ ও ১৬৭ ধারা দুটি চালু করা হয় বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে। ১৮৯৮ সালে বা ১০৯ বছর পূর্বে। সম্পূর্ণই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই এসব আইন তৈরি করা হয়েছিল, যাতে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ওই আইন ব্যবহার করা যায়।

বিশেষ ক্ষমতা আইনে যে কাউকে যে কোনো সময় গ্রেফতারসহ ১ মাসের আটকাদেশ দেওয়া যায়। আবার ৫৪ ও ১৬৭ ধারায় অভিযোগ ছাড়াই পুলিশ যে কাউকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ, জোরপূর্বক (নিপীড়ন করে) স্বীকারোক্তি আদায় এবং রিমান্ডে নিতে পারে। এখন ধরা যাক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে একটা বিশেষ তালিকা প্রস্তুত করে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাদেরকে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যেই খুন করার নির্দেশ দিল। এটা কি আদতেই সম্ভব? আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হ্যাঁ সম্ভব। এবং আমরা গত কয়েক বছর ধরে ক্রসফায়ার নামে তা সংঘটিত হতে দেখছি। ফলে প্রশ্ন দাঁড়ায় সেই আইনি প্রক্রিয়ার প্রায়োগীক রূপটা কেমন, সেটা নিয়ে।

আইন প্রয়োগকারি সংস্থা হিসেবে র‌্যাব-পুলিশ ওই তালিকা ধরে ৫৪ ও ১৬৭ ধারায় তাদের গ্রেফতার করল। এরপর তাদের উপরে শারীরিক নিপীড়ন চালিয়ে বেশ কিছু মার্ডার কেসের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকার তথাকথিত স্বীকৃতি আদায় করল। এমনকি তার অমুক বন্ধুর কাছে অস্ত্র রয়েছে এ-ধরনের স্বীকৃতিও। এসব স্বীকারোক্তি টিপসইসহ পুলিশ ফাইলে নথিভুক্ত করা হলো। একই সঙ্গে তাদের ওই নিপীড়নমূলক অবস্থার ভাষ্য ক্যাসেটে রেকর্ডবন্দি করা হলো। তারপর গ্রেফতারকৃতকে নিয়ে যাওয়া হলো কথিত অস্ত্র উদ্ধারে। এবং তার পরের ইতিহাস তো আমরা জানি। যাকে সরকারের পক্ষ থেকে ক্রসফায়ার বলা হচ্ছে। আর সাধারণ মানুষ বলছেন হত্যাকাণ্ড। আইন বিশেষজ্ঞদের আরো দাবি ক্রসফায়ার নামে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল (পিআরবি) নামের আইনের উপরে ভিত্তি করে। এবার সেই প্রশ্নটা একটু খতিয়ে দেখা যাক।

ক্রসফায়ারের আইনগত দিক

পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল (পিআরবি) অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট অথবা পুলিশ সদর দফতরের পূর্বানুমতি ছাড়া এই সংস্থার সদস্যরা গুলি ছুড়তে পারে না। কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে তার ব্যতিক্রম রয়েছে। বিশেষ তিন ধরনের পরিস্থিতিতে পূর্বানুমতি ছাড়া তারা গুলি চালাতে পারে।

ক) মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বা যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কোনো আসামী পালানোর চেষ্টা করলে, সেই প্রচেষ্টা রুখতে তারা গুলি চালাতে পারে।

খ) দাঙ্গা দমনকালে প্রথমে হুসিয়ারী, তারপর পর্যায়ক্রমে লাঠিচার্য, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও রাবার বুলেট ছোঁড়া; এর পরেও যদি দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন ওই দাঙ্গা রুখতে তারা গুলি চালাতে পারে।

গ) আবার বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে যদি কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘিœত হয় (ওঁৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা গুলি চালালে, যা ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে তাদের বহুল আলোচিত ভাষ্য) তা হলে, সেক্ষেত্রেও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বা আত্মরক্ষার স্বার্থে তারা গুলি চালাতে পারে। উপরে বর্ণিত এই তিন ধরনের পরিস্থিতিতে তারা গুলি চালালেও পরবর্তীতে পুলিশ বিভাগের নিজস্ব এক্সিকিউটিভ ইনকোয়ারিসহ বিচার বিভাগীয় তদন্ত হতে হবে। তদন্তের মাধ্যমে উক্ত বিভাগগুলো দেশবাসীকে জানাবে গুলি ছোঁড়া জাস্টিফাইড ছিলো কি না? উল্লিখিত আইনগুলোকে জনসাধারণের বোধগম্য ভাষায় উপস্থিত করে যে বিষয়টি স্পষ্ট করতে চাচ্ছি তা হলো, কিভাবে আইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার ইচ্ছা করলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে নির্বিচারে খুন করতে পারে। অর্থাৎ বিশেষ ক্ষমতা আইনে বা ৫৪ ধারায় যে কাউকে আটক, ১৬৭ ধারায় তথাকথিত স্বীকারোক্তি আদায়; অতঃপর অস্ত্র উদ্ধারে যাওয়া, কল্পিত ওঁৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়া এবং কর্তব্যরত অবস্থায় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বা আত্মরক্ষায় পাল্টা গুলি চালানো। ফলাফল একটাই, উক্ত গুলি বিনিময়কালে শুধুমাত্র ধৃত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটা। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তিকে আটক করা হলে, আইনই হবে তার হেফাযতকারী। তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব সম্পূর্ণই আইনের। এটাই মানবাধিকারের কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি। ধৃত ব্যক্তিকে আইন বা আইন রক্ষাকারীবাহিনী নিরাপত্তা দেয়নি। বরং বন্দী অবস্থায় হত্যাকাণ্ডকেই আইনগতভাবে জাস্টিফাইড করা হয়েছে বলে আইনজ্ঞরা মনে করেন।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে ধৃত ব্যক্তি যদি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে মারা যায় তা হলে, বিধি অনুযায়ী একটা তদন্ত হবে। তদন্তটি আবার দুটি অংশে বিভক্ত।

একটি অংশ হলো বিচার বিভাগীয় তদন্ত, যা পরিচালনা করার দায়িত্ব জেলায় ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট এবং মেট্রোপলিটন সিটিতে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট অথবা তাদের নিয়োগকৃত ম্যাজিস্ট্রেটের।

তদন্তের অপর অংশটি নির্বাহী তদন্ত, যা পরিচালনা করার দায়িত্ব পুলিশের এএসপি পদমর্যাদাসম্পন্ন একজন কর্মকর্তার। উভয় তদন্তে যদি গুলি ছোঁড়াটা জাস্টিফাইড হয় তাহলে মামলাটির আইনগত বৈধতা থাকবে না, এটাই রাষ্ট্রীয়বিধী। আর যদি তদন্তে গুলি ছোঁড়াটা জাস্টিফাইড না হয়, তাহলে ওই গুলি ছোঁড়াটা হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হবে। তখন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পরিবার বা তার আত্মীয়জন অথবা রাষ্ট্র নিজে বাদি হয়ে মামলা করতে পারে।

এখানে লক্ষণীয় যে, গত কয়েক বছর ধরে র‌্যাব-পুলিশের গুলিতে বা তাদের ভাষায় কথিত ক্রসফায়ারে যতগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, প্রতিটি মৃত্যুর ক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ৩০২ ও ৩০৪ ধারায় মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হাতে গোণা ৭-৮ টি মামলা দায়ের করেছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার। বাদবাকি মৃত্যুর ক্ষেত্রে বাদী সরকার ওরফে র‌্যাব বাহিনী বা পুলিশ প্রশাসন।

দণ্ডবিধি ৩০২ ধারাটি হচ্ছে হত্যা অথবা খুনজনিত অপরাধ। আর দণ্ডবিধি ৩০৪ ধারা হচ্ছে, যদি কোনো ব্যক্তি খুন হয় বা এ-ধরনের অপরাধজনক প্রাণহানি করে অথবা কাজটিতে যদি তার মৃত্যু ঘটে, কাজটি করলে মৃত্যু হতে পারে বলে জানা থাকে, অথচ কাজটি মৃত্যু সংঘঠনের উদ্দেশে করা হয়নি, এমন অপরাধ। এই দুই ধারায় মূলত মামলা হয়েছিল।

এসব মামলার বাদী ছিলো স্বয়ং পুলিশ বা র‌্যাব। তাদের দাবি তারা খুন করেনি ঘটনাটি ছিলো ক্রসফায়ার। আবার হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটে গভীর রাতে। এবং ঘটনাস্থলে ওইসব সংস্থার সদস্য ছাড়া অন্য কারো উপস্থিতি ছিলো না। অবশ্য কোথাও কোথাও ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজনকে ডেকে জোর করে সাদা কাগজে সই করে নেওয়া হয়েছে, তারও অনেক তথ্য প্রমাণ রয়েছে। এতে করে মামলার ফলাফলগুলো যা হওয়া উচিৎ বলে জোট সরকার নির্ধারণ করেছিল, তাই-ই হয়েছে। অর্থাৎ র‌্যাব-পুলিশের ক্রসফায়ারে প্রায় সব মৃত্যুর ‘জুডিসিয়াল ইনকোয়ারি’ ও ‘নির্বাহী তদন্ত’ শেষ হয়েছে। বিধি অনুযায়ী দুই ধরনের তদন্তেই গুলি ছোঁড়া বা ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ড জাস্টিফাইড বা যুক্তিযুক্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। এখন কেউ মামলা করতে চাইলেও ওই মামলা আইনগত বৈধতা পাবে না। এই বিধান স্বয়ং রাষ্ট্রের। এর অন্যতম কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অধিকাংশ পরিবারের সদস্যরা কেউই মামলা করতে যায়নি। তাদের মতামত ছিলো রাষ্ট্র স্বয়ং বাদী হয়ে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করছে। ফলে মামলা করে কোনো ফায়দা হবে না। আর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের বাইরে আমরা তো খালেদা জিয়া এবং আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমেদের বক্তব্য দেখেছি। তারা তো ক্ষমাতাসীন হওয়ার পূর্বেই একটা যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে বা যুদ্ধের অঙ্গিকার নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছিল। মানবাধিকার রক্ষার তাগিদ বা ঘোষণা তাদের ছিলো না।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে তদন্তের অপর অংশ, বিচার ব্যবস্থার মতামত নিয়ে। আমাদের স্মরণ রাখা দরকার বিচার ব্যবস্থার যে অংশটি তদন্তের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলো। ওই অংশটি সরকারের নির্বাহী ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আর প্রতিটি সরকার তাদের ইচ্ছামতো ওই অংশকে ব্যবহার করছে। এই দাবিটা শুধু জনগণের নয়, খোদ বিচার বিভগেরও। তা ছাড়া, ’৭১ পরবর্তী বাংলাদেশের জন্মলগ্ন কাল থেকে ক্যাডার প্রশাসনে চাকরির প্রধান অংশটি রাজনৈতিক যোগাযোগের মধ্য দিয়েই ঘটেছে। ’৭৩ সালে জনাব তোফায়েলের ক্যাডার বাহিনী দিয়ে এই প্রশাসনের যাত্রা শুরুর কথা আমরা প্রায় সবাই জানি।

অপরদিকে সরকারের দাবি সংঘটিত ক্রসফায়ার প্রশ্নে অপারেশন ক্লীনহার্টের মতো কোনো দায়মুক্তি অধ্যাদেশের প্রয়োজন নেই। কারণ রাষ্ট্রীয় ভাষায় ঘটনাটি স্বয়ং আইনগত প্রক্রিয়া। তারপরেও ওটার প্রয়োজন পড়ত যদি এক্ষেত্রেও রাষ্ট্রীয় বাহিনী হিসেবে সেনাবাহিনী নামান হত। কেননা আর্মি ‘ল’ এবং পুলিশ ‘ল’-র মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। এই অন্যতম কারণে আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়ন অর্ডিনান্সের অধীনে র‌্যাব গঠন করা হয়। যাতে হত্যাকাণ্ডগুলো প্রচলিত আইনি কাঠামোর মধ্যেই থাকে। প্রচলিত আইনেই তাকে ন্যায্যতা দেওয়া যায় বলে অনেকে মনে করেন।

একইসঙ্গে জোট সরকার ’৭৪ সালে আওয়ামী শাসনামলের মত আর্মির প্যারালাল বা তার চেয়ে অধিক মানসম্পন্ন রক্ষিবাহিনী সৃষ্টি করে ক্রসফায়ার সংঘটিত করতে যায়নি। কারণ তা করতে গেলে ক্ষমতা কাঠামো টালমাটাল হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। খোদ আর্মিরই বিগড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। ফলে পুলিশী মর্যাদার অধীনে অধিক ক্ষমতা এবং বিশেষ সুযোগ,সুবিধা দিয়ে এই এলিট ফোর্স বা র‌্যাব গঠন করা হয়েছে বলে অনেক সমাজ বিশ্লেষক মনে করেন।

আলোচনার এই অধ্যায়ে আরেকটি প্রসঙ্গ উত্থাপন করা জরুরি। বিষয়টি হলো পুলিশ বাহিনী বা পুলিশ অধ্যাদেশ নিয়ে। মূলত আমাদের উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ১৮১৩ সালে প্রথম পুলিশবাহিনী গঠন করে। তখন উপমহাদেশ জুড়ে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে কৃষক-জনতার লড়াই চলছিল। ব্রিটিশ সেদিন এই পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলেই মুক্তিকামী জনগণকে প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য। পুলিশ প্রশাসন পরিচালনার জন্য যেসব আইন বাংলাদেশেও বিশেষভাবে গণ্য হয়ে আসছে, তার মধ্যে পুলিশ আইন ১৮৬১, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮, পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল ১৯৪৩ অন্যতম। পরবর্তীতে উল্লিখিত আইনের উপরে ভিত্তি করে মেট্রোপলিটন পুলিশ ‘ল’ ১৯৭৬, ১৯৭৮, ১৯৮৪, ও ১৯৯২ এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অর্ডিনান্স ১৯৭৯ জারি করা হয়েছে। কিন্তু আজো বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ১৮৬১, ১৮৯৮ এবং ১৯৪৩ সালের পুলিশ আইনই হলো পুলিশ বিভাগের মূল আইন। আমাদের স্মরণ রাখা জরুরি যে, ১৮৬১ সালের ওই আইন রচনা করা হয়েছিল উপমহাদেশের জনগণ প্রথম উপমহাদেশে জুড়ে যে স্বাধীনতার সংগ্রামের সূচনা করেন, ১৮৫৭ সালে, তাকে হিসাবে রেখে। আর ১৯৪৩ সালে পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গলও জারি করা হয়েছিল ওই বছরে উভয় বাংলায় কৃষকদের শক্তিশালী তেভাগা লড়াইকে প্রতিরোধ করার জন্য। অর্থাৎ তখনকার দিনে শাসক-শোষিতদের মধ্যে সম্পর্ক ছিলো ঔপনিবেশিক শাসক বনাম নিপীড়িত জাতি ও জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক। তার ভিত্তিতেই ওইসব আইন রচনা এবং তার প্রয়োগ চলে সেদিন। ওইসব আইনের আরো লক্ষণীয় দিক ছিলো, বাহিনী হিসেবে পুলিশের যেন কোনো ধরনের ঘোষিত মানবাধিকারের প্রতি আনুগত্য না-থেকে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি অনুগত থাকে। সরকারও যেন তার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরাসরি ওই সংস্থার তত্ত্বাবধান ও ব্যবহার করতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা। সেইভাবে এই সংস্থার কাঠামোগত বিন্যাসও করা হয় এবং সেই ধারা আজো আমাদের দেশে অব্যহত রয়েছে। তাছাড়া ১৮৬১ সালের আইনে পুলিশ যাতে সরাসরি জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সেই ক্ষমতা তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল। সেই আইনি ধারাবাহিকতা আজো ধরে রাখা হয়েছে। কিন্তু এখানে মৌলিক বিষয়টি হলো এই, একটি রাষ্ট্র যখন নিজেকে স্বাধীন এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করে ও ঘোষণা দেয়, তখন ওই রাষ্ট্রের পুলিশ জনগণের নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি হিসেবে কোনোভাবেই বিবেচিত হতে পারে না। সংস্থা হিসেবে পুলিশ বাহিনী একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি। ফলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, সবার জন্য সমভাবে ন্যায় বিচার পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা, মৌলিক অধিকার হিসেবে মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নে পুলিশের কোনো ধরনের দায়বদ্ধতার প্রশ্ন নেই। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের ঘোষিত সংবিধানের কাছেও পুলিশের কোনো ধরনের দায়বদ্ধতা নেই। তার সমস্ত দায়বদ্ধতা ঔপনিবেশিক যুগের মতো হুবহু ক্ষমতাসীন সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগের কাছে। ঔপনিবেশিক যুগ থেকে একই ধারাবাহিকতা চলে আসছে। ফলে যে সব রাজনৈতিক দল ’৭২ এবং ’৭৫ সালের সংবিধান নিয়ে জনগণকে বিভক্ত করেন এবং কে কতটা গণতান্ত্রিক সেই প্রতিযোগিতায় নামেন। রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা কেউই তাদের ঘোষিত সংবিধান ও মানবাধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত করে পুলিশ বাহিনীর কোনো ধরনের কাঠামোগত সংস্কার তো করেইনি, বরং গত ৩৭ বছর ধরে যে লুটেরা শ্রেণী দেশে শাসন করেছে, অবাধে লুঠপাট করেছে, সেই অবৈধ সম্পদ রক্ষা ও বৈধ করার মানসে পুলিশকে তাদের লাঠিয়াল এবং একই সঙ্গে আইনগত মার্ডারার বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলেছে বলে অনেক আইনজ্ঞরা মনে করেন। যার সব থেকে বড় প্রমাণ দেশে চলমান ক্রসফায়ার। আর বিচার বিভাগের নির্বাহী অংশটি গড়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের আইনগত মদতদাতা হিসেবে। এই মতামতটা শুধু দেশের আইনজ্ঞ বা জনগণের নয়। গত ৩০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক যে সব সংস্থার সঙ্গে আমাদের সরকারগুলোর দহরম-মহরম, সেইসব সংস্থার রিপোর্টেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে দূর্নীতিগ্রস্ত খাত হলো পুলিশ ও বিচার বিভাগ।

একই সঙ্গে আমরা এখন এটাও জানি গত ৩৭ বছরের বাংলাদেশে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিমন্ত্রীর নাম বাবর। তার বাড়িতে অবৈধ অস্ত্র পাওয়া গেছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এ-ধরনের ব্যক্তিদের কাছ থেকে ২০ কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ করে এজাহার থেকে নাম কেটে দিয়েছে। র‌্যাবের গাড়ি কিনতে গিয়ে কয়েক কোটি টাকা লুট করেছে। এবং বর্তমান সরকার তার কাছ থেকেই অবৈধভাবে অর্জিত টাকার সবচেয়ে বেশি আদায় করেছে। দেশের আইন যদি সবার ক্ষেত্রে সমান হয়ে থাকে তাহলে, বাররের অন্তত ১০০ বার ক্রসফায়ার হওয়ার কথা ছিলো, তা কিন্তু হয়নি। র‌্যাবের কর্মকর্তারা কিন্তু এক্ষেত্রে নিশ্চুপ। অর্থাৎ এখন এটা খোলাখুলিভাবে বলা যায় যে, রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে যারা গোটা দেশকে জিম্মি করেছে, রাষ্ট্র ক্ষমতা ব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছে, তারা কেউ ক্রসফায়ারের আওতাভুক্ত নন। এসব রাজনৈতিক লুটেরাদের আইনের কাছে সোপর্দ করা ছাড়া, তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করার ক্ষমতাও রাখে না র‌্যাব বাহিনী।

একইভাবে আমরা র‌্যাব-পুলিশের সংবাদ ভাষ্য থেকে কথিত ক্রসফায়ারের ঘটনার পাশাপাশি অস্ত্র উদ্ধারের তথ্য পাচ্ছি। কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র। যেমন অপারেশন ক্লিনহার্ট চলাকালীন সময়ে, সরকারের পক্ষ থেকে দেশের সমস্ত লাইসেন্সকৃত অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এবং দুই দফা তার মেয়াদও বাড়ান হয়। পরবর্তীকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র থেকে জানান যা, সারা দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ১লাখ ৮৯ হাজার ১৪২ টি। তার মধ্যে যে অস্ত্র জমা পড়েনি তার সংখ্যা ছিলো ৫০ হাজার। যার লাইসেন্স সরকার বাতিল করেছে। আমাদের প্রশ্ন হলো কাদের হাতে সেসব অস্ত্রের মজুদ রয়েছে? এসব অস্ত্রের লাইসেন্স কারা প্রদান করেছে? এবং র‌্যাব ও পুলিশ বাহিনী এই ৫০ হাজার অস্ত্রের মধ্য থেকে এ যাবৎ কয়টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে? তাদের কয়জনকেই বা ক্রসফায়ার দেওয়া হয়েছে? এসব প্রশ্ন উত্থাপন করার অর্থ এমন নয় যে, দেশে সংঘটিত ক্রসফায়ারকে ন্যায্যতা দিতে গিয়ে তা বলা হচ্ছে। মূলত এসব প্রশ্ন তোলার অন্যতম কারণ হলো, এযাবৎ যারা ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন ও আছেন তারাই প্রধানভাবে লাইসেন্সকৃত অস্ত্র এবং অবৈধ অস্ত্রের মালিক। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর তাদের মধ্যে একজন। ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তারাই প্রধানভাবে আইনি ও বেআইনি অস্ত্রের মালিক হয়েছেন। অথচ আমরা শ্রেণীগতভাবে তাদের একজনকেও ক্রসফায়ারে যেতে দেখিনি। একই সঙ্গে অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় ঘোষিত ৫০ হাজার অবৈধ অস্ত্রের মধ্যে ১টি অস্ত্র উদ্ধারের কাহিনীও শুনিনি। তাহলে কি আমরা ধরে নিতে পারি যে, সকল অবৈধ অস্ত্রবাজ র‌্যাব-পুলিশের টার্গেট নয়। সন্ত্রাস নিমূর্ল ও তাদের লক্ষ্য নয়। বিশেষ বিশেষ সন্ত্রাসী ও অবৈধ অস্ত্রধারীদের প্রতি তাদের পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। এবং অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় ৫০ হাজার লাইসেন্সকৃত অস্ত্র, অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে- মূলত অবৈধ কর্মকাণ্ড বাড়িয়ে চলার জন্যই? আমার মনে হয় এই গোটা বিষয় আজ পর্যালোচনা হওয়া দরকার।

