একগুচ্ছ ভাবনামা


ভাবনামা : ৬

নাম’র ভাব : ভাব’র নাম

ধরুন ‘ইসলাম’ যখন নাম, শুধুই নাম। সেই নামের ভাব হলো-- নামাজ, রোজা, হজ্ব, জাকাত, মসজিদ, জায়নামাজ, দাড়ি, টুপি, পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত যুব্বা, মাটির ঢিলা নিয়ে চল্লিশ কদম হাঁটা-হাটি, অযু, ফতোয়া আরো অনেক কিছু। শুধুই অনুষ্ঠান। এই সকল ভাব বহন করে একটি নাম আর সেটি হলো ‘ইসলাম’। অন্তত প্রচলিত, প্রতিষ্ঠিত ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধারণায়। এবং এই ‘ভাব’ই ইসলামের জনপ্রিয় চিহ্ন!

ফলে, ইসলাম এখন পণ্য, ইসলাম এখন বিজ্ঞাপন, ব্যবসা, শোষণের অস্ত্র, প্রতারণার হাতিয়ার, প্রাচুর্যের সিঁড়ি। অন্তত ইসলামিক ব্যাংক, ইসলামিক লাইফ ইন্সুরেন্স, ইসলামিক কোঃ অপারেটিভ মার্কেট, ইসলামিক টি.ভি, হালাল সাবান, হালাল ফ্রিজ ইত্যাদি। আবার কবে হয়তো দেখবো-- ইসলামিক জুতা, ইসলামিক মদ অথবা ইসলামিক বার। এত সবই সে কথায় প্রমাণ করে। এখানে কাজ নেই, নাম-ই কাফি...

অপর দিকে একটি ‘ভাব’ যে ভাবের নাম হলো ‘ইসলাম’ (শান্তি) আর সে ইসলামের চিহ্ন হলো-- রহমত, ইনসাফ, আনন্দ, জাত-পাতহীনতা, অ-সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ হীনতা, আশরাফ--আতরাফ বিলোপ, সম্পদের মালিকানাহীনতা, প্রাণীফুলের খলিফাত্ব, উপাস্য-উপাসকের ভেদহীনতা তথা ‘একক’ স্বরূপে উদ্ভাসিত অনন্ত-অসীম-অফুরন্ত স্বপ্ন...

এ চিহ্ন কাজ ব্যতিত বিরল। অত:পর কাজ হলো ‘সালাত’ যখন তা সুকর্ম করা অর্থে আর ‘যাকাত’ যখন তা পবিত্র হওয়া অর্থে আর ‘হজ্ব’ যখন তা পরিকল্পনা গ্রহণ নিমিত্তে একত্রিত হওয়া আর ‘সিয়াম’ যখন তা বে-ইনসাফ-এর কষাঘাত আত্মস্থ অর্থে আর ‘কলেমা’ যখন তা সেই-- উপলব্ধি শাশ্বত, একক, অনাদি, অখণ্ড এ জগত-প্রকৃতি।

অত:পর ‘কুরান’ যখন তা ‘পঠিত হয়’ অর্থে। পুনঃ পুনঃ যা পাঠ করলে সেই রস আস্বাদিত হয় যা অদমকে দেয় দায়-দায়িত্ব। এ দায়-দায়িত্ব আত্মস্থ সাপেক্ষে কর্মে রত না থাকলে রসুল জ্ঞানের দারোয়ান বলছেন--

“এমন এক সময় আসবে যখন লেখা-ছাড়া কুরানের আর কিছুই থাকবে না, শুধুমাত্র নাম ছাড়া ইসলামের আর কিছুই থাকবে না। সে সময় মসজিদগুলো ব্যস্ত থাকবে বড় বড় ইমারত নির্মাণের কাজে, কিন্তু তা পথ-নির্দেশ প্রদান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। সেখানে যারা থাকবে তারা পৃথিবীতে সবার চেয়ে নগণ্য বলে গণ্য হবে। তাদের থেকে অপকর্ম সাধিত হবে এবং সব বিভ্রান্তি তাদের দিকে ফিরে যাবে। যদি কেউ অপকর্ম থেকে ফিরে আসে, তারা তাকে অপকর্মের মধ্যে ঠেলে দেবে। হাদীস-এ কুদসীতে বলা হয়েছে: ‘আমি আমার সত্তার কসম করে বলছি যে, আমি তাদের উপর এমন অমঙ্গল অপতিত করবো যাতে ধৈর্যশীলরা হতভম্ব হয়ে পড়বে।’ অবহেলার কারণে এহেন অবস্থায় পতিত হওয়া থেকে আমরা আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করি।”

