ক্রসফায়ার প্রসঙ্গ: দ্বিতীয় অংশ 


প্রচলিত সেনাবাহিনী ও সেনাশাসন

রাজনীতিক দল গুলোর নিজস্ব মতামত

এবার আসা যেতে পারে আমাদের মত দেশগুলোতে প্রচলিত সেনাবাহিনী এবং রাজনীতিতে তাদের হস্তক্ষেপ সম্পর্কে আলাপচারিতায়। তার পরপরই তাদের খতম অভিযান, দেশের আইন-শৃঙ্খলা এবং প্রতিরক্ষা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কথা বলা যাবে।

এসব দলের মতানুসারে পাশ্চাত্যের উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতে পেশাদার সামরিক বাহিনী বেসামরিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে থেকে সমর বিভাগীয় আমলাতান্ত্রিক এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ বৈধ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের অধীনে তাদের কাজ হলো অনেকটা ম্যানেজারিয়ান ও টেকনিক্যাল। যাতে ওই সমস্ত দেশে গড়ে তোলা বুর্জোয়া ব্যবস্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানাদি টিকে থাকে।

তাছাড়া উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলোতে কাঠামোগতভাবে বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বুর্জোয়া ব্যবস্থাপনার বিকাশ ঘটার ফলেই সেনাবাহিনী পক্ষে থেকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মত উচ্চাকাক্সক্ষা পোষণ করা সম্ভব হয় না। সেনাবাহিনীর পেশাগত দাবি এবং কাঠামোগত চাহিদা সংশ্লিষ্ট দেশের পররাষ্ট্র নীতি ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। সেই সীমা অতিক্রম করতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাদির মধ্যেই প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। এসব নানাবিধ কারণে বৈধ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের বেঁধে দেওয়া সীমারেখাকে পেশাদার বাহিনী হিসেবে সেনাবাহিনী মেনে নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মত রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে এটাই বাস্তবতা।

অন্যদিকে আমাদের মত নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে তাদের মতামত হলো এসব দেশে সরকার থেকে সরকারে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াতে যখন বিরোধ শুরু হয় অথবা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তথাকথিত মুৎসুদ্দি পুঁজির মালিক বুর্জোয়া দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের নগ্ন বিরোধীতায় লিপ্ত হয়, যখন সংকট নিরসন বা মধ্যস্থতা করার মতো কোনো বৈধ্য পন্থা আর তাদের সামনে খোলা থাকে না; অথবা কোনো নির্বাচিত সরকার যখন গণকল্যাণমুখি কর্মসূচি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়; ঠিক তখন সামরিক বাহিনী বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করে নেয়। এবং সামরিক সরকার বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী জোটে ও তাদের আন্তর্জাতিক সমর্থনের ফলে রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিসহ মানুষের জীবনাচার ইত্যাদি সবকিছুর উপরে আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টি বা এসব রাজনৈতিক দল দৃঢ়ভাবে মনে করেন আমাদের মত দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার বদল না ঘটিয়ে সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল রোধ করা একটা অসম্ভব ব্যাপার। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে তারা ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শুরু করে অন্তত দেড়শ’ বছর ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অধিকাংশ দেশে গড়ে প্রতি ৬ সপ্তাহ অন্তর একটি করে সামরিক অভ্যত্থান সংগঠিত হওয়ার কথা বলেন। তাদের অনেক লেখায় তাদের দৃষ্টিতে সামরিক বাহিনীর এসব হস্তক্ষেপ কোনো মতেই ক্ষণস্থায়ী বিচ্যুতির বিষয় ছিলো না। এটা সম্পূর্ণই স্বতন্ত্র একটা রাজনৈতিক ধারা হিসেবেই আমাদের মত দেশগুলোতে গণ্য। একই সঙ্গে তারা আরো মনে করেন সামরিক অভ্যত্থানের পৌনঃপৌনিকতা এখন কমে এসে আজ সামরিক শাসনের স্থায়ীত্বের বিষয় অনেক দেশে অনেক বেড়ে গিয়েছে। তাদের মতে, প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক আমলেই কলোনিয়াল বাহিনী হিসেবে সেনাবাহিনীকে সমাজের অপরাপর যে কোনো সংগঠনের চেয়ে একটা দৃঢ় ও শক্তিশালী ভিত্তির উপরে দাঁড় করানো হয়েছিল। সেখানে একটা কেন্দ্রীয় চেইন-অব-কমান্ড; শৃঙ্খলা ও আনুগত্য; আনুগত্যের অভাবে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা দিয়ে ঐক্য রক্ষায় সচেষ্ট হয়েছিল শাসকরা। ফলে সাংগঠনিকভাবেই সামরিক বাহিনীর একটি শক্তিশালী অবস্থান আমাদের মত দেশগুলো তো রয়েছে এবং তারা সংগঠনগতভাবে যে কোনো উদ্দেশ্য সাধনে খুব দ্রুতই সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। তারা সক্রিয় হয়ে উঠলে তাৎক্ষণিক মোকাবেলা করার মত কোনো অবস্থা অন্য কোনো শক্তির নেই। অন্তত সংগঠনগতভাবে। এবং আমাদের মত দেশগুলোতে। এই মোকাবেলা করতে না পারার অন্যতম কারণ হলো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রীত সমস্ত বৈধ অস্ত্রের মালিক তারাই। আইনগতভাবেই এই বৈধতা তাদেরই দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে বিশিষ্ট নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কিছু সাধারণ মানের অস্ত্র বহন করার লাইসেন্স দেওয়া হয়ে থাকে। এই দুই পক্ষ ছাড়া অপর কোনো নাগরিকের ঘাড়ে অস্ত্র শোভা পেলে সেটা আইনের চোখে অবৈধ। ফলে সাংগঠনিক দক্ষতা, শৃঙ্খলা এবং অস্ত্রের প্রাধান্য সঙ্গে অস্ত্র ব্যবহারে রাষ্ট্রীয় বৈধতাই তাদের ক্ষমতা দখলের একমাত্র চাবিকাঠি।

এর পাশাপাশি ঔপনিবেশিক আমলেই পেশাদার বাহিনী হিসেবে সেনাবাহিনীকে গড়া হয়েছিল স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে। যেমন তাদের নিজস্ব সাপ্লাই, যোগাযোগ, ইঞ্জিনিয়ারিং কোর, চিকিৎসা ও শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে তা ভোগ করে থাকে। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের উপরে তাদের নির্ভর করার দরকার পড়ে না। অর্থাৎ নয়া ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার মধ্যে ব্যাপক উৎপাদক জনগোষ্ঠীর বিপরীতে তাদের জীবনাচার খুবই অগ্রসর। তাদের এই বৈজ্ঞানিক কলা-কৌশলের শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই তাদের পক্ষে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হস্তগত করা খুব সহজ হয়।

একইভাবে ঔপনিবেশিক আমলেই আমাদের মত দেশের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর এনফ্যানট্রি শাখাকে খুবই দ্রুতগামী এবং তার সাংগঠনিক কাঠামোকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের আদলেই তৈরি করা হয়েছিল। মূলত এগুলো হলো তাদের ক্ষমতা দখল করার কলা-কৌশলগত দিক। এর বাইরে আরো কিছু বিষয় রয়েছে বলে ওই সব কমিউনিস্ট পার্টি মনে করে।

তাদের দৃষ্টিতে আমাদের মত নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোতে শাসক শ্রেণী এমনভাবেই সামাজিক স্তর বিন্যাস স্থিতীকৃত করে রেখেছে যে, সমাজের নিচুতলার মানুষের পক্ষে কোনোভাবেই উপরতলায় উঠে আসা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এর পরেও রয়েছে বেকারত্বের বোঝা। কর্ম উপযোগী মানুষের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কর্মসংস্থান গড়ে তোলার কোনো ধরনের প্রচেষ্টা এসব দেশের সরকারের সামনে লক্ষ্য হিসেবে থাকে না। ঠিক এই ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরি হিসেবে সেনাবাহিনীতে চাকরি পাওয়াটাও সমাজের অধস্তন মানুষের জন্য ভাগ্যের বিষয়। এই চাকরি যাদের জোটে তাদের উপরে আরোপ করা হয় কঠোর শৃঙ্খলা-ও আনুগত্যের বোঝা। তার সঙ্গে থাকে আরো কিছু নীতি ও নৈতিকতা। যেমন সৈনিক মানে বীরত্ব, বিশ্বস্ততা, আত্মত্যাগের প্রতিমূর্তী; সৈনিক মানে শুদ্ধচারিতা ও কৃচ্ছতার জীবন; সৈনিক মানে স্বাধীনতা-সাম্য ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক, দেশ মানেই নিজের দেশ ইত্যাদি। এভাবে বিষয় ভিত্তিক শিক্ষাদানের মধ্য দিয়েই তাদের ট্রেন্ডআপ করা হয়। এছাড়া আপাতদৃষ্টিতে সামরিক বাহিনী থাকে দলীয় রাজনীতির বাইরে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের জবাবদিহিতা সরকারের কাছে। ফলে রাজনৈতিকভাবে ও প্রতিষ্ঠানগতভাবে তাদের পক্ষে নিরপেক্ষতার দাবি করা খুবই সহজ। এসব অন্যতম কারণ আমাদের মত দেশগুলোতে যখন সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করে, তখন নিরপেক্ষতার বর্তাবরণেই তারা আবদ্ধ থাকার ফলে প্রথমাবস্তায় ব্যাপক জনসমর্থনও তারা পায়। যেমন পাকিস্তান আমলে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দেওয়ার পর, পূর্ববঙ্গের ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিবীদের যে ঘোড়াদৌড় শুরু হয়েছিল। সেই দৌড়ে সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগ, পাকিস্তানী শাসকবর্গ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে সরকার গঠন করে। ওই স্বল্পসময়ে ক্ষমতায় থেকে পুরো পূর্ববঙ্গকে তারা দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিতে ডুবিয়ে দিয়েছিল। এমতাবস্তায় সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগকে হটিয়ে দেশে যখন সামরিক শাসন আসে, তখন পূর্ববঙ্গের প্রধানাংশের জনগণ প্রথম পর্যায়ে তাকে স্বাগত জানিয়েছিল। আবার ’৭১ পরবর্তী সময়কালে আওয়ামী দুঃশাসন থেকে মুক্তি পেতে মানুষ কিন্তু সামরিক শাসনকে স্বাগত জানিয়েছিল। এভাবে এশিয়া-আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অসংখ্য দেশে অসংখ্যবার সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে। অসংখ্য রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করেছে। এবং প্রতিটি দেশেই ক্ষমতা দখলের পূর্বশর্ত হিসেবে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, প্রশাসনে দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সংহতি বিপন্ন, জাতির ঘোরতর দুর্দিন ইত্যাদি ভাষ্যের পৌনঃপৌনিক ব্যবহার তারা করেছে। সামরিক বাহিনী কর্তৃক সমাজের এইযে চিত্র অংকন, সেটা একদমই বাস্তব। সামরিক বাহিনীর সাধারণ সৈনিকরা সমাজের নিচুতলার ঘর থেকে আসে বিধায় তারাও এটা বিশ্বাস করে। সাধারণ মানুষও তা বিশ্বাস করে। কিন্তু মিলিটারি শাসন এসব অব্যবস্থাপনা নির্মূল করতে সক্ষম, এমন কোনো নজির পৃথিবীতে অদ্যাবধী নেই। সমাজের গণতান্ত্রিক রূপান্তরে তারা সক্ষম, এমন নজিরও পৃথিবীতে নেই। তবে তারা প্রথম পর্যায়ে দুর্নীতিকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে বাধ্য হয়, জনসমর্থন পাওয়ার জন্য। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বৈধ সরকারের মতই মিলিটারি শাসনও সমান দুর্নীতিগ্রস্ত, এরও হাজারে হাজার দৃষ্টান্ত রয়েছে। ফলে আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর দাবি অনুযায়ী একটা দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া; কতিপয় সদিচ্ছাসম্পন্ন সামরিক কর্মকর্তা ইচ্ছা করলেন এবং উপর থেকে রেডিমেট আইন চাপিয়ে দিলেন, আর সমাজের রূপান্তর ঘটে গেল, সমাজ গণতান্ত্রিক হয়ে উঠলো এমন আলাউদ্দিনের চেরাগ তাদের হাতে আগেও ছিল না, এখনো নেই। বিষয়টি যে আদতেই ঘটা সম্ভব নয় এটা সামরিক কর্মকর্তারাও বোঝেন। তারপরেও রাজনীতিতে তাদের হস্তক্ষেপ ঘটে কেন? এটা সবার জন্যই জরুরি প্রশ্ন। এবং প্রশ্নটা নিয়ে পাকিস্তান আমল থেকেই বিতর্ক চলে আসছে রাজনীতিতে। আলোচিত বিশেষ ধারার কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যেও সে বিতর্ক রয়েছে। ফলে এই প্রশ্নে তাদের আরো মতামত আমরা সংক্ষেপে জেনে নিতে পারি।

এই কাজের সূত্র ধরে আমি তাদের কাগজপত্র যতটা হাতে পেয়েছি সেখানে দেখেছি যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে পরিচিত সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ ইত্যাদি দলগুলোকে সামরিক শাসন এবং বেসামরিক শাসন, এরকম একটা বিভাজন করে থাকে। এবং ক্ষমতার বৈধরূপ এবং অবৈধরূপ হিসেবে একটা তরিকা দাঁড় করায়। কিন্তু আলোচিত বিশেষ ধারার কমিউনিস্ট পার্টিগুলো নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বেসামরিক শাসক ও সামরিক শাসককে আলাদা শ্রেণী বা পরস্পর বিরোধী শক্তি হিসেবে গণ্য করে না। তারা মনে করে উভয়ই একই ব্যবস্থার পরিপূরক। একটি নয়া উপনিবেশিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে যখন সংকট ঘনীভূত হয়ে ওঠে; প্রচলিত আইন-কানুনে যখন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় না; তখন নগ্ন দমনপীড়ন নামিয়ে এনে সমস্ত মানবাধিকার-গণতান্ত্রিক অধিকারকে নস্যাৎ করে দিয়ে সামরিক বাহিনী প্রচলিত ব্যবস্থাকে রক্ষা করে। এটা হলো রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের প্রধান কারণ। তবে এক মাত্র কারণ নয়। আরো অনেক কারণ রয়েছে। যেমন নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোতে যদি ন্যূনতম গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশ ঘটার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে সেই সম্ভাবনাময় গণতান্ত্রিক শক্তিকে নির্মূলে সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করে থাকে। আবার একই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যদি সামরিক বাহিনীর সমান্তরালে অপর কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর আত্মপ্রকাশের সম্ভাবনা থাকে, তাহলেও সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটতে পারে। আবার সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীগুলোর পারস্পরিক স্বার্থ-দ্বন্দ্ব থেকেও অনেক সময় সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটে। এরকম অসংখ্য প্রশ্নে সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটার নজির রয়েছে। তবে কোন মুহূর্তে সেটা ঘটবে তা ওই রাষ্ট্রের সামরিক কর্মকর্তাদের ইচ্ছার উপরে নির্ভর করে না। সেটা প্রধানত নির্ভর করে সামরিক কর্মকর্তাদের প্রভূ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর দিক নির্দেশনার উপরে। যেমন পাকিস্তানের ২৫ বছরের শাসনামলে আমরা দেখেছি দেশের প্রতিরক্ষার প্রশ্নটি বা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিষয়টি সম্পূর্ণই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামরিক সাহায্যের উপরে নির্ভরশীল ছিলো। সেদিন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শত শত কোটি ডলার সামরিক সাহায্যের অন্তরালে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাখাতে অনুপ্রবেশ করেছিল। এই অন্যতম কারণে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পূর্ণ-নিয়ন্ত্রণ এবং তার উপরে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। অর্থাৎ পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা খাত সামরিক সাহায্যের আবরণে মার্কিন সমর বিশেষজ্ঞদের নিয়ন্ত্রণ এবং সাহায্যের শর্তাধীন থাকায় সেটা সম্ভব হয়েছিল। ফলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট হিসেবে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাজ করেছে। কোনো সামরিক জেনারেল অথবা বেসামরিক সরকার যখনই সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, তখনই সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটেছে। তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুপ্রবেশের কাজটি করে দেয় জামায়াতে ইসলাম। পাঞ্জাবে দাঙ্গা বাঁধিয়ে। ওই দাঙ্গার সুবাদে পাঞ্জাবে সামরিক শাসন জারি হয়। ব্রিটিশ সমর্থিত রাজনীতিবীদ ও আমলাদের জামানা শেষ হয়ে যায়। সরকারি ব্যবস্থায় রদবদল ঘটে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট, পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে মার্কিনীরা ক্ষমতায় বসায়। তিনিই প্রথম পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি করে পাকিস্তানী রাষ্ট্রে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুপ্রবেশের কাজটি করে দেয়। সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ ওইসব চুক্তিকে পার্লামেন্টে অনুমোদন করে। মূলত এটাই হলো পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক-বেসামরিক সরকারের সম্পর্ক। এবং এসব চুক্তির ফলেই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ জোটে নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে তারা সহজেই মার্সেনারী বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। যেমন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে এখন আমরা পৃথিবীর নানান দেশে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ জোটে শরিক হয়ে ভাড়া খাটতে দেখছি। ভারতের সেনাবাহিনীও একইভাবে পৃথিবীর নানান দেশে মার্সেনারী বাহিনী হিসেবে ভাড়া খাটছে। যদিও নামে সেটা শান্তি বাহিনী। আবার আমরা ’৫৬ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হওয়ার পরে পূর্ববঙ্গে যখন ন্যূনতমভাবে হলেও গণতান্ত্রিক শক্তি বিকাশের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, ঠিক তখনই গভর্নর শাসন জারি হতে দেখলাম। ওই শাসনের পূর্ণ মদদ দিয়েছিল সেনাবাহিনী। এবং সেদিন গভর্নর শাসন জারি হয়েছিল সরাসরি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নির্দেশে। আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে জরুরি অবস্থা চলাকালীন সময়ে আমরা যারা বেসামরিক নেতৃবৃন্দের মুখে সংস্কারের আওয়াজ শুনছি এবং একদল রাজনীতিবীদকে লেজুড়বৃত্তি করতে দেখছি। ঠিক অনুরূপভাবেই ’৫৬ সালে বেসামরিক নেতৃত্বর প্রধানাংশকেও আমরা সামরিক সরকারে লেজুড়বৃত্তি করতে দেখেছি এবং সংস্কারের কথাও শুনেছি।

এবার ধরা যাক আলজেরিয়ার আহমেদ বেনবেল্লার কথা। তিনি রীতিমত ফ্রান্স সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করেই ক্ষমতা দখল করেছিল। প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও গণতান্ত্রিক একজন নেতৃত্ব। একইসঙ্গে ওই দেশের জাতীয় নেতাও ছিলেন তিনি। দুই বছরের মাথায় ফ্রান্স সাম্রাজ্যবাদ সমর্থিত সামরিক জেনারেল হুরারি বুমবিয়ান সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এবং বাদবাকি জীবন তাকে কারাগারেই আটক রাখে। কারাগারেই তার জীবনাবশন হয়। আবার ৯০ -এর দশকে আলজেরিয়ার ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল যখন পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিজয় অর্জন করে, তখন তাদের সরকার গঠন করতে বাধা দেয় ফ্রান্স সাম্রাজ্যবাদ সমর্থিত সেনাবাহিনী। একই সঙ্গে গোট দেশে গণহত্যা সংঘটিত করে নির্বাচনে বিজয়ীদের উপরে একটা যুদ্ধ ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়। বলা হলো সামরিক বাহিনীর এই হস্তক্ষেপই নাকি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।

ঘানার গণতান্ত্রিক সরকার নত্রুমার ক্ষমতায় গিয়ে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ‘টয়লারস্ বিগ্লেড’ গঠন করেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক আমলে গড়ে ওঠা সেনাবাহিনী, রাষ্ট্রীয় বাহিনী হিসেবে‘ টয়লারস বিগ্লেডকে’ তাদের প্রতিপক্ষ মনে করে বসে। ফলে উৎখাত হয়ে যায় টয়লারস ব্রিগেটসহ নত্রুমার সরকার।