ক্রসফায়ারে প্রধানভাবে কারা নিহত এবং মিডিয়া নির্মিত সন্ত্রাসী

এ প্রশ্নের জবাব আমাদের সবারই কমবেশি জানা। র‌্যাব-পুলিশের সংবাদ বিবৃতি এবং মিডিয়াকর্মীদের পরিবেশিত সংবাদ থেকেই আমরা তথ্যগুলো জেনেছি। অর্থাৎ নিহতদের প্রধান অংশই একটা বিশেষ ধারার রাজনৈতিক কর্মী, যাদেরকে সংবাদপত্র-র‌্যাব-পুলিশের কর্মকর্তাদের ভাষ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত, বেআইনি, উগ্রপন্থী বা চরমপন্থী দলের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

দল হিসেবে তাদের নাম হলো

১. পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল),

২. পূর্ব বাংলার কমিউস্টি পার্টি (এম-এল) (জনযুদ্ধ),

৩. পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) (লাল পতাকা),

৪. পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি (সিসি),

৫. পূর্ব বাংলার সর্বহারা পাটি (এমবিআরএম),

৬. বাংলাদেশের বিপ্লবী কউনিস্ট পার্টি (এম-এল),

৭. শ্রমজীবী মুক্তি আন্দোলন

৮. নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি এবং

৯. জাসদ গণবাহিনীর প্রাক্তন কিছু সদস্য

ক্রসফায়ারে নিহতদের ক্ষেত্রে পরিবেশিত সংবাদপত্রের ভাষ্য এবং ওই দলের দাবি অনুযায়ী আমরা এসব দলের নাম পেয়েছি। একইসঙ্গে এসব দলের রাজনীতি পর্যালোচনা করে আমাদের অনেকের কাছে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, ৩৭ বছরের বাংলাদেশে পর পর দুইবার রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে উক্ত বিশেষ ধারার রাজনৈতিক দলসমূহকে নির্মূল করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রথম দফায় ১৯৭৩ সালে রক্ষিবাহিনী সৃষ্টি করে তা করার চেষ্টা হয়েছিল। তখন রাজনৈতিক দল হিসেবে উপস্থিত ছিলো।

১. পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল)

২. পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) এবং

৩. পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতা ও কর্মীরা

আর দ্বিতীয় দফায় ২০০৪ সালে র‌্যাব সৃষ্টি করে সেই চেষ্টার পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে। আবার দুই দফায় চালিত এই অভিযান প্রধানভাবে পরিচালিতই হয়েছে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোতে। ৩৭ বছরের বাংলাদেশে সরকার সমর্থিত মিডিয়াকর্মীরা জনগণকে বারবার জানান দিয়েছে আলোচিত ওই দুইটি বিভাগ নাকি সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। উক্ত জনপদের জনগণ এসব বেআইনি, নিষিদ্ধ দলের কাছে জিম্মি। এসব অভিযোগ আমরা র‌্যাব-পুলিশ ও মিডিয়াকর্মীদের উত্থাপিত অভিযোগ থেকে বিষয়টি জেনেছি। ফলে তাদের উত্থাপিত অভিযোগকে কয়েকটি পয়েন্টে বিভক্ত করে কিছু পর্যালোচনা আমরা করতে পারি।

প্রথমত, আসা যাক নিষিদ্ধ ঘোষিত বেআইনি দল সম্পর্কে। তথ্য জানার অধিকার মিডিয়াকর্মী ও র‌্যাব-পুলিশের কর্মকর্তাদের মতো এ-দেশের প্রতিটি নাগরিকেরই রয়েছে। প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটা নাগরিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। এবং এই অধিকারের উপরে ভিত্তি করে মিডিয়াকর্মীদের কাছে আমাদের প্রথম জিজ্ঞাসা হলো, ৩৭ বছরের বাংলাদেশে কোন সরকার, কত সালের, কোন তারিখে, কত নম্বর আইনি প্রজ্ঞাপন জারি করাসহ সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে উল্লিখিত দলগুলোকে বেআইনি এবং তাদের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে? আমরা আশা করতে পারি মিডিয়াকর্মীরা সততার সঙ্গে সেটা জনগণকে জানাবেন। সততার প্রশ্নটা আনা হচ্ছে এই কারণে যে, বাংলাদেশের সংবাদপত্রের সম্পাদকদের গরু-গাধা ভাবার কোনো কারণ নেই। তারা সম্পূর্ণতই উদ্দেশ্যপ্রনোদিতভাবে রিপোর্ট পরিবেশন করে বলেন অনেকেরই অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে এ-দেশের ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে মিডিয়াকর্মীরা কোনো-না-কোনোভাবে যুক্ত আছেন। এটা আজ অনেকের কাছে স্পষ্ট। একই সঙ্গে অনেক পত্রিকার সম্পাদক আমাদের দেশে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হিসেবেই পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত। তাদের সম্পাদিত বহুল প্রচারিত ও সততার শীর্ষে থাকা পত্রিকাগুলোতে আমরা আলোচিত এসব দলকে নিষিদ্ধ ঘোষিত বেআইনি দল এবং ওইসব দলের রাজনৈতিক কার্যক্রমকে নিছক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে ঘোষণা করতে দেখেছি বলেই সততার প্রশ্নটা আসছে।

এখন প্রশ্ন হলো ৩৭ বছরের বাংলাদেশে যদি কোনো সরকার আইনি প্রজ্ঞাপন জারি করে আলোচিত দলগুলোকে বে-আইনি এবং ওইসব দলের রাজনৈতিক কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি না-দিয়ে থাকে তাহলে, মিডিয়াগুলোর সম্পাদক ও সংবাদকর্মী বা র‌্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা ঘোষণা দিলেই কি দলগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যাবে? জনগণের দিক থেকে এ প্রশ্নটা উত্থাপন হতেই পারে? একইভাবে বিগত জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী সম্পর্কে ও একই প্রশ্ন তোলা যায়। তাছাড়া, তারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামে কিছু রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, সেটা কি সরকারে থাকাকালে তারা সংসদে প্রস্তাব আকারে তুলেছিলেন? সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার পরেও কি যুদ্ধ ঘোষণার প্রস্তাবনা সংসদে গৃহীত হয়েছিল? যদি সরকার হিসেবে তারা সেটা না-করে থাকে তাহলে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র কি সাংবিধানিকভাবে খালেদা জিয়া, মওদুদ, বাবরসহ র‌্যাব-পুলিশের কিছু কর্মকর্তাকে তাদের এই ঘোষিত যুদ্ধ চালানোর এখতিয়ার দিয়েছে? একইভাবে মিডিয়া কর্মকর্তাদের এ-ধরনের প্রপাগান্ডা চালানোর অধিকার? তাদের ঘোষিত এসব কর্মকাণ্ড ও প্রচারণা কি সাংবিধানিকভাবে গণতন্ত্র রক্ষার নামে আধুনিক ফতোয়াবাজি নয়? সাংবিধানিকভাবেই কি তাদের এসব প্রচারণা সংবিধান পরিপন্থি এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে না? আমাদের এটা অবশ্যই ভাবনার বিষয়।

তাছাড়া, প্রশ্নগুলো তোলা হলো এই করণে যে, গত ৩৭ বছরের বাংলাদেশে মিডিয়াতে প্রকাশিত তাদের তথাকথিত ‘সন্ত্রাস’ সম্পর্কে রিপোর্ট বা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে যে কেউ একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য হবেন। বিষয়টি হলো আলোচিত অঞ্চলগুলোতে আলোচিত দলগুলোর এযাবৎ কয়েক শত রাজনৈতিক কর্মী যেভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে খুন হয়েছে, সেই সব খুনের প্রত্যক্ষ মদদ যুগিয়েছে মিডিয়ার রিপোর্ট বা প্রতিবেদনগুলো। এভাবে কোনো একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শের রাজনীতিকে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে মিডিয়ার এই যুদ্ধ ঘোষণা কেন? এটা অবশ্যই আমাদের কাছে জরুরি প্রশ্ন। তাছাড়া, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আমাদেরকে নির্দিষ্ট করে এবং আইনি প্রজ্ঞাপন জারি করে আজো জানানো হয় নি আলোচিত রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে বাংলাদেশ আমলে। ওইসব আলোচিত দল সম্পর্কে সরকারগুলো যে ধরনের নীতি নির্ধারণ করেছে, তাদেরকে নির্মূল করার যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সরকারি কর্মকর্তারা যেভাবে ও যে ভাষায় কথা বলেছেÑ সেটা আসলেই গণতন্ত্রের পক্ষে ভয়াবহ বিপজ্জনক হতে বাধ্য। সরকার তার ভাষায় সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে দেশের দুইটি বিভাগকে টার্গেট করে নানান পদের যেসব অভিযান চালাচ্ছে তা রীতিমতো আশঙ্কাজনক। রাজনৈতিক কারণে ওসব দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে একটার পর একটা ফৌজদারি মামলা দিয়ে বাড়ি-ঘর ছাড়া করা, বিনাবিচারে আটকে রাখা, মানসিক ও দৈহিক নির্যাতন চালিয়ে চিরজীবনের মতো পঙ্গু করে দেওয়া এবং টার্গেট করে বিশিষ্ট বিশিষ্ট কর্মীদের হত্যা করার যে লাইসেন্স র‌্যাব-পুলিশকে দেওয়া হয়েছে তা রীতিমতো ভয়াবহ। এবং সরকার ‘জনগণকে’ আশ্বস্ত করছে রাষ্ট্রের এসব দমন-পীড়ন ও হত্যা নাকি সমাজ জীবনে সুফল বয়ে আনছে। একদিকে র‌্যাব-পুলিশ দিয়ে অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ড চালানো, অপরদিকে তাদের কর্মকর্তা ও সরকারের সাফাই গাওয়াÑ এটা একটা সরকারে নিত্যনৈমিত্তিক কাজ হতে পারে না; হলেও তা মেনে নেওয়া যায় না। এটা যে কোনো নাগরিকেরই দাবি।

এক্ষেত্রে অনেকের মতামত হলো সরকার তো সরকারি কাজই করছে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো বে-আইনি ধরপাকড় করা, অত্যাচার করা এবং বিনা বিচারে হত্যা করাটা কি সরকারি কাজ? সংসদীয় গণতন্ত্রের কাঠামোয় নির্বাচিত সরকারের কাজ হলোÑ যে কোনো মূল্যে আইনের শাসন রক্ষা করা। তাকে ভূলুণ্ঠিত করা বা পদদলিত করা সরকারের কাজ নয়। দেশের আইন তৈরি হয়েছে মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য। গণতন্ত্রে মানুষের সামাজিক অধিকার রক্ষা করে আইন। কিন্তু বিগত বিএনপি সরকার গণতন্ত্রকেই পদদলিত করেছে। তাছাড়া অভিযোগকারী এবং বিচারক যদি একই সংস্থা হয় তাহলে, আইন কি নিজের মতো করে চলতে পারে? কারণ ক্রসফায়ারের ঘটনাগুলোতে অভিযোগকারীও পুলিশ, বিচারকও পুলিশÑ এটা আর যাই হোক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ধরন হতে পারে না।

আমরা এক একটা ক্রসফায়ার ঘটনার পর সংবাদ বিবৃতি দেখেছি নিহত ব্যক্তি হয়তো কোনো গ্রামের আম অথবা জাম বাগানে বসে নাশকতামূলক কাজের পরিকল্পনা করছিল। নিহতদের বিরুদ্ধে একাধিক খুনের মামলা ছিলো। এভাবে যুক্তি দাঁড় করিয়ে ওইসব দলের কর্মীদের হত্যা করা হয়েছে ও হচ্ছে। বিষয়বস্তুকে যারা এভাবে দাঁড় করান, আমরা তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গির ঘোর বিরোধী। কারণ আইনের চোখে নিহত ব্যক্তি অভিযুক্তমাত্র। আদালতে অভিযোগটি অপরাধ হিসেবে প্রমাণিত না হলে উক্ত ব্যক্তি অপরাধী সাব্যস্ত হয় না। তাদের বিরুদ্ধে হাজারটি খুনের অভিযোগ থাকলেও সেটা কি আদালতে রায়ে প্রমাণিত ছিলো? অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়ার যে বিধান সংবিধানে দেওয়া হয়েছে, বিগত সরকার এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনী হিসেবে পুলিশ ও র‌্যাব কি তা লংঘন করেনি? আমরা স্পষ্টতই মনে করি, আইনের শাসনের বিপরীতধর্মী যে কোনো কাজই গণতন্ত্র বিরোধী। মানবাধিকার বিরোধী। আজ বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের সরকারি কাজের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে মানবাধিকারের বিষয়গুলোর উপরে অসীম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যার মর্মবস্তু হলোÑ নির্যাতনমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা। চারদলীয় জোট সরকার এবং র‌্যাব-পুলিশ কর্মকর্তারা সেটা স্পষ্টতই লঙ্ঘন করেছে। এটা প্রতিটি সচেতন নাগরিকেরই মতামত।

এসব রাজনৈতিক দল সম্পর্কে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, তারা অ্যানিহিলেলশন-এর মতাদর্শে বিশ্বাসী। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে তারা নিশ্চিহ্ন করারা তত্ত্বে বিশ্বাসী। তারা খুনের রাজনীতি করে। সন্ত্রাসের জাল ভয়ঙ্করভাবে ছড়াচ্ছে। ফলে সরকারের ঘোষণা ছিলো তাদেরকে কোনোভাবেই ছাড়া হবে না। অর্থাৎ সরকার কি প্রকৃত অর্থেই ঘোষণা দিচ্ছে না ওইসব দলের উপরে লাগামহীন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালানো হবে? যেহেতু তারা খুনের রাজনীতি করে, ফলে বদলা হিসেবে রাষ্ট্রকেও কি পাল্টা খুনের পথ ধরতে পারে? এটা কি আসলেই কোনো পদ্ধতি? তাদের খুনের জবাব কি পাল্টা রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড? আমরা ২০০৪ সালের পর থেকে লক্ষ্য করছি জোট সরকারসহ ড. ফকরুদ্দিনের সরকার এবং র‌্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা ওইসব দলের ব্যক্তি হত্যার রাজনীতিকে অজুহাত করে রাষ্ট্রীয় খুন ও সন্ত্রাসের মাত্রা দিনকে দিন বাড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষের অর্জিত গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহকে ক্রমান্বয়ে পদদলিত করছে। সংকুচিত করছে। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে খোদ রাষ্ট্রকেই একটা একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করছে। প্রশ্ন হচ্ছে ‘মারাত্মক’ অপরাধীদের প্রতি নির্মোহ হওয়া- নির্মম হওয়া, আর তাদের হত্যা করা সমার্থক বিষয় কিনা? ব্যক্তি হত্যা আর রাষ্ট্রীয় গণহত্যা এই দুইয়ের মধ্যে কোনটি বেশি বিপজ্জনক? এটা অবশ্যই আমাদের। আমাদের বিবেচনায় আনা দরকার।

আমাদের জানামতে এসব দলগুলো মতাদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দল। এটা ফৌজদারি মামলার কোনো বিষয় নয় আর যারা রাজনীতিকে ফৌজদারী মামলার ক্যাচাল মনে করেন, আমরা ওই দৃষ্টিভঙ্গির ঘোর বিরোধী। ফলে রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি পরিভাষায় যখন একজন ‘পেশাদার দুস্কৃতকারী’-র সঙ্গে একজন পেশাদার রাজনৈতিক কর্মীর পার্থক্য করে না, তখন ওই রাষ্ট্র কি নিজেই গণতন্ত্রের হননকারী রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করে না? সন্ত্রাস দমনের নামে রাষ্ট্র নিজেই যখন খুনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন ওই রাষ্ট্র কি নিজেই গণতান্ত্রিক সমাজ বিরোধী হয়ে ওঠে না? তাছাড়া এ্যাকশনবিহীন কোনো মানুষ যেমন নেই, তেমনি এ্যাকশনবিহীন কোনো রাজনৈতিক দলও নেই। আঘাতের পাল্টা প্রতিঘাত শতগুণ জোরালোভাবেই ফিরে আসতে পারে। একইসঙ্গে আলোচিত বিশেষ ধারার রাজনৈতিক দলসমূহ এমনই একটা ধারার রাজনীতি করে, যা প্রচলিত ধারার রাজনীতির সম্পূর্ণ বিরোধী। যেমন তারা কেউই ভোটযুদ্ধে লড়ে না। ফলে তাদের গদি হারানোর ভয় অন্তত নেই। তাদের সম্পর্কে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনেও লাভ নেই। কারণ তারা চূড়ান্ত অর্থে সমস্ত ধরনের রাষ্ট্রের বিলোপ চায়। তারা সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার তত্ত্বে বিশ্বাসী। ফলে রাষ্ট্র সশস্ত্র এ্যাকশনে নামলে তাদের দিক থেকেও সেটা বাড়তে পারে বলে অনেকেই মনে করেন। আর তেমনটি হলো নাগরিক হিসেবে আমাদেরকেই প্রধানভাবে সমস্যার ঘুর্নীবর্তে আটকা পড়তে হবে।

তাছাড়া, আমাদের জানা মতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ব্যক্তিই স্বার্বভৌম। ফলে একজন স্বাধীন ও স্বার্বভৌম ব্যক্তি বা মুক্তচিন্তার মানুষের যে কোনো রাজনৈতিক দলের আদর্শে বিশ্বাস রাখার অধিকার রয়েছে। এমনকি দলটি যদি নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দলও হয়, তাতেও কিছু যায় আসে না। এটাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মতাদর্শগতভাবে এবং প্রায়োগিকভাবে ভিন্নমত ও প্রায়োগিক বিভিন্নতা থাকবেই। তার মিমাংশাপত্রটা রাজনীতিগতভাবেই করতে হবে। ফৌজদারি কায়দায় বা পাল্টা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পথে আগানো হলে ফলাফল বিপজ্জনক হয়ে উঠতে বাধ্য। কারণ এতে করে একটা সময় প্রচলিত রাষ্ট্রের সমস্ত কাঠামোই ভেঙে পড়তে পারে। ইতিহাসে এর ঢের ঢের নজির রয়েছে।

বিশেষ ধারার রাজনীতির অর্থটা কি?

