অভিযুক্ত জাওয়ানদের ন্যায়বিচারই ভবিষ্যতে অনাকাক্ষিত ঘটনার আশঙ্কা রোধ করতে পারে


আজ পিলখানার বিডিআর বিদ্রোহের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। গতকাল, অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখে বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যদের বিচার শুরু হয়েছে। বসেছে বিশেষ আদালত-৫। ঢাকা সেক্টরের অধীনে যেসব বিডিআর ছিলেন এবং বিদ্রোহে অভিযুক্ত, তাদের বিচার হবে সেই দরবার হলেই-- যেখানে রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। দুপুর বারোটায় বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মইনুল ইসলাম চৌধুরী বিচারের কাজ শুরু করেছেন। এখানে শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই যে, ২৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রধানমন্ত্রী যেসব বিডিআর জাওয়ান বিদ্রোহ করেছে তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। বর্তমান বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্যে এই ‘সাধারণ ক্ষমা’-র অবস্থান বা ভূমিকা কোথায় তা এখনো পরিষ্কার নয়। ইতোমধ্যে ঢাকার বাইরের বিচার শুরু হয়ে গিয়েছে আগেই। যেমন, রাঙ্গামাটিতে ২৪ নভেম্বর (২০০৯), সাতক্ষীরায় ৭ ডিসেম্বর (২০০৯), ফেনীতে ২০ ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখে ইত্যাদি।

এটাও মনে রাখা দরকার যে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর বিডিআর জাওয়ানরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশমতো অস্ত্র জমা দেওয়ার পর তাদের চোখ বেঁধে অজানা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। বিদ্রোহী বিডিআরদের পিলখানার অন্য জাওয়ানদের কাছ থেকে আলাদা করা হয়। যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে তাদের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এই সময় বিডিআর জাওয়ানদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’সহ অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও নির্যাতনে বিডিআর জাওয়ানদের মৃত্যুতে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে সেই অভিযোগের তদন্তের দাবি করেছে। ‘অধিকার’-এর জানুয়ারি ২০১০ সালের বাৎসরিক রিপোর্ট দিয়েছে। ফলে এই বিষয়গুলো বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন নাই। অধিকার বলেছে, তাদের হিশাব মতে ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫১ জন বিডিআর মারা গিয়েছেন। এদের মধ্যে ২৬ জন মারা গিয়েছেন যখন তাঁরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ছিলেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারে এই খবরগুলো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ভয়াবহতাই প্রমাণ করে।

ন্যায়বিচারের দিক থেকে একটি প্রশ্ন এখন থেকেই যাবে যে নির্যাতনে যাঁরা মারা গিয়েছেন তাঁদের সাক্ষ্য ছাড়া এখন ইনসাফ কায়েম আদৌ সম্ভব হবে কি না। দ্বিতীয়ত, জাওয়ানদের বিরুদ্ধে তাদের স্বীকারোক্তিকে আদালত ব্যবহার করছে। আইনের দিক থেকে সেই স্বীকারোক্তির অবস্থা কী? নির্যাতনে যদি এতজন জাওয়ানকে মেরে ফেলা হয়ে থাকে তাহলে এই ধরনের স্বীকারোক্তি আদায় করতে কী পরিমাণ নির্যাতন করা হয়েছে আমরা তা অনায়াসেই আন্দাজ করতে পারি।