(নাহজুল বালাগা)

 

১৪০০ বছর পূর্বের এ ভবিষ্যৎবাণী আজও আমাদের রপ্ত হয়নি। আমরা হয়তো রত আছি লোক দেখানো অনুষ্ঠান পালন আর নাম ধারনে। আমরা নৈতিকতার বয়ান বহনে ভারী আনন্দিত অথচ মোটেও আনন্দ পাই না সত্য কাজে। আমরা যতটা সতর্ক বেদনার কারণ হিসেবে নৈতিকতার অভাবকে হাজির করতে ঠিক ততটা সতর্ক নই নৈতিকতা হীনতার আসল বুনিয়াদি কারণ অনুসন্ধানে। আমরা ফেরকার মধ্যে ফাঁক খুঁজি প্রাচুর্যের তথা সম্পত্তির মালিক হওয়ার। অথচ পাঠ করি না, ‘আত্ তাকাসুর’ অথবা ‘আল হোমাযা’। আমরা মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে বার বার স্মরণ করিয়ে দিই না-

“আধিক্য লাভের পরস্পর প্রতিযোগিতা তোমাদিগকে উদাসীন করিয়া দেয়,

যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা কবরে পৌঁছ।

কখনও নহে, অচিরেই তোমরা জানিতে পারিবে।

পুনরায় বলিতেছি! কখনও নহে, অচিরেই তোমরা জানিতে পারিবে।

কখনও নহে, হায়! যদি তোমরা জ্ঞান-ভিত্তিক বিশ্বাস মূলে জানিতে;

নিশ্চয় তোমরা (এই পার্থিব জীবনে) জাহান্নামকে দেখিবে।

(আত্ তাকাসুর)

আর আমরা ব্যাখ্যা করিনা--

“ধনার্জনের অদম্য পিপাসা এবং অর্থ, প্রতিপত্তি ও সম্মান বৃদ্ধিতে একে অন্যকে ছাড়াইয়া যাইবার জন্য পারস্পারিক তীব্র প্রতিযোগিতা মানুষের সকল অনিষ্টের মূল করণ। কেননা ইহা মানুষের উচ্চ মূল্যবোধ সমূহকে নিষ্পেষিত করে কিম্বা অবহেলার মধ্যে ফেলিয়া দেয়। মানুষের জন্য ইহা একটি দুর্ভাগ্য যে, পার্থিব বস্তু সমূহ আহরণের উগ্র বাসনার কোন সীমা নাই। যতই পাওয়া যায়, বাসনা ততই তীব্রতর হয়, কখনও চরিতার্থ হয় না।...

আমরা জন সম্মুখে বার বার ভাষণে স্মরণ করে দিই না--

“আফসোস সেই সব কুৎসা রটনাকারীদের প্রতি যাহারা মানুষের পশ্চাতে কুৎসা রটনা করে আর সম্মুখে অপবাদ দেয়,

আর আফসোস তাদের প্রতি যাহারা ধন-সম্পদ আহরণ করে, পুঞ্জিভুত করে, আর গুণে গুণে দেখে।

আর ভরসা করে যে, এই সম্পদ তাহাকে অমর করবে,

ককখ্নো নহে, বরং সে হুতামায় নিক্ষিপ্ত হইবে,

জান, হুতামা কি?