আমরা পূর্বের আলোচনায় দেখেছি যে, দেশে সংগঠিত ক্রসফায়ারে প্রধানভাবে টার্গেট করা হয়েছে একটা বিশেষ ধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত নেতা-কর্মী-সমর্থক ও জনগণকে।

আলোচিত উক্ত ধারার রাজনৈতিক দলগুলো মূলত কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে পরিচিত। যদি অনেকেই তাদেরকে আন্ডার গ্রাউন্ড পার্টি রূপে চিহ্নিত করেন। তবে ১৯৬৭ সালে আমাদের দেশে যখন কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে, তখন উল্লিখিত দলগুলোকে অনেকেই পিকিংপন্থি ধারা হিসেবে গণ্য করতেন। ওই পিকিংপন্থি ধারা হিসেবে এদেশের রাজনীতিতে সেদিন সক্রিয় ছিলো তিনটি দল। তাদের নাম হলো :

ক) ইস্ট পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল), ’৭১ পরবর্তীতে দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল);

খ) পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) এবং

গ) পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি।

পাকিস্তান পর্ব থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত আলোচিত তিনটি দলই মাওসেতুঙের কৃষিবিপ্লবের লাইন ও গ্রামভিত্তিক দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের-রণনীতিকে বাংলাদেশের ক্ষমতা দখলের পদ্ধতি বা রণনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল। ১৯৮২ সালের পর বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি মাওয়ের এই রণনৈতিক লাইনকে পরিত্যাগ করে এবং খোদ মাওবাদকে বিশ্ববিপ্লব বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে আধুনিক সংশোধনবাদ বলে মনে করে। মূলত এই দলটির বর্তমান তাত্ত্বিক ভিত্তি হচ্ছে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ। ক্ষমতা দখলের উপায় হিসেবে তারা এখন লেনিন প্রদর্শিত সশস্ত্র গণ-অভ্যুত্থানের লাইনকে গ্রহণ করেছে এবং নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পরিবর্তে তারা জাতীয়Ñগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলে।

পরবর্তীতে আলোচিত বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে ক্ষীন ধারায় আরো দুটি উপদলের সৃষ্টি হয়েছে। যা শ্রমজীবী মুক্তি আন্দোলন ও নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে পরিচিত।

পাশাপাশি কালের পরিক্রমায় এসে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পাটি ভেঙে আবার দুটো দল হয়েছে। যার একটি পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি (সিসি) এবং অপরটি পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি (এমবিআরএম) নামে পরিচিত। ভাঙন ঘটেছে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতেও। যার মধ্যে একটি এম-এল, একটি লাল পতাকা এবং অপরটি জনযুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। উল্লিখিত দলসমূহের মধ্যে বর্তমানে শেষোক্ত পাঁচটি দল নিজেদেরকে মাওবাদী হিসেবে গণ্য করে। অর্থাৎ মাও প্রদর্শিত কৃষিবিপ্লব ও গ্রামভিত্তিক দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র গেরিলাযুদ্ধের রণনৈতিক লাইনকে তারা মতাদর্শিকভাবেই গ্রহণ করেছে, যাকে এক কথায় তারা নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলে থাকে।

উপরি-উক্ত আলোচনা থেকে আমরা স্পষ্টই উপলব্ধি করতে সক্ষম যে, উল্লিখিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে হরেক কিসিমের মতপার্থক্য রয়েছে। আবার এটাও বাস্তবতা যে, আলোচিত দলগুলো পৃথক পৃথক অস্তিত্ব ধারণ করলেও কিছু মৌলিক প্রশ্নে আবার সকলের অভিন্নতা আছে। আলোচিত সমস্ত দলই সেই অভিন্ন মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি ধারাবাহিকভাবে ’৪৭ এবং ’৭১ উত্তর বাংলাদেশে একইভাবে ধারণ করে আসছে।

ফলে কি তাদের রাজনীতি এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যে সমস্ত মৌলিক প্রশ্নে তাদের অভিন্নতা রয়েছে তার একটা পর্যালোচনা আমরা করে নিতে পারি। তবে পর্যালোচনার কাজটা সবার জন্য বোধগম্য করার ইচ্ছা নিয়ে একটু সহজ-সরল বিশ্লেষণসহ একজন ব্যক্তি মানুষ হিসেবে এই কাজটি করতে গিয়ে আমি যতটা বুঝতে সক্ষম হয়েছি সেটা আমরা ভাষায় দাঁড় করাচ্ছি।

প্রথমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সম্পর্কে আলোচিত দলগুলোর মূল্যায়ন প্রসঙ্গে আসা যাক। এই প্রশ্নে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, দেশের প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক দল এবং বুদ্ধিজীবীরা যখন বাংলাদেশকে একটা স্বাধীন- গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করে, উল্লিখিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলো ওই দাবি নকচ করে দেয়। তারা বাংলাদেশকে কোনোভাবেই স্বাধীন-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করে না। তাদের দাবি হলো, বাংলাদেশ একটা নয়া-ঔপনিবেশিক, আধা-সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়াতে পারছে না। এ অবস্থার পরিবর্তন না- ঘটলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অর্জন করা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ তারা ভৌগোলিকভাবে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের পৃথক অস্তিত্ব থাকা এবং গণতন্ত্র, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব কে কখনোই সমার্থক বিষয় মনে করে না । ফলে দল হিসেবে আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলো সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল এবং স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে খোদ রাষ্ট্রসহ তার আনুসঙ্গিক সমস্ত উপাদানের আমূল পরিবর্তন বা বিপ্লবী রূপান্তরে কথা বলে। ’৪৭ উত্তর পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও তাদের একই দাবি ছিলো। ’৭১ উত্তর বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও অনুরূপ দাবিই বহাল রয়েছে। উল্লিখিত এই তথ্যগুলো আলোচিত দলগুলোর একদম ঘোষিত সিদ্ধান্ত। এখানে রাখত- কি করার মতো কোনো বিষয় তাদের দিক থেকে পূর্বেও কখনো ছিলো না, আজও নেই। ফলে রাষ্ট্র প্রশ্নে তাদের এই মনোভঙ্গি থেকে আমরা মোটাদাগের কয়েকটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি।

ক) তাত্ত্বিকভাবে নয়া-ঔপনিবেশিক, আধা-সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, এটা একটা সমাজ বিশ্লেষণ ক্যাটাগরি। যার উপরে ভিত্তি করে আলোচিত দলগুলো রাষ্ট্রের চরিত্র এবং একটা শত্র“-মিত্র ভেদজ্ঞান হাজির করাসহ বিপ্লবের স্তর বা এই মুহূর্তের করণীয়টা ঘোষণা করছে।

খ) ক্ষমতা দখলের পথ হিসেবে নির্বাচনী তরিকার বিপরীতে তারা সশস্ত্র যুদ্ধের কথা বলছে। এবং সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়েই তারা একটা স্বাধীন, সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিচ্ছে। একই সঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্রের মাজেজাকে অতিক্রম করে সোভিয়েত অথবা গণকমিউনিস্ট প্রতিষ্ঠার কথা বলছে।

গ) যেহেতু তারা ’৭১ পরবর্তী বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করে না। ফলে তাদের রাজনীতির ভাবকেন্দ্র দেশের চলমান রাজনীতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষের তরিকার একদম বিপরীত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে চলমান ধারা হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ অথবা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে তার ফ্যাসিস্ট মতবাদ হিসেবে গণ্য করে। একই সঙ্গে যে কোনো প্রকারের উগ্র-জাতীয়তাবাদী ভাবধারাকে তারা স্বাধীন-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মতাদর্শগতভাবে ও রাজনৈতিকভাবে শত্র“জ্ঞান করে। মূলত এটাই হলো আলোচিত দলগুলোর বিশেষ ধারার রাজনীতি। এখানেই তাদের অভিন্নতা।

আধা-সামন্ততান্ত্রিক ও নয়া উপনিবেশিক ব্যবস্থাটা কি

এবার আমরা তাদের বিশ্লেষণ ক্যাটাগরি হিসেবে আধা-সামন্ততান্ত্রিক, নয়া-ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা বলতে তারা কোন ধরনের চিত্রসহ শত্রু-মিত্রের ভেদজ্ঞান হাজির করছেন, সেই প্রশ্নে নজর দিতে পারি। তারা তাদের বিশ্লেষণ ক্যাটাগরির উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে বলছে নয়া-ঔপনিবেশিক, আধা-সামন্ততান্ত্রিক। এবং আলোচিত ব্যবস্থার রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে তারা সাম্রাজ্যবাদ, আমলা-মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ ও আধা-সামন্ততন্ত্রের প্রতিনিধিত্বকারী শক্তিসহ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে শত্রু রূপে চিহ্নিত করে।

আলোচিত দলগুলো নয়া-উপনিবেশ ও আধা-সামন্ততন্ত্র বলতে যে আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে চিহ্নিত করছে, তার উদ্ভব ও সূচনা হয়েছিল মূলত ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসন পর্বে। এটা তাদের দাবি। অর্থাৎ গত পাঁচশ বছর পশ্চিম ইউরোপ এবং ‘আমেরিকাতে’ সামাজিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হিসেবে পুঁজিবাদ গঠনের যে প্রক্রিয়া, পৃথিবীর নানান প্রান্তে তাদের যে ঔপনিবেশিক বলয় সৃষ্টি, উপমহাদেশ হিসেবে ভারত প্রায় দুই শ’বছর তারই প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীনে থেকেছে। তাদের শাসনাধীনেই উপমহাদেশের অভ্যন্তরীণ সম্পত্তি-সম্পর্ক ও সামাজিক সম্পর্কের রূপকাঠামো বদলে গেছে। তাদের দাবি অণুযায়ী ওই সময়ে ভারতকে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি গঠনের প্রধান তিনটে স্তর উপনিবেশ আকারে অতিক্রম করতে হয়েছে। অর্থাৎ আদিম পুঁজি সঞ্চয়ানের যুগ, শিল্প পুঁজি গঠন প্রক্রিয়ার যুগ এবং লগ্নি পুঁজির যুগ। একইভাবে আমরা ইতিহাসের অংশ হিসেবে এটাও জানি ইউরোপে সামন্তবাদের গর্ভে যে বণিক পুঁজির জন্ম ও প্রাধান্যের সৃষ্টি হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেই পুঁজির পুষ্টি বিকাশের প্রয়োজনে উপমহাদেশে প্রথম পা রাখে এবং সেটা বাংলাতেই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমাদেরকে এক শ’ বছর শাসন করেছে। তারপর কায়েম হয়েছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি শাসনের যুগ। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তাদের ওই প্রত্যক্ষ উপনিবেশের যুগ বহাল ছিলো। ’৪৭ পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশের শাসন ক্ষমতা দেশীয়দের হাতে হস্তান্তরকে অনেকেই উপমহাদেশের জন্য স্বাধীনতা হিসেবে চিহ্নিত করলেও, আলোচিত দলগুলো বলছে ওই সময় থেকে মূলত নয়া-ঔপনিবেশিক যুগের সূচনা হয়। আর সম্পত্তি-সম্পর্ক হিসাব ভূমি মালিকানার যে ধরন ঔপনিবেশিক পর্বে ব্রিটিশ সাম্রাজবাদ চাপিয়ে দিয়েছিল সেটাই আধা-সামন্ততন্ত্র। এখন তাদের এই দাবি কতটা যথাযথ এবং বাস্তবসম্মত আমরা সেটাও পর্যালোচনা করতে পারি।

আমরা যদি আমাদের দেশের ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের পূর্বের বাংলা এবং পরের বাংলার মধ্যে মৌলিকভাবে পৃথক অবস্থান দেখতে পাব। ঔপনিবেশিক শাসনামলের পূর্বে এদেশের অর্থনীতির মূলভিত্তি ছিলো ভূ-সম্পত্তি এবং ‘স্বয়ংসম্পন্ন’ গ্রামীণ সমাজ। ওই আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনায় ভূমিতে প্রধানভাবে ব্যক্তিমালিকানার অনুপস্থিতি ছিলো একটি মৌলিক বিষয়। সে যুগে প্রধান উপার্জনকারী সম্পদ হিসেবে ভূমি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকলেও মালিকানা ছিলো যৌথ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীন সমাজের হাতে। ওই গ্রামীণ সমাজের সদস্য একজন উৎপাদক কৃষক বংশানুক্রমে তা ভোগ করতে পারত। কিন্তু গোষ্ঠীর বাইরে ব্যক্তি হিসেবে তা ভোগ করা সম্ভব ছিলো না। সম্পত্তির গোষ্ঠীগত দখলদারত্বের মধ্যে ব্যক্তি ওই সমাজের সদস্য হিসেবেই ব্যক্তি উদ্যোগের সম্প্রসারণ ঘটাতে পারত। এই প্রক্রিয়াতে গোষ্ঠীর মধ্যে ব্যক্তির দখলদারিত্বের স্বীকৃতি ছিলো। এ-ধরনের ভূমি মালিকানার উপর ভিত্তি করে যে সম্পত্তি-সম্পর্ক বিরাজমান ছিলো, সেখানে উৎপাদক কৃষককে সারা বছরের প্রয়োজনীয় কৃষিযন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যদ্রব্য সরবরাহ করেছে অসংখ্য বৃত্তিজীবী সম্প্রদায় এবং বণিক সমাজ। অর্থাৎ কৃষি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিতভাবে গড়ে উঠেছিল বৃত্তিজীবীদের কুঠির শিল্প এবং সরবারহকারী কাঠামো। পরস্পরের মধ্যে দ্রব্য বিনিময় ছিলো প্রধান। এ-ধরনের সরল উৎপাদন পদ্ধতির গ্রামীণ সমাজ তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল শ-শ’ বছর। তখন সমাজ শাসিত হয়েছে গোষ্ঠীপতির দ্বারা। সমাজে পণ্য উৎপাদন এবং শ্রেণী বিভাজন ছিলো অবিকশিত। ওই সমাজেও আমরা জমিদারি প্রথার অস্তিত্ব পাচ্ছি। কিন্তু জমিদার ছিলো সম্রাটের পক্ষে খাজনা আদায়কারী প্রতিনিধি। তবে কিছু ঐতিহাসিকের মতে ভারত উপমহাদেশ জুড়ে প্রযুক্তি হিসেবে কৃষিতে বলদে টানা লোহার ফলাযুক্ত লাঙল ব্যাপকভাবে প্রচলন শুরু হওয়ার পর পর উদ্বৃত্ত উৎপাদনের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। কৃষি ব্যবস্থার এই উন্নতির উপরে নির্ভর করে বৃত্তি বিভাজিত রাষ্ট্রভিত্তিক সমাজকাঠামো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সেদিন। একইভাবে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত যেমন রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যের সহায়ক হয়ে ওঠে, তেমনি উৎপাদনের একটি বড় অংশ (এক-চতুর্থাংশ, এক-ষষ্ঠাংশ, এক অষ্ঠাংশ, এক দশমাংশ) রাজস্ব আকারে শাসক সম্রাটের হাতে কেন্দ্রিভূত হত। যা আবার সম্রাটের সাম্রাজ্যবৃদ্ধি ও শাসনব্যবস্থা কেন্দ্রিভূত হতে সহায়তা করে। এবং ওই উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদনের ফলেই সেই সময়ে কৃষিজীবীরা নিজেদেরকে প্রতিপালনের সঙ্গে সঙ্গে পুরোহিত সম্প্রদায়, অপরাপর রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি, সমাজের নানান বৃত্তিজীবীসহ পেশাদার সৈনিকদেরও প্রতিপালন করেছে বা উৎপাদক কৃষক তা করতে বাধ্য হয়েছে।

সমাজের কারিগর স্মপ্রদায়সহ বণিক সম্প্রদায়ের মূলধন তারাই যুগিয়েছে। তৎকালীন নগর বা নগরবাসীর উদ্ভব ও সংস্কৃতির বিকাশের সঙ্গেও কৃষির উদ্বৃত্ত আহরণ ছিলো সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। এটাই ছিলো তৎকালীন উপমহাদেশ জুড়ে কৃষক সমাজের সর্বনিম্ন ভোগের কারণ। যাবতীয় অসাম্যের উৎসও ছিলো ঠিক এখানে। অর্থাৎ বণ্টননীতিতে। কিন্তু সেদিন সম্পত্তি মালিকানাকে কেন্দ্র করে উৎপাদনকে কুক্ষিগত করার মতো কোনো শক্তিশালী শ্রেণী ছিলো না। স্থানীয় জমিদার, জায়গীরদার, বণিক, মহাজন, প্রশাসক বা পুরহিত সম্প্রদায়সহ অপরাপর বৃত্তিজীবীরা তাদের স্বার্থ থেকে রাষ্ট্রক্ষমতাকে তাদের অনুকূলে ব্যবহার করতে পারেনি। কারণ গোটা উপমহাদেশ জুড়ে বর্গ হিসেবে ওইসব গোষ্ঠী ভূমি থেকে সৃষ্ট উদ্বৃত্ত ভোগ করলেও সম্পত্তি-সম্পর্ক হিসেবে ভূমি ভোগের কোনো মালিকানা বা স্বত্বাধিকার তাদের ছিলো না। সামাজিক বর্গ হিসেবেও তাদের উদ্বৃত্ত আহরণের উৎসও ছিলো রাজা বা সম্রাটের কর্তৃত্ব। রাষ্ট্র ক্ষমতা ছিলো সম্রাটের হাতে। সম্রাটের আইনগত বণ্টননীতির ভিত্তিতেই তাদের প্রাপ্যটুকুই জুটত। এভাবে স্থানিক শাসকবর্গের স্বত্বাধিকারহীনতা, রাজনৈতিক অধিকারহীনতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলো। মোটামুটিভাবে প্রাক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পর্বে প্রধান সম্পত্তি-সম্পর্ক হিসাবে এটাই ছিলো ভূ-সম্পদ ব্যবহারের নীতি। যাকে স্বয়ংসম্পন্ন গ্রামীণ সমাজের চিত্র বলা হয়েছে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পর্বে ঔপনিবেশিক শাসকরা নিজস্ব স্বার্থ থেকেই স্বয়ংসম্পন্ন গ্রামীণ সমাজের ভাঙন ঘটায়। একটা নতুন ধরনের সম্পত্তি-সম্পর্ক গড়ে তোলে। সমাজ কাঠামো শ্রেণীভিত্তিক করে তোলে। প্রধানভাবে বাংলাতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে সেটা করা হয়েছিল।

চিরস্থায়ী বন্দোবাস্ত ছিলো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক শ্রেণীর সঙ্গে তাদের সৃষ্ট নব্য জমিদার ও ভূস্বামীদের মধ্যকার যে সম্পর্ক, তারই একটি আইনগত কাঠামো। যার সঙ্গে উৎপাদক কৃষক সমাজের কোনো যোগসূত্র ছিলো না। জমিদার ও ভূস্বামীদের উৎপাদক কৃষককে ভূমি থেকে উচ্ছেদের ক্ষমতা দেওয়া হয় এই আইনে। ফলে আইনগতভাবেই কোটি কোটি চাষি পরিবার গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে তাদের বংশানুক্রমিক রায়তীস্বত্ব হারিয়ে ফেলেন।

এই ব্যবস্থায় জমিদারকে ভূমি-প্রকৃতির একচ্ছত্র মালিক বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। আর উৎপাদক কৃষককে করা হয় জমিদারের অধীনস্ত প্রজা। যাতে করে জমিদারদের মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণে ভূমি রাজস্ব আদায় করা যায়। এবং ঔপনিবেশিক শাসনের ওই পর্বে রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎসই ছিলো কৃষকের উপর চাপানো ভূমিকর। পাশাপাশি ব্রিটিশ সরকারের অনুমতি ছাড়া জমিদারকে জমি বন্দক-দান-বিক্রি ও হস্তান্তর করার অধিকার দেওয়া হয়। একইভাবে ওই জমি কিভাবে, কোন প্রয়োজনে ব্যবহার করা হবে না হবে সেই আইনগত অধিকারও ভূস্বামী ও জমিদারের হাতে ন্যাস্ত করা হয়। এইসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অনেকগুলো উদ্দেশ্য সাধন করে ব্রিটিশরা।

ক) পূর্বে উৎপাদক কৃষককে জমি থেকে উচ্ছেদের ক্ষমতা কোনো ভূস্বামী বা জমিদারের ছিলো না। এখন নতুন আইনে সেই ক্ষমতা তাদেরকে দেওয়া হলো।

খ) পূর্বে উৎপাদক কৃষক জমিদারের প্রজা হিসেবে গণ্য হত না। এখন উৎপাদক কৃষক জমিদারের অধীনস্ত প্রজায় পরিণত হলো।

গ) জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা সৃষ্টি করা হলো এবং জমি বিক্রি, বন্দক, হস্তান্তরের অধিকার দিয়ে স্বয়ংসম্পন্ন গ্রামীণ সমাজের স্থিতি ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হলো। ভূ-প্রকৃতিকে পণ্যে পরিণত করা হলো। সেটা বেঁচে থাকার অবলম্বনের বিপরীতে বিক্রয়যোগ্য পণ্য হয়ে পড়ল।

ঘ) জমি কিভাবে, কোন প্রয়োজনে ব্যবহৃত হবে সেই ক্ষমতা জমিদারদের বা ভূস্বামীদের হাতে তুলে দিয়ে উৎপাদক কৃষকের ভোগ-দখলি কর্তা স্বত্বাধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হলো। একই সঙ্গে উৎপাদনের উপাদান থেকে প্রত্যক্ষ উৎপাদকের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে কোটি কোটি উৎপাদককে সম্পদচ্যুত ও কর্তৃত্বহীন করা হলো। অর্থাৎ প্রাকৃতিক সম্পদের যে অংশটুকুর উপর সমাজের দুর্বলতম উৎপাদক জনগোষ্ঠীর অধিকার ছিলো। সেটাই ছিনিয়ে নেওয়া হলো। উৎপাদক ও দুর্বলতম জনগোষ্ঠী প্রাকৃতিক সম্পদের যে অংশটুকু নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারত সেই অধিকার থেকে তাদের বহিষ্কার করা হলো। তাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে মৌলিক সম্পদের উপর যতটুকু স্বত্বাধিকার ছিলো তা ক্রমাগত হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা হলো। আবার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ততে যে রাজস্ব ব্যবস্থার স্থায়ীত্ব দেওয়া হলো তা কোনোভাবেই উৎপাদক কৃষক এবং কৃষির উন্নতির সহায়ক হলো না। উৎপাদনের গতি সঞ্চার বা জমির উন্নতির জন্য অতিরিক্ত অর্থ সঞ্চয় দূরে থাকুক নিজেদের জীবন রক্ষা করাই দায় হয়ে উঠল সেদিন থেকে। তাছাড়া চিরস্থায়ী ব্যবস্থাটিতে লক্ষ্য নির্ধারিত করা হয়েছিল এমনভাবে যাতে কৃষকরা কোনোরূপে বেঁচেবর্তে থাকে। জমিতে বিনিয়োগকৃত পুঁজি থেকে উৎপাদিত মুনাফা যাতে তার ঘরে না-আসে। এমনকি তাদের কাছ থেকে সংগৃহীত করের একটা ক্ষুদ্র অংশও সেদিন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি বা নব্য ভূমি মালিকরা উৎপাদক কৃষক এবং কৃষি উন্নতির জন্য ব্যয় করল না। এটাকেই মার্ক্স বলেছিলেন ব্রিটিশরা ভারতীয়দের উপরে যে দুর্দশা চাপিয়েছে তা ছিলো হিন্দুস্থানের আগের সমস্ত দুর্দশার চেয়ে মূলগতভাবেই পৃথক। অনেক বেশি তীব্র এবং দানবীয়। এটা হলো ঘটনার একটা দিক।

এর অপর দিকটা হলো, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ভূস্বামী ও জমিদারদের জন্য রাজস্ব প্রদানের পরিমাণ চিরকালের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা উৎপাদক কৃষকের কাছ থেকে কতটা রাজস্ব আদায় করতে পারবে তার ঊর্ধ্বসীমা ধার্য করা হয় না। এই নীতির মাধ্যমে কৃষকদেরকে সীমাহীন লুন্ঠনের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়। একইভাবে জমিদারদের রাজস্ব আদায়ের অধিকারকে অপরের কাছে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়। ফলে জমিদারী ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ অঙ্গ হিসেবে একটা নতুন মধ্যশ্রেণীর বিকাশ ঘটে, যারা ইজারাদার, উপ ইজারাদার, পত্তনিদার ইত্যাদি নামে খ্যাত।