অনেক পত্রিকা বিডিআর বিদ্রোহের এক বছর পূর্তিকে আখ্যায়িত করছে ‘কলঙ্কিত অধ্যায়’ হিশাবে। কিন্তু কলঙ্কটা কার বা কাদের সেটা বলছে না। এটা কি সেনাবাহিনীর? বিডিআরের জাওয়ানদের? নাকি ক্ষমতাসীন শাসক ও শোষক শ্রেণীর? আমি আওয়ামী লীগকে একটি দল হিশাবে অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকছি। আওয়ামী লীগের আমলেই এই দুঃসহ ঘটনাটি ঘটেছে। বিডিআরের সঙ্কট একা আওয়ামী লীগের তৈরি নয়। এক-এগারের ঘটনা ঘটানোর মধ্য দিয়ে এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নিজেরাই তৈরি করেছেন। সাবেক সেনাপ্রধান মইন উদ্দিন আহমেদ সেনাপ্রধান হতে পেরেছিলেন জোট সরকারেরই আনুকূল্যে। তিনি যে রাষ্ট্রটির স্বার্থ রক্ষার জন্য এক-এগারোর ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, সেটা শুরুতে স্পষ্ট না থাকলেও, ঘটনা ঘটানোর পরপরই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ক্রমে দিনের আলোর মতোই ফর্শা হয়ে গিয়েছিল আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কার বোঁচকা এই বাঙালি জাতীয়তাবাদী সেনাপতি বহন করতে এসেছেন। শেখ হাসিনা সঙ্গত কারণেই তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন, এখনো করছেন, ভবিষ্যতেও করবেন। আওয়ামী লীগের নেতা হিশাবে এটাই তো তাঁর করবার কথা। তাই না?

রাজনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির বর্তমান দুর্দশার প্রধান কারণ হচ্ছে বিএনপি জিয়াউর রহমানের পর কখনই রাজনীতি করেনি, এখনো করে না। এই দলটি আজ অবধি জিয়াউর রহমানের পুঁজি ভেঙেই খেয়েছে, এখনো তাই করে যেতে পারবে ভাবছে। শাসক ও শোষক শ্রেণীর দলকেও নিজ শ্রেণীর নেতৃত্বে বহাল থাকবার জন্য কিছু না কিছু নীতি, আদর্শ বা নিদেনপক্ষে ন্যূনতম রাজনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান চর্চা করতে হয়। আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ চায় বলে দাবি করে। অন্তত জনগণকে তারা বোঝাতে পেরেছে নিদেনপক্ষে এই নীতিগুলোর প্রশ্নে তাদের একটা অবস্থান আছে। বিএনপির কী আছে? বিএনপি কেন রাজনীতি করে? আওয়ামী লীগের বিপক্ষ টিম হওয়াই কি তার সাধনা? ইসলাম প্রশ্নে বাংলাদেশকে ধর্মতাত্ত্বিক ও সাম্প্রদায়িক পরিমণ্ডলের বিপরীতে আরো অগ্রসর অবস্থানে নিয়ে যাওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের অর্জনের মধ্যে তাকে আত্মস্থ করবার একটা রাজনীতির প্রকট অভাব আছে বাংলাদেশে। ইসলাম নিছকই ধর্মতত্ত্ব নয়, গ্রিকো- খ্রিষ্টান ‘আধুনিকতা’-র বিপরীতে তারও বিশ্বসভায় অবদান রাখবার উপাদান ও সম্পদ রয়েছে। বাংলাদেশে সেই রাজনীতি দাঁড়িয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। যার ফল উপমহাদেশে ইতিবাচক হোত। কিন্তু সেটা হয়নি। আমাদের সমাজে এখন এক দিকে আছে সেকুলারিজমের নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ চালাবার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরির কায়কারবার আর একই প্রক্রিয়ায় অখণ্ড ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবার নিরন্তর সাধনা। ভাষা ও সংস্কৃতিকেন্দ্রিক বাঙালি সাম্প্রদায়িকতা এবং ফ্যাসিবাদের এখন এটাই একমাত্র রাজনৈতিক মর্মকথা। অন্য দিকে তারই বিরুদ্ধে নিষ্ফল প্রতিক্রিয়া হিশাবে নিজেদের শুধু বাংলাদেশকে মুসলমানদের রাষ্ট্র বানাবার ভয়ানক রাজনীতি। বাঙালি মুসলমানের বিপ্লবী চেতনার অভিমুখ বাংলাদেশকে মুসলমানদের রাষ্ট্র বানানোর মধ্যে নয়। বরং সিন্ধু অববাহিকায় গড়ে ওঠা সভ্যতা বা উপমহাদেশের ইতিহাস যে একই সঙ্গে ইসলামেরও ইতিহাস, সেই সত্য প্রথমে প্রতিষ্ঠা করা। ঔপনিবেশিকতা, সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ ও সকল ধরণের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল একাত্তরের যুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের মধ্য দিয়ে। সেটা হতে পারত যদি বাঙালি জাতীয়তাবাদ মানে যে ইসলামকে বাদ দিয়ে নয়, সেই কাণ্ডজ্ঞান কিম্বা ইসলাম কায়েম করা আর মুসলমানদের রাজত্ব কায়েম করার মধ্যে যে আকাশ-পাতাল ভেদ আছে, এই ন্যূনতম ধর্মশিক্ষাটুকু থাকা। কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।

আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্র আগে চাইত, এখন তার কণ্ঠে গ্লোবালাইজেশান আর ডিজিটালের আওয়াজ। আওয়ামী মার্কা সমাজতন্ত্রের প্রাচীন হুঙ্কার দিতে আওয়ামী লীগ এখন শরম পায়। এই দলটি কখনই গণতান্ত্রিক ছিল না বরং সমাজতন্ত্র, একদলীয় শাসন, ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার মিশেল দিয়ে যে অনুপান আওয়ামী লীগ তৈরি করে তাকে সংক্ষেপে ফ্যাসিবাদ বলে। তার বিস্তর নমুনা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আচরণ, এমনকি শেখ হাসিনার ভাষা, আচরণ এবং অঙ্গভঙ্গির মধ্যে স্পষ্ট। কিন্তু এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবার হিম্মত বর্তমান বিএনপির নাই। বিএনপির মনের বাসনা যে আওয়ামী লীগ দেশ চালাতে ব্যর্থ হলে, জিনিসপত্রের দাম বাড়বার কারণে জনগণ বিক্ষুব্ধ হলে বাংলাদেশের বিদেশী দূতাবাসগুলোই তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। কিন্তু সেটা হবে না।

এই অরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই বিএনপি রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যক্তিনির্ভর সম্পর্কচর্চার অধিক কিছু ভাবতে পারে না। যেমন, তাদের ধারণা হয়েছিল, নিজেদের বিচারপতি থাকলে এবং তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানিয়ে দিতে পারলেই নির্বাচনে জেতা যায়। কিম্বা নিজেদের লোকজন সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে রাখলে সেনাবাহিনী দলের অধীনস্থ থাকে। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক বা সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট ভূমিকা ছাড়া এবং নিঃশর্তে কবি-সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক কর্মীদের স্বাধীন বিকাশে সহায়তা না করে একটি দলের প্রাধান্য সমাজে বহাল রাখা যায়--এই অদ্ভুত অরাজনৈতিক চিন্তা নিয়েই বিএনপি রাজনীতি করে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বা জাতীয় কবিতা পরিষদ জাতীয় সংগঠনের সামনে বিশেষণ হিশাবে ‘আওয়ামী’ কথাটি নাই। কিন্তু এইগুলো একান্তই দলীয় সংগঠন। আওয়ামী লীগকে এই সংগঠনগুলো পরিচালনা করতে হয় না। আমাদের বয়াতিরা গান গায়, ‘একটা চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া জনম ভইরা ঘুরতে আছে’--এইগুলি এই ধরণের জনম ভইরা ঘুরতে থাকা আওয়ামী সংগঠন। ফ্যাসিবাদের ভিত্তি। এই ধরণের সংগঠন আওয়াম লীগের আধিপত্য বজায় রাখবার ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য এবং বিস্ময়কর ভূমিকা রাখে। আওয়ামি লীগকে প্রশংসা না করে উপায় কী?