সিরিয়ার সেনাবাহিনী ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত মোট বিশ বছরে নয়বার অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ থেকে। মিশরে ১৯৫২ সালের ২৩শে, ছাড় এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নগীব ও নাসের ক্ষমতা দখল করে। ওই দিনেই নগীব ঘোষণা দেয় আমার প্রথম দায়িত্ব হলো পার্লামেন্টকে পুনর্বহল করা। আগস্টের ৮ তারিখে তিনি বলেন ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত করা হলো। ১০ই ডিসেম্বর ঘোষণা করলো সংবিধান বাতিল করা হলো। এবং তারাই অস্থায়ী সরকারের পক্ষে বিপ্লবের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। নগীবের সামরিক অভ্যুত্থানই বিপ্লব বলে পরিগণিত হলো। আবার জুন মাসে (১৯৫৩) কর্নেল নাসের ঘোষণা করলো তাদের অস্থায়ী সরকারের কার্যকাল হবে তিন বছর। ১৯৫৪ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি নাসের-নগীব দ্বন্দ্বে, নগীব পরাজিত হন। নাসের ক্ষমতার সর্বাধিনায়ক হয়ে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তার শাসনামলে একটা নির্বাচন হয়। এবং বিপুল ভোটে তিনি বিজয়ী হন। আবার নাসেরকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন সামরিক বাহিনীর আনোয়ার সাদাত ও হোসনী মোবারক। তারাও যথারীতি নতুন নতুন মডেলের গণতন্ত্রের উদ্ভব ঘটান। আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র অথবা জিয়াউর রহমানের মত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রের মত হাজার পদের গণতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে এভাবে। এবং যথারীতি ৯০ ভাগ ভোট পেয়ে পাশও করে যায় এসব সরকার।

যদি শেখ মুজিবের প্রসঙ্গেও আসা যায় সেখানেও একই চিত্র পাওয়া যাবে। তিনি দেশের সেনাবাহিনীর সমান্তরালে রক্ষিবাহিনী গঠন করেছিলেন ভারত-রাশিয়ার পরামর্শ মতে। সেটা ছিলো আমাদের দেশে ঔপনিবেশিক আমলে গড়ে ওঠা আর্মির জন্য একটা থ্রেট। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরে বন্দর স্যালভেজ করার অজুহাতে রাশিয়ার রিয়ার অ্যাডমিরাল সার্গোই ডুয়েংকার নেতৃত্বে ৭০০ রুশ সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিন উপস্থিতি এবং চট্টগ্রামে রাশিয়ার নৌঘাটি করার পরিকল্পনা আমেরিকা এবং ভারত কেউই সহজভাবে নেয়নি। শেখ মুজিব এই চাপ সামাল দিতে রুশ-ভারত সমর্থিত তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী থেকে সরিয়ে দিয়েও রেহাই পাইনি। প্রায় ঝাড়ে-বংশে তাকে নির্মূল করা হয় শেখ মুজিবের পরিবারকে। আমেরিকা সমর্থিত সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেটা করেন।

তাঁছাড়া, ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ ধারায় যে মক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। ওই যুদ্ধেও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিলো। তাদের নিয়েই গড়ে উঠেছিল মুক্তিফৌজ। যা আজকের মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিবাহিনী নামে পরিচিত। যদিও এই বাহিনীতে সদস্য বিক্রুটিংয়ের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা ভূমিকা ছিলো এবং তাদের তত্ত্বাবধানেই তা গড়ে ওঠে। তারপরেও সেখানে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ। কিন্তু’ ৭১ পরবর্তীতে বাংলাদেশ গঠন হওয়ার পর পর আওয়ামী লীগ সরকার ওই মুক্তি বাহিনীকে অস্ত্রমুক্ত করে তাদের পূর্বের জীবনে ফেরত পাঠায়। যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। কারণ জাতীয় মুক্তির আন্দোলন হোক, আত্মনিয়ন্ত্রণের যুদ্ধ হোক বা সাধীনতার সংগ্রাম হোক, এসব সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে সেনাবাহিনী মূলত জাতীয় সেনাবাহিনীর মর্যাদা পায়। চীন-ভিয়েতনাম লাওসসহ পৃথিবীর অনেকে দেশে তার দৃষ্টান্ত রয়েছে। শেখ মুজিব সেই নতুন জাতীয় চেতনাসম্পন্ন সেনাবাহিনী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র মুক্ত করে, দেশের প্রতিরক্ষার ভার তুলে দেন কলোনিয়াল এবং একই সঙ্গে পাকিস্তান আমলে থেকেই মার্কিন সাম্রজ্যবাদের স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেনাবাহিনীর হাতে। আর বিরোধী মতালম্বীদের খতম করতে মুজিববাহিনীকে রূপান্তরিত করেন রক্ষিবাহিনীতে। এবং তার ফলাফল আজ আমরা সবাই প্রত্যক্ষ করছি। অর্থাৎ সেনাবাহিনী ও রক্ষিবাহিনীর দ্বন্দ্বের খবরাখবর আমাদের দেশের শিক্ষিত জনের অজানা নয়।

আবার ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি ছিলো ১৯৬৩-৬৫ সালে পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহৎ কমিউনিস্ট পার্টি। ওই পার্টির পঞ্চম কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটির চতুর্থ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেসের লাইনকে বিনা সমালোচনায় গ্রহণ করে। ওই অধিবেশনেই শান্তিপূর্ণ উপায় ও সংসদীয় পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লাইন গ্রহণ করে পার্টি। তাদের পঞ্চম জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছিল মার্চ, ১৯৫৫ সালে। ওই চতুর্থ অধিবেশনের সিদ্ধান্তের ফলে ওই পার্টির লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় সুকর্নের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করা। এবং সুকর্নের নেতৃত্বাধীন অভিজাত গোষ্ঠীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা। তারা রাজনৈতিক লাইনের ক্ষেত্রে শ্রেণী সংগ্রামকে প্রধানভাবে আঁকড়ে ধরার বিপরীতে জাতীয়তাবাদকে সমর্থন এবং জাতীয় সংগ্রামকে প্রধান হিসেবে ধরেন। একই সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তির মধ্যে বা ক্ষমতাসীন সরকার ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে জনমুখী ও জনবিরোধী বিভক্তির একটা তত্ত্ব ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি হাজির করে। এসব তত্ত্বের উপরে দাঁড়িয়ে তারা ১৯৫৯ সালে সুকর্নকে সমর্থন করে। ১৯৬১ সালে সরকারে যোগ দেয়। ১৯৬৩ সালে ওই দেশে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। এবং ১৯৬৩ সালের শেষভাগে ভূমি সংস্কার আইন যখন তারা কার্যকরি করতে যায়, তখনই ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কমী ও সমর্থক জনগণকে কচুকাটা করে ফেলে ওই দেশের ঔপনিবেশিক পর্বে গড়ে ওঠা সেনাবাহিনী। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক আমলে গড়ে ওঠা ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনী এবং মুসলিম সংগঠনের মধ্যে যে ধারাটি ইন্দোনেশিয়াকে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণার দাবি নিয়ে লড়ছিল, এই উভয়শক্তি মিলে গণহত্যা সংগঠিত করে। ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির প্রায় ১১ লাখ সদস্য ও সমর্থক খুন হয়ে যান। ৫০ শতাংশের বেশি সদস্য দেশ থেকে বিতাড়িত হয়। অবশিষ্টরা একটানা ১৫-২০ বছর আত্মগোপন করে জীবন কাটান। অর্থাৎ ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টি নিজস্ব সেনাবাহিনী গঠন না করে জাতীয়তাবাদ ও প্রচলিত সেনাবাহিনীর উপরে নির্ভর করে ভূমি সংস্কার করতে গিয়ে উচ্ছেদ হয়ে যায়। ইন্দোনেশিয়ার মত একই লাইন গ্রহণ করে মালয়েশিয়াতে জাতীয়তাবাদী মাহতির ও সেনাবাহিনীর হাতে মালেয়েশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির ৫ লাখ কর্মী মারা যায়। থাইল্যান্ডে মারা যায় দেড়লাখ কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ও সমর্থক। তাদেরও নিধন করেছিল সেনাবাহিনী। চিলিতে নির্বাচিত সমাজতান্ত্রিক দল ও তার নেতা আলেন্দা সরকারসহ প্রায় ১ লাখ কর্মী -সমর্থক কচুকাটা হয়ে যান ওই ঔপনিবেশিক আমলের সামরিক বাহিনীর হাতে। অপরাধ একটাই তিনি দেশের জন্য ন্যূনতম গণতান্ত্রিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। আলোচিত এই সামগ্রীক অভিজ্ঞতা মিলিয়ে সেদিনে আলোচিত ধারার কমিউনস্ট পার্টিগুলো যেমন গণতন্ত্রের নামধারী স্বৈরাচারি পার্লামেন্টারি রাজনীতিকে পরিহার করে মাও নির্দেশিত গণকমিউনের পথকে আঁকড়ে ধরে, ঠিক তেমনি উন্নত বুর্জোয়া দেশগুলোর আদলে সেনাবাহিনী তৈরি অথবা ঔপনিবেশিক আমলে সৃষ্টি কলোনিয়াল সামরিক বাহিনীর উপরে নির্ভর না করে ‘কৃষি বিপ্লবের’ সঙ্গে সম্পর্কিত ‘পিপল আর্মি গঠনের উদ্যোগ নেয়। যারা কোনোভাবেই পেশাদার বাহিনীর মত রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ ও নিষ্ক্রিয় সেনাবাহিনী হবে না বলে তাদের দাবি। কৃষি বিপ্লব সফল করার সংগ্রামের মধ্যেই জনগণ নিজেদেরকে সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে গণ্য করবে। আর সৈনিকরা জনগণের সদস্য হিসেবেই পরিগণিত হবেন বলে তাদের দাবি। এই Massline যাতে বজায় থাকে এবং সেনাবাহিনী যাতে জনগণের অংশ হয়েই থাকে, সেই পথটি সশস্ত্র সংগ্রামের শুরু থেকেই মাওসেতুঙ তার রণনীতির অংশ হিসেবে গড়ে তুলেছিলন। মাও নির্দেশিত আর্মি ছিলো একাধারে Work Force, আবার Combat Force। অর্থাৎ তারা উৎপাদন কাজে যেমন স্বশীরে অংশ নিতেন তেমনি আবার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যুদ্ধও করেছেন।

এই সেনাবাহিনীর মধ্যে যদি কখনো মতাদর্শ ও দক্ষতার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, তখন মতাদর্শের উপরে গুরুত্বারোপের কথা বলেছিলেন মাওসেতুঙ। কারণ ইডিওলজি বা দেশের সার্বভৌমত্ব বিক্রি করে সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নের তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। ১৯৬৫ সালে এসে ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের স্ট্যান্ডিং কমিটির সিদ্ধান্ত মতে চীনের পিপলস আর্মির মধ্য থেকে পদবী (Rank), পোশাক, টুপি, তকমা ইত্যাদি সবকিছু বাতিল করে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে পিপলস আর্মির সহায়তায় রাষ্ট্রের সমস্ত সক্ষম নাগরিককে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সমস্ত জনগোষ্ঠীকে নিয়ে গণমিলিশিয়া গঠনের উদ্যোগ চলে। তবে মাওসেতুঙয়ের মৃত্যুর পর পর আলোচিত এসব উদ্যোগ বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। তারপরেও নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোতে সে সব রাজনৈতিক দল বর্তমানে নিজেদেরকে মাওবাদী হিসেবে গণ্য করেণ। তারা সবাই সমাজ রূপান্তর ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে মাও প্রবর্তিত ‘কৃষি বিপ্লব’ ‘গণকমিউন’ ও পিপলস আর্মি প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছেন। দেশের অপরাপর বামপন্থীদল ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে এসব মৌলিক প্রশ্ন নিয়েই তাদের রয়েছে ঘোরতর মতপার্থক্য এবং নীতিগত বিরোধ। যা রণনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয় বলে তারা মান্য করেন।

এ প্রসঙ্গে উদাহরণ না বাড়িয়ে এবার আমরা আরকটি ভিন্ন বিষয়বস্তুতে যেতে পারি। সেটা হলো আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন দলগুলোর সঙ্গে সশস্ত্র শক্তির যোগসূত্রতা কোথায় সেই বিশ্লেষণে। প্রসঙ্গটি একারণেই গুরুত্বপূর্ণ যে, আমাদের মত দেশের রাজনীতিতে শুধুমাত্র সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের প্রেক্ষাপট আলোচনা করে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর সামরিক শক্তির সঙ্গে যোগসূত্রতা যেমন স্পষ্ট হবে না, তেমনি বিষয় হয়ে দাঁড়াবে এক পাক্ষিক। এই বিশ্লেষণের উপরে দাঁড়িয়ে শ্রেণীগণতন্ত্রের সঙ্গে বল প্রয়োগের সম্পর্ক কি সেটাও স্পষ্ট হবে না।

আমরা সবাই মোটাদাগে একটা কথা জানি, ক্ষমতাসীন দলগুলো সরকার পরিবর্তনের রাজনীতিতে কেউই ঘোষণা দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বলেন না। তারা সংসদীয় পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের কথা বলেন। যে ব্যবস্থাটিকে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে ধরা হয়। যাকে দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, সুশিল সমাজ শান্তিপূর্ণ পথে সমাজ পরিবর্তনের তত্ত্ব হিসেবে দেখেন। এবং তাদের বয়ানে এটাই হলো মূল ধারার রাজনীতি।

এ প্রশ্নের জবাবেও আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টি বা মাওবাদী দলগুলোর রয়েছে। এবার আমরা তার উপরে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করবো। এসব দল মনে করে একটি সময় পৃথিবীর প্রতিটি সমাজের সক্ষম প্রত্যেকটি মানুষই ছিলেন সশস্ত্র। ফলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় আলাদাভাবে বিশেষ কোনো বাহিনী বা সামরিক সংগঠনের প্রয়োজন হয়নি। পাশাপাশি সমাজের প্রত্যেকটি মানুষ সশস্ত্র থাকলে কোনো গোষ্ঠী, সংস্থা বা ব্যক্তির পক্ষে অপরের উপর সশস্ত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় না। এবং বহিঃশত্রুর মোকাবেলাটা সবাই সম্মিলিতভাবেই করত সেদিন। পরবর্তীকালে সমাজ সভ্যতার ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে যে ব্যক্তিগত মালিকানা বা সম্পত্তির উদ্ভব, উদ্বৃত্ত সম্পদ সৃষ্টি ও দখল এবং ওই সম্পদের ব্যক্তিগত ভোগনীতি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ক্ষমতাসীনরা উৎপাদক জনগোষ্ঠীকে নিরস্ত্র করেছে। এবং উৎপাদন বিচ্ছিন্ন একটি সামরিক সংগঠনের প্রয়োজন পড়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে আইনগতভাবে ওই ব্যবস্থাপনার ন্যায্যতা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তাদের বিশ্লেষণে সমাজে ব্যক্তিগত মালিকানা সৃষ্টি, উদ্বৃত্ত লুট ও বৈষম্য বন্টননীতির সঙ্গে উৎপাদক জনগোষ্ঠীকে নিরস্ত্র করা এবং রাষ্ট্রের সশস্ত্র অবস্থান ও উৎপাদন বিচ্ছিন্ন সামরিক সংগঠন, পরস্পর সম্পৃক্ত বিষয়। ফলে আলোচিত দলগুলো উদ্ভব পর্ব থেকেই রাষ্ট্রকে শ্রেণী নিরপেক্ষ ও সমাজ ঊর্ধ্ব কোনো সংস্থা মনে করে না। রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন ও মতাদর্শকে শ্রেণী নিরপেক্ষ মনে করে না। উৎপাদন বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রীয় সামরিক সংগঠনকেও শ্রেণী নিরপেক্ষ মনে করে না। এবং প্রচলিত গণতন্ত্রকেও শ্রেণী নিরপেক্ষ মনে করে না। তাদের আরো বিশ্লেষণ অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বে যে সব আন্তর্জাতিক সাম্রজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো রয়েছে, তারাও এক সময় রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, সামন্তবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছে। আজ তারা গোটা বিশ্বব্যাপী যে দখল অভিযান চালাচ্ছে এবং সেই সক্ষমতা ধরে রাখতে পারছে সেটাও ওই সশস্ত্র শক্তির বলে। এছাড়া পৃথিবীর নানান দেশে উদারনৈতিক বুর্জোয়ারা যে রাষ্ট্র ও রাজনীতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, ‘সেটাও তারা করতে সক্ষম হয়েছে ওই সামরিক শক্তির সাহায্যে’। আবার নানান পদের স্বৈরাচারি ও ফ্যাসিস্ট সরকার তারা তাদের ওই ক্ষমতা ধরে রাখতে পারছে ওই সামরিক শক্তি বা সংগঠনের সমর্থন ও তাকে ব্যবহার করে।

তারা আরো মনে করে ’৪৭ পরবর্তী পাকিস্তান সরকার পূর্ববঙ্গসহ নানান জাতির উপরে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেছিল ওই সামরিক সংগঠনের উপরে ভর করে। ’৭১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় আসতে হয় রীতিমত সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হয়েছিল সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করে। সাত্তারকে হটিয়ে এরশাদও ক্ষমতাসীন হয়েছিল ওই সামরিক শক্তি ও সংগঠন ব্যবহার করে। এবং সর্বশেষ ফকরুদ্দিনের সরকারও টিকে রয়েছে ওই সামরিক সংগঠনের ক্ষমতা বলে। অর্থাৎ তাদের দাবি মতে একদিকে আধুনিক রাষ্ট্র গঠন, ক্ষমতা ধরে রাখাসহ একচেটিয়া শ্রেণীগণতন্ত্র প্রয়োগের সঙ্গে বল প্রয়োগ বা সামরিক শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি যেমন অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত, তেমনি আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ সরকার, জিয়া এবং এরশাদ সরকারও ক্ষমতায় এসেছে সরাসরি সশস্ত্র শক্তির সাহায্যে। তাদের সরকার পরিবর্তনের রাজনীতির সঙ্গে বল প্রয়োগের নীতিটা সম্পৃক্ত। বল প্রয়োগই এখানে নির্ণায়ক শক্তি। রাষ্ট্রের এই যে সশস্ত্র রূপ, সরকার বদলে সশস্ত্র অভিযান, এই প্রেক্ষাপটের আলোকেই মাওবাদীরা বলছে প্রকৃত অর্থে যদি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তুলতে যাওয়া হয়, তাহলে বল প্রয়োগ বা সশস্ত্র ছাড়া সেটা সম্ভব হবে না। এখন আমাদের কাছে প্রশ্ন হলো ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির ক্ষমতা দখল বা সরকার বদলের সঙ্গে যদি সরাসরি সশস্ত্র বল প্রয়োগের নীতি সম্পর্কিত হয়ে থাকে, তাহলে মাওবাদীদের জন্য একই নীতি কেন অন্যায্য পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে?