হুতামা সেই প্রজ্বলিত আগুন

যাহা তোমার অন্তর সমূহের গভীরে গিয়ে পৌঁছিবে।

এবং নিশ্চয় সে আগুনকে তোমাদের উপর চতুর্দিক হইতে বন্ধ করিয়া দেওয়া হইবে,

সুদীর্ঘ স্তম্ভ সমুহে।

(আল হোমাযা)

আমরা খুৎবায় দাঁড়িয়ে পুনঃ পুনঃ স্মরণ করিয়ে দিই না প্রাচুর্য ও জ্ঞানের নিয়তি সম্বন্ধে--

অর্থাৎ, ‘দুই ধরনের লোভ দুনিয়ায় অতৃপ্ত থাকে

এক. সম্পদের লোভ

দুই. জ্ঞানের লোভ

যে সম্পদের পেছনে ছোটে সে সম্পদের পাহারাদার হয় আর যে জ্ঞানের পেছনে দৌঁড়ায় জ্ঞান তার পাহারাদার হয়।’

হে মানুষ! কোন পথ তুমি গ্রহণ করবে?

২৯ সেপ্টেম্বর ০৯, যশোর।

 

ভাবনামা : ১৩

নারদের সম্পত্তি জ্ঞান

নারদ যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করিলেন-

বল, এ জগৎ সংসারে তুমি কতটুকু সম্পত্তির মালিক হতে পার?

যুধিষ্ঠির বলিল,

যতটুকু আমি অর্জন করিতে পারি।

নারদ বলিলেন,

না, বরং তুমি অতটুকু সম্পত্তির মালিক হতে পারবে

‘যে পরিমান ধনাদিতে নিজের ভরণ-পোষণ হয়,

তাবন্মাত্রেই দেহীদিগের স্বত্ব।

যে তাহার অতিরিক্ত ধন-সম্পত্তির অভিলাষ করে সে চৌর ;

সে দন্ড পাইবার যোগ্য।’

 

ও নারদ! হয়তো তুমিই সত্য হবে একদিন--

কিন্তু এখন সত্য তোমার জুধিষ্ঠির।

সুত্র: ভা: ৭/১৪/৮

ঢাকা; ১৩ জানুয়ারি, ১০

 

ভাবনামা : ১৬

হযরত আলীর সম্পত্তি

আলী তাঁর দুই পুত্রকে ওছিয়ত করিলেন

হে, খলিফার পুত্রদ্বয় হাসান এবং হোসেন, জেনো;

তোমরা ঐ সম্পত্তির মালিক--

যে অনাবাদী পতিত জমিন তোমাদের স্বীয় শ্রমে

আবাদী হয়েছে।

আর ঐ জমিনে স্বীয় শ্রমে উৎপাদিত ফসলের

অতটুকুর মালিক তোমরা

যতটুকু এই ওয়াক্তের আহার নিমিত্তে প্রয়োজন।

আর উদ্বৃত্ত অন্যের

কেননা, জমিন তোমরা সৃষ্টি করনি।

 

ও গো! শান্তির নীড় নির্মাতা আলী-

তোমার ওছিয়ত নামায় শিক্ত কলিজার টুকরাদ্বয়

শহীদ হয়েছেন অনেক আগেই-

আর সেই থেকে তোমার নির্মিত নীড় যে

দখলে রেখেছে হত্যাকারিরা!

কিন্তু তোমার উম্মতরা ওছিয়ত করছে

হে হায়দার-

সম্পত্তি সম্পর্কীয় তোমার অভিমতই সুন্দর।

সুত্র: নাহ্জুল বালাগা

ঢাকা: ১৩ জানুয়ারি ১০

 

ভাবনামা : ১৭

রসুলের সম্পত্তি

কে না জানে!

জগৎ সংসারে শান্তি প্রতিষ্ঠায়

ধনীপত্নি খাদিজার সম্পত্তি

দু’হাতে বিলায়ে মোস্তফা হয়ে উঠলেন রসুল মোহাম্মদ।

আর এও তো ইতিহাস-

মৃত্যু কালে মোহাম্মদ স্ত্রী আয়েশা কে শুধাইলেন-

কী আছে ঘরে সম্পদ বলে?

আয়েশা বলিলেন,

কয়েকটি স্বর্ণ মুদ্রা।

রসুল বলিলেন,

তাহলে তা এখনই দরিদ্র পরিবারকে দিয়ে দাও

কেননা, রোজ হাসরে ওগুলো হাতে রেখে আমার প্রভুর সঙ্গে

মিলিত হওয়া সংগত হবে না।

ও আমার প্রসংশিত রসুল!