আবার নগদ অর্থে রাজস্ব প্রদান বাধ্যতামূলক করে উৎপাদক কৃষকদের জন্য নগদ অর্থের প্রয়োজনীয়তা প্রকট করে তোলা হয়েছিল। ফলে নগদ অর্থের প্রয়োজনে কৃষকরা মহাজনের দারস্ত হতে বাধ্য হয়। মহাজনকে আবার তার পাওনা আদায়ের স্বার্থে কৃষকদের উপর শারীরিক নিপীড়ন চালানোর ক্ষমতাসহ তাদের সহায়সম্পদ ক্রোক করার আইনগত ক্ষমতা দেওয়া হয়। ফলে নতুন গড়ে তোলা কৃষি ব্যবস্থাপনার মধ্যে সেদিন আরেক ধরনের ক্ষমতার বিন্যাস গড়ে তোলা হয়। যেখানে মহাজনদেরও কাঠামোগত কর্তৃত্বের একটি বিষয় থাকে। যাতে করে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে মহাজনরা তাদের ক্ষমতা স¤প্রসারণ করতে পারে। এভাবে সেদিন অসংখ্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ভারত উপমহাদেশ ব্যাপি যে সম্পত্তিÑসম্পর্ক গড়ে তোলে, সেখানে ব্যক্তিগত সম্পদ হিসেবে জমি এক অনুৎপাদক শ্রেণীর হাতে হস্তান্তরের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়। অনুৎপাদক শ্রেণী হিসেবে তারাই উৎপাদনের নিয়ন্ত্রকশক্তি এবং কর্তাশক্তি হয়ে ওঠে। আর উৎপাদক শক্তি হয়ে পড়ে কর্তাস্বত্বাহীন। প্রাকৃতিক সম্পদের উপরে, নিজস্ব শ্রমের উপর, শ্রমার্জিত সম্পদের উপর থেকে তাদেরকে কর্তৃত্বহীন করে ফেলা হয়।

আবার অনুৎপাদক সম্পত্তিবানদের একটি অংশ মালিকানার স্বত্বাধিকার থেকে বর্গা এবং লিজ প্রথার মতো একটা ব্যবস্থার জন্ম দেয়। তাতে করে সম্পত্তি, কেন্দ্রিক স্বত্বাধিকারের কর্তৃত্বটা এমনই দাঁড়ায় যে, ওই অনুৎপাদক গোষ্ঠী উৎপাদনে কোনোরূপ শ্রম বা পুঁজি বিনিয়োগ না করেও লিজ বা বর্গাপ্রথার মাধ্যমে শ্রম এবং শ্রমার্জিত ফসলের বৃহদাংশটি উৎপাদিত ফসল ভাগ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাজস্ব আকারে লুটে নিতে সক্ষম হয়। এভাবে গড়ে তোলা সম্পত্তি-সম্পর্কের মধ্যেই তারা প্রকৃতি ও শ্রমের উপরে একটা নতুন ধরনের দাসত্বকরণ প্রক্রিয়া পাকাপোক্ত করে তোলে। ফলে প্রাক ঔপনিবেশিক পর্বে যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে জমি ব্যবহারের নীতি ছিলো মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ, সেখানে ঔপনিবেশিক পর্বে উৎপাদনের ধরন বদলে যায়। উৎপাদনের আনুসঙ্গিক নীতি হিসেবে প্রকৃতি ও শ্রম, অনুৎপাদক শ্রেণীর দাসে পরিণত হয়। আর নিত্য নতুন মালিকানার লক্ষ্য হয়ে ওঠে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য পূরণ। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক পর্বেই সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত যে বিশ্ববাজার গড়ে ওঠে, ওই বাজারে ভারতের কৃষিব্যবস্থা নতুন স্বত্বাধিকার বা নতুন মালিকানা মারফত অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। আর আমরাও প্রবেশ করি দ্রব্য বিনিময়ের আঙিনা ছেড়ে বিশ্ববাজারে বা পণ্য-অর্থ-পণ্যের এক জগতে। এই আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাগে উপমহাদেশের অবস্থান হয় কৃষি পণ্যের যোগানদার রাষ্ট্র হিসেবে। অবশ্য ততদিনে পুঁজিবাদী সামাজিক সম্পর্কের উপরে ভিত্তি করে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোতে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রয়োজনে যন্ত্রশিল্পের উদ্ভব ঘটে গেছে। ফলে প্রাক ঔপনিবেশিক ভারত উপমহাদেশের স্বয়ং সম্পন্ন গ্রামীণ সমাজের সম্পূরক হিসেবে যে কুঠির শিল্পের বিকাশ ও উদ্ভব ঘটেছিল। যন্ত্রশিল্পে উৎপাদিত পণ্যের প্রসার ঘটাতে কুঠির শিল্পের উচ্ছেদ সাধিত হয়। এতে করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তার ব্যবহার্য নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যদ্রব্যের প্রয়োজনেই শিল্পপণ্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আমাদের কৃষি, শিল্পপণ্যের যোগানদার হয়ে ওঠে। আবার নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যের প্রয়োজনে আমরা হয়ে উঠি শিল্পপণ্যের আমদানি কারক। এভাবে দুই মেরুতে অবস্থিত দেশগুলোর উৎপাদিত পণ্য যে বাজারে বিকতে উপস্থাপিত হয়, ওই বাজারে ঔপনিবেশিক শক্তির একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকায় একটা অসম বিনিময় প্রক্রিয়ার উদ্ভব ঘটে। কৃষিপণ্য শিল্প পণ্যের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। এতে করে কৃষিতে অর্জিত মুনাফা শিল্পপণ্যক্রয়ে পাচার হয়ে যায়। বা কৃষির কর্তাস্বত্বাহীনতার কারণে বাজার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কৃষিতে অর্জিত মুনাফা পাচার হয়ে যায়। উৎপাদক কৃষকরা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করার মতো একটা শক্তিশালী কর্তারূপ বা শ্রেণী হিসেবে অবির্ভূত হতে ব্যর্থ হয়, যাকে আমরা বুর্জোয়া অর্থসম্পর্কের প্রতিনিধিত্বকারী শক্তি বা শ্রেণী হিসেবে বিচার করতে পারি। এর আরো অন্যতম কারণ হলো-গড়ে তোলা নতুন সম্পত্তি সম্পর্কের ফলাফল হিসেবে উপমহাদেশব্যাপী যে কোটি কোটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জোত গড়ে উঠেছিল। সেখানে ক্ষুদ্রজোতের মালিক উৎপাদক কৃষকের পক্ষে রাজস্ব প্রদান এবং শিল্পপণ্য ক্রয়ের পর এমন কোনো উদ্বৃত্ত পুঁজি তাদের হাতে কখনো থাকেনি, যা দিয়ে তারা কৃষির উন্নতিতে পুনঃপুনঃ বিনিয়োগ করতে পারে বা বিনিয়োগের জন্য ওই পুঁজি যথেষ্ট। আবার কৃষিতে সম্পত্তির মালিক হিসেবে যে অনুৎপাদক জমিদার, ভূস্বামী ও মহাজনকে সেদিন কর্তৃত্বকারী কর্তাস্বত্বা হিসেবে পয়দা করা হয়, তারাও কৃষির উন্নতির জন্য কোনোরূপ বিনিয়োগ না-করে বর্গা বা লিজ প্রথার উদ্ভব ঘটিয়ে শুধু উদ্বৃত্তটাই লুটে নেয়। মোটামুটিভাবে এটাই হলো প্রাক ঔপনিবেশিক পর্ব থেকে ঔপনিবেশিক পর্বে সম্পত্তি-সম্পর্ক হিসেবে ভূমি মালিকানায় রূপান্তরের সংক্ষিপ্তসার। যে সম্পত্তি-সম্পর্ক ও ব্যবস্থাপনাকে কমিউনিস্ট পার্টিগুলো তাদের বিশ্লেষণ ক্যাটাগরির উপরে দাঁড়িয়ে সেমি ফিউডালিজম বা বাংলা তরজমায় আধা, সামন্তবাদ বলে দাবি করে আসছে। এখন প্রশ্ন হলো ঔপনিবেশিক পর্বের সম্পত্তি সম্পর্কের রদবদল কতটা ঘটেছে ’৪৭ অথবা ’৭১ উত্তর বাংলাদেশে এটা অবশ্যই জরুরি প্রশ্ন।

এবার আসা যাক আমলা পুঁজি ও মুৎসুদ্দি পুঁজি সম্পর্কে তাদের মতামত প্রসঙ্গে। মোটামুটিভাবে এসব দলগুলো দাবি করে থাকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে প্রত্যক্ষ উপনিবেশবাদের অবসান হয়ে নয়া-ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ গড়ে ওঠে প্রাক্তন উপনিবেশগুলোতে। ভারত উপমহাদেশও সেই প্রক্রিয়ার বাইরে ছিলো না কখনো। নয়া-উপনিবেশবাদের এই শাসন ক্ষমতাকে তারা বলে থাকেন আমলা পুঁজি ও মুৎসুদ্দি পুঁজির ক্ষমতা কাঠামোর যুগ। বিশেষত ঔপনিবেশিক বিশ্বে। মূলত নয়া-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ক্ষমতায় আমলা পুঁজির দৌরাত্ম বরাবরই প্রবল। আমলারাই এসব দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনার নিয়ামক শক্তি। তারাই প্রশাসক, সিদ্ধান্তদাতা ও জাতীয় সম্পদ নিয়ন্ত্রণকারী। জাতীয় অর্থনীতিতে তারা কখনই পুঁজি বিনিয়োগ না-করেও গোটা ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। সাম্রাজ্যবাদ প্রত্যক্ষভাবে আমলা শ্রেণীর সঙ্গে সংযোগ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে আলোচিত রাষ্ট্রগুলোকে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মূলত প্রকল্পভিত্তিক চুক্তি, ঋণ সাহায্য, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বেসামরিক-সামরিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-শিক্ষা সংক্রান্ত চুক্তির মধ্য দিয়ে তাদের এই নিয়ন্ত্রণ কখনো মূর্ত, কখনো বিমূর্তভাবে প্রকাশ পায়। ফলে একটি দেশের শাসন ক্ষমতা আমলা শ্রেণী কুক্ষিগত করে ফেললে, তাদের স্বার্থ ও সাম্রাজ্যবাদী একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ থেকে যে পুঁজির জন্ম হয় সেটা কেই তারা বলছে আমলা পুঁজি। এই পুঁজির বরাবরই উৎপাদন বিমূখ। এই পুঁজির প্রধানাংশটা অনুৎপাদক খাত হিসাবে প্রধানভাবে বিভিন্ন ভোগ বিলাস ও চোরাকারবারিতে নিয়োজিত হয়ে থাকে। অথবা বিদেশে পাচার হয়ে যায়। নয়া-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রসমূহে আমলা পুঁজি সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতি ও উপনিবেশবাদ বিরোধী যে কোনো মাত্রার রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতির বিপক্ষশক্তি হিসেবে কাজ করে। অনুৎপাদনশীল খাতেই তারা প্রধানত পুঁজি বিনিয়োগ করে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ সম্পদের যথেচ্ছা লুঠপাট, ঘুষ, সরকারি কোষাগার লুঠপাট ও প্রকল্পভিত্তিক ঘুষ গ্রহণ তাদের প্রধান আয়।

একইভাবে নয়া-উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোতে মুৎসুদ্দি পুঁজির (ঈড়সঢ়ৎধফড়ৎ ঈধঢ়রঃধষ) নিয়ন্ত্রণ ও প্রাধান্য বরাবরই প্রবল। মূলত এসব দেশগুলোতে বুর্জোয়াদের সেই অংশকে তারা মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া বলছে, যারা ব্যক্তিগত বা যৌথভাবে সাম্রাজবাদী রাষ্ট্রগুলোতে উৎপাদিত শিল্প পণ্য বা বহুজাতিক কোম্পানির উৎপাদিত পণ্য, স্থানীয় বাজারে বিক্রির এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। কখনো তারা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের শিল্প প্রতিষ্ঠান বা বহুজাতিক কোম্পানির শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়া-উপনিবেশিক রাষ্ট্রের শ্রম ও কাঁচামাল সংগঠিত করে বিদেশী বাজারের প্রয়োজনে শাখা শিল্প স্থাপন করে। মূলত মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ারাও প্রধানভাবে বিদেশী বাজারের প্রয়োজনেই উৎপাদন সংগঠিত করে থাকে। এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা স্থানিয় শিল্প সম্পদ ধ্বংস করে দেয়। ফলে আমলা পুঁজির মতই মুৎসুদ্দি পুঁজিও উপনিবেশবাদ বিরোধী রাজনীতি ও জাতীয় অর্থনীতি বিরোধী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে প্রত্যক্ষ উপনিবেশবাদের পতন ঘটলেও ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রসমূহে এই আমলা ও মুৎসুদ্দি পূঁজির দ্বৈত শাসন অনেক দেশেই আজ প্রতিষ্ঠিত। এটাকেই তারা বলছে নয়া উপনিবেশবাদের যুগ। যে যুগে সাম্রাজ্যবাদ প্রত্যক্ষ শাসন ক্ষমতা বজায় না রেখেও উপরে উল্লেখিত প্রকল্প বা উন্নয়নের রাস্তা ধরে উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাছাড়া, এসব দেশগুলোতে পুঁজিবাদ গড়েই উঠেছে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির একচেটিয়া আধিপত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে, এবং তাদের দেওয়া সুযোগ সুবিধা কাজে লাগিয়ে। যা স্থানীয়দের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশাধিকারের ছাড়পত্র ছিলো। ফলে এসব দেশে সাম্রাজ্যবাদ নির্ভরতা কে তারা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নির্ভরতা হিসেবে বিবেচনা করে না। অর্থনৈতিক নির্ভরতার থেকে ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়ও তারা মনে করে না। এর সঙ্গে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও কাঠামোগত আধিপত্য, শ্রেণীর পরিগঠনসহ আরো হাজারো প্রশ্ন জড়িত রয়েছে বলে তারা মনে করেন। সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির যেসব বৃহৎ শিল্প শাখা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেই শাখার মধ্যে যে শ্রমবিভাজন সেখানে আমাদের অবস্থান, আর আন্তর্জাতিক স্তরে আমাদের কৃষি যে বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং সেই বাজারের শ্রম বিভাজনে আমাদের যে অবস্থান এই দুইয়ের মধ্যে দেশ বিবেচনায়, একটির সঙ্গে অপরটির আন্তসম্পর্ক নেই। আবার আন্তর্জাতিক শ্রমবিভাজনে এসব দেশের অর্থনীতির সংশিষ্টতা থাকলেও সেটা পুরোপুরি অধিনতামূলক। এভাবে বিশ্ব পুঁজিবাদী বা সাম্রাজ্যবাদী শ্রমবিভাজনের সঙ্গে ঔপনিবেশিক বিশ্বের কৃষি ও শিল্পের শ্রম বিভাজন সম্পর্কিত থাকলেও যেখানে নীতি নির্ধারক ও নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে সাম্রাজ্যবাদ আজো নির্ধারক ভূমিকা পালন করে থাকে। তারাই এক একটি দেশের শ্রমবিভাজন নির্দিষ্ট করে দেয়। এবং গোটা ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি, নাট-বল্টু, কারিগরী জ্ঞান, বিশেষজ্ঞদের প্রশিক্ষণ প্রদান ইত্যাদি সরবরাহ করে কাঠামোগত অধিনস্ততা আরো বাড়িয়ে আমাদের মত রাষ্ট্রগুলোকে সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর করে তোলে। ফলে এইসব দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানের ৭০ শতাংশ, কাঁচামাল ও শ্রমের ৯০ শতাংশ, যন্ত্রপাতির ৯০ শতাংশ, জ্ঞান-প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার পুরোটাই আজ সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর। স্বনির্ভর কৃষির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে, স্থানীয় ও জাতীয় সম্পদ হিসেবে শিল্পকারখানা ধ্বংস করে দিয়ে এবং জীবন-যাপনের সমস্ত উপাদানগুলোকে শুকিয়ে মেরে ও তার বিলুপ্তি ঘটিয়ে বিপরীতে উন্নয়ন ও রাষ্ট্রীয় ঋণ সাহায্যের নামে সাম্রাজ্যবাদ নির্ভরতা, নির্দিষ্ট জ্ঞান, যন্ত্রপাতি ও আমদানি পণ্যের উপর নির্ভরতা, প্রতিটি অধিনস্ত দেশগুলোতে সেই ঔপনিবেশিক পর্বে গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে নয়া-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের উন্নয়ন প্রকল্প, জ্ঞান ও ঋণ সাহায্যের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণ প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত বরাবরই। তারা শাসন ক্ষমতা প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণে না-নিয়েও এইসব দেশকে কব্জা করে থাকে আলোচিত দুইটি শ্রেণীর মাধ্যমে। আবার অসংখ্য সামরিক চুক্তির সূত্র ধরে সরাসরি এসব দেশকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে প্রধানত ওই দুই শ্রেণীর মধ্য দিয়ে। ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শাসনকালে প্রশাসক হিসেবে এই আমলাশ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছিল সেটাও আমরা জানি। আবার মুৎসুদ্দি পুঁজির জন্মও হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পস্থাপনা ও শিল্পকারখানার শেয়ার কেনার মাধ্যমে। সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ, তাদের (সাম্রাজ্যবাদ) প্রতিষ্ঠিত বাজারের তাগিদ থেকে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে সেদিন এই শ্রেণী জন্ম লাভ করে। এর বাইরে ব্যবসা বাণিজ্য তো রয়েছেই। মূলত ভারত উপমহাদেশে নির্ধারক শক্তি হিসেবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সম্পত্তি-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও পণ্য-অর্থপণ্য সম্পর্কের মধ্য দিয়ে আলোচিত মুৎসুদ্দি পুঁজি সেদিন জন্ম লাভ করে।

একই সময়ে গ্রামীণ ভারতের অর্থনীতি ছিলো ব্রিটিশ সৃষ্ট জমিদার, ভূস্বামী, জোতদার, বণিক ও মহাজনদের নিয়ন্ত্রণে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতিষ্ঠিত সম্পত্তি-সম্পর্ক এবং পণ্য-অর্থ-পন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেদিন শ্রেণী হিসেবে এসব বর্গের উদ্ভব ঘটে। ঔপনিবেশিক ক্ষমতা কাঠামো ও সম্পত্তি-সম্পর্কের মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, শ্রেণী হিসেবে এসব বর্গকে ভূমি মালিকানার ভিত্তিতে সংগঠিত করে উৎপাদক কৃষক সমাজের শ্রমফলকে উদ্বৃত্ত (ভূমি খাজনা) আকারে লুট ও ভোগ দখলের ব্যবস্থা করে দেয়। ফলে ওই ব্রিটিশ পর্ব থেকে ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, জমিদার, জোতদার, মহাজন ও বণিকদের একটি অংশ ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় শিল্প সংস্থাগুলোর শেয়ার কিনছে, কেউবা শিল্পোদ্যোগগুলোতে অংশ নিচ্ছে, কিন্তু গ্রামীণ জীবনে ভূমি মালিকানা বা সম্পত্তি-সম্পর্কের যে বিন্যাস, তাকেও বহাল রাখার মধ্য দিয়ে শ্রেণী হিসেবে তারা কৃষক স¤প্রদায়ের শ্রমের ফলকে বা উদ্বৃত্তকে রাজস্ব হিসেবে লুঠও করে চলেছে। ভূমি মালিকানার দখলিস্বত্ব বা ভূমির মালিকানার কর্তাস্বত্বার কারণে শ্র্রেণী হিসেবে তারা যখন সাম্রাজ্যবাদী শিল্প ও বাজারের প্রয়োজনে ‘পণ্য উৎপাদন-সরবরাহ’ সংগঠিত করতে সক্ষমতা অর্জন করে, তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও উক্ত শ্রেণীর অনুকূলে নতুন নতুন আইন-কানুন সৃষ্টি করে। ফলে প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক যুগে আমাদের মতো দেশগুলোতে আমলা, মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া, ভূস্বামী, জোতদার, জমিদার, মহাজন ও বণিকদের স্বার্থ সংরক্ষণসহ তাদের উপরেই সম্পত্তি-সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয় এবং সেটা ঘটেছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যুগে। ফলে আলোচিত দলগুলো মানে ’৪৭ পরবর্তী সময়কালে আইনগতভাবে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করা হলেও সম্পত্তি-সম্পর্কের অবস্থান থেকে আজো ঔপনিবেশিক বাস্তবতা বহাল রয়েছে। এবং সমাজের গণতান্ত্রিক রূপান্তর সংগঠিত হয়নি। ’৭১ পরবর্তী সময়কালেও ওই একই রূপ বহাল থাকায় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তার সার্বভৌম অর্জন করতে পারেনি। এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে তারা কৃষি বিপ্লব বা নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার কথা বলেছেন।

তারা কি প্রতিষ্ঠা করতে চায়?