এ কথাগুলো বলছি এ কারণে যে রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র থাকে, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতার উত্থানপতনের ব্যাখ্যা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দিয়ে হয় না। ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য যে ঐতিহাসিক পরিস্থিতির দরকার--আর্থ-সামাজিক অবস্থা, রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশ-পরিস্থিতিসহ--সব দিকে নজর রাখলেই বরং রাজনীতির গতিপ্রক্রিয়া বোঝা সহজ হয়, ঠিক তেমনি ষড়যন্ত্রের চরিত্রকেও শনাক্ত করা যায় অনায়াসে। বিডিআরের ঘটনা একটা ষড়যন্ত্র--রাজনীতির গতিপ্রক্রিয়া এই ধরণের অলস মস্তিষ্কের ঠুনকা কথা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।

ওপরের কারণগুলোর কথা বাদ দিয়ে আরো সংক্ষিপ্ত জায়গায় যদি আমরা নজর দিই। যেমন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অবস্থা। বিডিআরের ঘটনা ঘটেছে কিছু পরিস্থিতি আগেই তৈরি হয়ে ছিল বলেই। কয়েকটি দিকের প্রতি আমি পাঠকদের নজর ফেরাতে বলব। যেমন, সেনাবাহিনীর ঔপনিবেশিক কাঠামো। যার কারণে সাধারণ সৈনিক ও অফিসারদের মধ্যে একটি অনতিক্রম্য দূরত্ব সবসময় কাজ করে। সেই সব নিয়ে কমবেশি লেখালিখি হয়েছে। উনিশ শো পঁচাত্তর সালের সাতই নভেম্বরের সৈনিক বিদ্রোহ হয়েছিল। সৈনিক ও জনগণের মৈত্রীর মধ্য দিয়ে যার ইতিবাচক পরিসমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু বাংলাদেশের শাসক ও শোষক শ্রেণী সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় নি। অফিসার ও জওয়ানদের মধ্যে দূরত্ব রয়ে গিয়েছে--এই বাস্তবতা স্বীকার না করে উপায় নাই। সেই ইতিহাসে আমি আজ যাবো না। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ের দিকেই বরং পাঠকদের দৃষ্টি ফেরাতে বলব। সাধারণ ভাবে (১) সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বের প্রকট অবক্ষয় (২) সৈনিকের নৈতিকতার অবক্ষয় (৩) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ নীতি বাস্তবায়নের জন্য ‘শান্তি মিশনে’ অংশগ্রহণের নামে সেনাবাহিনীকে ভাড়াটিয়া সেনাবাহিনী হিশাবে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহারের কুফল এবং (৪) সৈনিকদের চিন্তাচেতনার বিকাশ ও একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের সৈনিক হিশাবে তার যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন তার অভাব। সেই ধরণের শিক্ষা দেবার ক্ষেত্রে চরম গাফিলতি।

পেশাদারিত্বের তর্ক নতুন কিছু নয়। মুক্তিযুদ্ধের পরে পাকিস্তান থেকে যেসব অফিসার ও সৈনিক বাংলাদেশে ফেরতে এসেছিলেন, তখন এই পেশাদারিত্বের তর্কটাই মুক্তিযোদ্ধা বনাম পাকিস্তান ফেরতিদের তর্ক হিশাবে সেনাবাহিনীকে দীর্ঘদিন অস্থিতিশীল করে রাখে। কেউ চেয়েছে মুক্তিযুদ্ধে ব্যক্তিগত অবদানই হবে সেনাবাহিনীতে পদোন্নতির মানদণ্ড, আর কেউ সেটা অস্বীকার করেছেন। অনেকেই পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু অধিকাংশই পাকিস্তান থেকে নানা কারণে পালাতে সক্ষম হন নি। তার মানে এই নয় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তাঁদের কোনো অনুগত্য ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তর্কের জায়গাটা এখানেই কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়ায়, পেশাদারিত্বের প্রশ্ন--যার ওপর প্রতিষ্ঠান হিশাবে সেনাবাহিনীর শক্তি নির্ভর করে--সেই দিকটা সব সময়ই অস্পষ্ট বা ধোঁয়াশা হয়ে রয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে যাদের প্রতি সন্দেহ ছিল তাদের বাদ দিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে পেশাদারিত্বের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা ছিল সঠিক কাজ। কিন্তু সেটা হয়নি। এর জন্য শুধু দেশকে নয়, সেনাবাহিনীকেও কম মূল্য দিতে হয়নি।