আমাদের ক্ষমতাসীন দলগুলো, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী সমাজ ও মিডিয়াকর্মীরা দাবি করেন যে, সশস্ত্র ধারার কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে বল প্রয়োগের নীতি ছেড়ে মূল ধারার রাজনীতিতে আসতে হবে। আমাদের মত সাধারণদের প্রশ্ন হলো এদেশের ক্ষমতাসীন দলগুলো প্রথম পর্যায়ে ঠিক কোনো ধারার উপরে ভিত্তি করে ক্ষমতাসীন হয়েছিল? একই সঙ্গে তাদের ওই ক্ষমতা দখল আজ সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত বিষয় কী না? ফলে আমরা মূল ধারা বলতে কি বুঝবো এটা অবশ্যই প্রশ্নাকারে থাকে।

ক্ষমতা প্রশ্নে বা বল প্রয়োগের নীতি নিয়ে-এইযে বিতর্ক, তাকে ভিত্তি করে আলোচিত দলগুলোর আরো কিছু বক্তব্য রয়েছে। যেমন পূর্বেই বলা হয়েছে সমাজে ব্যক্তিমালিকানার সৃষ্টি, উদ্বৃত্ত লুন্ঠন ও বৈষম্যমূলক বন্টন নীতির সঙ্গে উৎপাদক জনগোষ্ঠীকে নিরস্ত্রকরণ ও ক্ষমতাসীনদের সশস্ত্র অবস্থান পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিষয়। এবং এই ব্যবস্থাপনাকে বহাল রাখতে গিয়ে উৎপাদন বিচ্ছন্ন একটি সামরিক সংগঠনের উদ্ভব ঘটাতে হয়েছে। এবং এসব দলের দাবি মতে বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থায় সশস্ত্র হওয়ার একচেটিয়া অধিকার ও কর্তৃত্ব শাসক দলগুলো বরাবরই তাদের হাতে রেখেছে। যা শ্রেণী রাষ্ট্র, শ্রেণী গণতন্ত্র ও শ্রেণী একনায়কতন্ত্রের অন্যতম উপাদান। এবং শাসকরা একমাত্র তাদের হাতে সামরিক ক্ষমতা ধরে রাখতে তাদের সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে গণ্য করে। ফলে জনগণের অধিকার আদায়ের যে কোনো ধরনের আন্দোলনকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করতে সক্ষম হয়। সাংবিধানিকভাবে সশস্ত্র হওয়ার একচেটিয়া অধিকার তাদের হাতে থাকায় জনগণের প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে শাসকরা রক্তাক্ত পথে ফয়সালা করে ফেলে। বাংলাদেশের পটভূমিতে এর শত শত উদাহরণ রয়েছে। তাদের এই একচেটিয়া সশস্ত্র হওয়ার অধিকারটি আবার দ্বিমাত্রিক চরিত্রসম্পন্ন। প্রথমত শুধুমাত্র শাসকদের একচেটিয়া সশস্ত্র হওয়ার অধিকার। দ্বিতীয় গণহত্যা চালানোর অধিকার। এই দুটো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিষয় বলে আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলি মনে করে। এই অন্যতম কারণে জনগণের চলমান গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে দমন করতে গিয়ে শাসকদের পক্ষ থেকে বলা হয় দেশজুড়ে রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা বেড়ে চলেছে। আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটান হচ্ছে। একদল দুস্কৃতিকারী রাষ্ট্রকে বিপন্ন করে তুলছে ইত্যাদি। এভাবে জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে দমন করতে গিয়ে দেশের আইন শৃঙ্খলা ও প্রতিরক্ষা নীতির সঙ্গে বিপক্ষ শক্তির আন্দোলনকে দাঁড় করায়। যেমন কানসার্ট আন্দোলন, ফুলবাড়ি আন্দোলন ও গার্মেন্টস আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমরা বিদেশী চক্রের হস্তক্ষেপের কাহিনী ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থিত বুদ্ধিজীবীদের মুখ থেকে অহরহ শুনেছি। আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলো বা মাওবাদীরা বহুপূর্ব থেকেই উপরে উল্লিখিত বিষয় নিয়ে কথা বলে আসছে। এবং অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা ও প্রতিরক্ষা প্রশ্নে তাদেরও সুস্পষ্ট ভাষ্য রয়েছে।

এসব দল মনে করে প্রচলিত জাতি অথবা প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ, রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে যে সার্বভৌমত্বের কথা বলে। সেটা কি শুধুমাত্র শাসক শ্রেণীর উপরে একচেটিয়া রূপেই বর্তে? যাকে শাসকরা প্রতিরক্ষামূলক নীতি বলছে? তারা বলেন, ধরা যাক ভারত অথবা আমেরিকা যদি বাংলাদেশ আক্রমণ করে, তাহলে এদেশের সেনাবাহিনীসহ অপরাপর সামরিক সংগঠনগুলোর পক্ষে কতঘণ্টা লড়াই চালানো সম্ভব? আর যদি দেশটা তারা দখল করে নেয়, তাহলে এসব সামরিক সংগঠনের পক্ষে দেশকে বিদেশী দখলদারদের হাত থেকে আদতেই কি মুক্ত করতে সক্ষম হবে? ইরাকের স্থায়ী সেনাবাহিনী পেরেছে কি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে ইরাক রাষ্ট্র ও জনগণকে রক্ষা করতে? অথবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে রাশিয়া লালফৌজ কি পেরেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন রক্ষা করতে? ইরান আক্রান্ত হলে শুধুমাত্র ওই দেশের সেনাবাহিনী কি পারবে ইরানকে রক্ষা করতে? এভাবে শেষ বিচারে যদি প্রতিরক্ষা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নটি জনগণের ঘাড়েই চাপে, সার্বভৌম ও প্রতিরক্ষার প্রশ্নটি যদি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা ও রক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়, আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি সার্বভৌম যদি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে থাকে, তাহলে ব্যাপক জনগণকে নিরস্ত্র রাখা হয়েছে কোন যুক্তি থেকে?

আর শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা প্রশ্নে তাদের জিজ্ঞাসা হলো- এটা রক্ষা করা কি ক্ষমতাসীনদের একক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে? শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নটি যদি গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়, তাহলে সেটা শুধুমাত্র বিশেষ বাহিনীর দায় কেন? পুলিশ বাহিনী পৃথিবীর কোন দেশে কবে, কখন; শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, জনগণের উপর দমন-পীড়ন ও শৃঙ্খল চাপিয়ে দেওয়া ছাড়া? এসব নানাবিধ কারণে কমিউনিস্ট পার্টিগুলো বা মাওবাদীরা মনে করে যে, শাসক দলগুলো সশস্ত্র হওয়ার একচেটিয়া অধিকার তাদের হাতে রাখতেই অনেক কুযুক্তিকেই আইনের শাসন হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। যা একদমই ভিত্তিহীন। বরং রাষ্ট্রের সশস্ত্র অবস্থানের সঙ্গে, ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়া সশস্ত্র কর্তৃত্বের সঙ্গে তাদের শ্রেনীগণতন্ত্র যেমন সম্পর্কিত, ঠিক তেমনি জনগণের নিরস্ত্রকরণ প্রক্রিয়াটিও যুক্ত। ফলে আলোচিত দলগুলো দাবি করে থাকে প্রকৃত অর্থে যদি একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে হয় যা কৃষি বিপ্লবের আলোচনায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে হয়, ব্যবস্থা বদলের লড়াই দাঁড় করাতে হয়, তাহলে শাসক শ্রেণীর একচেটিয়া সশস্ত্র হওয়ার অধিকারটি,কে আন্দোলনের সূচনা পর্ব থেকেই খতম করতে করতে যাওয়া জরুরী। এবং তারা মনে করে গণতান্ত্রিক সমাজ, রাষ্ট্র, সার্বভৌমত্ব, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নটি যেহেতু প্রতিটি জনগণের স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেহেতু প্রতিটি সক্ষম ব্যক্তিকে সশস্ত্র হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ জনগণের সশস্ত্র হওয়ার সঙ্গে তাদের অধিকার রক্ষা, সংরক্ষণ ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রামটি অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। এছাড়া তাদের প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রেও যাতে কোনোভাবে ক্ষমতার একচেটিয়া রূপ গড়ে উঠতে না পারে সেজন্য এটা জরুরি বলে অনেক দল মনে করে। পাশাপাশি আধুনিক জাতি রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার কারণেও প্রত্যেকটি জনগণের সশস্ত্র হওয়া দরকার বলে তারা মনে করে। অর্থাৎ এই প্রশ্নটি এসব দলের জন্য একদম নীতিগত বিষয়। ফলে আলোচিত অনেক দলই সংগ্রামের সূচনাবিন্দু থেকেই যেমন সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বলছে, তেমনি এই নীতি ঘোষণার মধ্য দিয়েই প্রচলিত রাষ্ট্রের যে একচেটিয়া সশস্ত্র রূপ, যা আবার শাসক শ্রেণীর সাংবিধানিক অধিকার, শাসক শ্রেণীর হত্যাকাণ্ড ঘটানোর যে একচেটিয়া কর্তৃত্ব; সেই ব্যবস্থাকেই খতমের কথা বলছে। এই রাজনীতিতে তারা নিজেরা যেমন সশস্ত্র হয়ে ওঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, তেমনি প্রতিটি জনগণকে সশস্ত্র হতে উদ্বুদ্ধ করে। তাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সশস্ত্রকরণের আন্তসম্পর্কটা ঠিক এখানেই। আমরা যদি খোদ মার্ক্সবাদী পাঠ নিতে আগ্রহী হই, তাহলে দেখা যাবে মার্ক্সের যুগে প্যারী কমিউনের যে লড়াই, এটা সেই অভিজ্ঞতারই ফসল। খোদ মার্ক্স গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় পরগাছারূপে স্থায়ী সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্র উচ্ছেদের বিষয়টি আশু কর্মসুচি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এবং সেনাবাহীনীর বিপরীতে গণমিলিশিয়া গঠনের উপরে গুরুত্বারোপ করেন। ফলে আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর কাছে গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের সঙ্গে গণফৌজ, উৎপাদন শ্রমে অংশগ্রহণ এবং তাদেরই কর্তৃত্ববান হয়ে ওঠা বা নেতৃত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা হওয়া সম্পর্ক যুক্ত। চীনের সংস্কৃতি বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে মাওসেতুঙ-এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। এছাড়া আজকের যুগে আমাদের মত দেশগুলোর ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের কর্তৃত্ব উচ্ছেদেসহ বহুজাতিক কোম্পানি ও তার স্বার্থ রক্ষাকারী সাম্রাজ্যবাদী জোটের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয় এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব অর্জন সম্ভব নয় বলে এসব দল মনে করে।

ব্যক্তি হত্যা, সন্ত্রাস, গণফৌজ গঠন ও গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্ক :

উপমহাদেশে রাজনৈতিক নকশাল ধারা এবং চারু মজুমদার যখন মাওয়ের কৃষি বিপ্লবের লাইনকে প্রায়োগিক অর্থে গ্রহণ করেন, সেদিন থেকেই এই ধারা নিয়ে অনেক বিতর্ক, প্রচারণা এবং পক্ষ-বিপক্ষ মতামত রয়েছে। তবে এর মধ্যে সবচাইতে বড় মাপের অভিযোগ হলো চারুমজুমদার মাওসেতুঙ-এর কৃষি বিপ্লবের বতারে ব্যক্তি হত্যা, খুন ও সন্ত্রাসবাদের রাজনীতি চালু করেছেন। যার সঙ্গে মার্ক্সবাদ বা মাওবাদের আদতেই কোনো সম্পর্ক নেই। এই অভিযোগ যে শুধুমাত্র শত্র“ শ্রেণীর, তা নয়। এককালে আমাদের উপমহাদেশে যারা সরাসরি নকশাল রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন, এইসঙ্গে বড় মাপের নেতাও বটেও অভিযোগটা তাদেরও। এবং গত ৩৬-৩৭ বছর ধরে এই প্রচারণাটা বহমান।

অপরদিকে যারা নিজেদেরকে মাওবাদী হিসেবে দাবি করেন, তাদের বক্তব্য ভিন্ন। তারা মনে করে শ্রেণীশত্র“ খতমের লাইনটি মাওবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়। এটি কৃষক জনতার গণফৌজ গঠন ও ঘাটি এলাকা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রাথমিক শর্ত হিসেবে কাজ করে। এবং একই সঙ্গে সেটা বিপ্লব ও গেরিলা যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই যে, পরস্পর বিরোধী প্রচারণা এবং যুক্তি পাল্টা যুক্তি তার মধ্যে ব্যক্তি হত্যা, সন্ত্রাসের রাজনীতি নিয়ে তাদের বিপক্ষে বিস্তর লেখা হয়েছে। বিপরীতে মাওবাদীদের যুক্তিগুলোর সঙ্গে আমরা তেমনটি পরিচিত নই। ফলে তাদের যুক্তিগুলোর উপরে আমরা এবার নজর বুলিয়ে নিতে পারি।

প্রথমেই মাওসেতুঙ-এর একটা উদ্ধৃতি দিয়ে আলোচনাটা শুরু করা যেতে পারে। ১৯২৭ সালে হুনানের কৃষক আন্দোলোনের তদন্ত রিপোর্টে মাও বলেছেন, ‘এধরনের বাঘা একজন জমিদারকে হত্যা দিয়ে করলে সারা মহাকুমা জুড়ে সাড়া পড়ে যায় এবং সামন্তবাদের বাকি কুগ্রহগুলির উৎসাহদানে এই কাজটি অত্যন্ত সহায়ক হয়। প্রত্যেক মহাকুমাতেই এই ধরনের বড় বড় জুলুমবাজরা রয়েছে। কোথাও রয়েছে কয়েকজন, অন্যত্র রয়েছে কয়েক ডজন এবং এই প্রতিক্রিয়াশীলদের দমন করার সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা হচ্ছে, প্রত্যেক মহাকুমার সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধী যারা, তাদের অন্তত কয়েকজনকে খতম করা। যখন স্থানীয় জুলুমবাজরা ও বদমাইস মহাশয়রা তাদের ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত ছিলো, তখন চোখের পাতা একবারও না নাড়িয়ে, সত্যি না নাড়িয়ে কৃষকদের হত্যা করেছে। হো মাই চুয়ান দশ বছর ধরে চাংসা মহাকুমার সিংকাং শহরের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান ছিলো। লোকটা প্রায় এক হাজার কৃষককে হত্যার জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী; এই হত্যাকাণ্ডকে সে ঘুরিয়ে বলত ‘ডাকাত মারা’। আমরা নিজের মহাকুমা সিয়াংতানে ইন তিয়েন শহরে প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান ছিলো তাং চুং-ইয়েন এবং লো সু-লিন। ১৯১৩ সাল থেকে ১৪ বছর এই দুইজন পঞ্চাশজনেরও বেশি লোককে খুন করেছে এবং চারজনকে জীবন্ত পুঁতেছে। যে পঞ্চাশ জনেরও বেশি লোককে তারা খুন করেছে তাদের প্রথম দুইজন ছিলো একেবারেই নিরীহ, ভিখারী। তাং চুন-ইয়েন বলেছিল, দুইজন ভিখারি খতম করে শুরু করা যাক, তারপর ওই দুইটি জীবনকে নিবিয়ে দেওয়া হলো। আগেকার জামানায় স্থানীয় জুলুমবাজ ও বদ মহাশয়দের এই ধরনের নিষ্ঠুরতা বলবৎ ছিলো, গ্রামাঞ্চলে তারা সৃষ্টি করেছিল এই ধরনের স্বেত সন্ত্রাস। কিন্তু আজ কৃষকরা উঠে দাঁড়িয়েছে এবং এদের কয়েকজনকে গুলি করে মেরেছে এবং প্রতিবিপ্লবীদের দমনে সামান্য একটু সন্ত্রাসের সৃষ্টি করেছেন। অতএব, একাজ তাঁদের করা উচিত নয় বলার কি কোনো কারণ আছে? অনুবাদটি চারুমজুমদারের জীবদ্দশায় প্রচারিত তাদের মূখপত্র দেশব্রতী পত্রিকা থেকে নেওয়া। উপরের এই উদ্ধৃতিতে কিন্তু শ্রেণী শত্রু খতমের একটা ন্যায্যতা পাওয়া যাচ্ছে। ফলে ব্যক্তি হত্যা, খুন চারুমজুমদারের আবিষ্কার এটা বলা চলে না। আর এই দাবিটি ১৯৬৮ সাল থেকে ভারতের নকশালপন্থীরা করে আসছেন।

মূলত তরাইয়ের কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে যখন কৃষি বিপ্লবের লাইন গ্রহণ করা হয়, তখন ওই আন্দোলনের সংগঠকদের কাছে সংগ্রামের প্রায়োগীক রূপ কেমন হবে এটা ছিলো জরুরি প্রশ্ন। কারণ তাদের কাছে কৃষি বিপ্লব বলতে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল ও সমাজের গণতান্ত্রিক রুপান্তরের প্রশ্নটি ছিলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিষয়। আবার রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের সঙ্গে জনগণের গণফৌজ গঠনের যে সম্পৃক্ততা রয়েছে তা আমরা আগেই বলেছি।

আবার কৃষি প্রধান দেশ হিসেবে ভারতে যে ঔপনিবেশিক ক্ষমতা কাঠামো ও সম্পত্তি সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়েছিল এবং সেই ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রাখতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যে জমিদার, ভূস্বামী, জোতদার ও মহাজনী প্রথা রোপণ করেছিল, যা আজো গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো বির্নিমাণের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হিসেবে ওইসব দল মনে করে, তাকে যদি উপড়ে ফেলতে হয়, তাহলে ওই সংগ্রামের যাত্রা বিন্দুটা আসলে কেমন হবে, এটা ছিলো সেদিন তাদের কাছে মৌলিক প্রশ্ন। একই সঙ্গে আরো প্রশ্ন ছিলো দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলা এবং সেটা একনাগাড়ে চালিয়ে যাওয়া, সাম্রাজ্যবাদ ও তার দেশীয় অনুচরদের পরাস্ত করার বিষয়। গ্রামকে আঁকড়ে ধরে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার বিষয়। গ্রামগুলোকে সুসংহত ও ঘাটি এলাকায় পরিণত করা, ঘাটি এলাকাকে সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে দুর্গে পরিণত করা এবং সেই ভিত্তির উপরে দাড়িয়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পথ অনুসন্ধানের বিষয়। এসব ভাবনার উপরে দাঁড়িয়ে তারা হুনান আন্দোলনের একটি কোর অংশকে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিকভাবে গ্রহণ করে। মাওয়ের ভাষায়, ‘এই ধরনের একজন বাঘা জমিদারকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে হত্যা করলে সারা মহাকুমা জুড়ে সাড়া পড়ে যায়, অর্থাৎ গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে যারা গণধিকৃত ও স্থানীয় উৎপিড়ক এবং ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, তাদেরকে খতমের মধ্য দিয়ে সূচনা পর্বে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে তারা। ওই খতম অভিযানে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে যে আলোড়ন তৈরি হয়, কৃষকদের মধ্যে যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে, তাকে ভিত্তি করে পার্টি গঠন ও গণফৌজ গড়ে তোলার পথ তারা গ্রহণ করেন। এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা জরুরি চারুমজুমদারসহ যারা সেদিন এই পথ গ্রহণ করেছিলেন তারা সবাই দীর্ঘদিন থেকে কৃষকদের মধ্যে কাজ করেছেন। তেভাগা আন্দোলনসহ আরো অসংখ্য আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। ফলে তাদের কাজের অভিজ্ঞতা, কৃষি প্রধান দেশ চীনের অভিজ্ঞতা মিলিয়েই তারা হুনানের পথটি ধরেন। এবং সেটা ছিলো পার্টি গঠন ও গণফৌজ গড়ার সূচনা বিন্দু। তার পর পরই নকশাল বাড়িসহ ভারতের অপরাপর প্রদেশে প্রায়োগিকভাবে কৃষিবিপ্লবের যাত্রাপথ হিসেবে খতম অভিযান শুরু হয়। এবং সেটা স্ফুলিঙ্গ আকারে বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলংকার ছড়িয়ে পড়ে, তখনই শুরু হয় সমালোচনা এবং বলা হয় এই বিষয়টি চারুমজুমদার উদ্ভাবিত ব্যক্তিহত্যা ও সন্ত্রাসবাদের লাইন।