এবার আমরা কৃষি বিপ্লব বলতে আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলো ঠিক কোন ধরনের সম্পত্তি-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা বা সমাজ বির্নিমানের কথা বলে থাকে, তার উপরে সংক্ষিপ্ত পরিসরে কিছু আলাপচারিতা সেরে নিতে পারি। তবে তাদের প্রসঙ্গে যাওয়ার পূর্বে আমাদের কৃষি নিয়ে যে সব তথ্য- উৎপত্তি চালু রয়েছে তার প্রতিও অল্প বিস্তর দৃষ্টিপাত করা দরকার, চলমান আলোচনার স্বার্থ থেকে।

আমাদের দেশের অসংখ্য অর্থনীতিবীদ ও সমাজ গবেষকদের মতে, বাংলাদেশ ভৌগোলিক আয়তনের বিচারে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করেন ৯২০ জন মানুষ। আজো দেশের তিন-চতুর্থাংশ মানুষেরই বাস গ্রামে। সেই বিবেচনায় জনগণের প্রধান অংশের আয়ের উৎস আজো ভূমি।

২০০৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৬ কোটি ৫০ লাখ দরিদ্র। যাদের প্রধানাংশের বাস আবার গ্রামে। এই গ্রামীণ জনসংখ্যার মধ্যে ৫৫ শতাংশ হচ্ছেন ভূমিহীন বা অর্থনৈতিক বিবেচনায় ভূমিহীন। এর সঙ্গে রয়েছে আরো ৩১ শতাংশ প্রান্তিক চাষী। সব মিলিয়ে গ্রামীণ জনগোষ্ঠির ৮৬ শতাংশ হচ্ছেন দরিদ্র। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই ৮৬ শতাংশ মানুষই প্রত্যক্ষ ও প্রধানভাবে গা গতরে কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। অথচ কর্মসংস্থানের উৎস হিসেবে উৎপাদনের উপায় ওই ভূমি মালিকানার উপরে তাদের কোনো দখলিস্বত্ব নেই। উৎপাদনের কোনো উপায়ও তাদের হাতে নেই। অথচ দেশের ৪৫ শতাংশ জমির মালিকানা রয়েছে এমন ৬ শতাংশ মানুষের হাতে, যাদের সঙ্গে কৃষির কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই, শুধুমাত্র কৃষি থেকে উদ্বৃত্ত লুঠ করা ছাড়া। কৃষি ব্যবস্থাপনায় যাদেরকে বলা হয়ে থাকে অনুৎপাদক শ্রেণী। দেশের মোট সরকারি খাস জমি রয়েছে ১ কোটি বিঘা। তার মধ্যে ৯০ শতাংশ জমি আবার ওই অনুৎপাদক গোষ্ঠিরই ভোগ দখলে।

পাশাপাশি আমাদের দেশে মোট মামলার ৭৬ শতাংশ বা ২৫ লাখ মামলাই হলো ভূমি সংক্রান্ত। এবং এই ভূমি সংক্রান্ত মামলায় বাদী-বিবাদী উভয়ে প্রতি বছর ব্যয় করে থাকেন ২৪ হাজার কোটি টাকা। পরিমাণ হিসেবে টাকার এই অংকটা হলো আমাদের দেশের প্রতি বছরের উন্নয়ন বাজেটের সমপরিমাণ। আবার ওই ২৪ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রায় অর্ধেক টাকা লেনদেন হয় ঘুষ হিসেবে। যা ভূমিকর্মকর্তা, পুলিশ, আমলা, উকিল ও বিচারকদের পকেটস্থ হয় বলে সমাজ বিশ্লেষকদের দাবি।

উপরোক্ত পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে সেই আইয়ুব খানের আমল থেকে সবুজ বিপ্লব, স্বনির্ভর কৃষি, উচ্চ ফলনশীল কৃষির গল্প শুনতে শুনতে আজ এমন একটি পর্যায়ে উপস্থিত হয়েছি যে, মোটা চালের দাম ৩৫ টাকাতে ঠেকেছে। উন্নয়ন জগতের দিকপালরাই বলছেন আমাদের কৃষি ও তার ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। চালের বদলে আলু খাওয়ার পারামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরামর্শদাতারা বলছেন খাদ্য সংকট আজ বিশ্বব্যাপী। পৃথিবীর অনেক দেশে খাদ্য নিয়ে দাঙ্গা হচ্ছে। সেটা নাকি আগামীতে আরো বেড়ে যাবে। খাদ্য সংকটে অসংখ্য মানুষ মারা যাবে। আমাদের দেশে ইতিমধ্যে খাদ্য ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে শিশুদের কেনাবেচা শুরু হয়ে গেছে। ক্ষুধার কারণে বাবা তার ঔরসজাত শিশুকেও খুন করছে । মূলত এটাই হলো তথাকথিত সবুজ বিপ্লব বা উচ্চ ফলনশীল কৃষির ফলাফল।

এর সঙ্গে আরো তথ্য রয়েছে। আমাদের দেশে প্রাপ্ত শ্রম সময়ের মধ্যে ৪০ শতাংশেরই বেকারের সংবাদ। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের উঠতি যুবকদের বেকারত্বের সংবাদ। রয়েছে শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সংবাদ। সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন উন্নয়নে স্থবিরতা চলছে। কেউ বলছেন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা স্বল্পতার কথা। বাজার দর্শনওয়ালারা বলছেন বাজারের আরো স্বাধীনতা বাড়াবার কথা। অর্থাৎ ’৭১ পরবর্তী বাংলাদেশে বাজার দর্শন গ্রহণ করার ফলাফল হিসেবে আজ যেখানে এসে ঠেকেছি, তাতেও অনেকে সন্তুষ্ট নন। আবার অনেকে বলছেন-বাজার নয়, বরং আমরা যদি রেশনখোর জাতি হয়ে উঠতে পারি একমাত্র তাহলেই সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটানো যাবে ইত্যাদি। আসলে প্রশ্ন হিসেবে আলোচিত বিষয়বস্তু ঘুরে ফিরে প্রায়ই আমাদের জীবন যাপনের মধ্যে মাঝে মধ্যে এসে পড়ছে। তবে পাঠকদের স্মরণ রাখা দরকার উপরে উল্লিখিত বিষয়বস্তু নিয়েই বা কৃষি প্রসঙ্গ নিয়ে আমাদের দেশে রাজনৈতিক বিভাজন ঘটেগিয়েছিল সেই ৬০ দশকে। সেই আলোকেই বা বাজার দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আমাদের শাসক রাজনৈতিক দলগুলো দেশ পরিচালনা করছে। এর বিপরীতে যারা আজ রাজনৈতিকভাবে ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ডের শিকার, তারা বলছেন কৃষি বিপ্লবের কথা। এই মৌলিক বিষয়টি আলোচনার শুরুতেই আমাদের স্পষ্ট থাকা দরকার।

মূলত আমাদের দেশের কৃষি ও তার ব্যবস্থাপনার বেহাল দশা অনেকদিন থেকেই। ওই দশা যখন প্রকট হয়ে ওঠে, সমাজের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তকে যখন স্পর্শ করে, তখন দেশজুড়ে হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। এবং নানান পদের পরামর্শ সভা ঘটতে দেখি আমরা। যা এখন হরহামেশাই হচ্ছে। অথচ আমাদের অনেক সমাজ গবেষকই দীর্ঘদিন থেকেই বলে আসছেন, দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ আজো কৃষির উপরে নির্ভরশীল। এই মানুষগুলোকে যদি বাচাঁতে হয়, তাহলে, কৃষির উন্নতি প্রয়োজন। এবং উন্নতির প্রশ্নে তারা প্রচলিত মালিকানা ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় আইন-কানুনকেই বাধা হিসেবে দেখেছেন। তাদেরও ভাষ্য মতে জমির প্রধানাংশের মালিকানা সমাজের এমন শ্রেণীর হাতে কেন্দ্রভূত হয়ে রয়েছে, যারা কশ্চিনকালেও জমি চাষ করে না। জমির উন্নতিতে পুঁজি বিনিয়োগ করে না। ফলে সমাজের প্রধানাংশে মানুষকে যদি বাচাঁতে হয়, রক্ষা করতে হয়, তাহলে দেশের প্রচলিত ভূমি আইন এবং ভূমি আইনের সংস্কারই যথেষ্ট নয়। তারা প্রতীকী অর্থে হলেও ভূমি মালিকানার সংস্কারের উপরে গুরুত্বারোপ করে আসছেন। এবং প্রতীকী অর্থে সংস্কার বলতে তারা প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সরকারি ১ কোটি বিঘা খাস জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণের উপরে জোর দিয়েছেন। পরবর্তীতে পরিবার প্রতি কৃষি জমির সিলিং নির্ধারণ। তার সঙ্গে ফলনশীল ফসলের চাষাবাদ। আমাদের স্মরণ রাখা দরকার এই ধারার সমাজ গবেষকরা কিন্তু কেউই কৃষি বিপ্লবের দাবি তোলনি। তার প্রচলিত মালিকানা কাঠামো ও আইনকানুনের মধ্যেই ফয়সালা চেয়েছেন। যেমনটি ঘটেছিল তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়াতে। যে বিশ্ব ব্যাংককে আমরা আজ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের উপর খবরদারী করতে দেখি। এবং যে রাষ্ট্রকে বর্তমান জামানায় পৃথিবীর অধিকাংশ জনগণ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। সেই আমেরিকা ও বিশ্বব্যাংকের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়াতে সিলিং নির্ভর ভূমিসংস্কার ঘটেছিল। আমাদের শাসক রাজনৈতিক দলগুলো এধরনের একটা পদক্ষেপও নিতে পারত। কিন্তু তারা সেটাও করেননি। করতে পারলে কৃষি থেকে উদ্বৃত্ত জনসংখ্যাকে শিল্পে স্থানান্তর করতে পারতেন তারা। তাতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ত। আভ্যন্তরিণ বাজারের আরো স¤প্রসারণ ঘটত। আমাদের শাসক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আমেরিকান সরকারগুলোর হরহামেশাই আমরা বৈঠক করতে দেখি। বিশ্বব্যাংক, আই এম এফ ও এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে গভীর সখ্যতাও দেখি। তাদের ম্যানেজ করে এধরনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা আমাদের সরকারগুলোকে দেখিনি।

আর ম্যানেজ করার প্রশ্নটা আসছে প্রধানভাবে রাজনৈতিক কারণেই। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালে চীন ও উত্তর কোরিয়ার স্বাধীনতা অর্জন ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার প্রভাব থেকে রক্ষা করতে তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়াতে বিশ্বব্যাংক ও আমেরিকা সবুজ বিপ্লব নামের এক কর্মসূচির প্রয়োগ করে। যে কর্মসূচির মধ্যে সিলিং নির্ভর মালিকানা ও ইরিগ্রেশন সম্পর্কিত। ওই দুইটি দেশের যতটা উন্নয়ন ঘটেছে তার মূলেও রয়েছে ওই ভূমি মালিকানার রদবদল। সাধারণভাবে বা নীতিগতভাবে বিশ্বব্যাংক ও অ্যামেরিকা আমাদের মত রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে ভূমি মালিকানার যে কোনো ধরনের সংস্কারের ঘোর বিরোধী। এককালীন গণপ্রজাতান্ত্রিক চীন ও উত্তর কোরিয়ার প্রভাব থেকে মুক্ত করতে তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়াতে ওই পদক্ষেপ নেয় তারা। এবং তারা লাল বিপ্লবের বিপরীতে সবুজ বিপ্লব নামের এক তরিকাও দাঁড় করায়। ফলে চাইলেই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একই মডেলের সংস্কার হবে এটা সম্ভব নয়। বিশ্বব্যাংক ও আমেরিকা চায় কিনা সেটাই মূল প্রশ্ন। ফলে ম্যানেজ করার প্রশ্নটা এসেছে। কিন্তু আমাদের সরকারগুলো এবং আমলাতান্ত্রিকতাও ওই প্রকল্পের ঘোর বিরোধী। ফলে গত এবং ৩৭ বছরে যারাই এদেশের শাসন কার্য পরিচালনা করেছে, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয়পার্টি, জামায়াত ফকরুদ্দিনের সরকার, তারা সবাই বিশ্বব্যাংক, আই এম এফ, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক ও বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের কৃষিকে স্থবির রেখে বিদেশী ঋণ সাহায্য নির্ভর শহর ভিত্তিক শিল্পায়ন গড়ে চলেছেন। এতে করে আমাদের বর্তমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে ধনিক শ্রেণীর অভিমুখিতা, বিদেশী সাহায্য নির্ভরতা এবং শহর অভিমুখিতা আজ প্রকট আকার ধারণ করেছে। একই সঙ্গে এই ৩৭ বছর ধরে সেই উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে একদম চিহ্নিত লুটেরাগোষ্ঠির স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে। মূলত আমাদের দেশের সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর লুটেরা মনোবৃত্তির সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদীদের পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বাধার কারণেই, যেসব সমাজ বিশ্লেষকরা দীর্ঘদিন থেকে রাষ্ট্রের আইনগত কাঠামোর মধ্যে প্রচলিত মালিকানা ব্যবস্থা বহাল রেখেই ন্যূনতম অর্থে হলেও একটা ভূমি সংস্কারের দাবি তুলেছিলেন, সরকারি ১ কোটি খাস জমিটুকু বিতরণের কথা বলে আসছেন, সেটাও নীতি নির্ধারকদের কাছে বর্জিত হয়েছে। নীতি নির্ধারকরা মনে করে, যে কোনো ধরনের সিলিং আরোপ বা ভূমিবন্টনের অর্থ হলো ব্যক্তি উদ্যোগের উপরে হস্তক্ষেপ। অর্থাৎ শাসক রাজনৈতিক দলগুলো এবং সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্র নীতিগতভাবেই আমাদের দেশের লুটেরা অনুৎপাদক শ্রেণী এবং পরাশক্তি হিসেবে সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদে আগ্রহী নয়। এসব রাজনৈতিক দল ও দেশের আমলাতন্ত্র সমাজের নিয়ামক শক্তি হিসেবে আজ লুটেরা অনুৎপাদক শ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে মৈত্রীর মধ্য দিয়েই আরো ক্ষমতাবান ও সম্পদশালী হয়ে উঠছে। আর এই মনোবৃত্তির কারণেই আলোচিত দল হিসেবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয়পার্টি, জামায়াত যেমন গণতান্ত্রিক চরিত্রসম্পন্ন রাজনৈতিক দল হয়ে উঠতে পারেনি, তেমন এসব ক্ষমতাসীন দলের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হওয়ার কারণেই রাষ্ট্র ও সমাজের ন্যূনতম অর্থে হলেও গণতান্ত্রিক রূপান্তর সংগঠিত হয়নি। মূলত গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মৌল কর্মসূচি হিসেবে কৃষি প্রশ্ন, প্রচলিত সম্পত্তি সম্পর্কের প্রশ্ন এবং ভোগদখলের প্রশ্নটি পাশকাটিয়ে বা উহ্য রেখে কোনো রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে যেমন গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠা সম্ভব নয়, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্ভব নয়। আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ক্ষমতাসীন দলগুলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্ট সম্পত্তি-সম্পর্ক বহাল রেখেই দারিদ্র্য দূরীকরণ, দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রবৃত্তি অর্জনের কেরামতি দেখাতে দেখাতে অবশেষে কৃষি ব্যবস্থাপনাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এবং এই মহলের সঙ্গে সম্পর্কিত ইসলামিক পণ্ডিত বা আলেম সম্প্রদায়ের একাংশ ওই ব্রিটিশ সৃষ্ট মালিকানাকেই ন্যায্যতা দিয়ে তারা আরো ইসলামীকরণ চাইছে।

আমরা আলাপচারিতার এই পর্বেই বলেছি যে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে তারা শাসক হিসেবে আমাদের সম্পত্তি-সম্পর্ক বদলে দিয়ে সম্পদ শোষনের ক্ষেত্র হিসেবে কৃষিখাতকে গড়ে তুলেছিল। এবং সেই থেকে আমাদের কৃষি আর স্থানীয় জনগোষ্ঠির খ্যাদ্যের উৎস কিংবা জীবনধারণের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। বিশ্ববাজারে অধিনস্ত এই কৃষির লক্ষ্য হলো উন্নত ধনতান্ত্রিক এবং সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর জন্য খাদ্যশস্য, কপি, চা, মাছ-মাংস, ফলমূল, তরিতরকারিসহ আরো হাজারো পদের কৃষি পণ্যের যোগান দিয়ে যাওয়া। আমাদের মত দেশগুলোর উৎপাদক কৃষকরা নিজেরা অভুক্ত থেকে, সন্তানদের অভুক্ত রেখে, জীবন ধারণের সমস্ত মৌলিক চাহিদা থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে সেই কর্মটি করে চলতে বাধ্য হচ্ছে। সরকারি পরিভাষায় এর নামকরণ করা হয়েছে উন্নয়নশীল কৃষি। যা আমাদের বিদেশী মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত হিসেবেও বিবেচিত। সরকারি এই পরিভাষা যদি আমরা উল্টে দেই, তাহলে তার অর্থ দাঁড়াবে এমন--আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা--কর্মী, সামরিক-বেসামরিক আমলা, পুঁজিপতি শ্রেণী, নগরকেন্দ্রিক ফটক বাজ ও চোরাকারবারীদের ক্ষমতা সংহত ও ভোগ বিলাসীতার জন্য বিদেশী উন্নতমানের অবৈধ অস্ত্র আমদানি, সন্তানদের বিদেশে শিক্ষাগ্রহণ, বিদেশে আবাসিক স্থল ক্রয়, তাদের প্রমদ ভ্রমণ, বিদেশে চিকিৎসা ক্রয়, ডলার পাচার, চোরাকারবারীসহ আরো হাজার পদের যে কায়কারবার এবং তার প্রয়োজনে যে বিদেশী মুদ্রার দরকার পড়ে, সেই বিদেশী মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্য চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে উৎপাদক কৃষকের ঘাড়ে। এবং সেটাকেই বলা হচ্ছে উন্নয়নশীল কৃষি।

একই সঙ্গে এদেশের আমলাতন্ত্র ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো কৃষিকে স্থবির রেখে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর শিল্পকারখানা গড়তে দিয়ে আরো নানা রকমের সংকট তৈরি করেছে। যেমন গত ৩৪ বছরে বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য পেয়েছে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। যার শতকরা ৭৫ ভাগই নানান প্রক্রিয়াতে লুঠ করেছে আলোচিত গোষ্ঠিগুলো। টাকার অংকে ওই লুঠ হওয়া টাকার পরিমাণ হলো ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এই অবৈধ টাকাঅলারাই আজ আমাদের দেশ-রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে কর্তৃত্বকারী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এবং ওই বিদেশী ঋণ নির্ভরতার কারণে বাংলাদেশের জনগণ আজ মাথা পিছু ১২ হাজার টাকা করে প্রত্যেকেই বিদেশীদের কাছে ঋণি। আবার ওই ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়েছে পরোক্ষ করারোপ করে। অর্থাৎ প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপরে অধিক হারে কর ও ভ্যাট বসিয়ে। দেশের রাষ্ট্র প্রধান, অর্থমন্ত্রীসহ এদেশের সমস্ত পদের বড় লোক ধরা না পড়লে যে কর দেন না তা আজ আমরা হরহামেশাই দেখছি। তাদের পাপের বোঝা পরোক্ষ করের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে।

অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক, আই এম এফ, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকসহ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র নির্ভর প্রকল্পভিত্তিক ঋণ সাহায্য ও শিল্পায়ন ঘটানোর কারিশমা আজ আমাদের সামনে আরো খোলামেলা হয়ে পড়েছে। মূলত ওই সব সংস্থা বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে ঋণ-সাহায্য গ্রহণ করতে গিয়ে তাদের শর্ত অনুযায়ী আমাদের কর্তাব্যক্তিরা রাষ্ট্র হিসেবে এদেশের নীতি নির্ধারণী ক্ষমতা তাদের হাতেই সম্পূণরূপে সপে দিয়েছে। ফলে ’৭১ পরবর্তী বাংলাদেশ জাতিসংঘ স্বীকৃত একটি দেশ হলেও এদেশের বিডিআর-এর নওজোয়ানদের সঙ্গে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষিদের প্রায় প্রতিদিন সীমান্ত সংঘর্ষ হলেও, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব বলতে যা বোঝায় সেটা আজ আর বাংলাদেশের নেই। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রশ্নে, আমাদের জাতীয় প্রশ্নে ওই সব সংস্থা ও রাষ্ট্রের সাধারণ কর্মচারীরা যেভাবে ওয়াজ- নসিহত করে চলেছে তাতে সেটাই প্রমাণিত হয়। তাছাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর নায়কদের, তাদের সন্তানদের, তাদের বৌ-ঝিদের ধরে ধরে যেভাবে উঙ্গল কায়দায় শায়েস্তা করা হচ্ছে, তাতে এ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নটি আদতেই কোনোকালে ছিলো কিনা সেটাও আজ জরুরি প্রশ্ন। বিদেশী রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বিভিন্ন চুক্তির শর্ত ধরে ও পরিকল্পনামাফিক আরো জাঁকিয়ে বসছে। তারা আরো সুযোগ সুবিধা চাচ্ছে আর ক্ষমতাসীন দলগুলোর গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম অবশিষ্ট নেতা-নেত্রীর তাদের সঙ্গে ফটোসেশন করে চলছে। মূলত এটাই হচ্ছে আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতা। এবং আমাদের জন্য প্রশ্ন হলো দেশ ও রাষ্ট্রের এই পরিণতির জন্য কারা প্রকৃত অর্থে দায়ী তাদেরকে চিহ্নিত করা।

আমরা কমবেশি যে, ৬০- এর দশকের শেষ লগ্নে এসে যখন আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, পূর্ববাংলার স্বায়ত্ত্বশাসনের আন্দোলন শেষ নাগাদ স্বাধীনতার আন্দোলনে গড়াবে, তারই প্রতিক্রিয়াতে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রশ্নে, কৃষি প্রশ্নে আমাদের নীতি নির্ধারক, রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব¡রা দল হিসেবে আলাদা হয়ে যান। এর মধ্যে যে সব রাজনৈতিক দল গণতন্ত্র বলতে শুধুমাত্র পাঁচ বছর অন্তর অন্তর সংসদ নির্বাচন বোঝে এবং সেটাকেই মূল ধারার রাজনীতি হিসেবে দাবি করে থাকে, তার একটা খুবই সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা সারলাম আমরা। এবার আমরা আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টির কৃষি বিপ্লবের পর্যালোচনার একটা সংক্ষিপ্ত সার তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