এ কি লজ্জ্বার কথা যে-

তোমার পোষাকী ভক্তরা আজ কোটি-কোটি, কোটিরও কোটি

স্বর্ণ মুদ্রার মালিক!

তুমি কি তাদের জন্যও সাফায়েত করবে হাসরে?

আর যদি না করো এত দোজখ আল্লা পাবে কোথায়?

বরং তুমি আল্লাকে বল:

ওদের হেদায়েত করতে

নতুবা অভিশপ্ত মৃর্তুর দারস্ত হতে।

সুত্র: আবদুল ওদুদ

ঢাকা: ১৩ জানুয়ারি ১০

 

ভাবনামা : ১৯

কোরাণ ও সম্পত্তি

পবীত্র কিতাবে মাবুদ বলছেন--

‘আধিক্য লাভের পরস্পর প্রতিযোগীতা

তোমাদেরকে উদাসীন করে দেয়,

যতক্ষন পর্যন্ত না তোমরা কবরে পৌঁছ।

... নিশ্চয় তোমরা (এই পার্থিব জীবনে) জাহান্নামকে দেখবে।

 

ও গো! মাবুদ নিরাকার,

কী নিক্ষুত অংক তোমার।

আধিক্য লাভের প্রতিযোগীতা

এ জগতকে করেছে জাহান্নাম।

ইরাক-আফগানিস্তান-প্যালেস্টাইন-পাকিস্তান

গোটা মধ্যপ্রাচ্য, গোয়ান্তানামবে তথা

সমগ্র জাহান।

 

কিতাব আরো বলছে--

‘... আফসোস তাদের প্রতি

যারা সম্পদ আহরণ করে, পুজ্ঞিভূত করে,

আর গুনে গুনে দেখে;

আর ভরসা করে যে,

এই সম্পদ তাকে অমর করবে,

কক্খনো না,

বরং সে হুতামায় নিক্ষিপ্ত হবে।

ও গো! প্রভু নিরঞ্জণ

ওরা আজও বোঝেনি তা;

সম্পদ তাদের ভরসা দিতে পারেনি।

তাইতো এত আক্রমন, এত রক্ত,মৃত্যু, আহাজারি, হাহাকার

তবুও তারা নিরাপদ না।

জগতের সবচেয়ে ঋণগ্রস্থ আর

নিরাপত্তাহীন জাতি তারা...

ঢাকা : ১৩ জানুয়রী ১০

 

ভাবনামা : ২২

অঙ্গ যে কারণে পূজ্য

সাধক কমাল কহিলেন--

‘আসলে তো মন্ত্র ও উপদেশ বলে মুখ ও জিহবা।

তবু মানুষ তো বলে না আমি মুখের ও জিহবার শিষ্য।

 

মুখ ও জিহবা যে গুরুর,

সেই পরিপূর্ণ গুরুরই পরিচয় সাধক দেয়।

ভিন্ন ভিন্ন মানুষের মধ্যে যে আমরা গুরুকে পাই

তাহাও তাঁহারা সেই পরমত্মা সর্বময় মহাগুরুর অঙ্গস্বরূপ বলিয়াই।

 

এই ক্ষেত্রেইবা কেন আমরা

পরমাত্মাকেই গুরু না বলিব?

গুরু এক তিনিই।

এঁরা সবাই তাঁরই অঙ্গ,

তাঁরই নিয়োজনে নিয়োজিত।’

 

মনরে মানো-

জগতের তাবত অস্তিত্ব

গুরুর অঙ্গ,

তাই, অঙ্গবিনে গুরু নেই

আবার গুরুবিনেও অঙ্গ নেই;

এ কারণেই--

অঙ্গ আয়াত, অঙ্গ নিদর্শন।

অঙ্গ পঠিত হয়, অঙ্গ কোরান।

অঙ্গ উপাশ্য, অঙ্গ পূজ্য।

 ঢাকা : ১৪ জানুয়ারি ১০


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।