ফলে নানা সময়ে সেনাবিদ্রোহের পেছনে মুক্তিযোদ্ধা বনাম পাকিস্তান ফেরতিদের বিরোধ উপাদান হিশাবে কাজ করেছে। এর জন্য বহু সৈনিক ও সেনাকর্মকর্তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ হয়েছে অসাধারণ বীরত্ব দেখিয়ে, অকুতোভয় সাহসে মুক্তিযুদ্ধে যেসব সৈনিক জীবন বাজি রেখে লড়েছিলেন, যাঁদের অবদানে এই বাংলাদেশ--স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁদেরকেও ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁদের কর্মকাণ্ড বা ভূমিকা ঠিক কি বেঠিক সেই বিচার আমার বর্তমান আলোচনার জন্য অবান্তর। আমার বক্তব্য সোজা--সৈনিকতা একটি পেশা। যদি সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিশাবে গণতান্ত্রিক সংবিধানের অধীনস্থ রেখে শাসক ও শোষক শ্রেণী ইতিবাচক অর্থে দেশ পরিচালনা করতে চায়, তাহলে তাদের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে সেনাবাহিনীতে প্রতিটি সৈনিকের মূল্যায়ন একমাত্র কঠোর পেশাদারিত্বের মানদণ্ডেই নির্ধারণ করা। অন্য কোনো ভাবে নয়। যখনি দলবাজি চর্চার আরম্ভ সেই দিন থেকে পেশাদারিত্বের অবক্ষয়ও শুরু হয়েছে। সেনাবাহিনী হয়ে উঠেছে দলীয় রাজনীতির হাতিয়ার। রাজনৈতিক দলগুলো চেয়েছে সেনাবাহিনী হবে তাদের দলের পেটোয়া বাহিনী। তাদের ক্ষমতায় রাখবার জন্য, জনগণের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ, লুণ্ঠন অব্যাহত রাখার জন্য তাদের দলীয় পাহারাদার। সৈনিক হিশাবে এর প্রতিরোধ করবার নৈতিক শক্তি সেনাকর্মকর্তাদের ছিল না বলেই আজ সেনাবাহিনীর বর্তমান দুর্দশা।

সৈনিকের নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটে প্রথমে দুর্নীতিতে। সারা বাংলাদেশ যদি দুর্নীতির সাগরে ভেসে থাকে সেনাবাহিনী, বিশেষত সেনাকর্মকর্তারা দুর্নীতিমুক্ত--এটা ভাববার কোনোই কারণ নাই। অর্থনৈতিক দুর্নীতির চেয়েও সেনাবাহিনীর নৈতিক অবক্ষয় শুরু হয়েছে যখন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যবহার শুরু হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থে। কিম্বা যখন তাদের ব্যবহার হয়েছে নতুন রাজনৈতিক দল বানাবার কাজে। সম্প্রতি আমরা দেখলাম সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভাবে কারো বিরুদ্ধে একটা কিছু অভিযোগ দেখিয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে অকথ্য নির্যাতন করেছে--বাংলাদেশেও একই কায়দায় নির্যাতন চলেছে। সেনাবাহিনী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত র‌্যাপিড একশন ব্যাটেলিয়নে থেকে আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছে। পিটিয়ে প্রকাশ্যে মানুষ মারবার নজিরও রেখেছে সেনাবাহিনী। সৈনিকতার প্রথম ও অলঙ্ঘনীয় নীতি হচ্ছে নিরস্ত্রের বিরুদ্ধে কোনো অস্ত্র প্রয়োগ বা জবরদস্তি না করা। নিজের হেফজতে যদি কেউ থাকে তার ওপর অত্যাচার সৈনিককে নিম্ন শ্রেণীর ক্রিমিনালে পরিণত করে। সৈনিক হিশাবে এই সকল অতি সাধারণ শিক্ষা থেকে সেনাবাহিনীকে বিচ্যুত করা হয়েছে। নিরস্ত্র ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন এবং অনেক সময় হত্যা করা মানবাধিকারের প্রশ্ন শুধু আমি তুলছি না, তুলছি সৈনিকতার প্রশ্ন, সৈনিকের মর্যাদার প্রশ্ন। সৈনিকের জন্য যা অবমাননাকর সেই সকল বীভৎস কর্মকাণ্ডে সৈনিককে খাটানো। সৈনিকদের অমর্যাদাকর কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়েছে। এই সব মারাত্মক নৈতিক অবক্ষয়ের মূল্য দিতে হবে সেনাবাহিনীকে।