আমাদের দেশে যে সব কমিউনিস্ট পার্টি আজ নিজেদেরকে মাওবাদী হিসেবে দাবি করছেন; যাদের নেতা-কর্মীরা আজ প্রধানভাবে ক্রসফায়ারের শিকার। ওইসব রাজনৈতিক দল এক সময় নকশাল নামে পরিচিত ছিলো। এবং আমরা সবাই কমবেশি এটাও জানি যে, ভারতের নকশালবাড়ির নাম অনুসারে ওই নামকরণটি ঘটে সেদিন।

মূলত আমাদের উপমহাদেশের রাজনীতিতে নকশালবাড়ির তরাই অঞ্চলের কৃষকরা যে সশস্ত্র কৃষি সংগ্রাম শুরু করেন সেটাকেই অনেক সমাজ বিশ্লেষক ‘কৃষি বিপ্লবের’ সূত্রপাত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। উপমহাদেশ জুড়ে তার প্রভাব ছিলো আলোড়ন সৃষ্টিকারী ও যুগান্তকারী। কারণ তাকে কেন্দ্র করেই উপমহাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতি বিভক্ত হয়ে পড়ে। বিভক্ত হয়ে যায় কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলনও। তার মধ্যে যারা তরাইয়ের পথ গ্রহণ করেন তারাই নকশাল নামে চিহ্নিত। বিশেষত ভারত ও বাংলাদেশ। আর নেপালে সেটা স্থানিকভাষায় নামকরণ হয় ঝাপা আন্দোলন। এই ঝাপা আন্দোলনের উত্তরাধীকারীরাই আজ নেপালের মাওবাদী পার্টি হিসেবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত এবং এখন তারা ক্ষমতাসীনও।

আজ আমাদের দেশ একটা সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। যার মধ্যে খাদ্যসংকট অন্যতম। আমরা পকেট ভর্তি পয়সা নিয়ে বাজারে গেলে চাল পাচ্ছি না, বিষয়টি এমন নয়। অর্থাৎ চাল বাজারে রয়েছে কিন্তু সেটা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। ফলে সাধারণ মানুষ যা আয় করেন তার প্রধানাংশ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে চাল কিনতেই। এর অন্যতম কারণ হলো চাল ব্যবসায়ীদের একটা শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেটকে আবার নীতিগতভাবেই সহযোগিতা দিয়ে চলেছে নীতি নির্ধারকদের সিন্ডিকেট। দেশের কর্তৃত্বশালীরা, ক্ষমতাশালীরা, রাজনীতিবীদরা এসব সিন্ডিকেট বজায় রেখেই বিদেশ থেকে চাল আমদানি করার নীতি গ্রহণ করেছেন। ফলে আমাদের অর্জিত বিদেশী মুদ্রার একটি অংশ চাল কেনা বাবদ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ঠিক একই ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিল ভারত। ১৯৬৪ সালের খাদ্য সংকট ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ অনেক রাজ্যকে গ্রাস করে সেদিন। কৃষকরা খাদ্য নিয়ে দাঙ্গা করেন। অনেকে জীবন দেন। এবং ওই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে তরাই-এর কৃষক আন্দোলন একটা পথ বাতলায়। সেটাই নকশালবাড়ির পথ নামে খ্যাত। তরাই-এর কৃষকরা সেদিন একটা মৌলিক দাবি সামনে এনে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। শ্লোগানাকারে স্থানিকভাষায় তারা দাবি করেন ‘পহেলা সব খেত রাষ্ট্রকে হাত মে হয়েক পড়ি’। তাদের দশ দফা কর্মসূচির মধ্যে এটাই ছিলো অন্যতম বা প্রধান দাবি। যাকে সমাজ বিশ্লেষকরা কৃষি বিপ্লবে সূচনা আকারে দেখে থাকেন। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সঙ্গে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বলে মনে করেন।

মূলত এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ''পহেলা সব খেত রাষ্ট্রকে হাত মে হয়েক পড়ি'' এই শ্লোগানের মধ্য দিয়ে তরাই-এর কৃষকরা জমি জাতীয়করণ করে তাকে জাতীয় সম্পদে পরিণত করার কথা বলেছিলেন। অথচ আমাদের দেশের নীতিহীন ও নামধারী কমিউনিস্টরা তরাই এর রাজনীতির নামকরন করেছেন, চারু মজুমদারের ব্যক্তি হত্যা, সন্ত্রাস ও গলাকাটার রাজনীতি নামে। এখন আমরা খুবই সংক্ষেপে পর্যালোচনা সেরে নিতে পারি জমি জাতীয়করণ করে জাতীয় সম্পদে পরিণত করতে পারলে মোটা দাগে সমাজের সবাই ঠিক কোন ধরনের ফলাফল ভোগ করতে পারবেন।

এই দাবি যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে প্রচলিত সম্পত্তি সম্পর্ক ঘিরে যে ব্যক্তি মালিকানা ভিত্তিক কর্তাস্বত্ত্ব গড়ে উঠেছে, প্রথমেই তার উচ্ছেদ ঘটে যাবে। অর্থাৎ এ পর্বের আলোচনায় যে কথাটি পরিষ্কার করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, বর্তমানেও সাম্রাজ্যবাদী দেশ ও নিপীড়িত জাতিসমূহের মধ্যকার সম্পর্কের কাঠামো স্রেফ বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অংশ মাত্র নয়। বরং সাম্রাজ্যবাদ আজো নির্ধারক অংশ। একই সঙ্গে আজো নিপীড়িত জাতিগুলোর অভ্যন্তরীণ শ্রেণী ও সামাজিক সম্পর্কসমূহ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে প্রধান শক্তি। নিপীড়িত সমস্ত জাতির মধ্যে গড়ে ওঠা প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীসমূহ অর্থাৎ ভূস্বামী, মুৎসুদ্দি ও আমলা, বণিক ও ব্যাংক মালিকরা সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার শ্রেণীগত মিত্র হিসেবে যে সম্পত্তি সম্পর্কের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠছে। তাদের শ্রেণীগত ক্ষমতা ধরে রাখছে। আরো সংহত করছে। ব্রিটিশরা উপমহাদেশ থেকে চলে গেলেও কাঠামোগতভাবে যে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার আজো অবসান ঘটানো হয়নি। জমি জাতীয়করণ করে জাতীয় সম্পদে পরিণত হলে প্রথমেই এই ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটতে বাধ্য। আবার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির রোপিত আধা সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক থেকে যেমন উৎপাদক কৃষকরা মুক্ত হতে পারে, তেমনি ঔপনিবেশিক সম্পত্তি সম্পর্কের কারণে যে আধুনিক অনুৎপাদক মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর হাতে জমি কেন্দ্রিভূত হচ্ছে, হয়ে আসছে। ওই মালিকানা কর্তাস্বত্ত্বার উচ্ছেদ ঘটবে। একই সঙ্গে আমাদের ভূপ্রকৃতি যেভাবে পণ্য আকারে কেনা বেচা হচ্ছে সেই প্রক্রিয়ার উচ্ছেদ ঘটবে। মহাজনী প্রথা, এনজিওদের সুদ কারবার, প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা শস্যহানীর কারণে উৎপাদক কৃষকের উচ্ছেদ হওয়া, গায়ের জোরে অপরের সম্পত্তি দখল ইত্যাদিসহ আরো নানাবিধ কারণে উৎপাদনের উপায় থেকে যেভাবে উৎপাদক কৃষকরা উচ্ছেদ হয়ে থাকে সেই সম্পর্কের আমূল রুপান্তর ঘটবে। একইভাবে ঔপনিবেশিক সম্পত্তি সম্পর্ক ও তার আইনগত ন্যায্যতার জোরে ভূমি মালিক অনুৎপাদক শ্রেণী হিসেবে উৎপাদক কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আকারে যে উদ্বৃত্ত লুট করে নিয়ে থাকে সেই প্রক্রিয়ারও অবসান ঘটবে। সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদের উপরে গণমালিকানা সৃষ্টির শর্ত তৈরি করবে। ব্যাপক গণমানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভোগের আকাক্সক্ষার বিপরীতে যৌথ মালিকানা সৃষ্টির দায়িত্ববোধ গড়ে উঠবে।

একইসঙ্গে প্রচলিত ভূমি মালিকানার সূত্র ধরে যে লাখ লাখ মামলা চলছে। তারও অবসান ঘটবে। মামলার কারণে কৃষি উদ্বৃত্ত থেকে বছরওয়ারী যে ২৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে তারও নিরসন হবে।

আবার ব্যক্তিগত সম্পত্তির সর্বশেষ রূপ হিসেবে ব্যক্তি মালিকানা ভিত্তিক যে একগামী পারিবারিক ব্যবস্থা নারীর উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে সেই ব্যবস্থা উচ্ছেদের সম্ভাবনা তৈরি হবে। এই ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে সন্তানের যে উত্তারধীকার প্রথা গড়ে উঠেছে, উত্তরাধীকার প্রথার সঙ্গে নারীর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হয়ে থাকার দশা থেকে মুক্ত হওয়ার শর্ত সৃষ্টি করে। সন্তানের বৈধ-অবৈধকরণ ভেদনীতি উচ্ছেদ হয়ে যাবে। পরিবার ভিত্তিক যে লিঙ্গ বিভাজন ও ধর্মীয় শিক্ষা দান সেটা থেকে মুক্তির শর্ত সৃষ্টি হয়। পারিবারিক শিক্ষাও অনুশাসনের বিপরীতে গণ শিক্ষার প্রসার ঘটা সহজ হবে। সবকিছু মিলিয়ে প্রচলিত একগামী পারিবারিক কাঠামোর উপরে আঘাত পড়বে। সম্পত্তিতে গণমালিকানা সৃষ্টি হওয়াতে সেটা নারীরও মালিকানায় রূপান্তর হবে। নারীর দিক থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার আরো সুনিশ্চিত হবে।

একই সঙ্গে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা বহাল থাকায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায় ও আদিবাসী জাতি সত্ত্বাদের সম্পদ রাষ্ট্রীয়ভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে লুট হচ্ছে। সেটা রোধ হবে। পাহাড়ি জাতিসত্ত্বাদের সম্পদ দখল রোধ হবে। পাহাড় ও প্রকৃতি রক্ষা পাবে।

আবার জমি জাতীয় সম্পদে পরিণত হলে যেমন উৎপাদিত ফসল জাতীয় সম্পদে পরিণত হবে, তেমনি উৎপাদিত ফসলের উপরে গণমালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে। এবং এটাই হলো খাদ্যে সার্বভৌমত্ব অর্জনের একমাত্র পন্থা। যা আবার সাম্রাজ্যবাদী খাদ্য রাজনীতির ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। অর্থাৎ এই একটি কর্মসূচি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া উপনিবেশিক ব্যবস্থার যেমন উচ্ছেদ ঘটান সম্ভব, তেমনি সমাজের প্রচলিত লিঙ্গ ভেদ, বর্ণভেদ, ধর্মীয়ভেদ, মর্যাদাভেদ ইত্যাদির কারণে সমাজের প্রধানাংশ মানুষের উপরে যে নিপীড়ন ও আধিপত্যমূলক দশা বহাল বা জারী রয়েছে। সেটা থেকে সমাজের প্রধানাংশ মানুষের মুক্তি ঘটার সমস্ত শর্ত সৃষ্টি করে। এবং সমাজ ব্যবস্থা ও ব্যক্তি মানুষ, গণতান্ত্রিক চরিত্রসম্পন্ন ও মর্যাদাবান হয়ে ওঠে।

একই ভাবে কৃষির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কৃষির উদ্বৃত্ত দিয়ে নতুন নতুন কর্মসংস্থা সৃষ্টি করা সম্ভবপর হয়। কৃষি থেকে বাড়তি জনসংখ্যা অন্য শ্রমক্ষেত্রে স্থানান্তর ঘটে তখন। মূলত এটাই হলো মূল ধারার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে তরাই এর কৃষক আন্দোলনের পার্থক্য। তরাইয়ের পথটাই উপমহাদেশের নকশালপন্থীরা ৬০ দশকে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লাইন আকারে গ্রহণ করেছিল। অদ্যবধী তারা সেটাই বাস্তবায়নে লড়ছে। তবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পূর্ব পর্যন্ত যেহেতু কৃষি বিপ্লবের পূর্নাঙ্গ কর্মসূচি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ফলে আলোচিত দলগুলো মূলনীতি বাস্তবায়নের সম্পূরক কর্মসূচি হিসেবে প্রথমে ‘যে জমি চাষ করে, জমি তার’ এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। এতে করে প্রচলিত রাষ্ট্রের যে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার ধরন এবং তার আইন, তাকেই আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলো অস্বীকার করছে। নতুন ধরনের সম্পত্তি সম্পর্ক গড়ে তোলার লড়াই করছে। অর্থাৎ প্রচলিত ব্যবস্থায় যে অসংখ্য মানুষ জমির মালিকানা নিয়ে বসে রয়েছে। উৎপাদিত ফসলে ভাগ বসানো ছাড়া জমির সঙ্গে যাদের আর কোনো সম্পর্ক নেই। এই অনুৎপাদক ভূমি মালিকদের মধ্যে যারা আবার গ্রামীণ সমাজ কাঠামোয় রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ও ক্ষমতাধর, একই সঙ্গে স্থানীয় জনগণের কাছে উৎপীড়ক বা নিপীড়ক-এমন ব্যক্তিদের জমি কোনো রকম ক্ষতিপূরন ছাড়া প্রথমেই তারা দখলের কথা বলছে। আবার কোথাও বা সরাসরি রাষ্ট্রীয় খাস জমি দখল করে বন্টন করছে। এসব জমি বন্টন করছে তারা ভূমিহীন উৎপাদক কৃষকদের মধ্যে। এভাবে জমি দখলের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিপীড়িত কৃষক যাতে নিপীড়ক শ্রেণী ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়তে শেখে, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে সাহসী হয়ে ওঠে, খোদ কৃষক বা উৎপাদক জনগোষ্ঠী যাতে ভূ-প্রকৃতির কর্তা স্বত্বা হয়ে ওঠে, তাদের শ্রমের ফসল যাতে তাদের কর্তৃত্বেই থাকে, উৎপাদক হিসেবে উৎপাদিত দ্রব্য যেন তার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়, উৎপাদক হিসেবে তার ঘরেই যাতে ভাতÑকাপড়ের ব্যবস্থা থাকে, এরকমের অসংখ্য প্রশ্ন তাদের এই সম্পূরক কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত। এবং তাদের এই কর্মসূচি প্রাথমিক স্তরের কর্মসূচি হলেও একটা ভিন্ন সম্পত্তি সম্পর্ক ও বণ্টননীতিকেই তা তুলে ধরে। মোটামুটি এটাই হলো আলোচিত দলগুলোর কৃষি বিপ্লবের সংক্ষিপ্ত সার। এবং এটাও মৌল সত্য যে, তাদের এই কৃষি বিপ্লবের সঙ্গে প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ও তার গণতান্ত্রিক চরিত্রের মধ্যে পার্থক্যটা অত্যন্ত প্রকট। অনেক সমাজ বিশ্লেষকরা বলেছেন এটা একদম নীতিগত পার্থক্য এবং বৈরী দ্বন্দ্ব হিসেবেই উপস্থিত। কারণ সমাজের কতিপয় সংখ্যালঘু মানুষ প্রচলিত ব্যবস্থা ও মালিকানার জোরে সম্পদের চরম স্থিতিতে ভোগ-বিলাসে গা ভাসাবে এবং সেই অবস্থানকে স্থিত করতে চাইবে, সেই স্থিতি ব্যবস্থাকে বজায় রাখার একমাত্র উপায় হিসেবে সমাজের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের উপরে অবদমন চাপিয়ে দিবে; তাদের সামাজিক চেতনাকে বিক্ষিপ্ত করতে চাইবে আর সমাজের সংখ্যগরিষ্ঠ মানুষ যখন শ্রেণী সচেতনতায় ক্লাশ ইন ইটসেলফ হয়ে উঠতে চাইবে; তখনই ওই সমাজে দ্বন্দ্বের ধরন বৈরী আকারে প্রকাশ পায়। রাষ্ট্র তখন আরো নিপীড়ক হয়ে ওঠে। খুনের রাস্তা ধরে। এটাই সমাজ বিশ্লেষকদের মতামত।

সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে তাদের মতামত

এবার আমরা অপরাপর আরো কয়েকটি প্রশ্নে এসব দলের মতামতের উপরে নজর বোলাবো। যার একটি হলো পার্লামেন্টারি রাজনীতি। অপরটি হলো দেশের সেনাবাহিনী, তাদের খতম লাইন ও সশস্ত্র যুদ্ধ সম্পর্কে অবস্থান। তবে এই আলোচনার শুরুতেই কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার। ’৪৭ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরপর তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার জমিদারী প্রথা বহাল রাখা এবং ঔপনিবেশিক সম্পত্তি সম্পর্ক আইন-কানুনকে টিকিয়ে রাখার জোর চেষ্টা চালালে কমিউনিস্ট পার্টি সরাসরি সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দেয়। তাদের সশস্ত্র সংগ্রাম চলে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত। ওই সশস্ত্র সংগ্রামের ধাক্কায় মুসলিম লীগ সরকার অন্তত আইনগতভাবে হলেও জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের ঘোষণা দেয়। একই সময়ে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের পক্ষ থেকে চলমান সশস্ত্র সংগ্রাম সমালোচিত হলে তা পার্টির পক্ষ থেকে উইড্রো করা হয়। এবং কমিউনিস্টরা আইনি পার্টিতে পরিণত হন। তবে ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করলে তারা প্রথমে আওয়ামী লীগ ও পরে ভাসানি ন্যাপসহ নানান গণসংগঠনের মধ্যে কাজ করেছেন। অবশ্য তখনকার বাস্তবতায় তারা মনে করতেন শ্রমিক শ্রেণী শ্রেণীগতভাবে অবিকশিত থাকার কারণে শ্রেণী ভিত্তিক একটি স্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করা নীতিগতভাবে ঠিক হবে না। এবং মাও প্রদর্শীত কৃষি প্রধান দেশে কৃষক সমাজ যে বিপ্লবের প্রধান ভিত্তি, সেটাও অস্কীকার করা হয়। ’৬০-এর দশকে এসে চারুমজুমদারের নকশালবাড়িতে সংগঠিত কৃষকের সশস্ত্র অভ্যুত্থান এবং তার তত্ত্বায়ন গ্রহণ আলোচিত দলগুলোর কর্মপদ্ধতি সম্পূর্ণ বদলে দেয়। আমরা সেই আলাপচারিতা কয়েকটি পয়েন্টে বিভক্ত করে করতে পারি। যেমন :

ক) সশস্ত্র বল প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের তত্ত্ব। ১৯৫১ সালে রণনৈতিক লাইন হিসেবে পাকিস্তান আমলেই পরিত্যাগ করা হয়েছিল।

খ) শ্রেণী ভিত্তিক-স্বতন্ত্র ও স্বাধীন পার্টি গঠন। উপমহাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক ও মতাদর্শগতভাবে এই নীতিগত অবস্থানকে বরাবরই উপেক্ষা করে আসা হয়েছিল।

গ) ১৯৭০ সালের প্রেক্ষাপটে ও তৎকালীন পূর্ব বাংলার বাস্তবতায় চারুমজুমদার নির্দেশিত ‘কৃষি বিপ্লবের’ লাইনকে রণনৈতিক লাইন হিসেবে গ্রহণ করা ছিলো তাদের কাছে একটি মৌলিক পরিবর্তন। অর্থাৎ ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত রণনৈতিকভাবে বিপ্লবের স্তর জনগণতান্ত্রিকের কথা বলা হলেও সেটা বাস্তবায়নের পথ হিসেবে বুর্জোয়া সংবিধান ও পার্লামেন্টারি পদ্ধতিকে নীতিগত ভাবে আকড়ে ধরা হয়েছিল। বিপরীতে ১৯৭০ সালে ‘কৃষি বিপ্লবের’ তত্ত্বকে আকড়ে ধরে যে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের রণনীতির কথা তারা বলে সেটা তাদের দৃষ্টিতে মৌলিক অর্থে বুর্জোয়া শ্রেণী গণতন্ত্র এবং পার্লামেন্টারি প্রথাকে অতিক্রম করে মাও প্রবর্তিত গণকমিউন প্রতিষ্ঠার লড়াই। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে বুর্জোয়া গণতন্ত্র এবং মাও প্রবর্তিত গণকমিউনের মধ্যে মৌলিকভাবে যে একটা পার্থক্য রয়েছে এটা ইতিহাসের কোনো ছাত্ররই অজানা বিষয় নয়। এবং একই সঙ্গে মাওয়ের গণকমিউন ছিলো মার্ক্সের যুগে প্যারি কমিউন ও লেনিনের যুগে সোভিয়েত ব্যবস্থার আরো বিকাশমান একটি রূপ। এভাবে ‘কৃষি বিপ্লবের’ তত্ত্বকে লাইন হিসেবে গ্রহণ করে ’৭০ পূর্ব রাজনীতি থেকে ’৭০ পরবর্তী রাজনীতির মধ্যে একটা মৌলিক ব্যবচ্ছেদ ঘটায় তারা। অবশ্য এই লাইন গ্রহণ করার ক্ষেত্রে দুইটি গুরত্বপূর্ণ প্রশ্ন কাজ করেছিল।

ক) প্রথম প্রশ্নটা ছিলো বুর্জোয়া শ্রেণী গণতন্ত্রের অন্যতম রক্ষাকবজ সংবিধান ও পার্লামেন্টারি প্রথা নিয়ে। এ প্রশ্নে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে কিছু প্রয়োজনীয় বার্তা তুলে ধরা যেতে পারে। যা আমাদের মত দেশের জন্য আজো বাস্তব।