এই বিতর্কের সূত্র ধরে তারাও পাল্টা প্রশ্ন করেন, কোনো জোতদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে আক্রমণ না চালিয়ে, তাদের ক্ষমতা কাঠামোয় আঘাত না হেনে, তাদের উচ্ছেদ না করে, তাদের লুণ্ঠিত ধনসম্পদ বাজেয়াপ্ত না করে, তাদের উপরে জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা না করে বিপ্লবী ঘাটি অঞ্চল কি আদতেই দাঁড় করানো যাবে? এক্ষেত্রে তাদের আরো ভাষ্য ছিলো যে, কৃষি বিপ্লব প্রধানত শ্রেণী সংগ্রাম নির্ভর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সংগ্রাম। ফলে ‘প্রতিবেশীকে ভালবাস’ এই খ্রীস্টিয় নীতির উপরে দাঁড়িয়ে ‘ভূস্বামী ও কৃষকদের’ মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের তত্ত্ব হাজির করে আর যাই হোক কৃষি বিপ্লব সফল হবে না। তাদের মতে কৃষি বিপ্লব হলো রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রশ্ন, তার সমাধান হবে ধাপে ধাপে, বিপ্লব যেহেতু দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া, বিপ্লবী ক্ষমতা দখলের লড়াইটি এক বা একাধিক এলাকায় যেহেতু প্রথমে গড়ে তুলতে হবে, সংগ্রামের ধরনটা যেহেতু প্রাথমিক পর্যায়ে স্থানিক, পরে সারা দেশে তাকে ছড়িয়ে দিতে হবে, সুতরাং স্থানিক পর্যায়ে শ্রেণীশত্রু খতমের প্রসঙ্গটি গ্রামাঞ্চলে আধাসামন্ততান্ত্রিক কর্তৃত্ব চুর্ণ করা এবং কৃষকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার পরিপ্রেক্ষিতেই দেখতে হবে। এক্ষেত্রে শ্রেণীশত্রু খতমের লাইনকে কৃষি বিপ্লব থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং কৃষি বিপ্লবকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের লড়াই থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যাবে না। এবং এটাই রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সূচনা বিন্দু বলে তারা মনে করে। একই সঙ্গে প্রশ্ন রাখে একজন জমিদার, ভূস্বামী, জোতদার, সুদখোর ও মহাজন কি গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে শুধুমাত্র নিরিহ ও বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি? তারা কি গ্রামীণ ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ, দালাল পুঁজি ও রাষ্ট্রের পক্ষের নির্ধারক শক্তি নয়? যদি তারা নির্ধারক শক্তি হয়ে থাকে, তাহলে বেষ্ণবীয় কায়দায় এই শ্রেণী শাসকদের ‘শুদ্ধাচারী’ ব্রাক্সক্ষণের মত তুলে ধরার চেষ্টা কেন? রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি পৃথক ও ভিন্ন স্বত্বায় দাঁড় করানোর চেষ্টা কেন? তাদের মত অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলের ক্ষমতা সম্পর্ক থেকে, রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশ থেকে, ভূস্বামী-জোতদার-মহাজনদের বিচ্ছিন্ন করে দেখার অর্থ হলো সাম্রাজ্যবাদ ও আধাসামন্তবাদী শোষণ ও শাসনের কর্তৃত্বকে আড়াল করা। শাসকদের সঙ্গে শোষিত ও নিপীড়িত কৃষকদের সহাবস্থানের লাইনে দাঁড় করানো। যা শেষ নাগাদ শাসক শ্রেণীকে রণনৈতিকভাবে রক্ষা করার অবস্থান নেওয়ার লাইন হয়ে দাড়াঁয়। অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলের ক্ষমতা সম্পর্ক থেকে জোতদার-মহাজন, ভূস্বামী ইত্যাদিদের পৃথক করে দেখার অর্থ হলো সামন্তবাদী শাসক ও সাম্রাজ্যবাদের গ্রামীণ এজেন্টদের উচ্ছেদ না করা, তাদেরকে আক্রমণ না করা, ঔপনিবেশিক সম্পত্তি সম্পর্কের উপরে হাত না দেওয়া, মহাজনদের লাখ লাখ টাকার হ্যান্ড নোট পুড়িয়ে না দিয়ে তা রক্ষা করা ইত্যাদি। মূলত এটাই হলো ভারতের মাটিতে কৃষি বিপ্লবের সূচনায় শ্রেণীশত্র“ খতম ও তার মধ্য দিয়ে শ্রেণীযুদ্ধ গড়ে তোলা, গণফৌজ গড়ে তোলার লাইন। মাওয়ের দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধ যে ধারাবাহিকতাকে ভর করে গড়ে উঠেছিল তার সারসংকলন করেই এই পথ আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলো গ্রহণ করে সেদিন। এখন প্রশ্ন হলো চারুমজুমদারের গ্রহণকৃত এই লাইন আজকের দিনে কতটা প্রয়োগযোগ্য সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু যেভাবে মাওবাদের প্রায়োগীক অবস্থান থেকে চারু মজুমদারকে বিচ্ছিন্ন করে এবং গোটা রাজনীতিকে সন্ত্রাসবাদীর কাতারে দাঁড় করানো হয়, সেই দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই সমস্যাবহুল।

একই সঙ্গে এখানে আর একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি যে, নেপালে মাওবাদীদের যে উত্থান, গ্রামাঞ্চলে ক্ষমতা দখল, সম্পত্তি সম্পর্ক রূপান্তর, গণফৌজ গড়ে তুলতে পারার সক্ষমতা ইত্যাদি সমস্ত কিছুর যে রূপটা আজ আমরা দেখছি, তারাও আজ এই স্তরে আসতে পেরেছে সূচনাতে ওই শ্রেণীশত্রু খতমের পথ ধরে। ভারতের অসংখ্য প্রদেশে মাওবাদীদের আজ যে শক্তিশালী অবস্থান, এক অন্ধ প্রদেশেই তাদের যে ১৬ হাজার নিয়মিত গণফৌজের বাহিনী সেটাও এই লাইনের উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠছে। অর্থাৎ সূচনাতে শ্রেণীশত্রু খতমের মধ্য দিয়ে বাহিনী গড়ে তুলে তাকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের সক্ষমতা অর্জনের মধ্যে একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে বলে তারা মনে করেন। এবং গড়ে ওঠা গণফৌজ গেরিলাযুদ্ধ আয়ত্ব করতে পারলে, তখন শ্রেণীশত্রু খতম ছাড়াও থানা-ফাড়ি দখল বা পুলিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গণফৌজের বিকাশ ঘটানো সম্ভব হবে বলে এসব দল মনে করেন। আলোচিত এসব দলের কর্মকাণ্ডকে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত করার পাশাপাশি গণবিচ্ছিন্নতার দোষে দুষ্ট বলে প্রচার করা হয়। এই প্রশ্নে একটি কথা বলা জরুরি যে, আমাদের দেশের যে সব অঞ্চলে নকশালরা কৃষি বিপ্লবের সূত্রপাত করেছিল, ওই সব অঞ্চলে গত শতকের তিরিশের দশক থেকে কমিউনিস্টদের নেতৃত্ব কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে। চল্লিশের দশকে ওইসব অঞ্চলে বা খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে তেভাগার লড়াই, জমি দখলের লড়াইসহ নাচোলের ইতিহাস গড়ে উঠেছে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশক জুড়ে কমিউনিস্ট পার্টির গড়ে তোলা প্রতিটি রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গেই ওইসব অঞ্চলের জনগণ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থেকেছেন। ফলে প্রশ্ন দাঁড়ায় ষাটের দশকের শেষ লগ্নে এসে কমিউনিস্ট পার্টি যখন বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং আলোচিত অঞ্চলের জনগণ যখন নকশাল ধারার সঙ্গে যুক্ত হন, সেই জনগণ কিভাবে বুদ্ধিজীবীদের বয়ানে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন এবং পার্টি হয় গণবিচ্ছিন্ন এটা অবশ্যই প্রশ্নাকারে থাকে। মূলত তিরিশের দশক থেকে যেখানে পার্টি গড়ে উঠেছে, পার্টির নেতৃর্তে¡ জনগণ বিরত্বের সঙ্গে লড়েছে, সেই অঞ্চলে বাড়তি প্রস্তুতির আদৌ কি দরকার রয়েছে? এই পাল্টা প্রশ্নটি নকশালপন্থীদের দিক থেকে ছিলো।

লড়াইয়ের দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধের চরিত্র সম্পর্কে তাদের ব্যাখ্যা ছিলো এই দেশে শ্রমিক-কৃষক ও জনগণের মধ্যে অনৈক্যের দিকটা আজো প্রধান। সঠিক রণনৈতিক লাইনের উপরে ভিত্তি করে দেশে একটি মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী ও মাওবাদী অনুসারী পার্টি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রকট ব্যর্থতা, দেশে মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদের নামে তথাকথিত কমিউনিস্টদের জাতীয়তাবাদের লেজুড়বৃত্তি করা। সংশোধনবাদী ও নয়া সংশোধনবাদী পার্টি কর্তৃক জনগণকে প্রতিনিয়ত প্রতারিত করা, বিভ্রান্ত করা ও বিপথে চালিত করার মত শক্ত অবস্থান আজো বহাল থাকা, জনগণের মধ্যে হরেক পদের প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর্শের একটি শক্তিশালী প্রভাব জারি থাকা, এসব নানাবিধ কারণে নয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য।

এবার আমরা এতক্ষণ আলোচিত তথ্য ও তত্ত্বের সারসংক্ষেপ করে নিতে পারি কয়েকটি পয়েন্টে -

ক) আলোচিত দলগুলো আমাদের মত নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল, সামরিক হস্তক্ষেপ ও সামরিক বাহিনীর রাজনীতি ইত্যাদি প্রশ্ন মিলিয়ে মনে করে তাদের পক্ষে আদতেই বুর্জোয়া গণতন্ত্র, বুর্জোয়া শাসনতন্ত্র অথবা পার্লামেন্টারি প্রথা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

খ) তারা জাতি রাষ্ট্র বা জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গঠনের ঘোর বিরোধী। এবং মতাদর্শগতভাবে তাকে উগ্র সা¤প্রদায়িক শক্তি হিসেবে গণ্য করে।

গ) মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ ও মাওবাদের ভিত্তিতে একটি শ্রেণী ভিত্তিক কমিউনিস্ট পার্টি ও তার নেতৃত্বে গঠিত যুক্ত ফ্রন্টের রণনীতির মাধ্যমে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা কায়েম করা সম্ভব বলে তারা মনে করে।

ঘ) প্রচলিত রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী রূপকাঠামো ও প্রচলিত সম্পত্তি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রের সশস্ত্র অবস্থান ও অভিযানের একচ্ছত্র ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রতিক্রিয়া হিসেবে তারাও সশস্ত্র বিপ্লবের নীতিতে অটল।

ঙ) সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, আমলা-মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী সংগ্রামে সমস্ত গণশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে বুর্জোয়া শাসন-শোষণ ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার বিপরীতে সমাজতন্ত্রের অংশ হিসেবে নয়া গণতান্ত্রিক বা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলেন। মর্মবস্তু হিসেবে যাকে কৃষি বিপ্লব বলা যেতে পারে। এবং ওই আর্থ-ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত গণকমিউন প্রতিষ্ঠা, পিপলস আর্মি ও গণমিলিশিয়া গঠনের প্রশ্নটিকে নীতিগত বিষয় মনে করেন তারা। মূলত ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে এসব সিদ্ধান্ত আলোচিত দলগুলো গ্রহণ করে, একটি রণনীতির অধীনে। ফলে ১৯৫১ সালের পর থেকে এই ভূ-ভাগের কমিউনিস্টরা স্বায়ত্ত্বশাসন, শাসনতন্ত্র ও বুর্জোয়া পার্লামেন্টারি প্রথা প্রতিষ্ঠার যে লড়াইয়ে লড়ছিল, সেই লড়াইকে চীনাপন্থী হিসেবে আলোচিত এসব দল নীতিগতভাবে বর্জন করে। এবং এই নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে তারা ভাসানী ন্যাপ, কৃষক সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন ইত্যাদি থেকে পদত্যাগ করে। তাদের শত শত কর্মী বাহিনী গ্রামে যান। চেষ্টা করেন শ্রেণী ভিত্তিক পার্টি গড়ে তোলার। একই সঙ্গে মনোযোগী হন কৃষি বিপ্লব সম্পন্ন করার লক্ষ্যে সংগঠন, সংগ্রাম ও বাহিনী গঠনের। ফলে তাদের কাজ ও মতাদর্শগত তরিকা যেমন ভিন্ন, সাংগঠনিক কাজের পদ্ধতিও তেমনি ভিন্ন। যেমন তারা সূচনা থেকেই সশস্ত্র সংগ্রামের তত্ত্বে বিশ্বাসী। এবং তাদের সাংগঠনিক কাঠামো প্রধানভাবেই সামরিক কাঠামো। অর্থাৎ সামরিক সংগঠনই প্রধান সংগঠন। মতাদর্শগতভাবে, রাজনৈতিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে, সংগঠনগতভাবে প্রচলিত রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলের একদম বিপরীত তাদের কাজের ধারা। ফলে এদেশের রাজনীতির ইতিহাসে লুম্পেন বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক দল বা সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট পুঁজির মালিক আমলাপুঁজি ও মুৎসুদ্দি পুঁজির মালিকদের রাজনৈতিক দল, তাদের আশির্বাদপুষ্ট এবং স্বার্থরক্ষাকারী সংবাদপত্র, তাদের পোষ্য ও করুণা প্রার্থী বুদ্ধিজীবী সমাজসহ তাদের লেজুড়বৃত্তিকারী কমিউনিস্ট নামধারী ও ইসলামপন্থীদের কাছে-রাজনৈতিক এই ধারাটি উগ্রপন্থী, নিষিদ্ধ ঘোষিত, চরমপন্থী, ইসলাম বিরোধী, চাঁদাবাজ ইত্যাদি পরিভাষায় চিহ্নিত। যদিও প্রচার মাধ্যমে প্রথম এই প্রচারণা শুরু করেছিল দৈনিক ইত্তেফাক। পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পত্রিকা হিসেবে খ্যাত সংবাদ এবং একতা, জামাত পত্রিকা হিসেবে দৈনিক সংগ্রাম, এবং বর্তমানে প্রায় সমস্ত দৈনিকগুলি একই কাজ করে চলেছে। মোটামুটি এটাই হলো বাস্তবতা।

পরিশেষে চলমান আলোচনার পরিসমাপ্তী টানার আগে আরো তিনটি বিষয়ের প্রতি পাঠক হিসেবে আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করবো।

প্রথমত ৬০ দশকের বাস্তবতায় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগকে আলোচিত এই রাজনৈতিক ধারাটি কখনোই জাতীয় বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গণ্য করেনি। ১৯৫৬ সালে সোহরাওয়াদীর পার্লামেন্টে সিয়াটো-সিনটো চুক্তি পাশ, পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি অনুমোদনসহ ভারতের পাকিস্তান ভেঙে দুর্বল করে কাশ্মিরের উপরে একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার যে রাজনীতি, তার সহযোগী শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগকে গণ্য করেছে।

বিপরীতে মস্কোপন্থী হিসেবে পরিচিত রাজনৈতিক দল সিপিবি, মোজাফ্ফর ন্যাপ, মতিয়া গ্র“পসহ আরো কমিউনিস্ট পার্টি শেখ মুজিবকে জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক, ধর্ম নিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে গণ্য করেছে। ফলে ’৭১ -এর যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে আলোচিত বিশেষ ধারার পকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলো স্ব স্ব অবস্থান থেকে কেউ জাতীয় বিপ্লব প্রধান আর কেউ কেউ শ্রেণীসংগ্রাম প্রধান, এই লক্ষ্য নির্ধারণ করে আত্মনির্ভরশীলভাবে যুদ্ধ গড়ে তোলে। তারা তৎকালীন সময়ে কোথাও কোথাও মুক্তাঞ্চল, ঘাটি অঞ্চল গড়ে তুলেছিল। ১৯৭১ সালের সেপ্টম্বর পর্যন্ত আজকের বাংলাদেশের বৃহত্তর ভূখণ্ডে তারাই প্রধানভাবে পাকবাহিনী-রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে মুক্ত করে। সেপ্টম্বরের পরে এসে প্রথম মুক্তিবাহিনী ও পরে মুজিববাহিনী তাদের উপরে আক্রমণ করলে, তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে তাদেরকে দুই ফ্রন্টে লড়াই গড়ে তুলতে হয়। ১৯৭২ সালের পরে এসে লড়তে হয় রক্ষিবাহিনী এবং কোথাও কোথাও সরাসরি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে।

মোদ্দাকথা মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট ব্লক আওয়ামী লীগ ধারায় গড়ে ওঠা যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধ বা জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করলেও চীনাপন্থী হিসেবে তারা তা করেননি। তাদের হিসেবে, তাদের কাছে তাদের রাজনীতি ছিলো পরিষ্কার। যেমন মার্ক্সÑএঙ্গেলসের যুগে চেকদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে মার্ক্সÑএঙ্গেলস প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দিয়েছিলেন। কারণ চেকদের জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম তৎকালীন জারের রুশ সাম্রাজ্যবাদকেই নানানভাবে সাহায্য করেছিল। লেনিনের যুগে লেনিনের দাবি ছিলো, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে দুনিয়াজোড়া সামগ্রিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে দেখতে হবে। আর কোনো অংশ সমগ্রের বিরোধীতা করলে, তাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। কোনো দেশের জাতীয় আন্দোলন কোনো সাম্রাজ্যবাদী-শক্তির চক্রান্তের হাতিয়ার হলে তাকে অবশ্যই সমর্থন করা চলবে না। আর স্টালিনের মত ছিলোÑসর্বহারা শ্রেণীকে প্রত্যেকটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে সব সময় সমর্থন করতে হবে, একথা ঠিক নয়। তারা সেই সব জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে সমর্থন করবে, যা সাম্রাজ্যবাদকে শক্তিশালী করে না অথবা তাকে জিইয়ে রাখে না। বরং তাকে উচ্ছেদের জন্য লড়ে। যা বিশ্ববিপ্লবের অংশ হিসেবে এগিয়ে চলে। অর্থাৎ জাতীয় মুক্তি আন্দোলন যদি সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের অংশীদার হয়, তাহলে, মার্ক্স থেকে মাও পর্যন্ত সবাই তার বিরুদ্ধে নীতিগতভাবেই দাঁড়াতে বলেছেন। ফলে তারা ’৭১ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়েননি। আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গটি কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেই কেউ বা জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা আর কেউ নয়াগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠার জন্যই লড়েছিলেন।

দ্বিতীয়ত ’৭১ সালের যুদ্ধে ভারতের অংশ গ্রহণকে আওয়ামী লীগ ধারার মুক্তিযোদ্ধাপন্থীরা মিত্রবাহিনী হিসেবে গণ্য করলেও আলোচিত ধারার রাজনৈতিক দলগুলো তা মনে করে না। তারা ভারতকে সরাসরি আগ্রাসী ও স¤প্রসারণবাদী রাষ্ট্রের হিসেবে গণ্য করে। ফলে ’৭১ সালে ভারতের ভূমিকাকে তারা স¤প্রসারণবাদী আগ্রাসন হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। এর অন্যতম কারণ ছিলো তৎকালীন চীনের সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়ার মুক্তি সংগ্রাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড কমিউনিস্টদের উত্থান, ফ্রান্স ও আমেরিকাতে ছাত্র বিদ্রোহ এবং ভারতে নকশালবাড়ি সৃষ্টি পূর্ববঙ্গের মানুষকে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। ফলে এদেশে যাতে কোনো ধরনের বৈপ্লবিক সংগ্রাম গড়ে উঠতে না পারে এ ব্যাপারে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা জোট ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া দুই অক্ষশক্তিই ছিলো তৎপর। ১৯৬৯ সালে সি আই এর ফাঁস হয়ে যাওয়া দলিলে স্পষ্টতই প্রমাণ ছিলো পূর্ব পাকিস্তানকে তথাকথিত স্বাধীন করার পরিকল্পনা খোদ আমেরিকারই ছিলো। এবং ভারত ছিলো সেই পরিকল্পনার অংশীদার। সেখানে আওয়ামী লীগের ভূমিকা কি হবে সেটাও নির্দিষ্ট ছিলো। পরবর্তীতে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-ভাগের ওপরে রাশিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নামলে এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সংকটাবস্থার কারণে ভারত সোভিয়েত সাহায্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। এতে করে ’৭১ সালের যুদ্ধে আমাদের দেশে সোভিয়েত ইউনিয়ন হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পায়। এবং ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট বাংলাদেশের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ‘ইন্দো-সোভিয়েত ফ্রেন্ডশিপ ট্রি ট্রি, নামে এক সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই সময়ে ভারতের রাজনীতি বিষয়ক মন্ত্রী মহারাজ কৃষ্ণ রামগোও ওয়াশিংটন সফর কালে বলেছিলেন, চুক্তি মোতাবেক ভারত রাশিয়া থেকে অস্ত্রশস্ত্র পেলেও ভারত তার নিজের লড়াই লড়ছে। সে সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে লড়ছে না। এখন প্রশ্ন হলো ভারতের নিজের লড়াই বলতে প্রকৃত অর্থে তার মর্মবস্তু কি ছিলো? এর জবাব পাওয়া খোঁজার আগে আমরা ইন্দিরাগান্ধীর ভাষ্যটাও দেখে নিতে পারি। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে চারটায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তান অংশ, ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করার পর, ওই একই দিন বিকাল সাড়ে পাঁচটায় ইন্দিরাগান্ধী লোকসভায় ঘোষণা করেন, আমরা আমাদের পদাতিক বাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর দক্ষতা ও ক্ষমতা দেখে গর্বিত। ...ভারতীয় বাহিনী প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটু সময়ও বাংলাদেশে থাকবে না। ২রা জানুয়ারি ১৯৭২ সালে আবার বলেন, ভারত বিশাল দেশ। এই দেশ তার সম্পদ ও ক্ষমতা দিয়ে অনেক কিছু করতে পারে যা পৃথিবীর অনেক দেশ ভাবতেও পারবে না।...আমরা কারো কাছ থেকে কোনো সাহায্য না নিয়েই বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় সব কিছু সরবারহ করতে পারি। এবং ৮ই জানুয়ারি লক্ষেèৗর জনসভায় ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ১৯৪৭ সালে দেশভাগ করে যে ভূল করা হয়েছিল তা শুধরে নেওয়া হলো। মূলত এটাই ছিলো ’৭১ সালে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের অন্যতম কারণ। ঠিক একারণেই আলোচিত দলগুলোর মধ্যে কেউ কেউ ১৯৫৬ সালে সোহরাওয়ার্দী-মুজিবের পাকিস্তানী পন্থী হয়ে পূর্ববাংলাকে পূর্বপাকিস্তান ঘোষণা যেমন মেনে নেয়নি, তেমনি ইন্দিরাপন্থী আওয়ামী লীগের ’৪৭ এর সীমানা বিভাজন অস্বীকার করে ভারতের উপনিবেশকরণের বাংলাদেশকেও স্বীকার করে না। দেশের নাম তার পূর্ববাংলা হিসেবে গণ্য করে। বাংলাদেশকে তারা নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করে। অর্থাৎ ভৌগোলিকভাবে দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জাতিসংঘ স্বীকৃত দেশ হলেও রাষ্ট্র হিসেবে সে নয়া উপনিবেশিক চরিত্রসম্পন্ন। পাশাপাশি ’৭১ সালে ভারতের আরো একটি নিজস্ব লড়াই ছিলো, তাহলো পার্বত্য চট্রগ্রামের উপরে এক ধরনের দখলদারিত্ব কায়েম করা। যাতে করে ভারতের সেভেন সিস্টারে চলমান মুক্তিসংগ্রামকে শক্ত হাতে দমন করা যায়। সেই প্রচেষ্টা ভারতের আজো রয়েছে। যার সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি সম্পর্কিত। আর এটাই ছিলো ভারতের নিজস্ব লড়াই। তাছাড়া’ ৭১ পরবর্তী আওয়ামী শাসনামলে দেশের পরিস্থিতি এমন ছিলো যে, দিল্লির অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক বা অপর কোনো দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করা সম্ভব ছিলো না।