এই সব প্রশ্ন তুলছি এই কারণে যে, যাঁরা মূল সঙ্কট চিহ্নিত না করে ঢালাওভাবে সৈনিকের বিরুদ্ধে সৈনিকতার মর্যাদার বিরুদ্ধে এবং সেনা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়ান-- তাঁদের সঙ্গে আমার চিন্তার পার্থক ধরিয়ে দেবার জন্য। তাঁদের অবস্থান আমি সন্দেহ করি। তাঁরা চান আমাদের কেনো নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থা না থাক। আমরা সেনাবাহিনীকে রক্ষীবাহিনী-জাতীয় একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করি আর আমাদের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করুক ভারত। অবশ্য আমাদের সীমান্ত এখন কার্যত তো পাহারা দিচ্ছে বিএসএফ। তাদের রাজনীতিই কি সেনাবাহিনী শেষমেশ বাস্তবায়িত করেনি?

বাংলাদেশ গরিব দেশ। ফলে তার পক্ষে সৈনিকের আর্থ-সামাজিক প্রয়োজন মেটানো সম্ভব নয়। শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ একটি আদর্শিক বিষয় হতেই পারে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি বাস্তবায়নের অংশ হিশাবে শান্তি মিশনে অংশগ্রহণের মূল উদ্দেশ্য সৈনিকতার আদর্শ কিম্বা একটি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রতি আনুগত্য নয়। বরং তার বিপরীত। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সৈনিককে ভাড়াটিয়া সৈন্যে পরিণত করা--নিজের দেশের প্রতি আনুগত্য নয়, বরং অর্থের প্রতি আনুগত্য বাড়িয়ে তোলা। দেশ এবং আন্তর্জাতিকতার ভেদরেখা বিলুপ্ত করে দিয়ে সৈনিকদের আন্তর্জাতিক যুদ্ধের ময়দানে ভাড়াটিয়া তৈরি করার এই প্রক্রিয়া বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ উভয়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়েছে।

শুধু বিদেশের কথা কেন বলি? পাঠকের হয়তো মনে থাকতে পারে যে বিডিআর জাওয়ানদের মুদি দোকানের দোকানদার বানাবার বিরুদ্ধে আমি ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছিলাম। পেশাদারিত্বের দিক থেকে এর চেয়ে খারাপ কিছু হতে পারে না। এখন বলা হচ্ছে ডাল-ভাত কর্মসূচির অধীনে বিডিআর জাওয়ানদের ব্যবহার থেকেই বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটেছে। তাহলে এই দায় কে নেবে? সেনাবাহিনী নিজে? এরপর রয়েছে প্রশিক্ষণ--চিন্তাচেতনার বিকাশের অভাব। বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে সেনাকর্মকর্তাদের সামগ্রিক ধারণার অভাব রয়েছে। একটি সুশৃঙ্খল সশস্ত্র সংগঠন পরিচালনা করা আর রাজনীতি করা যে এক কথা নয়, এই বোধটুকু অধিকাংশেরই নাই। এর জন্য অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে আমাদের।

