বর্তমান বিদ্যুৎ ঘাটতি, উৎপাদন ও বিতরণ অব্যবস্থাপনা


বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার মাত্র চল্লিশ শতাংশ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতাভূক্ত-- প্রতি একশ জনে চল্লিশ জন বিদ্যুৎ ভোগ করেন, গড়ে প্রতি জন ভোগ করেন ১৪০ ইউনিট বিদ্যুৎ। এমন পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগ মুহূর্তে জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল-- ২০১১ সালের মধ্যে ৫ হাজার মেগাওয়াট, ২০১৩ সালের মধ্যে ৭ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০২১ সালের মধ্যে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। কিন্তু সরকার সম্প্রতি বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের জন্য শুধু কয়েকটি কোম্পানির সাথে চুক্তি করা ছাড়া নিজের জায়াগায় দাঁড়িয়ে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে এখনো পর্যন্ত বিশেষ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে নাই। সরকার যথেষ্ঠ সময়ও পেয়েছে। কারণ গুরুতর এই জাতীয় সংকট মোকাবেলায় প্রাথমিকভাবে কিছু ফলাফল হাতেনাতে তুলে দিতে একটি দক্ষ ও সদিচ্ছা সম্পন্ন সরকারের জন্য ১৫ মাস মোটেও খুব কম সময় নয়। অন্যদিকে সংকটের তীব্রতা কমে আসারও কোনো আলামত এখনো সাধারণ মানুষ দেখতে পাচ্ছে না। সংকটের তীব্রতা হ্রাস না পেয়ে বরং তা আরো বেড়েছে।

বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে সরকারের উদ্যোগ ও বাস্তবতা

পদক্ষেপ নেয়ার অংশ হিশাবে চাহিদা ও সরবরাহ নির্ধারণেও সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নাই, দেশীয় পর্যাপ্ত দক্ষ লোক থাকা সত্ত্বেও বিদেশী পরামর্শক নিয়োগের মাধ্যমে অর্থের অপচয়, আর্থিক সুবিধা গ্রহণের উদ্দেশ্যে বিতরণ লাইনের ভারসাম্যহীন বিস্তার, পিএমএমপির লঙ্ঘন, প্ল্যান্টের আকার, প্রকৃতি ও স্থান নির্ধারণ নিয়ে রাজনীতিকরণ করা ছাড়াও বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়, প্ল্যান্ট স্থাপনে নিম্ন মানের যন্ত্রপাতির ব্যবহার সহ দুর্নীতি পুরা বিদ্যুৎ খাতকে ধ্বংস করেছে। ফলে সরকার বিদ্যুৎ খাতকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ কাজের কাজ না করে বিদ্যুৎ ঘাটতির জন্য বর্তমান সরকারও যথারীতি বিগত সরকারের কার্যক্রমকে দায়ী করছে।

লোডশেডিং মুক্ত দেশ গড়তে বর্তমান সরকার যে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে সময়মতো তার বাস্তবায়ন অনিশ্চতায় পড়তে পারে। এদিকে বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি সংকটও তীব্র হচ্ছে। জাতীয় উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার ২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে লোডশেডিংমুক্ত করার যে ঘোষণা দিয়েছে, সে বিষয়েও সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের পর থেকে দেশে কোনো লোডশেডিং হবে না। এই সময়ের মধ্যে ৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এর জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৪১ হাজার কোটি টাকা। মহাপরিকল্পনায় বছর ভিত্তিক বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে পার্থক্য চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, চলতি বছর চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে পার্থক্য অর্থাৎ ঘাটতি ১ হাজার ৭৫০ মেগাওয়াট। ২০১০ সালে ঘাটতি হবে ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। ২০১১ সালের পার্থক্য ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। ২০১২ সালে ১ হাজার ৮৫০ মেগাওয়াট। ২০১৩ সালে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট এবং ২০১৪ সালে ঘাটতি হবে ১ হাজার ৭৫০ মেগাওয়াট। কিন্তু যদি গ্যাস না পাওয়া যায় তাহলে ২০১৪ সালে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ হাজার মেগাওয়াট।

সরকার নতুন কেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সাশ্রয়েও বড় পরিকল্পনা হাতে নেয়। সে অনুযায়ী চলতি মাসের প্রথমার্ধের মধ্যে দুটি পর্যায়ে সারা দেশের গ্রাহকদের মধ্যে বিনামূল্যে মোট দুই কোটি ৬৫ লাখ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাল্ব বিতরণ করার কথা ছিল। এতে প্রায় ৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে বলে সরকারিভাবে জানানো হয়। বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে সরকার বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাল্ব বিনামূল্যে বিতরণের যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে তা অবশ্যই সুফল বয়ে আনতো। শুধু ঢাকা শহরের রাস্তার বাতিগুলোর পরিবর্তে এই এলইডি বাল্ব ব্যবহারেও দৈনিক ১১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় সম্ভব। কিন্তু এই উদ্যোগও আপাতত কার্যকর হচ্ছে না।

জরুরি ভিত্তিতে ঘাটতি মোকাবেলায় বর্তমান সরকারের প্রথম পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ হলো বেসরকারি খাতে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন। যদিও বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ই এ ধরনের কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার কয়েকটি ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের পদক্ষেপও নেয়। তবুও বর্তমান সরকার জরুরি ভিত্তিতে মোট ৫৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আটটি ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় নয় মাস পর।

ইতিমধ্যে সেচ মৌসুম কাছে চলে আসায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, চার মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য ডিজেলচালিত কয়েকটি ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। বাকিগুলো হবে ফার্নেস তেলচালিত। ডিজেলচালিত কেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে প্রায় ১৫ টাকা, যা ফার্নেস তেলচালিত কেন্দ্রের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। তার পরও জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। কিন্তু চলতি সেচ মৌসুমে এর এক ইউনিট বিদ্যুৎও পাওয়া যাচ্ছে না। দেশীয় উদ্যোক্তারা মনে করছেন, বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ দ্রুত না করে সরকার বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলায় ভাড়াভিত্তিক ছোট ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর যে পরিকল্পনা করছে তাতে বিদ্যুত সমস্যা কাটবে না। দেশীয় প্রযুক্তিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে বর্তমান সংকটের সমাধান সম্ভব। অন্যথায় এ সংকট আরো বাড়বে।

বাংলাদেশে আজ বিদ্যুতের যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তার গোড়ার কারণ হলো এ দেশে কখনো সমন্বিত এনার্জি বা জ্বালানি নিরাপত্তা, নীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় নাই। এ পর্যন্ত যা হয়েছে তা বিচ্ছিন্নভাবে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও জ্বালানি বিভাগের কাজের মধ্যে কোনো সমন্বয় নাই। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমান প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের কাছাকাছি। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা না হলে তা ৭ শতাংশে চলে যেত। প্রবৃদ্ধির এই হার ধরে রাখতে হলে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

এ বিষয়ে আরো পড়ুন:

১.বাংলাদেশে জ্বালানি সংকট: ধরন ও উত্তরণের উপায়

২.জ্বালানি সংকট



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।