আর নবগঠিত বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ যে শাসনতন্ত্র রচনা করে সেখানে জনগণের যে সব মৌলিক অধিকারের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই শাসনতন্ত্রেই আবার তা কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা ছিলো। যেমন ৩৫, ৩৬, ৩৭ ও ৩৮ ধারা অনুযায়ী সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চলাফেরা ও সমাবেশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা ছিলো। রাষ্ট্র পরিচালিত সমস্ত প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট বে-আইনী ঘোষণা করা হয়। রাষ্ট্র প্রধান কর্তৃক জারীকৃত ৯১ নম্বর অডিন্যান্স অনুসারে যে কোনো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে যতদিন ইচ্ছা জেলে ভরে রাখার আইন করা হয়। শাসনতন্ত্র ৩৯ ধারায় বলা হয়, বন্ধু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো কিছু বলার অধিকার কোনো ব্যক্তি বা সংবাদপত্রের নেই। এবং শাসনতন্ত্রের ৬৩ (৩) ধারায় সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রশ্নটিকে সামনে এনে বলা হয়েছিল, এ ধরনের পরিস্থিতি শাসনতন্ত্রে অধিকার সংক্রান্ত যে সমস্ত বিধান দেওয়া হয়েছে তার সব কিছুই বাতিল বলে গণ্য হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার ওই সময়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদী একটা তথাকথিত শান্তিচুক্তির নামে গোপন সামরিক চুক্তি হয়েছিল। ওই চুক্তির ৮, ৯ ও ১০ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে যে কোনোরূপ অশান্তিজনিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে এগিয়ে আসবে ভারতীয় সেনাবাহিনী। অর্থাৎ ’৭১ -এর পটভূমিতে ভারত-সোভিয়েতের মধ্যে যে ধরনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তারই অনুরূপ চুক্তি ছিলো এটি। এই অন্যতম কারণে ‘বন্ধুরাষ্ট্রের’ সমালোচনা শাসনতান্ত্রিকভাবে নিষিদ্ধ ছিলো। শাসনতন্ত্রে ঘোষিত সমস্ত মানবাধিকার কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছিল। এবং তৎকালীন সেনাবাহিনীর একজন খ্যাতিমান অফিসার লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিন প্রকাশ্যে অভিযোগ তোলেন ‘গোপন চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।’ একই ধরনের অভিযোগ ছিলো কর্নেল তাহেরের। এর পাশাপাশি ভারতীয় জেনারেলদের তত্ত্বাবধানে রক্ষিবাহিনী গঠন; ভারতীয় চোরাকারবারী, ব্যবসায়ী ও সেনাবাহিনীর অবাধ লুটপাট ইত্যাদি বিষয় তো ছিলোই। এসব নানাবিধ কারণে ’৭১ পরবর্তী বাংলাদেশকে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি সরাসরি ভারতের উপনিবেশ হিসেবে দাবি করেছিল। ১৬ই ডিসেম্বরকে তারা কালো দিবস ঘোষণা করে ঢাকায় হরতাল ডেকেছে। সেটা পালনও হয়েছে। ইস্ট পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ও পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশকে সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদের একটি উপনিবেশ এবং সোভিয়েত শাসকচক্রের পক্ষে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী শাসকচক্রকে তার তদারককারি শক্তি হিসেবে গণ্য করে। সেদিন ভারতের চারুমজুমদারপন্থী নকশাল গ্রুপেরও একই মূল্যায়ন ছিলো। ফলে রাজনৈতিক ধারা হিসেবে আলোচিত এসব দল বাংলাদেশ আমলের শুরু থেকেই রুশ-ভারতের আগ্রাসন মোকাবেলায় তাদের সশস্ত্র সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। একইভাবে একটি সময় উপরে উল্লিখিত সেনা অফিসার লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিন সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে যোগ দেন। কর্নেল তাহের সেনাবিদ্রোহ ঘটান। তাদের কাছেও প্রশ্ন ছিলো দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা। আমরা মেজর জলিলকেও সরাসরি ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দেখেছি। আর হাজার হাজার নকশালপন্থীদের জীবন দানের একটা পর্বতো ছিলোই। আলোচনার এই পর্বে হায়দাবাদ, সিকিম, ভূটান নেপালসহ সেভেন সিস্টারের প্রসঙ্গ ইচ্ছে করেই আনা হলো না। তবে বর্তমানের বাস্তবতায় এসব দলের কাছে ভারত একটি আধিপত্যবাদী, আগ্রাসী ও স¤প্রসারণবাদী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ভারত একটি বড় ধরনের বাধা হিসেবে তারা গণ্য করে। ফলে জাতীয় দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে তারা সকল সাম্রাজ্যবাদ এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে শত্রু হিসেবে গণ্য করে।

তৃতীয়ত চীনাপন্থী দল হিসেবে আলোচিত দলগুলোর মধ্যে ইস্ট পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম, এল) ১৯৭৮ সালে দলের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি রাখে। ৮০ দশকে এসে তাদের রাজনীতিও বদলে যায়। একদিকে মাওসেতুঙয়ের চিন্তাধারাকে বিশেষত ‘ত্রি বিশ্ব’ তত্ত্বকে তারা নয়া সংশোধনবাদী তত্ত্ব হিসেবে দেখে। ফলে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও- এর রাজনীতি থেকে তারা নিজেদের উড্রো করে নিয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধের বিপরীতে লেনিনের গণঅভ্যুত্থানের লাইন গ্রহণ করেছে। আবার ভারতকে তারা বর্তমানে আর সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্র মনে করে না। এর অন্যতম কারণ হিসেবে তাদের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো একটা নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্র সম্প্রসারণবাদী হতে পারে কিনা? তারা রণনীতিগতভাবে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলেন।

কেন এসব দলের কর্মীরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হলো

আমাদের জন্য এসব প্রশ্নের সহজ জবাব পাওয়া বা তৈরি করা বেশ খানিকটা মুস্কিলের বিষয়। তবে আলোচিত দলগুলো ’৭১ পরবর্তী বাংলাদেশকে যেহেতু একটি নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করে থাকে; ফলে তাদের বিশ্লেষণ ও সা¤প্রতিক সময়ের বিশ্বপরিস্থিতির উপরে ভিত্তি করে কিছু কথা বলা যায়।

প্রথমত আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলো মনে করে বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামো দিয়ে এদেশের ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবহির্ভূত লুটেরা বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক দল, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, বিভিন্ন দাতাসংস্থা, সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠিগুলো সবাই মিলিতভাবে তাদের স্বার্থ হাসিল করে চলছে। ’৭১ পরবর্তী বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে রেখেছে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী, কর্পোরেট হাউজ, তথাকথিত দাতা সংস্থা ও ভারতীয় স¤প্রসারণবাদের এজেন্টরা। এবং তারা বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নামের দুই ধারায় বিভক্ত, স্থানীয় এই ক্ষমতাসীনরা সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় স¤প্রসারণবাদ ও কর্পোরেট হাউজগুলোর নির্দেশেই ওঠাবসা করে থাকে। রাজনৈতিকভাবে তাদের কোনো স্বাধীন স্বত্বা নেই। একইভাবে তাদের করা নানাবিধ চুক্তির কারণে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সার্বভৌমত্ব নেই।

দ্বিতীয়ত এদেশের ক্ষমতাসীনরা রাষ্ট্র ক্ষমতা ব্যবহার করে শ্রেণীগতভাবে একচেটিয়া সম্পদ লুট এবং ওই সম্পদ বংশপরাম্পর ভোগের যে ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে রেখেছে। সেই ব্যবস্থা রক্ষা করার তাগিদেই তারা সাম্রাজ্যবাদী জোট ও ভারতীয় স¤প্রসারণবাদী রাষ্ট্রের শাসকদেরকে শ্রেণীগতভাবে মিত্র শক্তি মনে করে থাকে। সংসদীয় গণতন্ত্র ও ভোটের রাজনীতি হলো তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি। শাসকরা এদেশের জনগণকে কখনোই বা কোনো কালেই তাদের মিত্র বলে গন্য করে নি।

তৃতীয়ত বর্তমানের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব জোট এবং আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ পৃথিবীর যে কোনো দেশের রাজনীতিতে গণশক্তির উত্থানকে সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। মাওবাদী বা রেডিক্যাল ধারার কমিউনিস্ট আন্দোলনকে তাদের গড়ে তোলা রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে বিপদজ্জনক শক্তি হিসেবে গণ্য করে। এসব নানাবিধ কারণ আমাদের দেশে প্রায়োগীক রাজনীতির ক্ষেত্রে সশস্ত্র গণশক্তি হিসেবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ বিরোধী শক্তিকে নির্মূল করার অংশ হিসেবে তাদেরকে টার্গেট করে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করা হয়েছে বলে তারা মনে করে। খুব সংক্ষিপ্ত আকারে বললে ক্রসফায়ার সম্পর্কে এটাই হলো তাদের মূল্যায়ন। তবে এর সঙ্গে সম্পর্কিত আরো কিছু বিষয় রয়েছে। যেমন আমাদের কাছে মনে হয়েছে বিগত বিএনপি জোট সরকার ২০০৩ সাল থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন রাষ্ট্রের সঙ্গে যেসব চুক্তি করেছে এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রশ্নটিকে মার্কিন নীতির কাছে যেভাবে হস্তান্তর করেছে, দেশের চলমান ক্রসফায়ারের সঙ্গে তার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। সেদিকেও একটু দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

২০০৩ সালের মার্চ মাসে প্রাক্তন সিআইএ কর্মকর্তা এবং তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি পররাষ্ট্র সচিব ক্রিস্টিন রোকা বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন এটা আমরা সবাই জানি। ওই সময় বাংলাদেশ ও আমেরিকার মধ্যে ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি’ উন্নয়ন নামে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ওই চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ বিএনপি সরকার জনগণকে জানায়নি। পত্রিকার সূত্র থেকে যতটা জানা যায়, তাহলো এই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে আমেরিকা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবে। একই সঙ্গে ওই প্রকল্পের জন্য যে কোনো ধরনের সরঞ্জাম এবং বিশেষজ্ঞরা বিনা বাধায় ও প্রচলিত রাষ্ট্রের নিয়মকানুনের ধারের কাছে না গিয়েও বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ওই চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী মঈন খান। সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেছিলেন ওই চুক্তি সামরিক কাজে ব্যবহার হবে কিনা। উত্তরে তিনি বলেছিলেন ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ প্রয়োজনে তা করা হবে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে ওই চুক্তি স্বাক্ষর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই প্রয়োজন ছিলো। ওই একই বছরের আগস্ট মাসে ওয়াশিংটনে ঢাকা মার্কিন নামে আর একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তৎকালীন জোট সরকার এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এদেশের পররাষ্ট্র সচিব আমেরিকায় গিয়ে ওই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ওই চুক্তির খবর দীর্ঘদিন গোপন রাখা হয়েছিল। পরে চাপের মুখে সংক্ষিপ্তাকারে পত্রিকায় যা প্রকাশ করে সেটাও অপর্যাপ্ত। বিশেজ্ঞদের মতে ওই চুক্তি অনুযায়ী আমেরিকান একজন সেনা সদস্য, কর্মরত সরকারি কর্মচারী অথবা আমেরিকার কোনো ঠিকাদারী সংস্থার কোনো কর্মী যদি বাংলাদেশের মাটিতে গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, যুদ্ধাপরাধ বা অন্যকোনো অপরাধ করে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার তার কোনো বিচার করতে পারবে না। বাংলাদেশের মাটিতে তাদের বিচার করা যাবে না। অথবা তাদের বিচার চেয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিমিলান কোর্টে আবেদন করা যাবে না। আবার আমেরিকান সেনা সদস্যরা যদি অন্য কোনো দেশে অপরাধ করে [গণহত্যা], বা অপরাধ করার কারণে উক্ত দেশে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে, তাহলে, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না। অর্থাৎ আমেরিকান সৈন্যরা শুধু বাংলাদেশে গণহত্যা করেই ছাড়া পাচ্ছে না, অন্যদেশে গণহত্যা সংঘটিত করে বাংলাদেশকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। ওইসব চুক্তির পাশাপাশি বিএনপিÑজামাত জোট সরকার আমেরিকার সঙ্গে আর একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ২০০৪ সালের ১৯শে মে ক্রিস্টানা রোকা আবারো বাংলাদেশে আসেন। ওই সময়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তির নাম ‘ পারসোনাল আইডেন্টিফিকেশন সিকিউর কমপারিজন এন্ড ইভালুয়েশন সিস্টেম’ সংক্ষেপে পিসেস নামে পরিচিত। জোট সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল চুক্তিটা হচ্ছে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে সহায়তা ও উন্নয়ন বিষয়ক। কিন্তু ওই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার [আমাদের] দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ স্বার্থ বিরোধী কোনো কাজে নিয়োজিত বলে সন্দেহভাজন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করার সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে বলে অঙ্গিকার করেছে। একই সঙ্গে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষায় সবরকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পূর্বের চুক্তির মত এই চুক্তির সমস্ত কাগজপত্র তৈরি করেছে আমেরিকান পক্ষ এবং বাংলাদেশ সরকার তাতেই স্বাক্ষর করেছে। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়ে যে, ২০০৪ সালের ১৯ শে মে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করার পরপরই জোট সরকারের পক্ষ থেকে ২১ শে জুন, ২০০৪ সালে র‌্যাবের হাতে ক্রসফায়ারে প্রথম নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। ১৮ই অক্টোবর ২০০৪ সালে ৬৪ টি জেলায় তারা একযোগে অপারেশনে নামে। আমাদের দেশের অনেক সমাজ গবেষক মনে করেন আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেসব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছে। তার সঙ্গে র‌্যাব গঠন ও ক্রসফায়ার পরস্পর সম্পর্ক যুক্ত। ওইসব চুক্তির শর্ত ধরে রাষ্ট্রীয়ভাবে গণতহ্যা চলানো হয়েছে। এমনকি র‌্যাব গঠন করা হয়েছেও এফ বি আই- এর আদলে। তাছাড়া তারা আরো মনে করেন শত শত সমালোচনা থাকার পর অথবা সংগঠনগত দুর্বলতা থাকার পরেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজো সরাসরি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ বিরোধী একমাত্র সশস্ত্র রাজনৈতিক শক্তিই হলো আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলো। এর অন্যতম কারণে বিএনপি ও জামাত সরকারকে শর্ত মোতাবেক ওই রাজনৈতিক শক্তিকে নির্মূলের পথ গ্রহণ করতে হয়। পাশাপাশি আমরা সবাই কমবেশি জানি যে, দক্ষিণ-এশীয় অঞ্চলে ইতিমধ্যে মার্কিন-ভারত ও ইসরাইল মিলিতভাবে একটি অক্ষশক্তি গড়ে তুলেছে। এবং এই জোটের বাংলাদেশের রাজনীতিতে নজরদারী ও খবরদারী রয়েছে। ১৭ই মার্চ ২০০৫ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব কন্ডোলিজা রাইস দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পর ঘোষনা দেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে যে বিশেষ পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেটাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দিক থেকে যৌথভাবে তদারকি করা হবে। আমাদের স্মরণ রাখা দরকার যে, এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন যাবৎ ভারত যে সম্প্রসারণবাদী ও অধিপত্যবাদী তৎপরতা চালিয়ে আসছিল, তার সঙ্গে ছিলো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা, ওই ঘোষণার মধ্য দিয়ে তারই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এবং ভারত-বাংলাদেশ ও নেপালে সশস্ত্রশক্তি হিসেবে একমাত্র মাওবাদীরাই সেই শক্তি যারা জন্মলগ্ন থেকে এযাবৎ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের রাজনৈতিক বিরোধীতা করে আসছে। সেই রাজনৈতিক শক্তিকে নির্মূল করতে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্রসফায়ার চালু করেছে বলেই সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করেন।

তাদের আরো মতামত হলো বিএনপি-জামাত জোট সরকার ছিলো একটি নির্বাচিত সরকার। ফলে তাদের করা এসব চুক্তি পরবর্তী সরকারগুলো মানতে বাধ্য। ফলে ফকরুদ্দিনের সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে বিষয়টি আদতেই তা নয়। বরং বিএনপি-জামাত জোট সরকার নানা ধরনের গোপন ও দ্বিপাক্ষিক সামরিক-বেসামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের হাতে তুলে দিয়েছে। ফকরুদ্দিনের আমলে তারই সম্প্রসারিত রূপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। মোটামুটিভাবে এই ভাবনার উপরে দাঁড়িয়ে অনেকে মনে করে থাকেন আলোচিত ক্রসফায়রের মাধ্যমে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আলোচিত দলগুলোর নেতা-কর্মীদের হত্যা করার অন্যতম কারণ হিসেবে উপরে উল্লেখিত পটভূমির যোগসূত্রতা রয়েছে।

কাজের মতাদর্শ ও পদ্ধতি সম্পর্কে

আলোচিত প্রসঙ্গ ধরে কাজ করতে গিয়ে কোন কোন বিষয়ের উপরে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, এবার সেই প্রশ্নে কিছু আলাপচারিতা সেরে নেওয়া যেতে পারে।

তবে প্রথমেই একটি কথা বলা জরুরি, আমরা যারা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত তারা কেউই ক্রসফায়ারের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টিকে শুধুমাত্র মানবিধার লঙ্ঘনের প্রেক্ষিত থেকে দেখি না। আবার রাজনৈতিক মত ও পথকে ফৌজদারী মামলার বিষয়ও মনে করি না। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ হিসেবে গণ্য করি না। যারা বিষয়বস্তুকে এভাবে দেখেন ও মত প্রকাশ করেন আমরা ওই দৃষ্টিভঙ্গির ঘোর বিরোধী। ঠিক একারণেই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর কার্যক্রমকে নিছক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আখ্যা দেওয়া, ফৌজদারী মামলার বিষয় মনে করা ও তাদেরকে নিকেশ করতে ক্রসফায়ারের পথ বেছে নেওয়ায় আমরা ঘোর বিরোধী। রাষ্ট্রের এধরনের পদক্ষেপ দেশের ক্ষমতাবানদের সাময়িক সস্তির মধ্যে রাখলেও চূড়ান্ত অর্থে দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে অনেকে মনে করেন। ফলে এসব প্রশ্নে আরো খোলামেলা কথাবার্তা হওয়া জরুরি বলেই আমাদের মনে হয়েছে।