বিডিআর বিদ্রোহের কয়েকটি দিক রয়েছে। সামনের সারির ৭৪ জন সেনাকর্মকর্তা এই বিদ্রোহে নিহত হয়েছেন। আমি একে কিলিং মিশন বলেছিলাম। কারণ ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড মনে হয়েছে আমার, বিদ্রোহের ক্ষয়ক্ষতি মনে হয় নি। আমি ভুল কি ঠিক ইতিহাস একদিন তা প্রমাণ করবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, জাওয়ানদের বিদ্রোহের কোনো ন্যায়সঙ্গত কারণ ছিল না। এটা নিছকই হত্যার একটি মিশন এটা ভাববার কোনো কারণ নাই। ভাবতে কষ্ট হয়, এই ক্ষতি কোনো যুদ্ধে হয় নি, জাওয়ানদের বিদ্রোহই এই অপূরণীয় ক্ষতি ঘটালো। যেভাবে সেনাকর্মকর্তা এবং তাঁদের পরিবারকে হত্যা করা হয়েছে এবং একই সঙ্গে যেসকল রোমহর্ষক ঘটনাবলি ঘটেছে তাতে আমাদের নীতিনৈতিকতা বোধ গভীরভাবে আহত হয়েছে। মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের দুই বছরের সেনাশাসনের কারণে সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের যে ক্ষোভ জমেছিল, তার কারণে বিদ্রোহের প্রতি এক ধরণের গণসমর্থন ছিল শুরুতে। কিন্তু এই ঘৃণ্য অপরাধগুলো বিদ্রোহের চরিত্রকে নামিয়ে আনে নিছকই অপরাধের পর্যায়ে। আওয়ামী লীগের পক্ষে বিদ্রোহ দমনও সহজ হয়।

বিচার যখন শুরু হয়েছে তখন ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই প্রথম কাজ। সুনির্দিষ্ট অপরাধের বিচার ছাড়া বিদ্রোহের জন্য যদি প্রধানমন্ত্রী জাওয়ানদের ক্ষমা করে থাকেন তাহলে সেই ক্ষমতার বাস্তবায়ন আমরা দেখতে চাই। সেনাবাহিনীকে জাতীয় স্বার্থে উদার হতে হবে, কারণ আজ বাংলাদেশ অরক্ষিত এবং আমরা ভয়ানক বিপদের মধ্যে আছি। মনে রাখতে হবে, হেফাজতে থাকা অবস্থায় অভিযুক্ত বিডিআর জাওয়ানদের মৃত্যু জনগণ স্বাভাবিক ভাবে নেয়নি। আন্তর্জাতিক ভাবেও নির্যাতন ও হেফাজতে হত্যা নানান প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বাইরে থেকে একে প্রতিশোধ হিশাবে দেখেছে অনেকে। অন্য দিকে জওয়ানরা যেহেতু গরিব, ফলে পুরো বিষয়টা সেনাকর্মকর্তা বনাম গরিব জাওয়ানদের বিরোধ বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে। এখন বিচারের ফল যা-ই হোক এই অবিশ্বসাটুকু নিয়ে আমাদের থাকতে হবে। উপায় নাই। পথ খুঁজতে হবে কিভাবে ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনীকে সত্যিকারের গণমুখী কিন্তু পেশাদার সেনাবাহিনীতে পরিণত করা যায়। বলাবাহুল্য সেটা শাসক ও শোষক শ্রেণীর অধীনে সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলের পাহারাদার হয়ে নয়, জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্ষার সঙ্গে সংগতি প্রকাশের মধ্য দিয়েই সৈনিকতার মর্যাদা আবার প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যাঁরা মঙ্গল চান, আশা করি তাঁরা আমার কথা বুঝবেন। অভিযুক্ত জাওয়ানদের ন্যায়বিচারই ভবিষ্যতে অনাকাক্ষিত ঘটনার আশঙ্কা রোধ করতে পারে।

১২ ফাল্গুন ১৪১৬। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০। শ্যামলী।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।