আমরা মানবজাতির ইতিহাসে বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পূর্বে রাজতন্ত্র ও স্বৈরাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অনেক রকমফের দেখেছি। ইউরোপ রাজতন্ত্র ও স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদের শৈশব ও কৈশোরে পুঁজির ব্যক্তিগত ভোগ-দখলের ও অবাধ প্রতিযোগিতাকে ন্যায্যতা দিতে গিয়ে মূলত সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের দাবিতে জনগণের প্রধানাংশ স্বোচ্ছার হয়ে ওঠে। তারই ফলশ্র“তিতে সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্ম। ব্যবস্থা হিসেবে সংসদীয় গণতন্ত্র মোটামুটিভাবে পাঁচটি স্তম্ভের উপরে দাঁড়িয়ে আছে।

ক. প্রশাসনিক বিভাগ খ. বিচার বিভাগ গ. আইন বিভাগ ঘ. পুলিশ বাহিনী ঙ. সামরিক বিভাগ।

ক. আমরা প্রশাসনিক বিভাগকে মূলত নির্বাহী বিভাগ বা আমলাতন্ত্র হিসেবে চিনি। বিচার বিভাগের অপর নাম সুপ্রিম কোর্ট, উচ্চ ও নিম্ন আদালত। যা আবার দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিভাগ হিসেবে পরিচিত। আইন বিভাগকে আমরা সংসদ হিসেবে জানি। পুলিশ বাহিনীকে আভ্যন্তরিণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী হিসেবে জানি। এবং সামরিক বাহিনীকে প্রতিরক্ষা বা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারি বাহিনী হিসেবে গণ্য করি।

উপরে উল্লেখিত এই পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে আইন সভার সদস্যরাই সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। যাদেরকে আমরা সংসদ সদস্য হিসেবে মান্য করি। অর্থাৎ শুধুমাত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত করার মত একটি ক্ষেত্রে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সংবিধান প্রণেতারা সাংবিধানিকভাবে দিয়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে কোনো বহুপাক্ষিক, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বা উত্থাপিত বিলে ভোট প্রদান করে বিলকে আইনে পরিণত করে। তার পর পরই তাদের দায়-দায়িত্বও সাংবিধানিকতা শেষ হয়ে যায়। ওই বিল বাস্তবায়নের কোনোরূপ অধিকার আর সংসদ সদস্যদের থাকে না। এমনকি কোন ধরনের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে সমাজের সামাজিক শক্তি সমূহের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলশ্র“তিতে বিলটি উত্থাপন করা হয়েছিল। এবং বিলকে আইনে পরিণত করা হলো। এসব কোনো কিছুর ব্যাখ্যা করার অধিকার আর সাংসদের নেই। বিল আইনে রূপান্তরিত হওয়ার পরে উক্ত আইন ব্যাখ্যা করার অধিকার সাংবিধানিকভাবে আদালত বা বিচারকের। এবং আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের নির্বাহী বিভাগ ও পুলিশবাহিনীর বা আমলাতন্ত্রের। অথচ এরা কেউই জনগণের নির্বাচিত বা মনোনীত প্রতিনিধি নন। অর্থাৎ যে আমলাতন্ত্র আইনের ব্যাখ্যা করছে; আইন বাস্তবায়ন করছে; মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনাচারে, অফিস, আদালত ও থানায় যেসব কর্মকর্তার বা আমলাতন্ত্রের মুখোমুখি হচ্ছেন, তারা কেউই জনপ্রতিনিধি নন। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি নন। তাদেরকে নির্বাচিত করার কোনো অধিকার সাংবিধানিকভাবে জনগণের নেই। সাংবিধানিকভাবে আমলাতন্ত্রকে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র আমলাতন্ত্রের হাতেই। এবং আধুনিক সব ধরনের গণতান্ত্রিক বা প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত রয়েছে এই আমলাতন্ত্রের হাতে। এই অন্যতম কারণে সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে জনগণের জীবন্ত ও দৈনন্দিন যোগাযোগের মাঝখানে আমলাতন্ত্র একটা অপ্রতিরোধ্য দেওয়াল তৈরি করে রেখেছে। ফলে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বহু জনহিতকর আইন প্রায়োগীকভাবেই আমলাতন্ত্র অকেজো করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে।

খ. জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হওয়ার পর পর তাদের কার্যকলাপের জন্য সাংবিধানিকভাবেই আর জনগণের কাছে কৈফিয়ৎ দিতে বাধ্য নন। নির্বাচিত সাংসদরা তাদের কার্যকলাপের জন্য তখন দায়ী সংসদের কাছে। অর্থাৎ বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মূল আধার ব্যক্তি সার্বভৌমত্বের বিপরীতে সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সার্বভৌম সংসদের তত্ত্বকে। ফলে নির্বাচিত সাংসদরা যদি কালোবাজারি, অসৎ ব্যবসায়ী, নারী পাচারকারী, বিদেশী কর্পোরেট হাউজ বা জনস্বার্থে বিরোধী কোনো সংস্থার কাছে পাঁচ বছরের জন্য ব্যক্তিগত অর্থ উপার্জনের উপায় হিসেবে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের পূর্বে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী হিসেবে জনগণ ওই সাংসদ সদস্যের কাছে কোনো ধরনের কৈফিয়ৎ তলব করার ক্ষমতা আর রাখে না। অর্থাৎ সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যদি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে জনস্বার্থ বিরোধী, রাষ্ট্র বিরোধী, দেশের সার্বভৌমত্ব বিরোধী কোনো ধরনের বহুপাক্ষিক, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে বা কোনো বিশেষ সংস্থাকে বিশেষ সুযোগ দেয়, তাহলে, জনগণের দিক থেকে ওই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে অনাস্থা জ্ঞাপন করাসহ নির্বাচিত সাংসদকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার কোনো অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত নয়। যাকে রাইট টু রিকল বলা হয়।

গ. সংবিধানে যতই মানবাধিকারের ঘোষণা থাকুক না কেন। অথবা ব্যক্তি অধিকার সংরক্ষণের কথা লিপিবদ্ধ থাকুক না কেন। নির্বাচিত সাংসদরা দুই -তৃতীয়াংশ সমর্থনের ভিত্তিতে জনগণের সমস্ত অধিকার নাকচ করে দিতে পারে। কারণ সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষমতা তাদের হাতেই রেখেছে তারা। অর্থাৎ এই অধিকার সাংবিধানিকভাবেই সাংসদদের হাতে। জনগণের দিক থেকে তা প্রতিহত করার কোনো অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত নয়।

ঘ. গোটা সংসদীয় ব্যবস্থা আবার মন্ত্রী পরিষদের অধীন। একইভাবে সংসদীয় ধারার রাজনীতিতে জীবন্ত স্বত্তা হিসেবে ফ্লোর ক্রসিংও বেআইনি। ফলে এলাকার উন্নয়নে তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত সংসদ সদস্যদেরকে মন্ত্রীদের জুতার শুকতলা চেটেচুটে পরিষ্কার করার প্রতিযোগিতায় নামতে হয়।

অন্যদিকে মন্ত্রীবর্গ আমলাতন্ত্রের সহযোগিতায় যেসব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। সংসদে তার উপরে বিস্তারিত আলোচনার কোনো সুযোগ নেই। যদি কোনো সংসদ সদস্য দলীয় মন্ত্রীর উত্থাপিত বিলের ক্ষেত্রে ভিন্ন মত পোষণ করে। বিলের স্বপক্ষে ভোট প্রদান না করে, তাহলে তার সংসদীয় সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাবে। তার আসন শূন্য হয়ে যাবে। ফলে সংসদ সদস্যদের অন্যতম দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় মন্ত্রী পরিষদের উত্থাপিত বিলকে অনুমোদন দেওয়া। এবং সে বিল যতই রাষ্ট্র বিরোধী ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী হোক না কেন। এই ব্যবস্থাটা শক্তিশালী বা পাকাপোক্ত করতেই ফ্লোর ক্রসিং নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই অন্যতম কারণে আমাদের মত দেশগুলোতে যেমন সংসদীয় ব্যবস্থা মারফৎ হরেক পদের রাষ্ট্র ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী চুক্তিগুলো হয়ে থাকে, তেমনি সংসদে উক্ত চুক্তির উপর আলোচনা ও ফ্লোর ক্রসিং নিষিদ্ধ থাকায় বিষয়গুলো বরাবরই আমাদের অগোচরে থেকে যায়।

ঙ. বুর্জোয়া সংবিধানে যে সব মানবাধিকারের ঘোষণা দেওয়া হয়ে থাকে, সেটাও সম্পূর্ণতই স্ববিরোধী। যেমন সংবিধানে সম্পত্তিবান ও সম্পত্তিহীনদের সমানাধীকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া। অর্থাৎ দাস ও প্রভুর সমানাধিকারের কথা বলা হয়েছে এই ব্যবস্থায়। যা বাস্তবে কোনো অর্থেই কার্যকর নয়। একইভাবে শোষণের বিরুদ্ধে লড়ার অধিকার দেওয়া হয়ে থাকে। অন্যদিকে মালিকের ব্যক্তি সম্পত্তি বা শোষণ, যা মুনাফা অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার সেটাও রক্ষা করা সংবিধানের দায়িত্ব। একইভাবে কাজ পাবার অধিকার যেমন প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃত, তেমনি ক্রমবর্ধমানহারে দেশে রুগ্ন শিল্প বাড়িয়ে চলা; লাভজনক শিল্পকে মৃতশিল্প হিসেবে ঘোষণা দিয়ে লুটেরাদের হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের আছে।

চ. আমাদের দেশের সংবিধানে নারী-পুরুষ-ধর্ম-বর্ণ ভেদ এর বিপরীতে সবার সমানাধিকারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ সাংবিধানিকভাবে বিয়ে ও সম্পত্তি বন্টনের নীতির ক্ষেত্রে পারিবারিক আইনকে কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ নারীকে সম্পত্তিহীন করা এবং রাষ্ট্রের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মর্যাদা পারিবারিক আইনের স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সম্পত্তি সম্পর্ক আইনের ক্ষেত্রে অন্য ধর্মের অনুসারিদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি, আইনগতভাবে কেড়ে নেওয়ার অধিকার রাষ্ট্রের আছে। যেমন শত্রু সম্পত্তি আইন বা ভেস্টট প্রোপার্টি আইন তৈরি ও প্রয়োগ করে হিন্দু ও বিহারীদের সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, হচ্ছে। পাশাপাশি সাংবিধানিকভাবে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে স্বীকৃতি দেওয়াই নৃতাত্ত্বিকভাবে অসংখ্য জনগোষ্ঠীর সমষ্টিগত সম্পত্তির অধিকার ভোগকে বাতিল করা হয়েছে। কমিউনিটি প্রোপাটি হিসেবে হাওড়, বাওড়, খাল, নদী-সমুদ্র-বনভূমি থেকে জনগণের কর্তাস্বত্ব বিলোপ করে লুটেরা পুঁজির মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এবং সেটা সাংবিধানিকভাবে।

ছ. পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে নির্বাচিত সরকারের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থনকে গণতন্ত্রের সমার্থক ধরে প্রচার চালান হয়। অথচ মর্মগতভাবেই পার্লামেন্ট ও গণতন্ত্র দুটো পৃথক বিষয়। তাকে সমার্থক ধরে প্রচার চালানোটাই হলো হলো বুর্জোয়া রাজনীতির ধাপ্পাবাজী। যেমন জর্জ বুশের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ ওই দেশের ৮০ শতাংশ জনগণ সমর্থন জানিয়েছিল। একইভাবে অ্যারিয়েল শ্যারন প্যালেস্টাইনে নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও দখলদারী অভিযানের সমর্থনে ৮৫ শতাংশ সমর্থন পেয়েছিল। ফলে প্রশ্ন দাঁড়ায় পার্লামেন্টারি প্রথায় নির্বাচিত সরকার ও তার কর্মকাণ্ডে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পেলেই কী ওই সরকার পরিচালিত ভয়ঙ্কর পাশবিকতা ও গণহত্যার মত অপরাধগুলো বৈধতা পেয়ে যায়? সেটা কি গণতন্ত্রের সমার্থক বিষয়ে পরিণত হয়? অথচ পার্লামেন্টারি রাজনীতি তাকেই গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখে। তার স্বপক্ষে বিল অনুমোদন করে। গণহত্যা চালাবার জন্য জনগণের উপরে আরো অধিক হারে কর আরোপ করে। এটা আমেরিকা ও ইসরাইলের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, বাংলাদেশের জন্য বাস্তব। যা আমরা রক্ষিবাহিনীর আমল এবং জোট সরকারের আমলেও ঘটতে দেখছি।

জ. সংসদীয় গণতন্ত্রের একটি অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে দলীয় রাজনীতি। দলের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র ক্ষমতার জন্য লড়াই চলে। ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত হয়। অন্যদিকে আমাদের দেশে আজ এমন একটা সংসদীয় ধারার বুর্জোয় রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে, যার নেতা বা নেতৃবৃন্দের প্রতি সেই দলের প্রতিটি সদস্যের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। একইভাবে এসব দলের আজ এমন একজন নেতা-নেত্রীকে পাওয়া মুশকিলের বিষয়, যার নিজের প্রতি নিজের অন্তত এতটুকু আস্থা রয়েছে, তিনি যদি নির্বাচিত হন তাহলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরি-লুট ও দুর্নীতি করবেন না বলে দাবি করতে পারেন। আর এটাই যদি প্রকৃত বাস্তবতা হয়ে থাকে তাহলে এসব দলের আদতেই কি কোনো জীবন দর্শন, দায়বদ্ধতা, কোনো মহৎ লক্ষ্য এবং পথ চলবার সুনির্দিষ্ট ঠিকানা আছে? স্বার্থপরতা, ক্ষমতার লোভ এবং সুবিধাবাদিতার পায়ে নির্লজ আত্মসমর্পণের পথে এবং সংসদীয় ব্যবস্থা মারফৎ তার নায্যতা দিয়ে কি গণতন্ত্র অর্জিত হয়? এসব কারণে আমাদের দেশে সংসদীয় ধারার লুম্পেন বুর্জোয়া দলগুলো তাদের ঘোষিত দলীয় কর্মসূচির ভিত্তি দল ও রাষ্ট্র পরিচালনা করার বিপরীতে একদল তাবেদার দিয়ে দল ও সরকার পরিচালনা করে থাকে। তারা তাদের শ্রেণী স্বার্থেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সমূহকে ধ্বংস করে দেয়। দলের অভ্যন্তরে নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। আমলাতন্ত্রকে জনগণের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে। জনগণের ন্যূনতম দাবি দাওয়ার আন্দোলনকে দমন ও উৎখাত করতে সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে ধ্বংস করে দেয়। এটা হলো সংসদীয় ধারার দলবাজির অবস্থা।

ঝ. সংসদীয় রাজনীতিতে আজ যারাই ক্ষমতাসীন হতে চান, তারা সবাই নির্বাচনের পূর্বে সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় প্রতিশ্র“তি দেন। কিন্তু ওয়াদা রক্ষা করেন কদাচিৎ। প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এর ফলাফল হিসেবে জনগণ একদিকে যেমন তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন, তেমনি আস্থাও হারান নিজেদের প্রতি। এতে করে সমাজের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা, মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা, সৃজনশীলতা ইত্যাদি গুণাবলি সমাজের অধিকাংশ মানুষ হারিয়ে ফেলেন। জনগণ নিজেও যে পরিস্থিতির বদল ঘটাতে সক্ষম সেই আস্থা তারা হারিয়ে ফেলেন। তাদের কাছে রাজনীতি ও গণতন্ত্র আর কোনো কাজের ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য হয় না। এবং সংসদীয় ব্যবস্থা একদল স্মাগলার, লুটেরা ধনী, লুটেরা আমলা, নারী-শিশু পাচারকারী, ধর্ষক, লুটেরা ব্যাংকার, জোতদার-ভূস্বামী ও সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টদের ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। এবং এসব লুটেরাদের একনায়কত্বই রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব নানাবিধ কারণে পৃথিবীর অনেক দেশেই আজ এক একটা সংসদ নির্বাচনের পর, পরবর্তী নির্বাচন এলে সরকার পরিবর্তনের খেলায় ভোটারদের ভোট প্রদানের হার ক্রমশই কমে যাচ্ছে। সংসদীয় রাজনীতি এবং ওই ধারার রাজনৈতিক নেতৃত্বদের প্রতি সাধারণ মানুষের সম্মানবোধ ও সহমর্মিতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। ব্যবস্থাটির সঙ্গে ব্যাপক গণমানুষের ব্যবচ্ছেদ দ্রুত গতিতে বাড়ছে। এতে করে অনেক দেশেই সংসদীয় ব্যবস্থা জাদুঘরের বস্তুতে পরিণত হতে চলেছে। কোথাও বা সেটা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। আবার অনেক দেশে তার অন্তীম সময় উপস্থিত। যেমন আমাদের দেশেই ৯০ সালের পর থেকে যে কয়টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে একটি দল সরকার গঠন করলে, বিরোধী দল আর সংসদে উপস্থিত হন না। সময় উত্তীর্ণ হওয়ার বহুপূর্বেই সংসদীয় ধারার রাজনৈতিকরাই সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করে। কোনো বিশেষ কারণ বা পরিস্থিতিতে যদি উভয় দল সংসদে উপস্থিত হয়ও তাহলে পরস্পর পরস্পরকে ন্যাক্কারজনকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে থাকে। খিস্তি খেউড় হয়ে ওঠে রাজনীতির ভাষা। যা সংসদীয় রাজনীতিরই আজ স্থায়ী সংস্কৃতি হিসেবে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ সংসদ অধিবেশন চলাকালে প্রতিমিনিটে কয়েক লাখ টাকা খরচের মাধ্যমে আমাদের জাতীয় নেতারা তাদের খিস্তি খেউড় শুনতে দেশবাসীকে বাধ্য করে। একই সঙ্গে কোনো দল ক্ষমতায় গেলে তারা আর ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। অথবা কোনো দলকে জনগণ একবার নির্বাচিত করলে দ্বিতীয়বার তাদের আর নির্বাচিত করতে চায় না। যেহেতু সাংবিধানিকভাবে আমাদের দেশে সরকার বদলের পন্থা হিসেবে বা আইনগত পথ হিসেবে সংসদীয় রাজনীতিটায় স্বীকৃত। তার বাইরে অপর যে কোনো ধারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। এবং জনগণের দিক থেকে পরিস্থিতিটা মেনে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। ফলে গোটা বিষয় এবং দুই দলীয় শাসন ব্যবস্থা জনগণের ঘাড়ের উপরে সিন্দাবাদের ভুতের মত চেপে বসেছে। এটাই হলো সংসদীয় রাজনীতির পরিণতি। আমরা উপরে বর্ণীত পরিস্থিতিকে আবার ভিন্ন ভাষায় পাঠ করতে পারি। সেটা হলো এমন, যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা শোষণ ব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে সংসদীয় রাজনীতি, যা আধুনিক বিশ্বব্যবস্থা বা বুর্জোয়া ব্যবস্থার পক্ষে মতাদর্শ নির্মাণ, সম্মত্তি আদায় ও শ্রেণী শাসনকে স্থায়ীত্ব দিতে যেভাবে হাতিয়ার হিসেবে ক্রিয়া করত তার সীমাবদ্ধতার কারণে শেষ নাগাৎ সেটা জীর্ন হয়ে পড়েছে।

পাশাপাশি পৃথিবীর অনেক দেশেই আজ সংসদীয় রাজনীতি এবং তার অনুসঙ্গ হিসেবে দুই দলীয় শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটতে চলছে, জনগণকে আর প্রচলিত কায়দায় শ্রেণী শাসন মানানো যাচ্ছে না। শাসক শ্রেণী তাদের পুরনো পার্টি দিয়ে আর তাদের শ্রেণী শাসন চালাতে পারছে না। স্থায়ী সরকারের ধারণা এবং তার ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। অস্থিতিশীলতায় এক একটা দেশের প্রধান রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য এবং একমাত্র লক্ষণ হয়ে উঠছে। লুম্পেন বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক দল এবং তাদের ‘মহান সংসদ’ ‘মহান সংসদীয় গণতন্ত্র’ এর সব কিছুই আজ শেষ পরিণতি হিসেবে দল ভাঙাভাঙির ন্যাক্কারজনক খেলায় পরিণত হয়েছে। কোনো দেশে পরিস্থিতি সামাল দিতে খোদ জাতিসংঘকে তার বাহিনী নামাতে হচ্ছে। কোনো দেশে সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতা হাতে নিতে হচ্ছে। আবার কোনো কোনো দেশে শাসকরা জোটের রাজনীতি, সংস্কারের রাজনীতি চালু করে পরিস্থিতি সামাল দিতে মরিয়া হয়ে উঠছে। আমাদের দেশও এই পরিস্থিতির বাইরে নয়। দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, সুশিল সমাজ ও নীতি নির্ধারকদের বয়ানে আবার এটাই হলো মূল ধারার রাজনীতি। ফলে সরকার বদলের বা ব্যবস্থা বদলের অন্যকোনো ধারা বিকশিত হতে দেখলেই তারা সংকিত হয়ে ওঠে। এবং মূল ধারার রাজনীতিতে ফিরে আসতে ওয়াজ নসিহত করেন। অতি সংক্ষেপে বর্ণীত বিষয়বস্তুই হলো আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর সমালোচনা। ১৯৬৭ সাল থেকে উপমহাদেশ জুড়ে চিহ্নিত নকশাল ধারার রাজনীতির ধারকবাহকরা ধারাবাহিকভাবে তাদের প্রচার পত্রে এসব সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা করে আসছেন।