পাশাপাশি আমাদেরকে আরো স্মরণে রাখা দরকার যে মুহূর্তে বাংলাদেশে ক্রসফায়ারের ঘটনা সংগঠিত হচ্ছে, ঠিক তখনই রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নিজেই একটা ক্রান্তীকাল অতিক্রম করছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকা না থাকার একটা প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছে। এবং নাগরিক হিসেবে আমরা কমবেশি একটা ডিলেমার মধ্যে রয়েছি। এসব কিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।

মূলত আমাদের দেশে মূলধারার রাজনীতি বলতে যেসব ক্ষমতাসীন দল রয়েছে এবং তাদের ভোটের রাজনীতি ও সংসদীয় সরকার, রাজনীতির এই ধারাটি আজ জনগণের মোটা ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করাসহ একটি গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়েছে। এদেশের সমস্ত বিবেকবান মানুষ গত ৩৬ বছরে বাংলাদেশে নানা পদের শাসন কায়েম ও বিদেশীদের সঙ্গে করা চুক্তিসমূহ বিশ্লেষণ করে এক বাক্যে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হবেন। যে সব সংস্থা ও পশ্চিমা আগ্রাসী রাষ্ট্রের মত ও পথ অনুসরন করতে গিয়ে আমাদের মূল ধারার ক্ষমতাসীন দলগুলোর আজ এই বেহাল দশা, ওইসব শক্তি কিন্তু এখনো থেমে নেই। তাদের নির্দেশেই আলোচিত ক্ষমতাসীন দলগুলোর মূল দুই নেত্রীকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে তারা বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের পর্যায়ভুক্ত করার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে তারা এখন সুশাসন ও আইনের শাসন তরিকা নিয়ে তৎপর। অর্থাৎ আমাদের দেশে ’৭১ পরবর্তী সময়কালে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ হয়েছে, এবং ওই শ্রেণীর মধ্যে যে অংশটি নিজেদেরকে সুশিল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করে, যারা আবার সরাসরি সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট হাউজ ও সংস্থায় ম্যানেজেরিয়াল ক্লাশ হিসেবে চাকরিরত অথবা কর্পোরেট হাউজের অর্থায়নে দেশীয় সংস্থা হিসেবে পুষ্ট, দাতাসংস্থা ও পশ্চিমা আগ্রাসী রাষ্ট্রগুলো এই ম্যানেজেরিয়াল ক্লাশের শাসন কায়েমে তৎপর। যাকে বলা হচ্ছে সুশিল সরকার বা আইনী সমাজ গঠনের তৎপরতা। তবে তাদের এই তৎপরতা যে হঠাৎ করে শুরু হয়েছে এটা ভাববার কোনো কারণ নেই। ’৭১ পরবর্তী বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন দাতাসংস্থাসহ এনজিও নামক প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের পরামর্শ দাতা ও রাষ্ট্র পরিচালনা ক্ষেত্রে সমান অংশিদার। একই সঙ্গে আমাদের দেশের মূল ধারার ক্ষমতাসীন দলগুলো তারা তাদেরই শাসনামলে তাদের যুব সংগঠন ও ছাত্র সংগঠনগুলোকে চাঁদাবাজী,ঠিকাদারী ও হাট-বাজারের ইজারাদারী সংস্থায় পরিণত করেছে। অসংখ্যবার ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জোর চেষ্টা চালিয়ে এসেছে। দেশের শ্রমিক সংগঠন-কৃষক সংগঠন-নারী সংগঠন-সাংস্কৃতিক সংগঠনকে পরিকল্পিত উপায়ে ও রাজনৈতিকভাবে ডিমোরালাইজ করেছে। এইযে গোটা রাষ্ট্রব্যাপী ক্ষমতাসীন দলগুলোর নি-রাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া এবং নানান পদের চুক্তি মারফৎ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বিদেশীদের হাতে তুলে দেওয়া, তারই চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে বাংলাদেশ বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট হাউজগুলোর ম্যানেজেরিয়াল ক্লাশের অধিনস্ত হতে চলেছে। আসছে সংসদ নির্বাচনেই এই প্রক্রিয়াটি শুরু হতে যাচ্ছে। আর প্রকৃত অর্থে যদি সেটা ঘটে, তাহলে আমাদের স্মরণে রাখা দরকার যে আমাদের মত দেশগুলোতে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার মধ্যে যে উপনিবেশিক জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়েছিল ও তার বিকাশ ঘটেছিল, যে জাতীয়তাবাদী শক্তির একটি বিশেষ ধারা বরাবরই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে থেকেছে; রাজনীতির এই ধারাটি অচিরেই পতন ঘটতে যাচ্ছে। বিপরীতে কর্পোরেট হাউজগুলোর ম্যানেজেরিয়াল ক্লাশের শাসন কায়েম হতে চলেছে। অনেক বুদ্ধিজীবী একেই বলছেন নিঃরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া। এবং আমরা ধরে নিতে পারি যেহেতু রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব বিদেশীদের হাতে আমাদের ক্ষমতাসীন দলগুলো তুলে দিয়েছে। ফলে সাম্রাজ্যবাদী জোটগুলো যদি চায়, তাহলে অচিরেই বাংলাদেশে সেই শাসন কায়েম হবে। আসছে দিনে আমাদের দেশে এটাই হবে রাজনীতির মূল ধারা। আমাদের পত্র-প্রত্রিকাগুলো তারই সাওয়াল-জবাব করছে। এখন আমাদের মত নাগরিকের জন্য ডিলেমাটা হলো এই-আমরা কোন ধারাকে স্বাচ্ছা ধরবো? এবং তার স্বপক্ষে পল্টি খাব? আর এভাবে একই বৃত্তে ঘুরে ফিরে বারংবার পল্টি খাওয়ার মধ্যে আমাদের ভবিষ্যত ও দেশের ভবিষ্যত কতটা উজ্জ্বল সেটা প্রশ্ন আকারেই থাকে।

বিপরীতে আমাদের দেশের শাসককুলের বাইরে যেসব রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে; যারা বিকল্প সম্ভাবনার কথা হাজির করেন, তাদের সম্পর্কে সমাজের মধ্যবিত্ত হিসেবে আমাদের মনোভঙ্গিও সমস্যজনক। আমরা শাসককুলের দলবাজীর বাইরে অপরাপর সমস্ত ধারার রাজনীতির ঘোর বিরোধী। এই অন্যতম কারণে এদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর কার্যক্রমকে আমরা নির্মাণ করেছি ব্যক্তি সন্ত্রাস, হত্যা, খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজী ও চরমপন্থীর আলোকে সেই ষাটের দশক থেকে। যদিও এই নির্মাণের প্রধান কৃতিত্ব ছিলো সংবাদপত্রের এবং মধ্যবিত্ত হিসেবে আমরা তারই সহযাত্রী। ফলে আমাদের ভাবমানসে ওই নির্মাণটি আজো আধিপত্য আকারে রয়েছে। এই যে আমাদের মনোজাগতিক কাঠামো সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। সেটি হলো ব্যক্তি সম্পর্কে আমাদের অবনমিত দৃষ্টিভঙ্গি। যা একটি বিশেষ ধারার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদেরকে ভয়ঙ্কররূপে উপস্থিত করে। এটা আর কিছু নয়, উপনিবেশিক ভাবমানসের ফলাফল। একারণে আমরা ক্ষমতাবান হিসেবে আলোচিত দলগুলোর কাছ থেকে কিছুই আশা করি না। রাষ্ট্র এবং আমরা তাদেরকে মানুষ হিসেবেও গণ্য করি না। আর রাজনৈতিক দল হিসেবে তারাও সমাজের ক্ষমতাবান ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে আশা-ভরসা-সহমর্মিতা-সমঝোতা ও সাহায্য পাওয়ার কল্পনা করে না। ফলে আমরা আমাদের প্রচলিত সমাজ বিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুযায়ী তাদেরকে বেকার যুবক, নৈরাজ্যবাদী ও হতাশাগ্রস্ত মানুষের তালিকায় ফেলি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই প্রক্রিয়াটি আমাদেরকে ফৌজদারী মামলার দিকে ধাবিত করে। তাদেরকে নিকেশ করতে উৎসাহীত করে। আর এভাবে যদি আমরা তাদের থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে পারি, তাহলে সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তির প্রতি আমাদের অবমূল্যায়নের কাজটি সহজ হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে যাদের আমরা নষ্ট মানুষ ও নষ্ট জীবন বলছি, তাদের সঙ্গে আমরা যদি কোনোরূপ সম্পর্কই অনুভব না করি, তাহলে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য আমরা কারা? তাছাড়া, ওদের থেকে আমরা আলাদা এই কথাটি নীতিগতভাবে মেনে নেওয়ার অর্থই হলো মানবজীবনের প্রাকৃতিক চক্রে কিভাবে সমাজ যুক্ত, সমাজের বিকাশ যুক্ত, সমাজের প্রতিটি মানুষ কিভাবে সেই ধারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেই বিষয়টিতে আমাদের স্পষ্ট কোনো ধারণা না থাকা।

এই প্রশ্নটিতে আমাদের বিবেচনায় থাকা দরকার একজন সাধারণ মানুষ ও রাজনীতিবীদদের মধ্যে মৌলিকভাবেই একটা পৃথক অবস্থান রয়েছে। রাজনীতিতে একজন মানুষ অঙ্গিকারবদ্ধ না হলে, সেই মানুষটি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোতে দোদুল্যমান থাকে। তার পিছিয়ে যাওয়ার অবকাশ। থাকে সার্বক্ষণিক নিষ্ক্রিয়তা। অথচ আধুনিক সমাজ বলতে রাজনৈতিক সমাজই বোঝায়। বংশ ও গোত্রের বাইরে রাজনীতিই প্রধানভাবে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। রাজনৈতিক সমাজ কাঠামোতে ব্যক্তিসত্ত্বা আবার মৌল। ফলে ব্যক্তির নিষ্ক্রিয়তা ও দোদুল্যমানতা সমাজকে ফ্যাসিবাদী মানসিকতার দিকেই ঠেলে দেয়। ফলে যে মুহুূর্ত্বে একজন মানুষ রাজনীতিতে অঙ্গিকারবদ্ধ হন, তখন থেকে তিনি হয়ে ওঠেন অনাবদ্ধ ব্যক্তি। এই অন্যতম কারণ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই ক্ষমতাসীন দলগুলো বরাবরই চেষ্টা চালিয়ে এসেছে সমাজ যাতে রাজনৈতিক সমাজ না হয়ে উঠতে পারে। আর এ ধরনের সমাজনীতির কারণে মানুষ হিসেবে আমরা অধিকাংশই বেড়ে উঠেছি জড়বুদ্ধি ও দুর্বদ্ধিতে সংক্রমিত হয়ে। একই সঙ্গে প্রশ্নহীন অভ্যাসের মধ্য দিয়ে। কিন্তু আমাদের স্মরণে রাখা দরকার ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতার স্পৃহা প্রধানত জৈব। যদি একটি দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেষ্টনী প্রতিকূল হয়, তাহলে ধীরে ধীরে ওই স্পৃহার অতৃপ্তী নিয়েই মানুষের মৃত্যু ঘটে। যদি দীর্ঘ সময় ধরে পরিস্থিতিটা চলমান থাকে, তাহলে অধিকাংশ মানুষের অতৃপ্তীবোধ সমাজকে যুক্তিহীন-নীতিহীন ও ব্যাভিচারের দিকে ধাবিত করে। সমাজের এই বেহাল দশা পাল্টাতে পারে একমাত্র রাজনীতি। এই অন্যতম কারণে সমাজের চলমান প্রতিটি ঘটনা মাত্রই রাজনীতি নয়। রাজনীতির একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। যা গড়ে ওঠে সমাজের মধ্যে প্রতিশ্রুতিশীল মানুষের ক্রিয়া ও কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।

আমরা পূর্বেই বলেছি মানুষের জৈব অস্তিত্বের সঙ্গে তার স্বাধীনতার লড়াই ও রাজনীতি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। এবার এই কথাটার একটা স্পষ্ট ব্যাখ্যা দাঁড় করান যাক। আমরা সবাই জানি প্রজাতি হিসেবে মানুষ তার জন্মলগ্ন থেকে পৃথিবীতে প্রথমেই জৈব অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। এটাই তার স্বাধীনতার লড়াই। যে কোনো প্রতিকুলতার আধিপত্যকে অতিক্রম করে স্বাধীন হওয়ার লড়াই। এটাই মানুষের স্বভাব ধর্ম। এই স্বধর্ম মানুষ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বিশ্বজগতের মুখোমুখি হয়েছে। তাকে বিচিত্র অভিজ্ঞতায় বুঝতে চেয়েছে। নতুন নতুন তথ্য-তত্ত্ব আবিষ্কার করেছে। অন্তহীন শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয়েছে। এভাবে জড় থেকে চেতনার জন্ম হলেও বা এই দুইয়ের মধ্যে অবিচ্ছেদ সম্পর্ক থাকলেও পরিনামে চেতনা আজ এক স্বাধীন সত্ত্বা। মানুষের এই সচেতন সত্ত্বা ও তার কর্মোদ্যোগ, ইতিহাস-সংস্কৃতি ও সভ্যতা গড়ার অন্যতম প্রেরণা। মানুষ তার স্বপ্রয়োজনে নিজের সৃষ্টি, নিজের গতি ও ফলাফলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম। ফলে প্রচলিত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ও বৈষম্যের কারণে অধিকাংশ মানুষ তার নিজের সৃষ্টি থেকে, সচেতন প্রক্রিয়া থেকে, তার কাজের ফলাফল থেকে যতই নিষ্ক্রিয় থাকুক না কেন, একটি সময় সে ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য। সে নিজের গড়া জগৎ থেকে কোনো দিন বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। কিন্তু ক্ষমতাবানরা সমাজের বৈষম্যমূলক দশা বহাল রাখতে অধিকাংশ মানুষকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার চেষ্টা করে। মানুষের গতি রুদ্ধ করতে তৎপর হয়। তারা মানুষ নামক পরিচয়েরই মৃত্যু ঘটাতে চায়। যারা এই প্রচেষ্টা রুখে দিতে চান, তাদের এই লড়াইয়ের নামকরণ হলো শ্রেণী সংগ্রাম। এটা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোনো বিষয় নয়। সমাজের অভ্যন্তরেই তা রয়েছে। মানুষের স্বভাবধর্ম প্রতিষ্ঠার নামই হলো শ্রেণী সংগ্রামের রাজনীতি। অবিরাম চর্চা ও পরিচর্যায় তার বিকাশ ঘটে। সমাজের মধ্যে যারা সংবেদী, মুক্ত বুদ্ধি ও যুক্তিশীলতা ধারণ করে, অপরাপর মানুষের মধ্যে যে সব বৃত্তি সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে, সমাজের যে অপূর্ণতা রয়েছে, সেই পূর্ণতা প্রতিষ্ঠায় যারাই সচেষ্ট হন তারাই রাজনীতিবীদ। অর্থাৎ প্রচলিত অর্থে রাজনীতি ও রাজনীতিবীদ বলতে আমরা যা বুঝে থাকি তার মধ্যে বড় মাপের গোলমাল রয়েছে। এক্ষেত্রে আরো একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন আমরা সবাই জানি জাতিগত বৈচিত্র্য, ভাষাগত বৈচিত্র্য, ধর্মগত বৈচিত্র্য কখনই বিশ্বমানবতার অন্তরায় নয়। ফলে একটি রাষ্ট্রে একটি বিশেষ ধর্ম, ভাষা বা জাতির জনগণের প্রাধান্য স্বাভাবিকভাবেই থাকতে পারে। এটা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু তার অর্থ কি এমন যে, ওই রাষ্ট্রকে তার প্রধান জনগোষ্টীর নির্দিষ্ট ভাষা, ধর্ম বা জাতির নামে চিহ্নিত হতে হবে? আসলে এটাই কি বাস্তবতা? ইসরাইলের অধিকাংশ মানুষই হবেন ইহুদি-এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলকে অবশ্যই Jionist state হতে হবে-এটা কি আদতেই কোনো রাষ্ট্রনীতি হতে পারে? একইভাবে ভারত-বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষ হয় হিন্দু অথবা মুসলিম। তাদের প্রধান ভাষা ও সংস্কৃতি ধরে নেওয়া যাক হিন্দি-উর্দু ও বাংলাভাষা কেন্দ্রিক। তার অর্থ কি এমন, এসব রাষ্ট্রকে হয় হিন্দু নতুবা মুসলিম রাষ্ট্র হতে হবে? অথবা উর্দুভাষি-হিন্দিভাষি বা বাংলাভাষিদের রাষ্ট্র? যদি সেই চেষ্টা প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে, যদি এই দৃষ্টিভঙ্গিকেই রাজনীতির বয়ান আকারে দাঁড় করানো হয়, তাহলে, নাৎসীদের জার্মানিক আর্যরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দোষটা আসলে কোথায়? অথবা Jionist state প্রতিষ্ঠা কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনৈতিক? অথবা বিজেপির ভারত রাষ্ট্রকে ব্রাক্সক্ষন্যবাদী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা কোন বিবেচনায় অসাম্প্রদায়িক? রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে এই ধরনের নীতিমালা কি আসলেই রাজনীতি? এসব নীতি বাস্তবায়ন করায় কি মানুষের স্বভাবধর্ম বা স্বভাব নীতি? রাজনীতির জগতে এসব একদমই মৌলিক প্রশ্ন। মূলত গোটা বিশ্বজুড়ে রাজনীতির নামে এই নি-রাজনীতিকরণ প্রক্রিয়াটি প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছে। ক্ষমতাসীনরা তাকেই রাষ্ট্রনীতি হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। জনগণকে বিভক্ত করছে। আমাদের বাংলাদেশও এই প্রক্রিয়ার বাইরে নয়। আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলোসহ আরো অনেক সামাজিক শক্তি রাষ্ট্রনীতির নামে, রাজনীতির নামে এই নিÑরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসছে। তাদের ভাবনার গুরুত্ব ঠিক এখানে। তারা মনে করে দেশ-কাল-পাত্র ভেদে মানুষের বাইরের চেহারা আচার-ব্যবহার, পোশাক-পরিচ্ছেদসহ জাতিতে-জাতিতে, ধর্মে-ভাষায় এবং নারী-পুরুষে একে অপরের সঙ্গে নিজেকে যতই বিচ্ছিন্ন মনে করুক না কেন, এসব বাধা অতিক্রম করা সম্ভব। যে সব উপাদান মানুষের সমাজকে বিভক্ত করছে, মানুষে-মানুষে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করেছে, যে শ্রম বিভাগ, মানসিক ও শারীরিক শ্রমের বিভাজন, নগর ও গ্রামের পৃথকীকরণ, নারী ও পুরুষে বৈষম্য-এসব কিছুই বর্তমান দুনিয়াতে মানুষের স্বধর্মের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের জৈব স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং তাকে অতিক্রম করা সম্ভব। প্রতিটি মানুষ তার নিজের মানবীয় গুণাবলি ও সামর্থের বলে মানবীয় উৎকর্ষের সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছাতে সক্ষম। ফলে জাতি জাতিতে-ধর্মে-ভাষায় ও লিঙ্গীয় সম্পর্কে ভেদরেখা টানা অর্থহীন বলে তারা মনে করেন। একই সঙ্গে একটি অখণ্ড মানব জাতির অংশ হিসেবে প্রতিটি জাতির প্রত্যেকটি মানুষের অধিকারের সমতা নিশ্চিত করার লড়াইকে তারা রাজনীতি মনে করেন। যা মানুষের জৈব স্বাধীনতার সঙ্গে অন্তরগতভাবেই সম্পর্ক যুক্ত এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের প্রশ্ন হলো তাদের এই মনোভঙ্গি কি আসলেই ফৌজদারী মামলার বিষয়? অথবা তাদের হত্যা করে, খুন, ধর্ষক ও সন্ত্রাসী হিসেবে তকমা এটে কি তাদের নিকেশ করা যাবে? এই প্রশ্নটিতেই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করা দরকার। আর রাজনীতির যে ধারাটি অপরাপর রাজনৈতিক ধারাকে ফৌজদারী মামলার বিষয় মনে করে এসেছেন তারাই আজ ফৌজদারী মামলার আসামী। চাঁদাবাজী, ঘুষ দুর্নীতি মামলার আসামী। এখন তাদের দাবি তারা নিরাপদ। রাজনীতির কারণেই তাদের উপরে দমন নীতি চাপানো হয়েছে। তারা জেল থেকে তাদের অনুসারীদের গণআন্দোলন গড়ে তুলে তাদেরকে মুক্ত করার কথা বলছেন। আমাদের প্রশ্ন হলো রাজনীতি যদি ফৌজদারী মামলার বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে কেন আপনাদেরকে গণআন্দোলন করে বের করে আনতে হবে? আপনাদের সময়ে কি বিনা বিচারে লাখ লাখ রাজনৈতিক কর্মীকে জেলে আটক রাখেননি? বিনা বিচারে লাখ লাখ রাজনৈতিক কর্মীকে কি খুন করেননি? মোফাখখার চৌধুরীরকে হত্যা করেছে কারা? দেশের সেনাবাহিনীকে কি মার্সেনারী বাহিনী হিসেবে আপনারা বিদেশী শক্তির তাবেদারে ভিন্ন দেশে ভাড়া খাটাতে পাঠাননি? আমরা ক্ষোভ থেকে বা বর্তমান সেনা সমর্থিত সরকারের সমর্থনে কোনো কথা বলছি না। বাংলাদেশে রাজনীতির নামে যা ঘটে চলেছে সেটাকেই প্রশ্ন করছি শুধু। এবং এ ধরনের জিজ্ঞাসা দীর্ঘদিন যাবৎ সমাজের মধ্যে ক্রিয়াশীল বিধায়, সেই ভাবনা লিপিবদ্ধ করতে এই বইয়ের কাজে হাত দেওয়া। এই কাজের পিছনে এটাই আমাদের মনোভঙ্গি। তাছাড়া, খোলা চোখেও যদি আমরা বিষয়গুলো পর্যালোচনা করি, তাহলে তার মর্মবস্তুও ভিন্নভাবে দাঁড়ায়। যেমন বছরের পর বছর দেশে লাখ কোটি ডলারের বিদেশী সাহায্য আসবে। প্রতি বছর দেশে হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হবে। অথচ গরীব আরো গরীব হবে এটা চলতে পারে না। একজন কৃষক নিজের টাকায় সার কিনবে অথচ প্রয়োজনীয় সময়ে সেটা পাবে না। হয় তাকে পুলিশের লাঠিপেটা খেয়ে সেটা পেতে হবে নয়ত গুলিতে জীবন দেওয়ার পর সার মিলবে-এটা একটা দেশের রাষ্ট্রীয় নীতি হতে পারে না। ব্যাংকের হাজার হাজার টাকা গায়েব করে দিয়ে একজন দেশের সভ্য নাগরিক হবেন, আর কৃষক এক হাজার টাকা মওকুফ পাবে না। তাকে জেল যেতে হবে। ব্যাংক ও এনজিও কর্মীরা তারা সম্পত্তি নিলামে ওঠাবে অথবা ঘরের টিন খুলে নিয়ে যাবে, এটা একটা দেশের আইন হতে পারে না। প্রতি বছর বাজেটে বরাদ্দ বিদ্যুৎ খাতের সমস্ত টাকা লুটপাট করা হবে; আর মানুষ পয়সা দিয়েও বিদ্যুৎ পাবে না। বরং বছর বছরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে এটা আসলেই কোনো ব্যবস্থা হতে পারে না। দেশের ক্ষমতাবান ও লুটেরাদের সন্তানরা দেশের সেরা স্কুল ও সেরা সেরা শিক্ষাবিধদের তত্ত্বাবধানে পড়বে। অতঃপর বিদেশে পাড়ি জমাবে। আর অধিকাংশ মানুষের শিক্ষার ব্যবস্থাটা ব্রাকের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে, এটাও আদতেই কোনো রাষ্ট্রনীতি হতে পারে না। অথবা দেশের অধিকাংশ মানুষের চিকিৎসা সেবা হিসেবে সরকারি পরিসেবা, লুটপাট করে ভেঙে দেওয়া হবে। তাকে বেনিয়াদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। আর নিজেদের জন্য ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর, আমেরিকা অথবা সৌদি আরবে ব্যবস্থাটি পাকা থাকবে, এ ধরনের ব্যবস্থা কার্যত আজকের দিনে অচল। এধরনের রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের দায়বদ্ধতা থাকে কম। জনগণ বিকল্প সম্ভাবনা খুঁজে নিবেই। অনেকেই আবার ব্যবস্থা বদলের সংগ্রামে সংগঠিত হতে পারে। তারা সমাজ বদলের সংগ্রামের সঙ্গে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রশ্নটিকে সম্পর্কযুক্ত করতে পারে। রাষ্ট্রশক্তির সাহায্য সমাজকে এমনভাবে ঢেলে সাজানোর লড়াই করতে পারে যে রাষ্ট্রে মানুষ আর শোধিত হবে না। শাসক শ্রেণী হিসেবে কারো হাতেই আর শোষণের উপায় কেন্দ্রিভূত থাকবে না। শোষক হিসেবে আর কেউ সুদ পাবে না, মুনাফা পাবে না, জমির খাজনা পাবে না, ফসলের ভাগ পাবেনা,বাড়িভাড়া পাবেনা। উৎপাদন আর বন্টন হবে দেশ ও পরিবারের প্রয়োজন ভিত্তিক। শিক্ষা ও চিকিৎসায় সবার সমানাধিকার নিশ্চিত করা হবে। প্রতিটি সক্ষম মানুষের কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলা হবে। ফলে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক একটা বৈষম্যমূলক সমাজে এই ধরনের ভাবনায় অসঙ্গতি কোথায়? এদেশের ক্ষমতাবানরা নিজেরা সুধরাবেন না। রাষ্ট্রকে একটা রাজনৈতিক রাষ্ট্র, গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলবেন না। বিপরীতে সমাজের সম্ভাবনাময় শক্তিকে যারা প্রকৃত অর্থে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর কথা ভাবে, একটা বিকল্প সম্ভাবনা হাজির করে, তাদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হবে, এটা চলতে পারে না। আমাদের স্মরণে রাখা দরকার এ ধরনের নিকেশ করার পদ্ধতিতে একটা রাজনৈতিক শক্তিকে উচ্ছেদ করা যায় না। এবং সেই শক্তি যদি আবার মানুষের স্বভাব ধর্মকেই ধারণ করে। যার কথা আমরা এই পর্বের আলোচনার শুরুতেই বলেছি। ফলে রাষ্ট্রের ক্রসফায়ার পদ্ধতি নাগরিক হিসেবে আমাদেরকে আরো বিপদগ্রস্ত করে তুলবে। সেটা একদিকে যেমন গৃহযুদ্ধের দিকে দেশকে ঠেলে দিতে পারে, তেমনি আমাদের অর্জিত সমস্ত মানবাধিকার কেড়ে নিতে পারে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যে আজ একটা সংকটের আবর্তে আটকা পড়েছে, একথাটি আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর প্রয়োজন নেই। দেশের সমস্ত সম্ভাব্য গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। প্রত্যেকের মত ও পথ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা এবং নীতি নির্ধারণের সময় এসেছে। সেই দৃষ্টিকোন থেকে যারা আজ ক্রসফায়ারের শিকার, কী তাদের রাজনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি সেটা তুলে ধরতেই এই কাজটি হাতে নেওয়া হয়েছে। নিছক মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়। ফলে আলোচিত গ্রন্থটিকে আমরা অবশ্যই এদেশের রাজনৈতিক লড়াই ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অংশ হিসেবে বিবেচনা করি। মূলত এটাই হলো আমাদের কাজের বা গবেষণা পদ্ধতির একটা দিক। যাকে ভাবাদর্শগত দিক থেকে বলা যেতে পারে। এর আরো অপরাপর দিক রয়েছে। আমরা ইতিমধ্যকার আলোচনায় পাঠককুল আশা করি এতক্ষণে অনেকটা নিশ্চিত হয়েছেন যে, এই বইয়ের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। অবশ্যই তাই। আমরা নীতিগতভাবে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিনা বিচারে অথবা বিচার করে যে কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘোরতর বিরোধী। তারপরেও ক্রসফায়ারে সংগঠিত সমস্ত ধরনের হত্যাকাণ্ডের স্বরূপ উন্মোচন এই বইয়ের বিষয়বস্তু নয়। একটি বিশেষ ধারার রাজনীতির প্রতি আমাদের পক্ষপাত রয়েছে। কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে যারা কৃষি বিপ্লবকে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম হিসেবে দেখেন, যারা সকল ধরনের সাম্রাজ্যবাদ, কর্পোরেট হাউজসহ ভারতীয় স¤প্রসারণবাদ বিরোধী রাজনীতিতে সক্রিয়, ওইসব দল এবং তাদের নেতাকর্মীরা এই বইয়ের বিষয়বস্তু। কারণ হিসেবে আগেই বলেছি, গত ৩৬ বছরের বাংলাদেশে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে পরপর দুইবার তারাই রাষ্ট্রীয়ভাবে সংগঠিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার। একইভাবে ব্যাপক প্রপাগান্ডা তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে। ফলে কি তাদের রাজনীতি খুবই স্বল্প পরিসরে তা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এই বইটি প্রধানত সাক্ষাৎকার ধর্মী এবং চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত। এর মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায় সক্ষাৎকার ভিত্তিক। তবে এক্ষেত্রে একটি কথা বলে নেওয়া ভাল। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবার পরিজনদের সাক্ষাৎকার গ্রহণে গুরুত্ব দেওয়া হলেও প্রতিটি পরিবারের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এবং সেটা সম্ভবও ছিলো না।

প্রথম অধ্যায়ের সাক্ষাৎকারে রয়েছে বেশ কয়েকটি ধরন।

ক) নিহত রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের আত্মীয় পরিজনদের সাক্ষাৎকার।

খ) দল ভিত্তিক সেটা দাঁড় করান।

গ) যারা র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়ে ক্রসফায়ার থেকে রেহাই পেয়েছেন, স্বনামে ও ছদ্মনামে এবং ঘটনাটি উল্লেখ করে না করে নেওয়া কয়েকটি সাক্ষাৎকার।

ঘ) স্থানীয় নেতা ও সমাজকর্মী যারা ক্রসফায়ারে হত্যকাণ্ড নিয়ে ভাবিত তাদের একটি অংশের সাক্ষাৎকার।

ঙ) জাতীয় পত্র-পত্রিকার জেলা পর্যায়ের সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার। এদের মধ্যে খুলনা বিভাগের সাংবাদিকরা স্বনামেই সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। আর রাজশাহী বিভাগের সাংবাদিকরা ছদ্মনামে। রাজশাহী বিভাগের সাংবাদিকরা আজো মনে করেন বিএনপি নেতৃত্ব দুলুসহ আরো অনেকেই এখনো এতটাই ক্ষমতাধর যে, তারা জেলে থাকুক আর পলাতক থাকুক, স্বনামে সাক্ষাৎকার দিলে সাংবাদিক হওয়ার পরেও গুপ্ত ঘাতক দিয়ে ওইসব ক্ষমতাধরা আজো তাদের হত্যা করার ক্ষমতা রাখে।

চ) আবার নিহত রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে যারা হাইকোর্ট ও জজকোর্টের জামিনে ছিলেন এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে বর্তমানে নিষ্ক্রিয় ছিলেন, তাদেরও একটা ক্যাটাগরি রয়েছে।

দ্বিতীয় অধ্যায়ের স্বাক্ষাৎকারগুলো হলো দল ভিত্তিক।

মূলত, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি (সি সি), পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি (গইজগ), পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল), পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এল এল) (লাল পতাকা), পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল) জনযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির কাছে নানান পথে চিঠি দিয়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি (গইজগ) ও বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার প্রদানের ক্ষেত্রে অপারগতা প্রকাশ করা হয়। জনযুদ্ধের একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধির সঙ্গে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে মোট তিন ধাপ দেখা করি। সাতক্ষিরা অঞ্চলে তাদের প্রতিনিধির সঙ্গে লোক মারফৎ কথা বলায় এবং আবীর হাসান নামে তাদের আরেক প্রতিনিধির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করি। যিনি পরবর্তীতে নিহত হন। এত কিছুর পরেও এই দলের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিনিধির সাক্ষাৎকার গ্রহণ সম্ভব হয়নি। এমন কি তাদের প্রচার পত্র বা দলীয় কোনো কাগজপত্র সংগ্রহ করতে পারিনি। ফলে এই অধ্যায়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মোট তিনটি দল। এর মধ্যে লাল পতাকা ও এমএল -এর পক্ষ থেকে তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন। এই দুই সাক্ষাৎকার সরাসরি বা সামনা-সামনি নেওয়া। আর পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি সিসিদের সাক্ষাৎকারটি পত্র যোগাযোগ মারফত এবং প্রশ্ন উত্তর ভিত্তিক।

তৃতীয় অধ্যায়টি মূলত দলীয় প্রচার পত্র ভিত্তিক।

এই অধ্যায়ে যে পাঁচটি দল তাদের প্রচার পত্র এই বইয়ে সংযোজনের জন্য দিয়েছিলেন। তার মধ্যে থেকে বাছাই করা অংশ সংযোজনী আকারে দেওয়া হলো। এখানে একটি কথা বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন। কথাটি হলো-এসব দল সব মিলিয়ে এত সব তাদের কাগজপত্র দিয়েছেন তা একটি খণ্ডে প্রকাশ করা কিছুতেই সম্ভব হত না। সমস্ত কিছু ছাপতে গেলে অন্তত দশটি খণ্ড আকারে তা সম্ভব হতে পারে। ফলে তাদের কাগজপত্রের উপরে চোখ বুলিয়ে আমরা আলাপচারিতার মাধ্যমে তাদের সামগ্রীকতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। অন্যদিকে দলীয় কাগজ পত্রের ভিড়ে যারা নিহত হয়েছে ওইসব পরিবারের ভাষ্যগুলো যেন হারিয়ে না যায় সেদিকে সচেতন থেকেছি। তবে ভবিষ্যতে সম্ভব হলে তাদের দলীলপত্র দিয়েই আলাদা আলাদা গ্রন্থ প্রকাশ করার ইচ্ছা আমাদের রয়েছে।

চতুর্থ অধ্যায়ে রয়েছে নামের তালিকা।

যেসব নেতা কর্মীরা এবার নিহত হয়েছেন দলগতভাবে তাদের নামের একটি তালিকা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে অবশ্য সেটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা নয়। একটা নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে যারা মারা গিয়েছেন তাদের নামের তালিকা করা সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রধানভাবে সাহায্য করেছেন যশোরে ‘আমার দেশ’ পত্রিকার আঞ্চলিক অফিস। আহসান বাবুর সহযোগিতা ছাড়া এই কাজটি করা আমার জন্য অসম্ভব একটি ব্যাপার ছিলো। পরে ওই নামের তালিকা আলোচিত রাজনৈতিক দল এবং এলাক বাসীর মতামতের ভিত্তিতে দাঁড় করান হয়েছে।

এই বইয়ের কাজ করতে গিয়ে আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর যে সব অঞ্চলে কার্যক্রম রয়েছে প্রায় সমস্ত এলাকার মাঠ পর্যায়ের সঙ্গে একটা প্রাথমিক সংযোগ-সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়েছিল। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদাহ, যশোর, খুলনা, মাগুরা, সাতক্ষিরা, রাজবাড়ি, পাবনা, নাটোর, নওগাঁ, রাজশাহী ও সিলেট জেলার প্রায় দুই শতাধিক পরিবারের সঙ্গে কথা বলি। তাদের মধ্যে একটি অংশ সাক্ষাৎকার প্রদানে সম্মত হন। আর অধিকাংশ পরিবার ইচ্ছা থাকার পরেও মুখ খুলতে রাজি হননি। তারা আজো মনে করেন এবিষয়ে কোনোরুপ মন্তব্য করা হলে তাদেরকেও ক্রসফায়ারে হত্যা করা হতে পারে। তারাও মতামত প্রদান করলে ক্রসফায়ারের স্বরূপ উন্মোচনে আরো অসংখ্য তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যেত বলে আমার ধারণা। তবে রাজশাহী অঞ্চলে বাংলাবাহিনীর হাতে নিহত কয়েকটি পরিবারের সাক্ষাৎকার প্রাসঙ্গিকতার কারণেই নেওয়া হয়েছে। সাক্ষাৎকার গ্রহণের ক্ষেত্রে কি কি বিষয় জানতে চাওয়া হয়েছে সেটার উপরে কোনোরূপ মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। পাঠকগণ বিষয়টিতে মনোযোগী হলেই তা নিজেরাই উপলব্ধি করতে পারবেন। আর নিহতদের পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার স্থানীয় সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, সমাজ সেবক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা করেছিলেন। তাদের সহযোগিতা ছাড়া একাজ করা সম্ভব হত না।

এই কাজ করতে গিয়ে উল্লিখিত জেল গুলোতে অনেকবার যেতে হয়েছে। অসংখ্য মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। এবং সাধারণ জনগণ যেসব মন্তব্য করেছেন, সেগুলোকেও গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মন্তব্যকে আমরা কয়েক ভাগে ভাগ করে নিতে পারি।

প্রথমত: জনগণ মনে করেন আলোচিত অঞ্চলগুলোতে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীবাদ দিয়ে অপরাপর সমস্ত রাজনৈতিক দলের কর্মীদের মধ্যে ক্রসফায়ার ভীতি কাজ করেছে বিশেষত জোট সরকারের আমলে। জনগণের আরো অভিযোগ বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা স্থানীয়ভাবে র‌্যাবের সোর্স হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবে এধরনের প্রক্রিয়াতে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি অতীতে কোনোদিন এদেশে দেখা যায়নি। অসংখ্য স্কুল-কলেজগামী ছাত্রদেরকে র‌্যাব তাদের সোর্সে পরিণত করেছে, যা অতীতে কখনো ঘটেনি। আবার আলোচিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর স্থানীয় পর্যায়ের সক্রিয়-আধা সক্রিয় কর্মীদেরকে নানা প্রলোভন ও মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে র‌্যাব তাদের সোর্সে পরিণত করে। তাদের সাহায্যে সহযোগীদের গ্রেফতার ও ক্রসফায়ারে হত্যা করে। এবং পরিশেষে এসব সোর্সকেও র‌্যাব হত্যা করেছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ রয়েছে। বিশেষত এটি পাবনা-নওগাঁ ও খুলনার ক্ষেত্রে ঘটেছে। জনগণের আরো অভিযোগ অনেক থানার পুলিশ ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা রোজগার করেছে। তাছাড়া, স্থানীয় এমপি ও রাজনৈতিক নেতৃত্বদের পছন্দ-অপছন্দের জায়গা থেকেও অনেককে ক্রসফায়ারে দেওয়া হয়েছে। এমনকি অনেকের নামে আদতেই কোনো মামলা অথবা অভিযোগ ছিলো না। হত্যা করার পরে তাদেরকে অনেকগুলো জেলার পেইন্ডিং কেসে যুক্ত করা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত: আলোচিত দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত কিন্তু তারা সক্রিয় কর্মী ছিলেন না। এমন কয়েক হাজার মানুষ এখনো ক্রসফায়ারের ভয়ে আজো ভিটে-মাটি ছাড়া। তাদের পরিবারগুলো অসাহায়ত্ব পরিবেশের মধ্যে জীবন-যাপন করছে। অসংখ্য পরিবারে রক্ত-সম্বন্ধিয় আত্মীয়-স্বজন আর আসা-যাওয়া করতে পারছে না। ওইসব পরিবারে আত্মীয় স্বজনরা আসলে র‌্যাবের সোর্সরা পার্টির লোক এসেছে দাবি করে র‌্যাবের কাছে তথ্য দেয় এবং পরিবারগুলো কার্যত র‌্যাব কর্তৃক একটা ধাওয়ার মধ্যে পড়ে। এভাবে ওইসব পরিবারের উপরে একটা চাপ বহাল রাখা হয়েছে আজো।