মূলত ব্রিটিশ শাসিত ঔপনিবেশিক আমল থেকে ভারত উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে দুটো ধারা দীর্ঘ সময় ধরে আধিপত্য আকারে বজায় ছিলো। প্রথমত এর মধ্যে একটি মতামত হলো, যতদিন দেশে সংসদীয় নির্বাচনের অবাধ সুযোগ রয়েছে, সংসদীয় গণতন্ত্রের অস্তিত্ব রয়েছে, ততদিন পার্টি বিপ্লবী বল প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পথে যাবে না। ফলে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে ধারাবাহিকভাবে গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, পৌর নির্বাচন, সংসদ নির্বাচন, ট্রেড ইউনিয়ন নির্বাচন ও ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করে আসছিল। সেটাই ছিলো পার্টি কাজের প্রধান ধারা। আর প্রচলিত রাষ্ট্র, তারা আইন, সংবিধান, মতাদর্শ ও সংস্কৃতিতে তাদের রাজনীতি যতটা অনুমোদন করে, তাকেই ভিত্তি করে প্রচলিত ব্যবস্থার রক্ষাকর্তা হিসেবে শাসক দলের প্রতিনিধি ওই লুটেরা ইন্টেন্ডার, ব্যবসায়ী, ডাকাত, লুটেরা ব্যাংকার, জমিদার-ভূস্বামী-জোতদার ও চোরাকারবারীদের কাছে দাবি ভিত্তিক নিবেদনের মধ্যেই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটেছে। তরাইয়ের কৃষি বিপ্লবের পথ প্রথম এই দৃষ্টিভঙ্গি চ্যালেঞ্জ করে ঘুরে দাঁড়ায়।

দ্বিতীয়ত, ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালে চীনের স্বাধীনতা অর্জন ও উত্তর কোরিয়ার স্বাধীনতা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে বিপদগ্রস্ত করে তোলে। পাশাপাশি চীনের পথ ধরে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া ভিয়েতনামে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কৃষি বিপ্লবের লাইনের প্রতি সাধারণ মানুষ আগ্রহী হয়ে ওঠে। ওই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার কমিউনিজম বিরোধী প্রকল্প মার্শাল প্লানের অধীনে লাল বিপ্লবের বিপরীতে সবুজ বিপ্লবের এক তরিকা হাজির করে। ভারত সরকার পি এল ৪৮০ অধীনে খাদ্য চুক্তি করার পরপর, ওই চুক্তির শর্ত মোতাবেক সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণে বাধ্য ছিলো। কিন্তু কংগ্রেসীয় সরকার বিষয়টি নিয়ে কিছুটা গড়িমসি করলে আমেরিকা খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ফলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ আরো অনেক প্রদেশে তীব্র খাদ্য সংকটের মুখে পড়ে। এবং ওই সংকটে ভিত্তি করে রাজনৈতিক প্রশ্ন হিসেবে ভূমি সংস্কারের প্রশ্নটি আবারো সামনে চলে আসে। ১৯৬৬ সালে সিপিআই (এম)- এর খাদ্য ও জমি দখলের আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। ভারত সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৯৬৭ সালে চতুর্থ সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করে বসে। দল হিসেবে সিপিআই (এম) ওই নির্বাচনে অংশ নেয়।

নির্বাচনে কংগ্রেসের একদলীয় শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে অপরাপর শাসক পার্টিগুলো অকংগ্রেসীয় সরকার নামে একটা জোটের রাজনীতি সামনে আনে। আর সিপিআই (এম) নির্বাচনকে গ্রহণ করে কৌশল হিসেবে। চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল হিসেবে কংগ্রেসের পতন ঘটে। এবং কংগ্রেস জোটের ভিত্তিতে সরকার গঠনে অসম্মত হয়। এই প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গের অপরাপর শাসক দল, ধনিক শ্রেণী এবং তাদের সমর্থিত বুদ্ধিজীবী মহল রাজ্যের সরকার গঠনের প্রশ্নে ওই অকংগ্রেসীয় মতবাদের জোর প্রচারণা চালায়। সিপিআই (এম) পলিট ব্যুরোর কয়েকজন নেতার সিদ্ধান্তে সরকারে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। এবং গোটা পার্টিকে ঐক্যবদ্ধভাবে টেনে আনার চেষ্টা করে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নটি কৌশল হিসেবে আর থাকে না। মন্ত্রিত্ব রদবদলের রাজনীতিটা তাদের কাছে নীতিগত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে পার্টির নিচের স্তরের কর্মীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এবং গোটা পার্টিতে বিষয়টি ঘিরে আন্তপার্টি সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে।

আন্তপার্টি সংগ্রামের ক্ষেত্রে সিপিআই (এম) ধারাতে থেকে যাওয়া অংশ সরকারের অংশীদারিত্বের প্রশ্নে যে সব যুক্তি তুলে ধরেছিলেন সেদিন তার মধ্যে মূল কথাগুলো হলো এই, পশ্চিমবঙ্গের সাংবিধানিক সংকটের এই দুর্যোগপূর্ণ মুহুূর্তে আমরা যদি সরকার গঠনে এগিয়ে না আসি, যদি মন্ত্রিত্ব গ্রহণ না করি, তাহলে জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। ব্যাপক গনমানুষ থেকে পার্টি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। বরং কমিউনিস্ট পার্টি, সোসালিস্ট পার্টি ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো একজোট হয়ে অকংগ্রেসীয় সরকার গঠন করে, মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে, তাহলে দেশের শাসন ক্ষমতা হাতে পাওয়া যাবে। এভাবে রাজ্যে রাজ্যে ভোটে জিতে একসময় দিল্লির মসনদ দখল করে নিতে হবে। তারপর নতুন সংবিধান রচনা করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। এটাই ভারতের বিশেষ পরিস্থিতি। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কমিউনিস্টদেরও সরকার গঠনে অংশ নেওয়া দরকার। তা না হলে প্রতিক্রিয়াশীলরা ক্ষমতায় চলে আসবে। রাষ্ট্রকে আরো প্রতিক্রিয়াশীল করে তুলবে। দেশের শাসন ব্যবস্থা, তার সংবিধান আরো প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে জনগণের ঘাড়ে চাপাবে। তাছাড়া, প্রচলিত রাষ্ট্রের মধ্যেই গণতান্ত্রিক অধিকার সমূহকে শাসক শ্রেণীর হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। ওই গণতান্ত্রিক আইন বাঁচলে দেশে বাঁচবে। আর দেশ বাঁচলে বাঁচবে জনগণ। সংসদীয় গণতন্ত্র হলো জনগণের অগ্রগতি ও কল্যাণের স্বাক্ষর। ফলে সংসদকে আরো অর্থবহ করার দায়-দায়িত্ব কমিউনিস্টদেরই নিতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়িত্বশীল বিরোধীতা করতে হবে। তাছাড়া তাদের দিক থেকে আরো যুক্তি ছিলো লেনিন কি নির্বাচনে অংশ নেননি? মূলত এগুলোই ছিলো সিপিআই(এম) -এর নির্বাচন পন্থী অংশদের মতামত।

বিপরীতে সিপিআই (এম)-এর যে অংশটি নকশাল নামে পরিচিতি পায় তারা নীতিগতভাবে সংসদীয় ধারার গণতন্ত্রকে বিরোধীতা করে। তবে তাদের সম্পর্কে কথা বলতে গেলে প্রথমেই চারু মজুমদারের নামটি স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে। আমার জানা মতে উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে চারু মজুমদারই প্রথম নেতৃত্ব যিনি নেহেরু-ইন্দিরা অথবা কংগ্রেস, অকংগ্রেসীয় রাজনীতির বিপরীতে শ্রেণীগতভাবে শাসক শ্রেণীকে চিহ্নিত করার উপরে গুরুত্বারোপ করেন। একইভাবে কেন্দ্র-রাজ্যের দ্বন্দ্বের রাজনীতির বিপরীতে সকল জাতির আত্মনিয়ন অধিকার প্রতিষ্ঠার উপরে গুরুত্বারোপ করেন। সরকারের দায়িত্বশীল বিরোধীতা এবং সংসদ সর্বস্ব রাজনীতির বিপরীতে বল প্রয়োগে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল এবং সমাজের উৎপাদন সম্পর্ক বা সম্পত্তি সম্পর্কের বৈপ্লবিক রূপান্তরের উপরে গুরুত্বারোপ করেন। জমি বন্টন বা জমি দখলের আন্দোলনকে অর্থনীতিবাদী ও সংস্কারবাদী কাজের ধারা হিসেবে চিহ্নিত করে কৃষি বিপ্লবকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের অক্ষশক্তি রূপে আঁকড়ে ধরার উপরে গুরুত্বারোপ করেন। মূলত তরাই- এর কৃষক আন্দোলন বা নকশালবাড়ির অন্যতম তাত্ত্বিক রূপকার ছিলেন তিনি। একটা কৃষি প্রধান দেশে কৃষি বিপ্লবই যে গণতান্ত্রিক বিপ্লব, কৃষকরা যে বিপ্লবের প্রধানশক্তি মাওয়ের এই নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ত্বকে তিনি আন্তরিকভাবেই ভারতের উপযোগী করে প্রয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। যাই হোক আমরা আবার পূর্বের আলোচনায় ফিরে যেতে পারি। অর্থাৎ ১৯৬৭ সালে ভারতের চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনে সিপিআই (এম)- এর অংশগ্রহণ এবং পরবর্তীতে সরকার গঠনের প্রশ্ন ধরে ওই পার্টির মধ্যে যে আন্তসংগ্রাম শুরু হয়েছিল। তার মধ্যে জোতি বসুদের যুক্তিতর্ক আমরা দেখেছি। এবার আমরা নকশালপন্থীদের যুক্তি-তর্কের উপরে নজর বোলাবো কেন তারা সংসদীয় রাজনীতিকে গণতন্ত্রের সমার্থক হিসেবে গণ্য করে না উপরে উল্লিখিত তথ্যগুলোর সঙ্গে পরবর্তী অংশটুকু পাঠ করাও জরুরি।

সেদিন তাদের দিক থেকে বলা হয়েছিল, শ্রেণী শাসনের পক্ষে মতাদর্শ নির্মাণ, সম্মতি আদায় ও শ্রেণী শাসন চাপিয়ে দেওয়ার যে সংসদীয় ব্যবস্থা, ওই ব্যবস্থার ‘পবিত্র সংসদ’, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং আমলাতন্ত্র নির্ভর রাষ্ট্রযন্ত্র যখন ফুটো বেলুনের মত চুপসে যাচ্ছে। জনগণ নিজ থেকে যখন ওইসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি মোহগ্রস্ততা কাটিয়ে তুলছে। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতা বহির্ভূত লুটেরা শাসক এবং তাদের রাজনৈতিক দল যখন আর কোনোভাবেই প্রচলিত শাসনব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো টিকিয়ে রাখতে পারছে না, প্রচলিত ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য যুক্তি তর্ক দাঁড় করাতে পারছে না, তখন ওই ব্যবস্থা রক্ষা করা, মেরামত করা ও তার স্বপক্ষে যুক্তি দাঁড় করানোর দায়ভার কি কমিউনিস্ট পার্টির? তাছাড়া, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রসমূহের হামলা যখন আরো নগ্নভাবে প্রকাশ হচ্ছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ ও অধিনস্ততা যখন আরো নগ্নভাবে বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে, গোটা বিশ্বব্যাপী জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলনও আরো তীব্র হয়ে উঠছে, প্রতিরোধের কবলে পড়ে সাম্রজ্যবাদের নাবিশ্বাস যখন আরো বাড়ছে, সেই যুগে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রকৃত অর্থে কতটা অর্থবহ? ঘুরে ফিরে জনগণের ঘাড়ের উপরে সংসদীয় রাজনীতির জোয়ালটাকে জুড়ে দেওয়া কেন?

একইসঙ্গে শাসক শ্রেণী যখন গভীর সংকটে পড়েছে, রাজনৈতিক সংকটে যখন তারা তলিয়ে যাচ্ছে, রাষ্ট্র যখন মূমূর্ষু অবস্থায়, ওই রাষ্ট্রের শোষণ নিপীড়ন যখন জনগণে উপর পাহাড় পরিমাণে দূর্গতি চাপিয়ে দিচ্ছে, ইতিহাসের রায়ে যখন এধরনের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাচ্ছে, যা অনিবার্য ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখন অকংগ্রেসীয় যুক্ত ফন্ট্রের সরকার ও তার হবু মন্ত্রীরা ঠিক কোন লক্ষ্য থেকে প্রচলিত ব্যবস্থাকে রক্ষার দায়ভার নিজেদের কাঁধে নিচ্ছে? এটা কি পুরাতন ব্যবস্থাকেই নতুন মোড়কে পুরে তাকে আরো সুস্থিতি দেওয়া নয়? এটা কি জনগণের উপরে শ্রেণী শোষণকে আরো দীর্ঘস্থায়ী করার প্রক্রিয়া নয়? শ্রেণী দ্বন্দ্বকে অপ্রধান করে, সাম্রাজ্যবাদী যুগে, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে নিপীড়িতের দ্বন্দ্বকে অপ্রধান করে, কেন্দ্র-রাজ্য দ্বন্দ্ব, কংগ্রেস-অকংগ্রেসের দ্বন্দ্বকে প্রধান করাই বা কেন? এটা কি লগ্নীপুঁজির শোষণ, সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সামন্ততান্ত্রিক শোষণকে আড়াল করা নয়, রাষ্ট্র যদি শ্রেণী শোষণের হাতিয়ার হয়ে থাকে, তাহলে ওই রাষ্ট্রের রূপান্তর না ঘটিয়ে প্রচলিত রাষ্ট্রের মন্ত্রী হয়ে কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে কাদের স্বার্থ রক্ষা করতে চাওয়া হচ্ছে? প্রচলিত শোষণ ব্যবস্থা ও সম্পত্তি সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রেখে ওই রাষ্ট্রের মন্ত্রী হলেই কি রাষ্ট্র শ্রমজীবী জনগণের হাতিয়ার বনে যাবে? ঐতিহাসিকভাবেই যে ব্যবস্থার পতন ঘটতে চলেছে তাকে রক্ষা করাই কি কমিউনিস্টদের প্রধান কাজ? হ্যাঁ লেনিনও নির্বাচন করেছেন। লেনিনের কাছে ডুমা তো ছিলো সহায়ক কাজ। কিসের সহায়ক কাজ সেটা? আর নির্বাচন করা এবং সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর একটা নয়া উপনিবেশিক সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্রের মন্ত্রী হওয়া কি একই বিষয়? কবে কোথায় মার্ক্স-এঙ্গেলস ও লেনিন সেটা বলেছেন? তাছাড়া, একটি স্বাধীন দেশের সংসদীয় ব্যবস্থা ও একটি নয়া উপনিবেশিক দেশের সংসদীয় ব্যবস্থা কি সমার্থক বিষয়? মূলত এগুলো হলো সেদিনের আন্তপার্টি সংগ্রামের ক্ষেত্রে নকশালপন্থীদের সংসদীয় ব্যবস্থা বিতর্কের সংক্ষিপ্ত সার কথা। ১৯৬৭ সালের প্রেক্ষাপটে তারা সংসদীয়পন্থাকে পরিহার করে এযাবৎ যত তর্ক ও বিতর্ক করেছে তারও একটা সংক্ষিপ্ত সার আমরা পূর্বেই দেখেছি। সি পি আই (এম) বিভক্তির পরে জোতি বসুরা সবুজ বিপ্লবকে রাজনৈতিক লাইন হিসেবে আঁকড়ে ধরেন। আর নকশালপন্থীরা নয়া গণতান্ত্রিক বা কৃষি বিপ্লবকে। কৃষি বিপ্লবের প্রধান কর্মসূচি হিসেবে ভূ-প্রকৃতি জাতীয় সম্পত্তিতে রূপান্তরিত করার সংগ্রাম সফল হলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে আমরা কোনো কোনো বৈরীমূলক দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করতে পারবো বলে আলোচিত মাওবাদী দলগুলো দাবি করে থাকেন, সেটা আমরা তরাই-এর আলোচনা প্রসঙ্গে দেখেছি। এবার আমরা সংসদীয় গণতন্ত্র ও নয়া গণতন্ত্রের মধ্যে আরেকটি মৌলিক পার্থক্যের উপরে সংক্ষেপে নজর বোলাবো।

এসব দল মনে করে মাওয়ের নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও ইউরোপীয় বুর্জোয়া বিপ্লবের মধ্যে নীতিগতভাবেই পৃথক অবস্থান রয়েছে। যেমন ইউরোপে বুর্জোয়াদের নেতৃত্ব্ইে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল। তার ফলাফল স্বরুপ বুর্জোয়া একনায়কত্বের অধীনে বুর্জোয়া সমাজ তৈরি হয়েছিল। আর নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হবে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব শ্রমিক-কৃষক-পাতি বুর্জোয়া ও জাতীয় বুর্জোয়াদের যুক্তফ্রন্ট এবং যৌথ একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ এখানে নীতিগতভাবে রাজনৈতিক মত ও পথ এবং লিডারশীপের একটি পার্থক্য রয়েছে। আর দ্বিতীয় অন্যতম পার্থক্য হলো এই বিপ্লব একদিকে যেমন জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাবে, তেমনি সেটা আবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবেরও সূচনা করবে। অর্থাৎ নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে মাওবাদীরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অংশ হিসেবে গণ্য করেন। আর জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের বিষয়টি হলো মূলত সমাজ রুপান্তর এবং কর্তৃত্বের প্রশ্ন।

পাশাপাশি তাদের আরো দাবি নয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মডেল কখনই ইউরোপীয় ধাঁচে দুই দলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লড়াই নয়। আবার সমাজের সংখ্যালগিষ্ঠ প্রতিনিধিত্বকারী শ্রেণীকে দেশের অর্থনীতি-রাজনীতি ও সংস্কৃতির উপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থাও এটা নয়। উক্ত সংখ্যালগিষ্ঠ শ্রেণীর স্বার্থ উদ্ধারে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থাও এটা নয়। একইসঙ্গে সম্পত্তি-সম্পর্ক ও বন্টন ব্যবস্থায় বৈষম্য প্রকট করে তুলে তাকে দীর্ঘস্থায়ী করার ব্যবস্থাও এটা নয়। মূল উৎপাদক শ্রেণীকে জীবনধারণের সমস্ত মৌলিক উপকরণ থেকে বঞ্চিত করার ব্যবস্থাও এটা নয়। তাদের দিক নির্দেশনা হলো তরাই-এর পথ। তরাইয়ের কৃষি নীতি বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি আমাদের সমাজের, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির উপরে সমাজ সংখ্যাগুরু জনগণ বা উৎপাদক জনগণের নিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই এটা। তারা গণতন্ত্রের সংসদীয় মডেলের বিপরীতে গণকমিউন প্রতিষ্ঠার কথা বলে। যেমন কৃষকদের গণকমিউন, শ্রমিকদের গণকমিউন, সৈনিকদের গণকমিউন, নারীদের গণকমিউনই এভাবে নানান পেশা ও বর্গের কমিউনের উপরে থাকবে আর একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা। এসব সংস্থার নেতা নির্বাচিত হবে ওই পেশা বা বর্গের মধ্য থেকে এবং জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে। যদি তারা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন অথবা রাষ্ট্র ও তার সার্বভৌমত্ব বিরোধী কোনো কাজ করেন তাহলে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে রিকল করার অধিকার জনগণের থাকবে।

পাশাপাশি এসব কমিউনিস্ট পার্টি আরো মনে করে, আজো আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলের জনগণের জন্য মৌলিক সম্পদ হচ্ছে ভূ-প্রকৃতি বা জমি। আর পুঁজি হলো সামাজিকভাবে সৃষ্ট সম্পদ। জীবন ধারণের উৎস হিসেবে জমি ও পুঁজি ব্যক্তিগত সম্পদ হিসেবে অনুৎপাদক লুটেরা শ্রেণীর হাতে কেন্দ্রিভূত; আর গণতান্ত্রিক সমাজ হবে বিকেন্দ্রিভূত, এটা মূলত সোনার পাথরবাটি। এটাই বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় ধাপ্পাবাজী। এ অন্যতম কারণে আজ এদেশে যারা কেবলমাত্র সরকার পরিবর্তনের খেলায় মেতে না থেকে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের কথা ভাবছে এবং এ দেশের গ্রামে-গঞ্জে স্বাধীনতার সৌধ গড়ার স্বপ্ন দেখছে। তাদের সামনে রাজনৈতিক স্বাধীনতার আন্দোলনের সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং সাংস্কৃতি স্বাধীনতা মেলানোর প্রশ্ন রয়েছে। এসব স্তম্ভ মিলে মিশে একটি রাজনৈতিক রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক সমাজ তৈরি হয়। বৈপ্লবিক গণতন্ত্রের সূচনা হয়। আর বৈপ্লবিক গণতন্ত্র সূচনা পর্বেই সমস্ত কায়েমী স্বার্থের উচ্ছেদ করে বা তার অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রকে পরিপূর্ণতার স্তরে পৌঁছে দেয়। যে দেশের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর, প্রধানাংশ মানুষ খাবার পায় না, বহুজাতির মানুষের উপরে ও নারী সমাজের উপরে অজস্র রকমের অত্যাচার রয়েছে, সেখানে সমাজ রুপান্তের কাজে হাত লাগানোকে তারা গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন।

এর বাইরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি রয়েছে তাদের। তারা মনে করে বর্তমান বিশ্বে বুর্জোয়া মতাদর্শের উপরে ভিত্তি করে বুর্জোয়া শ্রেণীর পক্ষে নয়া উপনিবেশিক বা এককালীন উপনিবেশিক কোনো রাষ্ট্রেই আর বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হওয়া সম্ভব নয়। তাদের এই দাবিটা কত বাস্তবসম্মত সেটা আমরা ’৪৭ উত্তর পাকিস্তান এবং ’৭১ উত্তর বাংলাদেশের অবস্থা পর্যালোচনা করলে বুঝতে পারি। মোটামুটি সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে এটাই হলো তাদের দৃষ্টিভঙ্গি।

 সূত্র:: ক্রসফায়ার: রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, চিন্তা ঐতিহ্য যৌথপ্রকাশনা, ২০০৯।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।