তৃতীয়ত: জনগণের আরো অভিযোগ জেলা শহরগুলোতে অসংখ্য চিহ্নিত অস্ত্রধারী, চাঁদাবাজ রয়েছে যারা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাসীন দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত, তাদের কাউকে ক্রসফায়ারের আওতায় আনা হয়নি।

চতুর্থত: সাধারণ জনগণ কেউই বিনাবিচারে এই হত্যাকাণ্ডকে নীতিগতভাবে মানতে পারেননি। তারা মনে করেন এই ব্যবস্থা আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোকে আরো দুর্বল করে দিবে।

পঞ্চমত: আবার আলোচিত অঞ্চলের কোথাও কোথাও এসব কমিউনিস্ট পার্টি উচ্ছেদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের স্থানীয় নেতৃত্বদের দিয়ে বাহিনী গঠন করে। এসব বাহিনী আজো সক্রিয় রয়েছে এবং র‌্যাবের হয়ে ভূমিকা পালন করছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। পাবনায় বাহিনী নামে এ ধরনের সংগঠনের অস্তিত্ব রয়েছে। এদের হাতেও অনেকে মারা পড়েছেন।

আবার আলোচিত দলগুলো সম্পর্কেও জনগণের অভিযোগ রয়েছে এবার তার উপরে দৃষ্টি দেওয়া যাক।

প্রথমত, আলোচিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি দলের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জনগণ একদমই ওয়াকেবহাল নন। এসব দলের কী রাজনৈতিক লক্ষ্য, কি বা আশু কর্মসূচি এ সম্পর্কে জনগণের ন্যূনতম ধারণা নেই।

দ্বিতীয়ত, কয়েকটি অঞ্চলে কয়েকটি দলের সম্পর্কে অতিখতম, চাঁদাবাজি, হাটের ইজারাদারীর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ জনগণের দিক থেকে করা হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি দল তা স্বীকারও করেছেন তাদের প্রচার পত্রে।

তৃতীয়ত, এলাকা দখল নিয়ে এসব দলের মধ্যে পরস্পরের সংঘর্ষের অভিযোগও জনগণ করেন।

চতুর্থত, কোথাও কোথাও কোনো কোনো দলের পক্ষ থেকে অভিযুক্তকে শারীরিক নিপীড়নের অভিযোগ করেন জনগণ।

এ ধরনের অভিযোগের পাশাপাশি তাদের অনেক কার্যক্রমের প্রতি জনগণের নৈতিক সমর্থন রয়েছে। যেমন আমার জানা মতে পদ্মার চরাঞ্চলের মধ্যে ঢালার চর, সাদার চর, হঠাৎপাড়া, সর্বহারার চর, চর শামিলপুর ইত্যাদি অঞ্চলগুলো বর্তমানে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি গইজগ গ্রুপের প্রধানভাবে কাজ রয়েছে। এর মধ্যে এক ঢালার চরেই খাস জমির পরিমাণ হলো প্রায় ৮০ হাজার বিঘা। তার মধ্যে ’৪৭ পরবর্তী সময়কালে হিন্দু স¤প্রদায়ের মধ্যে যারা ভারতে চলে যান, তাদের প্রায় ১০ হাজার বিঘা জমি-জিরাত ছিলো। তহসিলদারদের সহযোগিতায় নামে-বেনামে পত্তনি-দরপত্তনি দেখিয়ে রাজবাড়ির কুদ্দুস মিয়া, আক্কাস মিয়া, টিটো চেয়ারম্যান ও নিলু চৌধুরীদের পরিবার দীর্ঘদিন যাবৎ ভোগ দখল করে আসছিল বলে স্থানীয় জনগণের অভিযোগ ছিলো। ৮০ দশকের শেষে এই অঞ্চলে সর্বহারা পার্টি ওই জমি পুনর্দখলে নামে। গরীব কৃষকদের মধ্যে তা বন্টন করে দেয়। ৯০ -এর দশকের শুরুতে সরকারি দমন-পীড়নের ফলে তাদের পার্টির পক্ষ থেকে সংগ্রামটি ছেড়ে দেওয়া হয়। সর্বহারা পার্টি বিভক্ত হয়ে MBRM গঠন হওয়ার পর আবারো জমি দখলের অভিযান শুরু হয়। এবং ওই জমির মধ্য থেকে প্রায় ৮ হাজার বিঘা জমি দখল করে ভূমিহীন গরীব কৃষকদের মধ্যে তারা বন্টন করে দেয়। সে ব্যবস্থা এখনো বহাল রয়েছে। একই সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বহারাদের এই কার্যক্রম উচ্ছেদ দুটি স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছে। র‌্যাবের টহল অভিযানও অব্যহত আছে। এর পাশাপাশি ঘাট কেন্দ্রিক যে শক্তিশালী ইজারাদারী ব্যবস্থা ছিলো, অনেক জায়গায় তারা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তার উচ্ছেদ করে দিয়েছে। নদীর সাধারণ ইজারাদারী হিসেবে মাছ মারলে খাজনা আদায় প্রথা নামে যে ব্যবস্থা ছিলো তারা সেটাও উচ্ছেদ করে দিয়েছে। এখন উচ্ছেদ হওয়া ইজারাদাররা সরকারের সহযোগিতায় পদ্মার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ঘিরে অভয়ারণ্য ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছে। কোথাও কোথাও সেটা ঘোষণাও করা হয়েছে। যাতে সাধারণ মানুষ ও জেলে স¤প্রদায় মাছ মারতে না পারে। আবার কোথাও রয়েছে কোল [বন্যা বা বর্ষা মৌসুমে পদ্মার বেশ কিছু অঞ্চলে ৫শ থেকে ১০০০ বিঘা জমির আয়তন নিয়ে এক ধরনের জলাশয় সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিকভাবে তাতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। এটা একটা অস্থায়ী বিষয়।] দখলের লড়াই। যারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কিত, তারা এসব কোল নানা পদ্ধতিতে লিজ নেয়। কোলের উপরে লাখ লাখ টাকার ব্যাংক ঋণ নিয়ে থাকে। পরের বছরে দেখা গেল বর্ষা অথবা বন্যার কারণে ওই কোলের আর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ব্যাংকের লাখ লাখ টাকা মৎস্য চাষের নামে লুট হয়ে যায়। এসব কোল যাতে জনগণের সম্পদ হিসেবে এবং তাদের খাদ্য নিরাপত্তার উৎস হিসেবে তাদেরই থাকে, এটা নিয়েও ক্ষমতাবানদের সঙ্গে ওই দলের লড়াই রয়েছে। আবার নতুন জেগে ওঠা চরে পরিবার প্রতি ১০০০ টাকা মাস কিস্তিতে জনবসতি স্থাপনের সুযোগ দেওয়া হয়। এই টাকাটা সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে ক্ষমতাসীন দলের মাস্তানবাহিনী আদায় করে থাকে। আলোচিত সমস্ত চরাঞ্চল থেকে এই প্রথার উচ্ছেদ করে দিয়েছে তারা। অসংখ্য গ্রামে বিকল্প বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। নারী নিপীড়ন বন্ধ করতে অনেক জায়গায় সক্ষম হয়েছে। আর এসব কাজের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাদের শক্তিশালী বাহিনীও গড়ে উঠেছে। এবং সেটা অদ্য বধি টিকেও রয়েছে। জনগণই তা টিকিয়ে রেখেছে। কারণ ওই অঞ্চলের জনগণই মনে করেন সর্বহারা পার্টি ও তাদের বাহিনীর কারণে তারা যতটুকু ক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছেন, পার্টি ও বাহিনী যদি না থাকে তাহলে এর কোনো কিছুই আর তাদের থাকবে না।

আবার অনেক হাট-বাজারের ইজারাদারীও তারা উচ্ছেদ করে দিয়েছিলেন। যার মধ্যে সুজানগর থানার শ্যামগঞ্জ গরুরহাট একটি। বর্তমানে পুলিশ তহসিলদারদের সহযোগিতায় ওই হাটের খাজনা আদায় করে। একটি সময় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিও চতরার বিল, টাকিগাড়, জলকা, চিতলিয়া ও গারুলিয়া বিলের ইজারাদারী প্রায় উচ্ছেদ করে দিয়েছিল। এসব বিলের উপরে মৎস্যজীবী ও শ্রমজীবী জনগণের অধিকারও তারা অনেকদিন কায়েম রাখে। আবার চলনবিল এরিয়াতেও অসংখ্য খাস পুকুর-খাস জমি দখলসহ অনেক জায়গায় বিকল্প বিচার ব্যবস্থা পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি (সি সি) প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। এবং শত চাপের মধ্যেও তাদের সেই সক্ষমতা এখন বজায় রয়েছে। সিলেট অঞ্চলে হাওড়-বাওড়ের উপরে শ্রমজীবী ও মৎস্যজীবীদের দখল কায়েমে বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি দীর্ঘদিন থেকে লড়ে আসছে। এবং কোথাও কোথাও তাদের বড় মাপের সফলতা রয়েছে। সাতক্ষিরা অঞ্চলে জমি দখলের দীর্ঘ সংগ্রাম তাদের রয়েছে। রয়েছে যশোরে নদী অবমুক্তর সংগ্রাম। জলাবদ্ধতা নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসও তাদের আছে। উদাহরণ আর না বাড়িয়ে এটা বলা চলে এখনো বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে আলোচিত দলগুলোর অসংখ্য গুরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে ও চলছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে ঢালাও চাঁদাবাজি ও খতমের অভিযোগ জনগণ সমর্থন করে না। মূলত খুবই সংক্ষেপে এগুলোই হলো তাদের কার্যক্রমের কিছু টুকরো টুকরো দিক। তবে আমাদের স্মরণ রাখতে হবে তাদের এসব কার্যক্রম পরোপকার, দুঃস্থদের সেবা বা রামকৃষ্ণ মিশনের মডেলে গড়ে ওঠা কিছু নয়। এসব পার্টির সুনির্দিষ্ট ইডিওলজি রয়েছে। মাস অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে এধরনের কার্যক্রম গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের কাজটি তা সমন্বিতভাবে করে থাকেন। তাদের এই কার্যক্রম শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিকাঠামোর মধ্যেও সীমাবদ্ধ নয়। সমাজের গরীব মানুষ ও ক্ষেত মজুরী যখন বিকল্প বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হন, তখন সেটা তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামও হয়ে দাঁড়ায়। যা একেবারে হিউম্যানবিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়।

এই কাজটি করতে গিয়ে বেশ কিছু গণতন্ত্রীমনা মানুষের সঙ্গেও আমার পরিচয় ঘটে। তারা এসমস্ত দল সম্পর্কেও বিস্তর খবরবার্তা রাখেন। প্রচলিত ব্যবস্থার তারাও পরিবর্তন চান। কিন্তু কেউই সরাসরি রাজনীতিতে সম্পর্কিত নন। তারাও অনেক মন্তব্য করেছেন। তাদের মন্তব্যগুলোর উপরে দৃষ্টি বুলিয়ে আমার লেখাটিরও ইতি টানা হবে।

এসব ব্যক্তিদের প্রথম মন্তব্য হলো মাওবাদের নামে বা মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের নামে একটা দেশে এতগুলো পার্টির অস্তিত্ব থাকার অর্থ হলো জনগণের মধ্যে বিভক্তিকরণসহ একটা সমস্যাজনক পরিস্থিতির মধ্যে দেশের বিপ্লবী শক্তির আটকে থাকা। আবার কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে তাদের মধ্যে লক্ষ্য ও পথ নিয়ে এত দ্বন্দ্ব রয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত তারা আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে চান বা আমরা কোথায় যাওয়ার ক্ষমতা রাখি-সেটা স্পষ্টাকারে আমাদের জানা নেই। অথচ সবাই অভ্রান্ত মতবাদের দাবিদার। এ অন্যতম কারণে গত ৩৬ বছর ধরে মানুষ অসংখ্য গণ-বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে তাদের কাঁধের জোয়লাটা ছুঁড়ে ফেলতে গিয়েও পারেনি। এসব দল দাবি করে থাকেন জনগণ হচ্ছেন সমস্ত ক্ষমতার উৎস। কিন্তু সংগঠিত জনগণ শক্তির উৎস হিসেবে বিরাজ করে না। জনগণের সংগঠন গড়ার মধ্য দিয়ে তাদের শক্তি মূর্তরূপ পায়। জনগণের এই সংগঠন অগ্রগামীদের সংগঠন থেকে পৃথক। কারণ কোটি কোটি জনগণ কমিউনিস্ট পর্যায়ে উন্নীত হবেন, এটা একদমই বাস্তব বিবর্জিত ভাবনা। ফলে জনগণের নিজস্ব সংগঠন বা সোসাল ফোর্স মোবিলাইজেশনের ক্ষেত্রে এসব দলের মারাত্মক দুর্বলতা রয়েছে।

তারা আরো মনে করেন কোনো দেশের বিপ্লবের পরিস্থিতি নির্ভর করে বিপ্লবের বস্তুগত ও বিষয়গত এই উভয় অবস্থার পারস্পরিক সংযোগ সম্পর্ক ও পরিপক্ষতার উপরে। দেশজোড়া অর্থনৈতিক সংকট, চলমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য জনগণের তীব্র আকাক্সক্ষা, চলতি রাজনৈতিক ব্যবস্থার অস্থিরতা, শাসক শ্রেণীর ঘন ঘন শাসন পদ্ধতির পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়গুলো বিপ্লবের বস্তুগত অবস্থার পরিপক্বতারই লক্ষণ। আর শক্তিশালী অগ্রবাহিনী, তাদের সংগঠনিক ও সামরিক প্রস্তুতি, সোসাল ফোর্স হিসাবে জনগনের অজস্ত্র সংগঠন এবং অগ্রবাহিনীর সঙ্গে তাদের সংযোগ-সম্পর্কের দৃঢ় ঘনিষ্ঠতা ইত্যাদি বিষয়গুলো বিপ্লবের আত্মগত পরিস্থিতির পরিপক্কতার লক্ষণ। এই উভয়দিকের পরিপক্কতার উপর নির্ভর করে বিপ্লবী পরিস্থিতির পরিপক্কতা। এই দুটো দিকের একটি যদি পরিপক্ক হয়ে ওঠে, অপরটি পিছিয়ে থাকে, তাহলে, বিপ্লবী পরিস্থিতি চমৎকার- এই ধারণাটি ভ্রান্ত। এই বিশ্লেষণের উপরে দাঁড়িয়ে তারা মনে করছেন এদেশে বিপ্লবের বস্তুগত দিক অনেক আগেই পরিপক্ক হয়ে উঠেছে। কিন্তু বিপ্লবের আত্মগত দিকে রয়েছে শূণ্যতা। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলেও সংগঠিত রূপ হিসেবে তারা দাঁড়াতে পারেনি। গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক কৃষক আজো অসংগঠিত। কমিউনিস্ট পার্টিও সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে বিভিন্ন স্তরের ব্যাপক জনগণের সঙ্গে সৃষ্ট বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বিপ্লবের নেতৃত্ব দেওয়ার মত অগ্রবাহিনী হয়ে উঠতে পারেনি। সুতরাং এ ধরনের পরিস্থিতিকে আর যাই হোক বিপ্লবী পরিস্থিতি বলে দাবি করা চলে না। এ অবস্থায় নেতৃত্বের করণীয় হচ্ছে পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সংগঠন গড়ে তোলা। কার্যপদ্ধতি আয়ত্ব করা। এভাবে বিপ্লবের ভূমি প্রস্তুত করাই হলো রাজনৈতিক যোগ্যতার বিষয়। এটা অর্জন না করে যারা যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে বসেছেন তারা হঠকারী লাইনই অনুসরণ করছেন। এইযে ব্যর্থতা তার জন্য তারা আরো দুই-তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট উল্লেখ করেন। যেমন তারা মনে করেন এ দেশে যারা মাওবাদ চর্চা করে তাদের মাওবাদ আত্মস্থ করার ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। এসব দল বিপ্লবের জন্য তিনটি গুরত্বপূর্ণ শর্তের কথা বলে থাকেন। মজবুত পার্টি সংগঠন, লালফৌজ এবং যুক্তফ্রন্ট। কিন্তু এই তিনটি শর্ত দ্বারা পৃথিবীর কোনো দেশেই বিপ্লব সংগঠিত হওয়া সম্ভব নয়। যদিনা তার সঙ্গে দেশে বিপ্লবী পরিস্থিতি, নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত শত্রু তাদের সামনে না থাকে। যুদ্ধ-তা যে কোনো চরিত্রের হোক না কেন, সেখানে প্রতিপক্ষের শক্তি ও দুর্বলতা জানা যতটা জরুরি, তার চেয়েও অধিক জরুরি কারা মিত্র এবং নিজেদের দুর্বলতাগুলো অনুসন্ধান করা। কিন্তু যারা এদেশে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলেছেন তাদের কারোরই দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা বিশ্লেষণের উপরে কোনো গবেষণা নেই। চীনা সমাজের শ্রেণী বিশ্লেষণ দিয়ে এদেশেও শত্রু-মিত্র নির্ধারণের কাজটি চলছে। এটা আর যাই হোক বিপ্লবীদের লক্ষণ হওয়া উচিৎ নয়।

তাছাড়া, সমস্ত পার্টিতে একটা হায়ারর্কি রয়েছে। ফলে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাতে গিয়ে দলগুলো ভেঙে পড়েছে। একজন পলিটব্যুরো মেম্বার বা কেন্দ্রীয় সদস্য পার্টির একজন সাধারণ সদস্য থেকে অধিক ক্ষমতা ভোগ করে। পার্টির মধ্যে এই আমলাতান্ত্রিকতার জন্য উপরের নেতারা স্বেচ্ছাচার হয়ে ওঠেন। এই প্রবণতা বা পার্টি স্ট্রাকচার থেকে পার্টিকে বের করে আনা দরকার। কারণ আন্তপার্টি গণতন্ত্র ও সোসাল ফোর্সের সঙ্গে গভীর সম্পর্কের মধ্য দিয়েই গণতন্ত্রের স¤প্রসারণ ঘটে। শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের এটাই মৌলিক বিষয়।

একইভাবে তারা আরো মনে করেন এদেশের বিপ্লবী আন্দোলন আজ দুইটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটি ধারা জাতীয় সংগ্রামকে প্রাধান্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। অপর ধারাটি শ্রমিক কৃষককে ভিত্তি করে শ্রেণীসংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। অথচ দুটোই বিপ্লবী ধারা। দুই ধারারই গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই দুই ধারার আন্দোলনের মধ্যে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতার কারণে যে শক্তিটি পরস্পরের পরিপূরক হতে পারত, তা হয়ে ওঠেনি। বিপ্লবের প্রয়োজনেই তা হওয়া জরুরি ছিলো। মোটামুটি এগুলোই হলো তাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত। এদেশে যারা বিপ্লবী আন্দোলনে নিয়োজিত রয়েছেন তারা সবাই বিষয়গুলিতে মনোযোগী হবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস। সর্বশেষ একটা কথা বলা দরকার- ঠিক কোথায় কবে পেড়েছি তা মনে নেই। তবে বিষয়টি হলো এই -রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব নিয়ে রুশ পার্টি মহা ফাঁপড়ে পড়েছিল। কারণ মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোন থেকে অক্টোবর বিপ্লব করাটা মেটেও মার্ক্সবাদ সম্মত ছিলো না। কিন্তু সেটা করে ফেলাও ছিলো খুবই জরুরি। এই পরিস্থিতিতে লেনিন নাকি মন্তব্য করেছিলেন ‘থিয়োরি ইজ গ্রে মাই ফ্রেন্ড, গ্রিন ইজ দ্যা ইন্টারন্যাল ট্রি অব লাইফ’ ইংরেজিটা আমার বোধগম্য কোনো ভাষা নয়। ফলে লেনিন এই মন্তব্য করে ঠিক কি বলতে চেয়েছেন এখানে তা আমি বলতে পারবো না। যারা ভাবুক তাদের যদি কোনো কাজে লাগে, সেকারণে ঘটনাসহ উদ্ধৃতিটা উল্লেখ করলাম।

সূত্র: ভূমিকাংশ 'ক্রসফায়ার: রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড', ঐতিহ্য-চিন্তা যৌথ প্রকাশনা, ২০০৯।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।